ইনসাইড থট

ভাষা আন্দোলন ও বাংলাভাষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮:২৮ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১


Thumbnail

১. ভূমিকা

উনিশশ’ নব্বইয়ের দশকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। নগ্নপায়ে প্রভাত ফেরী করে, শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আলোচনা শুনতাম, কখনও অংশ নিতাম। একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা গান-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’ যা ভাষা চেতনাকে উজ্জীবিত করতো। এরপর আলোচনায় আসতো ভাষা শহীদদের নাম-সালাম, বরকত, রফিক,শফিক, জব্বার..., অতঃপর ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের নাম-এডভোকেট গাজীউর হক, আব্দুল মতিন সহ আরো অনেক নাম, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নাম কেউ বলেনা। সে সময় বুঝতে পারিনি এর কারণ কী।

১৯৯০ সালে এরশাদের পতন হলে দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৯১ এর নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। আরো ৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তিনি হন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় থেকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস দেশবাসি জানতে পারেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যার পর এদেশে বিকৃত ইতিহাস চর্চার পত্তন শুরু হয়। কিন্তু ইতিহাসের সত্য হলো তাকে মুছে ফেলা যায় না, সাময়িকভাবে ধামাচাপা দেয়া যায় মাত্র। তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যে কোন ঐতিহাসিক ঘটনায় ফিরে আসেন বারবার।

২. বাংলা ভাষা আন্দোলন: পিছন ফিরে দেখা
যে কোন আন্দোলনে ৩টি অবস্থা থাকে-
ক) যৌক্তিকভাবে আন্দোলনের প্রেক্ষিত তৈরি করা
খ) আন্দোলনের সময় সেটি দক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে পরিচালনা করা
গ) আন্দোলনে বিজয়ী হবার পর তার ফল কাজে লাগানো

বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে অনেক আগে থেকেই। মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০) তাঁর ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় মাতৃভাষা নিয়ে যে কথা বলেছেন তাই যেন ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষা প্রেরণা। কবি বলেন-
‘...যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুরায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।...’

ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যক্ষভাবে না পাওয়ার কারণ হলো আন্দোলনের যৌক্তিক প্রেক্ষিত তৈরি করার কারণে তিনি তখন কারাগারে ছিলেন। কিন্তু কারাগারে তিনি চুপচাপ বসে থাকেননি, আমরণ অনশন করে পাকিস্তানী জান্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর লিখিত ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে এর একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন- 
‘... তারপর ১৯৪৮-এ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র থাকাকালীন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের উপর কার্জন হলের সমাবর্তন সভায় বঙ্গবন্ধু এবং টাঙ্গাইলের সামসুল হক সাহেব সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘না,উর্দু নয়,বাংলাই হবে রাষ্ট্রভাষা’ যার জন্য তাকে সে সময়ই কারাবরণ করতে হয়েছিল। সরকার থেকে বলা হয়েছিল, ‘যদি ভবিষ্যতে শেখ মুজিব রাজনীতি করবে না এই মর্মে মুচলেকা লিখে দেয়,তবেই তাকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তিনি আইন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে মুচলেকায় স্বাক্ষর দিতে সম্মত না হওয়ায় তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল।

যখন বাংলার স্থলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার গভীর চক্রান্ত শুরু হয় তখন বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের সংগঠিত করে শুরু করেছিলেন ভাষার জন্য আন্দোলন। পাকিস্তানের জনক অপ্রতিরোধ্য জিন্নাহ সর্বপ্রথম এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়েছিলেন প্রতিরোধের সম্মুখীন। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুকে সেদিন আজীবন ‘রাসটিকেট’ করা হয়েছিল এবং ১৯৪৯-এ তাকে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ পর্যন্ত একনাগাড়ে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।

১৯৫২-তে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু তখন ভাষার জন্য কারাগারে বসে শুরু করেছিলেন আমরণ অনশন। ফলে ১৯৫২-র মার্চের প্রথম সপ্তাহে অনন্যোপায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী মৃতপ্রায় অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে স্টেচারে করে মুক্তিদানের নামে ফেলে রেখে গিয়েছিল আমার মা এবং দাদীর কাছে।’ (শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব আমার পিতা, পৃ. ৭৯-৮০)

ওপরের ঘটনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে ভাষা আন্দোলনে কী মাত্রায় নিগৃহীত হয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

৩. দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে যোগ দেন এবং অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এজন্য মুসলিম লীগ সরকার তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। জোরালো আন্দোলন এবং অনশন ধর্মঘটের কারণে জেল কর্তৃপক্ষ তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পূর্বে ভারত, পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময় কলকাতায় হিন্দু মুসলিম ভয়ানক দাঙ্গা হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহিত হয়। সম্মেলনের কমিটিতে গৃহিত প্রস্তাব পাঠ করেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন যার মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন। এসময় তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং দারিদ্র, বেকারত্ব ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য এটিকে একমাত্র সমাধান মনে করতে থাকেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গণ-পরিষদের অধিবেশনে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তাঁর এই বক্তব্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদী শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে মুসলি লীগের এই পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। একই বছরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রনেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হয় যেখানে শেখ মুজিবর রহমান একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এখান থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয় ভবনের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং অন্য ছাত্র নেতাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। এদের মুক্তি উপলক্ষে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় এক র‌্যালি ও সভা হয় যাতে শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন। পুলিশ এই র‌্যালি অবরোধ করেছিল। পুলিশী কার্যক্রমের প্রতিবাদে শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ তারিখে দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। এ ছাড়াও তিনি ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তারিখে তাকে আবার আটক করা হয় এবং তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন। উল্লেখ্য যে, ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট তার হৃত ছাত্রত্ব (ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়) ফিরিয়ে দেয়া হয়।

১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে আবার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবী আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন যার জন্য তাঁকে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জরিমানা করে। কিন্তু তিনি এই জরিমানাকে অবৈধ ঘোষণা করে তা প্রদান থেকে বিরত থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ এপ্রিল মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী শামসুল হক টাঙ্গাইলে একটি উপ-নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন। শেখ মুজিব তার সেই আন্দোলনের সফলতার জন্য উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনের ধর্মঘট করেন, এসময় তাকে আবার আটক করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিশ^বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান। 

৪. ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও চক্রান্ত

ভাষা আন্দোলনকে ব্যর্থ করার জন্য নানারকম চক্রান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। বাংলা ভাষার আন্দোলন সাধারনভাবে শুধু ভাষারই আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল বাঙালির স্বাধীকার ও অস্তিত্বের আন্দোলন। এই আন্দোলকে ব্যর্থ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়েছিল। তাঁকে ভুল বুঝিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এ সময় ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধু, কারণ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিবৃতি বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠাকে কঠিন করে তুলতো।

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে ‘খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থে চমৎকার বর্ণনা রয়েছে-‘জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। সোহরাওয়ার্দী এই অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর এই মত পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর সমর্থন আদায় করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন, ‘ সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ওই বছর জুন মাসে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তাঁর কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবীর সমর্থনে তাঁকে একটি বিবৃতি দিতে বলি।’ (বদরুদ্দিন ওমর, পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ৩য় খন্ড, পৃ. ৩৯৬).

বাংলা ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর দরদ ও অসীম রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ফলশ্রুতিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন দিয়ে বিবৃতি দেন। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মাওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ বাংলা ভাষার পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, আওয়ামীলীগের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।’ শেখ মুজিবুর রহমারে মত দূরদর্শী নেতার দ্বারাই সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন,-‘একথা তো আমি বলি নাই। উর্দু ও বাংলা দুইটা হলে আপত্তি কি? এ কথাই বলেছিলাম।’ (উৎস: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

বাংলা ভাষা ও বাংলালিপির সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যাপারে শেখ মুজিবের একটি বক্তব্য প্রসঙ্গে মাহফুজা খানম সম্পাদিত মাসিক নওবাহার পত্রিকায় ১৩৮৯ বাংলা সনের চৈত্র সংখ্যার এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়,‘আমরা এই ভাষা সমস্যা সমাধানের ভার অধ্যাপক আবুল কাশেম এবং শেখ মুজিবুর রহমানের উপর ন্যাস্ত করছি।’

২৭ এপ্রিল ১৯৫২ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সুদীর্ঘ আড়াই বছর কারাভোগের পর প্রথম বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন-,‘জনগণের নায্য দাবীপ্রসূত আন্দোলনকে সরকার রাষ্ট্রের দুশমন ও এজেন্টেদের আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সরকারকে চালেঞ্জ দিয়ে বলেন, কারা রাষ্ট্রের দুশমন এর উপর গণভোট হউক। আমার বিশ্বাস, শতকরা ৯০ ভাগ ভোট আমাদের অনুকূলে দেওয়া হবে। তাঁর মতে, রাষ্ট্রভাষা সমস্যার সমাধান গণভোট মারফত অতি সহজেই হতে পারে।’

৫. ভাষা আন্দোলন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্নমূল্যায়ন

ইতিহাস তার বরপুত্রদের যোগ্য স্থান দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলার পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর অববাহিকায় পলিসমৃদ্ধ উর্বর মাটিতে একটি স্বাধীন দেশ চেয়েছিলেন, যারা বাংলায় (বাংলা ভাষায়) কথা বলবে, নদীর জলে গোসল করে মাছ-দুধ দিয়ে পেট ভরে ভাত খাবে, আব্বাস উদ্দিন-আব্দুল আলিমের ভাটিয়ালি-পল্লিগীতি গাইবে, রবীন্দ্র সংগীতের সুরের মূর্ছনায় ঘুমুতে যাবে, নজরুলের চেতনায় জেগে উঠবে, জসিমউদদীনের পল্লিবালক হয়ে মাঠে কাজ করবে,জীবনানন্দের কবিতায় দেশপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে দেশকে ভালবাসবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনে নিজের ভূমিকা ও তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহ নিজেই মূল্যায়ন করে জেলখানায় বসে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ (৮ ফাল্গুন) ডায়েরীতে যে সব কথা লেখেন তা ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল। তিনি লিখেন-, ‘আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ঠিক পনের বছর আগে সেদিন ছিল ১৩৫৮ সালের ৮ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার, ইংরেজি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বীরসন্তান: ১। আবদুস সালাম, ২। আবদুল জব্বার, ৩। আবুল বরকত, ৪। রফিকউদ্দিন, আহত হয়েছিলেন অনেকেই। ঠিক পনের বছর পূর্বে এইদিনেও আমি জেলে রাজবন্দি ছিলাম ফরিদপুর জেলে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করি। জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানেই ছাত্রনেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশন করব আর ২১ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিবস পালন করা হবে বলে স্থির করা হয়। আমাকে আবার জেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো চিকিৎসা না করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি আমাকে ও মহিউদ্দিনকে ফরিদপুর জেলে চালান দেওয়া হলো। মহিউদ্দিনও আমার সাথে অনশন করবে স্থির করে দরখাস্ত দিয়েছিল।

আজ ঠিক পনের বছর পরেও এই দিনটাতে আমি কারাগারে বন্দি।
প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আব্দুল ওয়াদুদসহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়। ১৫ই মার্চ জনাব নাজিমুদ্দিন (তখন পূর্ব পাকিস্তান এর চীফ মিনিস্টার ছিলেন) সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করে ঘোষণা করলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান আইন সভা হতে প্রস্তাব পাশ করাইবেন বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে’। সব বন্দিকে মুক্তি দিবেন এবং নিজেই পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত করবেন। ওই দিন সন্ধ্যায় আমরা মুক্তি পাই।

১৬ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সভা হয়, আম সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকেলে আইন সভার সামনে লাঠিচার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, ‘নাজিমুদ্দিন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুড়িশিয়াল তদন্ত করতে হবে।’ ২১ মার্চ বা দুই একদিন পরে কায়েদে আজম সাহেব প্রথম ঢাকায় আসবেন। সেইজন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলো। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ ছাত্ররা তার সামনেই কনভোকেশনে প্রতিবাদ করলো। রেসকোর্স ময়দানেও প্রতিবাদ উঠল। তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন এরপরে কোনদিন ভাষার ব্যাপারে কোন কথা বলেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রত্যেক বছর ১১মার্চকে ‘ভাষা দিবস’ পালন করেছে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ (এখন আওয়ামী লীগ) এই একই দিনে ‘ভাষা দিবস’ পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অবদান সবচেয়ে বেশি। পরে ইয়ুথ লীগও আন্দোলনে শরীক হয়েছে।

১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা আইন সভায় করেছিলেন, ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তা ভেঙ্গে পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে’। তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠল। আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। কারণ ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাজেট সেশন শুরু হবে। আমি ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করবো মুক্তির জন্য। কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহম্মদ, আব্দুল ওয়াদুদ ও আরো অনেকে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করতো।

তখন জনাব নূরুল আমিন মূখ্যমন্ত্রী। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি হলো। আমার ভাইরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার দাবী প্রতিষ্ঠা করলো। এইদিন আমাদের কাছে পবিত্র দিন। ১৯৫৫ সালে নূতন কেন্দ্রীয় আইন সভায় আওয়ামীলীগ ১২ জন সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। আওয়ামীলীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করলো। ১৯৫৭-৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারিভাবেও পালন করা হয়েছে। শহীদ মিনার করার জন্য পরিকল্পনা করে বাজেটে টাকা ধরে কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারী হওয়ার পরে এই দিনটি ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়ল, আর মিনারটা চুনকাম করেই শেষ করে দেওয়া হলো।

আমি কারাগারের এই ছোট্ট ঘরটি থেকে আমার আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই বাংলার যুব সমাজ ও জনগণকে, আর শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি।

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মজহারুল হক (বাকী) জামিন নিয়ে এতদিন জেলের বাইরে যেতে পারে নাই। আজ সকালে তাকে কোর্ট পাঠাইয়া দিয়েছে। জেলহাজত থেকে মুক্তি পেয়ে শহীদ দিবস পালন করছে।’(কারাগারের রোজনামচা,পৃ.২০৫-২০৭)

৬. ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান

১৯৫৫ সালের ৫ জুন শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান গণপরিষদের কার্যক্রমে বাংলাভাষা ব্যবহারের দাবী তুলে যে ভাষণ দেন তাতে তিনি উল্লেখ করেন-‘ অন্য কোন ভাষা জানি কি জানি না তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমরা এখানে বাংলাতে কথা বলতে চাই। যদি আমাদেরকে অনুমতি না দেওয়া হয়, তবে আমরা হাউজ পরিত্যাগ করবো। বাংলাকে অবশ্যই হাউজে গ্রহণ করে নিতে হবে-এটাই আমাদের স্ট্যান্ড।’

১৯৫৫ সালের ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদেও দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবী জানান। বঙ্গবন্ধু আইন সভায় বলেন-‘...I would like to say that our interpretation is that if forms official records and when the orders of Day were issued in English and Urdu it should also have been isuued in Bengali.’

একই সালের ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে খসড়া শাসনতন্ত্রের অর্ন্তগত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সর্ম্পকে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবী এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক।’

১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আইন সভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবী জানান। বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে পাকিস্তান গণপরিষদে তখনকার তরুননেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,-‘ They want to place the word East Pakistan instead of East Bengal. We have demanded so many times that you should make East Bengal. The word Bengal has a history, has a tradition of its own…what about the state language Bengali.What about joint electorate. What about autonomy?... I will here and speak in Bengali and nobody can prevent me from doing that.’
(এমআর মাহবুব, জনক, বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পরিষদ, আগস্ট, ২০০৯, পৃ. ১২৫-১৩৯ এর আলোকে অনুলিখন)

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তা বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে এক বিরল সম্মান এনে দেয়। তাঁর ভাষণের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো-

‘জনাব সভাপতি,
আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমাদের এই অঙ্গীকারের সাথে শহীদদের বিদেহী আত্নাও মিলিত হইবে। ইহা বিশেষ আনন্দের ব্যাপার যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা সভাপতি থাকাকালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেওয়া হইয়াছে। 

জনাব সভাপতি, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্যের ব্যাপারে আপনাদের মূল্যবান অবদানের কথা আমি স্মরণ করিতেছি। যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্ব-সমাজে স্থানলাভ করিয়াছে, এই সুযোগে আমি তাঁদেরকেও অভিবাদন জানাই। বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনদানকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংহতকরণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় বাংলাদেশকে যাঁহারা মূল্যবান সাহায্য দিতেছেন, তাঁহাদেরকেও আমরা ধন্যবাদ জানাই। জাতিসংঘে যাঁহারা আমাদের স্বাগত জানাইয়াছেন, তাঁহাদেরকে আমি বাংলাদেশের পক্ষ হইতে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।...

বাংলাদেশ প্রথম হইতেই ‘শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত’¡ এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে। কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করিতে আমাদেরকে সক্ষম করিয়া তুলিবে এবং সক্ষম করিয়া তুলিবে দারিদ্র, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য আমাদের সকল শক্তি ও স¤পদকে সমাবেশ ও কেন্দ্রীভূত করিতে। এই ধারণা হইতে জন্ম নিয়াছে শান্তির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি। এই জন্য সমঝোতার অগ্রগতি, উত্তেজনা প্রশমন, অস্ত্র সীমিতকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা সহ বিশ্বের যে কোনো অংশে যে কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হউক না কেন, আমরা তাহাকে স্বাগত জানাই। এই নীতির প্রতি অবিচল থাকিয়া আমরা ভারত মহাসাগরীয় এলাকা স¤পর্কে শান্তি এলাকার ধারণা, যাহা এই পরিষদ অনুমোদন করিয়াছে, তাহাকে সমর্থন করি। আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তি, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ এলাকায় পরিণত করার প্রতিও সমর্থন জানাই।

জনাব সভাপতি, মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো যেইসব দেশ সংগ্রাম ও আত্নদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্ব-নির্ভরতা। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স¤পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকান্ডকেও সহজতর করিবে, ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটিতেছে। আমাদের নিজেদের শক্তির উপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদেরকে গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।’ 
(বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, খন্ড ২, বাংলা একাডেমি, ২০০৮)

৭. উপসংহার

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণের পর এর চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। পরবর্তীকালেও তিনি বাংলা ভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারে সেই একই দাবী ও কথাগুলো আরো বর্ধিত উচ্চারণে জাতির ও বিশ্ব ফোরামে তুলে ধরতে সক্ষম হন।

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের সফল,সার্থক ও যোগ্য নেতা ছিলেন বলেই ভাষা সমস্যার ভার তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছিল। এই মহান নেতা বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় ও বাংলা ভাষাভাষীদের আন্তর্জাতিক অঙ্গণে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ। ১৯৯৯ সালে মাতৃভাষাপ্রেমী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক জাতিসংঘে বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা করার উদ্যোগ গ্রহণ-এ সবই বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী চিন্তার বাস্তব রূপায়ণ।’ (খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু, পৃ.৭৭)

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক
সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশই দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ


Thumbnail

দেশের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করা হয়। আজ এ কমিউনিটি ক্লিনিকের ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ নিয়ে লিখেছেন দেশবরেণ্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ, কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী

বাংলাদেশের জন্য আজকের দিনটি অনন্য, অসাধারণ। আজকের দিনটিকে আমি মনে করি, প্রান্তিক মানুষের বিজয়ের দিন। জনগণের ক্ষমতায়নের দিন। আজ কমিউনিটি ক্লিনিকের ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

এপ্রিল মাস বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭ এপ্রিল জাতির পিতার নির্দেশে এবং তার নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, সে দিকনির্দেশনা বাস্তবায়ন করে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান জাতীয় চার নেতা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ক্ষুধামুক্ত সাম্যের বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর সেজন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার জায়গা হলো অসাম্প্রদায়িক, সাম্য এবং বঞ্চনামুক্ত বাংলাদেশ। আর এ এপ্রিল মাসেই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল। এপ্রিল মাস বাংলাদেশের জন্য আরেকটি চেতনার পতাকা বহন করে চলেছে। তা হলো, এই এপ্রিলেই দেশের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল গিমাডাঙ্গায় কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এবং সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবার অনন্য মডেল হিসেবে পরিচিত এবং স্বীকৃত কমিউনিটি ক্লিনিক তার অভিযাত্রা শুরু করেছিল। আমি এ কারণেই মনে করি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার অভিযাত্রা বা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভিযাত্রা যেমন এপ্রিল মাসে, তেমনি প্রান্তিক মানুষের অধিকার এবং জনগণের ক্ষমতায়নের পূর্ণতার বৃত্ত পূরণ এ এপ্রিল মাসেই হয়েছিল। এ কারণেই আমি আজকের দিনটিকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ মনে করি। দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মূল দর্শন হলো জনগণের ক্ষমতায়ন। আর এ দর্শনটি তিনি আত্মস্থ করেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন চেয়েছিলেন জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে। জনগণের সাম্যতা এবং ন্যায্যতার জন্য তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। আর সে কারণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে তিনি একটি শান্তি, প্রগতিশীল এবং উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিনির্মাণের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু রূপ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। জাতির পিতা চেয়েছিলেন স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে। আর এ কারণেই তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক নীতিমালা-সংক্রান্ত অংশে স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু জাতির পিতার এ স্বপ্নযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ওইদিন শুধু জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছিল বাঙালির স্বপ্ন, বাঙালির অগ্রযাত্রা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশের অন্ধকার যাত্রা শুরু হয়েছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকেই। আর এ অন্ধকার যাত্রাকে থামাতে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন তিনি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।

২০২৩ সালের ১৭ মে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি অর্জন আসে। জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’। এটি বাংলাদেশের জন্য গৌরবের।

কমিউনিটি ক্লিনিক যেমন শেখ হাসিনার একটি উদ্যোগ বা ইনিশিয়েটিভ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তেমনি আজকের যে বাংলাদেশ ক্ষুধা, দরিদ্রমুক্ত, স্বনির্ভর, উন্নয়নের রোলমডেল বাংলাদেশ, সেটিও দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ। আজকে বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনা সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব আজ কল্পনাও করা যায় না। শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের এ অভিযাত্রা কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি। দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করেননি, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি একজন দক্ষ নির্মাতা বটে। আর এ কারণে তিনি বাংলাদেশকে এমন এক উন্নয়নের রোল মডেল বানিয়েছেন, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তার অধিকারগুলো পাচ্ছে, জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটছে। জনগণের ক্ষমতায়ন এবং প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রাপ্তির এক অসাধারণ মডেল হলো বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। এই কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে অনেক নীরব বিপ্লব বাংলাদেশে ঘটেছে, আমি সেদিকে সামান্য একটু আলোকপাত করতে চাই।

প্রথমত কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে এই প্রজাতন্ত্রের মালিক যে জনগণ তা স্বীকৃত হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল এমন একটি মডেল, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। জনগণ জমি দিচ্ছে আর সরকার ভবন নির্মাণ করছে। জনগণ দেখছে যে, তারা সেবা পাচ্ছে কি না। জনগণের কাছে কমিউনিটি ক্লিনিকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কমিউনিটি গ্রুপগুলো জনগণের ক্ষমতায়নের ছোট ছোট বাতিঘর। দ্বিতীয়ত এ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তৃতীয়ত এ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার এক নতুন দর্শন তৈরি করা হয়েছে। রোগ প্রতিরোধই যে একটি সুস্থ জাতি গঠনের অন্যতম পূর্বশর্ত, সেটি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। আর এ কারণেই গত বছর ১৭ মে জাতিসংঘে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেলটি ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত হয়েছে। শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক মডেলটি ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ নয়, বাংলাদেশের বদলে যাওয়া, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা, বাংলাদেশের অভাবনীয় এ উন্নতির মূল উদ্যোক্তা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজকের যে বাংলাদেশ তা হলো ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’। আমরা যদি বাংলাদেশর উন্নয়ন কাঠামো লক্ষ্য করি, তাহলে সবচেয়ে যেটি বিস্ময়কর ব্যাপার তা হলো, বাংলাদেশে সমন্বিত উন্নয়ন বাস্তবতা চলছে। একদিকে যেমন অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের কথা বলছি, দেখছি; তেমনি বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বেড়েছে। বাংলাদেশ একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অন্যতম শর্ত হলো, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে যেমন কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য অধিকার এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করছেন, অন্যদিকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের আবাস্থলের নিশ্চয়তাও দেওয়া হচ্ছে।

সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে একটি সুবিন্যস্ত উন্নয়ন পরিকল্পনা করছেন। যে উন্নয়ন পরিকল্পনাই কেউই বাদ যাবেন না। আর বাদ না যাওয়ার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল উদ্যোক্তা হলেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তিনি এমন একটি উন্নয়ন মডেল বাংলাদেশে তৈরি করেছেন, যে উন্নয়ন মডেলের মাধ্যমে সব মানুষ উন্নয়নের সুবিধা পাবে এবং বৈষম্য দূর হবে। আমি মনে করি, কমিউনিটি ক্লিনিক শেখ হাসিনা যেভাবে বাংলাদেশ তৈরি করতে চান তার একটি প্রতিরূপ। সারা বাংলাদেশে সাম্য, ন্যায্যতা এবং সবার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নীরব বিপ্লব চলছে। আর সেই নীরব বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে। আমরা জানি যে, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন যে, তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবেন। স্মার্ট বাংলাদেশ মানে কী? স্মার্ট বাংলাদেশ মানে হলো এমন একটি আধুনিক, প্রগতিশীল এবং উন্নত বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশের সব নাগরিক সমান অধিকার পাবে। সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে এবং দুর্নীতিমুক্ত একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। যেটি বাংলাদেশের সব মানুষকে সুখী এবং সমৃদ্ধ করবে। আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে যদি প্রতিটি গ্রামকে যদি স্মার্ট গ্রাম করতে পারি, আধুনিক করতে পারি, সুখী করতে পারি এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে যদি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে সারা বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে বিনির্মিত হবে।

কাজেই কমিউনিটি ক্লিনিক যেমন বাংলাদেশকে স্মার্ট করতে পারে তেমনি ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের চাবি। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে আরও উন্নত করা এবং স্বপ্নের সোনার বাংলার চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর সে কারণেই কমিউনিটি ক্লিনিক দিবসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমি মনে করি, ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ আমরা যদি হৃদয়ে ধারণ করি, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা কী চান, তিনি কী ভাবেন, মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি কী কী কাজ করতে চান, সেটি যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি এবং তার নীতি এবং চিন্তার প্রতি আমরা যদি সৎ থাকি, আদর্শবাদ থাকি, তাহলে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া রূপ আরও বিস্তৃত হবে, বাংলাদেশ সারা বিশ্বে একটি রোলমডেল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হবে। আর এ কারণেই কমিউনিটি ক্লিনিক দিবসকে আমরা ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছি।


দ্য শেখ হাসিনা   ইনিশিয়েটিভ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বিসিএস পরীক্ষার জন্য ছোট বেলা থেকেই প্রস্তুতি প্রয়োজন


Thumbnail

১৯৯৮ সাল। বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকুরী করি। স্থানীয় চাইনিজ রেস্তোরাতে একটি সেমিনার হবে। ঢাকা থেকে ওষুধ কোম্পানির এক কর্মকর্তা এসেছেন। তিনি একই মেডিকেলে আমার এক বছরের সিনিয়র। বেশ খাতিরের বড় ভাই। তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে একটি যন্ত্র বের করলেন। যন্ত্রটি অন করার পর দেখি সেটি একটি কম্পিউটার। কোন তার ছাড়া কম্পিউটার।  জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কি জিনিস এটা, নাম কি ? বললেন, ল্যাপটপ। জীবনে এই প্রথম আমার ল্যাপটপ দেখা। তবে নাম শুনেছি এর তিন বছর আগে, ১৯৯৫ সালে। যখন নাম শুনেছি, তখন বুঝিনি জিনিসটা কি ?

১৯৯৫ সালে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দেই, ১৭তম বিসিএস। জীবনে একবারই এই পরীক্ষা দেই। উত্তীর্ণ হই। সাড়ে আট বছর চাকুরী করেছি, ছেড়েও দিয়েছি । সে অন্য প্রসঙ্গ। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন ছিল, ল্যাপটপ কি ? অপশন ছিল- ছোট কুকুর, পর্বতারোহন সামগ্রী, বাদ্যযন্ত্র ও ছোট কম্পিউটার। উত্তর কি দিয়েছিলাম তা মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে, আমি উত্তরের জায়গায় ছোট কম্পিউটারে টিক দেইনি। জীবনে যে জিনিসের নামই শুনিনি তাতে টিক দেই কেমনে ? সেকালের কোন গাইড বইতে এ ধরণের কোন প্রশ্ন বা তার উত্তর নেই বলে শুনেছি। পরীক্ষার্থীদের প্রায় ৯৯ ভাগ সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। গাইড পড়ে এ ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। তবে যারা আধুনিক প্রযুক্তি বা অনাগত প্রযুক্তি সম্পর্কে ধ্যান ধারণা রাখে তারা সঠিক উত্তর দিয়েছিল।

ঘটনাটি মাথায় এলো সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও দেখে। সেখানে দেখলাম হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী হুড়োহুড়ি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ঢুকছে। শুনলাম তারা আসন্ন বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিবে। ভিডিওটি আবার দেখার জন্য গুগলে অনুসন্ধান করলাম- 'ঢাবি লাইব্রেরিতে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের ভিড়'। সেখানে দেখি শত শত খবর। প্রতি বছর নাকি এমনটি হয়। লাইব্রেরিতে ঢুকতে হুড়োহুড়ি। পরীক্ষার আগে নাকি সেখানে এমন যুদ্ধ চলে। বিসিএস কি দু এক মাস বা দু এক বছরের প্রস্তুতির ব্যাপার ? একবার পরীক্ষা দিয়ে আমার কাছে তা মনে হয়নি। আমার মতে, এর জন্য সমগ্র শিক্ষা জীবন ধরে প্রস্তুতি প্রয়োজন। এটি আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। আমার সাথে অনেকেই একমত নাও হতে পারেন।

ছোট কাল থেকে নিয়মিত অধ্যাবসায়ের পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদপত্র পড়া প্রয়োজন। জগৎ সংসার, দেশ বিদেশ, বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ভূগোল, খেলাধুলা বিষয়ে খোঁজ খবর রাখা দরকার। কোন একটি দেশি বা বিশ্ব ইভেন্ট চলছে। সেটি চলাকালে দৈনন্দিন খোঁজ খবর রাখার পাশাপাশি ওই ইভেন্টের অতীত জেনে নিলেন। কবে থেকে ইভেন্টটি চলছে, কোথায় সেটি শুরু হয়েছিল, সেটি জেনে নিলেন। নিয়মিত সংবাদপত্র পড়লে বা টিভি সংবাদ দেখলে সেগুলি আপনা আপনি জেনে যাবেন।

তবে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য একটু প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। আমি নিয়েছি এক সপ্তাহের। তাও ইন্টার্নি চলাকালে ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে। আপনি এর জন্য সর্বোচ্চ এক মাস বরাদ্ধ রাখতে পারেন। বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস অংশে কিছু সাল মনের মধ্যে গেঁথে নেয়ার জন্য গাইড বইটি একটু চোখ বুলাতে পারেন। যে সব বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো একটু দেখতে পারেন। অংকের ফর্মুলা গুলো একটু ঝালাই করে নিতে পারেন। সমসাময়িক বিশ্ব বিষয়ে অনেকের দুর্বলতা থাকে। সংবাদপত্রের এ অংশটুকু প্রায়ই এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ অধ্যায়টিও দেখে নিতে পারেন। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে যদি এর চেয়েও বেশি সময় প্রয়োজন হয়, তাহলে বুঝতে হবে আপনার দুর্বলতা অনেক। বিসিএস পরীক্ষার জন্য ছোট বেলা থেকে আপনার প্রস্তুতি নেই। সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। লেখকঃ প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

মতিউর রহমানই প্রথম আলো বিক্রির প্রধান বাঁধা?


Thumbnail

দেশের শীর্ষ স্থানীয় গণমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ বিক্রির বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য টাউন’। বাংলাদেশের বিভিন্নি গ্রুপ কোম্পানি এই প্রতিষ্ঠানটি কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছে বলেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদক মতিউর রহমানের এতে শেয়ার রয়েছে। তিনিও প্রতিষ্ঠানটির মালিক। মালিকানা থাকলেও এখন মতিউর রহমান তার সম্পাদক পদটা নিশ্চিত করতে চান। সেজন্য তিনি কর্ণফুলী গ্রুপের কাছে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করার জন্য খুব আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন বাস্তব কারণে কর্ণফুলীগ্রুপের কাছে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির বিষয়টিতে রাজি হয়নি বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

শুধু কর্ণফুলী গ্রুপই নয়, প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করতে স্কয়ার গ্রুপের সাথেও বেশ অগ্রসর হয়েছিলেন মতিউর রহমান। এর মধ্যে বসুন্ধারাসহ আরও কয়েকটি গ্রুপ এতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আমার জানা মতে সর্বশেষ এস আলম গ্রুপ এই প্রতিষ্ঠানটি কেনার জন্য বেশ অগ্রসর হয়েছে এবং তারাই এখন সবচেয়ে অগ্রগামী। কিন্তু এস আলম গ্রুপ কেনার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। কারণ উনি দেখছেন যে, একমাত্র কর্ণফুলী ছাড়া অন্য যে কোন গ্রুপে গেলে তার সম্পাদক পদের নিশ্চয়তা নেই।

তবে ধারণা করা হচ্ছে, যারাই ‘প্রথম আলো’ প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় করুক না কেন, তারা মতিউর রহমানকে প্রথম দিকে রাখলেও পরবর্তীতে তারা পরিবর্তন করবে। যদি প্রথম আলোতে কেউ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন, আমার ধারণা আনিসুল হক আসতে পারেন। কারণ আনিসুল হক সবার কাছে যেমন সম্মানিত তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

‘প্রথম আলো’ প্রতিষ্ঠানটি যদি এস আলম গ্রুপ কিনে নেয় তাহলে প্রধান বাঁধা হবে মতিউর রহমান। কিন্তু তার বাঁধা টিকবে না। কারণ কোন প্রতিষ্ঠানের যদি ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ‘প্রথম আলো’ নিজেদের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের ফলে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে চরম দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। সাধারণত যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে তারা দেখবে। সরাসরি না হলেও প্রথম আলোর মতিউর রহমান এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেছেন। যদিও মতিউর রহমান বিভিন্নিভাবে বিষয়টি প্রকাশ করে বুঝাতে চেষ্টা করছেন যে, এতে উনার কোন আগ্রহ নেই। 

তবে এর আগে থেকেই কিছু গণমাধ্যমে এসেছিল যে, মতিউর রহমন ও ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনাম এই দ্বন্দ্বে জড়িত রয়েছেন। যদিও বিষয়টি তাদের মধ্যকার বিষয়। কিন্তু এখন প্রথম আলো বিক্রিতে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন মতিউর রহমান। অচিরেই এই বাঁধা অতিক্রম করে ‘প্রথম আলো’ বিক্রি হবে এবং প্রতিষ্ঠানটি কিনবে এস আলম। কারণ এস আলম একজন বিচক্ষণ ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসাতেই যুক্ত হচ্ছেন ব্যর্থ হচ্ছেন না। বরং সফল হচ্ছেন।

‘প্রথম আলোর’ কেনার জন্য দেশে যেসব কর্পোরেট হাউজগুলো আছে তাদের অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে। তবে এক একজনের আগ্রহ একেক কারণে। কেউ চান প্রথম আলোর জনপ্রিয়তা ও অভিজ্ঞ জনবলের কারণে, আবার কিছু কর্পোরেট হাউজের ইচ্ছে হলো ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্ব একেবারে কমিয়ে আনা। এসব বিভিন্ন কারণে আগ্রহ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

তবে আমার বিশ্বাস প্রথম আলো বিক্রিতে যে প্রধান বাঁধা মতিউর রহমান। তার বাঁধা টিকবে না। অবশেষে প্রতিষ্ঠানটি একটা কর্পোরেট হাউজের হাতেই যাবে। আমার ধারণা মতে, এস আলম গ্রুপই প্রথম আলোকে কিনতে সক্ষম হবে। আমরা হয়ত কয়েক মাসের মধ্যেই দেখব যে, প্রথম আলোর নতুন মালিক হিসেবে আরেকটি কর্পোরেট হাউজ এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথম আলোতে বর্তমানে যারা অভিজ্ঞ সাংবাদিক আছেন যারা শিক্ষিত তাদেরকে ইতোমধ্যে অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞ লোকদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। 

আমার ধারণা, এ পর্যায়ে প্রথম আলো বিক্রি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এমনকি মতিউর রহমানের চেষ্টাও সফল হবে না। তবে আমার সবসময়ের আকাঙ্খা, সংবাদপত্রের সাথে যারা জড়িত তাদের চাকরি যেন অবশ্যই নিশ্চয়তা থাকে। কারণ এরা দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, নিজেদেরকে একটা পর্যায়ে এনেছেন আর এদের চাকরি অবশ্যই থাকতে হবে এবং তাদের যে মেধা, সেই মেধা থেকে জাতি যেন বঞ্চিত না হয়।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

এক বছরের রাষ্ট্রপতির যত অর্জন


Thumbnail

আজ ২৪ এপ্রিল। গত বছর এই দিনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সে হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আজ এক বছর পূর্ণ হল। অঙ্কের হিসেবে এক বছর সময় অনেক কম মনে হলেও এই সময় তিনি সেরা সাফল্য অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন যে সময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন সে সময়টা ছিল নির্বাচনী বছর। বাংলাদেশে নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে কিনা, দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে ইত্যাদি নানা রকম শঙ্কা ছিল অনেকের মধ্যে। দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রপতির প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচন বিষয়টি যদিও নির্বাচন কমিশনের কাজ। কমিশন এটা আয়োজন করে থাকে। কিন্তু এর পিছনে আসল কাজটি করেছেন রাষ্ট্রপতি।

দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা এবং সেটাকে দেশে-বিদেশি সবার কাছে যোগ্য করে তোলার আসল কাজটি করতে হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে। এই কাজটি রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেষ পর্যন্ত খুব ভালো ভাবে এবং সফল ভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন। গত এক বছরে এটিই এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির সেরা অর্জন বা সেরা সাফল্য বলে আমি মনে করি। রাষ্ট্রপতি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ভাবে না করতে পারতেন তাহলে দেশের গণতন্ত্র এক বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়ত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সেটি ভালো ভাবে সামাল দিতে পেরেছেন। আমাদের গণতন্ত্র রক্ষা পেয়েছে, গণতন্ত্রের জয় হয়েছে।

আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ কথা না বললেই নয় যে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে আমি ব্যক্তিগত ভাবে গর্বিত। কারণ দেশের এক নম্বর নাগরিক বা রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্বেও তিনি যেভাবে সবার সাথে মিশেন সেটা অতুলনীয়। একজন মানুষ প্রকৃত অর্থেই মাটির মানুষ না হলে তার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। এখনও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের গায়ে গ্রামের সেই ধুলোবালির গন্ধ পাওয়া যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার যে ধ্যান ধারণা থাকার কথা সেটাও তার মধ্যে অত্যন্ত প্রখর এবং সেই চেতনা তিনি সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন বলেই আমার কাছে দৃশ্যমান হয়। সেজন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ ধন্যবাদ দিতে চাই যে, তারা এ রকম একজন রাষ্ট্রপতিকে এই পদে মনোনয়ন দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনের মনোনয়ন শুরুতে সবাইকে অবাক করলেও সেটা ছিল আমাদের অগত্যা। কারণ অনেকে তার সম্পর্কে সঠিক ভাবে জানতেন না। অথচ তিনি একজন স্থানীয় নেতা হয়েও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি পাবনার মত একটি জেলা শহরে থেকে তিনি এটি করেছেন। আমরা সেটার মাহাত্ম্য বুঝতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকরী ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন আর সেজন্য রাষ্ট্রপতিকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। আমি প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন ইউসুফের কাছে শুনেছি যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং তার (প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন ইউসুফ হাত পা খাটের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এভাবে অনেক দিন তিনি জেল খেটেছেন। এরপর তিনি জেলে থেকেই আইন পাশ করেন। তিনি পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নেন এবং জেলা জজ পর্যন্ত হয়ে তিনি তার চাকরির জীবন শেষ করেন। পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত হন। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য হিসেবে এবং আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের নির্বাচন কমিশনের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছেন। রাষ্ট্রপতি হলেও এখনও তিনি আগের মতই সহজ-সরল রয়ে গেছেন। তার এই সরলতা ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছে।

গত এক বছরে রাষ্ট্রপতির আরেকটি উল্লেখ্য করার মত সাফল্য হল যে, তিনি এমন ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন বা এখন পর্যন্ত তার কাজকর্ম কিংবা সিদ্ধান্তগুলো দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিনি আগে কখনও কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তিনি তার নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে পেরেছেন। রাষ্ট্রের সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সহ সর্বশেষ তিনজন রাষ্ট্রপতি গণ মানুষের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে পেরেছেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, এরপর অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ এবং মো. সাহাবুদ্দিন তারা প্রত্যেকই অতি সাধারণ জীবন যাপন করে আপামর জনগণের মন জয় করে নিতে পেরেছেন। রাষ্ট্রপতি হবার আগে যে সাধারণ জীবন যাপন করেছেন রাষ্ট্রপতি হবার পরও একই ভাবে থেকেছেন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের তালিকায় এমন রাষ্ট্রপতিও আছেন যারা রাষ্ট্রপতি হবার আগে এক রকম ছিলেন পরে আবার অন্যরকম ভাবে আবির্ভূত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হবার আগে যে আদর্শ ধারণ করতেন রাষ্ট্রপতির চেয়ার বসলে তাদের সেই আদর্শের বিচ্যুক্তি ঘটে। কিন্তু এক্ষেত্রে এই তিনজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তারা আগে যা ছিলেন রাষ্ট্রপতি হবার পর একই রকম থেকেছেন, আদর্শচ্যুত হননি। মো. সাহাবুদ্দিন যে আদর্শ ধারণ করেন সেই আদর্শে তিনি তার কাজকর্ম সফলতা সাথে করে যাচ্ছেন। আমরা তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।


রাষ্ট্রপতি   মো. সাহাবুদ্দিন  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনা ছাড়া কেউই অপরিহার্য নয়


Thumbnail

প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন শেষ হয়েছে গতকাল। কিন্তু অবাক করার বিষয় যে, একমাত্র পলকের শ্যালক ছাড়া আর কেউই মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। অথচ আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনা আছে যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী, এমপিদের পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয় স্বজনরা কেউ নির্বাচন করতে পারবেন। দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী, এমপিদের পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তাদেরকে প্রত্যাহারের জন্য তিনি নির্দেশও দিয়েছেন। তিনি শেষ পর্যন্ত কেউই তা মানেননি। এতে করে সুস্পষ্ট ভাবে তারা আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনাকে অমান্য করেছে। যা দলীয় সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন এবং গুরুতর অপরাধও বলে আমি মনে করি।

আওয়ামী লীগ যদি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি টিকে থাকতে চায় তাহলে দলকে এবার কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি তারা ইনিয়ে বিনিয়ে এখন নানান অজুহাত তৈরি করছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের উচিত হবে এ সমস্ত অজুহাত না শোনা। কারণ যিনি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত পরিপন্থি কাজ করেছেন এটা সুস্পষ্ট। সুতরাং এখানে দল উচিত তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দল করলে তাকে দলীয় শৃঙ্খলা মানতেই হবে। অনথায় দল থেকে বাদ দিতে হবে। যারা দলীয় সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কাজ করেন তারা কখনই দলের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এদের মত আট-দশ দলে না থাকলে আওয়ামী লীগের কিছু যায়-আসে না। একমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতি দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক ছাড়া আর কেউই আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য নয়। শেখ হাসিনাই কেবল মাত্র আওয়ামী লীগ এবং দেশের স্বার্থে অপরিহার্য। সুতরাং, এখন আমরা দেখতে চাই শৃঙ্খলা পরিপন্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

যারা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা অমান্য করেছেন তিনি দলের যত বড় নেতাই হোন না কেন তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। দরকার হলে দল থেকে তাদেরকে বাদ দিতে হবে কিংবা বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। শুধু বহিষ্কারই নয়, তাদের প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল করতে হবে। এতে করে কারও যদি এমপিত্ব চলে যায় তো যাবে। কিন্তু দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে দলের স্বার্থে। তাদের আসনে যে কাউকে নির্বাচন করে জিতে আসতে পারবেন। কোন মন্ত্রী এমপি আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য নয়। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন উপজেলা গুলো প্রার্থী দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে দল কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটা দেখার জন্য গোটা দেশের মানুষ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে আছে।

অতীতে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কঠোর পদক্ষেপ নেবেন এমনটি আশা আওয়ামী লীগের প্রতিটি তৃণমূল নেতাকর্মীর। এখন আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় আমরা সেটার অপেক্ষা আছি।


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন