দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস বাকি। সংবিধান অনুযায়ী এই সরকারের মেয়াদ আর দুই মাস। এর পরই গঠিত হবে নির্বাচনকালীন সরকার। এর মধ্যে চলতি মাসেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুটি উপনির্বাচন। ১৭ জুলাই হবে ঢাকা-১৭ আসনের ভোটগ্রহণ এবং চট্টগ্রাম-১০ আসনের ভোটগ্রহণ ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে এসে এই উপনির্বাচন নিয়ে জটিল অঙ্কের সমীকরণে রয়েছে দলটির নীতিনির্ধারণী মহল। একদিকে যেমন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং বিতর্কমুক্ত একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি সরকারের শেষ সময়ে দুটি আসনেই জয়লাভ, সরকারে জন্য ইমেজের ব্যাপার। বিশেষ করে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ঢাকা-১৭ আসনের ভোটের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে সরকারের স্বস্তি ও অস্বস্তি।
এদিকে ঢাকা-১৭ ও চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপ-নির্বাচনে চার পর্যবেক্ষক সংস্থাকে ভোট পর্যবেক্ষণে অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোট পর্যবেক্ষণে চার সংস্থাকে পর্যবেক্ষক পরিচয়পত্র এবং গাড়ির স্টিকার ইস্যু করতে এ দুই আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছে ইসি। শনিবার (৯ জুলাই) ইসির জনসংযোগ শাখার সহকারী পরিচালক মো. আশাদুল হক এ তথ্য জানান। চিঠিতে বলা হয়, আগামী ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ ও ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-১০ আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন প্রণীত স্থানীয় পর্যবেক্ষণ নীতিমালা-২০১৭ ও সংশ্লিষ্ট আইন মেনে ঢাকা-১৭ আসনে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য কমিশনে নিবন্ধিত স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন এবং যুব উন্নয়ন সংস্থার ৭ জন করে মোট ২১ জনকে পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, এই উপনির্বাচনে থাকছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল।
অন্যদিকে নির্দলীয়, বা নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে সরব বিএনপি, আবার একই কারণে রয়েছে বিদেশিদের চাপ। এই পরিস্থিতিতে উপনির্বাচনে যেন কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না হয়, সেদিকে নজর রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। তবে বিশেষ করে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে জটিল অঙ্কের সমীকরণে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, সরকারের শেষ সময়ে উপনির্বাচন উভয় সংকট হয়ে এসেছে। নৌকার প্রার্থীর বিজয় এই মুহূর্তে সরকারের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আবার বিতর্কমুক্ত নির্বাচন উপহার দেওয়াও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সংসদ থেকে বিএনপির পদত্যাগের পর ছয়টি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন হয়। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল আলোচনায়। সংসদ সদস্য পদ ছাড়ার পর বিএনপি ত্যাগ করা উকিল আবদুস সাত্তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তাকে সরকার জিতিয়ে আনার জন্য কৌশল করেছে বলে তখন বিরোধীদের পক্ষ থেকে ব্যাপক বিতর্ক এবং সমালোচনা হয়। এছাড়াও বগুড়ার দুটি আসনে ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিতর্ক ও আলোচনার জন্ম দেন। যদিও তিনি বগুড়া-৪ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের কাছে ৮৩৪ ভোটে হেরে গিয়েছিলেন, তথাপিও পরে তিনি দাবি করেন যে, তাকে কারচুপি করে হারানো হয়েছে। অথচ হিরো আলম বগুড়া-৬ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী রাগেবুল আহসানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারিয়েছেন।
এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতর্কের জন্ম দেওয়া হিরো আলমকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন অনেকেই। কেননা ঢাকা-১৭ আসনে আবার প্রার্থী হয়েছেন এই হিরো আলম। প্রথমে তার মনোনয়ন বাতিল হলেও আপিল করে প্রার্থী হিসেবে বৈধতা পেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত। তিনি একজন শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত এবং সজ্জন ব্যক্তি। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান (ফারুক) মারা যাওয়ায় এ আসনটি শূন্য হয় এবং ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-১০ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ডা. আফছারুল আমীন মারা যাওয়ায় ওই আসনটিও শূন্য হয়।
এ দুটি উপনির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। তাদের দাবি, এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। অন্যদিকে সরকারপ্রধান বারবার সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করছেন। নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া পাঁচ সিটি করপোরেশনের প্রথম ভোট গাজীপুরে সেরকম দেখা গেছে। যদিও পরে বরিশালে প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে সরকারপ্রধানের অঙ্গীকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রয়াসে আস্থা না রাখার কথাই বলছে বিরোধীরা। সে কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন সরকারি দলের দাবির সপক্ষে যৌক্তিক উদাহরণ হতে পারে, হতে পারে বিএনপির দাবির বিপক্ষের শক্তিশালী প্রমাণ।
তারা বলেন, নানা অঙ্কের সমীকরণ সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করা- এ দুটি কীভাবে সম্ভব করবে, তা নিয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করেছে। অন্য যেকোনো সরকারের সময়ের তুলনায় এবারের উপনির্বাচন একটু ভিন্নমাত্রার। তাছাড়া আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা যাবে কি না, তা যাচাই করতে উপনির্বাচনের সময়ে ঢাকায় থাকবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। এছাড়া, এই উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম ভোটে নেমে আরও জটিল করে তুলেছে নির্বাচন। কারণ সরকার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত সব মহল মুখিয়ে আছে এ নির্বাচন নিয়ে। যাতে ইস্যু তুলে আনতে পারে। ছোট অনেক ঘটনা বড় করে দেশ-বিদেশে অপপ্রচার করার টার্গেট নিয়ে বসে আছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলগুলো।
নেতারা আরও বলেন, ভোটের পরিবেশ ঠিক রাখতে চান প্রধানমন্ত্রী। দেশি-বিদেশি সমালোচক মহলের মুখবন্ধ রাখার ব্যাপারটা দলের কাছে ও সরকারের কাছে অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজধানীর অভিজাত এলাকা নিয়ে ঢাকা-১৭ আসন। সেখানে যেনতেন নির্বাচন করার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি দলের ও সরকারের ভাবনাতেও নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব, তা ঢাকার উপনির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। অন্যদিকে সরকারের জনপ্রিয়তা রয়েছে সেটা প্রমাণ করতে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে হবে। দুটোই যদি সফল হয় তাহলে দেশ-বিদেশে- এ উদাহরণ তুলে ধরে সরকার বিরোধীদের দুর্বল করতে পারবে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ‘টপ প্রায়োরিটি’ (সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার) বিতর্কমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। দলীয় প্রধান হিসেবে নৌকার প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করাও ‘প্রায়োরিটি’।
তিনি দাবি করেন, ‘বিএনপি সবসময়ই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে কূটকৌশল করে।’