ইনসাইড থট

কই তদন্ত কমিশন? বঙ্গবন্ধু হত্যার পথপ্রশস্তকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেলো!


Thumbnail কই তদন্ত কমিশন? বঙ্গবন্ধু হত্যার পথপ্রশস্তকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেলো!

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কি স্রেফ একটি সামরিক হত্যাকাণ্ড? কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল উচ্চবিলাসী নিম্নপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন হত্যাকাণ্ড? নাকি একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড? আওয়ামী লীগ দাবি করে আসছে, একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও জাতীয় চার নেতা হত্যার হত্যার মাধ্যমে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। এই ধারণার উদ্রেকের কারণ হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের স্রোতধারায় একই খুনীদের পরিকল্পনায় ৮১ দিনের মাথায় ৩ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজিবনগর সরকারের নেতাদের হত্যাকাণ্ড। যে সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্থাৎ পাকিস্তানের পরাজয়ের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান ভূখণ্ডে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিকনায়ক ও রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হত্যার শিকারকালীনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অপসারিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দিয়েই মুজিব নগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামানকে বন্দীদশা অবস্থায় হত্যা করায় আওয়ামী লীগে এ ধারণার উদ্রেককে যথার্থই মনে হতে পারে। এ ধারণাকে প্রকট বা প্রগাঢ় করে তোলে যখন পর্যবেক্ষক মহল দেখতে পান নিহত মুজিব নগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরামর্শেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ কর্তৃকই খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হারান এবং ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাজধানী কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় স্থানান্তরত্তোর যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা বা সরকার গঠন করা হয়, তা থেকে দূরে রাখা হয় বা দূরে থাকেন খন্দকার মোশতাক। জানা যায়, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিদ্যুৎমন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাককে শপথ নিতে বলা হয়েছিল, কিন্তু মোশতাকই অস্বীকৃতি জানান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। নতুন মন্ত্রিসভায় যোগদান করে খন্দকার মোশতাকও মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে নবাগত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে শপথগ্রহণ করেন। সরকারের অভ্যন্তরীণ উপদলীয় কোন্দলে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছিলেন খন্দকার মোশতাক। কেননা মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতার বিপক্ষে একটি কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ারূপেই উপরাষ্ট্রপতি- তথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের পরামর্শক্রমেই পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে অপসারিত করা হয়েছিল। স্বভাবতই সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীনের পরিণতিতে মোশতাক বেজায় খুশী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলোপ করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শিল্পমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর স্থলে তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রী করা ছিল, মোশতাকের প্রাথমিক জয়। বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফেরার ছয় দিন আগেই চার জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে মুজিব বাহিনীর দুই শীর্ষনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের সমর্থক দুই গ্রুপের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য ও আচরণ আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। এ কথাটি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ও তথ্য-বেতার মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে দায়িত্বপালনকারী মিজান চৌধুরীর মতে, স্বাধীনতার পর সরকার গঠন প্রশ্নে মুজিব বাহিনীর সংগঠকদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী মনোভাব ও অবস্থান স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপই তাদের শক্তি প্রদর্শনের মহড়া করে। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রায়, তখন বঙ্গবন্ধু দুই গ্রুপকেই ডেকে দ্বন্দ্ব নিরসনে সমঝোতা করে ফেলার নির্দেশ দেন। সিরাজুল আলম খান গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শক্তির প্রতিনিধিত্বমূলক একটি অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে গণপরিষদ বাতিল করার পক্ষে অবস্থান নেয়। অপরদিকে শেখ ফজলুল হক মনি গ্রুপ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা-কে "মুজিববাদ" আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সাংবিধানিক সংসদীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। মুজিববাদের পক্ষে শেখ ফজলুল হক মনির গ্রুপে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে সিরাজুল আলম খানের গ্রুপে ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ সমর্থকরা আত্মপ্রকাশ করে। ১৯ জুলাই ১৯৭২, ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ সিরাজ পন্থীরা পল্টন ময়দানে এবং মনি পন্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের আয়োজন করে। দুটি সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি করা হয়। বঙ্গবন্ধু দৃশ্যত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে যোগদান করে একটি পক্ষ অবলম্বন করায় সিরাজুল আলম খান গ্রুপ তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করে ফেলে। ছাত্রলীগের এই বিভক্তি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ সিরাজুল আলম খানের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে সভাপতি, আসম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক ও শাজাহান সিরাজকে যুগ্ম সম্পাদককে করে গঠন করা হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ। ছাত্রলীগও পৃথক হয়ে যায়। মুজিববাদী ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয় বেগম মুজিবের বোনের ছেলে তৎকালীন সরকারি তথ্য কর্মকর্তা শেখ শহীদুল ইসলামকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় এম এ রশীদকে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পন্থী ছাত্রলীগের সভাপতি হন আফম মাহবুবুল হক ও সাধারণ সম্পাদক হন মাহামুদুর রহমান মান্না।


মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতে, ওই সময়ে সংগঠনে বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং যে ভাবমূর্তি তাতে করে তাঁর নেয়া সমঝোতা উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কেন সফলকাম হলো না তা রহস্যাবৃত। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয় মধ্য ফেব্রুয়ারিতে - বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে। দলের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি কে এম ওবায়দুর রহমান প্রথম বক্তা হিসাবে জোড়ালো যুক্তি দিয়ে বলেন,"বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সভাপতি দুই পদেই থাকবেন।" সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী তখন বলেন, বঙ্গবন্ধু আপনি যেখানেই থাকুন - দলের নেতা আপনিই, যদি সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়ে শুধু প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলেও যেমন, তেমনি প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে শুধু দলের সভাপতি থাকলেও সবাই আপনার কাছেই আসবে। মওলানা তর্কবাগীশ যখন দলের সভাপতি ছিলেন, তখনো নেতাকর্মীরা আপনার (সাধারণ সম্পাদক) কাছেই যেতেন। একটি গণতান্ত্রিক ট্রাডিশন সৃষ্টির লক্ষ্যে আপনি দুটির একটি বেছে নিন। সেক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব আপনি সরকার প্রধান থাকবেন। এতে সভায় মিশ্রপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। হঠাৎ পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয় আব্দুল মান্নানের দুঃসাহসিক এক বক্তব্যে। বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আব্দুল মান্নান বলেন, " কাদের সিদ্দিকীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে আপনি বলেছেন, কাদের তুই চারজনকে মেরেছিস, চারশ' লোক মারলেও আমি তোকে কিছুই বলতাম না। প্রকাশ্য সরকার প্রধানের এই বক্তব্যের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা কি করে প্রতিষ্ঠা হবে? উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু এতোটাই উদার ছিলেন যে, সেই টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নানকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেন এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকে করেন তথ্যমন্ত্রী। পরবর্তীতে মিজানুর রহমান চৌধুরী ত্রান মন্ত্রী হন এবং মন্ত্রীত্ব হারান। ১৯৭৫ সালের বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক শুরু হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আলোচনার সূত্রপাত করেন এই বলে "বঙ্গবন্ধু, আপনি সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে যাচ্ছেন সেটা আসলে কি এবং কেনো তা নিজ মুখে বলুন। আপনি যা বলবেন তাই গৃহীত হবে এবং পরে তা আইনে পরিণত করা হবে।" বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, আমি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে আগ্রহী, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাই। যারা আমার বক্তব্য সমর্থন করো, তারা হাত উঠাও।" পলকের মধ্যে সভাস্থলে সবার হাত উঠে গেলো। জেনারেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন ওদিনের বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৫ এর সংসদীয় দলের বৈঠকে জেনারেল ওসমানী একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরোধিতা করে বলেন, "আমরা আইউব খানকে দেখেছি, ইয়াহিয়া খানকে দেখেছি, আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুজিবুর রহমান খান হিসাবে দেখতে চাইনা।" বঙ্গবন্ধু সভা কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর পরই বৈঠক শেষ করেন এবং ডেকে পাঠিয়ে জেনারেল ওসমানীকে বলেন,"Don't be excited my old friend, people are fed up with fiery speeches. They want some revolutionary changes in the social, political and economic system. " বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে খন্দকার মোশতাক একদিন বিকেলে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে তার আগামসি লেনস্থ বাসভবনে যেতে অনুরোধ করেন। মোশতাক তখন বানিজ্য মন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ওয়াজেদ মিয়া খন্দকার মোশতাকের বাসভবনে যেয়ে দেখেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনকে। মঈনুল হোসেন চলে যাবার পর খন্দকার মোশতাক ডঃ ওয়াজেদকে বলেন, "তোমার শশুর যে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেছেন সে সম্মন্ধে তুমি কি কিছু জানো কিংবা শুনেছো কিনা? বঙ্গবন্ধুর এটা করা মারাত্মক ভুল হবে। " এম এ ওয়াজেদ প্রতিত্তোরে বলেন," কাকা আমি স্বাধীনতার পর থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা বলি না। আপনি বরং শেখ মনির সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করুন। খন্দকার মোশতাক তখন বলেন, "মনিকে বলে কিছু হবে না, কারণ সে নিজেই তোমার শশুরের পক্ষাবলম্বন করছে।" একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে তলেতলে সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যারা তাদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক ছাড়াও ছিলেন বাকশাল সরকারেরই তিন প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন অবশ্য একদলীয় শাসন পদ্ধতির পক্ষে ভোট না দিয়ে সংসদ সদস্য পদ হারান। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও নূরে আলম সিদ্দিকী একদলীয় শাসন পদ্ধতির সমালোচনা করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যপ্রবণ ছিলেন বলে পক্ষেই ভোটদান করেন। তবে মিজান চৌধুরীর ভাষ্য মতে, ওদিন থেকেই নূরে আলম সিদ্দিকী হাতে তসবি গোনা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের চার খলিফাখ্যাত ছাত্রনেতার মধ্যে শীর্ষ নামটিই অনলবর্ষী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকীর হাতে আজও তসবি রয়েছে। ২৪ জানুয়ারি ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে শেখ কামালকে বলেন, "আগামীকাল তোর আব্বা রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন, অতএব তোরা রাষ্ট্রপতির বঙ্গভবনে নাকি ধানমন্ডিস্থ এই তোদের বাসায়ই বসবাস করবি " শেখ কামাল জবাবে বলেন, "না, না না, আমরা কোন অবস্থাতেই বঙ্গভবনে যাবো না।" ওই দিন বিকেল পাঁচটার দিকে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ডঃ ওয়াজেদ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে দেখেন খন্দকার মোশতাক গেইট হতে বের হচ্ছেন। ওয়াজেদকে দেখে একটু দূরে নিয়ে ফিসফিস করে মোশতাক বলেন, "আগামীকাল তোমার শশুর সংবিধানের যে পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন সেটা শুধু মারাত্মক ভুলই হবে না, দেশে বিদেশে তাঁর ভাবমূর্তিও অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেতলাতে গিয়ে তোমার শশুরকে বিষয়টি অনুধাবন করানোর চেষ্টা করো। আমি আমার শেষ চেষ্টা করে বিফল মনোরথে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে যাচ্ছি।" ডঃ ওয়াজেদ কিছু বলবেন বলে ঠিক করলেও তা আর হয়ে ওঠেনা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনারত। রাত সাড়ে দশটায় শেখ মনি বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে ঢোকেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়।

২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। যেদিন বঙ্গবন্ধু "দ্বিতীয় বিপ্লব" ঘোষণা করে সংবিধান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনপূর্বক প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সংসদ কক্ষেই রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণের পর স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল সংসদের শীতকালীন অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরস্থ সড়কের বাসভবনে ফিরেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। বঙ্গবন্ধুরই জ্যেষ্ঠ জামাতা ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়ার একটি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা নিয়ে যে ঘরে বাইরে ব্যাপক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু ২৬ জানুয়ারি বিকেলে মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১১ ফেব্রুয়ারী জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিবাদ করে সংসদ সদস্য পদে ইস্তফা দেন। কিন্ত অনেকেই একদলীয় শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করে আসলেও সংসদ সদস্য পদ হারানোর ভয়ে পক্ষেই ভোট দেন। তাদের প্রায় সবাই মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেন। কমরেড মনি সিং এর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি - ন্যাপ বাকশালে যোগ দিলে জাতীয় সংসদের ৮ জন বিরোধী সদস্যের ৪ জন প্রবীণ নেতা অধুনালুপ্ত পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, জাসদের আব্দুস সাত্তার, সৈয়দ কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও মিস্টার খোয়াই বেয়োজরও বাকশালে যোগদান করেন। যাহোক একদলীয় শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেও যারা বাকশালের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই তাদের স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করছি। ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়া একদলীয় শাসন পদ্ধতি নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। যে অসন্তোষ লক্ষ্য করা যায় তাঁর " বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে কিছু ঘটনা" শীর্ষক গ্রন্থটিতে। তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু দেশ বিদেশে একজন জাতীয়তাবাদী গনতন্ত্রী ও প্রগতিশীল মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরূপে পরিচিত। সারা বিশ্বের যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এতো সম্মান মর্যাদা দিয়েছেন, যাদের মধ্যে বিভ্রান্তি শুধু নয়,তাঁর ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হয়ে যাবে। দাতা দেশগুলো সরকারকে যে অর্থ প্রযুক্তি সাহায্যদানে ইতস্ততই শুধু করবে না, বরং এদের কেউ কেউ তা একেবারে বন্ধও করে দিতে পারে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বিকেল পশ্চিম জার্মানির উদ্দেশ্যে ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। অপরদিকে একই বছর ২৯ জুলাই ঢাকা ত্যাগ করেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা (দুইশিশুসন্তানসহ), শেখ রেহানা। তারা বাংলাদেশে ফেরার আগেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এরপর পশ্চিম জার্মানি থেকেই ভারতের দিল্লিতে গমন করেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফেরার আগে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ফিরে যাচ্ছি একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রক্রিয়ার বিষয়ে।

আগেই বলেছি জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুর কথা ভ্রুক্ষেপ না করে একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ থেকে ইস্তফা দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ আগস্ট জেনারেল ওসমানী অবৈধ প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত জিয়াউর রহমানকেও একই দিন প্রেসিডেন্ট মোশতাক সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। এর আগের দিন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলীকে কারারুদ্ধ করেন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। জেনারেল ওসমানী নিশ্চয়ই জেনেশুনে অবৈধ প্রেসিডেন্টের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এতোটাই আনুগত্য ছিল যে, জাতীয় চার নেতা হত্যার খবরে যখন বঙ্গভবনে মোশতাক ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা খালেদ-শাফায়েত বাহিনীর হাতে নাজেহাল হচ্ছিল, তখন তাদের বাঁচাতে এগিয়ে যান জেনারেল ওসমানী। জাতির পিতার হত্যাকারী বাস্টার্ড গালি দিয়ে যখন অভ্যুত্থানকারীরা প্রেসিডেন্ট মোশতাকের দিকে স্টেনগান তাক করেন তখন জেনারেল ওসমানী তাকে রক্ষা করেন। নিহত জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বাধীন মুজিব নগর সরকারেরই অধীনে এমএজি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগলাভ করেছিলেন। আওয়ামী লীগকে বড় করুণ পরিণতি হজম করতে হয়েছে। যেমন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন করে জেনারেল ওসমানীকেই "নৌকা" প্রতীক দিয়ে আওয়ামী লীগের মোকাবিলা করতে হয়েছে। যাক ফিরছি বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন বিষয়ে। এ পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর জামাতা ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে তার আগামসিহ লেনস্থ বাড়িতে দাওয়াত করেন। মোশতাক তখনও বানিজ্যমন্ত্রী। ডঃ ওয়াজেদ বাড়িতে পৌঁছে দেখেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের সঙ্গে আলাপরত। মঈনুল হোসেন চলে যাবার পর মোশতাক ওয়াজেদকে বলেন," তোমার শশুর যে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেছেন সে সম্মন্ধে তুমি কি কিছু জানো কিংবা শুনেছো কিনা? তোমার শশুরের এটা করা মারাত্মক ভুল হবে। "ওয়াজেদ মিয়া প্রতিত্তোরে বলেন," কাকা আমি স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা বলি না। আপনি বরং শেখ মনির সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করুন।" খন্দকার মোশতাক তখন বলেন, "মনিকে বলে কিছু হবে না, কারণ সে নিজেই তোমার শশুরের পক্ষাবলম্বন করছে।" একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে সংগোপনে মোশতাকের সঙ্গে যোগসাজশ গড়ে উঠেছিল বাকশাল মন্ত্রিসভার তিন সদস্য (প্রতিমন্ত্রী) তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, কে এম ওবায়দুর রহমান ও চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের। মোশতাক প্রেসিডেন্ট হবার পর উপরোক্ত চার নেতা তারও প্রতিমন্ত্রী হন এবং জাতীয় চারনেতাকে বাসা থেকে তারাই বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। মোশতাকের মুখের ওপর সরকারে যোগদানের প্রস্তাব ছুঁড়ে মাড়ার কারণে চার নেতাকে কারারুদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর খুনীদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়। ১৯৬৬-১৯৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বপালনকারী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং মুক্তিযুদ্ধের খলিফা খ্যাত চার ছাত্রনেতার মধ্যে শীর্ষে অবস্থানকারী অনলবর্ষী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকী একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি এতোটাই অনুরক্ত ছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত বাকশাল পদ্ধতির পক্ষেই সংসদে ভোট দিয়েছেন। তবে মিজানুর রহমান চৌধুরীর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, "একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের দিন থেকেই নূরে আলম সিদ্দিকী হাতে তসবিহ গুনতে শুরু করেন।" বলা বাহুল্য মিজান চৌধুরী পরলোকে। কিন্তু নূরে আলম সিদ্দিকী আজও হাতে সারাক্ষণ তসবিহ গুনেন। আওয়ামী লীগ (মিজান) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইউসুফ আলী মন্ত্রীত্বের টোপ গিলে বিএনপিতে এবং পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মূল আওয়ামী লীগে ফিরে গেলে নূরে আলম সিদ্দিকী সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে তিনিও মূল আওয়ামী লীগে ফিরে এলেও বর্তমানে নিস্ক্রিয় রয়েছেন। তাঁর পুত্র তাহজিব সিদ্দিকী অবশ্য আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। আওয়ামী লীগ (মিজান) সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দল ছেড়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপ গিলেন। পরবর্তীতে এরশাদের বিরুদ্ধেও পৃথক জাতীয় পার্টি করেন। শেষ বয়সে আওয়ামী লীগে ফেরার কিছুদিন পর ইন্তেকাল করেন। ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড়পুত্র ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। আসাযাওয়া ছিল বঙ্গবন্ধু বাড়িতেও। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন অর্থাৎ সংবিধান চতুর্থ সংশোধন বিল পাস হবার একদিন আগে ২৪ জানুয়ারি(১৯৭৫) বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে শেখ কামালকে বলেন, "আগামীকাল তোর আব্বা প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, অতএব তোরা প্রেসিডেন্টের বঙ্গভবনে নাকি ধানমন্ডিস্থ এই বাড়িতেই থাকবি?" শেখ কামাল বলেছিলেন, "না,না না, আমরা কোন অবস্থাতেই বঙ্গভবনে যাবো না।" ওদিন বিকেলে খন্দকার মোশতাকও একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুর সায় না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ মেজাজ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন মোশতাক। গেইটে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর জামাতা ডঃ ওয়াজেদের সঙ্গে। মোশতাক একটু অদূরে ওয়াজেদকে টেনে নিয়ে বিড়বিড় করে বলছিলেন,"আগামীকাল তোমার শশুর সংবিধানের যে পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন সেটা শুধু ভুলই হবে না, দেশবিদেশে তাঁর ভাবমূর্তি অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেতলায় গিয়ে তোমার শশুরকে বিষয়টি অনুধাবন করানোর চেষ্টা করো। খন্দকার মোশতাক ডঃ ওয়াজেদকে আরও বলেন যে, "আমি আমার শেষ চেষ্টা করে বিফল মনোরথে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে যাচ্ছি।" ডঃ ওয়াজেদ শশুরের সঙ্গে দেখা করে একথা বলবেন ভাবলেও তা আর হয়ে ওঠে না। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এম মনসুর আলীকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে দশটায় বাড়িতে ফিরে শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি কক্ষে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত কথাবার্তা শেষ হলে শেখ মনি তার বাসায় চলে যান। পরদিন ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। সংবিধান চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে দেশে কায়েম হয় একদলীয় রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা। এ আমূল পরিবর্তন বঙ্গবন্ধুর ভাষায় "দ্বিতীয় বিপ্লব।" প্রেসিডেন্টের আদেশে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ - সংক্ষিপ্ত নাম যার বাকশাল। দলে দলে সরকারি বেসরকারি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আবেদন করে সদস্য প্রাপ্তির জন্য। দ্রুত সুফলও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাতে কি! দেশবিদেশের ষড়যন্ত্র থেমে থাকে? মোটেই নয় বরং ষড়যন্ত্র চক্রান্ত আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত যে সত্যাসত্য তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয় গোটা জাতির। খন্দকার মোশতাক আহমেদ একদলীয় শাসনপদ্ধতির বিরোধিতা করেও বাকশালের অন্যতম নীতিনির্ধারক ছিলেন। ছিলেন বানিজ্যমন্ত্রী। সেই মোশতাকই কিনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রেসিডেন্টের মসনদে উপবিষ্ট হলেন। খুনী ফারুক-রশিদদের "সূর্য সন্তান" হিসাবে অভিহিত করে বললেন," অন্য কোন উপায়ে স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে উৎখাত করা সম্ভব ছিল না, বিধায় সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সামনে স্বর্ণ দ্বার খুলে দিয়েছে। অথচ ২০/২৫ জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাসহ গোলন্দাজ ও ট্যাংকবাহিনীর ১৪০০ সৈন্য এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। মোশতাকের চারপাশে জড়ো হলো কয়েকঘন্টা আগেও যারা বঙ্গবন্ধুর মোসাহেবি করেন সেইসব মন্ত্রীরা। বঙ্গবন্ধুর দুই রাষ্ট্রপতির একজন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আট আগস্ট দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন। সেই তিনি খন্দকার মোশতাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। আরেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ কিনা মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হলেন। দুই শিক্ষাবিদ ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক ও ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু যথাক্রমে শিক্ষা ও অর্থমন্ত্রী করেছিলেন, অথচ সেই দুই ব্যক্তিই মোশতাকের মন্ত্রী হয়ে বসলেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মোমিন, মনোরঞ্জন ধর, আসাদুজ্জামান খান, ফণিভূষণ মজুমদার, সোহরাব হোসেন, প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, ডাঃ ক্ষীতিশ চন্দ্র মন্ডল, রিয়াজুদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, মোসলেম উদ্দিন খান ও সৈয়দ আলতাফ হোসেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। শুধুমাত্র ফণিভূষণ মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে মন্ত্রীপদে শপথ পড়ানোর কথা শোনা গেলেও অন্যান্যের মন্ত্রীগ্রহণে কোন জোরজবরি ছিল বলে ইতিহাসের সূত্র সাক্ষ্য দেয় না। বরং কে কোন দফতর পাবেন সে নিয়েও খুনীদের দিয়ে তদবির করেন বলে জানা যায়। উপরোক্তদের মধ্যে কেবল মোসলেম উদ্দিন হাবু মিয়া বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সরকারের মন্ত্রী ছিলেন না। ২৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় মন্ত্রিসভার সর্বসম্মতিক্রমে। মন্ত্রিসভায় চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত ছিলো "জাতীয় টুপি" আইন ঘোষণা। খন্দকার মোশতাক গাঢ় ছাই রঙের কিস্তি টুপিটাই হয়ে গেলো জাতীয় টুপি। তবে তাসের ঘরের মতো মাত্র ৮১ দিনের মাথায় অবৈধ ক্ষমতা মোশতাক সরকারের মাথার ওপর ভেঙে পড়লো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরী শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে মোকাবিলা করতে হয়েছে দেশবিদেশের ষড়যন্ত্র শুধু নয়, নিজ দলের নেতাদেরও নানা চক্রান্তকে। বড় ট্রাজেডি যে, দল পরিচালনা করতে গিয়ে মোশতাক মন্ত্রিসভারও বহু সদস্যকে অনিবার্য কারণে মেনে নিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে যে সুবিচারের প্রশ্ন স্বভাবতই আসতে পারে। যেমন আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠন করে। ইনডেমনিটি বাতিল হওয়ার পর শুরু হয় সাধারণ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া। মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনেকে ইন্তেকাল করলেও বেঁচে ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বডি প্রেসিডিয়ামে ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মোমিন, বিশেষ দূত মহিউদ্দিন আহমেদ। মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীও তখনো আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। উল্লেখিত নেতারা সংসদ সদস্য হলেও শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। এতে নেতাকর্মীদের মনে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয় যে, নীতিগতভাবে মোশতাক মন্ত্রিসভার কাউকে শেখ হাসিনার সরকারে দেখা যাবে না। বর্তমানে মোশতাক মন্ত্রিসভার কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু অনেক ছিলেন যাদের অবস্থান স্বীকার করেই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিচালনা করতে হয়। মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যে ব্যক্তিটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানশেষে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, "বাংলাদেশ ফেরাউনের হাত হতে রক্ষা পেয়েছে", সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল। তাকেও প্রেসিডিয়ামে রেখে শেখ হাসিনাকে পথ চলতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর কাউন্সিলে সেই মালেক উকিলই আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আব্দুল মালেক উকিল পরাজিত হওয়ায় যাকে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়, সেই আসাদুজ্জামান খানও খুনী মোশতাকের মন্ত্রী হন। বিরোধী দলের উপনেতা পদটিতেও যে মহিউদ্দিন আহমেদকে সেই তিনিও মোশতাকের বিশেষ দূত হয়ে মস্কো সফর করেন সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন এনে দিতে। বহুল আলোচিত সমালোচিত "বাকশাল" নামকরণকারী ব্যক্তিটি আর কেউ নন,১৯৭৩ সালে ন্যাপ (মোঃ) ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী এই মহিউদ্দিন আহমেদই। লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।

তদন্ত কমিশন   বঙ্গবন্ধু হত্যা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

আমার চোখে দেখা ১৭ মে, ১৯৮১


Thumbnail

আমি ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেতে এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করার প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরি। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরার পরে তখন আমি একধরনের দোটানায় ছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। যার কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল তিনি নেই। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে আছেন, তারাও দেশে নেই। আমি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমি হাসপাতালে যাই, কাজ করি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা আমার কাছে আসতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ছাত্রলীগ ও বিএমএ’র জুনিয়র ডাক্তারদের সাথেই তখন আমার সময় কাটে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর নেতৃত্বে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আমার বাসায় আসতো। তাদের সাথে কথা বলে অন্তত পক্ষে এটা মনে হতো যে, ঠিকই দেশে ফিরেছি। কিন্তু তারপরও একটা অপূর্ণতার ভাব ছিল। 

শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় এবং ১৭ মে তিনি দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন দেশের ভেতরে বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় যা শুনতাম তাতে আমার নিজের মনে হতো, তিনি বোধহয় দেশে না আসলেই ভালো হতো। কারণ, আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তখন উৎপন্ন হয়েছিল। আর এই ধারণাটি ছিল, আসার সাথে সাথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে! তাই ভাবলাম অন্তত বিদেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বেঁচে থাকুক এটাই বড় কথা। কিসের রাজনীতি, কিসের কি? বঙ্গবন্ধু নেই। সত্যিকার অর্থে বলা চলে আমি একপ্রকার রাজনীতিবিমুখ ছিলাম তখন।
 
তারপর যখন ১৭ মে আসলো তখন আমি ভাবলাম, এয়ারপোর্টে যাই। এয়ারপোর্টে আমাকে একজন বুদ্ধি দিল, একটু দূরে গাড়ি রেখে হেটে যাওয়ার জন্য। আমি তাই করলাম। তখন প্রথমদিকে খুব বেশি লোকজন নজরে পড়েনি। কিন্তু যখন বিমান নামলো এবং নেত্রী শেখ হাসিনা বিমান থেকে নামলেন তখন চতুর্দিকে হঠাৎ দেখি লক্ষ লক্ষ লোক। আমার তখন চোখ দিয়ে তখন পানি। এখনও তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের প্রতি ভালোবাসা মানুষের যায়নি। 

এর আগে আমার মনে হতো যে, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আর স্বপ্ন দেখতে যদি কেউ ভুলে যায় তাহলে সে মানুষের বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমার সত্যিকার মানসিক অবস্থা তখন এমনই স্বপ্নহীন ছিল। স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন ভালোবাসা দেখে আমার তখন মনে হলো এই বুঝি আবার জীবিত হলাম। তখনও শেখ হাসিনার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি। কারণ সেই সময় তাঁর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। 

মানুষের ভিতরে যে ভাবাবেগ তা পরদিন মানুষের সঙ্গে মিশে বুঝলাম। তখন একটা সুক্ষ্ম মিল আমি খুঁজে পেলাম। তাহলো, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসেন, তখন আমরা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জনগণ যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, আমাদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণতা পেল। ঠিক তেমনি একটা ভাব আমার মনে হল। তখন মাত্র শেখ হাসিনা এসেছেন। শুধুমাত্র তাকে দেখার ফলে জনগণের মধ্যে একটা উজ্জ্বীবিত ভাব এলো। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতারা এদের সবার ভেতরে একটি গণজোয়ারের ভাব লক্ষ্য করা গেল। 

এত বছর পরে আজ আমি বলছি, সেদিন আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এই শেখ হাসিনা নেত্রী শেখ হাসিনা হবেন, দার্শনিক শেখ হাসিনাতে রূপান্তরিত হবেন। এবং তাঁর দর্শন দ্বারা বাংলাদেশে সোনার বাংলা হিসেবে গঠন করতে পারবে। সেদিন আমার মধ্যে আবেগ ছিলোৎ কিন্তু এই চিন্তাগুলো ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে তিনি কীভাবে দেশ গড়েছে তা সমস্ত লোকই জানে। সেই ১৭ মে যে জনসাধারণ তাকে একটু দেখবার জন্য গিয়েছিল, তাদের মনের ভাষা, মুখের ভাব এসব যদি অনুভব করা যায় তাহলে বোঝা যায়, সত্যি বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে সেদিন প্রবেশ করেছিল। এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শীতা এবং দার্শনিক ভিত্তির কারণে জনগণের আশা আকাঙ্খাকে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং বাংলাদেশকে আজ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার দারপ্রান্তে। 

সেই ১৭ মে’র কথা যদি চিন্তা করি, তখন অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে এতোদূর পর্যন্ত দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবে তা চিন্তা করিনি। এখন যেমন তিনি সমস্ত বিশ্বে নন্দিত বিশ্বনেতা। সেই তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সেই ১৭ মে’র কথা আজকে মনে পড়ে। আমি প্রার্থনা করি দার্শনিক শেখ হাসিনাকে যেন সৃষ্টিকর্তা ভালো রাখেন এবং দেশ গড়ার সুযোগ যেন তিনি অনেকদিন পান।  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রত্যাবর্তনের পর সেদিন তিনি যা বলেন


Thumbnail

কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও  তিনি কাঁদছিলেন।  

প্রকৃতিও সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল।  পৌনে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতি তাঁর কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। কুর্মিটোলা থেকে তিনি যান বনানী গোরস্থানে। সেখানে যেয়ে আবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বনানী থেকে তিনি যান শেরে বাংলা নগরে। সেখানে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ জনতা অপেক্ষা করছিল। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বক্তব্য রাখেন।

কি বলেছিলেন তিনি লাখ লাখ জনতার সমাবেশে? হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া ফলাও করে এসব খবর সেদিন কোন পত্রিকা বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। ৪৩ বছর আগের সে সব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াও আজ কষ্টসাধ্য। সেদিনের ভাষণের যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।  

আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই বোন, আরো অনেক প্রিয়জন।  ভাই রাসেল, আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আমি আপনাদের কাছে এসেছি।

বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা নেতা হবার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসাবে, মেয়ে হিসাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসাবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।

আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলার মানুষের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার পরিজন হত্যা করে বলেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমানো ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কি? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দিনে দুপুরে মানুষ খুন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে।  সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না, আর একশ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে।

ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃংখলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তবে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকতো না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তববায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি; আপনাদের ভালবাসা নিয়ে, পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। আপনারা আমার সাথে শপথ করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।  

স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি।

আপনাদের ভালবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।

(তথ্যসূত্র: সংবাদপত্রে শেখ হাসিনার বক্তৃতা: ১৯৮১-১৯৮৬; প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩)


প্রত্যাবর্তন   আওয়ামী লীগ   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে জিয়ার অপতৎপরতা


Thumbnail

আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল।বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।

ওই লিফলেটে আরো লেখা ছিল: “আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তি সংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে।...তিনি আমাদের কর্ম চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।

প্রচারপত্রে আরও বলা হয়েছিল: “...ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।...আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশাজনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে প্রত্যাবর্তন। বাঙালী জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বস্তিতে ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কায় সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শঙ্কিত বোধ করছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরূদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির এক সভায় শেখ হাসিনাকে বিদেশি শক্তির তল্পিবাহক বলে অভিহিত করা হয়। একই দিনে আরেকটি সভা থেকে বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, বাকশালিরা ভারতের গোলাম। তারা বিদেশি সৈন্যের সহায়তায় ক্ষমতায় বসতে চায়। যে দলের প্রধান দিল্লিতে, সে দল জনগণের কল্যান করতে পারে না। সাতাশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুনী মুশতাক গংদের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে বলা হয়েছিল, ইন্দিরার নীলনকশা এখন বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, “৭৫ এর পর তারা দিল্লি লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচেষ্টা চালায়। লন্ডনে জমে ওঠে দিল্লির সেবাদাসদের আড্ডা। তারাই আজ বাকশালী কমিটির ছত্রচ্ছায়ায় দেশে ফিরছে। সমস্ত কিছু ঠিক করে হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।

সে সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের খবরে সে সময়কার জিয়া সরকারের ভিতরে উদ্বিগ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে গিয়েছিল ; আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান)- ওরকমভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর আর্দশের কর্মীরা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেমন একটি সময় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়াকে তৎকালীন জিয়া সরকার মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে তাইশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনকরা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালিন জাতীয় সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না

বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেনশেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।পরদিন মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনজননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জানিয়ে দেন তাঁকে যদি হত্যা করার চেষ্টাও করা হয় তাহলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন গণআকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করেশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনশেখ হাসিনা আসার আগেই তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।

দীর্ঘ 'বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলে লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে তাদের নেত্রীকে বরণ করে নেন। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকেই শহরজুড়ে কেবলি মিছিল আর মিছিল। সেদিন শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা জানাতে ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের ঢাকা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বন্দীশালা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন, সেদিনটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা।  বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।

কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান অবতরণ করবে সেদিকে নজর রেখে লক্ষাধিক মানুষ মধ্যাহ্ন থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকেই বিমানবন্দরে কোন নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। হাজার হাজার মানুষ ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে নিয়োজিত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে প্রথমে দেয়ালের উপর ওঠে। একই সময়ে বিমানবন্দর ভবনের দোতলায় কন্ট্রোল টাওয়ারের যেখানে স্থান করা সম্ভব সেখানেই জনতা উঠে যায়। সবারই উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখা। পুলিশ বারবার চেষ্টা করেও তাদের সরাতে পারে নি। বিমানবন্দরের বাইরে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

সাদা-কালো রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যখন ৪টা ৩২ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে সজ্জিত ট্রাকে নামছিলেন; তখন লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই– 'শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব', 'শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা' 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' বিমান থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত হাসিনাকে নিয়ে আসতে ট্রাকটির ১৫ মিনিট সময় লাগে। সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়। পরিবেশ উচ্ছ্বাসের, পরিবেশ আনন্দে অশ্রু ফেলার। বিমান থেকে নামার আগে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক যখন শেখ হাসিনার গলায় মালা দিচ্ছেলেন, তখন তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা আসার পথেও শেখ হাসিনা পাঁচ-ছয়বার অঝোরে কেঁদেছিলেন।

বিকেল চারটার দিকেই আকাশে কালো মেঘ ছিল। পৌনে পাঁচটায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে মিছির শুরু হবার পরপরই চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। রাত আটটা পর্যন্ত সেদিন মুষলধারে বিরতীহীন বৃষ্টি ঝরেছিল। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেইসাথে তীব্র ঝড়। প্রকৃতি ভয়াল রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। এরই মাঝে ট্রাকে রাস্তার দুপাশের জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান। বর্ষণসিক্ত শেখ হাসিনা ঝড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে যাচ্ছিলেন বনানী হয়ে শেরেবাংলানগরের সভাস্থলে। বনানী গোরস্থানে শেখ হাসিনার মা নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি কান্নায় আকুল ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কবরে শায়িত মাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, আমাকে কেন রেখে গেলে?’

কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত আট মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগার কথা খুব বেশি হলে ত্রিশ মিনিট। প্রায় তিনঘন্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরের সভাস্থলে পৌছিয়েছিলেন। তখনও চারদিক অন্ধকার, মুষলধারে বৃষ্টি। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন তখন প্রায় বিপন্ন, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সভাস্থলে তখনো লক্ষ লক্ষ লোক উপস্থিত।  শেখ হাসিনাকে তারা দেখবেনই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসম্বর্ধনা সভার মঞ্চে এলেন।

লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সমাবেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।"

বক্তৃতাদানের এক পর্যায়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, "আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।"

বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা পাথেয় করে আমি আগামীদিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করে দেবো।

১৭ মে রাতে শেখ হাসিনা ছোট ফুপুর বাসায় ছিলেন। সেই সময়েও শেখ হাসিনাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। বাধ্য হয়েই তিনি তখন কিছুদিন ছোট ফুপুর বাসায়, কিছুদিন মেঝো ফুপুর বাসায় থাকতেন। দেশে ফিরে তিনি ধানমন্ডিতে নিজেদের বাসায় গেলে সেখানে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া মিলাদ পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ধানমন্ডির বাসাটা সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যকেই বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।

১৮ মে সকালে শেখ হাসিনা দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন এবং পরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্জন করেন। ওইদনই বিকেলে তিনি পিতা শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তিনি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বাড়ির গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্রন্দনরত শেখ হাসিনাকে অনেকে সান্ত্বনা দেন। তিনি সেখানে সমাধিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের  মাজার  জিয়ারত করেন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

২০ মে গোপালগঞ্জের ঈদগাঁ ময়দানে মেখ হাসিনার সম্মানার্থে এক গণসম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল।   সেই সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংষার করছিলাম। আপনাদের ডাকে সবকিছু ছেড়ে এসেছি। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার জীবর দান করতে চাই।তিনি আরো বলেছিলেন, “গত ছয় বছরে দেশের মানুষের কোনরকম উন্নতি তো আমি দেখি নি। মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কৃষক-শ্রমিক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য পাচ্ছে না।তিনি উত্তাল জসমুদ্রের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, “তবে কেন বঙ্গবন্থু, শেখ মনি চার নেতাকে হত্যা করা হলো?”

লেখক: . আবুল হাসনাৎ মিল্টন: সভাপতি, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাৎপর্যপূর্ণ


Thumbnail

আজ ১৭ মে, প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৪৩তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা খুনিদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।

পশ্চিম জার্মানি থেকে সেই সময় ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন শেখ হাসিনার স্বামী পরমানু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া। ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লি পৌছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান।

বিমানন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। সেখানে কারো সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরিচয় না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাদের। সেই সময় ভারতীয় পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোন খবরাখবর ছাপা হচ্ছিল না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একরকম অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। দিল্লিতে পৌছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানে শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের পুরো ঘটনা জানতে পারেন।

১৯৭৯ ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে। আব্দুর রাজ্জাক কাবুলে যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং যুবনেতা আমির হোসেন আমু দিল্লিতে যান। তাদের সবার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিতে রাজি করানো।

পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ১৬ ফেব্রয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ ২৪ ফেব্রæয়ারি আব্দুল মালেক উকিল, . কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ঢাকা থেকে দিল্লিতে পৌছান। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করেন তারা।

দেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে রাতে দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তখনকার রাজনীতির মতোই প্রকৃতিও সেদিন ছিল ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ছিল কালবৈশাখী হাওয়া, বেগ ছিল ঘন্টায় ৬৫ মাইল। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও সেদিন গতিরোঘ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল।

মুষলধারে বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন নেত্রী কখন আসবেন এই প্রতীক্ষায়। অবশেষে বিকাল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জনসমুদ্রের জোয়ারে এসে পৌছান শেখ হাসিনা। তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।

তখন স্বাধীনতার অমর শ্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনীতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কন্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল-পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।

আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল-সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।

তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। তিনি আরো বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত¡ থেকে বঞ্চিত হয়। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার; বঙ্গবন্ধু হত্যা জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হৃত গণতান্ত্রীক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মানবতার জননী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে; যা মোটেও সহজ কাজ নয়। এসব একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সম্ভব হচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন, দারিদ্রসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি পরিশ্রমের ফসল। এরই মধ্যে উদ্বোধন হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র, বহুল কাঙ্খিত পদ্মা সেতু এবং ঢাকা মেট্রোরেল। এছাড়া চলমান রয়েছে দেশের মেগা সব প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে আসুন আমরা দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যা হবে জাতির জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণের একমাত্র পথ।

১৯৮১ সালের ১৭ মে তার দুঃসাহদী সিদ্ধান্তের কারণেই আওয়ামী লীগ আজ দল হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত বছর সরকারপ্রধান হতে পারেননি। এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। দলটি আজ তার নেতৃত্বে সামরিক শাসনের স্মৃতি পেছনে ফেলে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। তার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে, জাতি হিসেবে বাঙালিকে এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়।


শেখ হাসিনা   স্বদেশ প্রত্যাবর্তন   সমৃদ্ধ বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার তাৎপর্যময় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন


Thumbnail

১৭ মে বাঙালি জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। তবে শুধু স্মরণীয় বললে হয়ত তার তাৎপর্য ম্লান হতে বাধ্য। ১৯৮১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৬ বছর পর শেখ হাসিনা বাধ্যতামূলক নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ২০০৭ সালে ৭ মে স্বল্প-সময়ের বিদেশ বাসের পর বহু বাধা বিঘ্ন ঠেলে তিনি দেশে ফিরে আসেন; যদিও ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে না আসলে ২০০৭ সালের ৭ মে অপ্রাসঙ্গিক হতো।

এই দুটি উপলক্ষ ছাড়া বহুবার তিনি বিদেশ গিয়েছেন, আবার ফিরেছেন। তবে ঐ দুটি তারিখে তিনি দেশে না আসলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানটি মুসলিমলীগের ন্যায় হয়ত টিম টিম করে বেঁচে থাকত; যার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ হারিয়ে যেত। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশন সম্ভব না হলেও দেশটি একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হতো। রাজাকাররা চিরস্থায়ী রাজা বাদশাহ হয়ে সবার শিরে চেপে বসত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হোত, মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ তিব্বতের দালাইলামার সম-অনুসারী কাঞ্চা ও কাঞ্চিতে রূপান্তরিত হতো। দেশে থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে খুন করা হতো। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকতনা। ক্রমশ: প্রতিটি মানুষ ইসলামাবাদের গোলামে পরিনত হতো, ধর্মের ধ্বজাধারীগণ দেশটা কে চষে বেড়াত, বাংলাভাষা ও জাতি বিলুপ্তির পথে যেত।

দেশে প্রত্যাবর্তনের পর দীর্ঘ সময় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন না। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের উপর এতটা চাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষরা সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন এনে দেশটাকে ইসলামী রিপাবলিকের দিকে ঠেলে দিতে পারেনি। তিনি ফিরে না এলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যেত। আমাদের দেশটা হতো একান্তই সাম্প্রদায়িক দেশ।

শেখ হাসিনা ফিরে না আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান শান্তিটুকুও প্রতিষ্ঠিত হোত না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন হওয়া ছিল অকল্পনীয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা হোত দা-কুড়ালের। আজকে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমরা ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছি। বিশ্বের বুকে একটা মর্যাদাবান জাতি হিসাবে আবির্ভূত হবার কিংবা মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের দিন গনিয়ে আসত না।

আবারও বলছি শেখ হাসিনা দেশে না ফিরলে আওয়ামী লীগের ভাগ্য হোত মুসলিম লীগের ভাগ্য। আর অন্যান্য সব কিছুর আকর হোত এই ক্ষমতাহীনতা। বিষয়টা একটু বিশ্লেষণ করছি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সব রাজনৈতিক দল বিলোপ করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালের ১ আগষ্ট থেকে দেশে ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়। সেই আগষ্টে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনে প্রয়াস নেয়া হয় এবং সাথে শুরু হয় দলীয় উচ্চাসন নিয়ে কামড়া কামড়ি। দলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই জেলে। সে সময় প্রয়োজন ছিল ঐক্যের কিন্তু তখনই দলের শীর্ষ পদ দখলের উলঙ্গ প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়। মোল্লা জালাল ও মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত আহ্বায়ক কমিটি আপোষকামিতা ও তৃণ মূলে অগ্রহণযোগ্যতার কারণে তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ১৯৭৭ সালের ৩রা এপ্রিলের কাউন্সিল অধিবেশনে তদ্রুপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলেও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে একটা দায় সারা গোছের কমিটি করা হয়। তিনি এক বছরও নেতৃত্বে থাকতে পারেন নি। ১৯৭৮ সালের ৩রা মার্চ পূর্বের ন্যায় নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতে মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পুনরায় কাউন্সিলে পূর্ববত অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এবারেও যখন জোড়াতালি দিয়ে কমিটি গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে ও দল ছিন্ন ভিন্ন হবার উপক্রম হয় তখন সাধারণ কর্মীরা শেখ হাসিনার নামে শ্লোগান দিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনাকে দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করে। সেদিন তাকে সভাপতি নির্বাচিত না করলে দল বহুধা বিভক্ত হোত, কেউ মিজান আওয়ামীলীগ, কেউ বাকশাল কিংবা কেউ বা বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে ও তার উত্তরাধিকারীত্ব দাবী করে বহু নামের আওয়ামী লীগ গঠন করে দালালী বলবত রেখে আত্ম—তরক্কি করতে পারত। সেনা আশ্রিত দলে পরোক্ষভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে আশ্্রয় নিতে নিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি নি:শেষ হয়ে যেত। দেশটাতে এমন সেনাশাসন চিরায়ত হয়ে যেত।

শেখ হাসিনা দেশে আসার কারণে তার দল অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পাঁচ পাঁচবার ক্ষমতায় এসেছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্প্রসারিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসায় যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে উল্লাসিত হয়েছিল তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস—চ্যান্সেলর, প্রো—ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার হয়েছে, ব্যাংক বীমার চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টর হয়েছে, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হয়েছে। আরও কত কি? ব্যক্তির পর্যায় ছাড়িয়ে সামষ্ঠিক পর্যায়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি নব মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে।


বিষয়গুলোর একটু গভীরে যাচ্ছি:

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার:

নির্বাসিত জীবন থেকে দলীয় নেতাদের বিশেষ অনুরোধে ও কর্তব্যবোধে তাড়িত হয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এলেন। দেশে ফেরার দিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি ছিল। দুর্যোগ উপেক্ষা করেও বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ তাদের মহান নেতার কন্যাকে দেখতে ও স্বাগত জানাতে ভীড় জমালেন। দেশে ফিরে আসার আগেই তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।

দেশে প্রত্যাবর্তনের ৬ বছরের মাথায় অর্থর্াৎ ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মত নির্বাচিত হলেন ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসলেন। জনস্বার্থ বিবেচনা করে তিনি ১৯৮৮ সালে পদত্যাগও করেন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করা হয়, তিনি সেই জোটের প্রধান ছিলেন। এরশাদ শাসনামলে তিনি বেশ কয়েকবার গৃহবন্দি ছিলেন। শারীরিক আক্রমণের শিকারও হয়েছিলেন। তবুও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯০ সালে ১৫ দলের নেত্রী শেখ হাসিনার প্রচণ্ড গণআন্দোলনে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তার জনপ্রিয়তা ও অনমনীয়তার কারণে সবাই ধরে নিয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন। শতাংশের হারে বেশি ভোট পেয়েও সুক্ষ্ণ কারচুপির কারণে তিনি বিএনপি অপেক্ষা কম সিট পেলেন; যে কারণে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর আকর্ষণীয় পদটি থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। জাতি বঞ্চিত হল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নেতৃত্ব থেকে এবং তার মূল্যও জাতিকে দিতে হলো বহুভাবে। তারপর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন।

জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবার পর শেখ হাসিনা জনমঙ্গল নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অংশ হিসাবে সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত ও পুনর্গঠিত করেন। এ’সব কমিটিতে মন্ত্রীর পরিবর্তে কোন সাংসদকেই চেয়ারম্যান করা হয়ে থাকে।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রশাসন ও নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ফলে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ হ্রাস পেয়েছে ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার:

শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে না আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়—মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হতো। বিচারের প্রক্রিয়াটি ১৯৯১ সালে পুনরায় শুরু হয়। ঘাতক দালাল নিমূর্ল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহবায়িকা ও সদস্য—সচিব নির্বাচনে শেখ হাসিনার সক্রিয় সমর্থন ছিল। আন্দোলনে শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ প্রধান শরিক সংগঠন হিসেবে যোগ দেয়। আন্দোলনকারী শক্তিসমূহ বিশেষতঃ বুদ্ধিজীবীগণ অফুরন্ত অনুপ্রেরণা লাভ করে। শেখ হাসিনা না থাকলে জামায়াতের ন্যায় ক্যাডার ভিত্তিক সশস্ত্র ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই কঠিন ছিল। ১৯৯২ সালেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০১ জন সংসদ সদস্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তা স্পীকারের কাছে পেশ করেন। তার আন্দোলনের ফলশ্রম্নতিতে গণ আদালতের ২৪ জন তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহীর মুক্তি এবং গোলাম আজমের বিচার সহ ৪ দফা প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয়।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি অনতি বিলম্বে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচারের সকল সাংবিধানিক বাধা দূর করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একে একে অভিযুক্তদের বিচার শুরু করেন। আজ পর্যন্ত ১০ জন শীর্ষ মানবতা বিরোধীসহ অনেকের বিচার কাজ একাধিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল প্রায় সকলকেই আদালত মৃত্যু দন্ডাদেশ দিয়েছে, কেউ কেউ কারাবন্ধি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি:

তাঁর প্রথমবারের সরকারের বিশাল অর্জন হচ্ছে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তি এবং সন্তুলারমার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন। এ’গুলো ছিল অনেক পুরানো সমস্যা। পানি সমস্যা পাকিস্তান আমলের আর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রায় ২৪ বছরের পুরানো ছিল। আত্নঘাতি ও ভ্রাতৃঘাতি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছে; স্বাধীনতা—সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছিল এবং বহির্বিশ্বে মানবিক ও অসা¤প্রদায়িক বাঙালির ভাবমূর্তিকে চুরমার করে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সংকট সৃষ্টি করেছিল। শেখ হাসিনা তার কৌশলী নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে এই অঞ্চলকে দেশের মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্তকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। গঙ্গার পানি চুক্তি ও পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্তসহ প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়েছে। শান্তি চুক্তির পাশাপাশি ছিটমহল সমস্যা ও সমুদ্র সীমা সমস্যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও দেশের আয়তন বৃদ্ধি করেছে। আমরা ব্লূ—ইকোনোমির স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পেয়েছি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার:

তার আমলের অপর একটি অর্জন হচ্ছে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল যা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের পথ সুগম করেছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ঘাতকদের বিচার না করে প্রচলিত আদালতেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু ২০০২ সালে বি এন পি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এই বিচারের রায় কার্যকরী না করলেও শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে তা কার্যকরী করেন। জাতির প্রত্যাশা মোতাবেক শেখ হাসিনা বিশেষ আদালতে নিষ্পত্তি না করে প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে বিচার কার্য শেষ করে দূরদর্শিতা নয়, রাষ্ট্র নায়ক সুলভ আচরণের প্রমাণ আরও একবার রাখলেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না আসলে দেশটা হতো মিনি পাকিস্তান। ভাষা—সংস্কৃতি যেত তলিয়ে। শুধু ভাষা সংস্কৃতি রক্ষা নয়, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে জাতিসংঘের ঘোষণা আদায়ও তাঁর অনন্য কৃতিত্ব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা তার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল কিন্তু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার কারণে তার পূর্ণাঙ্গতা দেয়া সম্ভব হয়নি।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও সোহ্রাওয়াদীর্ উদ্যানে স্বাধীনতা স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে। বাঙালির মনন বাংলা একাডেমির কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়াও আত্মিক পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রথম বারের জন্যে বাংলা একাডেমির জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়েছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন:

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা ধরে কাজ শুরু করেছিল। বিশ্বকে পেছনে ফেলে সহস্রাব্দ উন্নয়নের সবক’টি লক্ষ্য মাত্রা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাংলাদেশ অর্জন করেছে। ম্যাক্রো —মাইক্রো অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় অনন্য দক্ষতা দিয়ে তিনি প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রেখেছেন। নিম্নের সারনীতে অর্থনৈতিক চাল—চিত্রের সামান্য পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে ঃ

শিরোনাম

2005-06

2017-18

2022-2023

২০২৪ এর প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রা

জিডিপি প্রবৃদ্ধি

5.40%

7.86%

7.50%

7.97%

মাথাপিছু আয় (মার্কিন ডলারে)

427.00

1751.00

2793

2750.00

জাতীয় সঞ্চয় (জিডিপির শতাংশে)

27.70

29.00

31.00

37.00

বিনিয়োগ (জিডিপির শতাংশে)

24.70

30.50

32.00

37.00

বাজেট (কোটি টাকায়)

64,683.00

4,64,000.00

-

10,00,000.00

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

3.88

34.00

35.00

50.00

রপ্তানী আয় (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

10.05

36.60

55.56

72.00

আমদানি (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

14.70

56.00

-

110.00

দরিদ্র জনংখ্যা (শতকরা হারে)

41.51

21.50

18.13

12.30

অতি দরিদ্র জনসংখ্যা (শতকরা হারে)

25.10

11.30

5.6

4.50

বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা (মেগাওয়াটে)

3,782.00

20,400.00

27500.00

28,000.00

 

সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তার:

দুঃস্থ মানুষের মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দিতে তার সরকার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বহু নির্মাণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। একটি বাড়ি, একটি খামার এক অনন্য কর্মসূচি। বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্যে কর্মসংস্থান ব্যাংক তাদের লেনদেন কাজ শুরু করেছে। বন্যা ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্ম অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করে শেখ হাসিনা দেশি ও বিদেশিদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার প্রথম শাসনামলে যেখানে বিদেশি পত্রিকার পূর্বাভাস ছিল যে আকস্মিক বন্যায় দু’কোটি মানুষ মারা যাবে, সেখানে মালের ক্ষতি মাত্রাতিরিক্ত হলেও মানুষ মরেছে ২ হাজারেরও অনেক কম, তাও কয়জন না খেয়ে মরেছে সে তথ্য বিরোধী পক্ষও উপস্থাপন করতে পারেনি। তিনি দেশে না এলে কি এমনটি হতো?

সামাজিক মঙ্গল:

তাঁর শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে তা পূর্বে কোন আমলে এমনটি হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ ও দুর্ভোগ, স্বদেশের হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, জ্বালাও—পোড়াও এর মধ্যেও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, মানুষের গড় আয়ু ৭৩ —এ ছুঁই ছুঁই করছে, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে প্রতিবেশী ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে, সুপেয় পানীয় জল সরবরাহে ঈর্ষান্বিত সফলতা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যে ভেজাল নিরোধ প্রয়াস ও চিকিৎসা ব্যবস্থা জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছিয়ে দেয়ার কারণে এমনটি অর্জন করেছে। তেমনি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে অন্যান্য ক্ষেত্রে, যার মাঝে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী বাহিনী প্রেরণ অন্যতম।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা:

শেখ হাসিনার প্রথমামলের সরকার ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছিল। সেই কবে ম্যালথাস নামক একজন ধর্মযাজক বলেছিলেন যে, ‘জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে’। আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলাম স্কুল জীবনে এবং এক জাতীয় হতাশা ও নৈরাশ্য আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমার ছেলে বেলায় বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটির মত; আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এখন যা আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি। তখন জন্মের হার ছিল বেশি, শিশু মৃত্যুর হার ছিল বেশী, ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল অনেক কম। বর্তমানে জনসংখ্যা বেড়েছে সেদিনের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ। আবাদী জমির পরিমাণ বিবিধ কারণে অন্ততঃ এক—তৃতীয়াংশ কমেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ৪০ লক্ষ টন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দুটো বন্যা হয়েছে।

পরবর্তীতে দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি উত্তর বঙ্গের মঙ্গা বিতারণ কর্মসূচিকে বেগবান করা হয়। বর্তমানে মঙ্গা ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে পাটের জীবন—বৃত্তান্ত উৎঘাটিত হয়েছে। বিভিন্ন রকমের উচ্চ ফলনশীল ও দ্রুত ফলনশীল খাদ্যের উদ্ভাবন ঘটিয়ে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। একটি বাড়ী — একটি খামার কর্মসূচির পূর্ণসূচনার কারণে এবং ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বন্টন কর্মসূচি খাদ্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। 

ডিজিটাল বাংলাদেশ:

কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দেবেন কিন্তু ২০১৩ সালের মধ্যে সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সব জেলায় ই—সার্ভিস সেন্টার চালু হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল স্বাস্থ্য—সেবা, ই—কমার্স ও ই—গভর্নেন্স উল্লেখযোগ্য হারে চালু হয়েছে। তিন কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছে। আর মোবাইলে থ্রি—জি সেবা চালু করা হয়েছে। এখন আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ; যার রূপায়ন ক্রমশ: দৃশ্যমান হচ্ছে।

শেষ কথা:

শেখ হাসিনা আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। তিনি দেশে ফিরে না এলে তার তেমন কোন ক্ষতি ছিল না। দেশে না ফিরলে তার ব্যক্তি জীবন ও সন্তানদের জীবন মোটামুটি সচ্ছলভাবে চলে যেত। দেশে ফিরে এসে তিনি নিজের জীবন ও সন্তানদের জীবনকে সংকটাপন্ন করেছেন। সংকটাপন্ন করেছেন বোনের জীবন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমন নেতা আছেন কিনা যিনি ২৩ বার হামলার শিকার হয়েও বেঁচে আছেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আল্লাহতায়ালা বঙ্গবন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের গোলামী জিঞ্জির ভাঙার জন্যে আর শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশকে কোন উচ্চতর মাত্রায় পৌছে দিতে।

 

লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন