এডিটর’স মাইন্ড

সংকটে যোগ্যদের সামনে আনা জরুরি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৩ জুলাই, ২০২২


Thumbnail সংকটে যোগ্যদের সামনে আনা জরুরি

দীর্ঘ এক যুগ পর সারা দেশে ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। ঢাকায় ১ ঘণ্টা। ঢাকার বাইরে কোথাও ২, কোথাও ৩-৪ ঘণ্টা। ঢাকায়ও লোডশেডিংয়ের এলাকাভিত্তিক যে সূচি দেওয়া হয়েছে তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোথাও ২-৩ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। দীর্ঘ এক যুগে শতভাগ বিদ্যুতের দেশে লোডশেডিং মানুষ মেনে নিতে পারছে না। অর্থনীতিতেও সংকটের চেহারাটা আর গোপন থাকছে না। নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি বাংলাদেশ। একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া মানেই খারাপ সংবাদ। এতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মুদ্রাস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭.৫৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও সুখবর নেই। দুই বছর পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি না হলে এবং আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সামনে সংকট আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে।’ এজন্য শেখ হাসিনা সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

ব্যক্তির জীবনে যেমন অযাচিত অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট আসে, তেমনি একটি রাষ্ট্রও সংকটে পড়তে পারে। ব্যক্তির জীবনে সংকটের জন্য অনেক সময় যেমন ওই ব্যক্তির কোনো দায় থাকে না, তার কোনো ভূমিকা ছাড়াই তিনি আচমকা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। ২০২০-২১ সালে এরকম অনেক ঘটনা আমাদের চারপাশে দেখেছি। চাকরি হারিয়ে অনেকেই অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশে যে সংকট, সেখানে সরকারের ভূমিকা খুব সামান্যই। এ সংকট সরকার বা জনগণের সৃষ্ট নয়। বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরিস্থিতির শিকার। রাশিয়ার ওপর মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন টালমাটাল বিশ্ব। বাংলাদেশ এর নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব জনগণকে পাশে নেওয়া। আশ্বস্ত করা। নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা প্রকাশ। তাদের কষ্টের সমব্যথী হওয়া। খোলামেলাভাবে বাস্তবতা জনগণের কাছে তুলে ধরাটা জরুরি। বর্তমান সরকার ১৩ বছরের বেশি দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলের নেতা-কর্মী, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী- সবাইকে এ পরিস্থিতিতে বিনয়ী, নম্র ও সংযত হওয়া দরকার। জনগণ যেন বুঝতে পারে সরকার তাদের পাশে আছে। চেষ্টা করছে।


এ ধরনের পরিস্থিতি একা কোনো সরকারের পক্ষেই মোকাবিলা সম্ভব নয়। একটা ইতিবাচক বিষয় এ বৈশ্বিক বিপর্যয়ে আমি সরকারের মধ্যে লক্ষ্য করেছি। বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়ার বিষয়ে সরকার এখন পর্যন্ত লুকোচুরি করেনি। বরং প্রথম থেকেই বাস্তবতার আলোকে কৃচ্ছ্রসাধনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। জনগণকে অন্ধকারে রাখেনি। বরং জনগণকে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছে। কিন্তু সংকটে সংযত, বিনয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকে আন্তরিক মনে হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দায়িত্ববান ব্যক্তিরা এক ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারে যেন আগ্রহী। কোনো কোনো ব্যক্তি অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। মসজিদে এসি কখন চলবে কিংবা চলবে কি না এসব নিয়ে কথা বলার দরকার কি? এ সময় এমনিতেই মানুষ অস্বস্তিতে আছে। এর মধ্যে এসব কথা বলার প্রয়োজন কি? রাত ৮টার মধ্যে দোকান বন্ধের নির্দেশ ঈদের আগেই দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে বিকালের পর দোকানপাট খোলা রাখা হয় না। কেউ যদি রাত ৮টার পর দোকানপাট খোলা রাখে তা দেখার দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর হুঙ্কার দেওয়ার দরকার কি? বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দিচ্ছেন। কেন? মানুষকে হুমকি দিয়ে ঠান্ডা করার সময় এখন নয়। এটা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সংস্কৃতিও হতে পারে না। অবশ্য দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কিছু কিছু ব্যক্তি এখন যেন মুষ্টিযোদ্ধা অথবা পালোয়ান হয়ে গেছেন। যখন অর্থনৈতিক ও বিদ্যুৎ সংকটে জনগণের মধ্যে হতাশা, তখন কোনো কোনো এমপি যেন কুস্তিগিরে পরিণত হয়েছেন। একে ওকে পিটিয়ে তাঁরা আলোচনায়। কেউ পেটাচ্ছেন অধ্যক্ষকে, কেউ পেটাচ্ছেন আরেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে! ক্ষমতার দাপটে তাঁরা দিশাহারা। দেশের এ পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা জনগণের পাশে দাঁড়াবেন। জনগণকে আশ্বস্ত করবেন। অথচ তাঁরা করছেন উল্টো। এর ফলে বদনাম হচ্ছে আওয়ামী লীগের, সরকারের। শুধু কয়েকজন সংসদ সদস্যই যে এরকম দায়িত্বহীন আচরণ করছেন তা নয়। হাতে গোনা দু-এক জন মন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যই ইতোমধ্যে নিজেদের অযোগ্য প্রমাণ করেছেন। এ সংকটে তাঁরা ভূমিকা-হীন। কেউ গা বাঁচিয়ে চলছেন। কেউ বা দম্ভোক্তি করে জনগণের করুণার পাত্র হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া জনগণের আস্থা-ভাজন আর কজন আছেন এ মন্ত্রিসভায়? এ মন্ত্রীরা কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর নামে স্তুতির বন্যা বইয়ে দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন কজন মানেন? কজন শেখ হাসিনার মতো সাধারণ মানুষকে সম্মান করে কথা বলেন? কেউ কেউ উল্টো জনগণকে খেপিয়ে তুলছেন কথায় ও কাজে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এ সরকারের রাজনৈতিক চেহারাটা ফিকে। বিবর্ণ। এ কঠিন সময়ে সরকারের রাজনৈতিক অবয়বটা সামনে আনা অত্যন্ত জরুরি। যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্বে আনাটা খুবই দরকার। আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণই দলটির প্রাণশক্তি। এ দলে অনেকে আছেন যাঁদের সঙ্গে জনগণের এখনো গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। করোনার সময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে নিজস্ব উদ্যোগে কষ্টে থাকা মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। ধান কেটে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা-কর্মীরাই। এবারের বন্যায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন পরম মমতায়। লাঠিয়াল এমপি কিংবা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা মন্ত্রীদের সঙ্গে এ আওয়ামী লীগের পার্থক্য অনেক। দুটি ধারা দুই মেরুতে। শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্য আর মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের একটু তুলনা করে দেখুন। কি ভীষণ পার্থক্য। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরীর মতো নেতা কি সরকারে আছেন? এই প্রবীণ, বর্ষীয়ান জাতীয় নেতাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব-উল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম কিংবা মির্জা আজমের মতো মাঠে-ময়দানে জনগণের সঙ্গে সারাক্ষণ সংযুক্ত থাকা নেতাদের কজন আছেন বর্তমান মন্ত্রিসভায়? এ মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য জনগণের চেহারা পড়তে পারেন না। যেমন পারেন শেখ হাসিনা। এ মন্ত্রিসভার এক বড় অংশ জনগণের ভাষায় তাদের আপন হয়ে কথা বলতে পারেন না। যেমনটি পারেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন। এ সময় তিনি যৌক্তিক কারণেই অনেক হেভিওয়েট নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেননি। তার পরও ওই মন্ত্রিসভায় ছিলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো জাতীয়ভাবে পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নূরুল ইসলাম নাহিদ কিংবা জাহাঙ্গীর কবির নানকের মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ ওই মন্ত্রিসভাকে একটা রাজনৈতিক অবয়ব দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবার মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী আবার হেভিয়েটদের ফিরিয়ে আনেন। শুধু আওয়ামী লীগের নয়, ১৪ দল থেকেও রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুর মতো বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মন্ত্রিসভায় চমক আনেন। প্রথমবার মন্ত্রী হয়েই তাজুল ইসলাম পান স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। জীবনে প্রথম সংসদ সদস্য হয়েই ড. আবদুল মোমেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, শেখ হাসিনা নতুনদের সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি সরকার ও দলকে আলাদা করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই মন্ত্রিত্বকে দেশসেবার মহামূল্যবান সুযোগ মনে করেননি। কেউ কেউ একে ‘আলাদিনের চেরাগ’ মনে করেছেন। অনেক মনে করেছেন একটা আরাম-আয়েশের চাকরি। তাঁরা দলীয় প্রধানের দেওয়া সুযোগটার অর্থ বুঝতে পারেননি। এঁদের কেউ কেউ এত বোধশক্তিহীন যে নিজেদের অযোগ্যতাটুকুও বুঝতে পারেন না। করোনা মোকাবিলায় সীমাহীন অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার পর কোনো মন্ত্রী যখন নিজেকে সফল দাবি করেন, তখন মানুষ হাসবে না কাঁদবে ভেবে কূল পায় না। দ্রব্যমূল্য নিয়ে যখন মন্ত্রী তাঁর অসহায়ত্বের কথা বলেন, অথচ তখনো তিনি দল, দেশ এবং নেতার চেয়ে নিজের চেয়ারটাকে মূল্যবান মনে করেন। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার যখন সিন্ডিকেটের খাঁচায় বন্দি হয় তখন কি মন্ত্রীর সরে যাওয়ার একবারও ইচ্ছা হয় না? এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। এসব অযোগ্য মন্ত্রী এখন সরকারের জন্য বোঝা হয়ে গেছেন, তাঁরা নিজেদের অযোগ্যতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ভাগ্যিস শেখ হাসিনা ছিলেন। যিনি সবকিছুতেই নজর রাখেন। সবকিছু দেখেন। মূলত গত সাড়ে তিন বছর শেখ হাসিনা একাই সব সামলেছেন। করোনায় ব্যর্থ মন্ত্রীকে না সরিয়ে নিজে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণেও তাঁকেই উদ্যোগ নিতে হয়েছে। খেলার মাঠ উদ্ধার থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু- সব ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণেই বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে।

আমরা জানি, শেখ হাসিনা দূরদর্শী, বিচক্ষণ, অমিত সাহসী একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধা দরকার, দরকার বিশ্বস্ত অনুসারী। খেলায় যেমন একজন মেসি কিংবা নেইমার সব সময় দলকে জেতাতে পারেন না, এ কথা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দরকার হয় কিছু নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীর, সহযোদ্ধার। যাঁরা শেখ হাসিনার চিন্তাগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবেন। যাঁরা তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা, দর্শন বুঝবেন। মন্ত্রীরা যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলেন না তখন আমলারা অবলীলায় শূন্যস্থান পূরণ শুরু করেন। করোনার সময় বাস্তবতার কারণে আমলাদের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারপ্রধানকে। সে সময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাঁর সামনে কোনো বিকল্পও ছিল না। কিন্তু আমলারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই করেন না। তাঁদের সব কাজের একটা বিনিময়মূল্য আছে। করোনাকালে তাঁরা যে কাজ করেছেন তার বিনিময়ে রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে তথ্য কমিশন- সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এখন আমলাতন্ত্রের দখলে। আওয়ামী লীগই সৃজনশীল অর্থনীতিবিদ ও পণ্ডিতদের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন লুৎফর রহমান সরকারের মতো সৃষ্টিশীল ব্যাংকারকে। তাঁর মেয়াদ শেষ হলে ড. ফরাসউদ্দিনের মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বকে গভর্নর করা হয়েছিল। ড. ফরাসউদ্দিন একজন আমলা ছিলেন বটে, কিন্তু একজন সাবেক আমলার চেয়ে একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ‘গরিবের অর্থনীতিবিদ’ ড. আতিউর রহমানের মতো ব্যতিক্রমী পণ্ডিতকে গভর্নর করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানও এখন আমলাদের দখলে চলে গেছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে অর্থ সচিবদের অবসর-উত্তর ঠিকানা এখন বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় একজন সদ্য অবসরে যাওয়া আমলার চেয়ে ড. আতিউর রহমান, ড. আবুল বারকাতের মতো মেধাবী উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী অর্থনীতিবিদ বেশি দরকার। নবনিযুক্ত গভর্নর নিঃসন্দেহে দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কিন্তু দীর্ঘদিন নথির মধ্যে থাকতে থাকতে তিনি হয়তো বর্তমান সংকটের সমাধানও নথিতেই খুঁজবেন। আমলারা কোনো সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করেন না বা করতে পারেন না। সৃজনশীলতা উপেক্ষা করেন। গৎবাঁধা রুটিনে কাজ করতে চান। এক ক্ষমতাবান আমলা বিদ্যুৎ সংকটের ‘কুইক রেন্টাল’ সমাধান আবিষ্কার করে নিজের ক্যারিয়ার তরতর করে ওপরের দিকে উঠিয়েছিলেন। এখন সেই কুইক রেন্টাল সরকারের গলার কাঁটা।

এভাবেই আমলারা ভবিষ্যতের কথা ভাবেন না। তাৎক্ষণিক সমাধান করে নিজেদের ‘দক্ষ’ প্রমাণ করতে চান। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে যেমন আমলাতন্ত্রের শিকল ছিঁড়ে বেরোতে হবে, তেমনি সরকারকেও রাজনীতির ধারায় ফিরিয়ে আনাটা জরুরি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রবীণ হেভিওয়েট কিংবা জনপ্রিয় নেতাদের মন্ত্রী বানালেই কি সংকটের সমাধান হবে? সংকট তো দেশে তৈরি হয়নি। মন্ত্রী বদল করে সমাধান হবে কীভাবে? সংকট সমাধান নয়, এখন প্রয়োজন জনগণকে সাহস দেওয়া। তাদের অনিশ্চয়তা দূর করা। আমলাতন্ত্রের দফাওয়ারি সুপারিশের পর ‘আতঙ্কের কোনো কারণ নেই’ ধরনের বক্তব্যে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে না। জনগণ বুঝতে পারে এমন ভাষায় কথা বলে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। জনগণের কাছে শেখ হাসিনার বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। এরকম বহু যোগ্য নেতা আওয়ামী লীগে আছেন। এঁদের ভুলত্রুটি আছে, আছে অতীত স্খলনও। কিন্তু এ সংকটে তাঁরাই হবেন যোগ্য সহযোগী। এতে মানুষ ভরসা পাবে। অযোগ্যদের ভারমুক্ত হবে জাতি। এই তো এক বছর আগের কথা। করোনা, অর্থনৈতিক সংকট, কৃষক বিদ্রোহ সব মিলিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তায় নিম্নমুখী স্রোত। এর মধ্যেই ৯ জুলাই, ২০২১-এ ১২ জন মন্ত্রীকে ছাঁটাই করে মন্ত্রিসভা রদবদল করলেন। এটা গণতান্ত্রিক একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন মেয়াদে এটি করেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও নির্বাচন কালীন মন্ত্রিসভায় তিনি হেভিওয়েট নেতাদের যুক্ত করেছিলেন। সৈয়দ আশরাফের মতো কঠিন সময়ের পরীক্ষিত নেতার দফতর বদলেও তিনি পিছপা হননি। কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।  এরকম বহু উদাহরণ আছে শেখ হাসিনার ১৮ বছরের দেশ পরিচালনায়। এ সংকট একটা বিশ্ব বাস্তবতা। এখন ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে হবে মমতায়, ভালোবাসায়।  যেভাবে আওয়ামী লীগ জনগণের পাশে দাঁড়ায় সব সংকটে। এ সংকটে যোগ্যদের সামনে আনাটা এখন সময়ের দাবি।


লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

Email : poriprekkhit@yahoo.com


লোড শেডিং   বিদ্যুৎ   সংকট অর্থনীতি   রাজনীতি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

বিশ্বজুড়ে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অস্বস্তি, বাংলাদেশে?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো গত ৭ মে। আজ (১৩ মে) চতুর্থ দফায় ৯৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বিজেপির নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে কারও কোনো সংশয় ছিল না। বিশেষ করে এই নির্বাচনে বিজেপি এবার রেকর্ডসংখ্যক চারশ আসনের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, এবার বিজেপির লক্ষ্য লোকসভায় ৪০০ আসন পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এখন চারশ আসন তো দূরের কথা, শেষ পর্যন্ত ২৭২ আসনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট অর্জন করতে পারবে কি না, তা নিয়েই চিন্তা দেখা দিয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম, মোদির মুসলিম বিদ্বেষনীতি, চাকরির বাজারে হাহাকারের পরিপ্রেক্ষিতে এখন ক্ষমতাসীনদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভারতের নির্বাচনের ফল কী হবে, সেটি জানা যাবে ৪ জুন। তবে এ নির্বাচন যে মোদির জন্য বা বিজেপির জন্য স্বস্তিদায়ক হচ্ছে না, সেটি এখন থেকেই বলা যায়।

গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে। তার আগে একটা রিহার্সাল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নির্বাচনে ২ হাজার ৬০০ কাউন্সিলরের মধ্যে দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থাকা কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি পেয়েছে ১ হাজার ৬১টি পদ। অন্যদিকে ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি মাত্র ৫০৪টি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়ে দলগতভাবে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। নির্বাচনে দ্বিতীয় হয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। ৪০ বছরের ইতিহাসে এটি কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ঋষি সুনাকের নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা যে ভীষণ নড়বড়ে, তা এই নির্বাচনেই প্রমাণ হয়েছে। নির্বাচনের পর পার্লামেন্ট নির্বাচনে কনজারভেটিভদের ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা না বলা গেলেও কনজারভেটিভ পার্টি যে আগামী নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ অস্বস্তি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, সেটি হলফ করে বলা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ বছর নভেম্বরে। এই নির্বাচনে জো বাইডেনের অবস্থা তথৈবচ। জো বাইডেনকে কোনো জনমত জরিপেই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। আইনি মারপ্যাঁচ, যৌন কেলেঙ্কারি ডেমোক্রেটদের নানামুখী বাধা ইত্যাদি নানা সংকট থেকে মুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আবার প্রার্থী হওয়া ট্রাম্পের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না সেটি যেমন প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো যে, জো বাইডেন এই নির্বাচনে কি দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ এবং ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বকে জ্ঞান দেয়, মানবাধিকার চর্চার জন্য শাসন করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এখন মানবাধিকার সংকটে। গাজায় ইসরায়েলের তাণ্ডবের প্রতিবাদে মার্কিন তারুণ্যের গণবিস্ফোরণ পুরো বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। আর এই গণবিস্ফোরণকে ঠেকাতে যেভাবে জো বাইডেন সরকার দমন নীতি গ্রহণ করেছে, তা তাকে সবচেয়ে কোণঠাসা অবস্থায় নিয়ে গেছে। জনগণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিশ্বাস করছে না, জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তিনি এখন তলানিতে অবস্থান করছেন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিজয়ী হয়েছিলেন অনেক লড়াই করে। বিজয়ের পর জনগণ তার পক্ষে কতটুকু আছে বা জনগণের মনোভাব কী, তা যাচাইয়ের একটি উপায় ছিল গত মার্চের স্থানীয় সরকার নির্বাচন। কিন্তু সে নির্বাচনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের দলের শোচনীয় ভরাডুবি ঘটেছে। তিনি বড় শহরগুলোতে মেয়র পদে যাদের প্রার্থী দিয়েছিলেন, তারা ধরাশায়ী হয়েছেন বিরোধী পক্ষের কাছে।

সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর অবস্থা ভালো না। নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জের মুখে। জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক স্থানেই বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান করছে নাগরিকরা। এর একটি বড় কারণ হলো, মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারছে না ক্ষমতাসীনরা। এরকম বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক এবং অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশে এখন পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচন চলছে। প্রথম ধাপের উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো গত ৮ মে (বুধবার)। এ উপজেলা নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে চেয়েছে; কিন্তু সে উদ্যোগও সফল হয়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, প্রথম ধাপে ৩৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। এটি সর্বনিম্ন ভোটের রেকর্ড। এটি নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতে যেমন ক্ষমতাসীন দল চ্যালেঞ্জের মুখে, পুনরায় তাদের ক্ষমতায় আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, বাংলাদেশে পরিস্থিতি তেমনটি নয়।

বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে কেউ ক্ষমতাসীন দলের বিপর্যয়ের কথা কল্পনাও করেনি। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল তারা কেউই ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেনি বা ক্ষমতায় আসার মতো জনপ্রিয়তা, নেতৃত্ব বা সাংগঠনিক দক্ষতা তাদের ছিল না। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল অবধারিত। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে যারা দলের মনোনয়ন পাননি সে বিদ্রোহী প্রার্থীদের। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৮ জন স্বতন্ত্র বিজয়ী হয়ে নির্বাচনের মান বাঁচিয়েছে। নির্বাচনকে ‘জীবন’ দিয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। উপজেলাতেও তাই আওয়ামী লীগ একই কৌশল গ্রহণ করেছে। উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা ছিল দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করলে বিএনপির জন্য নির্বাচনে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে—এমন গুঞ্জনও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি পুরোনো পথে হেঁটেছে। তারা উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শতাধিক বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।

প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনে তাদের ৭ জন বিজয়ী হয়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। তবে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিকূল রাজনীতির পরিবেশে নির্বাচন করে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা যায় না। তার পরও যে উপজেলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়ে বিএনপি নেতারা অংশগ্রহণ করেছে সেজন্য তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ সুস্থ রাজনীতির জন্য দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার পরও উপজেলা নির্বাচন গণতন্ত্রের সংকটের বার্তা। নির্বাচন নিয়ে জনগণের অনীহা ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তির। আওয়ামী লীগের সামনে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নেই। আওয়ামী লীগের এমন কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ নেই যারা জনপ্রিয়তা বা সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তা ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের তীব্র সংকট চলছে। কদিন আগেই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে হটিয়ে তারা ক্ষমতা নিতে চায়, তাদের নেতা কে?’ এই নেতৃত্বের সংকটই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, নেতৃত্ব সংকটের কারণেই বিএনপি নির্বাচনবিমুখ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে এখন ‘স্বেচ্ছা বন্দি’। তিনি ফিরোজায় বাসভবনে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রাজনীতিতে তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি নির্বাচনের অযোগ্য। অন্যদিকে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাসহ একাধিক মামলায় দণ্ডিত। তার দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এ কারণে বিএনপি এখন নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। বিএনপির লক্ষ্য সুস্পষ্ট। তারা নির্বাচন থেকে দূরে থেকে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। গণতন্ত্রকে সংকটে ফেলতে চায়। গণতন্ত্রে সংকট দেখা দিলে তৃতীয় কোনো পক্ষের ক্ষমতায় আসার পথ উন্মুক্ত হবে।

তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতায় এলে বিএনপি তার রাজনৈতিক পুনর্গঠন নতুন করে শুরু করতে পারবে। অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে তারেক জিয়া দেশে ফেরা, খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফের বিষয়গুলো তারা ফয়সালা করতে চায়। এজন্য নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক রীতিতে ক্ষমতায় আসা নয়; বরং একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। এ কারণেই তারা যতটা না জনমুখী কর্মসূচি পালন করে তার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ধর্ণা দেয়, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশগুলোকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা বিএনপির রাজনীতির প্রধান কৌশল। ফলে নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের খুশি বা আত্মতুষ্টির কারণ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪২ শতাংশ। এ নিয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় এবং সন্দেহ রয়েছে। তার পরও একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই নির্বাচনে কম ভোটার উপস্থিতিকে সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে ভোটার উপস্থিতি কম হবে—এটাই স্বাভাবিক বিষয়। বিএনপি অংশগ্রহণ না করার পরও যে একতরফা নির্বাচন হয়নি, বিশেষ করে ২০১৪-এর মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগ বেরিয়ে আসতে পেরেছে, সেটি নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের বড় অর্জন। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন জনগণ আরও ভোটবিমুখ। এটি আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই অশনিসংকেত। গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভোটাররা যদি গণতন্ত্রের প্রতি অনাগ্রহী হন, ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে না যান, ভোটাররা যদি তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখান তাহলে গণতন্ত্র সংকটে পড়বেই। আর গণতন্ত্র দুর্বল হলে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বে আওয়ামী লীগ। এ কারণে অন্য দেশগুলোতে যখন ক্ষমতাসীনরা ভোটে জিতবে কি জিতবে না সেই অনিশ্চয়তায়, সেখানে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বলে আমি মনে করি। নির্বাচনে পরাজয়ের শঙ্কার চেয়ে গণতন্ত্রের মৃত্যুর শঙ্কা বেশি ভয়াবহ।

উপজেলা নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে অতীতে দেখা গেছে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকে জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহী হয়। এ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক হয় এবং একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এবার উপজেলা নির্বাচনে সেটি হয়নি। কেন হয়নি তার কারণ আওয়ামী লীগকে খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ সমর্থক আছে। তারাও কেন ভোট দিতে যাচ্ছেন না? এর উত্তর খুঁজতে হবে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটিকে। দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করেও আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে পারেনি। এই না পারার কারণ হলো আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষমতা লোভ, বাড়াবাড়ি এবং এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদগ্র বাসনা। তারা দমন করার চেষ্টা করেছে পেশি শক্তি প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশকে নষ্ট করেছে। সাধারণ মানুষ সব জানে, সব বোঝে। তারা এসব ঝুট-ঝামেলার মধ্যে যেতে চায়নি। সে কারণেই তারা ভোট থেকে আগ্রহ ফিরিয়ে নিয়েছে। অনেক জায়গায় নির্বাচনের ফল ছিল পূর্ব অনুমিত। তারা জানত যে, এমপির ভাই দাঁড়িয়েছে, এমপির ছেলে দাঁড়িয়েছে কাজেই তাদের বিজয় ঠেকাবে কে। এই বোধটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগকে এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না বটে, তবে ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না, তা হলফ করে কে বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে আবার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকে তিনি এই ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। অতিডান এবং অতিবামরা নতুন করে ষড়যন্ত্র করেছে বলে তিনি নেতাদের সতর্ক করেছেন। 

আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষড়যন্ত্রের কাছেই আওয়ামী লীগ বারবার পরাজিত হয়েছে, হয়েছে বিপর্যস্ত। আর এই ষড়যন্ত্র শুধু বাইরে থেকে হয়নি, দলের ভেতর থেকেও হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র ঠেকানোর একটাই উপায়, তা হলো গণতন্ত্রকে মুক্ত স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে দেওয়া, জনগণকে উৎসাহিত করা, ভোটকেন্দ্রে যাতে ভোটাররা যান, তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন সে পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া। উপজেলা নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সভাপতি দলের নেতাকর্মীদের ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য প্রচারের নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেখ হাসিনা মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করার জন্য যে নির্দেশ দেন, তা কেউ মানেনি। যারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তারাও ষড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংকটে। বিরোধী দলহীন গণতন্ত্র মুণ্ডুহীন দেহ। সরকারের কোনো জবাবদিহি থাকে না। এতে ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বদের দূরত্ব তৈরি হয়। এভাবেই পল্লবিত হয় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। অবৈধ ও অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হয়। তেমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছেই যেতে হবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিশ্ব   নির্বাচন   বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

মামা-ভাগ্নের নির্বাচনে ধান কাটার উৎসব

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১০ মে, ২০২৪


Thumbnail

দেশের মানুষের এমনিতেই নাভিশ্বাস অবস্থা। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ সংকটে চেয়েও বড় অস্থিরতা হলো জিনিস পত্রের দাম। অস্থির সময়ে মানুষের জন্য বিনোদনের কোন খোরাক নেই। তবে প্রধান নির্বাচন কাজী হাবিবুল আউয়াল মানুষের জন্য অস্বস্তির তাপদাহে এক পশলা বৃষ্টির মতো, বিনোদনের খোরাক যোগালেন। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ১৩৯ টি উপজেলার নির্বাচনের পর সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘ধান কাটার কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে আসেননি।’ নিষ্প্রাণ উপজেলা নির্বাচনে সিইসির বক্তব্যই একমাত্র চমক। 

উপজেলা নির্বাচন উত্তেজনাহীন হয়েছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। আগে উপজেলা নির্বাচনগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা ছিলো, স্থানীয় জনগণের মাঝে নানারকম হিসেব-নিকেশ এবং মেরুকরণ হতো। এবার তেমনটি হয়নি। সবাই জানে কেন উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিলো। প্রতিপক্ষহীন খেলা কখনও উত্তেজনাপূর্ণ হয় না। দর্শকদের আগ্রহও থাকেনা। বিরোধীদল হীন নির্বাচনও ভোটারদের জাগাতে পারেনা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেই নানারকম বেসামাল কথা-বার্তা বলতে হয়। কাজী হাবিবুল আউয়াল এতোদিন অনেকটাই সংযত ছিলেন। কিন্তু এখন তার সংযমের বাঁধ সম্ভবত ভেঙ্গে গেছে। উপজেলা নির্বাচন যখন হচ্ছিল তখন কত নির্বাচনী এলাকায় ধান কাটা চলছিল সে হিসেব কি কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছে আছে? তিনি কি জানেন, ধান কাটার জন্য কতজন কৃষক নিয়োজিত থাকেন? 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ শুমারীতে সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা কত সে হিসেবটা নিশ্চয়ই সিইসির জেনে নেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু ধান কাটার উৎসব হোক বা আম পাড়ার উৎসবই হোক, বাস্তবতা হলো উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ ছিলো না। তার প্রধান কারণ হলো, এ নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ অংশগ্রহণ করেনি। বিরোধী পক্ষ ছাড়া নির্বাচন যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না সেটি বারবার প্রমাণিত, আর এটিই বাস্তবতা। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত এই নির্বাচনেও যেন একাধিক আওয়ামী লীগের প্রার্থী দাঁড়াতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর সেই সুযোগ নিয়ে এবার নির্বাচনের উৎসব হয়েছে ‘মামা-ভাগ্নের নির্বাচন’। 

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার কথাই ধরা যাক। এখানে নির্বাচন হয়েছে প্রথম ধাপে। এই উপজেলার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী এবং কবির হাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার শিউলির ছেলে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরী। সাবাব চৌধুরী নির্বাচনে আনারস প্রতীক নিয়ে ৩৭,৬৪৮ ভোট পেয়েছেন। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বর্তমান চেয়ারম্যান দোয়াত-কলম প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনাম সেলিম পেয়েছেন ৩৬,৯৪৫ ভোট। ৭০৩ ভোটের ব্যবধানে মামাকে হারিয়ে দিয়েছেন ভাগ্নে। স্থানীয় রাজনীতিতে অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনাম সেলিমকে মামা ডাকতেন সাবাব। ‘মামা-ভাগ্নে নির্বাচনে’ ভাগ্নে জিতেছে, মামা হয়েছে কুপোকাত। এভাবে সারাদেশেই উপজেলা নির্বাচন এখন মামা-ভাগ্নের নির্বাচন। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল এমপি-মন্ত্রীরা যাতে আত্মীয় স্বজনদেন প্রার্থী না করে। ধারণা করা হয়েছিল যে, একরামুল করিম চৌধুরীদের মত ব্যক্তিদেরকে নিশানা করেই আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। 

প্রধানমন্ত্রী গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, একই পরিবারের সবাই যদি সবকিছু দখল করে তাহলে কর্মীরা কি করবে। নোয়াখালীতে তাই ঘটেছে। নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী, কবিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী আর ছেলে হলেন সুবর্ণচর উপজেলার চেয়ারম্যান। ফলে নোয়াখালীতে একরামুল করিম চৌধুরীর রাজত্ব এখন ঠেকায় কে। শুধু যে নোয়াখালীতে এমন ঘটনা ঘটেছে তা নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেই এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের লড়াই হয়েছে। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাদের কুপোকাত করে দিয়েছে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। আওয়ামী লীগের এই প্রীতি ম্যাচে ৩৬ শতাংশ ভোট তো অনেক বেশী।  

একটি নির্বাচনে সাধারণ মানুষ বা ভোটাররা কেন ভোট দেবেন? সাধারণত মানুষের সামনে যখন অনেকগুলো বিকল্প থাকবে তখন মানুষ ভোটের মাধ্যমে একটি বিকল্প পছন্দ করে নেবেন। নানা মত, নানা পথের যে বৈচিত্র্য, সেই বৈচিত্র্যই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। যদি সকল রাজনৈতিক দল একই মতামত প্রকাশ করে, অভিন্ন চিন্তাভাবনার অনুসারী হয় এবং ক্ষমতাই যদি তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্র হয়না, তাতে মানুষেরও আগ্রহ থাকেনা। বিরোধী দল লাগাতারভাবে নির্বাচন বর্জনের ফলে এরকম একটি পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে। বিএনপি কেন উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলো সেটি একটি বড় প্রশ্ন। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি থেকে যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘণ করে অংশগ্রহণ করেছেন তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু দলের বিদ্রোহীরা বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়েই নির্বাচন করেছেন। প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দেখা গেছে যে ৭ টি উপজেলায় বহিষ্কৃতরা বিজয়ী হয়েছেন। যদি বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে এ বিধি নিষেধ আরোপ না করতো তাহলে নির্বাচনগুলো আরো উৎসবমুখর হতো এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়তো। সবচেয়ে বড় কথা হতো ভোটারদের সামনে ভালো মন্দ বাছাই করার সুযোগ তৈরি হতো। যেসমস্ত উপজেলাগুলোতে বিএনপির প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছেন সেই উপজেলাগুলোতে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি ছিলো। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে চিংড়ি মাছ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম। এখানে ভোটের হার অন্যান্য উপজেলাগুলোর চেয়ে তুলনামূলক বেশি। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, যখন একটি বিরোধী পক্ষ নির্বাচনে থাকে তখন সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ে। দুপক্ষের প্রচারণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী একটি আবেগ বা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন নির্বাচনটি শুধু হয়ে যায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিষয় বা প্রীতি ম্যাচের মত, নির্বাচন যখন মামা-ভাগ্নের লড়াইয়ে পরিণত হয় তখন মানুষ নিজেকে অধিকারহীন ভাবে, মানুষ ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নির্বাচনের ফলাফল তার জীবন এবং ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আনবে না, এরকম একটি বোধ তাদের মধ্যে প্রোথিত হয়। আর এরকম একটি পরিস্থিতির কারণেই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ  কমে যাচ্ছে। 

এজন্য দায়ী কে? ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন নাকি বিরোধী রাজনৈতিক দল? ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশ যাতে ভোটের মাধ্যমে হয় সেটির জন্য একটি অনুকূল আবহ সৃষ্টি করা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখা, প্রশাসন যেন নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে তা নিশ্চিত করা। অবাধ ও সুষ্ঠু উপজেলা নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের এ ব্যাপারে কোন ঘাটতি ছিলোনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে চেয়েছেন উপজেলা নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। তবে ভালো উদ্যোগ ভন্ডুল করতে আওয়ামী লীগে অতি উৎসাহীদের অভাব নেই। আওয়ামী লীগের ভেতর যারা ‘জমিদারতন্ত্র’ কায়েম করতে চায়, এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, নির্বাচনী এলাকায় জনগণকে পায়ের নীচে রেখে লুটপাটের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পুরোপুরি বিপক্ষে। নির্বাচন মানেই তাদের কাছে গদী দখল, একারণেই তারা ‘মাই ম্যান’-দেরকে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী করেছে, অনেকে ‘মাই ম্যান’দেরকে ভরসা করতে পারেনি। তারা আত্মীয় স্বজনদেরকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করে এলাকা দখল এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মিশনে নেমেছে। যদিও আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয় স্বজনদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলো, কিন্তু আওয়ামী লীগের এই নির্দেশনা মাঠে বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ মন্ত্রী-এমপিরা এখন এতই ক্ষমতাধর হয়ে গেছেন যে, তারা দলের নির্দেশনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন। যদি শেষ পর্যন্ত উপজেলাগুলোতে আত্মীয় স্বজনদের প্রার্থীতা না দিতেন তাহলে উপজেলা নির্বাচনটি আরো প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর হতো বলেই আমি মনে করি। কারণ এর ফলে অন্য প্রার্থীরা সমান সুযোগ পেতেন, ভোটারদের কাছে যেতেন। যেসস্ত নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রী-এমপিদের নিজস্ব ব্যক্তি এবং আত্মীয় স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন সেসমস্ত নির্বাচনী এলাকাগুলোতে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা হয়েছে, প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হয়েছে, ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। ফলে ভোটাররা কুণ্ঠিত হয়েছেন। এতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলেছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইলেও মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শুভ চিন্তাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে কিছু লোভী, অপরিণামদর্শী মন্ত্রী-এমপি এবং প্রভাবশালী নেতা। 

নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে যে আন্তরিক, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং গঠনমূলক নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটা চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু  মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশন শুধুমাত্র রেফারি মাত্র। নির্বাচনের আসল খেলোয়াড় হলো ভোটার রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে না পারে, প্রার্থীরা যদি জনগণকে ভোটকেন্দ্রে না নিয়ে যেতে পারে তাহলে শুধু নির্বাচন কমিশনের একা কিছু করার নেই। নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের তদারকি করতে পারে মাত্র। 

এবার বিরোধী দলের দায়িত্ব কতটুকু তা একটু খতিয়ে দেখা যাক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি দল বা ক্ষমতাসীন দলের যতটুকু দায়িত্ব ঠিক ততটুকু দায়িত্ব বিরোধী দলেরও। আধুনিক গণতন্ত্রে মনে করা হয় ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব অনেক বেশী। কারণ সরকারের ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়া, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা সামনে নিয়ে এনে, সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করাই বিরোধী দলের প্রধান কাজ। আর একারণেই আধুনিক গণতন্ত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ‘ছায়া সরকার’ গঠন করে। এই ছায়া সরকারের মাধ্যমেই তারা সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে এবং জনগণের কাছে তা তুলে ধরে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। কিন্তু আমাদের বিরোধী দলগুলো কি করছে? সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি এখন আস্তে আস্তে অস্তিত্বের সংকটে বিলীন প্রায়। এই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে জাগরণ তৈরি করার কোন চেষ্টা তারা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। উপজেলা ব্যবস্থাটি জাতীয় পার্টির সৃষ্টি। এই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির আলাদা আবেগ থাকার কথা ছিল। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে শুধু ম্রিয়মানই দেখা যায়নি, জাতীয় পার্টির অনীহা ছিলো চোখে পড়ার মতো। 

বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন না করে যত না ভুল করেছে তার চেয়ে বেশি ভুল করেছে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে। কারণ এ নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলকে সংগঠিত করার সুযোগ ছিল বিএনপির সামনে। বিএনপি তাদের নেতা-কর্মীদের হতাশা কাটিয়ে  তোলার জন্য উপজেলা নির্বাচনকে ব্যবহার করতে পারতো। আর উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি যদি দলগতভাবে অংশগ্রহণ করতো তাহলে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের জন্য তারা একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারতো। কিন্তু বিএনপি সে পথে হাটেনি। এটি কি বিএনপির রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নাকি ইচ্ছে করেই এটি করেনি? আমার বিবেচনায় এটি বিএনপি ইচ্ছে করেই নির্বাচন বর্জনের পথে হেটেছে। এটি তাদের কৌশলগত অবস্থান। কারণ বিএনপি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাঁধাগ্রস্থ করতে চায়। গণতন্ত্রকে ধ্বংসের বড় উপায় হলো নির্বাচন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলা। ভোটারদের অনাগ্রহী করা এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে জনগণের মধ্যে অনীহা সৃষ্টি। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি নিবিড়ভাবে সে কাজটি করে যাচ্ছে। আর সেকারণেই আস্তে আস্তে নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন মামা-ভাগ্নের নির্বাচনে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। উপজেলা নির্বাচন তার সর্বশেষ প্রমাণ। আর নির্বাচন গুরুত্বহীন হলেই অগণতান্ত্রিক শাক্তি সুযোগ পায়। অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণের পায়তারা করে। বিএনপি হয়তো গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এরকম একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই তৃতীয় পক্ষের হয়ে কাজ করছে। সব নির্বাচনকে তারা তামাশা বানানোর চেষ্টা করছে। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আবার ঢাকায় কেন ডোনাল্ড লু?

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ০৮ মে, ২০২৪


Thumbnail

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আবার বাংলাদেশ সফরে আসছেন। নানা কারণে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে অত্যন্ত আলোচিত একটি নাম। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে তাঁর তৎপরতা বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি একাধিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাঁর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং বেশ কিছু কথাবার্তা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

ডোনাল্ড লু নির্বাচনের আগে একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য তিনি বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন। যখন ২৮ অক্টোবর বিএনপি সারা ঢাকা শহরে তাণ্ডব চালায়, এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে গেলেও ডোনাল্ড লু’র একটি চিঠি নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে ধর্না দিয়েছিলেন। অবশ্য ডোনাল্ড লু’র এই চিঠিকে আমলে নেননি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। 

ডোনাল্ড লু’র এই রাজনৈতিক সংলাপের বার্তাকে অনেক বিলম্বে দেওয়া বলে অভিহিত করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এরপর দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে একটি পরিবর্তিত নীতি এবং অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ এই বক্তব্য রেখেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ রকম একটি অবস্থা যখন বিরাজমান তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন ঢাকা সফর করছেন- এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। 

জানা গেছে, ১৪ থেকে ১৬ পর্যন্ত দুই দিনে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে সরকারি এবং বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এছাড়াও তিনি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। আর এবার ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফর কী বার্তা দেবে তা নিয়ে নানারকম জল্পনা কল্পনা চলছে। 

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফর। সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়া এবং বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অবস্থানকে সম্প্রসারণ করাই ডোনাল্ড লু এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলেই একাধিক কূটনৈতিক সূত্র দাবি করেছে। 

বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশেষ করে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকার যে দরপত্র আহ্বান করেছে সেখানে যেন মার্কিন কোম্পানিগুলো সুবিধা করতে পারে সে সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী। তবে এর পাশাপাশি বাংলাদেশের মানবাধিকার, বিরোধী দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড লু’র সফর নিয়ে যত মাতামাতি হতো বা যে আতঙ্ক তৈরি হতো এবারে সেই পরিস্থিতি হচ্ছে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ডোনাল্ড লু   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের সাজা প্রায়শ্চিত্ত, বিএনপির মৃত্যুদণ্ড

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৬ মে, ২০২৪


Thumbnail

শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?

আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।

এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।

কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।

আরও পড়ুন:  আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার

কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত। ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল। কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।

গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।

আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে। এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল। যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই অকেজো হয়ে যাচ্ছে।

৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।

আরও পড়ুন:  প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি

২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান। চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়, তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই। দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই। সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।

শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।


সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com

 


আওয়ামী লীগ   বিএনপি   জাতীয় সংসদ নির্বাচন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন। যেহেতু কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্যোগকে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই এমন একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা সমীচীন নয়, শোভনও নয়। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি করতে চাই। তুমি যোগাযোগ কর। আমি বঙ্গভবনে যোগাযোগ করলাম। রাষ্ট্রপতি চিকিৎসা শেষে মাত্র যুক্তরাজ্য থেকে ফিরেছেন। একান্ত সচিব বললেন, ‘আমি দেখছি।’ দুদিন পর সময় পাওয়া গেল। আমি এবং সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী গেলাম বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি হবার পর এটা ছিলো আমার তৃতীয় সাক্ষাৎ। তিনবারের কোন বারেই তার আন্তরিকতার ঘাটতি পাইনি। দেশে সর্বোচ্চ পদে যাবার পরও তিনি সেই হাসিখুশী, বন্ধুসুলভ, প্রাণবন্ত, নির্ভেজাল মানুষ। সদ্য চিকিৎসা শেষ করে তিনি দেশে ফিরেছেন। জরুরী রাষ্ট্রীয় কাজ ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কিন্তু আমাদের অনুরোধ তিনি ফেললেন না। সচিবকে ডেকে একটা তারিখ ঠিক করতে বললেন। সেই থেকে এই আয়োজনের ব্যস্ততা। অবশেষে ৩০ এপ্রিল একটা সফল এবং গোছানো অনুষ্ঠান করলো ক্রিয়েটিভ মিডিয়া। অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। রাতের খাবারের পর সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে আধো ঘুমে টেলিভিশন সংবাদ দেখার চেষ্টা করছি। রাত বাজে সাড়ে দশটা। এমন সময় রাষ্ট্রপতির ফোন। আমি বেশ বিস্মিত হয়েই ফোন ধরলাম। রাষ্ট্রপতি বললেন ‘বোরহান খুব সুন্দর অনুষ্ঠান করেছেন। ধন্যবাদ।’ আমি আপ্লুত, হতবিহম্বল। রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘অনুষ্ঠানে আপনাকে খুঁজলাম। পেলাম না। দেখা হলো না, তাই ফোন করলাম।’ আমি জানালাম পর্দার পিছনে থেকে অনুষ্ঠান তদারকি করছিলাম। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি ফোন রাখলেন। দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির বিনয়, উদারতা মুগ্ধ করার মতো। আজকাল এই আচরণ অভাবনীয়। আমার জন্য এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর সম্প্রতি পূর্ণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে বঙ্গভবনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। মোঃ সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি হওয়াটাই ছিলো এক চমক এবং বিস্ময়কর ঘটনা। নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এনিয়ে নানা আলোচনা ছিলো। বিভিন্ন রথী মহারথীদের নাম সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে কোথাও মোঃ সাহাবুদ্দিনের নাম ছিলো না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গুলশানে আমি নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি আমি রাষ্ট্রপতি হবো।’ আমাকে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন এভাবে ‘পরদিন পাবনা যাবো। এজন্য সেলুনে গেছি, চুল কাটাতে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, কি করছি। আমি জবাব দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন আমার ব্যাংকে কোন লোন আছে কিনা, ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ইত্যাদি।’ তিনি বললেন, ‘তখনও আমি ভাবিনি, এরকম কিছু হচ্ছে।’ 

একটা কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্য সেই সময়টা ছিলো কঠিন, অনিশ্চয়তায় ভরা। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানী, বিরোধী দলের আন্দোলন, সুশীলদের চক্রান্ত। সব কিছু মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, সেটিই ছিলো এক বড় প্রশ্ন। এরকম পরিস্থিতি সব সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলের দরজা খুলে দেয়। চক্রান্ত ডাল মেলা মেলে। বাংলাদেশে অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রায়ই বঙ্গভবন হয় ষড়যন্ত্রের আঁতুড় ঘর। ২০০৭ সালের এক এগারো যার সর্বশেষ উদহারণ। সুশীলদের পক্ষ থেকে ‘নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য’ কাউকে রাষ্ট্রপতি করার আহ্বান ছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো চাইছিলো এমন কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে যার মাধ্যমে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেটানো যায়। 

আওয়ামী লীগের জন্য নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিলো অগ্নি পরীক্ষা। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগ যে ভুল করেছিল তার মাশুল চরম ভাবে দিতে হয়েছিল দলটিকে। কে নতুন রাষ্ট্রপতি হবেন, এনিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই ছিলেন অন্ধকারে। এরকম এক সময় আলোচনার বাইরে থাকা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। এটি ছিলো আচমকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আসন্ন চক্রান্ত মোকাবেলার জন্যই বেছে নিয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তিকে যিনি বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ এবং আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তার জীবনে কোন দিন আদর্শচ্যুত হননি। জাতির পিতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রতিবাদ করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারাভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তবে আদর্শের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিলো পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময়। ডাক সাইটে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা চেয়েছিলেন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগকে প্রশ্রয় দিতে। তারা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে কলংকিত করার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানও নন। একজন সদস্য মাত্র। দায়িত্ববানরা যেকোন পরিস্থিতিতেই আদর্শের প্রশ্নে অটল হিমালয়ের মতো দাঁড়াতে পারেন তার প্রমাণ সে সময় রেখেছিলেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। দুদকের কমিশনার থেকে একাই তিনি রুখে দেন ষড়যন্ত্র। কিন্তু এনিয়ে তিনি হৈ চৈ করেননি। আত্ম অহংকারে বেসামালও হননি। আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আমার দায়িত্ব। কোন কিছু প্রাপ্তির জন্য এটি আমি করিনি।’ সারাজীবন এভাবে নীরবে, নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এই মানুষটি। আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়াই। মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কেন্ডিক প্রসাদ ষড়যন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দেন শেখ হাসিনা। যারা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে ন্যূনতম চেনে তারা জানেন, আর যাই হোক নীতির প্রশ্নে তাকে এক চুলও টলানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য প্রয়োজনে তিনি জীবন দেবেন। 

আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনার দূরদর্শী, বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিলো একটি টার্নিং পয়েন্ট। এর মাধ্যমে নির্বাচন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোট হতচকিত হয়ে যায়। দায়িত্ব নিয়ে মোঃ সাহাবুদ্দিন নির্বাচন কেন্ডিক উত্তাপ সামাল দেন ঠান্ডা মাথায়। তার অভিভাবকত্বে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। একবার ভাবুন তো, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময় ভীরু, কাপুরুষদের কেউ যদি রাষ্ট্রপতি হতেন, তাহলে কি এভাবে নির্বিঘ্নে সব কিছু হতো? সংশোধিত শ্রম আইনে স্বাক্ষর না করে তিনি বুঝিয়েছেন বঙ্গভবন দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় কথা মোঃ সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার একজন যোগ্য অভিভাবক হিসেবে একবছরে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ক্ষমতার দম্ভ তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ পদ তার বিনয়, সৌজন্যতাকে ম্লান করতে পারেনি। এখনও তিনি যেন সেই প্রাণখোলা মানুষটি। কিন্তু নীতির প্রশ্নে অটল। ৩০ এপ্রিলের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মহামূল্যবান একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন ‘শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাই হলো ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ।’ এই বার্তাটি তিনি সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান। আমি মনে করি এই নির্দেশনাটি মহামূল্যবান। এটিই এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রধান করণীয়।  

মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি হবার পরও ঠিক আগের মতোই আছেন। জনবিচ্ছিন্ন হননি। নিরাপত্তার শৃংখল থেকেও তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সূতোটা কাটেননি। এই জীবনে তো বহু মানুষ দেখলাম, যারা ক্ষমতা পেলে এমন দম্ভ দেখান যে, মনে হয় সারাজীবন এরকম ক্ষমতাবানই থাকবেন। ক্ষমতাহীন অবস্থায় যারা বুকে টেনে নিতেন, ক্ষমতা পেয়েই তারা অচেনা মানুষ হয়ে যান। এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। যারা অযোগ্য, চাটুকার, মতলববাজ তারাই ক্ষমতা পেয়ে দিশেহারা হন। অতীত ভুলে যান। উপকারীকে এড়িয়ে চলেন। কৃতজ্ঞহীন এক অমানবিক মানুষে পরিণত হন। এদের একজনের গল্প বলি।  

তিনি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে হতাশায় মুষড়ে পরলেন। প্রায় প্রতিদিন আমার অফিসে আসতেন। তার পরিবারের কাছে কিভাবে তিনি ছোট হলেন তার বিবরণ দিতেন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে। দুপুরে আমার অফিসেই খাবার টেবিলে মনোনয়ন না পাওয়ার বেদনায় আক্রোশ ঝাড়তেন মুরগীর রান চিবিয়ে। শেখ হাসিনা তাকে মূল্যায়ন করলো না, এনিয়ে তার কি গোস্বা। কিছুদিনের মধ্যেই খবর এলো তাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হচ্ছে। এক বিকেলে উচ্ছ্বাসিত ভাবে এলেন অফিসে। প্রধানমন্ত্রী তার ফাইল অনুমোদন করেছেন। এখন রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলেই সরকারি আদেশ জারী হবে। রীতিমতো ঘামছেন। রাষ্ট্রপতি তখন যুক্তরাজ্যে। বিভিন্ন জন তাকে নানান তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেন না, ফলে তার অস্থিরতাও কমছে না। তার এই অবস্থা দেখে আমি সরাসরি ফোন করলাম রাষ্ট্রপতিকে। তিনি যুক্তরাজ্যে আছেন জেনেও। তিনি ফোন ধরে বললেন, ‘বোরহান আমি হাসপাতালে, আমার টেস্ট চলছে, জরুরী কিছু? আমি ঐ উপাচার্যের ফাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘আমি একটু আগেই ফাইলে স্বাক্ষর করেছি।’ আমার এই ধৃষ্টতা এবং বাড়াবাড়িতে তিনি এতটুকু বিরক্ত হলেন না। বরং নতুন উপাচার্যকে অভিনন্দন জানালেন। একজন মানুষ কতটা খাটি, নির্ভেজাল এবং আন্তরিক হলে এটা সহ্য করে। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এই বিনয়ের কারণ তিনি আদর্শবান, যোগ্য। আর যে ব্যক্তি এমপি না হতে পেরে উপাচার্য হলেন, তিনি কদিন পর বিরাট মানুষ হয়ে গেলেন। তার কথা বার্তা, আবার আচরণে মুহূর্তে অন্যরকম হয়ে গেল। আমি তার কাছে আবর্জনা হয়ে গেলাম। 

আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ফারুক আমাকে এক বিকেলে ফোন করলেন। অনুরোধ করলেন, ঈদের অনুষ্ঠানে নতুন উপাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়। আমি যেন তাকে বলে দেই। আমি উপাচার্যকে ফোন করলাম। তিনি ফোন ধরলেন না। আগে যিনি দিনে কয়েকবার ফোন করতেন। ফোন না পর্যন্ত বার বার ফোন করেই যেতেন, তিনি আমার ফোন রিসিভ না করাতে আমি এতোটুকু দুঃখিত হইনি। ভাবলাম নিশ্চয়ই ব্যস্ত। উপাচার্য বলে কথা। নিশ্চয়ই ফ্রি হলে ফোন করবেন। কিন্তু তিনি ফোন ব্যাক করলেন না। পরদিন বিকেলে আবার ফারুকের অনুরোধ। এবার আমি ফারুককে রেখেই উপাচার্যকে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে। বললেন, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমি ভীষণ ব্যস্ত।’ আমি একটু বিস্মিত হলাম। ধাতস্থ হয়ে ফারুকের প্রস্তাব বললাম। আমি যেন মহা অন্যায় করেছি। তিনি বললেন, ‘এসব এখন হবে না। আমি ব্যস্ত।’ আরো কিছু কথা শোনার পর আমি বললাম ‘ভাগ্যিস আপনি শুধু উপাচার্য হয়েছেন, মন্ত্রী এমপি হননি।’ কদিন আগে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রে মাষ্টার হেডে প্রধানমন্ত্রীর ছবিই বাদ দিয়েছেন। উপাচার্য হয়েই তিনি নিরপেক্ষ হবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই মাইনাস করলেন? অযোগ্যরা ক্ষমতায় গেলে এভাবেই সম্ভবত বদলে যায়, অহমিকার এক মুখোশ পরে। এই ব্যক্তি একা না। এরকম ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী ক্ষমতা যাদের মাথা খারাপ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। এর কারণ তারা ক্ষমতা লোভী, অযোগ্য। রাষ্ট্রপতি হলেন একজন অসাধারণ সাধারণ মানুষ। ক্ষমতা যার মৌলিকত্ব, অকৃত্রিম আন্তরিকতা কেড়ে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তিনি যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি গত এক বছরে কাজ দিয়েই তা প্রমাণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। 
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন