এডিটর’স মাইন্ড

সংকটে যোগ্যদের সামনে আনা জরুরি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৩ জুলাই, ২০২২


Thumbnail সংকটে যোগ্যদের সামনে আনা জরুরি

দীর্ঘ এক যুগ পর সারা দেশে ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। ঢাকায় ১ ঘণ্টা। ঢাকার বাইরে কোথাও ২, কোথাও ৩-৪ ঘণ্টা। ঢাকায়ও লোডশেডিংয়ের এলাকাভিত্তিক যে সূচি দেওয়া হয়েছে তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোথাও ২-৩ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। দীর্ঘ এক যুগে শতভাগ বিদ্যুতের দেশে লোডশেডিং মানুষ মেনে নিতে পারছে না। অর্থনীতিতেও সংকটের চেহারাটা আর গোপন থাকছে না। নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি বাংলাদেশ। একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া মানেই খারাপ সংবাদ। এতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মুদ্রাস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭.৫৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও সুখবর নেই। দুই বছর পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি না হলে এবং আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সামনে সংকট আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে।’ এজন্য শেখ হাসিনা সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

ব্যক্তির জীবনে যেমন অযাচিত অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট আসে, তেমনি একটি রাষ্ট্রও সংকটে পড়তে পারে। ব্যক্তির জীবনে সংকটের জন্য অনেক সময় যেমন ওই ব্যক্তির কোনো দায় থাকে না, তার কোনো ভূমিকা ছাড়াই তিনি আচমকা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। ২০২০-২১ সালে এরকম অনেক ঘটনা আমাদের চারপাশে দেখেছি। চাকরি হারিয়ে অনেকেই অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশে যে সংকট, সেখানে সরকারের ভূমিকা খুব সামান্যই। এ সংকট সরকার বা জনগণের সৃষ্ট নয়। বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরিস্থিতির শিকার। রাশিয়ার ওপর মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন টালমাটাল বিশ্ব। বাংলাদেশ এর নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব জনগণকে পাশে নেওয়া। আশ্বস্ত করা। নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা প্রকাশ। তাদের কষ্টের সমব্যথী হওয়া। খোলামেলাভাবে বাস্তবতা জনগণের কাছে তুলে ধরাটা জরুরি। বর্তমান সরকার ১৩ বছরের বেশি দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলের নেতা-কর্মী, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী- সবাইকে এ পরিস্থিতিতে বিনয়ী, নম্র ও সংযত হওয়া দরকার। জনগণ যেন বুঝতে পারে সরকার তাদের পাশে আছে। চেষ্টা করছে।


এ ধরনের পরিস্থিতি একা কোনো সরকারের পক্ষেই মোকাবিলা সম্ভব নয়। একটা ইতিবাচক বিষয় এ বৈশ্বিক বিপর্যয়ে আমি সরকারের মধ্যে লক্ষ্য করেছি। বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়ার বিষয়ে সরকার এখন পর্যন্ত লুকোচুরি করেনি। বরং প্রথম থেকেই বাস্তবতার আলোকে কৃচ্ছ্রসাধনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। জনগণকে অন্ধকারে রাখেনি। বরং জনগণকে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছে। কিন্তু সংকটে সংযত, বিনয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকে আন্তরিক মনে হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দায়িত্ববান ব্যক্তিরা এক ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারে যেন আগ্রহী। কোনো কোনো ব্যক্তি অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। মসজিদে এসি কখন চলবে কিংবা চলবে কি না এসব নিয়ে কথা বলার দরকার কি? এ সময় এমনিতেই মানুষ অস্বস্তিতে আছে। এর মধ্যে এসব কথা বলার প্রয়োজন কি? রাত ৮টার মধ্যে দোকান বন্ধের নির্দেশ ঈদের আগেই দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে বিকালের পর দোকানপাট খোলা রাখা হয় না। কেউ যদি রাত ৮টার পর দোকানপাট খোলা রাখে তা দেখার দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর হুঙ্কার দেওয়ার দরকার কি? বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দিচ্ছেন। কেন? মানুষকে হুমকি দিয়ে ঠান্ডা করার সময় এখন নয়। এটা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সংস্কৃতিও হতে পারে না। অবশ্য দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কিছু কিছু ব্যক্তি এখন যেন মুষ্টিযোদ্ধা অথবা পালোয়ান হয়ে গেছেন। যখন অর্থনৈতিক ও বিদ্যুৎ সংকটে জনগণের মধ্যে হতাশা, তখন কোনো কোনো এমপি যেন কুস্তিগিরে পরিণত হয়েছেন। একে ওকে পিটিয়ে তাঁরা আলোচনায়। কেউ পেটাচ্ছেন অধ্যক্ষকে, কেউ পেটাচ্ছেন আরেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে! ক্ষমতার দাপটে তাঁরা দিশাহারা। দেশের এ পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা জনগণের পাশে দাঁড়াবেন। জনগণকে আশ্বস্ত করবেন। অথচ তাঁরা করছেন উল্টো। এর ফলে বদনাম হচ্ছে আওয়ামী লীগের, সরকারের। শুধু কয়েকজন সংসদ সদস্যই যে এরকম দায়িত্বহীন আচরণ করছেন তা নয়। হাতে গোনা দু-এক জন মন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যই ইতোমধ্যে নিজেদের অযোগ্য প্রমাণ করেছেন। এ সংকটে তাঁরা ভূমিকা-হীন। কেউ গা বাঁচিয়ে চলছেন। কেউ বা দম্ভোক্তি করে জনগণের করুণার পাত্র হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া জনগণের আস্থা-ভাজন আর কজন আছেন এ মন্ত্রিসভায়? এ মন্ত্রীরা কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর নামে স্তুতির বন্যা বইয়ে দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন কজন মানেন? কজন শেখ হাসিনার মতো সাধারণ মানুষকে সম্মান করে কথা বলেন? কেউ কেউ উল্টো জনগণকে খেপিয়ে তুলছেন কথায় ও কাজে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এ সরকারের রাজনৈতিক চেহারাটা ফিকে। বিবর্ণ। এ কঠিন সময়ে সরকারের রাজনৈতিক অবয়বটা সামনে আনা অত্যন্ত জরুরি। যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্বে আনাটা খুবই দরকার। আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণই দলটির প্রাণশক্তি। এ দলে অনেকে আছেন যাঁদের সঙ্গে জনগণের এখনো গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। করোনার সময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে নিজস্ব উদ্যোগে কষ্টে থাকা মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। ধান কেটে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা-কর্মীরাই। এবারের বন্যায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন পরম মমতায়। লাঠিয়াল এমপি কিংবা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা মন্ত্রীদের সঙ্গে এ আওয়ামী লীগের পার্থক্য অনেক। দুটি ধারা দুই মেরুতে। শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্য আর মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের একটু তুলনা করে দেখুন। কি ভীষণ পার্থক্য। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরীর মতো নেতা কি সরকারে আছেন? এই প্রবীণ, বর্ষীয়ান জাতীয় নেতাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব-উল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম কিংবা মির্জা আজমের মতো মাঠে-ময়দানে জনগণের সঙ্গে সারাক্ষণ সংযুক্ত থাকা নেতাদের কজন আছেন বর্তমান মন্ত্রিসভায়? এ মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য জনগণের চেহারা পড়তে পারেন না। যেমন পারেন শেখ হাসিনা। এ মন্ত্রিসভার এক বড় অংশ জনগণের ভাষায় তাদের আপন হয়ে কথা বলতে পারেন না। যেমনটি পারেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন। এ সময় তিনি যৌক্তিক কারণেই অনেক হেভিওয়েট নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেননি। তার পরও ওই মন্ত্রিসভায় ছিলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো জাতীয়ভাবে পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নূরুল ইসলাম নাহিদ কিংবা জাহাঙ্গীর কবির নানকের মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ ওই মন্ত্রিসভাকে একটা রাজনৈতিক অবয়ব দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবার মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী আবার হেভিয়েটদের ফিরিয়ে আনেন। শুধু আওয়ামী লীগের নয়, ১৪ দল থেকেও রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুর মতো বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মন্ত্রিসভায় চমক আনেন। প্রথমবার মন্ত্রী হয়েই তাজুল ইসলাম পান স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। জীবনে প্রথম সংসদ সদস্য হয়েই ড. আবদুল মোমেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, শেখ হাসিনা নতুনদের সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি সরকার ও দলকে আলাদা করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই মন্ত্রিত্বকে দেশসেবার মহামূল্যবান সুযোগ মনে করেননি। কেউ কেউ একে ‘আলাদিনের চেরাগ’ মনে করেছেন। অনেক মনে করেছেন একটা আরাম-আয়েশের চাকরি। তাঁরা দলীয় প্রধানের দেওয়া সুযোগটার অর্থ বুঝতে পারেননি। এঁদের কেউ কেউ এত বোধশক্তিহীন যে নিজেদের অযোগ্যতাটুকুও বুঝতে পারেন না। করোনা মোকাবিলায় সীমাহীন অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার পর কোনো মন্ত্রী যখন নিজেকে সফল দাবি করেন, তখন মানুষ হাসবে না কাঁদবে ভেবে কূল পায় না। দ্রব্যমূল্য নিয়ে যখন মন্ত্রী তাঁর অসহায়ত্বের কথা বলেন, অথচ তখনো তিনি দল, দেশ এবং নেতার চেয়ে নিজের চেয়ারটাকে মূল্যবান মনে করেন। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার যখন সিন্ডিকেটের খাঁচায় বন্দি হয় তখন কি মন্ত্রীর সরে যাওয়ার একবারও ইচ্ছা হয় না? এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। এসব অযোগ্য মন্ত্রী এখন সরকারের জন্য বোঝা হয়ে গেছেন, তাঁরা নিজেদের অযোগ্যতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ভাগ্যিস শেখ হাসিনা ছিলেন। যিনি সবকিছুতেই নজর রাখেন। সবকিছু দেখেন। মূলত গত সাড়ে তিন বছর শেখ হাসিনা একাই সব সামলেছেন। করোনায় ব্যর্থ মন্ত্রীকে না সরিয়ে নিজে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণেও তাঁকেই উদ্যোগ নিতে হয়েছে। খেলার মাঠ উদ্ধার থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু- সব ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণেই বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে।

আমরা জানি, শেখ হাসিনা দূরদর্শী, বিচক্ষণ, অমিত সাহসী একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধা দরকার, দরকার বিশ্বস্ত অনুসারী। খেলায় যেমন একজন মেসি কিংবা নেইমার সব সময় দলকে জেতাতে পারেন না, এ কথা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দরকার হয় কিছু নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীর, সহযোদ্ধার। যাঁরা শেখ হাসিনার চিন্তাগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবেন। যাঁরা তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা, দর্শন বুঝবেন। মন্ত্রীরা যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলেন না তখন আমলারা অবলীলায় শূন্যস্থান পূরণ শুরু করেন। করোনার সময় বাস্তবতার কারণে আমলাদের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারপ্রধানকে। সে সময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাঁর সামনে কোনো বিকল্পও ছিল না। কিন্তু আমলারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই করেন না। তাঁদের সব কাজের একটা বিনিময়মূল্য আছে। করোনাকালে তাঁরা যে কাজ করেছেন তার বিনিময়ে রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে তথ্য কমিশন- সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এখন আমলাতন্ত্রের দখলে। আওয়ামী লীগই সৃজনশীল অর্থনীতিবিদ ও পণ্ডিতদের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন লুৎফর রহমান সরকারের মতো সৃষ্টিশীল ব্যাংকারকে। তাঁর মেয়াদ শেষ হলে ড. ফরাসউদ্দিনের মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বকে গভর্নর করা হয়েছিল। ড. ফরাসউদ্দিন একজন আমলা ছিলেন বটে, কিন্তু একজন সাবেক আমলার চেয়ে একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ‘গরিবের অর্থনীতিবিদ’ ড. আতিউর রহমানের মতো ব্যতিক্রমী পণ্ডিতকে গভর্নর করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানও এখন আমলাদের দখলে চলে গেছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে অর্থ সচিবদের অবসর-উত্তর ঠিকানা এখন বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় একজন সদ্য অবসরে যাওয়া আমলার চেয়ে ড. আতিউর রহমান, ড. আবুল বারকাতের মতো মেধাবী উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী অর্থনীতিবিদ বেশি দরকার। নবনিযুক্ত গভর্নর নিঃসন্দেহে দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কিন্তু দীর্ঘদিন নথির মধ্যে থাকতে থাকতে তিনি হয়তো বর্তমান সংকটের সমাধানও নথিতেই খুঁজবেন। আমলারা কোনো সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করেন না বা করতে পারেন না। সৃজনশীলতা উপেক্ষা করেন। গৎবাঁধা রুটিনে কাজ করতে চান। এক ক্ষমতাবান আমলা বিদ্যুৎ সংকটের ‘কুইক রেন্টাল’ সমাধান আবিষ্কার করে নিজের ক্যারিয়ার তরতর করে ওপরের দিকে উঠিয়েছিলেন। এখন সেই কুইক রেন্টাল সরকারের গলার কাঁটা।

এভাবেই আমলারা ভবিষ্যতের কথা ভাবেন না। তাৎক্ষণিক সমাধান করে নিজেদের ‘দক্ষ’ প্রমাণ করতে চান। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে যেমন আমলাতন্ত্রের শিকল ছিঁড়ে বেরোতে হবে, তেমনি সরকারকেও রাজনীতির ধারায় ফিরিয়ে আনাটা জরুরি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রবীণ হেভিওয়েট কিংবা জনপ্রিয় নেতাদের মন্ত্রী বানালেই কি সংকটের সমাধান হবে? সংকট তো দেশে তৈরি হয়নি। মন্ত্রী বদল করে সমাধান হবে কীভাবে? সংকট সমাধান নয়, এখন প্রয়োজন জনগণকে সাহস দেওয়া। তাদের অনিশ্চয়তা দূর করা। আমলাতন্ত্রের দফাওয়ারি সুপারিশের পর ‘আতঙ্কের কোনো কারণ নেই’ ধরনের বক্তব্যে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে না। জনগণ বুঝতে পারে এমন ভাষায় কথা বলে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। জনগণের কাছে শেখ হাসিনার বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। এরকম বহু যোগ্য নেতা আওয়ামী লীগে আছেন। এঁদের ভুলত্রুটি আছে, আছে অতীত স্খলনও। কিন্তু এ সংকটে তাঁরাই হবেন যোগ্য সহযোগী। এতে মানুষ ভরসা পাবে। অযোগ্যদের ভারমুক্ত হবে জাতি। এই তো এক বছর আগের কথা। করোনা, অর্থনৈতিক সংকট, কৃষক বিদ্রোহ সব মিলিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তায় নিম্নমুখী স্রোত। এর মধ্যেই ৯ জুলাই, ২০২১-এ ১২ জন মন্ত্রীকে ছাঁটাই করে মন্ত্রিসভা রদবদল করলেন। এটা গণতান্ত্রিক একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন মেয়াদে এটি করেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও নির্বাচন কালীন মন্ত্রিসভায় তিনি হেভিওয়েট নেতাদের যুক্ত করেছিলেন। সৈয়দ আশরাফের মতো কঠিন সময়ের পরীক্ষিত নেতার দফতর বদলেও তিনি পিছপা হননি। কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।  এরকম বহু উদাহরণ আছে শেখ হাসিনার ১৮ বছরের দেশ পরিচালনায়। এ সংকট একটা বিশ্ব বাস্তবতা। এখন ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে হবে মমতায়, ভালোবাসায়।  যেভাবে আওয়ামী লীগ জনগণের পাশে দাঁড়ায় সব সংকটে। এ সংকটে যোগ্যদের সামনে আনাটা এখন সময়ের দাবি।


লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

Email : poriprekkhit@yahoo.com


লোড শেডিং   বিদ্যুৎ   সংকট অর্থনীতি   রাজনীতি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন। 

আগামীকাল ৩০ এপ্রিল দলটির কার্যনির্বাহী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এবং এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল ৩০ এপ্রিলের দিকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। ৩০ এপ্রিল কি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ধোঁকা খাবে? যারা ক্ষমতাবান মন্ত্রী-এমপি সংসদ সদস্য তারা তাদের সন্তানদেরকে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী করার ফলে তারা কি শাস্তি পাবেন? নাকি এবারেও তারা পার পেয়ে যাবেন? ৩০ এপ্রিল কি আওয়ামী লীগের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হবে, নাকি ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ আবারো ধোঁকা খাবে। 

আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন, ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের যারা সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছেন, যারা স্বজনপ্রীতি করেছেন, যারা ভাই, ভাতিজা, স্ত্রী, কন্যা, পুত্র, শ্যালককে প্রার্থী করেছেন তাদেরকে লাল কার্ড দেখানো হবে। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা বলছেন যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যেহেতু কঠোর বার্তা দিয়েছেন সেহেতু তার কাছে নিশ্চয়ই ‘ট্রাম্প কার্ড’ আছে। আর এই এই ট্রাম্প কার্ড দেখানো হবে ৩০ এপ্রিল। দলের সিদ্ধান্ত যারা লঙ্ঘন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই এমন কথাও বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। 

আওয়ামী লীগের জন্য ৩০ এপ্রিল দিনটি অত্যন্ত প্রতারণামূলক এবং ধোঁকা খাওয়ার দিন হিসেবেই পরিচিত। ঠিক কুড়ি বছর আগে এই ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ ধোঁকা খেয়েছিলো। তখন পাদপ্রদীপে ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল। ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে ফেলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ৩০ এপ্রিলের আগে প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে আসতেন এবং কিভাবে সরকারের পতন হবে সেবিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিতেন। ৩০ এপ্রিলের আগে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সে কর্মসূচি গুলোর মাধ্যমে সরকার পতনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ৩০ এপ্রিল ম্যাজিক দেখাবেন বলেই বারবার ঘোষণা করছিলেন। তার কাছে ট্রাম্প কার্ড আছে এমন বক্তব্য তিনি রেখেছেন একাধিকবার। কিন্তু ৩০ এপ্রিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কিছুই হয়নি বরং আওয়ামী লীগই অসম্মানিত হয়েছে। 

সাধারণ মানুষের কাছে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি হাস্যকর হয়েছে। ৩০ এপ্রিলের গ্লানি আওয়ামী লীগকে বহুদিন বহন করতে হয়েছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ৩০ এপ্রিল নিয়ে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কম টিটকারি করেনি। আবার একটা ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্য নির্ধারণের দিন। এবারও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই পাদপ্রদীপে। ৩০ এপ্রিল যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে নাকি ৩০ এপ্রিল আবারো আওয়ামী লীগ ধোঁকা খাবে। গত কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগের মধ্যে বিশৃঙ্খল একটা অবস্থা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে সবাই নেতা হয়ে গেছেন, কেউ কাউকে মানছেন না। তবে একটা আশার ব্যাপার ছিলো। সকলে মনে করতেন যে, আওয়ামী লীগের সভাপতি ঐক্যের প্রতীক। তাকে সকলে মানেন এবং তার কথার কেউ অবাধ্য হবেন না। 

২০০৭ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ এবং কোন্দলকে প্রশ্রয় দেয়া হতো একটি চিন্তা থেকেই। সেটি হলো আওয়ামী লীগে যে যত গ্রুপই থাকুক না কেন, যে যত পক্ষই করুক না কেন তারা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে। শেখ হাসিনা যা বলবেন সেটি তারা মানবেন। শেখ হাসিনাই একমাত্র নেতা। আর বিভক্ত বিভিন্ন গ্রুপগুলো তাকিয়ে থাকতো শেখ হাসিনার দিকে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার প্রতি অন্ধ আনুগত্য বা আস্থা স্রেফ কথার কথা। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতারা যেটি বলেন সেটি আসলে বাস্তবে করেন না। শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করেন। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেন। আর এটিই আওয়ামী লীগের জন্য শঙ্কার এবং উদ্বেগের বিষয় বলে আমি মনে করি। কারণ যদি শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকেও নেতারা অমান্য করে তাহলে দলের অস্তিত্বই চ্যালেঞ্জের মুখে পরে। আওয়ামী লীগ আসলে এবার সে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। 

২০১৮ সালের নির্বাচনের পরেই আওয়ামী লীগের ভিতর একটা ‘ফ্রি স্টাইল’ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। যে যার মতো, যেমন খুশী বক্তব্য রেখেছিলেন এবং সে বক্তব্যের কোন জবাবদিহিতাও ছিল না। একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও কেন্দ্রীয় সদস্যকে গালাগালি করেছেন, একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি সমালোচনার তীর ছুড়েছেন। এটি আওয়ামী লীগে হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক ব্যাপার। ২০১৮ এর পর স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগ মুখোমুখি হয়েছে, হানাহানি করেছে, একে অন্যকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছে। এঘটনাগুলো যখন নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে তখনও আওয়ামী লীগের নেতারা নির্লিপ্ত ছিলেন। সারাদেশেই আওয়ামী লীগ দুই তিন ভাগে বিভক্ত। এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেছে। দলের পক্ষ থেকে তাদের কারো বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়নি। যার ফলে আওয়ামী লীগের ‘চেইন অব কমান্ড’ পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল। 

২০২৪ এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে সিদ্ধান্তটি ছিলো, দলের প্রতীক না পাওয়া ব্যক্তিরা দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারবে। আর এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক করার স্বার্থে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত এখন আওয়ামী লীগের জন্য একটি বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। সারাদেশে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি-কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো এই বিভক্তি এবং কোন্দলগুলো দূর করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বারবার নেতাকর্মীদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা করেও এ ব্যাপারে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে যে, এই কোন্দল এবং বিভক্তি কমেনি। বরং বেড়েছে। এই কোন্দল বিভক্তি থেকে রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়। দল থেকে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। কিন্তু এর ফলে দেখা গেল আরেক সমস্যা। আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা নিজ নিজ এলাকায় জমিদারতন্ত্র কায়েমের মিশনে নেমে পরলো। তারা তাদের নিজেদের ভাই-ব্রাদার আত্মীয় স্বজনদের প্রার্থী করে এলাকাগুলোতে পরিবারতন্ত্র কায়েমের মিশনে ঝাপিয়ে পরেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি একারণেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, উপজেলা নির্বাচনে কোন মন্ত্রী এমপি তার আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থী করতে পারবেন না। 

ধারণা করা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের প্রতি সকলে সম্মান দেখাবেন। সকলে না দেখাক অন্তত যারা দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র নেতা, যারা মন্ত্রিত্বে আছেন কিংবা তারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন। তারা নিজেদের স্বার্থকে কিছুটা হলেও সংকুচিত করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের ভাই, সন্তান, স্ত্রী, আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থীতা থেকে সরে আসার অনুরোধ প্রত্যাখান করেছেন। তার মানে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে তারা শ্রদ্ধা করেন না, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মানেন না। তারা দলকে বিকশিতও করতে চান না। এধরনের ব্যক্তিরাই যে আওয়ামী লীগে এখন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে সেটি বোঝার জন্য পন্ডিত হবার দরকার নেই। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটি এসেছে, আওয়ামী লীগ এসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারী এবং দলের স্বার্থ পরিপন্থি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বারবার বলছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ৩০ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল আসলে কি হবে? ৩০ এপ্রিল কি কুড়ি বছর আগের মতো আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ধোঁকা খাবে? 

২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল যেমন আওয়ামী লীগের অগণিত তৃণমূলের কর্মীরা অন্ধকারে ছিল। কি হবে তারা জানতেন না। তাদের জন্য কোন নির্দেশনা ছিলো না। রাজপথে নামার জন্য তাদেরকে কোন আহ্বান জানানো হয়নি। তারা বুঝতে পারেননি যে, কিভাবে সরকারের পতন ঘটবে এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতের পতন ঘটেনি। ঠিক তেমনি এবারের ৩০ এপ্রিলও আওয়ামী লীগের অগণিত তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা অন্ধকারে। তারা জানেন না ওবায়দুল কাদের কি ব্যবস্থা নিবেন এবং আদৌ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন কিনা। কারণ এর আগেও দেখা গেছে যারা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, দলের নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন তাদের খুব কম লোকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এবারেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাবান, স্বার্থান্বেষী এবং স্বজনপ্রীতি করা নেতাদের কাছে আওয়ামী লীগ কি পরাজিত হবে, নাকি সত্যি সত্যি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আওয়ামী লীগ কী ঘুরে দাড়াবে নাকি তৃণমূল প্রতারিত হবে। এই প্রশ্নটি এখন সবার সামনে বড় হয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ যদি এই সমস্ত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগের ভিতরে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যা ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনা হলেন আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক, শেখ হাসিনা হলেন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তার নির্দেশই যদি নেতারা অমান্য করেন তাহলে তাদের নেতৃত্বে থাকা উচিত? 

একটা কথা খুব স্পষ্ট, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ছাড়া কেউই অপরিহার্য না। আওয়ামী লীগ যদি কঠোরভাবে দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে তাহলে আওয়ামী লীগের তৃণমূল মুখ থুবড়ে পড়বে, সাংগঠনিক শক্তি হারাবে আওয়ামী লীগ। সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নাজুক অবস্থা নগ্নভাবে প্রস্ফুটিত হবে। যদি আওয়ামী লীগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তাহলেই দলটি ঘুরে দাড়াবে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে। প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে সহায়তা দিচ্ছে। দেশে কোন বিরোধী দল নেই। সেই কারণে আওয়ামী লীগ একটা স্বাচ্ছন্দ্য অবস্থায় আছে এবং কোনরকম চাপ অনুভব করছে না। কিন্তু যদি সংগঠন না থাকে, সংগঠন যদি এরকম হতশ্রী অবস্থায় চলে যায় তাহলে দুর্বল সংগঠন নিয়ে আওয়ামী লীগ কী টিকে থাকতে পারবে। এই প্রশ্নের উত্তর আওয়ামী লীগকেই খুঁজতেই হবে।  

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

বিএনপি কি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল। বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।

কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।

যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত। ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী। অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।

বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না। জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।

বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে। দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে উত্তর নেই।

খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী? নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন, ‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর। দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে।

জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা। আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।

এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি, আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।

আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন, দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ। বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিএনপি   জিয়া   পরিবারমুক্ত  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

৩০ এপ্রিল কী হবে আওয়ামী লীগে

প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ্যতা, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কীভাবে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন সেটির দিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ। 

উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একটা নিরপেক্ষ অবস্থান রাখতে চেয়েছিল। দলের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। শুধু দলীয় প্রতীক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নয়, আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, উপজেলা নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করতে পারবেন তাদেরকে মন্ত্রী-এমপিরা সমর্থন দেবে না এবং আওয়ামী লীগ দলগত ভাবে কোন প্রার্থী দেবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো আওয়ামী লীগের এই নির্দেশনা অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপিরা মানেননি। তারা তাদের আত্মীয় স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন এবং যারা আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী করেননি তারা নিজস্ব ব্যক্তিকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করেছেন এলাকায় আধিপত্য রক্ষার জন্য। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার নির্দেশনা দিলেও সেই নির্দেশনা মানেননি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা। এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের ৩০ এপ্রিলের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এ নিয়ম আওয়ামী লীগের মধ্যে নানারকম চর্চা হচ্ছে। 

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা কারা কারা দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে উপজেলা নির্বাচন করছেন, স্বজনদেরকে উপজেলা নির্বাচনের মাঠে নামিয়েছেন সেই তালিকা তৈরি করেছেন। আগামী ৩০ এপ্রিলের বৈঠকে এই তালিকা আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে দেওয়া হবে। 

দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র গুলো বলছে, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে থাকবে। বিশেষ করে নির্বাচনকে যেন কেউ প্রভাবিত করতে না পারে, নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি কোনো ছাড় দেবেন না- এই বার্তাটি প্রধানত দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে দেওয়া হবে। 

বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, যে সমস্ত মন্ত্রী এবং এমপিরা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নিজেদের স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে পর্যায়ক্রমে। আওয়ামী লীগ আকস্মিকভাবে তাদেরকে বহিষ্কার করা বা চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার মধ্যে দিয়ে যাবে না। বরং প্রথমে তাদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং যে সমস্ত নেতারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে তাদের স্বজনদেরকে প্রার্থী দিয়েছেন তাদের কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করার বিষয়টিও সামনে আসতে পারে। এ ছাড়া যারা মন্ত্রী এবং এমপি তাদের জন্য এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের বার্তা দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

একাধিক সূত্র বাংলা ইনসাইডারকে জানিয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে আছেন। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো তাৎক্ষনিকভাবে সবাইকে বহিষ্কার করা বা দলে থেকে বের করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ তিনি নেবেন না। তবে বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য হলো উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা। নির্বাচনে যেন ভোটার উপস্থিতি বাড়ে সেটি নিশ্চিত করা। এই বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে উপজেলা নির্বাচনে যেন মানুষ ভোট দিতে যায় সে বিষয়ে জনগণকে উদ্ধ করার পর জোর দিবেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ যেন উপজেলা নির্বাচনের যাকে ইচ্ছা মানুষ ভোট দিক সে বার্তাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সেই নির্দেশনা দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগ   কার্যনির্বাহী কমিটি   উপজেলা নির্বাচন   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

শাজাহান খানরা কি আওয়ামী লীগও খাবেন?

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। 

আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রেীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেজন্য অপেক্ষা করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তবে আওয়ামী লীগের স্বজনপ্রীতি যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তাতে এ দলটি এখন সত্যি সত্যি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। এতদিন মনে করা হতো, আওয়ামী লীগ সভাপতির কথা সবাই এক বাক্যে শোনে। দলের ভিতর যতই বিভক্তি এবং কোন্দল থাকুক না কেন, দলের সভাপতির নির্দেশনা সকলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। কিন্তু বাস্তবতা যে তা নয়, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক হেভিওয়েট নেতাই সেটি প্রমাণ করলেন। 

আওয়ামী লীগের এই ছন্নছাড়া অবস্থার জন্য কে দায়ী সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে, আওয়ামী লীগে যারা শেখ হাসিনার নির্দেশনা মানেন না, যারা শেখ হাসিনাকে অসম্মান করলেন তাদের কী আওয়ামী লীগ করার অধিকার আছে? আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা যদি অবাধ্য হতেন, দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করতেন সেটি অন্য কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা, সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক নেতারা যখন দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত, দলের সভাপতির সিদ্ধান্ত অমান্য করেন তখন তা অগ্রহণযোগ্য এবং উদ্বেগের।  

আওয়ামী লীগে এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরী হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের ভিতর নানা রকম সুবিধাবাদী ও অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো নিজেদের আখের গোছানো, নিজেদের ক্ষমতাবান করা। এবার পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগ্রাসী উদ্দীপনা যে কিছু কিছু নেতার মধ্যে দেখা গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এসমস্ত নেতাদের দলের প্রতি ন্যূনতম কমিটমেন্ট নেই, দায়িত্ববোধ নেই। আওয়ামী লীগ সভাপতিকে তারা ততটুকুই মানেন, যতটুকু নিজেদের স্বার্থের জন্য প্রয়োজন হয়। এরা আওয়ামী লীগের জন্য বোঝা।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম হলো নীতি নির্ধারক ফোরাম। এ প্রেসিডিয়ামের অন্যতম দুইজন সদস্য শাজাহান খান ও ড. আব্দুর রাজ্জাক। এ দুই জনই স্বজনদের তাদের নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী করেছেন। আব্দুর রাজ্জাক তার খালাতো ভাইকে প্রার্থী রাখার ব্যাপারে অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন। যুক্তিটা হলো এরকম যে, খালাতো ভাই আগে থেকেই উপজেলা চেয়ারম্যান । কাজেই তার জন্য এই নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে না। তিনি আত্মীয় কিনা সেটি বড় কথা নয়। আগে থেকেই যেহেতু তিনি চেয়ারম্যান সেহেতু এবারও তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচন করতেই পারেন। এতে কোন সমস্যা নেই। ড. রাজ্জাকের এই যুক্তিটি অদ্ভুত এবং অন্যায্য। গতবার উপজেলা নির্বাচন করেছেন বলে এবার আত্মীয়রা উপজেলা নির্বাচন করার সার্টিফিকেট পাবেন এরকম আজগুবি যুক্তি রাজনীতির মাঠে অচল। গতবার আওয়ামী লীগ স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এরকম অবস্থান গ্রহণ করেনি। শেখ হাসিনা স্বজনদেরকে নির্বাচন করা যাবে না- এমন নির্দেশনাও দেননি। বিষয়টি স্বজনদেরকে প্রার্থী করা নয়, শেখ হাসিনার নির্দেশনা। 

৭৫’ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উত্তরাধিকার একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে ছিলো সবসময়। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে ততই আত্মীয়করণ এবং স্বজন প্রীতি একটি ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের জন্য ক্যান্সার। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা যে যেখানে পেরেছেন তাদের স্ত্রী-পুত্র, ভাই-শালা-শালী সবাইকে আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢুকিয়েছেন। চর দখলের মত এলাকা দখলের অভিযান চালাচ্ছেন কিছু কিছু পরিবার। এভাবে বাংলাদেশের বহু এলাকায় বহু পরিবার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতির অজানা নয়। এবার শেখ হাসিনা কেন আত্মীয় স্বজনদেরকে নির্বাচনে দাঁড়াতে বাঁধা দিচ্ছেন, তার পিছনে একটি দার্শনিক ভিত্তি আছে। আর এই দার্শনিক ভিত্তিটি যারা বুঝতে পারেন না তারা সত্যিকারের আওয়ামী লীগ করেন না। শেখ হাসিনার নীতি এবং আদর্শকেও অনুসরণ করেন না। আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছু নেতাকর্মী যারা ত্যাগী, আদর্শবান এবং আদর্শিক চর্চা করে বেড়ে উঠেছেন তারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে না। তারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানান না। আওয়ামী লীগের মধ্যে যেসমস্ত নেতারা সুবিধাবাদী, সুসময়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন এবং যোগ্যতা ছাড়াই বড় নেতা হয়েছেন তারাই আওয়ামী লীগ সভাপতির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো এই যে, তারাই এখন আওয়ামী লীগে ক্ষমতাবান, তারাই এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে বেশী প্রভাবশালী। 

শাজাহান খানের কথাই ধরা যাক। তিনি জাসদের রাজনীতি করতেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে যে দলটি সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছিল সেটি হলো জাসদ। জাসদের গণবাহিনী জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে নাশকতার রাজনীতি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ৭৫’ এর ১৫ আগস্ট সৃষ্টির পিছনে রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি করেছিল জাসদ। এখন জাসদের অনেকেই আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ। অনেক জাসদের পরিত্যক্ত বিপ্লবী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। চাটুকারিতা আর পদলোহনের এক রুচীহীন সংস্কৃতির চর্চা করছেন তারা প্রতিনিয়ত। কিন্তু এই জাসদ ৭২’ থেকে ৭৫’ এ কি করেছে সেই ইতিহাস অনেকের কাছে অজানা। শাজাহান খান ছিলেন সেই দলে যারা ৭২’ থেকে ৭৫’ পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অগণতান্ত্রিক, ন্যাক্কারজনক, অবৈধ সব পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। শাজাহান খানরা শুধুমাত্র আখের গোছানোর জন্য এবং রাজনীতিতে পাকা পোক্ত অবস্থানকে নিশ্চিত করার জন্যই আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। আওয়ামী লীগও ৭৫’ পরবর্তী রাজনীতিতে অনেক সমঝোতা করেছে। কারণ ৭৫’ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে ধর্মান্ধ মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যেভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল সেরকম বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের সামনে আর কোন বিকল্প ছিলো না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ন্যূনতম বিশ্বাসী সকলকে একত্রিত করার রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছিল। আর একারণেই জাসদ, বাসদসহ বিভিন্ন বিভ্রান্ত বামদলকেও আওয়ামী লীগে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। শাজাহান খান তেমনই একজন নেতা। এলাকায় তার জনপ্রিয়তা থাকার কারণে নির্বাচনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগে শাজাহান খানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু শাজাহান খান হিসেবে ভালোই জানেন। হিসেব নিকেশ করেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর তার প্রাপ্তির ঝুলি ইতিমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। তিনি মন্ত্রী হয়েছেন, তিনি পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এখন তার উত্তরসূরীরা যেন তার সিংহাসন দখল করতে পারে সেজন্য তিনি তার ছেলেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রার্থী করেছেন। শাজাহান খানের পুত্রের এই প্রার্থী হওয়াটাকে স্থানীয় জনগণ ভালো চোখে নিচ্ছে না। আওয়ামী লীগও এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নেয়নি। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শাজাহান খানকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন। গত বুধবার ধানমন্ডি কার্যালয়ে শাজাহান খান গিয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে। এসময় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনি তো দলের কথা শুনলেন না, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তও মানলেন না।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। শাজাহান খানরা কখনোই আওয়ামী লীগের কথা মানে না। দলের সিদ্ধান্ত মানে না। তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যেটি প্রয়োজন সেটিই তারা করতে পারেন। শাজাহান খান আওয়ামী লীগ থেকে কি কি খেয়েছেন তার ফিরিস্তি আমি এখন দেবো না। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগকে খেয়ে ফেলবেন কিনা সেই প্রশ্ন এখন উঠছে। শাজাহান খান একটি প্রতীক মাত্র। যারা অন্য দল থেকে এসেছে। দলছুট অনুপ্রবেশকারী তাদের একটা বড় অংশই যে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য, রাজনৈতিক এবং আর্থিক ফায়দা লোটার জন্যই এই ধরনের রাজনৈতিক ডিগবাজি দিয়েছেন তা মোটামুটি স্পষ্ট। শুধু শাজাহান খান একা নন। এরকম নেতার সংখ্যা আওয়ামী লীগে কম না। যারা জীবনে কোনদিন রাজনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করেননি। দলের জন্য, আদর্শের জন্য কোন ঝুঁকি নেননি। সুসময়ে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে দলকে বিতর্কিত করেছেন, তাদের কর্মকান্ডের কারণে আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায় থেকেও বিপর্যস্ত। 

ড. আব্দুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক ইতিহাস ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ এর মত। তিনি আওয়ামী লীগে এসেছেন। এমপি হয়েছেন। ২০০৯ সালে মন্ত্রী হয়েছেন, ২০১৮ সালে মন্ত্রী হয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন, নীতি নির্ধারকে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু তিনি কি বলতে পারবেন, আওয়ামী লীগকে তিনি কি দিতে পেরেছেন? নির্বাচনের আগে তার বিরোধী দলের নেতাদের ছেড়ে দেয়া নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য সারাদেশকে হতবাক করেছিলো। আওয়ামী লীগ সভাপতি কেবল একটি দলের সভাপতি নন। তিনি আওয়ামী লীগের দলের ঐক্যের প্রতীক, আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি একমাত্র পথের দিশারী। এরকম একজন নেতার অবাধ্য হওয়াটা বিস্ময়কর। যারা আওয়ামী লীগে থেকে শেখ হাসিনার নির্দেশ অমান্য করেন তারা একালের মোশতাক। ২০০৭ সালের এক এগারোর সময় আওয়ামী লীগ সভাপতিকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কোন কোন নেতা ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তারা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বড় সেই ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিল দলের তৃণমূল। তৃণমূলের ভালোবাসা আর তৃণমূলের ঐক্যের কারণে ২০০৭ সালে মাইনাস ফর্মুলা সফল হয়নি। এবার অন্যরূপে শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত ও দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সবচেয়ে শক্তি যে তৃণমূল, সে তৃণমূলকেই অকার্যকর, দুর্বল করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। তৃণমূলকে করা হচ্ছে হতাশ। এবার যে উপজেলা নির্বাচনে ‘আত্মীয় করণ’ হলে আওয়ামী লীগের তৃণমূল বিলুপ্তিরই একটি প্রক্রিয়া। এই শাজাহান খানরা যখন তাদের এলাকায় পরিবারতন্ত্র কায়েম করবেন, তখন তৃণমূলরা দূরে ছিটকে যাবে। এই তৃণমূল শেখ হাসিনার হৃৎপিন্ড, শেখ হাসিনার রক্ত প্রবাহ। এই তৃণমূলই হলো আওয়ামী লীগের শক্তি, আওয়ামী লীগের সাহস। এখন পরিকল্পিতভাবে শাজাহান খানরা আওয়ামী লীগের তৃণমূল ধ্বংসের মিশনে নেমেছেন। আসলে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে শাজাহান খানরা কার স্বার্থ সিদ্ধি করছেন সেটি এখন দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগের তৃণমূল যদি দুর্বল হয়ে যায়, তৃণমূল যদি শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তৃণমূল যদি স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাহীন হয়ে যায় তাহলেই শেখ হাসিনা দুর্বল হয়ে যাবেন। শেখ হাসিনাকে তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে আবার মাইনাস ফর্মুলা বাস্তবায়ন করা যাবে। তৃণমূলকে শেখ হাসিনা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই বাংলাদেশে রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তাহলেই আওয়ামী লীগ মুখ থুবড়ে পড়বে, আওয়ামী লীগ অস্তীত্বের সংকটে পরবে। শাজাহানরা কি তাহলে আওয়ামী লীগকেও খেয়ে ফেলবেন?  

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে স্ত্রী-পুত্র, ভাই, শালাদের উৎপাত

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২২ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।

এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না। আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।

দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন। এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।

শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়। এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয় নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের মতো উন্মোচিত করেছে।

উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয় কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন, সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।

উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায় জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি। যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।

সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার। তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।

প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন। নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি। ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন। এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত, পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।

এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন। শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

 

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


আওয়ামী লীগ   রাজনীতি   বিএনপি  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন