আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে এখন কেবলই বেজে ওঠছে ভাঙনের সুর। শরিক দলগুলোর অসন্তোষ থেকেই ১৪ দল থেকে শরিক দলগুলো একে একে সরে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র। সূত্রগুলো বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসন বণ্টনের দাবিতে সোচ্চার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরা। প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগেই বিষয়টি ‘ফয়সালা’র আশ্বাস দিলেও অন্য শরিকরা তাতে আস্থা পাচ্ছে না। মূলত গত দুই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তাদের অনাস্থা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। নির্বাচন এগিয়ে আসায় এই অনাস্থা জোটের ঐক্যে কিছুটা হলেও সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এদিকে ইতিমধ্যে জোটে নিষ্ক্রিয় রয়েছে শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ। ২০১৬ সালের ৯ মার্চ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ থেকে বেরিয়ে শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন একটি অংশ বাংলাদেশ জাসদ নামে আরেকটি দল গঠন করেছিল। যদিও এখন পর্যন্ত এ দলটি নিবন্ধন পায়নি। আরেক শরিক হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের যুক্তিতর্ক চলছে। জোটের শরিক অন্তত তিনটি বাম দল আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট। কিন্তু স্বতন্ত্র অবস্থান নেওয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তি না থাকায় তারা অসন্তোষ নিয়েই জোটে থাকছে। ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছেন।
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার জালে আটকে পড়ায় অস্বস্তিতে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের দুই শরিক দল- বিকল্পধারা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের শীর্ষ নেতারা। ফলে তাদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। এছাড়াও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ১৪ দল নিয়ে তাদের হতাশার কথা। যদিও সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া এক সময়ে ১৪ দলীয় জোটের হয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রাক্তন মন্ত্রীর প্রতি বর্তমান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর নির্লিপ্ততা তাকে হতাশ করেছে বলেও জানিয়েছে একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র।
২০১৬ সালের দিকেই শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ ১৪ দলীয় জোট ছাড়ে। পরে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ জাসদের দলীয় এক অনুষ্ঠানে দলটির সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, ‘আমরা ১৪ দলের কোনো কর্মসূচিতে যাই না। তবে এখনো জোট থেকে বের হয়ে যাইনি।’
সে সময়ে জোটে দলটির অবস্থানের বিষয়ে শরিফ নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই যাই না (কর্মসূচিতে)। ১৪ দল তো এখন শুধু দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচি পালন করে থাকে। অন্য কোনো ইস্যুতে তেমন আলাপ নেই। আওয়ামী লীগ যদি আলাপ না করতে চায়, তাহলে আমরা তো তাদের বাধ্য করতে পারব না। শুরুতে ১৪ দলের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। জোটটি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পেরেছে। এখন আর সে অবস্থা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বর্তমান সময়ের কর্মকাণ্ড জোটের হারমনির (ছন্দ) সঙ্গে যায় না। তাদের অনেকেই দুর্নীতিতে মগ্ন। সেক্যুলার রাজনীতি করার যে কষ্ট তা তারা করতে চায় না। এটা বঙ্গবন্ধু করেছেন। তিনি গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিজেদের মতাদর্শের পক্ষে পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু এখনকার আওয়ামী লীগ- তা চায় না। তারা চায় নানা সমীকরণ মিলিয়ে ক্ষমতায় থাকতে। তারা চায় নানা কিছু দখল করতে। কিন্তু মানুষকে পরিবর্তন করে নিজেদের পক্ষে আনার দিকে তারা নেই।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি ১৪ দলে না থাকার বিষয়ে রেজুলেশন পাস করেছে। ২৮ মার্চ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এখন থেকে বাংলাদেশ জাসদ আর ১৪ দলের শরিক নয়।’
১৪ দলে না থাকার সিদ্ধান্তের কথা জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুকে জানানো হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে নুরুল আম্বিয়া বলেন, ‘সেটার প্রয়োজন মনে করছি না।’
সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলগুলোকে নিয়ে জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই বছরই ২৩ দফা ঘোষণা দিয়ে ১৪ দলীয় জোটের যাত্রা শুরু হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ১১ দলীয় জোট মিলে এই জোট গঠিত হয়। কিন্তু জোট গঠনের পরপরই ১১ দল থেকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)সহ কয়েকটি দল বেরিয়ে যায়। কিন্তু জোটটি তখনও ১৪ দল নামেই বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেছিল। পরে ২০০৭ সালের এক-এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় জোটের শরিক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে ১৪ দল ছেড়ে না গেলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার প্রায় ১৩ বছরে আর কোনো দল আওয়ামী লীগের জোট ছেড়ে যায়নি। বরং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন জোটে যোগ দেয়।
জোটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরিক হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের সঙ্গেও বেশ টানাপড়েন চলছে আওয়ামী লীগের। ২০২১ সালের দিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু ও কর্নেল তাহের বাংলাদেশ বেতারে গিয়েছিলেন উল্লেখ করে এ হত্যাকাণ্ডে তাঁদেরও দায় আছে মন্তব্য করেছিলেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাও বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদের দায় আছে বলে মন্তব্য করেন।
আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকে নেতিবাচক সমালোচনা শুনে ক্ষুব্ধ জাসদের কেন্দ্রীয় নেতারা। তাঁরাও পাল্টা বক্তব্য দিচ্ছেন। সে সময়ে শেখ সেলিমের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে একটি বিবৃতিও দিয়েছিল জাসদ। দলটির দপ্তর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জাসদকে যুক্ত করে বক্তব্য প্রদানকারী শেখ সেলিম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁর আপন মামা বঙ্গবন্ধু ও আপন ভাই শেখ মনির লাশ ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে যুক্ত তৎকালীন আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে কী করেছিলেন, তা জাতি জানতে চায়।’
সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগ ও জাসদের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য জোটের মধ্যে অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ। দিবসভিত্তিক ভার্চুয়াল সভা-সেমিনার আয়োজন ছাড়া কার্যত নিষ্ক্রিয় ১৪ দলের এই দুই শরিকের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি বাড়তে থাকলে তার পরিণতি হতে পারে জোট ভাঙন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাসদের একজন নেতা জানান, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদের ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগ সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে জাসদকে সম্পৃক্ত করতে চাওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাঁরা তো আওয়ামী লীগের নেতাদের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে যান না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা এগুলো করতে চাইলে তা জোটের জন্য ক্ষতিকর হবে।
সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে ১৪ দলের বেশ কয়েকটি শরিক ক্ষুব্ধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির বিকল্প কোনো বড় রাজনৈতিক জোট না থাকায় তারা জোট ছাড়ছে না। আবার স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরির মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই বলে অনেকটা বাধ্য হয়েই জোটে থাকছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরিক একটি বাম দলের সাধারণ সম্পাদক জানান, জোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এখন আর ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চর্চা করছে না। তাঁরা উপেক্ষিত। কিন্তু জোট ছেড়ে কই যাবেন আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে গত ১৭ বছরে তেমন কোনো সাংগঠনিক লাভও হয়নি। সব মিলিয়ে দোটানায় আছেন তাঁরা।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে শরিক সব দলই আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী তালিকাও তৈরি করে ফেলেছে। কয়েকটি দল তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা তৈরির কাজ শেষও করে ফেলেছে। বেশিরভাগ দলই নিজস্ব প্রার্থী তালিকার পাশাপাশি দরকষাকষির জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাও করে রেখেছে। জয়লাভের সম্ভাবনা বিবেচনায় এনেই এসব তালিকা করা হচ্ছে বলে দাবি শরিক দলগুলোর নেতাদের। সব মিলিয়ে ১৪ দলের শরিকরা আগামী নির্বাচনে ৯০ থেকে ১০০টি আসনের নিশ্চয়তা চাইছে প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগের কাছে। গত নির্বাচনে ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে মাত্র ১৬টি আসনে ছাড় দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের শরিক সাম্যবাদী দলের (এমএল) সাধারণ সম্পাদক এবং সাবে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বাংলা ইনসাইডারকে বলেন, ‘আমাদের রাজনীতি করার, আমরা রাজনীতি করি। বিএনপি যখন জঙ্গিবাদের সাথে, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির সাথে আঁতাত করেছে। তারা বাংলা ভাইকে প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতিকরণ করেছে। বিএনপির ছত্রছায়ায় যখন সারাদেশে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের উত্থান হয়েছে, তখন বামপন্থীরা বাধ্য হয়েছিল আওয়ামী লীগের সাথে জোট করার জন্য। সেদিন বিএনপি যদি মৌলবাদীদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিতো, তাহলে তো আজকে এই পরিস্থিতি হতো না।’
এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে অসুন্তোষের ডালপালা ছাড়ানো নুতন কিছু নয়। মূলত সংসদীয় ভোটের রাজনীতির কারণেই জোট বা মহোজোট গড়েছিল আওয়ামী লীগ। সেখানে আসন বণ্টনের একটি ব্যবস্থা ইতিপূর্বেও করা হয়েছিল। যেসব দলগুলো জোট থেকে বের হয়ে যাবার, তারা বের হয়েছে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু জোটকেন্দ্রীক নির্বাচন ছিল, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এর আগেও শরিক দলগুলোকে বিভিন্ন আসন ছেড়ে দিয়েছিল। আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে আগামী নির্বাচনেও হয়তো শরিক দলগুলোর জন্য আসন ছেড়ে দিবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী যদি এককভাবে নির্বাচনে যায়, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। আর যদি জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে যায়, তাহলে অবশ্যই আলোচনা হবে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ কী করে এবং তার প্রেক্ষিতে শরিক দলগুলো কি সিদ্ধান্ত নেয়।