করোনাভাইরাসের নতুন ধরণ ওমিক্রনের বাজে ধারায় পড়েছে দেশের বাণিজ্য খাত। ভাইরাসটির প্রভাবে এরই মধ্যে কমে গেছে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য। ব্যবসায়ীদের শঙ্কা, ওমিক্রনের সংক্রমণ যদি আরো দীর্ঘায়ত হয় তবে ভবিষ্যতে রপ্তানি খাতে এর বাজে প্রভাব তৈরি হবে।
সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) করা ‘করোনার নতুন ধাক্কা: ব্যবসার আস্থা কোন পথে?’ শীর্ষক জরিপে ব্যবসায়ীদের এমন আশঙ্কার কথা উঠে এসেছে।
জরিপের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। প্রতিষ্ঠানটি মূলত এই জরিপ করেছে চলতি বছরের ৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত। সারা দেশের আটটি বিভাগের ৩৮টি জেলার ৫০২টি প্রতিষ্ঠান এই জরিপে অংশ নেয়। এর মধ্যে উৎপাদনমুখী কারখানা ২৫২টি ও সেবামূলক (সার্ভিস সেক্টর) প্রতিষ্ঠান ২৫০টি।
জরিপে বলা হয়, ওমিক্রনের প্রভাবে ৭১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বা বিক্রি কমেছে। ওমিক্রনের কারণে রপ্তানি কমার ঝুঁকি বেড়েছে বলে জানিয়েছে ৮৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বলছে, ওমিক্রনের কারণে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থাসহ নানাবিধ কারণে ব্যয় বৃদ্ধির ঝুঁকি বেড়েছে। ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বলেছে, এতে করে পুঁজি ও শ্রমের খরচ বৃদ্ধির ঝুঁকি বেড়েছে। ভবিষ্যতে ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে ওমিক্রনের প্রভাব আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এ জন্য সরকারের পুনঃপ্রণোদনা চান তাঁরা।
জরিপের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমরা জরিপে দেখলাম, ব্যবসায়ী যে ধরনের ব্যাবসায়িক পুনরুদ্ধারের কথা ভেবেছিলেন, বিষয়টি সেভাবে এগোচ্ছে না। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানের পুনরুদ্ধার হচ্ছে, তাদের সবই বড় প্রতিষ্ঠান। তাদের পুনরুদ্ধারের পেছনে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ভালোভাবেই কাজ করেছে। তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনরুদ্ধারের গতি খুবই মন্থর।’ এ সময় তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেওয়া উচিত।
সানেমের জরিপে বলা হয়, ৬৯.২৩ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী বলছেন, তাঁরা সরকারের পুনঃপ্রণোদনা চায়। ৯৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলছেন, তেলের দাম বৃদ্ধিতে সব ধরনের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ৭০ শতাংশ বলছেন, তাঁরা সর্বশেষ তিন মাসে ঋণ করে ব্যবসা চালিয়েছেন। এই ঋণের বেশির ভাগই করেছেন তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে। দুর্নীতি কারণে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ঋণ পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।
সানেম বলছে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে তথ্য-উপাত্ত নিতে গিয়ে তারা দেখেছে, এরই মধ্যে এর প্রভাব ব্যবসায়ীদের ওপর পড়েছে। ৯৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে যানবাহনের খরচ বেড়েছে। জরিপে ৭৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বলেছে, তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
ঋণ পেতে দুর্নীতি বড় বাধা: ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি এখনো অন্যতম বড় বাধা মনে করে দেশের ৪৩ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ব্যাংক কিংবা নন-ব্যাংক উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা। জরিপে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশ কোনো প্রণোদনা প্যাকেজ পায়নি। মাত্র ২৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজ পেয়েছে।
জরিপে বলা হয়, আবার যেসব প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা পেয়েছে, তাদের ৪০ শতাংশ বলেছে, ওই প্যাকজে যথেষ্ট নয়। ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বলেছে, সরকারের পক্ষ থেকে আরো সাহায্য দরকার। এর মধ্যে স্বল্পসুদে ঋণ, রপ্তানিকারকদের জন্য শিপমেন্ট পূর্ববর্তী পুনরর্থায়ন সুবিধা এবং অসহায় শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি।
ঋণ পেতে কী ধরনের দুর্নীতি হয়—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সেলিম রায়হান বলেন, ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তার কথা বলা হলেও অনেকে শেষ পর্যন্ত সরকারি প্রণোদনা ঋণ পাননি। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ৯ থেকে ১০ শতাংশ ঋণ পেয়েছে।’
এ সময় সানেমের নির্বাহী পরিচালক দুর্নীতি দমনে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে আরো তৎপর হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আগের জরিপে এ ধরনের ফলাফল নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কোন ব্যবসায়ী তাঁদের এ ধরনের তথ্য দিয়েছেন, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। কভিড শুরুর পর এ নিয়ে সাতবার জরিপ করেছে সানেম। ব্যবসায়ীরা যাতে কোনোভাবে বিব্রত না হন, সে বিষয়েও সতর্ক থাকার চেষ্টা করছে তারা।