নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
পদত্যাগের প্রায় বছরখানেক পর একটি বই লিখে আবার আলোচনায় বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বইয়ের নাম ‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল’, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’। যার অর্থ দাঁড়ায় ‘একটি স্বপ্নভঙ্গ: আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র’। গতকাল বুধবার গণমাধ্যমে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বই প্রকাশের খবর আসে। আর এর পরপরই তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ড. কামাল হোসেনের ঐক্য হলো বিএনপির সঙ্গে। দুই এর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি? স্পষ্টতই নির্বাচনের আগে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার পরিকল্পনা চলছে। অবশ্য, পুরো বই না আসায় তা পড়ার সৌভাগ্য কারও হয়নি এখনো। তবে সিনহার বইয়ের প্রচ্ছদ ও শিরোনাম থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, এখানে স্বপ্নভঙ্গের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কার স্বপ্নভঙ্গের কথা বলা হয়েছে।
আমরা জানি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার একটি স্বপ্ন ছিল। তাঁর স্বপ্ন ছিল ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়। যে স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল সাবেক এই প্রধান বিচারপতির। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে অসাংবিধানিক ধারার সূচনাও ছিল সুরেন্দ্র কুমার সিনহার স্বপ্ন। ২০১৬ সালের ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে তিনি লিখেছিলেন, কারও একক কর্তৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা কি স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলেন? বাংলাদেশকে গণতন্ত্রহীন জায়গায় ঠেলে দেওয়াই কি ছিল তাঁর উদ্দেশ্য? যা হয়নি বলেই স্বপ্নভঙ্গ?
কোনো পেশার সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়াই ওই পেশার মানুষের স্বপ্ন বলে ধরে নেওয়া হয়। একজন সাংবাদিকের যেমন সম্পাদক হওয়ার স্বপ্ন থাকে, তেমন একজন বিচারকের স্বপ্ন হতে পারে প্রধান বিচারপতি হওয়া। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে গিয়ে সিনহার পেশাগত জীবনের স্বপ্ন তো পূরণ হয়েছিল। অবশ্য বিচারপতি সিনহার কিন্তু প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ছিল না। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের তালিকা করেছিল সেনা সমর্থিত তৎকালীন ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ দুর্নীতিবাজ বিচারক হিসেবে নাম এসেছিল সুরেন্দ্র কুমার সিনহার। চায়ের আমন্ত্রণে দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের ডেকে নিয়ে গিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু সুরেন্দ্র কুমার সিনহা কৌশলে সেদিন পালিয়েছিলেন বঙ্গভবন থেকে। পরে ওয়ান ইলেভেনের অন্যতম কুশীলব ড. কামাল হোসেন। সাংবিধানিক নানা ফতোয়া দিয়ে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে টিকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। সেই ড. কামাল হোসেনই জোরপূর্বক পদত্যাগ থেকে বাঁচিয়েছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সিনহাকে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। সেখান থেকে প্রধান বিচারপতিও হন। অনাকাঙ্ক্ষিত পদত্যাগ থেকে প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আর পেশাগত সর্বোচ্চ অর্জন বাকি রইলো না। এরপরও কি তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়নি?
পেশাগত জীবনের সর্বোচ্চ স্থানে গিয়ে নিজের অযোগ্যতা ঢাকতেই কিনা ‘পঁচা পিয়াজের ঝাঁজ বেশি‘ নীতিতে গেলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। হেন কোনো সমাবেশ নেই যেখানে গিয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতা দেননি তিনি। অতিকথনে সমালোচিত হলেও সাবেক প্রধান বিচারপতির কথন থামেনি কখনো। অথচ এই সিনহার বিরুদ্ধেই উঠতে থাকে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাওয়া যায় হিসাববিহীন দুই কোটি টাকা। নৈতিক স্থলনের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। অধস্তন নারী কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর অনৈতিক সম্পর্কের খবর ছড়িয়ে পড়ে আদালত পাড়ায়। তখন সিনহার প্রধান বিচারপতি থাকাটা আর কতোটা যৌক্তিক থাকে?
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদটি অনন্য উচ্চতার একটি পদ বলেই মানা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিসহ সব কিছুর উর্ধ্বে একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হন প্রধান বিচারপতি। এই পদে ছিলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ, যার হাতেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে। শুধু বিচারপতি শাহাবুদ্দিনই নয়, তাঁর মতো আর সব বিচারপতিই ছিলেন সব কিছুর উর্ধ্বে। সেখানে বিচারপতি সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর থেকে একটি দিন কাটেনি যখন বিতর্কিত হননি।
বিচারপতি সিনহার আরেকটি স্বপ্ন ছিল, যা তিনি বিভিন্ন স্থানের বক্তৃতায় বলেছেনও। স্বপ্নটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়া। বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিল। জানা গিয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে একটি রিভিউ পিটিশন তৈরি করেছিলেন ড. কামাল। যা নিয়ে আসার কথা ছিল আপিল বিভাগের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বেঞ্চে। বিচারপতি খায়রুল হকে রায় প্রদানের কথার ভিত্তিতে এই পিটিশন তৈরি করেছিলেন ড. কামাল। আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া ১৫৪ এমপির বিরুদ্ধে রিট যা হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছিল, তাও নিয়ে আসার কথা ছিল ড. কামালের। রিট দুটির মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে অবৈধ করায় ড. কামালের অন্যতম ভরসা ছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সরকারের বিরুদ্ধে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’র পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়াই সুরেন্দ্র কুমার সিনহার স্বপ্নভঙ্গ। নিজের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করতে পারেননি সেজন্য সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বেদনার্ত, নাকি ড. কামাল হোসেনকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী না বানাতে পারায় তিনি শোকাহত।
বাংলাদেশের আইন ও বিচার সংশ্লিষ্টরা এখন এমন দাবি তুলতেই পারেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় বিচারালয়ে যে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছিলেন তার ওপর যেন বই বের হয়। তা না হলে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কলঙ্কের কালিমা মুছবে না দেশের বিচার বিভাগ থেকে।
বাংলা ইনসাইডার/জেডএ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
খালেদা জিয়া বিএনপি এভারকেয়ার হাসপাতাল তারেক জিয়া
মন্তব্য করুন
গতকাল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গটি আলোচনাই হয়নি। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করে কেবল সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনার জন্য নির্দেশনা দেন। ফলে আওয়ামী লীগের কোন নেতাই আর উপজেলা নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আলোচনায় নিয়ে আসেনি।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বৈঠকে উপস্থিত অন্তত দুজন নেতা বলেছেন যে, আগামী ২৩ জুন দলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কীভাবে জাকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করা যায় ও ২১ থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা করা এবং শেষদিনে বড় সমাবেশ করার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। এবার আওয়ামী লীগ ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে করবে। সেই প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসা হয়।
আর আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইচ্ছে করেই উপজেলা নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আনেননি বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী লীগ সভাপতি যারা উপজেলা নির্বাচনে শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছে, দলের নির্দেশনা অমান্য করে আত্মীয় স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন, তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন বলে মনে করলে ভুল হবে।
বিএনপিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় হটকারী ভাবে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছে তাদেরকে বহিষ্কার করে সবকিছু শেষ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন রাজনৈতিক প্রজ্ঞায়, ধীরস্থিরভাবে, আস্তে আস্তে।
জাতীয় সংসদে একবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন যে, বাঘে ধরলেও ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা যাকে ধরে তাকে ছাড়ে না। যারা উপজেলা নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন তারা দীর্ঘমেয়াদি প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করবেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তারা শেখ হাসিনার কালো ডায়েরিতে নাম লিখিয়েছেন। শেখ হাসিনার কালো ডায়েরিতে নাম লেখালে রাজনৈতিক পরিণতি কী হয় তা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়।
এক এগারোর সময় যারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন সেই সমস্ত ডাকসাইটে নেতাদের কাউকেই তিনি দল থেকে বহিষ্কার করেননি। কিন্তু দলে তাদের অকার্য করেছেন, নিষ্ক্রিয় করেছেন। তাদের প্রায়শ্চিত্ত উপলব্ধি করার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন। এটাই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল।
শেখ হাসিনা এক এগারোর পর সংস্কারপন্থিদেরকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। যারা কম সংস্কারপন্থী ছিলেন, কম ষড়যন্ত্র করেছেন- তাদেরকে তিনি নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন। প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিয়েছেন। তাদের অনেক হেভিওয়েট নেতাকে প্রেসিডিয়াম থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের আলঙ্কারিক পদ দিয়ে শাস্তি দিয়েছেন। এই শাস্তি দল থেকে বহিষ্কারের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তিনি রাজনীতিতে নতুন করে বিদ্রোহী এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি করার সুযোগ দেননি। বরং দলে তাদেরকে শাস্তি দিয়ে দলের ঐক্য অটুট রেখেছেন।
আর দ্বিতীয় প্রকার যারা ছিল এক এগারোর সংস্কারপন্থীর মূল হোতা তাদেরকে তিনি মনোনয়ন দেননি। মনোনয়ন না দিয়ে তাদেরকে দলে নিষ্ক্রিয় করেছেন। এদের মধ্যে অনেকে মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে নতুন দল করেছে। কিন্তু রাজনীতিতে জীর্ণ শীর্ণ ভিখারীতে পরিণত হয়েছে। এটাই শেখ হাসিনার কৌশল।
কাজেই এবার যারা উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছে, তারা আসলে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেনি, তারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছে। শাস্তি তাদের পেতেই হবে। তবে তারা কবে কীভাবে পাবেন এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের কী হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
কারণ যারা আত্মীয়স্বজনদেরকে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী করেছেন তারা অবশ্যই আওয়ামী লীগ সভাপতির কালো খাতায় নাম লিখিয়েছেন। শেখ হাসিনার কালো খাতায় নাম লেখালে কী হয় তা অতীতে অনেক নেতাই উপলব্ধি করেছেন। অনেকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে।
বহিষ্কার হলে একজন রাজনৈতিক নেতা পরিত্রাণ পায়, নির্বাণ লাভ করে। তিনি নতুন সুযোগ পান অন্য কিছু করার। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতা যখন দলেই উপেক্ষিত হন, অনাহূত হন, পরিত্যক্ত ঘোষিত হন- তখন তার রাজনৈতিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। আর শেখ হাসিনার কালো খাতায় নাম লেখালে রাজনৈতিক জীবন দুর্বিষহ হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ তৃণমূল উপজেলা নির্বাচন রাজনীতি ড. আব্দুর রাজ্জাক শাজাহান খান জাহিদ মালেক মোস্তফা কামাল
মন্তব্য করুন
এভারকেয়ার হাসপাতাল খালেদা জিয়া বিএনপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন