ইনসাইড থট

ছাত্রলীগ প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারী অধিকাংশই বিপরীত স্রোতে!

প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ০৩ জানুয়ারী, ২০২৩


Thumbnail

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে যেসব অবিস্মরণীয় অবদান সমৃদ্ধ করেছে এবং করেছে গৌরবোজ্জ্বল- সেই মহান    স্বাধীনতার পতাকা, স্বাধীনতার ইশতেহার, জাতীয় সঙ্গীত, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা উপাধী সবই যে  ছাত্রলীগের উপহার। যে সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক মুসলিম হলের মিলনায়তন কক্ষে। নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে।পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগনামে জন্ম নেয়ার পরই ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের ভাষা রক্ষার দাবিতে। এক রক্তাক্ত অনবদ্য ইতিহাস রচনা করে ভাষা সংগ্রাম পরিষদে নেতৃত্ব দিয়ে - নাম লিখিয়ে নেয় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন আর একুশে ফেব্রুয়ারির অমর কাব্যগাঁথায়। 

অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী অবিভক্ত বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কর্ণধার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কলকাতা ফেরত অনুগত সমর্থক-কর্মীরাই মূলত পূর্বপাকিস্তানে ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটান। যে সংগঠনের মূলে প্রাণপ্রদীপ হয়ে ওঠেন মুজিবুর রহমান। পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সমর্থনপুষ্ট ছাত্রসংগঠন নিখিল পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের   বিপরীতে এটাই ছিল মূলত প্রথম কোন রাজনৈতিক সংগঠন।

পুরান ঢাকার ১৫০ মোগলটুলীমুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প ছিল পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কার্যালয়।   

পরবর্তীতে ছাত্রলীগ নেতারাই সোহরাওয়ার্দীর পরিকল্পনায় এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। যে কারণে ছাত্রলীগকে বলা হয় আওয়ামী লীগের মাতৃ সংগঠন। ভাষা স্বাধীনতার পতাকাবাহী সংগঠন রূপেও পরিচিতি রয়েছে সংগঠনটির। এই ছাত্রসংগঠনের হাত ধরেই বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের শুরু এবং সাফল্য। 

চুয়ান্নোর নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির বাঙালি মুক্তির সনদ ছয় দফা, উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা অর্জনের মূলচালিকা শক্তিরূপে অবিস্মরণীয় ভুমিকা রাখে। স্বাধীনত্তোর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, নব্বই ছিয়ানব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন হিসেবেও ছাত্রলীগের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। রাজশাহীর নঈমউদ্দীন আহমেদকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্য বিশিষ্টআহবায়ক কমিটিগঠনের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ।

শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও সদস্য হিসেবে ছিলেন বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধরী, কুমিল্লার অলি আহাদ, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ,পাবনার আব্দুল মতিন, দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, রংপুরের মফিজুর রহমান, খুলনার শেখ আব্দুল আজিজ, ঢাকার নওয়াব আলী, ঢাকা সিটির নুরুল কবির, কুষ্টিয়ার আব্দুল আজিজ, ময়মনসিংহের সৈয়দ নুরুল আলম, চট্টগ্রামের আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী। 

উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা কেউ বেঁচে নেই। ১৫ জন সদস্যের মধ্যে  ছাত্রলীগের মূল প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কেবল হত্যার শিকার হন। বাকীদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ বেঁচে ছিলেন শেখ আব্দুল আজিজ। তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামেও যুক্ত ছিলেন। শেখ আবদুল আজিজ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যই শুধু নন, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগেরও প্রথম সভাপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কারাবরণ করেন মোশতাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে।

কুমিল্লার অলি আহাদ চলে গেছেন পরলোকে। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক আব্দুর রহমান বহিস্কৃত হন। শূন্য পদে আসীন করা হয় অলি আহাদকে। প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক কোরবান আলীকে সরিয়ে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে। নতুন সাংগঠনিক সম্পাদক হন অলি আহাদ। তিনি দ্রুত সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী হয়ে ওঠেন। শেখ মুজিবের একই সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রিত্ব গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলে দলে উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি করেন। শেখ মুজিব মন্ত্রীত্ব ছেড়ে সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকলে বিতর্কের অবসান ঘটে। পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্বে প্রদেশে আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রীতত্বে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতাসীন সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বিরোধচরমে পৌঁছে। বিশেষ করে বৈদেশিক নীতি নিয়ে। মাওলানা ভাসানীর সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ সম্পর্কিত একটা পত্র সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদ দলীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের হাতে তুলে না দিয়ে তা সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেয়। ফলে অলি আহাদ বহিস্কার হন।

এর প্রতিবাদে যে জন এম এল পদত্যাগ করেন, তার মধ্যে অব্যতন ছিলেন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম এমএলএ। ফলে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত হন। 

পাবনার আব্দুল মতিনও এম এল ছিলেন। তিনিও পরলোকে। পরবর্তীতে মতিন ভাসানী ন্যাপে ছিলেন। রংপুরের মফিজুর রহমান, নোয়াখালীর আজিজ আহমেদ, কুষ্টিয়ার আব্দুল আজিজ, ময়মনসিংহের সৈয়দ নুরুল আলম, চট্টগ্রামের আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী৫৪ এর নির্বাচনে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ঢাকার নওয়াব আলী ঢাকা সিটির নুরুল কবির ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পদ অলংকৃত করলেও জাতীয় রাজনীতিতে শীর্ষে ছিলেন না।

উল্লেখ্য ১৯৪৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ১৬ এপ্রিল শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আহ্বায়ক নঈমউদ্দীন আহমেদ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সলিমুল্লাহ হলের ভিপি আব্দুর রহমান চৌধুরী বহিস্কৃত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন দানের অপরাধে যে ২৭ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছাত্রত্ব হারান, তাদের মধ্যে নঈমউদ্দীন অন্যতম ছিলেন। ধর্মঘটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি বন্ড দিয়ে ছাত্রত্ব বহাল করায় সংগঠনের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ফলে তাকে বহিস্কার করে দিনাজপুরের দবিরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়। বরিশালের আব্দুর রহমান চৌধুরীকেও একই অভিযোগে বহিস্কার করে কাজী গোলাম মাহবুবকে কোঅপট করা হয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসাবে। তাকে যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। সলিমুল্লাহ হলের ভিপি আব্দুর রহমান চৌধুরী রাজনীতিতে বিশিষ্ট ভুমিকায় কখন অবতীর্ণ না থাকলেও আইনজীবী হিসাবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থান গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। স্বাধীনত্তোর আব্দুর রহমান চৌধুরী বিচারপতি পদ অলংকৃত করেন। 

ছাত্রলীগের প্রথম নারী ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদিকা লুলু বিলকিস বানু। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৭ বহিস্কৃত শিক্ষার্থীর মধ্যে বিলকিস বানু অন্যতম। শেখ মুজিবুর রহমান যেমনি মুচলেকা বা বন্ড দিয়ে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে যাননি আর তার অনুসরণ করেই পথ চলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নেত্রী বিলকিস বানু।

 

ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ১৯৪৮-২০২৩: 

 

নইমুদ্দিন-দবির 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে নাঈমুদ্দীন আহমেদকে আহ্বায়ক করে ছাত্রলীগের ১৫ সদস্যের যে কমিটির যাত্রা তা শুরুতেই হোঁচট খায়। নাঈমুদ্দীন আহমেদ নেতৃত্বগ্রহণের দু'মাস ১২ দিনের ব্যবধানে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বহিস্কৃত হন। ১৯৫৪ সালের মার্চের আইন পরিষদ নির্বাচনে রাজশাহী থেকে আওয়ামী লীগার হিসাবে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে জয়ী হলেও দলে শীর্ষ নেতৃত্বের সারিতে উঠে আসতে পারেননি। নাঈমুদ্দিনের পর ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয় দবিরুল ইসলামকে। 

 

দবির-খালেক 

 

ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলন হয় ১৯৫৩ সালে।  সভাপতি হন দবিরুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক হন খালেক নেওয়াজ খান। দবিরুল ইসলামেরহেবিয়াস কপার্স মামলাপরিচালনার জন্যই ঢাকায় আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এতে বিখ্যাত হয়ে যান দবিরুল ইসলাম। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় দবিরুল ইসলামকেও ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নিতে হয়। ১৯৫৫ সালে তাকেও নেতৃত্বের উপদলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার হতে হয়।

ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান শেরেবাংলার পার্লামেন্টারি সচিবের পদ গ্রহণ করে বহিষ্কার হন। পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে ঢাকার একটি আসনে হারিয়ে দিয়ে গোটা পাকিস্তানে চমক সৃষ্টি করলেও রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি খালেক নেওয়াজ খান। 

 

কামরুজ্জামান-ওয়াদুদ 

 

ছাত্রলীগের দ্বিতীয় সম্মেলন হয় ১৯৫৪ সালে। কামরুজ্জামান সভাপতি এবং এম ওয়াদুদ সাধারণ সম্পাদক হন। শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে নামের সঙ্গে অধ্যক্ষ যোগ করেন কামরুজ্জামান। আওয়ামী লীগের থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। ২০'০২ সাল পর্যন্ত কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হলেও এমপি নির্বাচিত না হওয়ায় মন্ত্রীত্বের দেখা পাননি কখনো। তিনিও পরলোকে।

 

মমিন-ওয়াদুদ 

 

১৯৫৫ সালের সম্মেলনে সভাপতি হন আব্দুল মমিন তালুকদার। তাঁরও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জুটি ছিলেন এম ওয়াদুদ। দু'বার নির্বাচিত হওয়ার মূলে ছিল তার একাগ্রতা অপরিসীম সাংগঠনিক দক্ষতা। যদিও এম ওয়াদুদ পরবর্তীতে কর্মাধ্যক হিসাবে ইত্তেফাককেই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বেছে নেন। ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ন্যায় পদপদবীতে না থাকলেও আওয়ামী লীগের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন। এমএ ওয়াদুদের মেয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি।

 

মমিন-আউয়াল 

 

১৯৫৪-৫৫ এবং ১৯৫৬-৫৭ দুই মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির পদে দায়িত্বপালন করেন আব্দুল মমিন তালুকদার। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগেরও বড় নেতা ছিলেন। এখন পরলোকে। 

আব্দুল মমিন তালুকদারের দ্বিতীয় মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন এম আউয়াল। স্বাধীনত্তোর ছাত্রলীগের ভাঙ্গনকে কেন্দ্র করে ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস সিরাজুল আলম খানের তন্ত্র-মন্ত্রে এবং জলিল-রব-সিরাজের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)গঠিত হলে তাতে যোগ দিয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তার আগে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক আদমজী জুট মিলের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে বরখাস্ত হন। ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা থেকে প্রার্থী হলেও জামানত হারান। সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর প্রয়াত   সমাজতন্ত্রী এম আউয়াল নিজেকে জাসদের মূল নেতা হিসাবে দাবি করেছিলেন।  

 

রফিকউল্লাহ-আজহার- মোয়াজ্জেম 

 

১৯৫৭-৬০ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন রফিকউল্লাহ চৌধুরী। সিএসপি পরীক্ষায় প্রথমস্থান অধিকারী রফিকউল্লাহ আমলাতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা বেছে নেন। সৎ নিষ্ঠার পরিচয় মেলে স্বাধীনতাত্তোর তাকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্যসচিব পদে নিযুক্তির ঘটনায়। রফিক উল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলেন,'পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র যা করেছে, তা দয়া করে আপনি করবেন না। আমার নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লংঘণ হয়েছে। যদি আমাকে আপনার পাশে রাখতেই চান, তাহলে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সচিব করতে পারেন।" বঙ্গবন্ধু তাই করেন। রফিক উল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চাকুরী থেকে বরখাস্ত হন। স্পিকার . শিরীন শারমিন চৌধুরীর পিতা রফিকউল্লাহ চৌধুরী।

রফিক উল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে দু'বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী আজাহারুল ইসলাম। ব্যারিস্টারি পড়তে বিলাতে গমন করায় পরবর্তী এক বছর (১৯৫৯-৬০) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। 

 

মোয়াজ্জেম-মনি 

 

১৯৬০-১৯৬৩ দুই মেয়াদে সভাপতি হন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। স্বাধীনতাত্তোর প্রথম জাতীয় সংসদের চিফহুইপ নির্বাচিত হওয়া মোয়াজ্জেমের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে জুটি বাঁধা শেখ ফজলুল হক মনির সম্পর্কের টানাপোড়ন ছাত্রলীগের শুরু থেকেই। আওয়ামী লীগে কাঙ্খিত পদ না পাওয়ায় বরাবরই অসন্তোষ ছিল তার মনে। চিফহুইপ ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়। বাকশাল হলে শেখ মনি অন্যতম সম্পাদক হিসাবে ১৫ সদস্যের সর্বেশ্বরী নীতিনির্ধারক মন্ডলীতে ঠাঁই পেলেও কেবল সদস্য পদ নিয়ে খুশী থাকতে হয় মোয়াজ্জেমকে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোচতাকের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার অন্যতম আসামী শাহ মোয়াজ্জেম খুনী মোশতাক ডেমোক্রেটিক লীগ গঠনে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখেন। এরশাদ জমানায় প্রথমে মন্ত্রী পরে উপপ্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব নিযুক্ত হন। শাহ মোয়াজ্জেম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কখন স্থান পাননি। বর্তমানে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন মৃত্যুর কদিন আগে। শাহ মোয়াজ্জেমের সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মনির জুটি ছিল ছাত্রলীগের ইতিহাসে একটি বলিষ্ঠ জুটি। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাকশাল হলে শেখ মনি ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী পরিষদে সদস্য হন অন্যতম সম্পাদক হিসাবে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার দিন তার বাসভবনও খুনীরা হামলা চালায়। এতে তিনি এবং তার অন্তঃ সত্তা স্ত্রী আরজু মনিও নিহত হন। ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি তার পুত্র। 

 

ওবায়েদ-সিরাজ 

 

১৯৬৩-৬৫ মেয়াদে কে এম ওবায়েদুর রহমান ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার সঙ্গে জুটি বাঁধেন সিরাজুল আলম খান। ইতিহাসে দু'জনই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তুখোড় রাজনীতিবিদ। কিন্তু আওয়ামী লীগে টিকে থাকতে পারেননি কেউই। ওবায়দুর রহমান ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য হন। এরপর প্রতিমন্ত্রী হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর খুনী মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী হয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়েন। জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার আসামী হয়ে মোশতাকের দোসর হিসাবে বিতর্কিত হন।

সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে কাছে টেনে মন্ত্রী করেন। কিছুদিন পর অব্যাহতি দেন। জিয়া নিহত হলে বিচারপতি সাত্তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু তাতে স্থান পাননি তিনি। এরশাদের সামরিক আদালতে দুর্নীতির দায়ে কে এম ওবায়েদের ১৪ বছর জেল হলেও তা ভোগ করতে হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান হলে কে এম ওবায়েদ মহাসচিব নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে তাকে এরশাদের সঙ্গে যোগসাজশের দায়ে বহিস্কার করা হয়। মন্ত্রী হওয়ার গুঞ্জণ গুজবে পরিণত হয়। জনতা দল নামে একটা দল গঠন করলেও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিতে ফিরে গিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। ২০'০১ সালে বিএনপি সরকারে এলেও মন্ত্রী হতে পারেননি কে এম ওবায়দুর রহমান। তিনি পরলোকে।

অপরদিকে সিরাজুল আলম খান

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হিসাবে রাজনীতিতে এখনও এক রহস্যময় পুরুষ। সিরাজুল আলম খান ১৯৬৩-১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস বলে খ্যাত এই নেতা মুজিব বাহিনীরও অন্যতম কান্ডারী ছিলেন। স্বাধীনতার পতাকা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা উপাধি  ইত্যাদির নেপথ্যেও ক্রীড়নকের অবদান রাখেন সিরাজুল আলম খান। আওয়ামী লীগের কোন পদে ছিলেন না। স্বাধীনতার পর মুজিববাদ নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে সর্বদলীয় সরকার গঠণের দাবি জানান তিনি। ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধে চার খলিফা খ্যাত ছাত্রনেতা ডাকসু ভিপি আসম রব ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন অংশ সিরাজুল আলম খানের মতবাদের প্রতি সমর্থন দেন। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুজিববাদের পক্ষে অবস্থান নিলে ছাত্রলীগ ভেঙ্গে যায়। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় সিরাজুল আলম খানের দর্শনেই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। বঙ্গবন্ধু পরে জাতীয় চারনেতা নিহত হওয়ার পর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হলে জাসদ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী বিপ্লব সংঘটন করা হয়। জিয়াকে সরিয়ে সেনাপ্রধান হওয়া খালেদ নিহত হন। মোশতাককে সরিয়ে  বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। খালেদ নিহত হলে জিয়া সেনাপ্রধান পদে ফিরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। সিরাজুল আলম খানের জাসদীয় দর্শন বা তাহের ১২ দফা মানতে অস্বীকার করে জেনারেল জিয়া উল্টো তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলান এবং সিরাজুল আলম খান কারাদন্ড দেন সামরিক আদালতে। সিরাজুল আলম খান পরবর্তীতে রাজনীতির অদৃশ্য হয়ে যান। আজো রহস্যময় এক রাজনীতিবিদ বটে। 

 

কোরেশী- রাজ্জাক 

 

ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী আব্দুর রাজ্জাক মাজহারুল হক বাকী আব্দুর রাজ্জাক জুটিও ছাত্রলীগের ইতিহাসে এক অনবদ্য চরিত্র। ফেরদৌস কোরেশী ছাত্রলীগের সভাপতি শুধু নন, ডাকসু'রও ভিপি ছিলেন।১৯৬৫-১৯৬৬ মেয়াদে। কোরেশী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে স্থান পাননি। স্বাধীনতাপূর্বই তিনি বঙ্গবন্ধু ঘরণার বিরোধী। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হয়েছিলেন জেনারেল জিয়ার আমলে। বিগত ওয়ান ইলেভেনকালে তিনি আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। নতুন এক পার্টি গঠনেরও দৌড়ঝাঁপ ছিল নিত্যদিনের মিডিয়ার খবর। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায় তার সব পরিকল্পনা। যখন সেনাবাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দীনের সরকারের টু মাইনাস থিউরি ভেস্তে যায়। 

 

বাকী-রাজ্জাক 

 

মাজহারুল হক বাকী

৬৫-৬৬ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মাজাহারুল হক বাকী। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের তুখোড় নেতা হিসাবে সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের ন্যায় বলিষ্ঠ ভুমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন বাকী।  পরবর্তীতে অবশ্য আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দেখা যায়নি।অপরদিকে আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। 

বঙ্গবন্ধু যাকে আদর করে বলতেন "আমার রাজ্জাক" সেই রাজ্জাক ছাত্রলীগের দু'বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর সঙ্গে প্রথম দফা। স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস আব্দুর রাজ্জাকই ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে একমাত্র নেতা যিনি আওয়ামী লীগের দু'বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একবার ১৯৭৮ সালে আব্দুল মালেক উকিলের সঙ্গে আরেকবার ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেং হাসিনার সঙ্গে। তিনি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৩ সালে বাকশাল পুনরুত্থানের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কার্যত রাজ্জাকেরই ১৪ শতাংশ সমর্থনপুষ্ট ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বগ্রহণ করলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাকশালকে একীভূত করতে বাধ্য হন রাজ্জাক। তাঁকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়।

২০০৯ সালে কাউন্সিলে উপদেষ্টা পরিষদে ঠাঁই হয় তাঁর। অনেকটা নীরবে নিভৃতে না ফেরার দেশে চলে গেছেন আব্দুর রাজ্জাক। 

 

রউফ-খালেদ 

 

১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন আব্দুর রউফ। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। ১৯৭৩ সালের মার্চের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বিজয়ী হওয়ার পর হুইপ হয়েছিলেন উপমন্ত্রীর মর্যাদায়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খুনী মোশতাকেরও হুইপ হন ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুর রউফ। জীবদ্দশায়ই রাজনীতি থেকে হারিয়ে যান। খালেদ মোহাম্মদ আলী আব্দুর রউফের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খালেদ মোহাম্মদ আলী। ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানের সময়ে তিনি বিশিষ্ট ভুমিকাপালন করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পেলেও শীর্ষ পদে তাকে কখনো দেখা যায়নি। বর্ষীয়ান নেতা বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনেও ভুমিকা রাখেন।  বর্তমানে রাজনীতিতে নেই।

 

তোফায়েল-রব 

 

তোফায়েল আহমেদ

ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে কিংবদন্তীতুল্য মহানায়ক। ১৯৬৯- গণঅভ্যুত্থান হয় তার নেতৃত্বে। তোফায়েল আহমেদকে বলা হয় গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক। ১৯৬৯ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধীতে ভূষিত করেন তোফায়েল আহমেদ। ছাত্রলীগের সভাপতি হন এরপর পরই। তার সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রবও পরের বছর ডাকসু' ভিপি হন। তোফায়েল আহমেদ মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।স্বাধীনতাত্তোর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব নিযুক্ত হন মন্ত্রীর মর্যাদায়। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ১৯'৯২ -২০০৯ পর্যন্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শিল্প বানিজ্য মন্ত্রী ছিলেন। প্রেসিডিয়াম থেকে বিস্ময়করভাবে তাকেও সরিয়ে দেয়া হয়। পাঁচ বছর রাখা হয় মন্ত্রিসভার বাইরে। পরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবার সরকারে এলে বানিজ্য মন্ত্রী করা হয় বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদকে। গত নির্বাচনে বিজয়ী হলেও মন্ত্রীত্ব দেয়া হয়নি। অপরদিকে রব জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ডাকসু ভিপি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন খলিফাখ্যাত স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা আসম রব প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে 'জাতির পিতা' উপাধী দেন ডাকসুর পক্ষ থেকে। রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় তাঁকে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হতে হয়েছে। জেনারেল জিয়ার সামরিক আদালতে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র মামলায় কারাদন্ডলাভ করতে হয়েছে। ১৯৮৮ সালে প্রহসনের নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) নেতা হিসাবে তিনি বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসেন। ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনা সরকারের নৌ পরিবহন মন্ত্রী হন। তিনি জাসদের সভাপতি। বর্তমানে আবার আওয়ামী লীগ বিরোধী। 

 

সিদ্দিকী-সিরাজ 

 

রাজনীতির ময়দানে অনলবর্ষী বক্তা বলে পরিচিত নূরে আলম সিদ্দিকী একাত্তরের আগুনঝরা দিনগুলোর অন্যতম নির্মাতা। ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের প্রতিটি সভা-সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন। তার জ্বালাময়ী ভাষণ ইতিহাসের একেকটি স্পূলিঙ্গ।

মুজিববাদের সমর্থক। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি তার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাকশাল বিরোধী নূরে আলম সিদ্দিকী ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে এলেও কার্যকর ভুমিকা রাখার সুযোগ পাননি। অপরদিকে শাহজাহান সিরাজ মুক্তিযুদ্ধকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। তিনি স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বরখাস্ত হন। পরে জাসদ হলে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাসদ (সিরাজ) বিলোপ করে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদে প্রতিমন্ত্রী পরের মেয়াদে মন্ত্রী হন। তবে বিএনপিতে সাংগঠনিক মর্যাদা লাভে ব্যর্থ হন। মৃত্যুর আগে তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বলেন। 

 

সিদ্দিকী-গামা 

 

ইসমাত কাদির গামা

শাহজাহান সিরাজ বহিস্কার হলে ইসমাত কাদির গামাকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী।  ১৯'৭২ সালে শেখ মনি সমর্থিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে শেখ শহীদুল ইসলাম সভাপতি এমএ রশীদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অপরদিকে সিরাজুল আলম খান সমর্থিত ছাত্রলীগ (রব-সিরাজ) আফম মাজবুবুল হককে সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সাধারণ সম্পাদক করে। বঙ্গবন্ধু শেখ শহীদ এম রশীদের ছাত্রলীগকে সমর্থন দেয়ায় তা মূল ছাত্রলীগ বলে বিবেচিত হয়। 

ছাত্রলীগ (মাহবুব-মান্না) পরিচিতি লাভ করে জাসদ ছাত্রলীগ নামে।

 

শহীদ-রশিদ 

 

১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন শেখ শহীদুল ইসলাম। তিনি পরে আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল হলে অঙ্গফ্রন্ট জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন সাংবিধানিক কাঠামোয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। এরশাদের সময়ে মন্ত্রী নিযুক্ত হন। বর্তমানে মঞ্জুর বিজেপির মহাসচিব তিনি। অপরদিকে এম রশীদ

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন সংকটময় মুহূর্তে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবস্থান করে নিতে পারেননি নেতা। 

 

মনি-প্রধান-জালাল 

 

১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া মনিরুল হক চৌধুরী জাতীয় পার্টি শাসনামলে চিফ হুইপ ছিলেন। এখন বিএনপিতে আছেন দায়সারাভাবে

মনিরুল হক চৌধুরীর সময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন শফিউল আলম প্রধান। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডার সংঘটিত হওয়ার দায়ে প্রধানকে বরখাস্ত করে কারারুদ্ধ করা হয়। তার সাজাও হয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার জেনারেল জিয়া তাকে কারামুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। চরম আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী শফিউল আলম প্রধান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাগপা সভাপতি ছিলেন। শফিউল আলম প্রধান বরখাস্ত হলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারির সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। শিক্ষমতা বলে একই বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে দেশে জাতীয় দলীয় ব্যবস্থা স্বরূপ 'বাকশাল' কায়েম করেন। বাকশালের পাঁচটি অঙ্গফ্রন্টের মধ্যে ছাত্রলীগ একটি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ 'জাতীয় ছাত্রলীগ' নামধারণ করে। সভাপতি বলে কোন পদ না রেখে অন্যান্য সংগঠনের ন্যায় এর একজন সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ করা হয় বাকশাল চেয়ারম্যান রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক। 

শেখ শহীদ বাকশালের অন্যতম অঙ্গফ্রন্ট জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ লাভ করেন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম শেখ শহীদুল ইসলাম। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু প্রায় সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর খুনী খন্দকার মোশতাক কর্তৃক সেপ্টেম্বর বাকশাল আদেশ বাতিল করা হয়। ফলে বাকশালসহ অন্যান্য অঙ্গফ্রন্টের মতো জাতীয় ছাত্রলীগেরও অস্তিত্ব লোপ পায়। প্রসঙ্গত, শেখ শহীদুল ইসলামও বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মীনী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের একমাত্র বোনের ছেলে শেখ শহীদুল ইসলাম জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে এরশাদের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) মহাসচিব। 

রাজনৈতিক দলবিধি আইনের আওতায় '৭৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনর্জীবিত হয়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। 

 

কাদের-চুন্নু 

 

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পুনর্জীবিত হলে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কারাগারে অন্তরীন মেধাবী ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদের সভাপতি বাহা উল আলম চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগ নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগের উপদলীয় কোন্দলের প্রভাব ছাত্রলীগের ওপরও পড়ায় দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন অনুষ্ঠান সম্ভবপর হয়নি। এরপর ১৯৮৩ সালে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওবায়দুল কাদের সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সংগঠক হিসাবে তিল তিল করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উঠে এসেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য থেকে যুব ক্রীড়া সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য এবং আওয়ামী লীগের গত তিনটি কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার ১৯'৯৬-২০০১ সরকারের যুব ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হওয়া ওবায়দুল কাদের বর্তমানে সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী। ছাত্রলীগের ইতিহাসে সভাপতি সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ অলংকৃত করেন। তিনি তৃতীয় দফা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। ওবায়দুল কাদের বাহা উল মজনু চুন্নুর  নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ১৯৮৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত টিকে থাকে। এসময় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চাঙ্গা হয়ে ওঠে। চলে বহিস্কার পাল্টা বহিস্কারের ঘটনা। আবারও ভাঙ্গনের মুখে পড়ে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের দুটো নেতৃত্ব আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন সভাপতি আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদন করেন।  অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সভাপতি মন্ডলীর সদস্য মহিউদ্দীন আহমেদসহ সহমত পোষণকারীরা 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) পুনরুজ্জীবিত করেন এবং ফজলুর রহমানকে সভাপতি এবং বাহা উল আলম মজনু চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক করে 'জাতীয় ছাত্রলীগকেও পুনর্জীবিত করেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ফজলুর রহমান কিশোরগঞ্জ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচিত হন।

১৯৯২ সালে বাকশাল আওয়ামী লীগে একীভূত হলে অনলবর্ষী বক্তা ফজলুর রহমান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পান। পরে বহিস্কৃত হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। অপরদিকে উভয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাহা উল আলম মজনু জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবস্থান করে নিতে পারেননি। 

 

জালাল-জাহাঙ্গীর 

 

মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন 

১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেভেন মার্ডার সংঘটিত হলে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান বহিস্কার হলে।  জালাল মহিউদ্দিন ১৯৬৯- জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ১৯৮৩ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সহ প্রচার সম্পাদক হওয়া মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন ১৯৮৭- ২০০৯ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।  ২০০৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা- আসনে জয়ী হলেও সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ী হওয়া জালাল বিএমএ' বর্তমান সভাপতি। মহাসচিব হিসাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিশিষ্ট ভুমিকা রাখেন।

মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীনের সঙ্গে ছাত্রলীগে জুটি বেঁধে ছিলেন আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। আওয়ামী লীগের সহ দপ্তর সম্পাদক ছিলেন ২০০৯ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্বপালন করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন হাতছাড়া হয় চার বারের সংসদ সদস্যের। সর্বশেষ নির্বাচনের আগের নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পুনঃউদ্বার করে জয়ী হন। গত নির্বাচনে মনোনয়ন না পেলেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফিরে আসেন। আকষ্মিক তিনি মারা যান। 

 

মান্নান-নানক 

 

১৯৮৪ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে আব্দুল মান্নান সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির নানক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আব্দুল মান্নান  বগুড়া- আসনে এমপি থাকা অবস্থায় সম্প্রতি ইন্তেকাল করেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০০৯ সালে কমিটি থেকে বাদ পড়েন। আব্দুল মান্নান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধানের বিশ্বস্তভাজন হিসাবেও পরিচিত। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি আব্দুল মান্নান ১৯৮৭ সালে কেন্দ্রীয় সদস্য, ১৯৯২ সালে সহ প্রচার সম্পাদক ১৯৯৭ সালে প্রচার সম্পাদক এবং ২০০২ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুল মান্নান। তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। আব্দুল মান্নানের জুটি হিসেবে জাহাঙ্গীর কবির নানক ১৯৮৪ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বরিশাল বিএম কলেজের ভিপি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি অবস্থান থেকে সরাসরি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর কবির নানক ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদে ছাত্রলীগ প্যানেলে নির্বাচনও করেন। যে প্যানেলে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভিপি পদে প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে উঠে আসতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয় তাকে। ২০০২ সালে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় অভিষেক ঘটলেও তিনি ২০০৩ সালে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন যুগ্ম সম্পাদক থেকে। ২০০৯ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক কিছুদিন পর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন নানক। সর্বশেষ কাউন্সিলেও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী। তিনি ঢাকা থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।  

 

সুলতান-রহমান 

 

রাজনীতির ক্লিনম্যান বলে পরিচিত সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ১৯৮৬ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সুলতান মনসুর স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত ছাত্রলীগের ডাকসুতে নির্বাচিত হওয়া একমাত্র ভিপি। সাবেক এমপি সুলতান কেন্দ্রীয় সদস্য পদ থেকে ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। কিন্তু ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন হাতছাড়া হয় তার। ২০০৯ সালে হারান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। সেই থেকে রাজনীতির মাঠে নেই সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী সদস্য ছিলেন। গত নির্বাচনে বিএনপি জোট থেকে মৌলভীবাজারের একটি আসনে গণফোরাম প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন নেতা। তবে বঙ্গবন্ধুর আর্দশের সৈনিক বলেই সংসদে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সুলতানের জুটি হিসেবে আব্দুর রহমান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক  ছিলেম। আব্দুর রহমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উঠে আসেন ২০০২ সালের কাউন্সিলে। ২০০৯ সালের কাউন্সিলে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ হাতছাড়া হয়। শুধু সদস্য করা হয় তাকে। পরে তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। ফরিদপুর- আসনের এমপি হন। গত নির্বাচনে মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হলেও কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। 

 

হাবিব-অসীম 

 

১৯৯০ সালের সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া হাবিবুর রহমান হাবিবকে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে পাবনার একটি আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু '৯০ ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে মনোনয়নলাভে ব্যর্থ হন। যোগ দেন বিএনপিতে। অবশ্য বিএনপির মনোনয়ন পেলেও জয়ী হতে পারেননি। বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচকও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অসীম কুমার উকিল। তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং সংসদ সদস্য। 

 

আলম-অসীম 

 

বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে '৯০ এর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের সহ সভাপতি পদে থেকেই ভিপি পদে মনোনয়ণ পেয়েছিলেন মোহাম্মদ শাহে আলম। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ভেঙ্গে যাওয়ায় ছাত্রলীগকে এককভাবে লড়তে হয়। ফলে ডাকসু হাতছাড়া হয়ে চলে যায় ছাত্রদলের হাতে। '৯০ এর ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব আওয়ামী লীগে যোগ দেন। 

তিনি ১৯৯১ এর নির্বাচনে প্রার্থী হলে সংগঠনের সহ সভাপতি শাহে আলমকে ছাত্রলীগের সভাপতি ঘোষণা করা হয়। সাধারণ সম্পাদক পদে অসীম কুমার উকিলই থেকে যান পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া পর্যন্ত। 

শাহে আলম বর্তমানে বরিশাল- আসনের সংসদ সদস্য। 

হাবিবুর রহমান হাবিব মোহাম্মদ শাহে আলমের সঙ্গে জুটি বেঁধে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব করেছেন অসীম কুমার উকিল। তিনি '৯০ এর ছাত্রগণঅভ্যুত্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগে উপ প্রচার সম্পাদক হন তিনি। ২০০৯ সালেও একই পদে নির্বাচিত হন। বিগত কাউন্সিলে অসীম কুমার উকিল আওয়ামী লীগোর সাংস্কৃতিক সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এমপি হয়েছেন নেত্রকোনা থেকে। তবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসীন হতে পারেন নি শাহে আলম। 

সংসদ সদস্য নিয়েই সন্তষ্ট থাকতে হচ্ছে তাকে।

 

মঈনু-ইকবাল 

 

১৯৯২ সালে কথিত আদু ভাইদের বিদায় দিয়ে নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়েছিল। মঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরীকে সভাপতি ইকবালুর রহিমকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগ নব উদ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৪ আসনে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়। কিন্তু তিনি হেরে যান। এরপর থেকে তাকে আর মনোনয়ন দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও স্থান হয়নি জনপ্রিয় নেতার।  অপরদিকে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯'৯২ সালের সম্মেলনে। সাবেক এমপি আওয়ামী লীগের এককালীন কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি প্রয়াত আব্দুর রহিমের পুত্র ইকবালুর রহিম। দিনাজপুর- আসনের সংসদ সদস্য। এখনো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই না পেলেও জাতীয় সংসদের হুইপ নির্বাচিত হয়েছে এবারও।

 

শামীম-পান্না 

 

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি কে এম এনামুল হক শামীম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৯৪ সালের সম্মেলনে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হলেও পরের কাউন্সিলে বাদ পড়েন। তিনি শরিয়তপুর- আসনর এমপি এবং পানি সম্পদ উপমন্ত্রী।

ইসহাক আলী খান পান্না

ছাত্রলীগে এনামুল হক শামীমের সঙ্গে জুটি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক হিসাবে। ১৯৯৪ সালের সম্মেলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পিরোজপুর- দলীয় মনোনয়ন পেলেও পরে জোটগত কারণে হাতছাড়া হয়ে যায়। তিনিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে অবস্থান করছেন। তবে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন জনপ্রিয় সাবেক ছাত্রনেতা। 

 

বাহাদুর-খোকন 

 

১৯৯৬ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন বাহাদুর বেপারী সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন। বাহাদুর বেপারী এখনো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাননি। শরিয়তপুর- আসনে প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন তিনি।

অজয় কর খোকন 

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকনেরও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এখনো অভিষেক ঘটেনি। কিশোরগঞ্জের একটি আসনে মনোনয়ন চেয়েও পাননি গত নির্বাচনে। 

 

লিয়াকত-বাবু 

 

লিয়াকত শিকদার। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে কারারুদ্ধ ছিলেন দীর্ঘদিন। ফরিদপুর- আসনে প্রার্থী হতে চান আগামী নির্বাচনে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে অবস্থান হয়নি এখনো। অপরদিকে নজরুল ইসলাম বাবু নারায়ণগঞ্জ- আসনের সংসদ সদস্য। নজরুল ইসলাম বাবু ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এখনো কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়নি তার।

 

রিপন-রোটন 

 

মাহমুদ হোসেন রিপন মাহহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন যথাক্রমে ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগে তাদের অভিষেক ঘটেনি এখনো। ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মারা যাবার পর গাইবান্ধা- আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে   ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হোসেন রিপনকে। 

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার রোটন চৌধুরীও চট্টগ্রামের একটি আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। 

 

সোহাগ-নাজমুল 

 

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনও নাম লেখাতে না পারলেও মনোনয়ন দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন বাগেরহাটের একটি আসনে।  

নাজমুল আলম সিদ্দিকী

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আলম সিদ্দিকীরও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পরিচিতি গড়ে ওঠেনি।

 

সাইফুল- জাকির 

 

সাইফুল ইসলাম সোহাগ 

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম সোহাগ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেই সক্রিয় রয়েছেন। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বিএম জাকির হোসেনও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। 

 

শোভন- রাব্বানী 

 

রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন 

ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বিতর্কিত হয়ে বরখাস্ত হন। তিনি এর আগে ডাকসু ভিপি পদে হেরে যান।ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আলোচিত সমালোচিত ছিলেন গোলাম রাব্বানী। ডাকসু জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। নৈতিক স্খলন জনিত অপরাধের অভিযোগে সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরীর সঙ্গে তিনিও বরখাস্ত হন।  

 

জয়- লেখক  


ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেও গত প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা সম্মেলন ছাড়াই তাদের সরাসরি নিযুক্ত করেন। সর্বশেষ ছাত্রলীগের ডিসেম্বর ২০২২ সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন সাদ্দাম হোসেন সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। নিশ্চয়ই তাদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নতুন কিছু সংযোজন করে ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করবে। শুভ জন্মদিন।  



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

উপজেলায় ভোটার কম কেন?


Thumbnail

#সবচেয়ে বেশি ক্ষেতলালে ৭৩ ভাগ
#শতকরা মাত্র ১৭ ভাগ মিরসরাইতে

১৩৯ টি উপজেলার মধ্যে ৩০টি উপজেলায় শতকরা ৩০ ভাগের কম ভোট পড়েছে। আর শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে মাত্র ২৩ টি উপজেলায়। সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে ইভিএমে ভোট নেয়া উপজেলাগুলোতে। ২০টি উপজেলায় ইভিএমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনোটিতেই ৫০ ভাগ ভোটও পড়েনি। ইভিএমে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে পাবনার সুজানগর উপজেলায়, শতকরা ৪৯.৭৮ ভাগ। এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আব্দুল ওয়াহাব, তার প্রাপ্ত ভোট ৬২ হাজার ৭৫২। নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী শাহীনুজ্জামান পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৪৪১। মাত্র ৪ হাজার ৩১১ ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ায় বলা যায় ভোটের লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। কারণ প্রথম ধাপের খুব কম উপজেলাতেই প্রতিদ্বন্ধীতামূলক নির্বাচন হয়েছে, অন্তত ভোটের ফলাফল তাই বলে। ইভিএমে সবচেয়ে কম শতকরা মাত্র ২২.৭০ভাগ ভোট পড়েছে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায়। এখানে বিজয়ী মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন পেয়েছেন ৪৭ হাজার ৮০৭ ভোট। আর মাত্র ৩ হাজার ৮২৩ ভোটে হেরেছেন মো. রাশেদ ইউসুফ। ভোটের লড়াই ভালো হলেও হতাশার ব্যাপার হচ্ছে এখানকার ৪ লাখ ৫৬ হাজার ২২২ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ৩ হাজার ৫৫৬ জন। কেন এতো কম ভোটার? প্রশ্নের জবাব কে খুজবে নির্বাচন কমিশন, দলীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক প্রার্থী না দিয়ে অংশগ্রহনকারী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নাকি অন্য কেউ ? দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষাথীরা কি গবেষণা করবেন?    

সবচেয়ে বেশি শতকরা ৭৩.১৬ ভাগ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট ক্ষেতলাল উপজেলায়। এখানে ৯৫ হাজার ১৯১ ভোটের মধ্যে পড়েছে ৬৯ হাজার ৬৩৯টি। জয়ী দুলাল মিয়া সরকার পেয়েছে ৩০ হাজার ৪০০ ভোট আর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী তাইফুল ইসলাম তালুকদার ২২ হাজার ৯০০ ভোট। এখানে তৃতীয় হয়েছেন সর্বশেষ উপজেলা চেয়ারম্যান মুস্তাকিম মন্ডল। যিনি পেয়েছেন ১৪ হাজার ৯২৮ ভোট। এই তিনজনই আওয়া লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নাকি আরেকজনও ছিলেন, নাজ্জাষী ইসলামের ভোট নাকি পেয়েছেন নামমাত্র ভোট,টেকেনি জামানতও। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো প্রার্থীরা ভোটারদের জয়ী দুলাল মিয়া ক্ষেতলাল পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর তাইফুল ইসলাম এর আগে ১৯৯০ ও ২১০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। মুস্তাকিম মন্ডল ২০১৮ সালে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এখানে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ ছিল, কারণ বর্তমান ও সাবেক দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেও দুলাল মিয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে প্রথম থেকেই। তিনি জয়ী হলেও অন্য দুজনও ভালো ভোট পেয়েছেন। টাকা খরচেও নাকি কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। এই এলাকার সাংসদ জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন প্রত্যক্ষভাবে কারো পক্ষে নেননি বলেই জানালেন জয়পুরহাটের দুজন সাংবাদিক। তবে প্রথম দিকে তার একজনের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন থাকলেও পরবর্তীতে দলের নেতাকর্মী বা ভোটারদের কোনো একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে তিনি এমপি হিসেবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। আর সুষ্ঠু ভোটের জন্য কয়েকজন প্রশংসা করলেন জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলমের। হায় অন্য উপজেলাগুলোতে এমন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে “ ভোটারহীন নির্বাচনের’’ অপবাদ সইতে হতো না। আওয়ামী লীগ প্রধান যে বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের কৌশল হিসেবে দলের নেতাদের মধ্যেই উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্ধিতামূলক করতে চেয়েছিলেন তাও সফল হতো, যদি প্রথম ধাপের নির্বাচনের মধ্যে ৭০ টির অবস্থা ক্ষেতলাল উপজেলার মত হতো। তবে উল্লেখ করতেই হয় ক্ষেতলালে ভোটের হার বেশি হলেও ভোটারের উপস্থিতি অনুযায়ী খুবই খারাপ ভোট হয়েছে একই জেলার আক্কেলপুর উপজেলায়। ভোট পড়েছে মাত্র শতকরা ১৯.৯৩ ভাগ। ১ লাখ ২২ হাজার ৮৪২ ভোটের মধ্যে ভোটার হাজির হয়েছিলেন ২৪ হাজার ৪৮৮ জন। যার মধ্যে মোকসেদ আলি মন্ডল ১৯ হাজার ৫৩৯ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রার্থী নুরন্নবী আরিফ ভোট পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৮৮। বলা যায় নূন্যতম প্রতিদ্বন্ধিতা হয়নি এখানে। এই জেলার অন্য একটি উপজেলা কালাইতে ভোট পড়েছে ৬৯.৭৫ ভাগ। 

এবার বলি সবচেয়ে কম, শতকরা মাত্র ১৭ ভাগ ভোট পড়া চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কথা। এখানে মোহাম্মদ এনায়েত হোসেন নয়ন ৩৩ হাজার ৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত, আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমান পেয়েছেন ২০ হাজার ৭৬৭ ভোট। এখানে আরো তিনজন চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। এদের মধ্যে ফেরদৌস হোসেন আরিফ ৩ হাজার ৪৩৪, উত্তম কুমার র্শমা ৩ হাজার ৩৪৬ এবং মোহাম্মদ মোস্তফা ৬৬৫ ভোট পেয়েছেন। এই উপজেলায় মোট ভোটারের সংখ্যা  ৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫৭টি । এই উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের এলাকা। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি নিজের ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেলকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য সুপারিশ করে দলের মনোনয়নে তাকে এমপি করতে পেরেছেন। তখন উপজেলা আওয়ামী লীগের যারা তার জন্য কাজ করেছেন তারা এবারের উপজেলা নির্বাচনে সরাসরি কোনো চেয়ারম্যান প্রার্থীর জন্য প্রচারে নামেননি। আর প্রতিদ্বান্ধতা হয়েছে যে দুজনের মধ্যে তাদের দুজনই চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা। এনায়েত হোসেন নয়ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আর শেখ আতাউর রহমান সাধারন সম্পাদক । তিনি কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একএম জাহাঙ্গীর ভূইয়ারি একটি বিতর্কিত বক্তব্য নির্বাচনে দারুণভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। স্থানীয় পত্রিকার খবর অনুযায়ী তিনি ২৯ এপ্রিল একটি সমাবেশে শেখ আতাউর রহমানের পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “ আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রিয়নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ‍সুযোগ্য সন্তান মাহবুব উর রহমান রুহেলকে জিতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোনো অপকর্ম ছাড়া ভোট কেন্দ্র খোলা রাখবো।’’ এই বক্তব্যের জন্য তাকে কেন্দ্র থেকে শোকজ করা হয়েছে। আবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর নিজেই উপজেলা নির্বাচনে আগ্রহী ছিলেন। স্থানীয় দুজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে বর্তমান সাংসদের পরোক্ষ সমর্থন নাকি ছিল এনায়েত হোসেন নয়নের পক্ষেই। ফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বুঝতে পারেনি দল কাকে চায়, আর যেহেতু দলীয় প্রতীকও ছিল না, তাই তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী ছিল না। আর মাঠের বিরোধীদল বিএনপি বর্জন করেছে, জাতীয় পার্টি উপজেলা নির্বাচনে থেকেও নাই। ফলে ৩ লাখ ৭২ হাজার ভোটারের মাত্র ৬৩ হাজার ২৬৬ ভোট দিয়েছেন মিরসরাইয়ের উপজেলা নির্বাচনে। 
কেন ভোটারের উপস্থিতি কম? তা নিয়ে কারো মাথা-ব্যাথা নেই। সাধারন মানুষের ভাবনা এমন যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তাদের ভোট দেয় না দেয়ায় কিছুই আসে যায় না। দেশের দুই বড় দলের একটি আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও তারা দলীয় প্রার্থী না দিয়ে উন্মুক্ত করেছে,দেয়নি প্রতীকও। বিএনপি আছে বর্জনে। জাতীয় পার্টি নিজেরাই বিপর্যস্ত। একটি পৌরসভায় স্থানীয় মানুষ যেভাবে তার সেবা পায়,উপজেলা পরিষদ থেকে নাগরিক সেবা কম,উন্নয়নের কাজও বেশি হয় ইউনিয়ন পরিষদে। ফলে ভোটারের আগ্রহ কম। তারই প্রতিফলন পড়েছে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোটে। এখন দেখা যায় দ্বিতীয় পর্বে কাল ২১ মে ভোটে কেমন ভোটার আসে ভোট কেন্দ্রে?


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

আমার চোখে দেখা ১৭ মে, ১৯৮১


Thumbnail

আমি ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেতে এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করার প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরি। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরার পরে তখন আমি একধরনের দোটানায় ছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। যার কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল তিনি নেই। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে আছেন, তারাও দেশে নেই। আমি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমি হাসপাতালে যাই, কাজ করি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা আমার কাছে আসতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ছাত্রলীগ ও বিএমএ’র জুনিয়র ডাক্তারদের সাথেই তখন আমার সময় কাটে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর নেতৃত্বে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আমার বাসায় আসতো। তাদের সাথে কথা বলে অন্তত পক্ষে এটা মনে হতো যে, ঠিকই দেশে ফিরেছি। কিন্তু তারপরও একটা অপূর্ণতার ভাব ছিল। 

শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় এবং ১৭ মে তিনি দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন দেশের ভেতরে বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় যা শুনতাম তাতে আমার নিজের মনে হতো, তিনি বোধহয় দেশে না আসলেই ভালো হতো। কারণ, আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তখন উৎপন্ন হয়েছিল। আর এই ধারণাটি ছিল, আসার সাথে সাথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে! তাই ভাবলাম অন্তত বিদেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বেঁচে থাকুক এটাই বড় কথা। কিসের রাজনীতি, কিসের কি? বঙ্গবন্ধু নেই। সত্যিকার অর্থে বলা চলে আমি একপ্রকার রাজনীতিবিমুখ ছিলাম তখন।
 
তারপর যখন ১৭ মে আসলো তখন আমি ভাবলাম, এয়ারপোর্টে যাই। এয়ারপোর্টে আমাকে একজন বুদ্ধি দিল, একটু দূরে গাড়ি রেখে হেটে যাওয়ার জন্য। আমি তাই করলাম। তখন প্রথমদিকে খুব বেশি লোকজন নজরে পড়েনি। কিন্তু যখন বিমান নামলো এবং নেত্রী শেখ হাসিনা বিমান থেকে নামলেন তখন চতুর্দিকে হঠাৎ দেখি লক্ষ লক্ষ লোক। আমার তখন চোখ দিয়ে তখন পানি। এখনও তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের প্রতি ভালোবাসা মানুষের যায়নি। 

এর আগে আমার মনে হতো যে, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আর স্বপ্ন দেখতে যদি কেউ ভুলে যায় তাহলে সে মানুষের বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমার সত্যিকার মানসিক অবস্থা তখন এমনই স্বপ্নহীন ছিল। স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন ভালোবাসা দেখে আমার তখন মনে হলো এই বুঝি আবার জীবিত হলাম। তখনও শেখ হাসিনার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি। কারণ সেই সময় তাঁর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। 

মানুষের ভিতরে যে ভাবাবেগ তা পরদিন মানুষের সঙ্গে মিশে বুঝলাম। তখন একটা সুক্ষ্ম মিল আমি খুঁজে পেলাম। তাহলো, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসেন, তখন আমরা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জনগণ যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, আমাদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণতা পেল। ঠিক তেমনি একটা ভাব আমার মনে হল। তখন মাত্র শেখ হাসিনা এসেছেন। শুধুমাত্র তাকে দেখার ফলে জনগণের মধ্যে একটা উজ্জ্বীবিত ভাব এলো। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতারা এদের সবার ভেতরে একটি গণজোয়ারের ভাব লক্ষ্য করা গেল। 

এত বছর পরে আজ আমি বলছি, সেদিন আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এই শেখ হাসিনা নেত্রী শেখ হাসিনা হবেন, দার্শনিক শেখ হাসিনাতে রূপান্তরিত হবেন। এবং তাঁর দর্শন দ্বারা বাংলাদেশে সোনার বাংলা হিসেবে গঠন করতে পারবে। সেদিন আমার মধ্যে আবেগ ছিলোৎ কিন্তু এই চিন্তাগুলো ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে তিনি কীভাবে দেশ গড়েছে তা সমস্ত লোকই জানে। সেই ১৭ মে যে জনসাধারণ তাকে একটু দেখবার জন্য গিয়েছিল, তাদের মনের ভাষা, মুখের ভাব এসব যদি অনুভব করা যায় তাহলে বোঝা যায়, সত্যি বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে সেদিন প্রবেশ করেছিল। এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শীতা এবং দার্শনিক ভিত্তির কারণে জনগণের আশা আকাঙ্খাকে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং বাংলাদেশকে আজ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার দারপ্রান্তে। 

সেই ১৭ মে’র কথা যদি চিন্তা করি, তখন অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে এতোদূর পর্যন্ত দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবে তা চিন্তা করিনি। এখন যেমন তিনি সমস্ত বিশ্বে নন্দিত বিশ্বনেতা। সেই তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সেই ১৭ মে’র কথা আজকে মনে পড়ে। আমি প্রার্থনা করি দার্শনিক শেখ হাসিনাকে যেন সৃষ্টিকর্তা ভালো রাখেন এবং দেশ গড়ার সুযোগ যেন তিনি অনেকদিন পান।  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রত্যাবর্তনের পর সেদিন তিনি যা বলেন


Thumbnail

কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও  তিনি কাঁদছিলেন।  

প্রকৃতিও সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল।  পৌনে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতি তাঁর কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। কুর্মিটোলা থেকে তিনি যান বনানী গোরস্থানে। সেখানে যেয়ে আবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বনানী থেকে তিনি যান শেরে বাংলা নগরে। সেখানে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ জনতা অপেক্ষা করছিল। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বক্তব্য রাখেন।

কি বলেছিলেন তিনি লাখ লাখ জনতার সমাবেশে? হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া ফলাও করে এসব খবর সেদিন কোন পত্রিকা বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। ৪৩ বছর আগের সে সব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াও আজ কষ্টসাধ্য। সেদিনের ভাষণের যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।  

আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই বোন, আরো অনেক প্রিয়জন।  ভাই রাসেল, আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আমি আপনাদের কাছে এসেছি।

বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা নেতা হবার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসাবে, মেয়ে হিসাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসাবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।

আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলার মানুষের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার পরিজন হত্যা করে বলেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমানো ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কি? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দিনে দুপুরে মানুষ খুন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে।  সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না, আর একশ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে।

ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃংখলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তবে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকতো না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তববায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি; আপনাদের ভালবাসা নিয়ে, পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। আপনারা আমার সাথে শপথ করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।  

স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি।

আপনাদের ভালবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।

(তথ্যসূত্র: সংবাদপত্রে শেখ হাসিনার বক্তৃতা: ১৯৮১-১৯৮৬; প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩)


প্রত্যাবর্তন   আওয়ামী লীগ   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে জিয়ার অপতৎপরতা


Thumbnail

আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল।বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।

ওই লিফলেটে আরো লেখা ছিল: “আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তি সংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে।...তিনি আমাদের কর্ম চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।

প্রচারপত্রে আরও বলা হয়েছিল: “...ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।...আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশাজনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে প্রত্যাবর্তন। বাঙালী জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বস্তিতে ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কায় সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শঙ্কিত বোধ করছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরূদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির এক সভায় শেখ হাসিনাকে বিদেশি শক্তির তল্পিবাহক বলে অভিহিত করা হয়। একই দিনে আরেকটি সভা থেকে বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, বাকশালিরা ভারতের গোলাম। তারা বিদেশি সৈন্যের সহায়তায় ক্ষমতায় বসতে চায়। যে দলের প্রধান দিল্লিতে, সে দল জনগণের কল্যান করতে পারে না। সাতাশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুনী মুশতাক গংদের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে বলা হয়েছিল, ইন্দিরার নীলনকশা এখন বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, “৭৫ এর পর তারা দিল্লি লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচেষ্টা চালায়। লন্ডনে জমে ওঠে দিল্লির সেবাদাসদের আড্ডা। তারাই আজ বাকশালী কমিটির ছত্রচ্ছায়ায় দেশে ফিরছে। সমস্ত কিছু ঠিক করে হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।

সে সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের খবরে সে সময়কার জিয়া সরকারের ভিতরে উদ্বিগ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে গিয়েছিল ; আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান)- ওরকমভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর আর্দশের কর্মীরা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেমন একটি সময় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়াকে তৎকালীন জিয়া সরকার মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে তাইশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনকরা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালিন জাতীয় সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না

বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেনশেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।পরদিন মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনজননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জানিয়ে দেন তাঁকে যদি হত্যা করার চেষ্টাও করা হয় তাহলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন গণআকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করেশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনশেখ হাসিনা আসার আগেই তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।

দীর্ঘ 'বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলে লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে তাদের নেত্রীকে বরণ করে নেন। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকেই শহরজুড়ে কেবলি মিছিল আর মিছিল। সেদিন শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা জানাতে ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের ঢাকা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বন্দীশালা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন, সেদিনটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা।  বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।

কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান অবতরণ করবে সেদিকে নজর রেখে লক্ষাধিক মানুষ মধ্যাহ্ন থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকেই বিমানবন্দরে কোন নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। হাজার হাজার মানুষ ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে নিয়োজিত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে প্রথমে দেয়ালের উপর ওঠে। একই সময়ে বিমানবন্দর ভবনের দোতলায় কন্ট্রোল টাওয়ারের যেখানে স্থান করা সম্ভব সেখানেই জনতা উঠে যায়। সবারই উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখা। পুলিশ বারবার চেষ্টা করেও তাদের সরাতে পারে নি। বিমানবন্দরের বাইরে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

সাদা-কালো রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যখন ৪টা ৩২ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে সজ্জিত ট্রাকে নামছিলেন; তখন লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই– 'শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব', 'শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা' 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' বিমান থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত হাসিনাকে নিয়ে আসতে ট্রাকটির ১৫ মিনিট সময় লাগে। সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়। পরিবেশ উচ্ছ্বাসের, পরিবেশ আনন্দে অশ্রু ফেলার। বিমান থেকে নামার আগে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক যখন শেখ হাসিনার গলায় মালা দিচ্ছেলেন, তখন তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা আসার পথেও শেখ হাসিনা পাঁচ-ছয়বার অঝোরে কেঁদেছিলেন।

বিকেল চারটার দিকেই আকাশে কালো মেঘ ছিল। পৌনে পাঁচটায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে মিছির শুরু হবার পরপরই চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। রাত আটটা পর্যন্ত সেদিন মুষলধারে বিরতীহীন বৃষ্টি ঝরেছিল। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেইসাথে তীব্র ঝড়। প্রকৃতি ভয়াল রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। এরই মাঝে ট্রাকে রাস্তার দুপাশের জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান। বর্ষণসিক্ত শেখ হাসিনা ঝড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে যাচ্ছিলেন বনানী হয়ে শেরেবাংলানগরের সভাস্থলে। বনানী গোরস্থানে শেখ হাসিনার মা নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি কান্নায় আকুল ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কবরে শায়িত মাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, আমাকে কেন রেখে গেলে?’

কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত আট মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগার কথা খুব বেশি হলে ত্রিশ মিনিট। প্রায় তিনঘন্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরের সভাস্থলে পৌছিয়েছিলেন। তখনও চারদিক অন্ধকার, মুষলধারে বৃষ্টি। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন তখন প্রায় বিপন্ন, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সভাস্থলে তখনো লক্ষ লক্ষ লোক উপস্থিত।  শেখ হাসিনাকে তারা দেখবেনই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসম্বর্ধনা সভার মঞ্চে এলেন।

লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সমাবেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।"

বক্তৃতাদানের এক পর্যায়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, "আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।"

বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা পাথেয় করে আমি আগামীদিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করে দেবো।

১৭ মে রাতে শেখ হাসিনা ছোট ফুপুর বাসায় ছিলেন। সেই সময়েও শেখ হাসিনাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। বাধ্য হয়েই তিনি তখন কিছুদিন ছোট ফুপুর বাসায়, কিছুদিন মেঝো ফুপুর বাসায় থাকতেন। দেশে ফিরে তিনি ধানমন্ডিতে নিজেদের বাসায় গেলে সেখানে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া মিলাদ পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ধানমন্ডির বাসাটা সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যকেই বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।

১৮ মে সকালে শেখ হাসিনা দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন এবং পরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্জন করেন। ওইদনই বিকেলে তিনি পিতা শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তিনি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বাড়ির গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্রন্দনরত শেখ হাসিনাকে অনেকে সান্ত্বনা দেন। তিনি সেখানে সমাধিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের  মাজার  জিয়ারত করেন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

২০ মে গোপালগঞ্জের ঈদগাঁ ময়দানে মেখ হাসিনার সম্মানার্থে এক গণসম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল।   সেই সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংষার করছিলাম। আপনাদের ডাকে সবকিছু ছেড়ে এসেছি। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার জীবর দান করতে চাই।তিনি আরো বলেছিলেন, “গত ছয় বছরে দেশের মানুষের কোনরকম উন্নতি তো আমি দেখি নি। মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কৃষক-শ্রমিক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য পাচ্ছে না।তিনি উত্তাল জসমুদ্রের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, “তবে কেন বঙ্গবন্থু, শেখ মনি চার নেতাকে হত্যা করা হলো?”

লেখক: . আবুল হাসনাৎ মিল্টন: সভাপতি, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাৎপর্যপূর্ণ


Thumbnail

আজ ১৭ মে, প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৪৩তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা খুনিদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।

পশ্চিম জার্মানি থেকে সেই সময় ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন শেখ হাসিনার স্বামী পরমানু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া। ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লি পৌছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান।

বিমানন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। সেখানে কারো সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরিচয় না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাদের। সেই সময় ভারতীয় পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোন খবরাখবর ছাপা হচ্ছিল না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একরকম অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। দিল্লিতে পৌছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানে শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের পুরো ঘটনা জানতে পারেন।

১৯৭৯ ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে। আব্দুর রাজ্জাক কাবুলে যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং যুবনেতা আমির হোসেন আমু দিল্লিতে যান। তাদের সবার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিতে রাজি করানো।

পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ১৬ ফেব্রয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ ২৪ ফেব্রæয়ারি আব্দুল মালেক উকিল, . কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ঢাকা থেকে দিল্লিতে পৌছান। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করেন তারা।

দেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে রাতে দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তখনকার রাজনীতির মতোই প্রকৃতিও সেদিন ছিল ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ছিল কালবৈশাখী হাওয়া, বেগ ছিল ঘন্টায় ৬৫ মাইল। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও সেদিন গতিরোঘ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল।

মুষলধারে বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন নেত্রী কখন আসবেন এই প্রতীক্ষায়। অবশেষে বিকাল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জনসমুদ্রের জোয়ারে এসে পৌছান শেখ হাসিনা। তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।

তখন স্বাধীনতার অমর শ্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনীতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কন্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল-পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।

আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল-সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।

তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। তিনি আরো বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত¡ থেকে বঞ্চিত হয়। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার; বঙ্গবন্ধু হত্যা জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হৃত গণতান্ত্রীক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মানবতার জননী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে; যা মোটেও সহজ কাজ নয়। এসব একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সম্ভব হচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন, দারিদ্রসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি পরিশ্রমের ফসল। এরই মধ্যে উদ্বোধন হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র, বহুল কাঙ্খিত পদ্মা সেতু এবং ঢাকা মেট্রোরেল। এছাড়া চলমান রয়েছে দেশের মেগা সব প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে আসুন আমরা দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যা হবে জাতির জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণের একমাত্র পথ।

১৯৮১ সালের ১৭ মে তার দুঃসাহদী সিদ্ধান্তের কারণেই আওয়ামী লীগ আজ দল হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত বছর সরকারপ্রধান হতে পারেননি। এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। দলটি আজ তার নেতৃত্বে সামরিক শাসনের স্মৃতি পেছনে ফেলে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। তার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে, জাতি হিসেবে বাঙালিকে এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়।


শেখ হাসিনা   স্বদেশ প্রত্যাবর্তন   সমৃদ্ধ বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন