লিট ইনসাইড

জিতুর দেড় দিন

প্রকাশ: ০২:৪৭ পিএম, ১৪ মার্চ, ২০২২


Thumbnail জিতুর দেড় দিন

ঘুম থেকে উঠে জিতু টের পেল আজকের দিনটা অন্য রকম, অন্য সব দিনের মত নয়। এমনটি সাধারণত হয় না। সকালে মা দুই তিন কি চার বার ডাক দিয়ে যায়,’ জিতু উঠে পড়, ইশকুল টাইম’। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়তে মন চায় না। শেষ বার মা একটু জোর গলায় লম্বা টান দিয়ে বলে, ‘জি-ই-ই-তু, উঠ।‘ জিতু জানে এরপর আর কোন ডাকাডাকি নেই, মা এসে কোলে করে নিয়ে সোজা ভিতরের বারান্দার বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। সে পর্যন্ত জিতু চোখ বুঁজে থাকে। বেসিনের উপর দুই হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো জিতু পিট পিট করে চোখ খুললেই দেখতে পায় সামনের খয়েরি রঙের শিশির গায়ে মোড়ানো কাগজে লেখা, বিদ্যুৎ কালো নিমের মাজন। শিশি থেকে বাম হাতের তালুতে মাজন নিয়ে ডান হাতের আঙ্গুলে লাগিয়ে দাঁত মাজতে শুরু করে। মা তার স্কুল ড্রেস এনে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের উপর রাখে। বাবা তখন বাথরুমে, গোসল করছে, অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি। দাঁত মাজা শেষ হতে না হতেই বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে, হাতে থাকে ভেজা লুঙ্গি। বাবার কাছ থেকে লুঙ্গি নিয়ে জিতু দৌড় দেয় সামনের বারান্দায়, তারের উপর মেলে দিয়ে দোতলা থেকে রাস্তার দিকে তাকায়। খানিকক্ষণ সকাল দেখে। এর পর বাবা আর ছেলের রেডি হওয়ার পালা, জিতুর স্কুল আর বাবার অফিস। জিতু অবশ্য নিজেই এখন ড্রেস পরতে পারে, মা কেবল জুতার ফিতা লাগিয়ে দেয়। এর মধ্যেই টেবিলে নাস্তা এনে রাখে শাপলা। রুটি আর ভাজি, বেশির ভাগ দিনই আলু অথবা পেপে ভাজি। কখনো কখনো ডিম। পাশাপাশি চেয়ারে বসে জিতু আর বাবা নাস্তা খেতে খেতে মা স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে ফেলে। এ সময় বাবা নিজের ভাগ থেকে রুটির টুকরায় ভাজি তুলে জিতুকে খাইয়ে দেয়। জিতু এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে। এই সময় দুই জনের মৃদু হাসি বিনিময় হয়। একই রুটি, একই ভাজি; মাত্র দুই তিন টুকরা, তবুও জিতুর কাছে তার স্বাদ অন্য রকম। কখনো কখনো শেষ টুকরার জন্য বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মা হাসতে হাসতে বলে, ‘হ্যা তোর বাবার আঙ্গুলে তো মধু লাগানো আছে!’ এই কথায় বাবা হাসে, জিতু লজ্জা পায়। বেশির ভাগ দিন ছোট বোন মিতু তখনো ঘুমিয়ে। নাস্তা সেরে বাবা তিন বাটির একটা অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বের হয়ে যায়। মা বাবাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে জিতুকে নিয়ে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালে বাবা রাস্তায় নেমে একবার উপরের দিকে তাকায়, তখন বাবার সাথে মা আর জিতুর হাসি বিনিময় হয়। হাঁটতে হাঁটতে বাবা গলির মোড়ে পৌঁছে আবার বাসার দিকে তাকায়। মা বলে, ‘জিতু বাবাকে টা টা দাও’। মা আর জিতু হাত তুলে টা টা দিলে বাবাও হাত তুলে টা টা দিয়ে বাম দিকে ঘুরে চোখের আড়াল হয়ে যায়। যদিও জিতু কখনো বাবাকে টা টা দিতে ভুল করে না তবুও মা প্রতিবার এই কথা বলবেই। এরপর জিতুর স্কুলে যাওয়ার পালা। জিতুর স্কুলের খালামণি এসে দরজায় দাড়ালে মা ওকে নিয়ে নিচে নেমে খালামণির দলের সাথে মিলিয়ে দেয়। এই সময় মা প্রতিদিন একই কথা বলে; জিতুকে বলে, ‘সাবধানে যাও’ আর খালামণিকে বলে, ‘দেখে শুনে রাইখো’। বন্ধুদের দলে ভিড়ে জিতু সব ভুলে যায়, টুক টুক গল্প করতে করতে স্কুলের পথে হাঁটতে থাকে; তাদের ঠিক পিছনে পিছনে খালামণি। সারাক্ষণ কথা বলতে থাকে; ‘সোজা হাঁটো’, ‘এদিকে না’, ‘ওদিকে না’, ‘মুন্নি তিন্নির হাত ধরো’, ‘সবাই দাঁড়াও’, ‘এখন রাস্তা পার হও’, ‘আমার সাথে সাথে, একদম দৌড় দিবা না’।

কিন্তু আজকের দিনটা অন্য সব দিনের মতো নয়। এ রকম হঠাৎ হঠাৎ হয়, ছুটির দিনে; যেদিন স্কুল ছুটি বা যেদিন সাথে বাবার অফিসও ছুটি থাকে। স্কুলে যাওয়ার কোন তাড়া নেই, তাকে কেউ ঘুম থেকে জাগায় না, সে নিজে থেকেই উঠে। আজকের দিনটা সে সব দিনের মতোও নয়। জিতু নিজেই বিছানা থেকে নেমে চোখ কচলাতে কচলাতে বেসিনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। চোখ খুলে দেখে সামনে মা দাঁড়িয়ে। মাকে দেখে জিতুর মুখের হাসি মাঝ পথে এসে থেমে গেল। মায়ের এমন চেহারা সে আগে কখনো দেখেনি। মার পুরো মুখ পাথরের মত, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে;  প্রতিটা পেশি যেন সিমেন্ট দিয়ে হাড়ের সাথে লাগানো, কোন নড়াচড়া নেই। চোখ জোড়াও তেমনি, নির্লিপ্ত আর কঠিন দৃষ্টি; অন্যান্য দিনের মত হাসির ঝিলিক নেই। মনে হচ্ছে আগুন ঝরছে, সব পুড়িয়ে ফেলবে। গলার স্বরও অন্য রকম, ভয় ধরিয়ে দেয়া। ‘যাও, তাড়াতাড়ি রেডি হও’ - মায়ের কণ্ঠ শীতল আর রূঢ়। জিতুর বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল, ঠোঁট, গলা শুকিয়ে এল। বেসিনের দিকে পা বাড়াতেই জিতুর চোখ পড়লো বাবার দিকে, বাবা লুঙ্গি হাতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছে। অন্যান্য দিনের মতো এগিয়ে যাবে নাকি যাবে না এমন ভাবনায় দুই পা এগিয়েই থেমে গেল। মা আগের চেয়েও শক্ত মুখ করে আরো কঠিন গলায় বলল, ‘তোমার লুঙ্গি মেলতে হবে না। যাও, রেডি হও। ‘জিতুর দিকে একবার তাকিয়ে বাবা চুপচাপ লুঙ্গি হাতে নিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেল। জিতু বুকের ভিতরে একটা হাতুড়ি পিটিয়ে চলছে , ঢিপ ঢিপ ঢিপ ঢিপ।

জিতু বুঝতে পারল এখন কথা বলা মানেই বিপদ ডেকে আনা। বকা তো বটেই এমনকি মারও কপালে জুটতে পারে। বেসিনের সামনে গিয়ে কালো নিমের মাজন দিয়ে সে দাঁত মাজতেই থাকলো, ভয়ে অথবা ইচ্ছা করেই দাঁত মাজতেই থাকলো। দাঁতের উপর দিয়ে যতটা সময় পার করা যায়। এর মধ্যেই বাবা অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে কয়েক পা এগিয়ে থেমে গেল। বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে জিতু অবাক হয়ে দেখল ডাইনিং টেবিলে রোজকার মত নাস্তা নেই, আর নাস্তা নিয়ে কেউ আসছেও না। বারান্দা দিয়ে সোজা তাকালে শেষ মাথায় পাক-ঘর। শাপলা সেখানে বসে তখনো আটা মলছে। নীরবে, গভীর মনোযোগ দিয়ে; ধীরে ধীরে যেন কোন তাড়া নেই, নির্বিকার। যেখানে রুটিই বেলা হয় নাই, নাস্তা আসবে কোত্থেকে। বাবা সেই সকাল থেকে জিতুর সাথে একটা কথাও বলেনি; এটাও অস্বাভাবিক। বাবা হয়তো এখনই বলবে, ‘জিতু আব্বু, তাড়াতাড়ি রেডি হও’। সাথে সাথে সে একটা হাসি দিয়ে তাড়াতাড়ি কুলি করে মুখ ধুয়ে জামা কাপড় পরতে শুরু করবে। সেই সাথে এতক্ষণের দুঃস্বপ্ন পাল্টে  গিয়ে অন্য সব দিনের মতোই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে রকম কিছুই হলো না। বাবা নীরবে চেয়ারে বসে জুতা পরতে শুরু করেছে দেখে তার খুব অভিমান হলো। বাবার উপর অভিমান। বাবা ইচ্ছা করলেই সব ঠিক করে দিতে পারে, কিন্তু কেন যে করছে না! মাকে খুব ভয়ঙ্কর লাগছে। জুতা পরা শেষে বাবা একবার মার দিকে তাকালো। মার চোখে মুখে কোন ভাবান্তর নেই। মা বাবার দিকে তাকিয়েও কিছু দেখছে না। বাবা ডাইনিং টেবিলের উপর আরেকবার চোখ বুলিয়ে জিতু দিকে ফিরে বলল, ‘আব্বু তাড়াতাড়ি রেডি হও।‘ এবার মা মুখ খুলল। জিতু দিকে ফিরে কাটা কাটা গলায় বলল, ‘আজ থেকে তোমার ইশকুল বন্ধ। তাড়াতাড়ি কুলি কর, মুখ ধোও’। জিতুর আবারো মনে হলো, বাবা এবার এমন কিছু বলবে যাতে সব ফুস মন্তরে ঠিক ঠাক চলতে শুরু করে। কিন্তু বাবা একটা কথাও না বলে ধীর পায়ে দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকাল। জিতুর সাথে বাবার চোখাচোখি হলেও মার দৃষ্টি অন্য দিকে। বাবা কয়েক সেকেন্ড মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। ঠক ঠক, ঠক ঠক; বাবার জুতার শব্দ বেশ জোরেই শোনা যাচ্ছে। হয়তো সবাই চুপ করে আছে তাই, হয়তো বাবাই শব্দ করে নামছে।

বাবার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর জিতু ভয়ে ভয়ে একবার মায়ের দিকে তাকাল। তার খুব ইচ্ছা হলো এক দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে নিত্য দিনের মত বাবাকে দেখে, বাবাকে টা টা দেয়। কিন্তু মা নিশ্চুপ, শুধু হাতের ইশারায় বেসিন দেখিয়ে দিল। ধীর পায়ে সেই দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মাঝপথে জিতু থমকে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠল মায়ের কর্কশ গলা শুনে, ‘নবাবাজদী, এখনো নাস্তা হয় নাই’। জিতু আড় চোখে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল শাপলা রুটি বেলতে শুরু করেছে আর তার দুই চোখ বেয়ে বড় বড় কান্নার ফোঁটা নেমে আসছে। বুঝতে আর বাকি রইল না, দিনটা আজ বিচ্ছিরি আর মায়ের মেজাজ খুব তিরিক্ষি।

ভয়ের চোটে দ্রুত মুখ-হাত ধুয়ে জিতু লক্ষী ছেলের মত ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে পড়ল। আর মা মিতুকে বিছানা থেকে তুলে রেডি করে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে গেল। সেই সকাল থেকে মায়ের চেহারায় এক ফোঁটা হাসি নেই, পাথরের মত নিরেট আর শক্ত। আর মা যে ভাবে ঘুম থেকে তুলে মিতুর মুখ-হাত ধোয়ালো তাতে মিতুও বুঝতে পেরেছে আজকের  দিনটা অন্য সব দিনের মত নয়। অনবরত চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই শাপলা টেবিলে নাস্তা রাখতে এল। শাপলার মুখ থেকে একটা কথাও বের হয়নি সকাল থেকে, এটাও অস্বাভাবিক।  একটা ভয়ংকর নীরবতা, একটা দম বন্ধ হাসফাস পরিবেশ। মা নাস্তা খাওয়ানোর সময় অন্যান্য দিন মিতু নানান বাহানা করে, গল্প করে, প্রশ্ন করে কিন্তু আজ নীরবে নাস্তা সেরে নিল। নাস্তা শেষে মা ওদের দুই জনকে সামনের রুমে পাঠিয়ে দিল, ‘যাও ভাই-বোন মিলে খেলা কর। খবরদার, কোন দুষ্টামি করবা না।‘ অন্যান্য দিন এমন খেলার সুযোগে যে আনন্দ নিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওরা খেলনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কাড়াকাড়ি করে; আজ তার ব্যতিক্রম হল।

জিতু আর মিতু চোখের আড়াল হতেই মা দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসে গলায় ডাক দিল, ‘হারামজাদী, এদিকে আয়’। সামনের রুম থেকে ওরা দেখতে পেল শাপলা পায়ে পায়ে মায়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। ‘তোর ব্যাগ কই?’ মায়ের এই কথার জবাবে শাপলা তার কাপড়ের ব্যাগটা দুই হাতে তুলে উঁচু করে দেখাল। ‘তোর কাপড়-চোপড় সব নিয়েছিস?’ শাপলার মুখে কোন কথা নেই। ঘাড় কাত করে জানালো, নিয়েছে।

‘এখান বের হয়ে সোজা তোর মায়ের কাছে যাবি। জীবনেও যেন আর না দেখি।’
গলা চিরে বের হয়ে আসতে চাওয়া কান্না চেপে শাপলা ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘আফা আমার কোন দোষ নাই।’
‘একদম চুপ। একটা কথাও না’। মার গলা আগের চেয়েও কঠিন আর হিংস্র।

তারপরও শাপলার কিছু বলার ছিল। কিন্তু মায়ের নির্মম দৃষ্টি আর নিষেধের ইশারায় ঠোঁটের আগায় আসা কথা নিমেষে গিলে ফেলল। ধীর পায়ে দরজা পার হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে মা তার শেষ কথাটা শুনিয়ে দিল, ‘কোন দিন যদি আমার চোখের সামনে পড়িস খুন করে ফেলব’। মনে হল, মা সত্যিই খুন করতে পারে! 
শাপলা বেরিয়ে যেতেই জিতু-মিতুকে অবাক করে দিয়ে মা অস্ফুট কণ্ঠে অনুচ্চ কান্নার শব্দ চাপা দিয়ে আঁচলে চোখ মুছল। পর মুহূর্তে মায়ের দুই চোখ থেকে বড় বড় দুই ফোঁটা অশ্রু বের হয়ে গাল বেয়ে নেমে এল। 
 
আজ স্কুলে যেতে পারলেই ভালো ছিল। বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে মা কেঁদেই চলেছে। নীরব কান্না, কেবল দুই চোখ বেয়ে পানি টপ টপ করে নেমে আসছে; কিছুক্ষণ পর পরই কখনো আঁচল দিয়ে, কখনো হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে মুছে ফেলছে। ঠিক তখনই ঝট করে ওদের দিকে তাকাচ্ছে; সন্তানরা কি দেখে ফেলল তার কান্না! ভয়ের কারণে জিতু মাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহসও পাচ্ছে না। আর মিতু সারাক্ষণ ভাইয়ের সাথে সাথে, মার কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায়। শাপলা না থাকায় রান্নার সব কাজ মাকে সারতে হল । এর ফাঁকে আদর করে দুই একটা কথা তাদের বলেছে বটে কিন্তু গলার স্বরে সেই আদর নেই। ছোট্ট মিতুও বুঝতে পারছে সুর কেটে গেছে কোথাও। পড়তে বসা নিয়ে কোন শাসন নেই, খেলা নিয়ে নেই কোন উচ্চবাচ্য।

ডাইনিং টেবিলের কোনায় রাখা এক ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও প্রতিদিন দুপুরে চালু হয়, এই সময়টা সবার জন্য আনন্দের। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে বাজতে থাকা সিনেমার গান শুনতে শুনতে মা টুক টুক করে কাজ করে। তারপর ওদের গোসল করায়, নিজেও গোসল করে। গোসল শেষে মা যখন গামছা দিয়ে বাড়ি মেরে চুল থেকে পানি ঝরায় তখন মায়ের গায়ে-পায়ে লেপ্টে জিতু-মিতুর গায়ে একটা খুব হালকা ঝিরঝিরে ইলশেগুড়ি বৃষ্টির মত পানি ঝরে পড়ে; দুই হাতের তালু মেলে ধরে জিতু আর মিতু, মা হাসে আর বলে, ‘আরে সর না। তোদের জন্য শান্তিতে কিচ্ছু করার উপায় নাই’। হঠাৎ করেই মা কখনো পরিচিত কোন গানের কলির সাথে গুণ গুণ করে গলা মিলায়। তারপর খেতে বসে, জিতু-মিতু আর মা। খাওয়া শেষে প্লেট-গ্লাস সব গুছিয়ে শাপলা যায় গোসল করতে, সবার শেষে সে খাবে। আর মা ওদের নিয়ে বিছানায় যায়, ঘুম পাড়াবে বলে। সে সময় তাদের গল্প শোনার, শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ার।

কিন্তু আজ সব ওলট পালট হয়ে গেছে। রেডিও বাজে নি আর সে কথা মাকে মনে করিয়ে দেয়ার সাহস হয়নি জিতু বা মিতুর। মা নিজে গোসল করেনি, ওদেরও গোসল করায়নি, করতেও বলেনি। রান্না শেষে একটা প্লেটে ভাত-তরকারি সব এক সাথে মাখিয়ে নিজের হাতে দুই জনকে খাইয়ে দিয়েছে। সব গুছিয়ে ওদের বিছানায় নিয়ে এসেছে  ঘুম পাড়ানোর জন্য। মা যে খায়নি, তা খেয়াল করে জিতু মিনমিন স্বরে বলল, ‘মা তুমি খাবা না?’ এই কথার জবাবে মা দুই হাতে জিতুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। খুব দ্রুত আঁচলে চোখ মুছে মিতুর কপালেও একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘দেখি কে আগে ঘুমাতে পারে, যে আগে ঘুমাবে তার জন্য পুরস্কার।‘ প্রতিদিনের নিয়ম ভেঙ্গে মা আজ ওদের সাথে ঘুমাতে এল না। জিতু দেখল, মিতুও দেখল, মা নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে আর একটু পর পর কখনো হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে কখনো আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে।

বিকালে জিতুরই আগে ঘুম ভাঙ্গল, বিছানা থেকে নেমে মাকে খুঁজতে যেয়ে চোখে পড়ল মা ডাইনিং টেবিলে দুই হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে। সাথে সাথে জিতুর মনে হল, আজ যেমন স্কুলে যাওয়া হয়নি তেমনি হয়তো মা মাঠেও যেতে দেবে না। বাসার সামনেই বিশাল মাঠ, বিকেল হতে না হতেই পাড়ার ছেলে-মেয়েরা নানা দলে সেই মাঠ জুড়ে খেলতে শুরু করে। এই সময়টা জিতু-মিতুর জন্য সবচেয়ে মজার, সবচেয়ে আনন্দের। সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বাধীনতা, শুধু খেলা আর খেলা। 
পায়ের শব্দে মাথা তুলে মা দেখতে পেল জিতু সামনে দাঁড়িয়ে। মার বিষন্ন মুখ জুড়ে শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগ নানা আঁকিবুঁকি তৈরি করেছে। এই চুপচাপ দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও জিতু পালিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু মাকে কিছু বলবে সে সাহস নেই, বরং ভয় আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। যেন জিতুর মনের কথা বুঝতে পেরেই মা মিতুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দুইজনকে রেডি করে মাঠে পাঠিয়ে দিল। ‘সন্ধ্যার সাথে সাথে বাসায় ফিরে আসার কথা মনে করিয়ে দিল। মাঠে পৌঁছেই দুই ভাই-বোন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। খেলায় মেতে ভুলে গেল সারাদিনের কথা।

সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফেরার পথে ফিরে এল সারাদিনের দুঃসহ স্মৃতি। বাসায় গিয়ে কি আগের মতোই দেখবে মা কাঁদছে, আবার মনে হয় রেগেও আছে। এই সময়ে নিয়ম মাফিক পড়তে বসে ওরা। মা জিতুকে পড়া দেখিয়ে দেয়। পাশেই বর্ণমালার বই নিয়ে বসে থাকে মিতু। যতনা পড়ে তার চেয়ে বেশি বিরক্ত করে, মায়ের সাথে খালি গল্প করে। সেই গল্পে জিতু যোগ দিতে চাইলেই মা ওকে হোম ওয়ার্কের তাড়া দেয়। আজ  জিতু চুপচাপ নিজে থেকেই পড়তে বসল, দাদার দেখাদেখি মিতুও তার বর্ণমালার বই নিয়ে। মা এখন আর কাঁদছে না। তবে চেহারা সেই সকালের মতই নিষ্প্রাণ, দৃষ্টিতে শূণ্যতা। দুই একবার ওদের কাছে এলেও বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি, কোন কথাও বলেনি। মা এখন সারা বাসায় পায়চারি করছে, ঘর থেকে বারান্দায়, বারান্দা থেকে ঘরে, তারপর এই রুম থেকে সেই রুমে। পায়চারির করতে করতেই জিতু-মিতুর কাছাকাছি এসে হাঁটার গতি মৃদু/ধীর করে ওদের দিকে তাকায়। মনে হয় কিছু বলবে কিন্তু কিছু বলে না।  কখনো মনে হয় মায়ের ঠোঁট নড়ছে, বিড় বিড় করে নিজের মনেই কিছু বলছে। জিতু-মিতু সামনে বই খুলে রেখে চুপচাপ মাকে খেয়াল করতে থাকে আর প্রাণপনে অপেক্ষা করতে থাকে কখন বাবা ফিরবে। দুই জনেই মনে প্রাণে চাচ্ছে বাবা তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক। বাবা এলেই তাদের বিশ্বাস এই গুমোট হাওয়া কেটে যাবে, হেসে উঠবে পুরো বাসা।

কিন্তু বাবা আর আসছেই না। রাতে সবাই একসাথে খাবার খায়, সবাই মিলে গল্প করে; কত হাসি, কত মজা হয়। রাত বাড়তেই মা দুপুরের খাবার গরম করে দুপুরের মতই একসাথে দুইজনকে খাইয়ে দিল। মার চেহারায় আগের কাঠিন্য সরে গিয়ে দুঃশ্চিন্তার ছাপ দেখা দিল, সাথে একটু ভয়ও, এতো দেরি তো কখনো হয় না। এবার আর পায়চারি করতে করতে বারান্দায় গিয়ে মা সাথে সাথে ফিরে এল না। মার দেরি দেখে জিতু আর মিতু গুটি গুটি পায়ে বারান্দায় গিয়ে  দুই পাশে দাঁড়াল। মা দুই হাত বাড়িয়ে ওদের দুইজনকে জড়িয়ে ধরলেও ওদের দিকে তাকাল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। ওরাও মায়ের সাথে সাথে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। অফিসে যাওয়ার সময় রাস্তার যেখান থেকে  বাবা বামে মোড় নেয় ঠিক সেই জায়গাটার দিকেই তিনজনের চোখ। তিনজনেই অপেক্ষা করছে, এক্ষণি হয়তো দেখা যাবে বাবা ধীর পায়ে ওখান দিয়ে হেঁটে আসছে। তিনজনের মনের মধ্যে যে ভাবনা চলছে তাকে হঠাৎ ভাষা দিল মিতু, ‘মা, বাবা আসবে না!?’ মিতুকে জড়িয়ে ধরা হাতেই মা তার মুখে হাত চাপা দিল, আতঙ্ক মেশানো গলায় বলল, ‘ছিঃ আম্মু, এই সব কথা বলে না।‘ তারপর দাঁতে দাঁত পিষে মৃদু/নিচু স্বরে বলল, ‘চুরি চুরি, আবার সিনাজুরি!’ বাসার সামনের নির্জন রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরটা উঠে গলা উঁচিয়ে ওদের দিকে তাকাল, ঘেউ ঘেউ করে কয়েকবার ডাক দিল। রাতের খাবার শেষে এঁটো-কাঁটা বাবা একটা মরচে ধরা এলুমিনিয়ামের প্লেটে/থালায় করে দরজার সামনে রেখে আসে এই কুকুরটার জন্য। আজ কুকুরটার সেই খাবার জোটেনি তাই হয়তো মনে করিয়ে দিচ্ছে।

রাত আরেকটু বাড়তেই মা আর পারলো না। বাসা থেকে বের হয়ে বাবাকে খুঁজতে চাইল, কিন্তু খুঁজবে কোথায়, এতো রাতে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে। আর যাবেই বা কি ভাবে, বলবেই বা কি। ছোট দুইটা বাচ্চা/শিশু, এই গভীর রাতে ওদের কোথায় রেখে যাবে। রাগ আর ক্ষোভ ছাপিয়ে মার চেহারায় এখন আতংক আর দুঃশ্চিন্তার ছায়া। বারান্দা থেকে ঘরে এসে চাবির রিং হাতে নিয়ে আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। মার সাথে সাথে পিছে পিছে জিতু আর মিতুও। না, কারো কোন ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। কেবল কুকুরটা এখন রাস্তার মাঝখানে চার পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে রাতের খাবার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওদের দুই জনকে সাথে করে দরজায় তালা মেরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রাস্তায়। পায়ের শব্দে কুকুরটা একটু মাথা উঁচু করে তাকিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মার ডান দিকে জিতু আর বাম দিকে মিতু হাত ধরে মায়ের সাথে সাথে গলির মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল, পিছন পিছন কুকুরটা। তখন মোড়ের তিনটা দোকানের শেষ দোকানটার ঝাঁপ পড়ছে। মোড়ে পৌঁছে তিনজনেই বাম দিকে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল কিছু দেখা যায় কিনা, বাবাকে দেখা যায় কিনা। ল্যাম্প পোস্টের ম্লান হলুদ আলো রাতের অন্ধকার খুব কমই দূর করতে পেরেছে। সেই আলো-আধাঁরির ভিতর দিয়ে রাস্তার মাঝ বরাবর একটা হারিকেনের মৃদু আলো ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে তিন জনই আশা নিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন রিক্সাটা কাছে আসবে আর তাতে দেখা যাবে বাবা বসে আছে।  খালি রিক্সাটা ওদের হতাশ করে পার হয়ে গেলে শেষে বন্ধ করা দোকানটার কর্মচারীর পিছু পিছু মা আর জিতু-মিতু বাস স্টপেজের দিকে হাঁটা ধরল। এই পর্যন্ত এসে কুকুরটা থেমে গেল, মধ্য রাতে নিজের সীমানা ছেড়ে ওদের সঙ্গী হলো না। নিঝুম রাস্তায় কেবল চারজন হেঁটে যাচ্ছে, ওদের লম্বা ছায়া ছোট হতে হতে ল্যাম্প পোস্টের ঠিক নিচে একেবারে ছোট্ট হয়ে আবার লম্বা হতে শুরু করে, এই ছায়ার কারণেই হোক অথবা বাবার জন্য  দুঃশ্চিন্তার কারণেই হোক ভয়টা যেন সয়ে যাচ্ছে। গলিটা যেখানে বড় রাস্তায় মিশেছে সেখানে বাস থামে, টেম্পু থামে; সেখানে ফুটপাথে ছেঁড়া চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা এক ভিক্ষুক বা পাগল ছাড়া বাকি সব সুনসান। জিতুর হাত ছাড়িয়ে মা চট করে দুই চোখ মুছে আবার শক্ত করে হাত ধরল। এই সময় একটা বাস ওদের দেখতে পেয়ে যাত্রীর আশায় কাছাকাছি এসে থামলে হেল্পার চিৎকার করে জানান দিল,‘লাস্ট টিপ, লাস্ট টিপ’। যাদের যাত্রী ভেবে এই হাঁক ডাক তাদের কোন ভাবান্তর নেই দেখে টান দিয়ে বের হয়ে গেল। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও কোন বাস বা টেম্পুর দেখা না পেয়ে মা বাসার দিকে ফিরতি পথ ধরল। ক্ষুধা, ক্লান্তি, ক্ষোভ, ভয় আর দুশ্চিন্তায় বিধ্বস্ত মায়ের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। জিতু-মিতু বার বার মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে তাদের অনুচ্চারিত প্রশ্নটি করতে গিয়েও আঁটকে যাচ্ছে। বাবা কোথায়? বাবা বাসায় ফিরছে না কেন? 
বাসায় পৌঁছে মা ওদের বিছানায় শুইয়ে দেয়ার প্রায় সাথে সাথেই মিতু ঘুমিয়ে পড়ল। জিতুর ঘুম আসছে না, কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সে কান্না ভেজা গলায় জানতে চাইল, ‘মা, বাবা আসবে না’। মা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটিয়ে ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, ‘আসবে, বাবা, হয়তো কোন কাজে আঁটকে গেছে’। এরপর কখন যে জিতু ঘুমিয়ে পড়েছে তা মনেই করতে পারে না।

পরদিন সকালে প্লেট-পেয়ালার টুং টাং শব্দে ঘুম থেকে জেগে জিতু বুঝতে পারল আজও স্কুলে যাওয়া হয়নি। মা ডাইনিং টেবিলে নাস্তা রেডি করছে। লক্ষী ছেলের মত মা কোন কথা বলার আগেই জিতু নিজে নিজে দাঁত মেজে, হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে এসে বসল। যেন জিতু কি জানতে চায় তা বুঝতে পেরেই মা খুব সহজ গলায় বলল, ‘নাস্তা খেয়ে আমরা বাইরে যাব। বাবার অফিসে ফোন করতে হবে’। মিতুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রেডি করে নাস্তা শেষে গত রাতের মতই তিনজনে বের হল একই পথে, একই দিকে, একই উদ্দেশ্যে, একই আশায়।

পথে যেতে যেতে মা জিতুকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিল, কি করতে হবে, কি বলতে হবে। রাস্তার মোড়ের ড্রাই ক্লিনার্স লেখা সাইন বোর্ড ঝুলানো দোকানের সামনের শোকেসের উপরে এক প্রান্তে একটা টেলিফোনের পাশে দেয়ালে সাঁটা আছে হাতে লেখা কাগজ, ‘এখানে টেলিফোন করা হয়। প্রথম ১ মিনিট ২ টাকা, পরের পতি মিনিট ১ টাকা’। মা ওদের নিয়ে লন্ড্রী দোকানে এসে হাতের ইশারায় টেলিফোনটা দেখিয়ে দিলে দোকানদার ডায়াল প্যাডে লাগানো ছোট্ট টিপ-তালাটা খুলে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল। মা ডায়াল করে বার দুই দ্রুত লাইন কেটে দিয়ে তৃতীয় বার শক্ত করে রিসিভার কানের সাথে চেপে অপর পাশের রিং টোনের শব্দ শুনতে পেল। অন্য  প্রান্তের ‘হ্যালো’র জবাবে টেলিফোন নম্বর উল্লেখ করে নিশ্চিত হয়ে আবদুর রহমান সাহেবকে চাইলে জবাবে ‘একটু লাইনে থাকুন, দিচ্ছি’, শুনে রিসিভার জিতুর হাতে দিল, হাতটা যেন একটু কাঁপছিল। একটু পরে ওই প্রান্তের কথার উত্তরে জিতু বলল, ‘বাবা আমি, জিতু’।  তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘বাবা মা বলেছে, তুমি আসলে আমরা একসাথে দুপুরে ভাত খাব’।  আবার খানিক নিরবতার পর ‘আচ্ছা’ বলে জিতু রিসিভার মায়ের হাতে দিলে মা একবার কানের কাছে ধরে রেখে দিল। টাকা শোধ করে ওদের নিয়ে ফিরিতি পথে চলতে চলতে দোকান থেকে বেশ দূরে এসে জানতে চাইল, ‘বাবা কি বলেছে?’ জিতু মায়ের দিকে ফিরে ছোট্ট করে জবাব দিল,’ আসবে বলেছে’।

দুপুরে টেবিলে ভাত তরকারি সাজানো আছে, চারটা প্লেট টেবিলের উপর উপুড় করে রাখা। পানির জগ, গ্লাস সব রেডি। সবার অপেক্ষা কখন বাবা আসবে আর সবাই মিলে খেতে বসবে। একই সাথে উৎকণ্ঠা আর আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করছে জিতু। এই বিচ্ছিরি সময়টার শেষ দেখতে চায় সে, ফিরে পেতে চায় আগের সেই সময়। 
দুপুর পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাবার দেখা নেই। দুই ভাই-বোন সামনের বারান্দার রেলিঙে দুই হাতের উপর থুতনি রেখে দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, নির্নিমেষ দৃষ্টি পথের দিকে, যে পথ দিয়েই বাবা অসিসে যায় আর অফিস থেকে বাসায় ফিরে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আর তাকিয়ে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল, কত জন এই পথ ধরে হেঁটে হেঁটে ওদের বাসা পার হয়ে এদিক-ওদিক চলে গেছে কিন্তু বাবা আসছে না। প্রতি মুহূর্তে দম বন্ধ করা অপেক্ষা, আশা; এই বুঝি বাবাকে দেখা যায়।
না পেরে নীরবতা ভেঙ্গে মিতু জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, কখন আসবে,’ মিতুর এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিতু উল্টা প্রশ্ন করল, ‘ক্ষুধা লাগেছে? ভাত খাবি’? মিতু উত্তরে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়িয়ে জানাল না। মা কিন্তু একবারও বারান্দায় এসে দাঁড়ায়নি। মা জানে সন্তানদের চেহারা আর আচরণই জানান দেবে বাবাকে দেখা যাচ্ছে কিনা।

অপেক্ষার দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর প্রহর যখন মনে হচ্ছে আর টেনে নেয়া সম্ভব নয় তখন মায়ের ডাক পড়ল, ‘মিতু-জিতু খেতে আসো’। এই গলায় ভর করে আছে রাজ্যের হতাশা আর বিষণ্ণতা, হয়তো ভয়ও। মায়ের ডাক শুনে তারা কেবল মায়ের দিকে তাকাল কিন্তু জায়গা থেকে নড়ল না। মা এবার উঠে এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমেই রাস্তার দিকে তাকাল, মাকে অনুসরণ করে ওরাও। মধ্য দুপুরের রোদে সুনসান রাস্তার উপরে কেবল কুকুরটাই বাসার নিচের ছায়ায় বসে জিব বের করে হাঁপাচ্ছে।

মা জিতু-মিতুকে সাথে নিয়ে আরো খানিক ক্ষন অপেক্ষা করে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললে ওরা মায়ের মুখের দিকে তাকাল। দ্রুত একটা মলিন হাসি ফুটিয়ে মা ওদের ঘরের ভিতরে নিয়ে এলো।

মায়ের কথা শুনে একে একে মুখ-হাত ধুয়ে জিতু আর মিতু খুব অনিচ্ছা নিয়ে টেবিলে এসে বসল। জিতুর খুব ইচ্ছা খাওয়া শুরুর আগে আরেকবার বারান্দায় গিয়ে দেখে আসে, বাবা আসছে কিনা। বাবা তো ওকে বলেছে, দুপুরে আসবে একসাথে ভাত খাবে। আরেকটু অপেক্ষা করলে কি হয়!

মা টেবিলের উপর উপুড় করে রাখা চারটা প্লেট থেকে একটা তুলে নিল, গত কালকের মত এক প্লেটেই ভাত তরকারি একসাথে মাখিয়ে ওদের দুই জনকে খাইয়ে দেবে। ঠিক সেই সময়ে মায়ের হাত হঠাৎ থেমে গেল। উৎকর্ণ তিন জোড়া কান একটা মৃদু পায়ের শব্দ শুনতে পেল। দম বন্ধ করে তিন জনই নিশ্চিত হতে চাইল ঠিক শুনতে পাচ্ছে কিনা, যেন নিঃশ্বাসের শব্দে হারিয়ে যেতে পারে তা। শোনা যায় কি যায় না এমন একটা ধীর ঠক ঠক শব্দ সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে আসতে ক্রমশঃ জোরালো হচ্ছে। এই শব্দ তাদের খুব চেনা, খুব পরিচিত। তিন জোড়া চোখ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে, নিস্পলক। জোরালো হতে হতে শব্দটা দরজার কাছে এসে থেমে গেল।

তারপর দরজার দুই পাশেই নিরবতা। হয়তো কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক সেকেন্ডের কিছু বেশি কিন্তু সেই সময়কেই যেন মনে হচ্ছিল যেন কত যুগ! দরজার কড়া নাড়ার শব্দে সেই প্রতীক্ষার অবসান হলো, অন্যান্য দিনের চেয়ে মৃদু কিন্তু ছন্দ আর ধরণে অভ্যস্ত কানগুলো ঠিকই বুঝতে পারল বাবা এসেছে। সাথে সাথে তিনজনই উঠে দাঁড়াল এক সাথে। মা দরজা খোলার জন্য কয়েক পা এগিয়েও থমকে দাঁড়াল। জিতুকে ইশারা করল দরজা খুলে দিতে।

দরজা খুলে জিতু বাবাকে দেখতে পেল। বাবার গায়ে গতকাল অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ের পোষাক, গালে এক দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাতে একটা পেপার। শরীর জুড়ে ক্লান্তি আর অবসন্নতা। জিতুর দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি কোন রকমে চেহারায় ফুটিয়ে তুলল।

বাবা ঘরে ঢুকে কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের দিকে তাকাচ্ছে কি তাকাচ্ছে না তা বোঝা গেল না। মাও বাবার দিকে কয়েক পা এগিয়ে থেমে গেল। দুই জন দুই জনের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল।

কয়েক হাত দূরে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে একবার মা আর একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে জিতু আর মিতু।


মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

কবিতা

প্রকাশ: ০২:০৩ পিএম, ২৩ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail




মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

বিশ্বের সেরা এবং আকর্ষণীয় পাচ মসজিদ

প্রকাশ: ১১:০২ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪


Thumbnail

বিশ্বের এমন পাঁচটি মসজিদ সম্পর্কে জেনে নিন:


১. মসজিদুল হারাম, মক্কা, সৌদি আরব:

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ দেখতে যায়, এমন মসজিদের তালিকায় সবার প্রথমে আছে পবিত্র নগরী মক্কার মসজিদুল হারাম। প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ এই মসজিদে যান। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। একসঙ্গে ১৫ লাখ মানুষ এখানে প্রবেশ করে ঘুরে দেখতে পারেন। মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র তিন স্থানের একটি এই মসজিদুল হারাম। মুসলমানদের কিবলা পবিত্র কাবাশরিফ এখানেই অবস্থিত।

তবে যে কেউ চাইলেই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করতে পারেন না। অমুসলিমদের জন্য মক্কা নগরীতে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ।


২. শেখ জায়েদ মসজিদ, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত:

২০০৭ সালে স্থাপিত এই মসজিদ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদগুলোর একটি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঝাড়বাতি ও সবচেয়ে বড় গালিচাও আছে এই মসজিদে।

আরব আমিরাতে বসবাসকারীদের বেশির ভাগই প্রবাসী, যাঁরা মূলত শ্রমজীবী হিসেবে বিভিন্ন দেশ থেকে সেখানে যান। এই বৈচিত্র্যময়তাই মসজিদটির নকশার মূল ভিত্তি। ব্রিটিশ, ইতালীয় ও আমিরাতি স্থপতিরা মিসর, মরক্কো, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের মসজিদের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শেখ জায়েদ মসজিদের নকশা এঁকেছেন।

প্রতিবছর মসজিদটি দেখতে প্রচুর দর্শনার্থী আসেন। শুধু ২০১৭ সালেই এসেছেন প্রায় ৫৮ লাখ দর্শনার্থী। নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময় অমুসলিম দর্শনার্থীরাও মসজিদ ঘুরে দেখতে পারেন। তবে শুক্রবার অমুসলিম দর্শনার্থীদের এই মসজিদে প্রবেশ নিষেধ।


৩. আয়া সোফিয়া, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক:

ইউরোপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহরগুলোর একটি তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুল। আর ইস্তাম্বুল বা গোটা ইউরোপের অন্যতম সুন্দর মসজিদ আয়া সোফিয়া। ৩৬০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে স্থাপিত এ স্থাপনা শুরুতে মসজিদ ছিল না। ১৪৬৩ সালে সুলতান মেহমেদ এটিকে মসজিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

১৯৩৪ সালে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে তৎকালীন তুরস্ক সরকার। কিন্তু ২০২০ সালে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এটিকে আবার নামাজ আদায়ের জন্য মুসল্লিদের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। ১৯৮৫ সালে আয়া সোফিয়াকে বিশ্ব ঐতিহ্যর স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো।


৪. আল–আকসা মসজিদ, পূর্ব জেরুজালেম, ইসরায়েল:

মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর শুরুর দিককার অন্যতম নিদর্শন জেরুজালেমের আল–আকসা মসজিদ।

বলা হয়ে থাকে, খোলাফায়ে রাশিদিনের অন্যতম খলিফা হজরত উমর (রা.)–র শাসনামলে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় মসজিদটির নির্মাণকাজ। তবে বর্তমানে আল-আকসা বলতে পুরো চত্বরটাকেই বোঝানো হয়। ‘হারাম আল শরিফ’ নামে পরিচিত এই চত্বরের চার দেয়ালের মধ্যে আছে কিবলি মসজিদ, কুব্বাতুস সাখরা (ডোম অব দ্য রক) ও বুরাক মসজিদ। মূল আল–আকসা বা কিবলি মসজিদ হলো ধূসর সীসার পাতে আচ্ছাদিত গম্বুজওয়ালা একটি স্থাপনা। তবে পর্যটকের কাছে আল–আকসা নামে বেশি প্রসিদ্ধ সোনালি গম্বুজের স্থাপনা কুব্বাতুস সাখরা।

জেরুজালেমের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদ ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় উঠে আসে ১৯৮১ সালে। এখানে প্রায় চার লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন । তবে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েলি পুলিশ। কোনো মুসল্লিকে তারা মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকতে দিচ্ছে না। পবিত্র স্থানটির দায়িত্বে থাকা ইসলামিক ওয়াক্‌ফ বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।


৫. দ্বিতীয় হাসান মসজিদ, কাসাব্লাঙ্কা, মরক্কো:

আলজেরিয়ার জামা এল জাযের মসজিদের মিনার সবচেয়ে উঁচু, ৮৭০ ফুট। তারপরেই কাসাব্লাঙ্কার দ্বিতীয় হাসান মসজিদের মিনার, উচ্চতা ৬৮৯ ফুট। মরক্কোর বাদশাহ দ্বিতীয় হাসানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত মসজিদটির নকশাকার ফরাসি স্থপতি মিশেল পিনসু।

আটলান্টিক মহাসাগরের একটি শৈলান্তরীপের মাথায় মসজিদটির অবস্থান। মেঝের একটা অংশ স্বচ্ছ কাচের বলে আটলান্টিকের নীল পানি দেখতে পান নামাজে যাওয়া মুসল্লিরা। দেয়ালে মার্বেলের চোখধাঁধানো কারুকাজ। ছাদ অপসারণযোগ্য বলে নামাজ পড়তে যাওয়া মুসল্লিরা রাতের আকাশও দেখতে পান।

দ্বিতীয় হাসান মসজিদের মিনার থেকে একটি লেজাররশ্মি মুসলমানদের কিবলা কাবাঘরের দিকে তাক করা। অনন্য স্থাপত্যশৈলীর জন্য জগৎ–খ্যাত এই মসজিদে একসঙ্গে ১ লাখ ৫ হাজার মুসল্লির নামাজ আদায় করার সুবিধা আছে।


মসজিদ   সেরা  


মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

মুখের ঠিকানা

প্রকাশ: ১২:১৬ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪


Thumbnail




মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

স্পর্শে তুমি

প্রকাশ: ০৪:৪৫ পিএম, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪


Thumbnail




মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন