লিট ইনসাইড

চে’র মৃত্যু নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯:৩০ পিএম, ০৯ অক্টোবর, ২০২১


Thumbnail

তোমার হত্যার প্রতিশোধ আজও নিতে পারিনি চে
অথচ কোমল কৈশোরেই প্রতিশোধ চেয়ে
ঘর ছেড়েছিলাম নিষিদ্ধ অস্ত্র হাতে গোপন গেরিলা
বন-বাদাড়, ঝোপ-ঝাড়, হাওর-বাঁওড় নদী ও পাথার, বালুচর
কৃষকের কুঁড়েঘর, শ্রমিক-বস্তিতে কত না ওঁত পেতে থেকেছি
ট্রিগারে নেচে উঠেছে বিক্ষুব্ধ আঙুল
তোমার ঘৃণ্য হত্যাকারীর ওপর অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে
চোখে বলিভিয়ার জঙ্গল, পাহাড়ি গিরিখাত, স্রোতস্বিনী
কালমিনা খামার, অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ দাস ক্যাপিটাল
লোরকার কবিতা হাতে কতদিন নিজেকে ভেবেছি চে গুয়েভারা।

হিগেরের ঝোড়ে গুলিবিদ্ধ আহত বন্দি
স্কুলের চালাঘরে হাতবাঁধা রক্তাক্ত
তবুও তুমি যখন তরুণ শিক্ষিকাকে উদ্ভাসিত করছিলে জ্ঞানের আলোকে
ঠিক তখনি ঘাতকের নয়টি বুলেট ঝাঁঝরা করে দিল তোমাকে
(এত ভয় ছিল তোমাকে ওদের)! সেই চিত্রকল্প কত দিন কত রাত
নির্ঘুম অস্থির যন্ত্রণায় পৃথিবীর সবচে নিষ্ঠুর প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছে
অথচ চে, আজও আমি প্রতিশোধ নিতে পারিনি!
আজও তোমার হত্যাকারীরা ক্ষুধা দারিদ্র্য শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াকু
অনুসারীদের নির্মমভাবে হত্যা করছে পৃথিবীর সব দেশে
ধর্ম বর্ণ গোত্র শক্তি দম্ভ আধিপত্য আর সভ্যতার কূটচালে।

আমি এখনো মনে প্রাণে তোমার পথকেই একমাত্র পথ মনে করি চে
একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লব, সুষম বণ্টন এনে দিতে পারে গরীবের মুক্তি
সেই নিরন্তর গভীর পরিচর্চায় সাংস্কৃতিক উত্তরণ
আর যা কিছু মধুবিষ, জ্যোৎস্নার প্রলেপে অমাবস্যা, সভ্যতার সফেদ
কফিনে মোড়ানো মানবতার নষ্ট লাশ
নিরাময়হীন ব্যাধিতে অসুস্থ করে তুলছে বিশ্বায়ন!

চে, এখনো লালপতাকা হাতে
তোমারই মতো বীরদর্পে হেঁটে যেতে চাই-
তোমারই শেষ বাণী উচ্চকিত করি- ‘বিপ্লবের মৃত্যু নেই’।

তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারিনি চে-
আমরা কোনো লেনিন পাইনি
আমাদের কোনো ক্যাস্ত্রো নেই, আমাদের কোনো গোর্কী নেই
আমাদের সবই ইউসেবি আর চিঙ্গালো, লিন পিয়াও কিংবা
মীর জাফর বা উমিচাঁদ- বারবার স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে
তবু নতুন স্বপ্নের বীজ বুনি মনে
প্রতিদিন প্রতিশোধ-স্পৃহা জ্বলে ওঠে হৃদয়ে
প্রতিশোধ একদিন হবেই, কেউ না কেউ তো আসবেই...



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

স্বপ্ন বিক্রি

প্রকাশ: ১২:৩১ পিএম, ০২ জুন, ২০২৩


Thumbnail

চরিত্র

মেয়েটি

মুক্তিযোদ্ধা

নাতি

যুবক

বুড়ো

কোরাস

 

মেয়েটি : জানি কি আমাদের প্রাপ্য কতটুকু?

মুক্তিযোদ্ধা : প্রাপ্য বুঝে নিতে হয়।

নাতি : আচ্ছা এই মেয়েটি কি আমার প্রাপ্য?

বুড়ো : যে জয় করে নিবে এ তারই সম্পদ।

মেয়েটি : তাহলে জয় করে নাও। পরাজিত হতে চাই। কেউ একজন পরাজিত করবে আমাকে।

বুড়ো : আমি তোমাকে স্বপ্ন দেবো, যা তোমরা পাওনি কখনও। সাদাকালো স্বপ্ন দেখে ক্লান্ত তোমরা। এবার তাতে রঙ দেবো।

নাতি : পারবে কি দিতে তুমি?

বুড়ো : জীবনে যা চেয়েছি তার একফোঁটাও পাইনি। এবার সুদসহ চাই। একটুও কম নয়।

নাতি : সে দেখা যাবে, কে জয় করতে পারে?

বুড়ো : ওহে বোকা বয়স আসেনি, মেয়েদের ছোঁয়ার। কি করে পাবে তাকে? এখনও সময় আছে, তোমাকে দেবো আমার ভাগ থেকে কিছু।

নাতি : তার আর প্রয়োজন নেই, আহা আকাশ জ্বলে-পুড়ে যায় চারদিক তার ভেতরে কেমন করে খুঁজে নিবো?

মেয়েটি : আপাতত বিদায় নিচ্ছি। আমাকে বলে দিও কি করতে হবে।

[মেয়েটি চলে যায়]

কোরাস : হুম না, আমাদের ঘরে

নাকি তোমাদের ঘরে

আলো জ্বলে না

হুম না হুম না।

বুড়ো : চলে গেলো সে, যেন আবার ফিরে আসার পোশাক গায়ে।

নাতি : ওকে যে ফিরতে হবে, আমি ওকে ফিরিয়ে আনবো।

বুড়ো : আজ থেকে আর বন্ধুত্ব নেই। সেখানে উড়বে ছাই শত্রুতার।

নাতি : সে আপনার ইচ্ছে। আমি তাহলে বিদায় নিচ্ছি।

বুড়ো : ধন্যবাদ, যাবার সময় নিয়ে যেও স্মৃতি। ওটা এখানে অপ্রয়োজনে উড়বে।

[নাতি চলে যায়]

বুড়ো : খানিকটা ঘুমানো যেতে পারে। একটু বিশ্রাম, আবার এ বাড়িতে উড়বে পাখি, ফুল আর সুবাস। মেয়েটির গায়ে গন্ধপোকারা উড়ে। আহা, আমি মাতাল হয়ে যাই। এই পোকারাই আমার পথ। বোকা ছেলেটি কি জানে এসব? এমন সময় আবার কে কড়া নাড়ে। আসুন যে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার ওপাশে।

[একজন লোক প্রবেশ করে]

লোক : ভালো আছেন নিশ্চয়ই। আপনার চোখে-মুখে অচেনা রেখা দেখা যায়।

বুড়ো : ঠিক চেনা হলো না। আগে দেখেছি এমনও নয়। রঙ গায়ে চড়িয়েছেন যে ভুল হয় মাঝেমধ্যে। মানুষ নাকি রঙের গোলা।

লোক : বোধহয় ভুলে গেছেন। আজ এখানেই আসার কথা ছিল আপনার কাছে। সময় বোধহয় ভুলিয়ে দিয়েছে, যাক তবে সে কথা।

বুড়ো : তবে সময়ই মনে করিয়ে দেবে, মনে করানোর কাজ তারই।

লোক : সময়ের প্রতি এত বিশ্বাস?

বুড়ো : সময়কে বিশ্বাস না করলে দীর্ঘ পথ শেষ করা যেত না।

লোক : কাজের কথা শুরু হয়নি।

বুড়ো : হয়ে যাবে কোনো একসময়। আপনি নিজেও জানবেন না তা।

লোক : ফুল এসেছে, যেমন বলেছিলেন আপনি।

বুড়ো : তবে দিয়ে এসো তাকে যার জন্য এনেছি এসব। আমার বারতা তার ঘরে দিয়ে এসো। যেন বা আমার চুম্বন এই ফুলের শরীরে।

লোক : আজ কোনজনার ভাগ্য খুলবে।

বুড়ো : ওহে বোকা, যে আমার ঘরের গন্ধ বদলে দেয়। পুড়িয়ে ফেলে পুরনো বসন্ত আসে মধুর হাওয়ায়।

লোক : তাকে একবার দেখতে হয়, মৃতের শরীরে সে প্রাণ দেয়। দিকে দিকে তার জয় শুনি।

বুড়ো : তুমিও শুনতে পেয়েছ। তার পরানের ডাক। আহা কেই বা শুনতে না পায়। এমনও করে যে ডাক দিয়ে যায়। তার ডাকে...

লোক : তার ডাকে প্রাণ নাচুক। হেসে হেসে চলে যাক নদী অথবা বাড়ির সামনের পথ।

বুড়ো : তবে দিয়ে আসো তার দরজায়, তান উঠবে সেথায়। ফুল টেনে নিক তার ঘ্রাণ ফুলের বুকে জমুক ঈর্ষার পলি। পরদিন প্রভাতে মৃত্যুর আগে, জানবে পরাজিত হয়েছে।

লোক : অক্ষম আমি, আঁধার চারদিক, আড়াল ছিঁড়ে না হায়।

বুড়ো : অন্ধের হাতে বিশ্বাসের চাবি। খোলা যায় না দরজা। খুঁজে নিতে হবে পথ, জানো কি তার চলা? কেটে ফেলো চোখ কিংবা নাক তাদের, যারা তোমার সঙ্গে নেই।

লোক : কাটবার আগে শুনতে চাই সে নাম।

বুড়ো : বুকের জমিনে সে ফসল হয়, তাকে নাই বা দিলাম তোমার কানে সে থাকুক আমার বুকের জমিনে, নবান্নের গন্ধে মাতাল আমি।

লোক : তবে তার ঘরে কেমনে যাব? পথ বলে দিন চলে যাই।

বুড়ো : কাল একজনই বেগুনি ফুল পরেছিল।

লোক : তাকে চিনি আমি। তার খোঁপায় ফুটেছিল বেগুনি ফুল। নির্ঘুম রাত, নীরবতার কান্না, মেঘের আড়ালে ডুবে যায় চাঁদ। স্বামী বিছানায় একা ঘুমায়, তার শরীরে শ্বেত আলপনা আঁকে আরেকজন। উৎসবের রঙ উজ্জ্বল হয়, ভোরের আলো থমকে যায় বিছানায় অন্য পুরুষ ঘুমিয়ে।

বুড়ো : বকবক করে বলছো তুমি কার কথা, হে অবোধ, হে বোকা।

লোক : কাল যার খোপায় বেগুনি ফুল, সে বিয়ের আসরে প্রতীজ্ঞা করেছিল।

বুড়ো : প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গে, বিশ্বাস ভাঙ্গেÑ থাকে শুধু প্রত্যাশা। তা না হলে আত্মহত্যা করতো সে। আমাদের চারপাশ মরে যেত। কোনো এক মৃত ভোরে, রাতের সঙ্গে সঙ্গে।

লোক : একবার তাকে পরিচয় করিয়ে দিন। বাকি কাজটুকু আমার হাতেই হবে।

বুড়ো : এই আগুন লাগা ভোরে কার কথা তোমাকে বলবো হে ফুল মানুষ।  তারপরও যদি শুনতে শখ হয় তোমার। তবে বলছি, যে আমার নাতির হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়।

লোক : মাটি ফেটে চৌচির, আগুন জ্বলে ঘরের চৌকাঠে, চারদিকে ওড়ে আঁধারের দেবতা, পুড়ে যায় বসন্তের পোড়া সকাল, মৃত পাতা, খসা ভ্রুণ, ধূসর পথে সে চলতে থাকে অনেকের সাথে। নগরবেশ্যার শরীরে ফোটে শুভ্র শিউলি। আমি কি এই মৃতের কাছেই দিয়েছি সব।

বুড়ো : যাই বলো তাকে আমার চাই।

লোক : তার হাতে আমিই দেবো ফুল।

বুড়ো : চিনতে কি পেরেছো তাকে?

লোক : তাকে চিনি আমি অনেকদিন থেকেই।

বুড়ো : তবে তো আর ভয় নেই। তোমার হাতেই তুলে দেবো আমার শখের পথ।

লোক : ভয় আছে আমার একটা। এখনও জানি না তার হাতে তুলে দিবো কোনো ফুল।

বুড়ো : ওহে, শরীর মুগ্ধ পুরুষ বলছো কি? ও তোমার ঘরে একরাতও থাকবে না।

লোক : থাকেনি, একরাতও থাকেনি সে। ভেঙেছে বিশ্বাসের দরজা-জানালা ।

বুড়ো : সরল করে বলো শুনি।

লোক : শুনতেই যদি চান, সময় দিতে হবে। সময়ের পিঠে চড়ে শোনাবো সে কথা।

বুড়ো : বলো, বলো তুমি।

লোক : পিপাসায় আর্ত আমি। তারপরও আপনার জন্য বলতে হবে।

বুড়ো : তুমি না বললে আর কেউ আমাকে বলবে না সে কারণ।

লোক : তাহলে বলছি, একদিন তার সঙ্গেই ঘুমিয়েছিলাম। আমার ঘরের সকল চাবি তার আঁচলে।

বুড়ো : এও কি বিশ্বাস করতে বলো।

লোক : তবে শুনুন, আমার কথায় খুলে দিতো বুকের বসন। কিংবা শরীরের আবরণ। তার স্তন খুলে দিতো পিপাসা মেটাতে। উরুর তিলে চুমু দিতাম।

বুড়ো : বলছো কি তুমি?

লোক : ওর বুকে মাথা না রাখলে ঘুম দূরেই থাকতো।

বুড়ো : ওহো এসব আর বলো না।

লোক : জানি আপনি শুনতে চাইবেন না। কিন্তু? একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। সে আমার চারধারে ঘুরঘুর করে। আমি কি দিতে পারিনি কিছু?

বুড়ো : বলো বলো কীসের অভাব ছিলো তোমার?

লোক : জানি না।

বুড়ো : একটা কিছু তুমি দিতে পারোনি। তাই আমি তুলে দিবো ওর কোলে।

লোক : দিন, তাই তুলে দিন। আমাকে ক্ষমা করুন এবার।

বুড়ো : আমি বটের সমান বয়সী।

লোক : সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

বুড়ো : আমি যোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা।

লোক : এটাও বাণিজ্য আপনার। যেমন স্ত্রী বিক্রি হয় বিত্তশালীর ঘরে।

বুড়ো : ও সেটাও জানো বুঝি।

লোক : জানি আমি অনেক কিছু।

বুড়ো : শুধু জানো না স্ত্রীবশীকরণ মন্ত্র।

লোক : সকালের আলোয় দুজনার একটি ঠোঁট।

বুড়ো : ওরে বাপরে, জানতে তাহলে সবই।

লোক : কেন জানবো না, ওর চোখে ছিলো মেনকা আর রম্ভা। আর ঠোঁটে মনসা শরীর। ঊরু সে যে ঊবর্শীর সন্দেহ নেই। স্তনে ছিলো আফ্রেদিতি। এমন রূপবতীর কাছে যে সব রাখা যায়।

বুড়ো : আমিও বলছি সব রাখতে দাও। আমি সব রেখে ধন্য হতে চাই।

লোক : তাহলে রাখুন আপনার সব।

বুড়ো : তোমাকে ডেকে এনেছি, খালি হাতে ফেরাবো না। আমার কাজটি করে দাও।

লোক : ঠিক আছে বলুন কি চান আপনি?

বুড়ো : ওর হাতে তুলে দাও ফুলের গুচ্ছ।

লোক : আজই তুলে দিতে চান।

বুড়ো : হ্যাঁ অনেক ফুল মিলে একটি প্রাণ।

লোক : তবে তাই হোক।

[লোকটি চলে যায়]

বুড়ো : যে পুরুষ মেয়েদের চেনেনি সে কি করে আনবে তাকে ডেকে। ব্যাটা বোকা পুরুষ জীবনে একবার হেরেছিলাম। সে হারও আমি তুলে রেখেছি। ওরা জানে না, স্মৃতিকে খুন করতে হয়। তা না হলে ও নিজেই খুনি হয়ে যায়। যাক আজ আমার আরামের ঘুম ডাকতে হবে না আর চোখের পাতায়।

[বৃদ্ধ বেরিয়ে যায়। নাতি আর মেয়েটি প্রবেশ করে]

[কোরাস]

হুম না

আমাদের ঘরে

নাকি তোমাদের ঘরে

আলো জ্বলে না

হুম না হুম না

সে তোমার অতি আপনজন

তার ঘরেই হোক উদ্বোধন।

নাতি : এসো ঘর আলো করে এসো, চারদিকে অন্ধকারের দৌড়। একবার এসে দাঁড়াও এখানে তারপর...।

মেয়েটি : তারপর?

নাতি : তারপর হবে উৎসব, আমাদের দুজনার আনন্দের মেলা। ওই দূর আকাশের তারাদের লোভ জাগে।

মেয়েটি : তারাদের ছুঁতে চাই, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। আমার ভেতরে বৃষ্টি নামে সারা আকাশ কালো করা মেঘ, বৃষ্টির জলে স্নান করি।

নাতি : তোমার কথায় ফুল ফোটে, আরও বলো আরও বলো শুনি।

মেয়েটি : কি শুনবে?

নাতি : যা বলতে চাও।

মেয়েটি : বলার নেই আমার কিছু।

নাতি : কোনো শব্দ অথবা বাক্য?

মেয়েটি : না স্যাঁতসেতে পৃথিবী, মৃত নদী আর কিই বা বলার আছে।

লোক : ভেবে দেখো আরেকবার, হয়তো ভুলে গেছে কেউ। যা বলা খুব দরকার।

মেয়েটি : লাল আকাশের বুকে ঝুলন্ত সূর্য অথবা চাঁদ স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।

লোক : আর কিছু?

নাতি : কে তুমি?

লোক : প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন জমে, উত্তরের ফেরা হয় না প্রশ্নের ঘরে।

নাতি : কেমন করে কখন এলে।

লোক : স্যাঁতসেতে দেয়ালে শ্যাওলা জমেÑ শ্যাওলার আড়াল থেকেই এসেছিÑ বাক্যেরা আঁধারে ঠাসঠুস ফোটে।

মেয়েটি : শান্তি নেমেছে চারদিকে, আবার ফিরেছ।

লোক : পুরোনো ভুল মুছে দেই।

মেয়েটি : সে ক্ষমতা কি তোমার আছে?

নাতি : ভুল? কোন ভুলের কথা বলো?

লোক : তার গায়ে গন্ধ পোকার বাস, দেহের ফাঁকে জমেছে রক্তপুঁজ। সুখ মেলে না।

মেয়েটি : নিলামের পাল্লায় উঠেছি, যাচাই-বাছাই করে নিন দ্রুত।

লোক : পাবো নাকি একটি সুযোগ?

মেয়েটি : বিশ্বাস খুন হলে কি আর ফেরা যায়?

লোক : ফুল হোক বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব। ভেবে নাও, এই পাপড়ির গায়ে হৃদপিণ্ডের রক্ত। আড়ালের তিনি পাঠিয়েছেন, ভেবে দেখো কাকে নেবে তুমি?

মেয়েটি : টগবগ করে ফোটে সে, হাওয়ায় উড়িয়ে নেয় আমার চুল। ফেনাভাঙা সমুদ্র ঢেউ, জলে মাছ উৎসব, অকস্মাৎ চমকে উঠি তপ্ত নিশ্বাসে। পেশিবহুল হাত আকড়ে ধরে শরীরের সন্ধিতে সন্ধিতে খেলে আঙুল। অন্ধ হয়ে যাই উত্তাপে।

লোক : মোহর পূজা করো না বালিকা, মোহ কেটে গেলে ডুবে যাবে নিশ্চয়ই তুমি, ডুবে যাবে গভীর অন্ধকারে।

মেয়েটি : ডুবতে চাই, ডুবতে চাই অতল জলে, সেখানে হাঙর, অক্টোপাস আর আমি।

লোক : মূর্খ মেয়ে বোঝে না নির্ভরতা, চেনে না তার বিশ্বাসের বিন্দু। ঘাস জমিনে ফলায় স্বর্ণরেণু। কেমন করে নিশ্চুপ থাকবে তুমি?

নাতি : সাবধান, সাবধান মিষ্টি মেয়ে, ওরা তোমাকে হত্যা করবে।

লোক : ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়ে যায়। হালকা হাওয়ায় ভাসে স্বপ্ন কল্পনার জাল। সেখানে যাই করো ভুল হবে তোমার। রইলো এখানে ফুলগুচ্ছ, বিদায় নিলাম।

মেয়েটি : ফুল তো প্রতীক আড়ালে তার নৃমুখ, চামড়ার ভাঁজে কেঁপে কেঁপে ওঠে। চোখের আলোয় শ্বেত পর্দা। বৃদ্ধের শরীর নদীরেখায় ভাসে।

নাতি : কে এই লোকটি?

মেয়েটি : একঘরে থাকতাম, আমার শরীরে ছিলো তার যথেচ্ছ অধিকার। আড়াল হলেই বদলে যেত মানুষটি। অন্য ফুলের মধু শোষণ করে।

নাতি : বলছো কি তুমি?

মেয়েটি : সংশয়ের দোলাচল।

নাতি : সংশয় আমাদের খেয়ে ফেলে।

মেয়েটি : ভয় নেই খুন করো সংশয়কে।

নাতি : খুন হয় না অবয়বহীনতা।

মেয়েটি : বলো তবে কি করবে?

নাতি : শেষ করে দিবো তাই, যা আমাকে টানে তোমার দিকে।

মেয়েটি : তবে শেষবারের মতো আমাকে নাও।

নাতি : যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে, জমিন চাষ হয় না। ফলে না কোনো ফসল।

মেয়েটি : পাও না কি ফলনের ঘ্রাণ, এই শরীরে আউশ ফোটে না কি?

নাতি : ফিরে যাও তোমার পুরনো ঘরে।

মেয়েটি : বিশ্বাস ভাঙার নায়ে চড়তে বলো। যদি তাই চাও তবে দিয়েছিলে কেন তুমি।

নাতি : আজ ফিরিয়ে নিলাম সব।

মেয়েটি : তবে আর কি বিদায় হয়ে যাক।

[কোরাস]

হুম না

ভাঙে ঘর হুম না

এই ঘরে সে থাকে না

হুম না হুম না

ফিরে আসে সে বৃদ্ধ

হুম না হুম না।

বুড়ো : আবারও চলে গেলে যুবক, অনেক বছর আগের মতো এ বছরও একই ঘটনা।

মেয়েটি : একই ঘটনা?

বুড়ো : অনেক বছর আগে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সে চলেও যায়। তারপর তার স্মৃতি থাকে। এবারও আরেকজন চলে গেলো।

মেয়েটি : আরেকজন?

বুড়ো : আরেকজন নয় স্মৃতি চলে যায়।

মেয়েটি : তবে?

বুড়ো : তবে আর কি? এই স্মৃতিকে বাঁচাতে হবে নিজেদের প্রয়োজনে।

মেয়েটি : কি করে?

বুড়ো : তোমাকে গ্রহণ করে ওর ভালোবাসা বিশ্বাস সবটুকুই তুমি, তোমাকেই নিতে চাই।

মেয়েটি : ও তবে কার স্মৃতি?

বুড়ো : আমার সন্তানের, যে চলে যাবার আগে মরে যায়। আমি তার শেষ চোখ দেখি সেখানে শুধু বাবার জন্য ঘৃণা। আর মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে আর কী থাকে?

মেয়েটি : আপনি নিজেও তো একজন...

বুড়ো : ওহে মেয়ে চুপ আর নয়, শুনতে চাই না কিছুই আর শেষ করে দাও এখানেই।

মেয়েটি : আপনি চাইলে এখানেই শেষ।

বুড়ো : হ্যাঁ আমার চাওয়া শেষ করো তুমি এসব। আমি তোমাকে বলবো না কে আমি?

মেয়েটি : নিজেকে এত ভয়।

বুড়ো : না তোমাকে ভয়।

মেয়েটি : ভয়কে জয় না করলে, আমাকে পাবে না।

বুড়ো : না তোমাকে না পেলে হারবো।

মেয়েটি : তোমায় গলায় জয়ের মালা, সে তো আমিই।

বুড়ো : তবে শোনো বলি তোমাকে। আমি জয়ী হতে পারিনি। আমার ছেলে ছিলো যোদ্ধা। এক নামকরা মুক্তিযোদ্ধা। এক রাতে জেনে যায় তার বাবার পরিচয়।

মেয়েটি : রাজাকার সে।

বুড়ো : জানো তুমি।

মেয়েটি : আর সে খুন হয় বাবার হাতেই।

[কোরাস]

ধূপ দাও চারদিকে

ধোয়া উড়ুক

ধূপ দাও ধোয়া উড়ুক

আমি সুখ চাই

পাখি চাই

আর ওকে খুন করতে চাই।

এখানেই শেষ হতে চাই

ধোয়া উড়ুক

ধূপ দাও ধোয়া উড়ুক

উড়ুক ধোঁয়া।

বুড়ো : সব জানার পরও এলে তুমি।

মেয়েটি : আসিনি তুমি জয় করে নিয়েছ।

বুড়ো : কিন্তু...

মেয়েটি : আমাকে গ্রহণ করো পুরুষ।

বুড়ো : তোমার চোখে তার চোখ, ভুল হয়নি আমার একচুলও।

মেয়েটি : ভোগ করো আমাকে আর কষ্ট নেই ভোগ করো।

বুড়ো : ফিরে যাও তুমি, চাই না তোমাকে ফিরে যাও বালিকা। আমার ঘরে সর্বনাশের আগুন জ্বলে। ফিরে যাও হে বালিকা।

মেয়েটি : ফেরার জন্য নয়, তোমার জন্য এসেছি। আমি বর্তমানের পিঠেই চড়তে চাই।

বুড়ো : আমার অতীত ফিরে আসে, তাকে ফেরাতে পারি না।

মেয়েটি : তোমার জন্য ভাঙতে পারবো না, থাকবে সে আমার পাশে। আয়তন আরও বড়ো হবে।

বুড়ো : তবে তোমার বুক কেটে রক্ত পান করাও আমাকে। আমার পিপাসার্ত ঠোঁটের আশা মিটুক।

[কোরাস]

সুখ দাও

ধোঁয়া উড়ুক

ধূপ দাও ধোয়া উড়ুক

সুখ উড়ুক।

তার বুকে মাখন কাটে ধারালো অস্ত্র

চিৎকার শেষ হলে কি আর শব্দ হয়

শবদেহ জুড়ে তখন শীতল রক্ত।

রক্ত দাও

পুণ্য হোক।

লেখক, ড. তানভীর আহমেদ সিডনী : গবেষক, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

বীথির ছুটি

প্রকাশ: ০৯:৩১ এএম, ০২ জুন, ২০২৩


Thumbnail

অ্যালার্মের টুংটাং শব্দে বীথি আড়মোরা ভেঙে ঘুম থেকে ওঠে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছাড়তে হয় তাকে।

আহা সুমন কি সুখের ঘুম দিচ্ছে… এক ঝলক তাকিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে সে।

ফজর নামায শেষে, রান্নাঘরে ঢোকে সকালের নাস্তা তৈরির জন্যে। তাড়াহুড়া করে সবার নাস্তা তৈরি করে টেবিলে লাগিয়ে দেয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় সাতটা।

বাচ্চাদের রুমে গিয়ে দেখে কাঁথা জড়িয়ে দিব্বি ঘুমিয়ে আছে সবাই।

‘ওঠ্ ওঠ্ জলদি, স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে, নাস্তা রেডি’- বলেই চাদর টেনে নেয় বীথি। জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়, সূর্যের আলো বাচ্চাদের মুখের ওপর এসে পড়ে।

‘মা মা পর্দা টেনে দাও মা, চিৎকার জুড়ে দেয়।’

‘স্কুলে দেরি হয়ে যাবে।’

‘মা আজ স্কুল বন্ধ।’

‘কেন রে?’

মে দিবস। আজ ছুটি।

এদিকে স্বামীকে তাড়া দেয় বীথি,

‘ওঠো ওঠো অফিসের দেরি হয়ে যাবে, নাস্তা  রেডি…’

‘আজ ছুটি, মে দিবস আজ। ঘুমাতে দাও।’

প্রায় নয়টা বাজে, বুয়ারও দেখা নেই। অন্য দিনে সকাল আটটার মধ্যেই চলে আসে। আজ দেরী কেন? বুয়াকে ফোন দেয় সে,

‘বুয়া এত দেরী কেন আজ?’

‘আজ আসুম না আপা।’

‘কি? ময়লা কাপড জমে আছে দুদিন ধরে। আজ মাছও কাটা লাগবে। অনেক কাজ বাকি।’

‘আজ তো ছুটি আপা। আজ মে দিবস। শ্রমিক দিবস। আব্দুলের বাবা আজ বাড়িতে।’

সবারই আজ ছুটি… তার কোনো ছুটি নেই।

মনটা খারাপ হয়ে গেল বীথির।

বাড়িতে সারাক্ষণ দৌড়ঝাপের মধ্যেই কেটে যায় তার সময়।

বইয়ের স্তুপ পড়ে আছে। পড়ার সময় হয় না তার। শুধু যত্ন করে মুছে রাখা হয় নিয়মিত।

বীথি হঠাৎ অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসলো। হুট করে দুপুরের রান্নার সরঞ্জাম ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিলো। গতকালের রান্না যা আছে তা আজ হয়ে যাবে।

ঘরে ঢুকেই স্বামীর গায়ের চাদরটা অর্ধেক টেনে নিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে।

সুমন বেশ অবাক হলো। ‘কি ব্যাপার? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? শুয়ে পড়লে আবার!’

‘হুম। আজ মে দিবস। আমিও আজ ছুটি নিলাম।’

‘বাচ্চারা ঘুম?’ বলেই সুমন বীথির কাছাকাছি এসে তাকে টেনে নিতেই…

‘একদম বিরক্ত করবে না। একটা ঘুম চাই। টেবিলে সব খাওয়া সাজানো আছে। যে যার মতো খেয়ে নিও।’

বলেই সে মাথা অব্দি চাদরটা টেনে নিলো।

লেখক, শাহলা আহমেদ: গল্পকার 



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

হাজেরার শেষ অনুরোধ

প্রকাশ: ০৯:১০ এএম, ০২ জুন, ২০২৩


Thumbnail

হাজেরার শ্বাস উঠেছে।

শ্রাবণের ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার রাত। সারা দিনের একটানা টিপটিপ বৃষ্টি শেষ বিকেলে দমকা হাওয়ার উসকানিতে দ্বিগুণ তীব্রতা পেয়েছে। ছলিম শেখ সেই সকাল থেকেই হাজেরার পাশে বসে আছে। কামারের হাপরের মতো হাজেরার পাঁজরসর্বস্ব বুক এক-একবার সশব্দে উঠছে আর নামছে। হাজেরার মাথার কাছে ম্লান কেরোসিন বাতিটি দমকা বাতাসে নিভে যাওয়ার উপক্রম। রাতের গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি আর বাতাসের তোড় যেন বেড়েই চলেছে। ছলিম শেখের গায়ে তেল চিটচিটে কাঁথা দ্বিগুণ ওজনে যেন আধভেজা হয়ে লেপ্টে আছে। হাজেরার নিমিলিত চোখের পাতায় তার ভ্রুক্ষেপহীন দৃষ্টি।

এই চেয়ে থাকা ছাড়া ছলিম শেখের আর কী-ই বা করার আছে! নাছিরপুরের গৌর কবিরাজের হলুদ বাটা হাজেরার বুকে মালিশ করে দিয়েছে, উজলপুরের মুন্সী পীরের মাদুলি বাহুতে বেঁধে দিয়েছে, খান জাহান আলীর মাজারে শিরনি মানত করেছে, গত দুই দিন যাবত হাজেরার পাশে বসে তার শুশ্রুষা করেছে। এর বাইরে কিছু করার আর কী-ই বা থাকতে পারে ছলিম শেখের?

সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরের দাম্পত্য; সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, মান-অভিমান, আগ্রহ-অবহেলা, জীবিকা-জৈবিকতার সাথি হাজেরা। চেখের সামনে মৃত্যুর হীমশীতল অজানা রাজ্যের পথে এক-পা দু-পা করে এগিয়ে যেতে দেখেও ছলিম শেখের কিছুই করার নেই। কিছুতেই সে ফেরাতে পারবে না হজেরাকে।

ছলিম শেখের বিস্ফারিত চোখের কোণে সহসাই ঝিলিক দিয়ে যায় একটা দৃশ্য। তাদের যৌথজীবনের শুরুর দিককার ঘটনা। ক্ষেতে মই দেওয়া শেষে গাই দুটোকে রাস্তার পাশে বেঁধে দিয়ে এসে হাজেরার কাছে ভাত চেয়েছে। আজ একটু আগেই এসেছে বৈকি, কিন্তু খিদেটাও যেন পেটের মধ্যে হাঙরের মতো কামড়াতে শুরু করেছে। হাজেরা গোবরের ঘুঁটে বানাচ্ছিল। ‘আসতিছি’ বলে আর আসার নাম নেই। এরইমধ্যে আরও দুবার ভাত চাওয়া হয়ে গেছে ছলিম শেখের। হাজেরার কোনো সাড়া নেই। ছলিম ঘরের পেছনের যে দিকটায় হাজেরা কাজ করছিল, সেখানে গিয়ে চিৎকার করে উঠল।

‘ভাত চালাম না?’  

‘শুনিছি তো। দুডে-তিনডে ঘুঁটে আছে, শেষ করে আসতিছি।’

হাজেরার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে ছলিমের মাথায় খুন চড়ে গেল- সোওয়ামির কথায় সে গুরুত্বই দিলো না! মহিলারা এভাবেই আস্তে আস্তে সোয়ামির অবাধ্য হতে শেখে। ছলিম শেখ হুংকার দিয়ে ওঠে-

‘তোর ঘুঁটে বানানি শেষ কত্তি অবে না। আমিই তোরে শেষ কত্তিছি।’

সেদিন দুপুরের আগক্ষণে ঘটনার আকস্মিকতা আর অনিবার্য উত্তেজনায় ছলিম প্রলয়পর্বের যেখানে এসে ইস্তফা দিলো, হাজেরার শুরু হলো ঠিক সেখান থেকেই।

ফাঁকা মাঠের মধ্যে লম্বালম্বি আল। সেই আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাজেরা। অনেক পেছনে ছলিম। হাজেরা যে সত্যি সত্যি বাপের বাড়ি রওনা দেবে এ কথা সে ভাবতেই পারেনি। ছলিম ডাকছে, ‘বউ..., বউ...’।

বাতাসের উজানে তার ডাক হজেরার কানে পৌঁছানোর কথা না, তা ছলিমের জন্য সহজেই অনুমেয়। তবুও ছলিম ডেকে যাচ্ছে, ‘বউ..., বউ...’। বারবার ‘বউ’ শব্দটির পুনরাবৃত্তি শেষ পর্যন্ত ছলিমের লজ্জার উদ্রেক করে। ছলিম এবার ডাকতে শুরু করে ‘হাজেরা’। ততক্ষণে হাজেরাকে প্রায় ধরে ফেলেছে ছলিম।

সন্ধ্যায় অনেক স্নেহে ছলিমের পাতে কলমি শাকের ঝোল তুলে দেয় হাজেরা। অনুতাপের সুরে হাজেরাকে উদ্দেশ্য করে ছলিম বলে ওঠে, ‘খিদে নাগলি আমার মাতা ঠিক থায়ে না, বউ’। হাজেরা আঁচলের নীচে লজ্জাবনত মুখে হেসে ওঠে। বড় প্রাঞ্জল, ক্ষমাশীল সে হাসি।

সেদিন যেভাবেই হোক ছলিম অনেক অনুনয় করে হাজেরার মান ভাঙিয়ে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু আজ মৃত্যুপথযাত্রী, চেতনাহীনা, হাজেরার পাশে বসে এই একটি কথাই শুধু ছলিম শেখ ভাবছে, কোনো অনুনয়েই হয়তো আজ হাজেরাকে ফেরানো যাবে না। সবকিছু ছাপিয়ে আরও একটা অনিশ্চয়তা তাকে ব্যগ্র করে তুলছে। হাজেরার শেষ অনুরোধটা সে রাখতে পারবে তো? তার মৃত্যুর সময় মেয়ে দুটি যেন পাশে থাকে, এই অনুরোধ ছিল তার।

গ্রামের একপ্রান্তে রাশিকৃত বাঁশ আর ঘন সন্নিবেশিত গাছগাছালির মধ্যে ছলিমের দোচালা ঘর। গ্রামের কেউ এ পথে হাঁটে না। তার ওপর একটানা বৃষ্টিতে এ দুদিনে এদিকে এমন কেউ আসেনি যাকে দিয়ে সে তার মেয়ে দুটির বাড়িতে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। ছদর মাঝি সামনের শীর্ণকায় খাল পথে প্রতিদিন খেপ নিয়ে যাত্রাপুর হাঁটে যায়। তাকে বলে দিলে আটটার মধ্যেই দুই মেয়ের বাড়িতে খবর পৌঁছে যাবে। কিন্তু ততখানি সময় ছলিম পাবে তো?

একটা ঝটকা বাতাসে হাজেরার সিথানের বাতিটি নিভে গেল। চারদিকে অথৈ অন্ধকার। ছলিমের মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা দোল দিয়ে গেল। কাঁপাকাঁপা হাতে কিছুক্ষণ ম্যাচটি খুঁজল। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজটা আরও বেড়েছে। তবে বৃষ্টির ফোঁটা আগের মতো বড়ো নেই বলেই মনে হচ্ছে। হাজেরা অদ্ভুত ভয়ানক একটা শব্দ করছে- গর্র... গর্র...। প্রথম ঘষায় আলো জ্বলল না। ভিজে আবহাওয়ায় ম্যাচকাঠির বারুদ ‘মজে’ গেছে। কয়েকবার চেষ্টার পর বাতি ধরালো ছলিম। বাতির আলোয় হাজেরার রোগজীর্ণ মুখখানি স্পষ্ট হয়ে উঠল। আহা, সেই মুখ! প্রথম যেদিন ছলিম হাজেরার মুখ দেখেছিল সে খুব আনন্দের মুহূর্ত। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা প্রেম আর কিছুটা কৌতূহলের দৃষ্টিতে ছলিমের চোখে হাজেরার সুবিন্যস্ত চুলের প্রচ্ছদপটে চন্দন, কুঙ্কুম, সুরমা চর্চিত মুখখানা এক কথায় ‘হুর’ বলে মনে হচ্ছিল। সে দৃশ্য এখনও ভোলেনি ছলিম। খুব বেশি ধুমধাম করে যে সে হাজেরাকে বিয়ে করেছিল, তা-ও না। অবশ্য এসব ক্ষেত্রে বাইরে ধুমধাম না থাকলেও অন্তরে সে ধুম মুখর হয়ে ওঠে। কিছুতেই তা চাপা থাকে না। হজেরা তার জীবনের প্রথম ও একমাত্র নারী যাকে সে ছুঁয়ে দেখেছিল। সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে চুমু খেয়েছিল। সেদিন লজ্জার রক্তিম হাসিটা পৃথিবীর সবচেয়ে দামী প্রসাধন হয়ে লেপ্টে ছিল হাজেরার মুখে। হাজেরার বয়স তখন সতেরো।

সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে মনে পড়ে যায় ছলিমের। প্রথমে সে ঘরে ঢুকল। হাজেরা জরির ঘোমটা পরে মাথা নিচু করে বসে আছে। ছলিম হাজেরার পাশে গিয়ে বসলো। তার মধ্যে শুধু সংকোচ আর অস্বস্তি। স্ত্রী হলেও অপরিচিত, অজানা একটা মেয়ে হাজেরা। তার সাথে কথা শুরু করতে অনেক সময় লেগেছিল। বেশ রাতে তারা পাশাপাশি শুয়ে পড়েছিল। সাহস করে ছলিম তাকে পরিপূর্ণভাবে বেষ্টন করে ধরে কয়েক দিনের বিয়ে সংক্রান্ত কাজে মন ও শ্রম দেয়ার ক্লান্তিতে খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছিল।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন শেষরাত। ঘন বাঁশের জটলা এড়িয়ে পশ্চিম দিকের বেড়ার ফাঁক হতে ভাঙা চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে আবছা আলোকিত করেছে। ছলিমের খেয়াল হলো এতক্ষণ সে হাজেরাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। হাজেরা তখনও ঘুমায়নি। ছলিমের বেষ্টিত বাহুর মধ্যে ঘুমের ভান করেছিল। হাজেরার শরীর থেকে বিয়ের শাড়ি আলাদা করে ফেলল ছলিম। হাজেরা বাঁধা দিলো না। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের ম্লান আলোয় হাজেরার উন্মোচিত শরীরের ফর্সা ত্বক দেখে ছলিমের গা দিয়ে ঘাম ছুটে এলো। সে তখন থরথর করে কাঁপছে। মনিহারি দোকানের সস্তায় কেনা কুঙ্কুমের তীব্র ঘ্রাণ সত্ত্বেও ছলিমের নাকে হাজেরার শরীর থেকে নাম না জানা ফুলের বিস্মৃত অথচ ঘোরলাগা ঘ্রাণ আসছিল। ছলিমের লোলদৃষ্টি হাজেরার পা হতে লেহন করে করে মুখের কাছে এসে থেমে গেল। চোখ বুঁজে সারা দেহ কাঁপিয়ে ঘন আর তপ্ত নিঃশ্বাস ছড়াচ্ছিল হাজেরা আর স্পর্শ বিহ্বল ছলিমের হাত হাজেরার সারা শরীর মথিত করছিল। এক অভূতপূর্ব উত্তেজনায় ছলিম শিহরিত হয়ে উঠল।


যে অঙ্গসৌষ্ঠব, যে লাবণ্য আর যৌবনের লালিত্য জীবনের প্রথম রাতে হাজেরা তাকে উপহার দিয়েছিল, তা আজ অতীত। তার সর্বস্ব শুধু এক হাড় জিরজিরে শরীর। অতীতের সুখস্মৃতিমন্থন শেষে বর্তমানের কিনারে এসে দাঁড়াতেই ছলিমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কুঞ্চিত কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা গরম অশ্রু।

ছলিম হাজেরার আর্তির কাছে নিজের অসহায়ত্ব নিয়ে আজ দুপুরেও একবার কেঁদেছিল। হাঁপাতে হাঁপাতে হাজেরা একটি কথাই শুধু বলছিল তখন, ‘কিছু ভালো ঠ্যায়ে না। ভালো ঠেয়ার কোনো ওষোধ আছে?’

নদীর ধারে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না ছলিমকে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে দেখল একটা ছিপছিপে নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু কালো মেঘে আকাশ গম্ভীর হয়ে আছে। ছলিম হাঁক দিলো- ‘ছদর, ও ছদর..’।

বৈঠা সঞ্চালনে বিরতি হলে প্রতু্যুত্তর এলো, ‘হ, কেডা’?

‘আমি ছলিম।’

‘ব্যান রাত্তিরি  (ভোরে) নদীর ঘাটে ক্যান, খবর কী?’

‘হাজেরার অবস্থা খারাপ! উঠে যাবে মনে অয়। মাইয়ে দুইডেরে খবরডা দিয়ো। হাজেরার ইচ্চে, শেষ দেহা দ্যাকপে।’

‘শুনে মনডা খারাপ অয়ে গেল। তুমি বাড়ি যাও। খবর পৌঁছোয়ে দেবানি।’

ছলিম ফিরে আসছে। মনে এক ধরনের দ্বিধাময় আনন্দ। মেয়ে দুটোকে সে হাজেরার মৃত্যুর আগেই খবর দিতে পেরেছে। বিকেল নাগাদ মেয়েরা বাড়িতে পৌঁছে যাবে। মায়ের রোগশয্যার পাশে তারা দু-দণ্ড অশ্রু বিসর্জন করবে, মায়ের বিশীর্ণ খসখসে শরীরে শীতল পরশ বোলাবে। হাজেরার কথা রাখতে এতটুকু ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিল না তার।

বাড়ির কাছে আসতেই আর এক পশলা বৃষ্টি নামলো। একটু দৌড় দিয়েই তাকে ঘরে উঠতে হলো। চারদিকে ততক্ষণে আবার অন্ধকার ঘিরে আসছে। ভোরের দিকে হাজেরা গৌর কবিরাজের মালিশটা আরেকবার মেখে দিতে বলেছিল। কৌটা নিয়ে হাজেরার পাশে গিয়ে বসলো ছলিম, হাত রাখলো শরীরে। একি! হাজেরার সারা শরীর বরফের মতো শীতল!

ছলিম মন্ত্রচালিতের মতো মালিশের কৌটাটা একপাশে সরিয়ে রাখলো।

[চাণক্য বাড়ৈ : কবি, কথাসাহিত্যিক]



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদ

প্রকাশ: ০৮:৪০ এএম, ০২ জুন, ২০২৩


Thumbnail

জীবনটা ছোটো হলেও কেউ ছোটো হয়ে বাঁচতে চায় না। অনেক স্বপ্ন নিয়ে পথচলা মানুষেরই ধর্ম। এই পথচলায় মানুষ অভ্যস্ত। পথ চলতে চলতে কেউ সফলতা বা ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে চিরতরে চলে যান পরকাল নামক বিস্ময়ভরা ভুবনে। সেখানে কি আছে না আছে কেবলই সৃষ্টিকর্তা জানেন। তারপরেও পরকাল নিয়ে মানুষের অযাচিত চিন্তাভাবনা। যে মানুষটি সারাদিনের ক্লান্ত শরীরের ঘাম ঝরিয়ে দিন শেষে জরাজীর্ণ ছোট্ট কুটির অথবা মধ্যবৃত্তের ঘ্রাণহীন দুর্বিসহ যন্ত্রণায় ছটফট প্রাণচঞ্চল পুরাতন কুটির অথবা বিলাসবহুল মোহময় অট্টালিকায় ফিরে আসে তখন আপনজনের মমতামাখানো মুখগুলো এনে দেয় প্রশান্তির ছোঁয়া। জীবন এরকমই যার যার স্থান থেকে উপভোগ্য। জীর্ণশীণ ছোট্ট কুটির, প্রাণচঞ্চল পুরাতন কুটির, বিলাসবহুল মোহময় অট্টালিকা যে যেখানে থাকি না কেন জীবন তো এমনই একদিন এ ভুবন থেকে চলে যেতে হয়। এ ভুবন ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে কি হয়? কি হবে? কারো জানা নেই। তবে পরকাল বিশ্বাসী স্ব স্ব ধর্মমতে দিনযাপন করেন। এমন ধ্রুব সত্যটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না বা পরকাল কেউই অস্বীকারও করে না।

৮২ বছর বয়সে খোকন মিয়াকে বার্ধক্য ছুঁতে পারলেও যৌবনের ভাবনা তাকে ঘিরে রাখে। খোকন তার আসল নাম নয়। খুব কাছের একজন মানুষ তাকে খোকন বলে ডাকতো। কাছের মানুষ বলতে স্ত্রীর বড়ো বোন। তার স্বামীর নামের সাথে মিল থাকায় আসল নাম ধরে কোনোদিন ডাকা হয়নি সালু বুজির। তাই ছোটো ভগ্নিপতিকে খোকন বলেই ডেকে তৃপ্তি পেতেন। স্ত্রীর বড়ো বোন মানে খোকনেরও বড়ো বোন। তার তুলনা হয় না। সালু বুজির দেওয়া নতুন একটা নাম পেয়ে খোকনও মহাখুশি। যা তিনি গর্ব করে অন্যদের বলতেন। অর্থ-বৃত্তের মধ্যে জীবন চালিকায় শক্তিমান এক অভিনেতা। তবে দুঃখ একটা, অভাবে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিল তখনও তিনি বিচলিত হননি। টুকটুক করে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া তাদের বিয়ে দেয়া সবই সম্পন্ন করলেন। মোটাভাত মোটা কাপড়ের সন্ধান প্রতিটি সন্তানের জন্য তিনি পরম মমতায় নিশ্চিত করেছেন। শুধু একটা কষ্ট মনের মধ্যে হোঁচট খেতে লাগল। ছয়টি সন্তানই বিয়ে দিয়ে যার যার স্থান করে দিয়েছেন। কোথাও বড়ো রকমের তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল না। 

প্রতিটি সন্তানকে তিনি শাসন আর ভালোবাসা দিয়ে গেছেন। স্বভাবতই সব সন্তানের মধ্যে ছোটো ছেলে একরোখা আর জেদী ছিল। একরোখা স্বভাবের কারণে তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। সে ভালোবাসার মূল্য সে রাখতে পারেনি। হয়তো তার একরোখা ভাষায় রেখেছে যা খোকন মিয়া বুঝতে পারেননি। সে রেগে গেলে তাকে কন্ট্রোল করা খুব সহজ ছিল না। মা‘র কাছে হার মানতো ছেলেটা। তার ওপর রাগও যেমন ছিল ভালোবাসাও ছিল প্রবল। বাবা সব সময় চাইতেন তার ছোট ছেলেটা ভালো থাকুক। তার ভালো থাকা নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না। ভালো ছাত্র, ক্লাসের ফার্স্ট বয়। খোকন মিয়া ভাবতো, হয়তো সে এ সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু তা আর হলো কই? বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে ছেলের। আয়-বরকত নাই। কেউ মেয়েও দিতে চায় না। ছোটো ছেলেটাকে নিয়ে খোকন মিয়ার পাহাড় সমান চিন্তা। 

অনেক প্রচেষ্টার পর বিয়েতে রাজি করা গেল ছেলেকে। ছেলে রাজী তাই খুটে-খুটে মেয়ে দেখার বিষয়টি বাদ দিয়ে দিনক্ষণ দেখে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বিয়ের পরেও শান্তি নেই ছেলের সংসারে। তাদের খরচ চালাতে হচ্ছে। তাতে দুঃখ নেই খোকন মিয়ার। ছেলে তার বউকে নিয়ে সুখে শান্তিতে খাকুক- এটাই তার একমাত্র প্রার্থনা।

২০১৬ সালের ২১ মার্চ যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন তার জীবদ্দশায় সেটা তার শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। ছোটো ছেলেকে বিয়ে দেয়ার ছয় মাস পরের ঘটনা। হাসিখুশি অবস্থায় তার বউকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল তারা। কিন্তু বাবার বাড়ি থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, তাদের মেয়েকে আর পাঠাবে না স্বামীর ঘরে। এদিকে ছেলে বৃদ্ধ বাবা-মাকে চাপ দিচ্ছে বউকে বাপের বাড়ি থেকে এনে দেয়ার জন্য। একপর্যায় ছেলের বউকে আনার জন্য বৃদ্ধ খোকন মিয়া স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হলেন। 

খোকন মিয়ার বড়ো সন্তান সূচনাকে বলে গেলেন, দেড় দুই ঘণ্টার মধ্যে ছেলের বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। তিনটা... চারটা... পাঁচটাও বেজে গেল! তাদের আসার কোনো নামগন্ধ নেই! সূচনা ফোন দিচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না কেউ। চিন্তায় পড়ে গেল মেয়েটি। 

সূচনার একমাত্র মেয়ের জন্মদিন আজ। মেয়েটা কাছে নেই। লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় থাকে। সন্তান দূরে থাকলে যা হয়, মন সবসময় অস্থির হয়ে থাকে। তার ওপর বৃদ্ধ বাবা-মা ছোটো ভাই, বউকে নিয়ে বাড়ি  ফিরছে না। একসময় ফোনও বন্ধ হয়ে যায়! বাবা-মায়ের জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার।

রাত দশটায় বাবা ফোন দিলেন। সূচনাকে বাবার বাসায় যেতে হবে। বাবার বাসায় হাজির হয়ে দেখলো বৃদ্ধ মা-বাবা রীতিমতো কাঁপছে থরথর করে । কিছুই বলতে পারছে না। অসহায় দুইজন মানুষ। তাদের করুণ চাহনি বলে দিচ্ছে না বলা কিছু যন্ত্রণা। বাবা-মাকে দেখে বাসায় ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা বাজলো সূচনার। দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছে না। 

পরদিন ভোরে অন্ধকার না কাটতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায়। দরজা খুলে দেখে মা দাঁড়িয়ে। কাক-পক্ষি জাগার আগে অন্ধকার ভোরে মা সূচনার বাসায় এসে হাজির! 

‘কি ব্যাপার মা, তুমি এত সকাল সকাল।’

মা বললেন, ‘কারো সামনে কথা বলা যাবে না।’

তিনি তখনও রীতিমতো কাঁপছেন।

‘ছোটো বউয়ের সামনে কথা বলা যাবে না, তাই তোর বাসায় এলাম।’ 

কথাগুলো বলা খুবই জরুরি। একপর্যায়ে গতকাল দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্মম অত্যাচারের গল্প বলে ফেললেন এক নিঃশ্বাসে। 

ছেলের শ্বশুর বাড়িতে যেতেই তাদের ফোন কেড়ে নেয়া হয়। মায়ের সামনেই বাবাকে অপমান করা হয়। বউ নিতে হলে স্ট্যাম্পের ওপর সই করে বউ নিতে হবে। বউ তারা দেবে না। সে বাড়ির পাঁচ-ছয় জন লোক মিলে বৃদ্ধ খোকন মিয়া ও তার স্ত্রীকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেছে। তাদের মেয়েকে নিতে হলে বাড়ি-জমি লিখে দিতে হবে, না হয় ছেলেকে দিয়ে খোরপোষসহ তালাক পাঠাতে হবে! বাবা সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে রাজি না হওয়ায় তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। একসময় বাধ্য হয়ে জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া নাবিকের মতো ফ্যালফ্যাল চাহনিতে ঘৃণাভরে স্ট্যাম্পের ওপর স্বাক্ষর করেন এবং ছেলের বউকে বাড়িতে আনার অনুমতি পায় তারা। 

বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। বউকে কোনো কথা শোনানো যাচ্ছে না। তার একটাই কথা, বাড়ি বিক্রি করে তাকে টাকা দিতে হবে, সাথে ডির্ভোস। তোর বাবা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাকে বাঁচানো যাবে না! রীতিমতো মরার ঘর থেকে ফিরে এসেছে।

সব শুনে মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ির রিকশায় তুলে দিলো। বিপদে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে। তবে সবার আগে জীবন বাঁচানোর জন্য সুস্থ থাকাটা জরুরি। মা নিরুপায় হয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। একমাত্র মা-ই পারে এ সংকট সামাল দিতে। মায়ের ধৈর্য অপরিসীম। 

সপ্তাহখানেক পরে ছোটো বউ ঢাকায় ছেলের কাছে গেল এবং দিনে একাধিকবার কারণে-অকারণে ফোন করে হাজারও অভিযোগ জানায়। প্রতিদিন ছেলে-বউ এর ঝগড়াঝাটি, মারামারির খবর অতিষ্ট  করে তোলে খোকন মিয়াকে। বিষয়টি নিয়ে তার নাওয়া খাওয়া বন্ধ প্রায়। 

একপর্যায়ে তার কাছে মনে হলো, ছেলেকে সে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবেন। ছেলের পরামর্শে খোকন মিয়া উকিলের সাথে তার সাথে ঘটে যাওয়া সবকিছু খুলে বলেন। উকিল প্রথমে হাসেন আর বলেন, ‘ছেলে ত্যাজ্য করে কি করবেন? ত্যাজ্য করলেও সে আপনার সম্পত্তির ভাগ পাবে। ওসব করে কোনো কাজ নেই। আপনি বরং ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টননামা করে দেন।’

খোকন মিয়া এবার বেঁকে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন, বন্টননামা করলে তো সাথে সাথে ছেলে-মেয়ে মালিক হয়ে যাবে। তারপর তারা যদি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন কি হবে? না, তা করা যাবে না। বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে পড়া যাবে না। তিনি উকিল সাহেবের কাছ থেকে সময় চেয়ে ফিরে এলেন। কিন্তু  দুই চোখে ঘুম নেই তার। কি হবে শেষ পর্যন্ত!

অনেক চিন্তা-ভাবনার পর স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর আর ছোট ছেলের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে সব ছেলে মেয়ের ছবি এনআউডি কার্ড যোগাড় করে তার ওয়ারিশদের নামে ওছিয়তনামা রেজিস্ট্রি করান। যা তার মৃত্যুর পরে কার্যকর হবে। বিষয়টি বাড়ির সবাই কমবেশি জানতো, শুধুমাত্র ছোটো ছেলেকে বলা হয়নি।

কারণ ছোট ছেলে বিষয়টি মেনে নেবে না বলে খোকন মিয়ার মনে হয়েছিল।  ওছিয়তনামা করার পরে তার দু:চিন্তা অনেকটা লাঘব হয়েছিল এবং ওছিয়তনামা  করার মাসখানেক পরে ছেলের কাছে ঢাকায় বেড়াতে যান। সপ্তাহখানেক ঢাকায় থাকেন। তার মধ্যে দুইদিন থাকেন ছেলের কাছে। ছেলে আর বউ এখন বেশ মিলেমিশে আছে দেখে বেশ শান্তি পেলেন তারা।

এক রুমের বাসা । রাতে খোকন মিয়া বাসার পাশে মসজিদে ঘুমাতে যাবেন। ছেলের বউ মসজিদে যেতে দিলেন না শ্বশুরকে। তারা নিচে বিছানা করে খোকন মিয়াকে খাটে ঘুমাতে দিলেন। দুই দিনে ছেলের বউকে নিয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। 

এক সপ্তাহ ঢাকা থেকে বাড়িতে এসে বেশ স্বস্তিতে ছিলেন তিনি। দেখতে দেখতে ছয়মাস কেটে গেল। ছয়মাস পরে ছোটো ছেলের বউ এলো বাড়িতে। দুইদিন থাকার পরে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করা সেই কাগজ শ্বশুরের হাতে ফেরত দিলেন। কি ভেবে স্ট্যাম্প নিয়েছিল আর কি ভেবে স্ট্যাম্প ফেরত দিলো তা নিয়ে আর কোনো কথা হলো না। খোকন মিয়া দুই চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা মনে করলো। একপ্রকার খুশি ছেলের বউয়ের ওপর, তার একরোখা জেদি ছেলের সাথে মানিয়ে থাকছে বলে। আর একটাই চিন্তা তার মনের মধ্যে তোলপাড় করে যাচ্ছে, আমি যখন থাকবো না তখন আমার ছেলে-মেয়েগুলো পারবে তো মান-সম্মানের সাথে পথ চলতে! 

খোকন মিয়া তার ও তার স্ত্রী স্বাক্ষরিত ফাঁকা স্ট্যাম্প নেড়েচেড়ে দেখছেন আর ভাবছেন কি বিচিত্র দেনা-পাওনা। অবশেষে উকিল এর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন তার এক খণ্ড স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদ করার।  স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদ হলো সব ওয়ারিশকে শরিক করে। মনের মধ্যে আর কোনো দ্বিধা রইলো না খোকন মিয়ার। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তার স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদপত্র এবং চাপের মুখে স্বাক্ষরিত ফাঁকা স্ট্যাম্প দায়িত্বশীল কারো কাছে তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিত হতে চান!

[তাসলিমা বেগম : কবি ও গল্পকার]



মন্তব্য করুন


লিট ইনসাইড

বন্ধুত্ব

প্রকাশ: ০৮:৩৯ পিএম, ২৬ মে, ২০২৩


Thumbnail

নীলা মধ্যবয়সী একজন নারী। সকাল থেকে রাত কাটে সংসারের চার দেয়ালের মাঝে। খুব সকালে উঠে ছেলে আর বরের জন্য নাস্তা বানায়। টেবিলে সাজিয়ে তারপর ওদের ডাকে। ওরা যে যার মতো উঠে খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। খাবার টেবিলে ছেলে ফোন নিয়ে থাকে। বরেরও তাড়া থাকে। টুকটাক দু’একটা কথা ছাড়া তেমন কোনো কথাই হয় না কারও সাথে। কারও কোনো সময় নেই নীলাকে দেবার। যে যার মতো খুব ব্যস্ত। রোজ কত কথা জমে থাকে নীলার মনে! একাকিত্বটা দিন দিন নীলাকে বড় বিমর্ষ করে তুলছে।

নীলার শরীরটা কিছুদিন ধরে বেশ খারাপ। হাসবেন্ড আসিফকে বলল, ‘আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি এসো ডাক্তারের কাছে যাব।’ আসিফ বলল, ‘সম্ভব নয়। একা চলে যেও। তুমি তো আর বাচ্চা নও যে সঙ্গে আমাকে যেতে হবে।’ কথাটা শুনে নীলার খুব মন খারাপ হলো। বয়স হয়েছে বলেই কি বরের সাথে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে না! বিকেলে সে একাই চলে গেল ডাক্তারের কাছে। ফেরার সময় হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাঁটছিল ও। হঠাৎ পাশের একটা রুম থেকে কারও প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পেল। ওর এত খারাপ লাগছিল যে, ও রুমে উঁকি দিল। দরজা খোলাই ছিল। দেখে ডাক্তার নার্স সবাই একজন মহিলাকে চেপে ধরে আছে। কিন্তু সে স্যালাইন হাতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আর চিৎকার করছে। দেখে নীলার এত কষ্ট লাগছে! কি কষ্ট পাচ্ছে মানুষটা! নার্স একটা ইনজেকশন পুশ করল। ধীরে ধীরে মহিলাটি শান্ত হলো। নীলা এবার ভালো করে মহিলার মুখটি দেখতে পেল। চেনা চেনা লাগছে। এবার ভালো করে দেখে। আরে! এত ওর কলেজ জীবনের বান্ধবী রুবি। কিন্তু একি অবস্থা ওর! কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি আজ এরকম হয়ে গেছে কিভাবে! শুকিয়ে কংকাল। সেই রূপ কোথায় ওর! বেশ কিছু বছরের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন হয়ে যায় মানুষের! তাছাড়া ওর কি হয়েছে যে এত কষ্ট পাচ্ছে! এসব ভাবতে ভাবতেই নীলা রুবির কাছে গেল। রুবি এখন অনেক শান্ত। ‘চিনতে পারছিস?’ নীলা জিজ্ঞাসা করল। 

রুবি কিছুক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ে। নীলা গিয়ে রুবিকে জড়িয়ে ধরল। অনেকক্ষণ দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। তারপর কথা বলতে বলতে নীলা জানতে পারে রুবির ক্যান্সার। তাও শেষ পর্যায়ে। নীলা এ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। এত বছর পর প্রিয় বান্ধবীকে খুঁজে পেলো, তাও এই অবস্থায়! নীলার খুব কষ্ট হচ্ছিল। 

কলেজে ওরা তিনজন ছিল কাছের বন্ধু। ওরা দু'জন। আরেকজন অরুনিমা। একদিন একে অপরকে দেখতে না পেলে যেন জীবন চলত না ওদের। সমস্ত কলেজ জানত ওরা থ্রি জুয়েলস। সব জায়গায় ওরা একসাথে যেত। ক্যাফে, লাইব্রেরি, আইসক্রিম খেতে যাওয়া। কিংবা মার্কেটে যাওয়া। সবাই বলত এমন বন্ধুত্ব খুব কমই হয়। কিছুদিন পর ওদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে ভর্তি হয়। তখন থেকেই শুরু হয় রুবি আর নীলার মধ্যে সমস্যা। রুবি হঠাৎ করেই কেমন নীলাকে এড়িয়ে চলে। নীলা অবাক হয়। কষ্ট পায়। কিন্তু কেন রুবি এমন করছে সেটা ও বুঝতে পারে না। যদিও রুবি তা মুখে প্রকাশ করত না। 

নতুন ছেলেটার নাম অর্ণব । রাস্তায় একদিন কিছু বাজে ছেলেরা নীলাকে টিজ করছিল। অর্ণব সেটা দেখতে পেয়ে ছেলেগুলোকে শায়েস্তা করে। সেটা দেখে নীলার অর্ণবকে খুব ভালো লেগে যায়। ধীরে ধীরে ও অনুভব করে যে ও অর্ণবকে ভালোবাসে। এদিকে রুবি যে অর্ণবকে ভালোবাসে এ কথা সে বুঝতে পারেনি। নীলা খুব ভালো ছবি আঁকত। ও অর্ণবের একটা ছবি এঁকেছে। ভেবেছে আজ সে অর্ণবকে ছবিটি দিয়ে ওর মনের কথা বলবে। কিন্তু গিয়ে দেখে অর্ণব আর রুবি খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসে কথা বলছে। নীলার আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না রুবি কেন ওকে এড়িয়ে চলে। রুবি জানত নীলা অর্ণবকে ভালোবাসে। তাই ও নীলাকে এড়িয়ে চলত। 

কলেজ জীবন শেষে তিন বান্ধবী একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। তারপর যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। কারও সাথে আর কারও যোগাযোগ থাকে না। নীলা রুবির পাশে বসে পুরনো কথাগুলো ভাবছিল। কিন্তু রুবিকে সে এভাবে দেখবে এটা সে ভুলেও ভাবতে পারেনি। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। নীলা জিজ্ঞেস করল অর্ণব কোথায়? রুবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানাল অর্ণবের সাথে ওর বিয়ে হয়নি ভুল বোঝাবুঝির কারণে। পরে রুবি আর বিয়ে করেনি। অর্ণব কোথায় সে জানে না। কিন্তু ওর শেষ ইচ্ছে অরুনিমা আর অর্ণবের সাথে দেখা করা। রুবি অনেক খুঁজেছে ওদের, পায়নি। নীলা যেন চেষ্টা করে ওদের খুঁজে বের করতে। মৃত্যুর আগে অন্তত একবার তাদের দেখতে চায় সে। নীলা কথা দেয় রুবিকে ওদের খুঁজে বের করবে। রুবি নীলার হাত ধরে শুয়ে আছে। দু'জনের চোখই ভেজা। রুবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নীলা বাসায় ফিরল। আজ ওর মন অনেক খারাপ রুবির জন্য। আজ আর সময়মত সংসারের সব কাজ নিখুঁতভাবে করার দিকে মন নেই ওর। 

নীলা ওর পুরনো ডায়েরিটা বের করে সব বন্ধুদের ফোন দেয়। কিন্তু কাউকেই আর আগের নম্বরে পাওয়া যায় না। ফেসবুক সার্চ করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে একজনের মাধ্যমে অরুনিমাকে খুঁজে পায়। কিন্তু অর্ণবকে খুঁজে পায় না কিছুতেই। এদিকে রুবির শেষ ইচ্ছে ওকে পূরণ করতেই হবে। 

নীলার স্বামী আসিফ অফিস থেকে এসে দেখে নীলা চুপচাপ বসে আছে। ইদানিং দেখে নীলা কেমন আনমনা থাকে। সংসারের প্রতি কোনো মন নেই। অন্যসময় হলে এ সময় সে আসিফের জন্য কফি নিয়ে আসত। কিন্তু এখন আর সেটা করে না। হঠাৎ নীলা বলল, "তোমার এক বন্ধু আছে না পুলিশের বড়ো কর্মকর্তা? "
‘হ্যাঁ। কেন?’
‘আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?’ 
‘তোমার আবার কী কাজ?’ আসিফ অবাক হয়। 
‘আমার একজন বন্ধুকে খুঁজে বের করতে হবে।’ 
‘মানে?’ 
আসিফ অবাক হলো। ‘কি বলছ এসব? বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পুলিশের সাহায্য লাগবে? সে কি ক্রিমিনাল? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

নীলা রুবির শেষ ইচ্ছের কথা শোনালো আসিফকে। আসিফ বলল, ‘ফেসবুকে খুঁজে বের করো।’ ‘খুঁজেছি। পাইনি। কি নামে আছে। সেটা তো জানি না। আসল নামে আর ছবিতে পাইনি।’ আসিফ বলল, ‘আচ্ছা দেখি রাকিবের সাথে কথা বলে। বাসায় আসতে বলবো। তুমিই কথা বলে নিও।’

এখন প্রতিদিন নীলা রুবিকে দেখতে যায়। এটা-সেটা রান্না করে নিয়ে যায়। যদিও রুবি কিছুই খেতে পারে না। ওরা বসে বসে কলেজ জীবনে ওদের ছবিগুলো দেখে। কখনো হাসে। কখনো কাঁদে। 

নীলা অরুনিমার ঠিকানা নিয়ে একদিন গিয়ে দেখে একি অবস্থা ওর! এত ধনী লোকের স্ত্রীর আজ এই অবস্থা! বাসার সবকিছুতে দারিদ্র্যের ছাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখতে না রাখতেই ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বর ধনী ব্যবসায়ী। তারপর আর পড়াশোনা করেনি ও। ওর বিয়েতে শেষবারের মতো সবার সাথে দেখা হয়েছিল নীলার। তারপর যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেল। আর কারও সাথে কারও যোগাযোগ হয়নি। 

নীলাকে দেখে অরুনিমা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বছর চারেক আগে অরুনিমার স্বামী মারা যায়। অনেক দেনা ছিল ওর বরের। সেসব শোধ করতেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় ওদের। অরুনিমা যেহেতু বেশি পড়াশোনা করেনি তাই ভালো কোনো চাকরি পায়নি। কোনোরকমে একটা চাকরি করে মেয়েকে নিয়ে চলছে। 

নীলার সব শুনে মন খারাপ হলো। নীলা ওকে রুবির কথা বলল। অরুনিমারও রুবির কথা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে। দু'জনে মিলে রুবিকে দেখতে গেল। রুবি অরুনিমাকে দেখে খুব খুশি হলো। এখন ওরা তিনজন মিলে গল্প করে। সময় কাটায়। তিনজনেরই ভালো লাগে। নীলা ওর একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে এসেছে। অরুনিমা অভাবের ভারে নুয়ে পড়ে বেঁচে থাকার আনন্দ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছিল। সেও এখন বন্ধুদের খুঁজে পেয়ে একটু ভালো আছে। রুবিও যে ক'টা দিন বেঁচে আছে ওদের সাথে আনন্দে সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু ওরা কিছুতেই অর্ণবকে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে রুবির শেষ ইচ্ছে বলে কথা। একদিন অরুনিমা আর রুবি একটা কফিশপে বসে কফি খাচ্ছিল। সেখানে গিয়ে অর্ণবের মতো একটা ছেলেকে দেখতে পায়। কিন্তু ছেলেটা বয়সে অনেক ছোটো। অর্ণব কি করে হবে ওরা ভাবে। ছেলেটা বন্ধুদের সাথে আডডা দিচ্ছে। নীলা ছেলেটার সাথে একটু আলাদা করে কথা বলতে চাইল। ও ছেলেটার সাথে কথা বলে জানতে পারে ওর বাবাই ওদের বন্ধু অর্ণব। ওরা ছেলেটার কাছে ওর বাবার ফোন নম্বর চায়। বাসায় ফিরে নীলা অর্ণবকে ফোন দেয়। 
‘হ্যালো, আমি নীলা। চিনতে পারছো?’
অর্ণব কিছুটা সময় নেয় চিনতে। রুবির কথা শোনে। 

পরেরদিন ওরা সবাই যায় রুবিকে দেখতে হাসপাতালে। রুবি অর্ণবকে দেখে চিনতে পারে। রুবি কাঁদছে। হয়ত পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছে। নীলা আর অরুনিমা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ওদেরকে একা ছেড়ে দেয়। কত কথা জমে আছে ওদের।  

নীলা বাড়ি ফিরে অর্ণবের ছবিটি বের করে দেখে, যেটা সে অর্ণবের জন্য এঁকেছিল। এতদিন সে ছবিটি যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। আজ সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিলো। এর কিছুদিন পর রুবি মারা গেল। মৃত্যুর সময় সে একটা চিঠি লিখে গেছে নীলার কাছে। নীলা সেই চিঠিটা অরুনিমা আর অর্ণবকে পড়ে শোনাচ্ছে। 

‘নীলা, তোর হয়তো আমার ওপর রাগ, দুঃখ, অভিমান ছিল। সে জন্যই বোধহয় অর্ণবের সাথে আমার ভাগ্য জুড়েনি। সারাজীবন আমি সুখী হতে পারিনি। জীবনের শেষ সময়গুলোতে সেই তুই আবার আমাকে একটু সুখ দিলি। সবাইকে আবার এক করলি। এভাবে সবাই এক থাকিস। সুখে-দুঃখে বাকি জীবন কেউ কাউকে ছেড়ে যাসনে। একে অপরের পাশে থাকিস। তবেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।’ চিঠিটা পড়ে সবার চোখ ভিজে উঠেছে। 


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন