রাজধানীতে জাল-জালিয়াতি করে ভূমি দখল এবং এসব ভূমিতে আবাসন প্রকল্প করে সাধারণ মানষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভূমি জবরদখলের প্রতারকচক্র। এই চক্রটি সরকারের কাছ থেকে লিজ নেওয়া এক শহীদ বুদ্ধিজীবি পরিবারের জমিও দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে- যে জমিটি বরাদ্দ দিয়েছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা ও দালালের সহযোগিতায় জাল দলিল এবং অন্যান্য ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে সরকারের অর্পিত (‘ক’ তালিকাভুক্ত) ও অধিগ্রহণকৃত জমিও দখল করে নিচ্ছে এসব প্রতারক চক্র। এই চক্রের সদস্যরা কখনো মৃত মানুষকে জীবিত করছে; আবার কখনো অস্তিত্বহীন ব্যক্তিকে মালিক সাজিয়ে সাধারণ মানুষের জমি ভুয়া কাগজপত্র করে লিখে নিয়ে জবরদখল করছে।
সূত্র জানায়, ভূমি অফিসের অসাধু কিছু কর্মকর্তার সহযোগীতায় জমির মালিকের ছবি পাল্টে বালাম বইয়ের মূল পাতাও গায়েব করে দিচ্ছে এই চক্রটি। মূল নথিপত্র গায়েব করার অভিযোগও রয়েছে এই চক্রটির বিরুদ্ধে। এছাড়াও সন্দেহ এড়াতে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ভুয়া নম্বর সংযুক্ত করে জাতীয় পরিচয় পত্রের মূল সার্ভারেও সংযুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। পাল্টে ফেলছে আদালতের আদেশ ও ডিক্রিও। এছাড়া শুধু জমি দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের জাল দলিল ধরিয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কাগজপত্র সবই ভুয়া, জাল।
এছাড়াও, এ প্রতারক চক্রকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দিচ্ছেন কিছু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। এই চক্রের সাথে ভূমি ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিভাগের কিছু কর্মকর্তাও জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও দুদকের জালে ধরা পড়লেও দমানো যাচ্ছে না এই চক্রের দৌরাত্ম্য। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশ ও বাংলা ইনসাইডারের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই প্রতারকচক্রের একটি বাস্তবচিত্র।
অর্পিত সম্পত্তির গেজেট ও পুলিশ সূত্র জানায়, এসএ রেকর্ড অনুযায়ী পুরান ঢাকার নবাবপুরের ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৬৬৪ অযুতাংশ সম্পত্তির মালিক গোপীনাথ বসাক। স্বাধীনতার অনেক আগেই সপরিবারে ভারত চলে যান গোপীনাথ। তিনি কিংবা তার পরিবার আর ফেরেননি। এর পর ওই সম্পত্তি অর্পিত ‘ক’ তালিকাভুক্ত করে সরকার। সর্বশেষ এই জমি লিজ হিসেবে বরাদ্দ পান আজহারুল হক খান নামে এক ব্যক্তি। এর পর লিজ নবায়নে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। আবেদনটি বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় জমিটি জবরদখল করেন স্থানীয় প্রভাবশালী জাবেদ উদ্দিন শেখ, মো. জাকির উদ্দিন ও তাদের সহযোগীরা।
সূত্র জানায়, জাবেদ একজন ভূমিদস্যু, সে প্রতারক, তার পুরোটাই জালিয়াতি। এই সম্পত্তির মূল মালিক সরকার- যা ১/১ খতিয়ান-এর অন্তর্ভূক্ত।
এদিকে এ ঘটনা তদন্ত করে আদালতে দুদক যে চার্জশিট দিয়েছে, তাতে উঠে এসেছে জালিয়াতির নানা নমুনা। তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন।
দুদকের চার্জশিটে বলা হয়েছে, গোপীনাথ বসাক ও তার পরিবারের কোনো সদস্য আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাদের জমি ফেরত চাননি। এই তথ্য জানতে পেরে জাবেদ উদ্দিন ওই সম্পত্তি আত্মসাতে ‘অদৃশ্য’ গোপীনাথ বসাককে দাতা দেখিয়ে শ্রী ননী গোপাল বসাকের নামে তৎকালীন জয়দেবপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল (নং-৪০৩২) তৈরি করেন। পরে আরেকটি জাল কাগজ বানিয়ে ননী গোপাল বসাককে মৃত দেখানো হয়। এরপর ননী গোপালের ছেলে দাবি করে তপন কুমার বসাককে জমির ওয়ারিশ হিসেবে সামনে আনা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুদুকের মামলার আসামিরা আদালতে তপন কুমার বসাকের একটি মৃত্যু সনদপত্র এবং তার ওয়ারিশান সনদপত্র দাখিল করেছেন। তাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৪ নম্বর (সাবেক-৭০) ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্বাক্ষর রয়েছে। সনদপত্রের তারিখ দেওয়া আছে ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর।
মৃত্যুসনদে উল্লেখ করা হয়- তপন কুমার বসাক নবাবপুরের সাং-হালে ২২১ ও ২২২ নম্বরের স্থায়ী বাসিন্দা। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর- ২৬৯৬৮২৭৮২৪৮৪৪। তিনি ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট বার্ধ্যক্যজনিত কারণে নবাবপুরের নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অফিস সূত্রে জানা যায়, তপন কুমার বসাকের এনআইডি নম্বর (২৬৯৬৮২৭৮২৪৮৪৪) নির্বাচন কমিশন অফিসের মূল সার্ভারে আছে। কিন্তু ঠিকানা দেওয়া আছে- উত্তরার বাসাবো। হিন্দু হলেও তার এনআইডির ধর্মের অংশে লেখা মুসলিম। আর বাধ্যতামূলক হলেও সার্ভারে তপন কুমার বসাকের কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ চক্রটি জাল করে ওই এনআইডি নম্বর সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মামুন বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, ‘আমি কিংবা আমার দপ্তর থেকে কেউ তপন কুমার বসাকের নামে মৃত্যুসনদ বা তার ওয়ারিশানদের সনদ দেইনি। আদালতকে অন্ধকারে রাখতে কোনো চক্র জাল-জালিয়াতি করে হয়তো সনদগুলো বানিয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কথিত তপন কুমার বসাক বাদী হয়ে আদালতে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ মোকদ্দমা দায়ের করেন। কিন্তু রাজধানীর সুবজবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার ও বংশাল থানা পুলিশ জানায়, তপন কুমার বসাক নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। জাবেদ ও জাকির একটি প্রতারক চক্রের হোতা। চক্রটি জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে নবাবপুর রোডস্থ ২২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৩ তলা ভবনটি অবৈধভাবে দখল করেছে।
জাবেদ আদালতে ওই সম্পত্তির মালিকানা বিষয়ে যে দলিল দাখিল করেন, তা সম্পূর্ণ জাল। এ ছাড়া জাবেদ তার অনুকূলে একটি মামলার ডিক্রি রয়েছে বলে আদালতকে জানান। মূলত এই ডিক্রিটি নারায়নগঞ্জ জেলার একটি মামলা, এর সাথে এই জমির কোনো সম্পর্ক নেই। ঢাকার দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালত থেকে সেই মামলার নথি তুলে তাতেও গরমিল পাওয়া গেছে বলেও চার্জশিটে উল্লেখ করেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, শেখ মো. জাবেদ উদ্দিন ভুয়া কাগজপত্র করে একজন বুদ্ধিজীবি পরিবারের জমি দখল করেছেন। ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর অস্ত্রের মুখে তিনি এই বুদ্ধিজীবি পরিবারের লিজকৃত নবাবাপুরের বাড়ি দখল করেন। পরে সেই জমিতে নিজের স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন আর জমির মালিক হিসেবে দাবি করেন জনৈক তপন বসাককে। অথচ জমিটি শীহদ বুদ্ধিজীবি এটিএম শামসুল হক খানের পরিবারকে বরাদ্দ দিয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার এই কাজে সহযোগীতা করেন বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপ-কমিশনার মো. ইব্রাহীম খান। এ অবস্থার কোনো প্রতিকারও চাইতে পারেননি ভুক্তভোগীরা। এই জালিয়াতির সাথে যুক্ত রয়েছেন জয়দেবপুর সাব-রেজিষ্ট্রার অফিসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও।
ভুক্তভোগীরা জানান, ২০২২ সালের দিকে এই জাল-জালিয়াতির অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় জাবেদের বিরুদ্ধে প্রতারণার ১৯টি মামলা থাকায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি জামিন পেয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন- কিন্তু দুদকের মামলার গ্যাজেটে উল্লেখ রয়েছে, তিনি পলাতক। এখানেও জালিয়াতির আশ্রয়। সর্বোচ্চ আদালত এই ১৮৬৪ অযুতাংশ সম্পত্তি সরকারের পক্ষে স্টে অর্ডার দিয়েছেন এবং এই স্টে অর্ডারকে ভ্যাকেট করার জন্য সেই জাবেদ উদ্দিন তপন কুমার বসাকের নামে একটি দরখাস্তও করেন। সর্বোচ্চ আদালত কোনো কারণ খুঁজে না পাওয়ায় উক্ত দরখাস্তটি বাতিল করে দেন। এই জালিয়াতি চক্র থেকে রক্ষা পেতে সরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করছেন ভুক্তভোগী পরিবার।
জাল-জালিয়াতি বঙ্গবন্ধু বরাদ্দ জমি দখল প্রতারকচক্র
মন্তব্য করুন
সাবেক ভূমিমন্ত্রী দুর্নীতি দুদক সাইফুজ্জামান চৌধুরী
মন্তব্য করুন
মাহমুদা খানম মিতু পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
দুদক দুর্নীতি রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ সরকার টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা গ্রহণ করছে। গত ১১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে। এর আগে তিন মেয়াদে যারা বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রী ছিলেন এবং সরকারের ভিতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের অনেকেরই দায়িত্ব পালনের সময়টি স্বচ্ছতার ছিল না। তারা নিজেদেরকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারেননি। আর এ কারণেই তাদের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। গত তিন মেয়াদ এ রকম অন্তত এক ডজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই দুর্নীতির অভিযোগ এখন বিভিন্ন সংস্থাগুলো তদন্ত করছে।