১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর। বাঙালি তখনও জানে না বিজয় দরজায় দাড়িয়ে। তবে, সকলেই নিশ্চিত। কারণ, মুক্তিবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় তখন ভূলুণ্ঠিত পাকহানাদারের দল। তাদের আর লুকিয়ে থাকার উপায় নেই, যুদ্ধ করারও সামর্থ্যেও তারা দুর্বল। আর তাই বাঙালি জাতির জন্য এই দিনটিও স্মরণীয়।
১১ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে যশোরের টাউনহল ময়দানে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । সেই জনসভায় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের পালাতে দেওয়া হবে না। তাদের পালাবার পথ বন্ধ করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এদিন স্থল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশ বেতারে বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর সেনাপতিদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি প্রচার করেন।
ভারতীয় জেনারেল মানেকশ পাকবাহিনীকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন- ‘খবরদার এরকম চেষ্টা করবেন না। যদি করেন আপনাদের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো তো ধ্বংস হবেই, সেই সঙ্গে আপনাদের সৈন্যরাও মারা যাবে।’ অন্যদিকে পাকি জেনারেল রাও ফারমান আলি হুশিয়ারি শুনে বার্তা দেন। বলেন, ‘আমি সৈনিকদের জীবন বাঁচাতে চাই।’
এই দিনেই জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘ সদর দফতরে জরুরি বার্তা পাঠান। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির এ প্রস্তাব মেনে নিতে জোর দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিন হোয়াইট হাউজের একজন মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক।
একাত্তরের এই দিনে জামালপুর ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট ও বাহাদুরবাদ ঘাটসহ মুক্ত হয় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ছয় দিনব্যাপী অবরোধ ও প্রচণ্ড যুদ্ধের পর এদিন ভোরে জামালপুর হানাদারমুক্ত হয়। জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনী ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ছয় জন কর্মকর্তা ও ৫২২ জন সেনা যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। হানাদেরদের মধ্যে নিহত হন ২১২ জন, আর আহত হন ২০০ জন।
এদিন মুক্ত যশোরের জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলো- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২৫ মার্চের আগের মালিককে সম্পত্তি ফেরত দান, সব নাগরিকের সমঅধিকার এবং চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ। সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন এক সংবাদ সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউসে বলেন, ‘আমরা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করব, যা ২৪ বছরে পাকিস্তান করতে পারেনি।’
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি হানাদার ঘাতকদের পরাজয় যখন সুনিশ্চিত, তখন মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে রওনা দেয়। এদিন ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজির কাছে এক বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানান, মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। চীনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিন বিকেল ৩টা থেকে ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকার প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার চার পাশে মিত্রবাহিনী নির্দিষ্ট এলাকায় রাতে ছত্রীসেনা অবতরণ করায়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বীরবিক্রমে ঢাকা অভিমুখে এগিয়ে আসে।
১১ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার থেকে প্রকাশিত জনগণের উদ্দেশে এক নির্দেশনায় বলা হয়, ‘ওই খুনিগুলোকে (ধরা পড়া বা সারেন্ডার করা পাকিস্তানি সৈন্য) তোমরা মেরে ফেলো না, মুক্তিবাহিনীর হাতে ওদের হস্তান্তর করো। হয়তো ওদের বিনিময়ে আমরা জাতির পিতাকে উদ্ধার করতে পারব।’
মুজিবনগর সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তাঞ্চলের জনগণের কাছে ধরা পড়া হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে জনগণ ‘জয়বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে হস্তাস্তর করে। এ দিন ঢাকার উপকণ্ঠে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনার অবতরণ এবং বিভিন্ন এলাকায় ছত্রীসেনাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। হানাদার পাকিস্তানিদের ফ্ল্যাগ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাও ফরমান আলীর উদ্দেশে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ অস্ত্র সম্বরণ ও আত্মসমর্পণ করার শেষ শেষ সুযোগটুকু গ্রহণের আহ্বান জানান।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
নতুন সরকার বাজেট ঘোষণা জাতীয় সংসদ
মন্তব্য করুন