সম্প্রতি সারাদেশের জেলা, উপজেলায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব সম্মেলনের পর জেলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের নতুন করে কমিটিও ঘোষণা করছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু স্থানীয় নেতাদের প্রভাব বিস্তার, আর্থিক লেনদেন, আত্মীয়করণ এবং যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে এসব নব গঠিত জেলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিগুলোতে স্থান করে নিচ্ছেন স্থানীয় বিতর্কিত ব্যক্তিরা। ফলে কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের ত্যাগী, দুঃসময়ের কাণ্ডারি এবং পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা। আর্থিক লেনদেন, স্থানীয় প্রভাব বিস্তার, আত্মীয়করণ ও যথাযথ মূল্যায়নের অভাবে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের এসব নব গঠিত কমিটিতে স্থান পেয়েছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্য, রাজাকার পরিবারের সদস্যসহ দীর্ঘদিনের আওয়ামী লীগ বিরোধী হাইব্রিট আওয়ামী লীগ এবং স্থানীয় বিতর্কিত ব্যক্তিরা। সম্প্রতি বাংলা ইনসাইডারের এক অনুসন্ধানে এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
কেইস স্টাডি: পিরোজপুর জেলা
সম্প্রতি পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত কমিটি অনুমোদন করা হয়েছে। গত ১৮ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত ৭৪ সদস্য বিশিষ্ট এই নতুন কিমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। উক্ত কমিটিতে আলহাজ্ব এ কে এম এ আউয়ালকে সভাপতি এবং অ্যাড. কানাই লাল বিশ্বাসকে সাধারণ সম্পাদক করে এই নতুন কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন এই জেলা কমিটি অনুমোদন হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় জেলা আওয়ামী লীগে তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বিরাজ করছে।
অভিযোগ ওঠেছে, ঘোষিত এই নতুন কমিটি- সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল রাজাকার-যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সন্তান ও তাদের বংশধর, বিতর্কিত ব্যক্তি এবং তার ব্যক্তিগত অনুসারী ও আত্মীয়-স্বজন দিয়ে পূর্ণ করেছেন। ফলে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত এবং ত্যাগী নেতা-কর্মীরাও কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন। মূলত সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল নতুন কমিটিকে ‘আউয়াল লীগ’এ পরিণত করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ জুন পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের এই কমিটি অনুমোদন করা হলেও সম্মেলন হয় গত বছরের ২৭ নভেম্বর। অর্থাৎ ৭ মাস পর এই কমিটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। ঘোষিত এই কমিটি নিয়ে জেলার আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে- যার প্রতিক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের দোকান- এমনকি রাস্তাঘাটেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঘোষিত কমিটিতে সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল এর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ব্যক্তিগত অনুসারী, যুদ্ধাপরাধী রাজাকারের সন্তান, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, কিন্তু অর্থ ব্যয়ে পদ পেতে সক্ষম- এমন ব্যক্তি ও বিতর্কিতদের স্থান দেওয়া হয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ ওঠেছে। আউয়াল পরিবারের অনুগত না হওয়ায় কারণে ঘোষিত নতুন কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরীক্ষিত অনেকেই।
সম্প্রতি বাংলা ইনসাইডারের এক অনুসন্ধানে জানা গেছে,পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের ঘোষিত নতুন কিমিটির সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ৫টি দুর্নীতির মামলার আসামি। এর মধ্যে তিনটি মামলায় ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে দুদক। মামলার বিচার কাজও শুরু হয়েছে। যে কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদীয় আসনে নির্বাচনের জন্য তিনি মনোনয়ন পাননি।
নতুন কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এই নতুন কমিটিতে সহ-সভাপতি হিসেবে স্থান পেয়েছেন যুদ্ধাপরাধী রাজাকার মোবারক আলী খানের পুত্র অ্যাড. মো. আলাউদ্দিন খান। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধীতাকারী এবং দেশ স্বাধীন হবার পর ২ বছর কারাগারে ছিলেন রাজাকার মোবারক আলী খান। প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক পদ পেয়েছেন অ্যাড. মো. শহিদুল হক পান্না। তার বাবা ফজলুল হক খান ছিলেন যুদ্ধাপরাধী। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে থেকে সরকারি চাকরি করেছেন তিনি। ভান্ডারিয়ার কুখ্যাত রাজাকার মজিদ জমাদ্দার, আশরাফ তালুকদার, নুরুল হক গংদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন অ্যাড. মো. শহিদুল হক পান্নার বাবা ফজলুল হক খান। দেশ স্বাধীনের পরে দীর্ঘদিন পলাতক ছিল ফজলুল হক খান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর, তিনি আনন্দ উচ্ছ্বাস করে মিষ্টি বিতরণসহ মিলাদ পড়িয়েছিলেন। তার পরিবারের ও আত্মীয়-স্বজনেরা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডার এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ লিখিতভাবে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পান্নার ফটো দিয়ে, যুদ্ধাপরাধীর পুত্র কিভাবে সরকারি আইনজীবী হয়েছিল- তা জানতে চেয়েও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
এ হলো আওয়ামী লীগের নীতিবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগে পদায়নের নমুনা। এছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে এ কে এম এ আউয়াল আত্মীয়করণ এবং বিরাজনীতিকরণ করেছেন স্বেচ্ছাচারিতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
কমিটি অনুযায়ী, নতুন কমিটিতে ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন মো. জাকির হোসেন খান। তিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের সম্পর্কে ভাতিজা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন মো. ফজলুল হক সেন্টু। তিনি কখনোই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেননি। মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামী লীগ বিরোধী কট্টর চীনপন্থী নকশাল বাহিনীর সদস্য ছিলেন তিনি। বাগেরহাটে রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে সংগঠিত চীনপন্থী স্বশস্ত্র বাহিনীরও সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে ভাষানী ন্যাপ, কাজী জাফরের ইউনাইটেড পিপলস পার্টির (ইউপিপি) রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। সেন্টু, মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের ঝগড়া হিসাবে অভিহিত করা রাজনীতির কট্টর কর্মী ছিলেন। সভাপতির ব্যক্তিগত অনুসারী হওয়ায় তাকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কমিটির ৩৩ নং সদস্য কামরুজ্জামান, তার ডাক নাম মুক্তা এবং বংশের নাম ফকির। ইচ্ছাকৃতভাবেই নামের ক্ষেত্রে ডাক নাম উল্লেখ করা হয়নি। কারণ, ডাক নাম ও বংশের নাম উল্লেখ করা হলে প্রকৃত পরিচয় বের হয়ে আসবে। খানাকুনিয়ারী গ্রামের অধিবাসী তার পিতা আব্দুস সোবাহান ফকির ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার। সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের ব্যক্তিগত অনুসারী ও ক্যাডার হওয়ায় নিজের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তাকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শ্রম সম্পাদক হয়েছেন শেখর শিকদার। সর্বহারা পার্টির অন্যতম সদস্য ছিলেন শেখর। খুন, ডাকাতি, ধর্ষণসহ ভয়াবহ অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শেখর প্রায় ১ ডজনের উর্ধ্বে মামলার আসামি ছিলেন। এছাড়া, পিরোজপুরের রাজনীতিতে কখনোই সম্পৃক্ত নন, একটি বড় কোম্পানীতে এলাকার বাইরে সার্বক্ষনিক চাকুরি করেও সহ-সভাপতি পদ পেয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার মো. মতিউর রহমান। তার ঘনিষ্ট সুত্র জানায়, টাকার বিনিময়ে পদ পেয়েছেন তিনি। একইভাবে ঢাকার এক ব্যবসায়ী মো. মণিপুর রহমান কখনোই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থেকেও সহ-সভাপতি পদ পেয়েছেন।
কমিটির ৭নং সদস্য আলতাফ হোসেন খান। তিনি ঢাকার একজন ধনী ব্যবসায়ী। গত ১০ বছরেও পিরোজপুরের কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাকে দেখা যায়নি। কমিটির ২৫ নং সদস্য মো. জাকারিয়া স্বপন, তিনিও ঢাকায় ব্যবসা করেন, এছাড়াও তাকে নেছারাবাদ উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক পদ দেয়া হয়েছে।
কমিটির ১৭ নং সদস্য মো. ইব্রাহীম হোসেন। তিনি ঢাকা উত্তর ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি। দলীয় পদ পেতে বাবার নাম পরিবর্তন করে জালিয়াতির অভিযোগে ছাত্রলীগের মহানগর কমিটি থেকে বাদ পরেছিলেন তিনি।
ঘোষিত নতুন কমিটি সূত্রে আরও জানা গেছে, কমিটির ৪ নং পদে রয়েছেন লায়লা পারভিন। তিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের স্ত্রী। এছাড়াও লায়লা পারভিন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী পদে বহাল রয়েছেন। সম্মেলনের প্রস্তুতি সভা করতে গিয়ে আউয়াল পরিবারের দ্বার লাঞ্চিত হয়েছেন মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী সাফিয়া খাতুন ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম ক্রীক।
নতুন কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি হয়েছেন আলহাজ্ব মো. হাবিবুর রহমান মালেক। যিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের আপন ভাই। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন মো. মুজিবুর রহমান খালেক। তিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের আপন ভাই। কার্যকরি কমিটির ৫ নং সদস্য হলেন মিসেস সালমা রহমান হ্যাপি। তিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের আপন ভাই মুজিবুর রহমান খালেকের স্ত্রী। অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মশিউর রহমান মহারাজ। তিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের আপন ছোট ভাই। এছাড়া তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের ১ নং সদস্য।
২০ নং সদস্য হয়েছেন মো. তোফাচ্ছেল হোসেন মল্লিক। তিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের বোনের ছেলে। এছাড়া তিনি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। অন্যতম সহ-সভাপতি অ্যাড. খান মো. আলাউদ্দিন। তিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের আপন ভাই মুজিবুর রহমান খালেকের ছেলের শ্বশুড়। বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মো. তৌহিদুল ইসলাম হিরু এবং ২৭নং সদস্য ইসলাম মিরণ। তারা সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের এক ভাইয়ের ভায়রার ছেলে। যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মো. নুরুল হুদা আলম। তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তিনি সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের আত্মীয়। মো. নুরুল হুদা আলমের স্ত্রী মিসেস তাহমিনা আলমও পদ পেয়েছেন এই কমিটিতে। তারা সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের আত্মীয় হওয়ায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। এছাড়া আরও ৮ জন রয়েছেন সভাপতি পরিবারের আত্মীয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি জেলা কমিটি- কোনো প্রকার নিয়মনীতি না মেনে কেবল সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্মীয়করণের মাধ্যমে কিভাবে অনুমোদন হলো- সে বিষয়টিই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।