মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে আছেন তিনি। মৃত্যু তাকে ঘুম দিয়েছে, নিয়ে গেছে দূরে, বহুদূরে, এই লোক-লোকান্তর ছেড়ে। তবু আমৃত্যু তিনি রয়ে গেছেন অনুসারীদের অন্তরে। মৃত্যুর কাছে প্রতিটি মানুষ বড়ই অসহায়, মৃত্যু যখন কাছে এসে বলে ... পৃথিবীর সব মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে, আয় আমার কাছে চলে আয়। তখন আর কিছুই করার থাকে না একমাত্র মৃত্যু ঘুমে নিপতিত হওয়ার অনন্ত যাত্রা ছাড়া। সেই অনন্ত যাত্রায় চলে গেছেন তিনি। কিন্তু রেখে গেছেন শত, সহস্র, লক্ষ, কোটি অনুসারী, গুণগ্রাহী। তিনি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুর্যোগের কান্ডারী।
সাবেক তিনবারের সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য প্রয়াত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর)। গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর রোববার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ৮৭ বছর বয়সে মারা যান বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
ফরিদপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাজেদা চৌধুরী ১৯৩৫ সালের ৮ মে মাগুরা জেলায় অবস্থিত মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সৈয়দ শাহ হামিদ উল্লাহ এবং মা সৈয়দা আছিয়া খাতুন। শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্বামী রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী প্রয়াত গোলাম আকবর চৌধুরী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের জননী।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ছিলেন একজন রাজনৈতিক কিংবদন্তি। তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তিনি ছিলেন অকুতোভয়া সৈনিক। ১৯৬৯-১৯৭৫ সময়কালে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ পুনর্গঠন, রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বরসহ দেশের প্রতিটি সঙ্কটে, আওয়ামী লীগের ক্রান্তিলগ্নে তিনি দৃঢ় নেতৃত্ব দিয়ে দলের পাশে ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা এবং তারপর ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যার পর আওয়ামী লীগ যে নেতৃত্ব সঙ্কটে ছিল, যে আওয়ামী লীগ বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে করুণ অধ্যায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, সেই নেতৃত্ব সংকটে, আওয়ামী লীগের চরম দূর্যোগের সময়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। দলের প্রতিটি সঙ্কটে সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগকে আগলে রেখেছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ১৯৫৬ সাল থেকে তার রাজনৈতিক পথ চলা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি করার ব্যাপারেও তিনি অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিক, সংসদ উপনেতা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধোত্তর ‘বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ এর পরিচালকের গুরু দায়িত্বও পালন করেছেন।
৭৫’র পর আওয়ামী লীগের সঙ্কটকাল
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বিপর্যয়ের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ। সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান।
সর্বজনবিদিত যে, তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারী। পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দুঃসময়ে দৃঢ়তার সঙ্গে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ৭৫’র ৩ নভেম্বর তাজউদ্দীন আহমেদসহ জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। আর জেলখানায় এই চার নেতা হত্যার পর আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়ে। জিয়াউর রহমানের স্বৈরশাসন আর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিশ্বাসঘাতকতা- সবকিছু মিলিয়ে আওয়ামী লীগের এক নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়। যে সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি বাংলার মানচিত্র থেকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগের নাম-নিশানা মুছে ফেলার নীলনকশায় মত্ত। ঠিক সেই সময়ে স্বামী হত্যার শোক বুকে ধারন করে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের কাজে নেতৃত্ব দেন জোহরা তাজউদ্দীন। আর আওয়ামী লীগের ৭৫ পরবর্তী এই করুণ দুঃসময়ে জোহরা তাজউদ্দীনের পাশে থেকে, যারা দলকে পুনর্গঠন করেছিলেন, দলকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দলকে সংগঠিত করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
পঁচাত্তরের পর সাজেদা চৌধুরীকে জিয়াউর রহমান যখন গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে যায়, তখন তিনি অপারেশনের রোগী ছিলেন। তার পেটে ব্যান্ডেজ ছিল। ঘাঁ তখনও ভালো করে শুকায়নি। জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সেই দুঃসময়ে তিনি জেল-জুলুম, নির্মম অত্যাচার সহ্য করে, তার দৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে দলকে সংগঠিত করে এগিয়ে নিয়েছিলেন।
২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর (রোববার) সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশনে সাবেক সংসদ উপনেতা মরহুম সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী স্মরণে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, তিনি শুধু সংসদ উপনেতাই নন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, সমাজ সেবক, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাকে হারিয়ে আমাদের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একজন সত্যিকার নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিকে হারাল। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই।
তিনি বলেন, যাদের সাথে ছিলাম একে একে সবাই ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বয়স হয়ে গেছে যেতেই হবে, হয়তো আমিও একদিন যাবো। তবে, যে যেটা করেছেন (যার যার অবদান) সেটা আমাদের স্মরণ করতে হবে।
তিনি স্মরণ করেন, চলার পথে সব সময় মরহুম সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে পাশে পেয়েছেন। তাকে ফুপু বলে ডাকতেন এবং সত্যিকার অর্থে যেন তার ফুপুই তিনি ছিলেন এবং স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সেবার কথাও স্মরণ করেন।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ফরিদপুর-২ আসন থোকে সাজেদা চৌধুরী একাধিকবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক ওমেন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সাজেদা চৌধুরীকে প্রথমবার জাতীয় সংসদের উপনেতা করা হয়। এরপর দশম ও একাদশ সংসদেও তিনি উপনেতার দায়িত্ব পান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন।
আমৃত্যু তিনি আওয়ামী লীগ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা এবং সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অনন্য এক অনুগত সেনানী ছিলেন। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। আমরা হারিয়েছি সত্যিকারের একজন অভিভাবক। তার নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা, দেশের প্রতি দায়িত্বশীল কর্মের অনুপ্রেরণা হয়ে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ফরিদপুর-২ আসনের নগরকান্দা ও সালথা উপজেলায় দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করেছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠন।
মন্তব্য করুন
সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি সত্ত্বেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে
মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বজনের প্রার্থিতা ঠেকাতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী
লীগ। হাতেগোনা দু-একজন বাদে ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন এ ধরনের বেশিরভাগ প্রার্থী। দলীয়
নির্দেশনা অমান্য করে যেসব মন্ত্রী-এমপির স্বজন উপজেলায় ভোট করছেন, তৃণমূল পর্যন্ত
অনেক নেতাকর্মীই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে সোচ্চার। তা সত্ত্বেও এ ইস্যুতে
এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আওয়ামী লীগ। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মৌখিক
বক্তৃতায় হুমকি-ধমকির মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ রয়েছে। এমনকি দলের কার্যনির্বাহী কমিটিতেও
এ নিয়ে আলোচনা হয়নি।
শুধু তাই নয়, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হওয়া প্রভাবশালীদের
বিরুদ্ধে আগামী দিনেও কঠোর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মূলত মন্ত্রী-এমপিসহ
স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে উপজেলা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক
করতেই আওয়ামী লীগ এমন কৌশল নিয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা।
জানা গেছে, এবারের উপজেলা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে শুরু থেকেই
সচেষ্ট ছিল আওয়ামী লীগ। এ কারণেই দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দিয়ে সবার জন্য প্রার্থিতা উন্মুক্ত
করা হয়। তা সত্ত্বেও বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক দল নির্বাচনের বাইরে থাকায় শেষ পর্যন্ত
এই নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে—তা নিয়ে সংশয় ছিল। বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রী, সংসদ
সদস্য কিংবা স্থানীয়ভাব প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপে অনেক উপজেলায় তাদের পছন্দের
প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
বিশেষ করে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্য বা স্বজনরা অবাধে
ভোটে দাঁড়াতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে আর কেউ প্রার্থী হতে চাইতেন না। এমন বিবেচনা থেকেই
ভোটের মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন ও নিকটাত্মীয়দের নির্বাচনে
অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। তা সত্ত্বেও
অনেক উপজেলায় ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন প্রভাবশালী প্রার্থীরা। তা সত্ত্বেও দলীয় কৌশল সফল
হয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
তাদের মতে, মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের ভোট করার নির্দেশনা দিয়ে দল
সবার জন্য একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। তা হলো, আওয়ামী লীগ অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক উপজেলা
নির্বাচন চায়। হাতেগোনা দু-চারটি বাদে মন্ত্রী-এমপি পরিবারের সদস্যরা নির্বাচনে অংশ
নিচ্ছেন না। তাদের যেসব আত্মীয়স্বজন প্রার্থী হয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই দীর্ঘদিন ধরে
দলীয় রাজনীতিতে অবদান রেখে আসছেন। তা ছাড়া দু-চারটি ব্যতিক্রম বাদে এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
নির্বাচিত হওয়ার সংখ্যা কম। সব মিলিয়ে উপজেলা নির্বাচনে নিয়ে দলীয় কৌশল সফল হয়েছে বলেই
অনেক কেন্দ্রীয় নেতার ধারণা।
এ বিষয়ে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন কালবেলাকে
বলেন, ‘দলের বার্তা খুব পরিষ্কার, উপজেলা নির্বাচন যেন প্রভাবমুক্ত হয়। দলীয় সভাপতি
ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এমন বার্তাই স্পষ্ট করেছেন। নির্বাচনকে প্রভাবশালীদের
হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতেই এই কৌশল। এখন পর্যবেক্ষণ করতে হবে নির্বাচন কতটা প্রভাবমুক্ত
হয়।’
গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ৬২ টিতেই
স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন করে জয়ী হন। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের মধ্যে সিংহভাগই
আওয়ামী লীগ নেতা। ফলে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে তৃণমূলে যে দ্বৈরথ তৈরি হয়েছে, উপজেলা নির্বাচনেও
তার প্রভাব পড়তে পারে বলে আওয়ামী লীগের আশঙ্কা। এ কারণেই দলীয় প্রতীকে প্রার্থী না
দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নির্বাচনকে আরও গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবমুক্ত রাখতে আত্মীয়-স্বজনদের নির্বাচন থেকে বিরত থাকতেও নির্দেশ
দেয় ক্ষমতাসীন দল। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়ে গেছেন এ ধরনের প্রার্থীরা।
নির্বাচন কমিশনের তপশিল অনুযায়ী প্রথম ধাপে ১৫২ উপজেলায়, দ্বিতীয়
ধাপে ১৬১, তৃতীয় ধাপে ১১২ ও শেষ ধাপে ৫৫ উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার
তৃতীয় ধাপের মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনের হিসাব অনুযায়ী অন্তত অর্ধশতাধিক মন্ত্রী ও এমপির
স্বজন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তবে ৪৮০টি উপজেলার মধ্যে এই সংখ্যাকে খুব বেশি বলে মনে
করছে না আওয়ামী লীগ। এ কারণেই ঢালাওভাবে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে আপাতত বিরত থাকছে তারা।
গতকাল গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি
শেখ হাসিনাও উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি
বলেন, ‘পারিবারিক ফর্মুলা কী? নিজের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী, এই তো। তারপর হিসাব করে দেখেন,
কয়জন ছেলেমেয়ে, কয়জন স্ত্রী দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে তো পরিবার ধরা হয় না। আমাদের
কথা হচ্ছে নির্বাচন যেন প্রভাবমুক্ত হয়। মানুষ যেন স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে।’
জানা গেছে, প্রতিটি সংসদীয় আসনে এক বা একাধিক উপজেলা রয়েছে। এলাকার
রাজনীতিতে এমপির পাশাপাশি উপজেলা চেয়ারম্যানের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েও অনেকে উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে হেরেছেন।
এ কারণে উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন সংসদ সদস্যরা। নিজ পরিবার কিংবা বলয়ের
লোককে উপজেলা চেয়ারম্যান করতে সচেষ্ট তারা।
এ পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেই মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের নির্বাচনে
অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে
কেউ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করলে তাদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও দলের
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ার করে দেন।
সূত্র জানায়, এরপরই মন্ত্রী এমপিদের স্বজনদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ
জমা পড়ে দলের দপ্তরে। অনেকে সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে
লিখিত ও মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভার আলোচ্যসূচিতেও
উপজেলা নির্বাচন ইস্যুটি অন্তর্ভুক্ত হয়। সাংগঠনিক সম্পাদকরা প্রতিবেদনও চূড়ান্ত করেন।
তবে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাহী সংসদের সভায় এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।
বৃহস্পতিবার (০২ মে) সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও
উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রার্থী হওয়ার প্রশ্নে অনেকটা নমনীয় মনোভাব
ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম (মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের নির্বাচন
থেকে বিরত থাকতে)। কারণ হচ্ছে, আমরা চাইছি, নির্বাচনটা প্রভাবমুক্ত যেন হয়, মানুষ যেন
স্বাভাবিকভাবে ভোটটা দিতে পারে। সেটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।’
এসব কারণে অনেকের ধারণা, মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নেওয়ার হুমকি ও হুঁশিয়ারি রাজনৈতিক কৌশল।
আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘মূলত বিএনপি নির্বাচনে
আসবে না জেনেই নির্বাচনকে জমজমাট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলীয় প্রতীক তুলে দেওয়ার
সিদ্ধান্ত দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। নির্বাচনে যদি মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন
ঢালাওভাবে অংশ নেয়, তবে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে একপেশে হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কায়
তিনি ওই কৌশল নিয়েছিলেন।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন কালবেলাকে বলেন,
‘আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো বার্তা দিয়েই দিয়েছেন। তার বার্তা
অনুযায়ী নির্বাচন যে-ই করুক, কেউ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন
কঠোর ভূমিকা পালন করবে। উপজেলা নির্বাচনে কেউ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না, যেহেতু
দল কঠোর অবস্থানে রয়েছে।’
প্রভাবশালী নেতা আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৪ দল আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
বিএনপি ধর্মঘট রাজনীতির খবর তারেক জিয়া
মন্তব্য করুন
সাংগঠনিক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি সত্ত্বেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বজনের প্রার্থিতা ঠেকাতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। হাতেগোনা দু-একজন বাদে ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন এ ধরনের বেশিরভাগ প্রার্থী। দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে যেসব মন্ত্রী-এমপির স্বজন উপজেলায় ভোট করছেন, তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতাকর্মীই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে সোচ্চার। তা সত্ত্বেও এ ইস্যুতে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আওয়ামী লীগ। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মৌখিক বক্তৃতায় হুমকি-ধমকির মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ রয়েছে। এমনকি দলের কার্যনির্বাহী কমিটিতেও এ নিয়ে আলোচনা হয়নি।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
বিএনপি এখন দিশেহারা দিগ্বিদিকহীন একটি রাজনৈতিক দল। দলটি কী করছে, কী বলছে সে সম্পর্কে তাদের নিজেদেরই যেন কোন হিসেব নেই। গত ২ দিন ধরে বিএনপির নেতারা এক নৈব্যক্তিক অবস্থায় আছেন। তারা কেউই কোন কথা বলছেন না। দলের রুটিন কার্যক্রম অর্থাৎ সভা সমাবেশ ছাড়া দলের নেতাদেরকে আগ্রহ নিয়ে কোনো তৎপরতা চালাতে দেখা যাচ্ছে না।