প্রায় সাড়ে ৪ বছর ধরে বিএনপি একই বাক্যের মধ্যে রয়েছে যে, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বোচনে অংশগ্রহণ করবে না দেশের মাঠের রাজনীতির প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের বেশ কয়েকটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তাতে কোনো দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেয়নি দলটি। উপরন্তু দলীয় মতামতের বিপরীতে বিএনপির যেসব নেতা-কর্মী এসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে- তাদেরকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকারি দলও রয়েছে একই বাক্যের মধ্যে। সরকারি দল বলছে, সংবিধান অুনযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সরকারি দলের এই সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ বিএনপি। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে একটি রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে।
আবার এই রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে বিদেশি কূটনীতিকসহ বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বেশ তোড়জোড় বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা এরই মধ্যে বাংলাদেশ সফর করেছেন। তারা সরকারি দল, বিরোধীদলসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের সাথে একাধিক বৈঠক করেছেন, মতামত নিয়েছেন। কিন্তু একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিকরা সমাধান করতে পারবেন না বলেই মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপিসহ সরকার বিরোধী সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিলে কম্বোডিয়ার মতো হতে পারে বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
উল্লেখ্য যে, প্রধান বিরোধী দল ছাড়াই কম্বোডিয়ার জাতীয় নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আজ রোববার (২২ জুলাই) অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশটির প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই এই নির্বাচন করা হয়। দেশটির দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি) সহজ জয় পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের দল সিপিপি কম্বোডিয়ার জাতীয় পরিষদের ১২৫ আসনের সব ক’টিই আবার পাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। কম্বোডিয়ার দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সিপিপির পাশাপাশি ১৭টি ছোট দল এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তবে সিপিপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো সক্ষমতা এই ১৭টি দলের কোনোটিরই নেই।
এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ‘নির্বাচিত’ শাসক হুন সেন। তিনি গত ৩৮ বছরে কম্বোডিয়ায় তাঁর ক্ষমতা সুসংহত করেছেন। আজকের নির্বাচনে সিপিপির জয় হলে ছেলে হুন মানেটের হাতে হুন সেনের দায়িত্ব হস্তান্তরের পথ প্রশস্ত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হুন মানেট এখন কম্বোডিয়ার সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন।
কম্বোডিয়ায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সিপিপির প্রধান প্রতিপক্ষ ক্যান্ডেললাইট পার্টি। দেশটির একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য এই বিরোধী দল আজকের নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। কারণ, নিবন্ধনসংক্রান্ত ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে গত মে মাসে এই দলকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ভিন্ন। বাংলাদেশের মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নিবন্ধন বাতিল করেনি বাংলাদেশ সরকার। বরঞ্চ সরকার এবং নির্বাচন কমিশেনের পক্ষ থেকে বিএনপিকে সহিংসতার রাজনীতি পরিহার করে বার বার নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহবান জানানো হয়েছে। মাঠের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপির আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, মিটিং, পদযাত্রাতেও কোনো প্রকার বাধা দিচ্ছে না সরকার। তবে সহিংস কোনো কর্মকাণ্ডে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের জানমাল রক্ষা এবং জনসাধারণ যেন কোনোভাবে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়, সেজন্য যথাযথ আইনানুগ পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১২, ১৩ সালের দিকে বিএনপির সহিংস রাজনীতির চিত্র এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। জ্বালাও-পোড়াও, বাসে আগুন দেওয়া, অফিস-আদালত পুড়িয়ে দেওয়া, মানুষ হত্যা এসব সহিংসতা কোনো সুস্থ ধারার রাজনীতির অংশ হতে পারে না। সিরাজ শিকদারের পার্টির কি হয়েছিল? তার নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ছিল ওই সময়ের এক আলোচিত বিষয়। তরুণদের একটা বড় অংশ এই দলের সশস্ত্র ধারার রাজনীতিতে শামিল হয়েছিল। তারা কারও চোখে বিপ্লবী, কারও চোখে সন্ত্রাসী। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের ব্যবচ্ছেদ করতে হলে অনিবার্যভাবেই উঠে আসে সিরাজ শিকদার এবং সর্বহারা পার্টির প্রসঙ্গ।
কিন্তু সহিংস ও সশস্ত্র রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি টিকতে পারেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বহারা পার্টির একটা প্রচারণা ছিল- একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ আবার ভারতের উপনিবেশ হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে সর্বহারা পার্টির একটা দলিলে ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব’কে মৌলিক দ্বন্দ্ব আখ্যা দেওয়া হয়। সেখানে আরো উল্লেখ করা হয়–‘এ দ্বন্দ্ব সমাধানের পথ হচ্ছে সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার পদলেহী কুকুর ছয় পাহাড়ের দালাল জাতীয় শত্রুদের খতম ও উৎখাত করা, বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে উৎখাত করা, পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করা।’
বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির পথেই হাটছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশ্লেষকরা তার কারণ হিসেবে বলছেন, কেননা বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্য সেই সহিংস রাজনীতির ইঙ্গিতই বহন করছে। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগী না হয়ে বিএনপি যদি ফের ২০১২, ১৩ সালের মতো সহিংস রাজনীতির পথ বেছে নেয়, তবে বিএনপির দশা হবে সিরাজ শিকদারের পার্টির মতো। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কম্বোডিয়ার নির্বাচনের আদলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে ফের ক্ষমতার মসনদে আসীন হবে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল বিএনপি।