তৎকালীন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কেড়ে নিয়েছিল অনেক তাজা প্রাণ। স্বজন হারিয়ে বিচার পাওয়ার আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন নিহতদের পরিবার। তাই ওসি প্রদীপের হাতে নির্যাতিত ও হত্যা হওয়া স্বজনদের পরিবারের একটাই চাওয়া সঠিক বিচার যেন হয়।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন বখতিয়ার আহমেদ। তাকে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই রাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যান টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। পরে টেকনাফের স্থলবন্দর এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বখতিয়ার নিহত হওয়ার খবর জানায় পুলিশ।
বখতিয়ারের ছেলে হেলাল উদ্দিন জানান, তার বাবা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হলেও ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস পাননি। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান খুনের মামলায় প্রদীপসহ ১৫ আসামির সাজার রায় হওয়ায় এখন আশাবাদী হেলাল উদ্দিন। বাবার হত্যার বিচারের জন্য মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
হেলাল উদ্দিন বলেন, সিনহার হত্যার মতো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলে প্রদীপের ‘ক্রসফায়ার’-বাণিজ্যের ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসবে। তার বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘর থেকে ১৪-১৫ লাখ টাকা ছিল, সেগুলো নিয়ে যান প্রদীপ। ওই টাকাটা ছিল বাজার ইজারার।
হেলাল উদ্দিনের মতো টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের অনেকের স্বজনেরা বিচার পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। সিনহা হত্যার দেড় বছরের মাথায় গত সোমবার মামলার রায় হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো সাহস পাচ্ছে, বিচার চাইতে শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত, ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় যোগ দেন ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর। চার দিনের মাথায়, ২৪ অক্টোবর পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মফিজ আলম (৩২)। সিনহা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগপর্যন্ত প্রায় দুই বছর টেকনাফে প্রদীপের কর্মকালে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহত হন ১৪৪ জন।
সিনহা হত্যা মামলায় র্যাবের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, অপরাধকর্মের জন্য পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নিজস্ব একটি ‘পেটোয়া ও সন্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন ওসি প্রদীপ। তার চাহিদামতো টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানো ও বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে মানুষ খুন করতেন।
সিনহা হত্যার পর ওসি প্রদীপের ক্রসফায়ার-বাণিজ্যের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। একে একে মুখ খুলতে শুরু করেন অনেকে। এরপর প্রদীপসহ তার সহযোগী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কক্সবাজারে ১২টি, চট্টগ্রামে ২টিসহ ১৪টি মামলা হয়। কিন্তু সিনহা হত্যা মামলার তদন্ত যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়েছে, এসব মামলার ক্ষেত্রে সেটা দেখা যায়নি। এসব মামলা তদন্ত করছে পুলিশ। এরই মধ্যে কক্সবাজারের ১২টির মধ্যে ৩টিতে প্রদীপসহ আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্তে কিছু পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। বাকি নয়টি এখনো তদন্তাধীন।
এসব তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হাছানুজ্জামা বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিতে হবে। এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।
দুই ভাইকে চট্টগ্রাম থেকে ‘হত্যা’
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়ন থেকে দুই ভাইকে ধরে নিয়ে টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগে মামলা হয় ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম আদালতে। প্রদীপসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যকে এতে আসামি করা হয়।
আমানুল হক ও আজাদুল হক দুই ভাই ছিলেন চন্দনাইশের ফকিরপাড়া গ্রামের আমিনুল হকের ছেলে। আজাদুল হক প্রবাসী। আমানুল হক এলাকায় পেয়ারা চাষ করতেন। আজাদ বিদেশ থেকে এসেছেন জানতে পেরে চাঁদার জন্য টেকনাফ থানার পুলিশ তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এর মধ্যে আমানুলকে ১৩ জুলাই সন্ধ্যা সাতটার দিকে এবং আজাদকে ১৫ জুলাই বেলা দুইটার দিকে ধরে নিয়ে যায় বলে পরিবারের অভিযোগ। ১৬ জুলাই কক্সবাজার সরকারি হাসপাতালে দুই ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন স্বজনেরা। তখন পুলিশ বলেছিল, টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে দুজন নিহত হন।
চট্টগ্রামে মামলার করার আগে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন নিহতের বোন জিনাত সুলতানা। তিনি বলেন, দেড় বছরের মধ্যে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সিনহা হত্যায় প্রদীপসহ অন্য আসামিদের সাজা হতে পারলে আমার দুই ভাই কী দোষ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। গরিব বলে আমাদের মামলার তদন্ত কি থেমে থাকবে?
তিনি দাবি করেন, আমার ভাইদের যে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়, সিসিটিভির ফুটেজ রয়েছে। ওসি প্রদীপ আট লাখ টাকা দাবি করেন। নইলে ক্রসফায়ার দেওয়ার হুমকি দেন। অনেক চেষ্টা করেও এত টাকা জোগাড় করতে পারিনি। পরে দুই ভাইয়ের লাশ পাই।
কক্সবাজারের মামলাটি তদন্ত করছেন উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাকিল আহমেদ। তদন্তের অগ্রগতি জানতে একাধিকবার তার মুঠোফোনে কল করেও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।
মামলার বাদী জানান, তারা মামলার বিষয়ে কোনো কিছু জানতে পারেননি। এ ছাড়া চট্টগ্রামে করা মামলাটি আদেশের জন্য রয়েছে।
এক পরিবারের তিনজনকে হত্যা
সিনহা হত্যার আগের মাসে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের এক পরিবারের তিনজনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে।
প্রদীপ কারাগারে যাওয়ার পর ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট এই ঘটনায় মামলা করেন নিহতদের একজন ছৈয়দ আলমের স্ত্রী সুলতানা রাবিয়া। তার অভিযোগ, ওই বছরের ৬ মে রাতে ছৈয়দ আলম, তাঁর ভাই নুরুল আলম ও ভাগনে আবদুল মোনাফকে ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে তুলে নেওয়া হয়। তখন তাঁদের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছিল। টাকা না দেওয়ায় বাড়ির পাশের পাহাড়ের নিচে বন্দুকযুদ্ধের ‘নাটক সাজিয়ে’ গুলি করে তিনজনকে হত্যা করা হয়। খুনের পর বাড়াবাড়ি করলে অথবা আইনের আশ্রয় নিলে প্রাণনাশেরও হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন সুলতানা রাবিয়া।
তিনি বলেন, সিনহা হত্যার মতো তার স্বামী, ভাই ও ভাগনে হত্যার বিচার চান।
একইভাবে টেকনাফের জিয়াউর রহমান, ইউসুফ জালাল, সাইফুল করিম, সাদ্দাম হোসেন, আবদুল জলিল, মুছা আকবরসহ বন্দুকযুদ্ধে নিহতের স্বজনেরা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে শাস্তি দাবি করেছেন। এ রকম ১০টি ভুক্তভোগী পরিবার এমন দাবির কথা বলেছে। তারা সবাই চায় ওসি প্রদীপের আগের অপরাধগুলো সামনে আসুক, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার হোক।
প্রদীপ বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে। তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তার আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত বলেন, ইয়াবা ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কারণে অনেকে প্রদীপের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। তারাই প্রদীপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে একের পর এক মামলা করছেন।
তবে কক্সবাজারের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতে, সিনহা হত্যা মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে টেকনাফে বিচারবহির্ভূত হত্যার অন্তত একটা ঘটনার প্রমাণ মিলেছে। তাই অন্য অভিযোগগুলোর বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত এখন সময়ের দাবি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কক্সবাজার জেলার সহসভাপতি অজিত দাশ বলেন, কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে নিরীহ মানুষ যাতে আর কক্সবাজারে খুন না হয়, সে জন্য সিনহা হত্যার মতো সব ঘটনার নিরপেক্ষ ও যথাযথ তদন্ত হতে হবে।