সম্প্রতি বিএনপির এমপিদের পদত্যাগ করা ছয়টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই উপনির্বাচনে অন্যান্য আসনগুলোর ফলাফল নিয়ে বিতর্ক না হলেও বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ ছয়টি আসনের ভোটে অনিয়ম বা কারচুপির উল্লেখযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও দাবি করেছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, ‘ছয়টি আসনে ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে। ছয়টি আসনে ৪০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ৮৬৭টি ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে এবং ছয়টি আসনে ভোটার সংখ্যা ছিল ২২ লাখ ৫৪ হাজার ।’
সূত্রমতে, বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা রেজাউল করিম তানসেন বেসরকারিভাবে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি মশাল প্রতীকে ২০ হাজার ৪০৫ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম একতারা প্রতীকে পেয়েছেন ১৯ হাজর ৫৭১ ভোট। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচনে কারচুপি করা না হলেও ফলাফল নিয়ে কারচুপি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন পরাজিত প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। পরে এই প্রার্থীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই বলেও জানিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, খুব সহজেই সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন ইউটিউবার খ্যাত হিরো আলম। কিন্তু ভোটে তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। তিনি নির্বাচন চলাকালেও নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। পরে তিনি কার পরামর্শে, কাদের ইন্ধনে নির্বাচনে ফলাফল কারচুপি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন, সেটি খতিয়ে দেখা একান্ত জরুরী। এ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে হিরো আলমের চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তাছাড়া মিডিয়া এ ঘটনাটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অনেক বড় করে তুলেছে। অথচ এ ঘটনাটি নিতান্তই একটি তুচ্ছ ব্যাপার, মজার খোরাক।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, উপনির্বাচন নিয়ে এই বিতর্ক সৃষ্টি উপনির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই করা হচ্ছে। হাস্যরস করে তথাকথিত হিরো আলমকে সমাজের অশিক্ষিত নিম্নবর্গের মানুষজন উস্কানি দিতেই পারেন, তবে তার পেছনে বিরোধী কোনো ইন্ধনও থাকতে পারে বলেও মনে করছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক মহল। তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির মনোবাসনা পূর্ণ না হওয়ার যে মন্তব্য হিরো আলমকে নিয়ে করেছিলেন, তার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। যে কারণেই আজ রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) হিরো আলম চ্যালেঞ্জের তীর ছুড়ে দিয়েছেন তাঁর দিকে। অথচ হিরো আলমের পক্ষেও সাফাই গেয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফলে হিরো আলমকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ঘটনা ঘটেছে।
সূত্র জানায়, বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে পুনর্নির্বাচন দিয়ে সেখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ করেছেন মো. আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম। রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে হিরো আলম বগুড়া-৪ আসনের ৪৫টি কেন্দ্রের ভোট পুনর্গণনার জন্য বগুড়া জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের কাছে আবেদন জমা দেন।। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ওই মন্তব্য করেছেন।
ওবায়দুল কাদেরের উদ্দেশে হিরো আলম বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের স্যার কথায় কথায় বলেন, ‘খেলা হবে। শক্তিশালী দল হলে খেলা হবে।’ খেলা হওয়ার মতো নাকি তিনি শক্তিশালী খেলোয়াড় খুঁজে পান না। তাঁকে জোর গলায় বলতে চাই, শক্তিশালী দলের সঙ্গে আপনাকে খেলতে হবে না। যেখানে মিথ্যা কথা বলে আমার ফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে, সেই বগুড়া-৪ আসনের ভোটে আসুন, আমার সঙ্গে ভোট করে দেখুন। আপনি দল থেকে দাঁড়াবেন, আমি স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হব। কেন্দ্রে কেন্দ্রে সিসিটিভি থাকবে। ভোটারদের ভয় দেখানো হবে না। সুষ্ঠু ভোট দিয়ে দেখুন তো দেখি, খেলা হয় কি না?’
হিরো আলমের এমন বক্তব্যকে বিরোধী চক্রান্ত বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, ইউটিউবার খ্যাত সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন অসাংস্কৃতিক ব্যক্তি এ ধরনের মন্তব্য করার যে সাহস দেখিয়েছেন, তার পেছনে শক্তিশালী বিরোধী কোনো চক্রের ইন্ধন রয়েছে। দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সরকার বিরোধী অনেক সাংস্কৃতিক কর্মীই রয়েছেন। তারা কখনও এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কোনো মন্তব্য করেছেন বলে মনে পড়ে না।
এদিকে, আলোচিত ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলমের পর, বগুড়া-৪ (নন্দীগ্রাম-কাহালু) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনের ফল প্রত্যাখান করেছেন জাকের পার্টির প্রার্থীরা। রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বগুড়া প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ ঘোষণা দেন। জাকের পার্টির প্রার্থীরা হলেন; বগুড়া-৬ আসনের মোহাম্মদ ফয়সাল বিন শফিক সনি ও বগুড়া-৪ আসনের আলহাজ্ব আব্দুর রশিদ সরদার।
রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) এই সংবাদ সম্মেলনে জাকের পার্টির প্রার্থীরা বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি উপনির্বাচনের দিন কী ঘটেছে আপনারা দেখেছেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ও ইভিএম মেশিন নিয়ে যা হলো- তা দুঃখজনক। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ইভিএম মেশিনে ভোট প্রদান প্রশ্নবিদ্ধ। এটি হ্যাক করা যায়। এক মার্কায় ভোট দিলে অন্য মার্কায় চলে যাওয়াসহ কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনকালে সাধারণ ভোটাররা আমাদের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরেন। জাকের পার্টি বর্তমানে সুসংগঠিত ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল। বগুড়ায় জাকের পার্টি ও সহযোগী সংগঠন সমূহের সাংগঠনিক বিস্তৃতি ব্যাপক। দলীয় ভোটারও প্রচুর। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে আমাদের গোলাপ ফুল প্রার্থীদের স্বল্প ভোটের কোটায় রাখা হয়েছে।
এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউটিউবে কিংবা ফেসবুকে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় হিট বাড়ানোর জন্য অবান্তর মন্তব্য করে কিংবা কৌতুকপূর্ণ কথা বলে কন্টেন্ট ভাইরাল করা হয়ে থাকে। হিরো আলম এ ধরনের মন্তব্যে পটু। তিনি এসব করেই ফেসবুক এবং ইউটিউব থেকে অর্থ উপার্জন করে থাকেন। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যবসা থাকার কারণে ইউটিউবার এবং ফেসবুক প্লাটফর্ম ব্যবহারকারীরা এ ধরনের অবান্তর মন্তব্য করা লোকজনই খুঁজে বেড়ায়। বাংলাদেশের রাজনীতি সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর নয়। তবে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো এসব নিয়ে কেন এতো তোলপাড় করছে- তা বোধগম্য নয় এবং এর পিছনে বিরোধী কোনো ইন্দন রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এ ঘটনা নিয়ে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র বা তার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করতেই তৎপর বিরোধীরা। এখন শুধুই দেখার বিষয় এই ঘটনা এবং এই ঘটনা নিয়ে ষড়যন্ত্রের পথ কোন দিকে মোড় নেয়।