কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসাকে ব্যবহার করছে বলে অনেকের ধারণা। রোহিঙ্গারা যদি এখনই ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে আরসার আধিপত্য বিস্তৃত হবে। এতে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস দুর্বল হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি গভর্ন্যান্সের ফেলো অধ্যাপক মো. শহীদুল হক।
বৃহস্পতিবার (০৯ ডিসেম্বর) রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাবিষয়ক এক ওয়েবিনারে শহীদুল হক এ মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ, গাম্বিয়া ও ব্রাসেলসভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘নো পিস উইদাউট জাস্টিস’ যৌথভাবে এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রাষ্ট্রপক্ষগুলোর ২০তম সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে এই আলোচনার আয়োজন করা হয়। আলোচনায় সঞ্চালনা করেন নো পিস উইদাউট জাস্টিসের পরিচালক অ্যালিসন স্মিথ।
কক্সবাজারের পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারের সরকারের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের মনোভাব প্রসঙ্গে শহীদুল হক বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রায় এক বছরের এই সময়কালে দেখা যাচ্ছে যে সন্ত্রাসী ও অপরাধী গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গা শিবিরে যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা পাহাড় থেকে নেমে আসছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের।
শুধু বাংলাদেশের নয়, অনেকের ধারণা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শিবিরে অস্থিতিশীলতার জন্য আরসাকে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের নির্বাসিত গোষ্ঠীগুলো আরসার বিরুদ্ধে যে বিবৃতি দিয়েছে, সে জন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। এটা আরও আগেই তাদের করা উচিত ছিল। কারণ, আরসার বিরুদ্ধে এখনই ঐক্যবদ্ধ না হলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।’
রোহিঙ্গা সংকট বৈশ্বিক ভূরাজনীতির ফাঁদে আটকা পড়েছে কি না, এমন এক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করতে গিয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ আইসিসি, আইসিজে ও আইআইএমএমে গেছে বলে সমস্যা সমাধানে আমি আশাবাদী। কখনো কখনো ভূরাজনীতির প্রসঙ্গটি বিভ্রান্তিকর। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ দেখেছে চীন, ভারতের পাশাপাশি আসিয়ানভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো এ বিষয়টির মানবিক ও সমাধানের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখেছে। বাংলাদেশ যখন আইসিসি ও আইসিজেতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন তারা আন্তর্জাতিক আদালতে না যেতে চাপ দিচ্ছিল। রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা আইসিজেতে নেওয়ার জন্য গাম্বিয়াকে তাদের উদারতার জন্য ধন্যবাদ জানাই।’
কানাডায় বসবাসরত রোহিঙ্গা মানবাধিকারকর্মী ইয়াসমিন উল্লাহ বলেন, মিয়ানমারে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে ভবিষ্যতে সেখানে গণহত্যার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, এই নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বিচার যে প্রক্রিয়া রয়েছে, তাতে আদালতের নির্দেশনা মাঠে অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, সেটা দেখার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। আবার আইসিসির যে প্রক্রিয়া, সেখানেও দ্রুত কিছু ঘটছে না। আইসিসি আরও তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কাজ করছে, যার মানে এতে সময় লাগবে।
রোহিঙ্গা শিবিরের বর্তমান পরিস্থিতি সহায়ক নয় উল্লেখ করে ইয়াসমিন উল্লাহ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য স্থানে বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী ও দারিদ্র্যের সুযোগ নেয় অপরাধী গোষ্ঠীগুলো। আরসার উপস্থিতি অস্বীকার করছি না। এখন আরসার উত্থানের নেপথ্যে কী ঘটছে, সেটা নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি।
ইয়াসমিন উল্লাহ বলেন, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক অধিকার গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার এখন চরম বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারা যথেষ্ট কিছু করেনি। কারণ, এখন পর্যন্ত দেশে জাতিগত বিদ্বেষ অব্যাহত আছে। ফলে এনইউজির জবাবদিহি নিশ্চিত করার একটা ব্যবস্থা থাকা জরুরি। তাই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে চাই।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বার্মা রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশনের সভাপতি তুন খিন বলেন, দুই বছর পেরিয়ে গেলেও মিয়ানমার আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশ মানেনি। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কারণে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সেখানে এখনো গণহত্যা সংগঠিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন পর্যন্ত যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি বলে মিয়ানমারে বিচারহীনতার সংস্কৃতি অব্যাহত আছে। এটি বন্ধ করতে হলে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ দিতে হবে।
মিয়ানমারের বিকল্প সরকার বা জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) ভূমিকাকে প্রবাসী রোহিঙ্গারা কীভাবে মূল্যায়ন করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তুন খিন বলেন, ‘অন্যদের চেয়ে তারা প্রগতিশীল। তবে অন্তর্ভুক্তির কথা বলার সময় আমরা শুধু রোহিঙ্গাদের অধিকারের কথাই বলছি না। আমরা দেশের সব নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অধিকারের কথা বলছি। তাই তাদের অতীতে যেতে হবে। অতীতে যদি না তাকান, তবে তাঁরা ভবিষ্যতের দিকে কীভাবে পা বাড়াবেন। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি তাঁরা কীভাবে দেবেন, সেটা তাঁদের স্পষ্ট করতে হবে। তাঁরা সামরিক সরকারের করা ’৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কী করবেন, সেটাও বলতে হবে। কারণ, আইনটি সেনাশাসনের সময় তৈরি। কাজেই এনইউজিকে অনেক কিছু করতে হবে।’
সূচনা বক্তৃতায় গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হোসেন টমাস বলেন, ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা গণহত্যার পুনরাবৃত্তি রোধে আইসিজে দুই বছর আগে সর্বসম্মতভাবে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা মেনে মিয়ানমার এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি। তাই মিয়ানমার যাতে আদালতের নির্দেশনা মেনে চলে, এ জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে চাপ দিতে হবে। মিয়ানমারের ওপর নিরাপত্তা পরিষদের শক্তি প্রয়োগ করাটা জরুরি।