ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধরণের কথা-বার্তা বলে। তাদের এগুলো নিয়ে এতো সিরিয়াস হওয়া ঠিক হবে না। কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এই ধরণের কাজ করে থাকে এবং একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলোকে সিরিয়াসলি নেওয়াটাই আমার মনে হয় ভুল। আমরা সচারচর এটি করে থাকি। যেহেতু আমেরিকা এটা বলেছে। এটা করেছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাস যে কমেছে, এটা আমরা ভাল করেই জানি।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বাংলাদেশের বর্তমান এবং সাবেক ৭ জন র্যাবের কর্মকর্তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা, পরবর্তীতে সন্ত্রাস দমনে র্যাবের প্রশংসা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ইনসাইডার এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ এসব কথা বলেছেন। পাঠকদের জন্য অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডার এর নিজস্ব প্রতিবেদক অলিউল ইসলাম।
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, র্যাবের যে সমালোচনা, এটা আমাদের পত্রপত্রিকা, সুশীল সমাজের বক্তব্যের মধ্যেই আছে। এটা আমাদের বাহিরের কারও কাছে শুনতে হবে না। যে সমালোচনাটি আছে, তা ঠিক করতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটি ঘটলেও এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আমেরিকা বলেছে বলে এটা ঠিক, আর এতদিন যে বলেনি, তার মানে কি এতদিন এটি ঘটেনি? আমেরিকায় তো আমাদের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ জন্য আমার মনে হয় না কোনো গুরুত্ব দেওয়ার দরকার আছে। এটা নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা হয়। কিন্তু আমি মনে করি না এর কোনো প্রভাব বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঘটবে।
লবিস্ট ভূমিকা প্রসঙ্গে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নাক গলানোর প্রধান কারণ হলো লবিস্ট। আমেরিকার বিদেশ নীতি শুধুমাত্র তাদের রাষ্ট্রদূতরা কি বললো তার উপর নির্ভর করে না। রাষ্ট্রদূত হলো একটি চ্যানেল। এম্বাসিতে বাংলাদেশি যারা আছেন, তারা একটি চ্যানেল। আবার দেশে আমেরিকার সমর্থক যারা ওই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তারা আরেকটি চ্যানেল। আবার লবিং বা লবিস্ট বলে আরেকটি জিনিস আছে, তারাও একটি প্রভাব ফেলে। এটি খুবই জটিল প্রক্রিয়া এবং মাঝে মাঝে অনেক আমেরিকানরাও জানেন না। আমার কথা হচ্ছে আমেরিকার এইসব রিপোর্ট নিয়ে মাথা ঘামানোর তেমন কিছুই নেই। প্রথম প্রতিবেদনটি একেবারেই সাংঘাতিক, খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছে এমনটি বুঝাচ্ছে। আবার দ্বিতীয় প্রতিবেদনে প্রশংসা করছে। ফলে এইগুলোর গুরুত্ব দেওয়াই ভুল।
তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা উঠেছে। আমরাও এর সমর্থন করি না। সেটা আমেরিকা এখন বলছে বলে ওঠে পড়ে লাগতে হবে, সেটি না। আমাদের এমনিতেই এসব বন্ধ করা উচিত। অন্যদিকে আমেরিকার নিজেরই তো আমাদের থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ বেশি। ফলে এই বিষয় নিয়ে তার তো মুরাল অথরিটি থাকার কথা না। কিন্তু সে বলে যায়। এটা করে কারণ সে সুপার পাওয়ার। তার প্রচুর পয়সা আছে। ফলে সে এসব রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু এগুলোকে আমি কখনো এতো গুরুত্ব দেইনি। এখনও আমার মনে হয় না এটি কোনো গুরুত্ব বহন করে।
তিনি আরও বলেন, আমেরিকার সাথে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। সামরিক সম্পর্ক আছে। ওদের দেশে পড়ালেখা করতে আমাদের ছাত্ররা যায়। এসব নিষেধাজ্ঞা এ বিস্তৃত সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না। আমেরিকা ভাল করেই জানে, বাংলাদেশ উন্নয়নের মধ্যে আছে। বাংলাদেশে যেসব যেসব ঘাটতি আছে, তা বাংলাদেশিরাই ঠিক করবে। বাংলাদেশের জনগণসহ বিভিন্ন স্টেক হোল্ডাররা ঠিক করবে। বাহির থেকে কেউ চাপিয়ে দেবে, আর আমরা মানবো, বাংলাদেশের ওই অবস্থাটি এখন আর নেই। এটা ভালো করে বুঝা দরকার। এটি অনেকে বুঝতে চান না বা বুঝতে চেষ্টা করেন না। যেই সমালোচনাটি আছে এটি আমরা এমনিতেই জানি। এটি নতুন কিছু নয়।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, র্যাবের সমালোচনা এখন থেকে না, যখন থেকে র্যাব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তখন থেকেই এর সমালোচনা হচ্ছে। আজকে যেসব দল র্যাবের সমালোচনা করছে, তারাই একসময় র্যাবের সমর্থক ছিল। প্রতিষ্ঠাতা ছিল। তারাই র্যাব তৈরি করেছে। কিন্তু যেই সমালোচনাটি হচ্ছে, এটির যতটুকুই এ দেশে ঘটে থাকুক, সেটা একেবারেই বন্ধ করা দরকার। সে ব্যাপারে আমি মনে করি কর্তৃপক্ষ যদি ছাড় না দিয়ে ব্যবস্থা নেয়, তখন আমরা ওইটাকে সমাধানে আনতে পারবো।
আমেরিকার আধিপত্যবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমেরিকা সবসময়ই আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এটাই করে আসছে তারা। এটি নতুন কিছু না। আমেরিকা একটি সুপার পাওয়ার। ফলে তাদের মোড়লগীরি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা খুবই স্বাভাবিক। আমেরিকার নিজেরই কিন্তু গণতন্ত্র নড়বড়ে। তার ক্যাপিটাল হিল যেভাবে আক্রমণ হয়েছে, যেভাবে স্পিকারের চেয়ারে সবাই বসেছিল, এটা যদি অন্যদেশে ঘটতো তাহলে তারা ওই দেশকে ফেইলড স্টেট বলে ঘোষণা দিতো। এটা আমেরিকা বলে কেউ বলছে না। যেহেতু আমেরিকার প্রচুর সমর্থক অনেক দেশে আছে। তারা সব সামলাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি না যে, আমেরিকা ক্যাপিটাল হিলের ঘটনাটি সামাল দিতে পেরেছে। কারণ হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেননি। বাইডেনের প্রেসিডেন্সি মেনে নেননি। ভাইস প্রেসিডেন্ট মেনে নিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প এখনও মনে করে সে জিতেছে এবং এক জরিপে দেখা গেছে, তার সমর্থকদের ৬০ শতাংশই মনে করে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জিতেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো লেখা, বক্তৃতা কিংবা বিবৃতিতে কখনোই সে নির্বাচন মেনে নেওয়ার কথা বলেনি। এই ঘটনার সাথে আমাদের দেশের কি খুব বেশি অমিল? আমাদের দেশেও তো তা-ই হয়। হেরে গেলে বিরোধী দল মেনে নেয় না। আমেরিকায় তো সেটিই হয়েছে। তারপর ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। তারপর এখন কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার সাপ্রেসান অ্যাক্ট হচ্ছে। এগুলো প্রকাশ পায় না, কেননা আমেরিকার প্রাচুর্য আছে। তার যেহেতু প্রচুর পয়সা আছে, ধনদলৌত আছে, সেজন্য সে এগুলোকে সহজেই সামাল দিতে পারে। এরা হলো আমাদের গ্রামের মাতবরদের মতো। গ্রামে পয়সাওয়ালা মাতবররা থাকেন না, যারা পয়সাপাতির জোরে যা মনে চায়, তা-ই বলেন। করেন। তার সব ভুলই ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা হয়। তার সব দোষ মাফ।
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর বলে একটি মিথ চালু আছে। তাদের গণতন্ত্র নাই। এখন ভোটার সাপ্রেসান অ্যাক্ট হচ্ছে। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গরা যাতে ভোট না দিতে পারে তার জন্য সবরকম প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তারা ছিদ্রান্বেষীদের মতো খুঁজে খুঁজে ছিদ্র বাহির করছে কিভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট থেকে দূরে রাখা যায়। ফলে তাদের কার্যক্রম নিয়ে এতো সিরিয়াস হওয়ার তেমন কিছুই নেই।