ইনসাইড থট

বঙ্গবন্ধুর ২১ শে ফেব্রুয়ারি ও বাংলা ভাষা প্রীতি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩


Thumbnail

২১ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম নিবিড়ভাবে জড়িত, সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সঙ্গেও।১৯৫৬, ১৯৬২ এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দিয়ে গেছেন তিনি। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন; সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।’ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন- ‘জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ সিদ্ধান্তটি তিনি আগেই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলা বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করার গুরুদায়িত্বটি অর্পিত হয়েছিল ফারুক চৌধুরীর ওপর। তিনি ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার। ছুটিতে দেশে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, ‘ফারুক, তোমার ছুটি নাই। তোমাকে এখানে কাজ করতে হবে।’ কাজগুলো হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর আসন্ন বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ; বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করতে প্রতিনিধি দল নিয়ে বার্মায় গমন। বার্মা থেকে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু ফারুক চৌধুরীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমার লন্ডন যাওয়া চলবে না। তুমি আমার সাথে নিউইয়র্ক যাবে এবং জাতিসংঘে আমি বাংলায় যে বক্তৃতাটি করব, তাৎক্ষণিকভাবে তুমি সেই বক্তৃতার ইংরেজি ভাষান্তর করবে।’ ফারুক ভাই সুন্দর ইংরেজি বলেন ও লিখেন। প্রথমে ফারুক ভাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তখন পরিস্থিতি সহজ করতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিহার্সাল দাও। বক্তৃতা ভাষান্তরের সময় ভাববে, যেন তুমিই প্রধানমন্ত্রী। তবে পরে কিন্তু তা ভুলে যেও।’

অর্থাৎ সেদিন বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করে দায়িত্ব শেষ করেননি বঙ্গবন্ধু। ইংরেজিতে তা অনুবাদ করে বিশ্বনেতৃবৃন্দকে বোঝানোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এখান থেকে আমরা শিখেছি যে, মাতৃভাষার মর্যাদা আমি রক্ষা করব কিন্তু একইসঙ্গে অনুবাদের মাধ্যমে তার আবেদন অন্যভাষীদের মধ্যেও সঞ্চারিত করব। তবে এর আগে ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত ৭৩ জাতি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা দেন। কারণ তিনি বলতেন ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা, বাংলার ইতিহাস, বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার আবহাওয়া, তাই নিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ।

২.

কেবল স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতিসংঘ কিংবা জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলায় ভাষণ নয়, বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত নয়া চীনের আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন।সে ঘটনা অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং আমার দেখা নয়া চীনে লিপিবদ্ধ রয়েছে। অংশ দুটি নিম্নরূপ- 

ক) ‘শান্তি সম্মেলন শুরু হল। তিনশত আটাত্তর জন সদস্য সাঁইত্রিশটা দেশ থেকে যোগদান করেছে। সাঁইত্রিশটা দেশের পতাকা উড়ছে। শান্তির কপোত একে সমস্ত হলটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক টেবিলে হেডফোন আছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একপাশে বসেছি। বিভিন্ন দেশের নেতারা বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। প্রত্যেক দেশের একজন বা দুইজন সভাপতিত্ব করতেন। বক্তৃতা চলছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও অনেকেই বক্তৃতা করলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।”

বক্তৃতার পর, খন্দকার ইলিয়াস তো আমার গলাই ছাড়ে না। যদিও আমরা পরামর্শ করেই বক্তৃতা ঠিক করেছি। ক্ষিতীশ বাবু পিরোজপুরের লোক ছিলেন, বাংলা গানে মাতিয়ে তুলেছেন। সকলকে বললেন, বাংলা ভাষাই আমাদের গর্ব।...(অসমাপ্ত আত্মজীবনী, অধ্যায় ৭৩)

খ) ‘বাংলা আমার মাতৃভাষা। মাতৃভাষার বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।

পাকিস্তানের কেহই আমরা নিজেদের ঘরোয়া ব্যাপার বক্তৃতায় বলি নাই। কারণ মুসলিম লীগ সরকারের আমলে দেশের যে দুরবস্থা হয়েছে তা প্রকাশ করলে দুনিয়ার লোকের কাছে আমরা ছোট হয়ে যাব। অনেকেই আমাদের জিজ্ঞাসা করলো, ভারত থেকে একজন বাংলায় বক্তৃতা করলেন, আর পাকিস্তান থেকেও একজন বক্তৃতা করলেন, ব্যাপার কী? আমি বললাম, বাংলাদেশ ভাগ হয়ে একভাগ ভারত আর একভাগ পাকিস্তানে পড়েছে। বাংলা ভাষা যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা এ অনেকেই জানে। ঠাকুর দুনিয়ার ‘ট্যাগোর’ নামে পরিচিত। যথেষ্ট সম্মান দুনিয়ার লোক তাকে করে। আমি বললাম, পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ জন লোক এই ভাষায় কথা বলে। এবং দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভাষার অন্যতম ভাষা বাংলা। আমি দেখেছি ম্যাডাম সান ইয়াৎ-সেন খুব ভালো ইংরেজি জানেন, কিন্তু তিনি বক্তৃতা করলেন চীনা ভাষায়। একটা ইংরেজি অক্ষরও তিনি ব্যবহার করেন নাই।’(আমার দেখা নয়া চীন)

আন্তর্জাতিক ফোরামে নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে পরিচিত করার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের- সে কথা স্বীকার করেই বঙ্গবন্ধু চীনের শান্তি সম্মেলনে এবং জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন ও জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। তবে মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন-দিল্লি হয়ে দেশে ফিরে আসার সময়ও তিনি মিডিয়ার সামনে যেমন ইংরেজি ব্যবহার করেছেন তেমনি কথা বলেছেন বাংলাতেও।

৩.

মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান গণপরিষদে সব বাধা অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন।তবে বাংলা ভাষার জন্য তাঁর লড়াই শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকে।তাঁর ওপর তৎকালীন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে ১৪ খণ্ডের বইয়ের মধ্যে প্রকাশিত প্রথম থেকে দশম খণ্ড(২০২১) পর্যন্ত পাঠকের হাতে এসেছে। ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের সময়কাল ১৯৪৮-১৯৫০ এবং দ্বিতীয় খণ্ডের ১৯৫১-১৯৫২ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল থেকে গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন শেখ মুজিব আর ১৯৪৮-৫২ ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার কাল।

এ দু’খণ্ডের গ্রন্থ ছাড়াও ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অংশগ্রহণের প্রমাণ রয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থদ্বয়ে। আরো আছে বিশিষ্টজনদের লেখায় বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্নের কথা। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখায় বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ার প্রসঙ্গ আছে এভাবে- ‘শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটি প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ ‘শুনবেন?’ তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুচকি হেসে বললেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে।আমি সুহরাবর্দী (সোহরাওয়ার্দী) সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ।... দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সুহরাবর্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে।...তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা।... হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলাভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে।

ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞেস করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে, পাক বাংলা। কেউ বলে, পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই, ‘জয়বাংলা’।... ‘জয় বাংলা’ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয় বা সাম্প্রদায়িতকার ঊর্ধ্বে।’

১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় কিন্তু পূর্ববাংলা নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। যার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ওই বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি এবং নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।

১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উদযাপনে যে কর্মসূচি নেয়া হয় তার সঙ্গেও শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা ছিল নিবিড়। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সম্পাদক। ওইদিন সকাল থেকে তিনি সাইকেলে করে গোটা ঢাকা শহরে টহল দিয়ে বেড়ান এবং মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। পরে আরমানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভায় শেখ মুজিব ভাষণ দেন। তাঁর অনুরোধে গাজীউল হক নিজের লেখা গান ‘ভুলবো না’ পরিবেশন করেন। সভায় অন্যান্য স্লোগানের মধ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ সচকিত করে তোলে।

ইতিহাসের এই অর্জন একদিনে সম্ভব হয়নি। আমরা জানি, ভারত বিভাগের পর এই ভূখণ্ডের ছাত্রনেতারা অনুমান করেছিলেন ১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাব’ অনুসারে মুসলমানদের জন্য দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এক রাষ্ট্র পাকিস্তান হওয়ায় বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসবে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বদলে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে।

এজন্য দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের আগস্টে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র একুশ দিনের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর কমরুদ্দিন আহাম্মদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নুরুদ্দিন আহম্মদ, আবদুল অদুদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠা হয়।

এই সংগঠনের কর্মী সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’

অন্যদিকে বাঙালির ভাষা ও কৃষ্টির প্রতি সম্ভাব্য হামলার প্রতিরোধ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক সভায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ সংগঠনটি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে পুনর্গঠিত হয়। সেসময় ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম।

১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ ঢাকা জেলা গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমানসহ যারা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে কাজ করেছে তারাই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লিফলেট ছড়াচ্ছে।’(ভলিউম-১, পৃঃ ৭) ৩ মার্চ গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের সম্মেলনে বাংলা ভাষার অধিকার নিয়ে কথা বলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এই ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন।

পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ১ম খণ্ডের পৃঃ ৭-এ সেই তথ্য আছে। অন্যদিকে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শাসমুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেফতার হই এবং আবদুল ওয়াদুদসহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেফতার হয়।’(পৃঃ-২০৬)

উল্লেখ্য, ভারত ভাগের আগেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৮ মে লাহোরের হায়দ্রবাদে উর্দু সম্মেলনে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের ঘোষণা ছিল ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।’ (দৈনিক আজাদ, ১৮ মে ১৯৪৭)। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর মর্নিং নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে রয়েছে- করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ।

উপরন্তু কায়েদে আযমকে দেওয়া জমিয়ত প্রতিনিধিদের স্মারকলিপিতে ‘পূর্ববঙ্গের জনগণ উর্দুর সমর্থক বলে দাবি করা হয়।’(দৈনিক আজাদ, ২৬ মার্চ ১৯৪৮) ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বাঙালি প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নির্দেশে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে একটি পত্র লেখেন। তাতে বলা হয়, ‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা বাংলা ভাষায় উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করতে চান এবং এর জন্য তাঁর সাহায্য পেলে তাঁরা উপকৃত হবেন।’

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সেই চিঠির জবাব দেননি বরং ভিন্নমত পোষণ করেন যা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত। এছাড়া তৎকালীন প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার প্রাদেশিক পরিষদে ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল পূর্ববাংলায় সরকারি অফিস ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাভাষা চালুর বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং বাংলা আরবি হরফে লেখার পক্ষে জোর প্রস্তাব রাখেন।

১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভায় ভাষার দাবিতে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বানে সম্মিলিত এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন শেখ মুজিব, নইমুদ্দিন আহম্মদ, আবদুর রহমান চৌধুরী। ওইদিন পিকেটিং করেন শামসুল হক, শেখ মুজিব, অলি আহাদ প্রমুখ এবং সে সময় তাঁরা বন্দি হন।

কিন্তু প্রতিবাদ মিছিল বের হয় দুপুর দুটোর দিকে। ১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমন উপলক্ষে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ১৫ মার্চ ১৯৪৮। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নেন কিন্তু এসব ছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের রাজনৈতিক চাল। কারণ তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করেছিলেন।

জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এসে রেসকোর্স ময়দানে সদম্ভে ঘোষণা করে বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন, ‘জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ আমরা প্রায় চার-পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না।’(পৃ ৯৯) জিন্নাহ সাহেব একই কথার প্রতিধ্বনি করেন ২৪ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন উৎসবে।

জিন্নাহ সাহেবের সে উক্তির যথাযথ প্রতিবাদ করেন সমবেত ছাত্র-জনতা। তিনি ঢাকা ত্যাগ করে যাবার পর সেদিনকার ঘটনা স্মরণ করে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষা শতকরা ছাপান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি। সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল।’(পৃঃ ৯৯-১০০) তবে তার আগে খাজা নাজিমুদ্দিনের চুক্তি মোতাবেক ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিব প্রমুখরা মুক্তি পান।

পরদিন ১৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভা হয়। সভায় তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন। ভাষার দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে আর সুশীলসমাজ তথা সাহিত্যিকদের যৌক্তিক বয়ানও উপস্থাপিত হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী দিবসে সভাপতির ভাষণে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু না মুসলমান এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য আমরা বাঙালী।এটা কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন, তা মালা-তিলক-টিকি কিংবা লুঙ্গি-টুপি-দাড়িতে ঢাকার জো নেই।’

এই সত্যকে সামনে রেখে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল সর্বধর্ম-বর্ণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে।

১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি ধর্মঘটের মাধ্যমে সমগ্র পূর্ববঙ্গে জুলুম প্রতিরোধ হিসেবে পালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ময়দান সভায় নইমুদ্দিন আহম্মদ সভাপতিত্ব করেন এবং বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিব, আঃ রহমান চৌধুরী প্রমুখ। পরে ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দু’বার গ্রেফতার হন।

১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম।১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দানের সময় শেখ মুজিব বন্দি হন এবং মুক্ত হন ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তার আগে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সমর্থন করায় শেখ মুজিবসহ ২৭ শিক্ষার্থীর ওপর বহিষ্কারাদেশসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি তখন আইনের ছাত্র। তাঁর শাস্তি হয় মুচলেকা এবং ১৫ টাকা জরিমানা, না হয় চূড়ান্ত বহিষ্কার। তিনি মুচলেকা দেননি, তাই বহিষ্কার এবং ছাত্রজীবন পরিসমাপ্ত হয়।

তবে ১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি গোপন দলিলের ২৭ নম্বর ভুক্তিতে ভাষা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কার্যক্রমের কয়েকটি বিষয় লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ ও চালু করার বিষয়ে তিনি তাঁর একাধিক ভাষণে জোর দিয়েছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জেলে। তবে তাঁর সক্রিয় ভ‚মিকা ছিল আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি মুহূর্তেও।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরকালে পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বন্দিদশার ভেতর থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের আলোচনা হয় পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা- (খাজা নাজিমুদ্দীনের ঘোষণার পর) ‘দেশের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হল। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ সকলেই এর তীব্র প্রতিবাদ করে।

আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরো বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না।

পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে।

নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালোবাসত। আরো বললাম, খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি।

তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এসো। আরো দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।’ (পৃ. ১৯৬-৯৭) ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গতিপথ বেয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তব হয়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২:০১ মিনিটে শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যথেষ্ট রক্ত দিয়েছি। আর আমরা শহীদ হওয়ার জন্য জীবন উৎসর্গ করব না এবার আমরা গাজী হব।সাত কোটি মানুষের অধিকার আন্দোলনের শহীদানদের নামে শপথ করছি যে, আমি নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গ করব।’

এই প্রতিজ্ঞা ফলপ্রসূ করতে গিয়ে তথা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে নিয়োজিত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে ৩০৫৩ দিন জেল খেটেছেন। তবু তিনি মাথা নত করেননি অন্যায়ের কাছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মাথা নত না করার প্রত্যয় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া।

অর্থাৎ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পাঠানো চিরকুটে তাঁর নির্দেশ ছিল, ‘বাংলা ভাষার প্রশ্নে কোনো আপস নেই। প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে।’বায়ান্নর পরবর্তী তেপ্পান্নর প্রথম একুশে উদযাপনের বিরাট শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিব।১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করা, পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু একাডেমির মতো পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, বাংলার লোকসাহিত্য ও ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ ইত্যাদি দাবি যুক্ত করা হয়।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৫৩ সালে একুশের একটি আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে। সভাপতিত্ব করেন ড. এনামুল হক। এই সভায় শেখ মুজিব বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলাম, প্রস্তাবিত পাকিস্তানে বাঙালিরা বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হওয়ায় দেশের রাজধানী, নেভাল হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া উচিত। বাংলা ভাষার মতো সেরা ভাষা সারা পাকিস্তানে আর নেই। উর্দুও তার সমকক্ষ নয়। তাই আমরা দাবি করতে পারতাম বাংলাই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আমরা তা করিনি। আজ তারই খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলার দামাল সন্তানদের বুকের রক্ত ঢেলে।’

১৯৫৫ সালে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতা সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও শেখ মুজিব তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘এটা বাংলা ভাষাকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার এক ধাপ মাত্র। এই ভাষা জাতীয় জীবনে ও সরকারি কাজকর্মের সর্বস্তরে ব্যবহার না করা হলে, শিক্ষার মাধ্যম না করা হলে কেবল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কেতাবি স্বীকৃতি দ্বারা কোনো লাভ হবে না’...

১৯৫৬ সালে আইন পরিষদের অধিবেশনে সংসদের কার্যসূচি বাংলায় লিপিবদ্ধ করার আহ্বান জানান। সে বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন।তিনি বাংলাকে ব্যাবহারিক ভাষা করার ওপর জোর দিয়েছিলেন।এরপর তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’ পত্রিকায় নিজের নামে প্রকাশিত প্রবন্ধে লেখেন, ‘মোগলরা ফার্সিকে রাজভাষা করেছিল। সাত’শ বছর তা রাজভাষা হিসেবে চালু থাকলেও জনজীবনে প্রতিষ্ঠা পায়নি। ভারতের মানুষ এক’শ বছরের মধ্যে তা ভুলে গেছে। বাংলাকে তেমন সরকারি ভাষা করলে চলবে না। তার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠা চাই। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক কার্যক্রমে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা দরকার। ওষুধের একটা প্রেসক্রিপশন বাংলায় লেখা যায় না। ভাষার এই দুর্বলতা দূর করা দরকার। আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক কাজকর্মে ফার্সি, উর্দু, আরবির বদলে বাংলা ভাষা ব্যবহার সর্বজনীন করা দরকার।’

আইয়ুবি জামানায় যখন রোমান হরফে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাব উঠেছিল, তখন তিনি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে মিলে সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং সফল হন। ছয় দফা আন্দোলন চলাকালেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নাম আগের বাংলাদেশ রাখার ঘোষণা দেন এবং বলেন, ‘আজ থেকে আমাদের জাতি পরিচয় হবে বাঙালি।’

১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু হবে।’ ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশ জারি করেন। ওই আদেশে বলা হয়, দেশ স্বাধীনের দীর্ঘ তিন বছর পরেও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়।

৪.

মূলত ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিব বর্ষ পেরিয়ে মহিমান্বিত। এজন্য বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা অনিবার্য। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জাতির পিতার অবদানকে স্মরণ করে বিশ্বের কাছে তুলে ধরবার দিনও এটি।বঙ্গবন্ধু বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।সেই প্রচেষ্টা শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও অব্যাহত রয়েছে; কিন্তু শীঘ্রই এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই আমরা।রবীন্দ্রনাথের পর বঙ্গবন্ধু বিশ্বসভায় বাংলাকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছিলেন বলেই আমরা আজ বিদেশে বাঙালি হিসেবে সম্মান পাচ্ছি। যেমন, ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় ভাষণ দেওয়ার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রচলিত হয়েছে ‘বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্ট ডে’ বা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী দিবস’।২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর টবি অ্যান স্ট্যাভিস্কি এই দিনটিকে ‘বাংলাদেশ ইমিগ্রান্ট ডে’হিসেবে রেজ্যুলেশন পাস করার জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি আলবেনিতে অনুষ্ঠিত সিনেট অধিবেশনে বিলটি উপস্থাপন করেন এবং দীর্ঘ শুনানির পর তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত ও স্টেট ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিবছর নিউইয়র্ক স্টেটে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষা প্রীতির কথা স্মরণ করে আরো বিস্তৃত হোক আমাদের একুশের গৌরব।

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

আমার চোখে দেখা ১৭ মে, ১৯৮১


Thumbnail

আমি ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেতে এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করার প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরি। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরার পরে তখন আমি একধরনের দোটানায় ছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। যার কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল তিনি নেই। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে আছেন, তারাও দেশে নেই। আমি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমি হাসপাতালে যাই, কাজ করি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা আমার কাছে আসতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ছাত্রলীগ ও বিএমএ’র জুনিয়র ডাক্তারদের সাথেই তখন আমার সময় কাটে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর নেতৃত্বে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আমার বাসায় আসতো। তাদের সাথে কথা বলে অন্তত পক্ষে এটা মনে হতো যে, ঠিকই দেশে ফিরেছি। কিন্তু তারপরও একটা অপূর্ণতার ভাব ছিল। 

শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় এবং ১৭ মে তিনি দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন দেশের ভেতরে বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় যা শুনতাম তাতে আমার নিজের মনে হতো, তিনি বোধহয় দেশে না আসলেই ভালো হতো। কারণ, আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তখন উৎপন্ন হয়েছিল। আর এই ধারণাটি ছিল, আসার সাথে সাথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে! তাই ভাবলাম অন্তত বিদেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বেঁচে থাকুক এটাই বড় কথা। কিসের রাজনীতি, কিসের কি? বঙ্গবন্ধু নেই। সত্যিকার অর্থে বলা চলে আমি একপ্রকার রাজনীতিবিমুখ ছিলাম তখন।
 
তারপর যখন ১৭ মে আসলো তখন আমি ভাবলাম, এয়ারপোর্টে যাই। এয়ারপোর্টে আমাকে একজন বুদ্ধি দিল, একটু দূরে গাড়ি রেখে হেটে যাওয়ার জন্য। আমি তাই করলাম। তখন প্রথমদিকে খুব বেশি লোকজন নজরে পড়েনি। কিন্তু যখন বিমান নামলো এবং নেত্রী শেখ হাসিনা বিমান থেকে নামলেন তখন চতুর্দিকে হঠাৎ দেখি লক্ষ লক্ষ লোক। আমার তখন চোখ দিয়ে তখন পানি। এখনও তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের প্রতি ভালোবাসা মানুষের যায়নি। 

এর আগে আমার মনে হতো যে, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আর স্বপ্ন দেখতে যদি কেউ ভুলে যায় তাহলে সে মানুষের বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমার সত্যিকার মানসিক অবস্থা তখন এমনই স্বপ্নহীন ছিল। স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন ভালোবাসা দেখে আমার তখন মনে হলো এই বুঝি আবার জীবিত হলাম। তখনও শেখ হাসিনার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি। কারণ সেই সময় তাঁর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। 

মানুষের ভিতরে যে ভাবাবেগ তা পরদিন মানুষের সঙ্গে মিশে বুঝলাম। তখন একটা সুক্ষ্ম মিল আমি খুঁজে পেলাম। তাহলো, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসেন, তখন আমরা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জনগণ যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, আমাদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণতা পেল। ঠিক তেমনি একটা ভাব আমার মনে হল। তখন মাত্র শেখ হাসিনা এসেছেন। শুধুমাত্র তাকে দেখার ফলে জনগণের মধ্যে একটা উজ্জ্বীবিত ভাব এলো। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতারা এদের সবার ভেতরে একটি গণজোয়ারের ভাব লক্ষ্য করা গেল। 

এত বছর পরে আজ আমি বলছি, সেদিন আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এই শেখ হাসিনা নেত্রী শেখ হাসিনা হবেন, দার্শনিক শেখ হাসিনাতে রূপান্তরিত হবেন। এবং তাঁর দর্শন দ্বারা বাংলাদেশে সোনার বাংলা হিসেবে গঠন করতে পারবে। সেদিন আমার মধ্যে আবেগ ছিলোৎ কিন্তু এই চিন্তাগুলো ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে তিনি কীভাবে দেশ গড়েছে তা সমস্ত লোকই জানে। সেই ১৭ মে যে জনসাধারণ তাকে একটু দেখবার জন্য গিয়েছিল, তাদের মনের ভাষা, মুখের ভাব এসব যদি অনুভব করা যায় তাহলে বোঝা যায়, সত্যি বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে সেদিন প্রবেশ করেছিল। এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শীতা এবং দার্শনিক ভিত্তির কারণে জনগণের আশা আকাঙ্খাকে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং বাংলাদেশকে আজ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার দারপ্রান্তে। 

সেই ১৭ মে’র কথা যদি চিন্তা করি, তখন অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে এতোদূর পর্যন্ত দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবে তা চিন্তা করিনি। এখন যেমন তিনি সমস্ত বিশ্বে নন্দিত বিশ্বনেতা। সেই তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সেই ১৭ মে’র কথা আজকে মনে পড়ে। আমি প্রার্থনা করি দার্শনিক শেখ হাসিনাকে যেন সৃষ্টিকর্তা ভালো রাখেন এবং দেশ গড়ার সুযোগ যেন তিনি অনেকদিন পান।  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রত্যাবর্তনের পর সেদিন তিনি যা বলেন


Thumbnail

কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও  তিনি কাঁদছিলেন।  

প্রকৃতিও সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল।  পৌনে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতি তাঁর কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। কুর্মিটোলা থেকে তিনি যান বনানী গোরস্থানে। সেখানে যেয়ে আবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বনানী থেকে তিনি যান শেরে বাংলা নগরে। সেখানে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ জনতা অপেক্ষা করছিল। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বক্তব্য রাখেন।

কি বলেছিলেন তিনি লাখ লাখ জনতার সমাবেশে? হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া ফলাও করে এসব খবর সেদিন কোন পত্রিকা বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। ৪৩ বছর আগের সে সব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াও আজ কষ্টসাধ্য। সেদিনের ভাষণের যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।  

আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই বোন, আরো অনেক প্রিয়জন।  ভাই রাসেল, আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আমি আপনাদের কাছে এসেছি।

বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা নেতা হবার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসাবে, মেয়ে হিসাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসাবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।

আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলার মানুষের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার পরিজন হত্যা করে বলেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমানো ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কি? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দিনে দুপুরে মানুষ খুন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে।  সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না, আর একশ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে।

ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃংখলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তবে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকতো না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তববায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি; আপনাদের ভালবাসা নিয়ে, পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। আপনারা আমার সাথে শপথ করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।  

স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি।

আপনাদের ভালবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।

(তথ্যসূত্র: সংবাদপত্রে শেখ হাসিনার বক্তৃতা: ১৯৮১-১৯৮৬; প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩)


প্রত্যাবর্তন   আওয়ামী লীগ   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে জিয়ার অপতৎপরতা


Thumbnail

আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল।বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।

ওই লিফলেটে আরো লেখা ছিল: “আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তি সংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে।...তিনি আমাদের কর্ম চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।

প্রচারপত্রে আরও বলা হয়েছিল: “...ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।...আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশাজনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে প্রত্যাবর্তন। বাঙালী জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বস্তিতে ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কায় সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শঙ্কিত বোধ করছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরূদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির এক সভায় শেখ হাসিনাকে বিদেশি শক্তির তল্পিবাহক বলে অভিহিত করা হয়। একই দিনে আরেকটি সভা থেকে বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, বাকশালিরা ভারতের গোলাম। তারা বিদেশি সৈন্যের সহায়তায় ক্ষমতায় বসতে চায়। যে দলের প্রধান দিল্লিতে, সে দল জনগণের কল্যান করতে পারে না। সাতাশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুনী মুশতাক গংদের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে বলা হয়েছিল, ইন্দিরার নীলনকশা এখন বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, “৭৫ এর পর তারা দিল্লি লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচেষ্টা চালায়। লন্ডনে জমে ওঠে দিল্লির সেবাদাসদের আড্ডা। তারাই আজ বাকশালী কমিটির ছত্রচ্ছায়ায় দেশে ফিরছে। সমস্ত কিছু ঠিক করে হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।

সে সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের খবরে সে সময়কার জিয়া সরকারের ভিতরে উদ্বিগ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে গিয়েছিল ; আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান)- ওরকমভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর আর্দশের কর্মীরা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেমন একটি সময় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়াকে তৎকালীন জিয়া সরকার মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে তাইশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনকরা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালিন জাতীয় সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না

বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেনশেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।পরদিন মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনজননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জানিয়ে দেন তাঁকে যদি হত্যা করার চেষ্টাও করা হয় তাহলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন গণআকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করেশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনশেখ হাসিনা আসার আগেই তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।

দীর্ঘ 'বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলে লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে তাদের নেত্রীকে বরণ করে নেন। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকেই শহরজুড়ে কেবলি মিছিল আর মিছিল। সেদিন শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা জানাতে ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের ঢাকা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বন্দীশালা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন, সেদিনটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা।  বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।

কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান অবতরণ করবে সেদিকে নজর রেখে লক্ষাধিক মানুষ মধ্যাহ্ন থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকেই বিমানবন্দরে কোন নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। হাজার হাজার মানুষ ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে নিয়োজিত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে প্রথমে দেয়ালের উপর ওঠে। একই সময়ে বিমানবন্দর ভবনের দোতলায় কন্ট্রোল টাওয়ারের যেখানে স্থান করা সম্ভব সেখানেই জনতা উঠে যায়। সবারই উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখা। পুলিশ বারবার চেষ্টা করেও তাদের সরাতে পারে নি। বিমানবন্দরের বাইরে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

সাদা-কালো রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যখন ৪টা ৩২ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে সজ্জিত ট্রাকে নামছিলেন; তখন লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই– 'শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব', 'শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা' 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' বিমান থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত হাসিনাকে নিয়ে আসতে ট্রাকটির ১৫ মিনিট সময় লাগে। সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়। পরিবেশ উচ্ছ্বাসের, পরিবেশ আনন্দে অশ্রু ফেলার। বিমান থেকে নামার আগে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক যখন শেখ হাসিনার গলায় মালা দিচ্ছেলেন, তখন তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা আসার পথেও শেখ হাসিনা পাঁচ-ছয়বার অঝোরে কেঁদেছিলেন।

বিকেল চারটার দিকেই আকাশে কালো মেঘ ছিল। পৌনে পাঁচটায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে মিছির শুরু হবার পরপরই চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। রাত আটটা পর্যন্ত সেদিন মুষলধারে বিরতীহীন বৃষ্টি ঝরেছিল। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেইসাথে তীব্র ঝড়। প্রকৃতি ভয়াল রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। এরই মাঝে ট্রাকে রাস্তার দুপাশের জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান। বর্ষণসিক্ত শেখ হাসিনা ঝড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে যাচ্ছিলেন বনানী হয়ে শেরেবাংলানগরের সভাস্থলে। বনানী গোরস্থানে শেখ হাসিনার মা নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি কান্নায় আকুল ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কবরে শায়িত মাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, আমাকে কেন রেখে গেলে?’

কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত আট মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগার কথা খুব বেশি হলে ত্রিশ মিনিট। প্রায় তিনঘন্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরের সভাস্থলে পৌছিয়েছিলেন। তখনও চারদিক অন্ধকার, মুষলধারে বৃষ্টি। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন তখন প্রায় বিপন্ন, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সভাস্থলে তখনো লক্ষ লক্ষ লোক উপস্থিত।  শেখ হাসিনাকে তারা দেখবেনই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসম্বর্ধনা সভার মঞ্চে এলেন।

লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সমাবেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।"

বক্তৃতাদানের এক পর্যায়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, "আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।"

বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা পাথেয় করে আমি আগামীদিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করে দেবো।

১৭ মে রাতে শেখ হাসিনা ছোট ফুপুর বাসায় ছিলেন। সেই সময়েও শেখ হাসিনাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। বাধ্য হয়েই তিনি তখন কিছুদিন ছোট ফুপুর বাসায়, কিছুদিন মেঝো ফুপুর বাসায় থাকতেন। দেশে ফিরে তিনি ধানমন্ডিতে নিজেদের বাসায় গেলে সেখানে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া মিলাদ পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ধানমন্ডির বাসাটা সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যকেই বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।

১৮ মে সকালে শেখ হাসিনা দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন এবং পরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্জন করেন। ওইদনই বিকেলে তিনি পিতা শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তিনি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বাড়ির গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্রন্দনরত শেখ হাসিনাকে অনেকে সান্ত্বনা দেন। তিনি সেখানে সমাধিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের  মাজার  জিয়ারত করেন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

২০ মে গোপালগঞ্জের ঈদগাঁ ময়দানে মেখ হাসিনার সম্মানার্থে এক গণসম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল।   সেই সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংষার করছিলাম। আপনাদের ডাকে সবকিছু ছেড়ে এসেছি। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার জীবর দান করতে চাই।তিনি আরো বলেছিলেন, “গত ছয় বছরে দেশের মানুষের কোনরকম উন্নতি তো আমি দেখি নি। মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কৃষক-শ্রমিক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য পাচ্ছে না।তিনি উত্তাল জসমুদ্রের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, “তবে কেন বঙ্গবন্থু, শেখ মনি চার নেতাকে হত্যা করা হলো?”

লেখক: . আবুল হাসনাৎ মিল্টন: সভাপতি, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাৎপর্যপূর্ণ


Thumbnail

আজ ১৭ মে, প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৪৩তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা খুনিদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।

পশ্চিম জার্মানি থেকে সেই সময় ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন শেখ হাসিনার স্বামী পরমানু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া। ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লি পৌছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান।

বিমানন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। সেখানে কারো সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরিচয় না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাদের। সেই সময় ভারতীয় পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোন খবরাখবর ছাপা হচ্ছিল না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একরকম অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। দিল্লিতে পৌছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানে শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের পুরো ঘটনা জানতে পারেন।

১৯৭৯ ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে। আব্দুর রাজ্জাক কাবুলে যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং যুবনেতা আমির হোসেন আমু দিল্লিতে যান। তাদের সবার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিতে রাজি করানো।

পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ১৬ ফেব্রয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ ২৪ ফেব্রæয়ারি আব্দুল মালেক উকিল, . কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ঢাকা থেকে দিল্লিতে পৌছান। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করেন তারা।

দেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে রাতে দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তখনকার রাজনীতির মতোই প্রকৃতিও সেদিন ছিল ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ছিল কালবৈশাখী হাওয়া, বেগ ছিল ঘন্টায় ৬৫ মাইল। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও সেদিন গতিরোঘ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল।

মুষলধারে বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন নেত্রী কখন আসবেন এই প্রতীক্ষায়। অবশেষে বিকাল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জনসমুদ্রের জোয়ারে এসে পৌছান শেখ হাসিনা। তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।

তখন স্বাধীনতার অমর শ্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনীতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কন্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল-পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।

আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল-সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।

তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। তিনি আরো বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত¡ থেকে বঞ্চিত হয়। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার; বঙ্গবন্ধু হত্যা জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হৃত গণতান্ত্রীক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মানবতার জননী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে; যা মোটেও সহজ কাজ নয়। এসব একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সম্ভব হচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন, দারিদ্রসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি পরিশ্রমের ফসল। এরই মধ্যে উদ্বোধন হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র, বহুল কাঙ্খিত পদ্মা সেতু এবং ঢাকা মেট্রোরেল। এছাড়া চলমান রয়েছে দেশের মেগা সব প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে আসুন আমরা দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যা হবে জাতির জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণের একমাত্র পথ।

১৯৮১ সালের ১৭ মে তার দুঃসাহদী সিদ্ধান্তের কারণেই আওয়ামী লীগ আজ দল হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত বছর সরকারপ্রধান হতে পারেননি। এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। দলটি আজ তার নেতৃত্বে সামরিক শাসনের স্মৃতি পেছনে ফেলে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। তার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে, জাতি হিসেবে বাঙালিকে এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়।


শেখ হাসিনা   স্বদেশ প্রত্যাবর্তন   সমৃদ্ধ বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার তাৎপর্যময় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন


Thumbnail

১৭ মে বাঙালি জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। তবে শুধু স্মরণীয় বললে হয়ত তার তাৎপর্য ম্লান হতে বাধ্য। ১৯৮১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৬ বছর পর শেখ হাসিনা বাধ্যতামূলক নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ২০০৭ সালে ৭ মে স্বল্প-সময়ের বিদেশ বাসের পর বহু বাধা বিঘ্ন ঠেলে তিনি দেশে ফিরে আসেন; যদিও ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে না আসলে ২০০৭ সালের ৭ মে অপ্রাসঙ্গিক হতো।

এই দুটি উপলক্ষ ছাড়া বহুবার তিনি বিদেশ গিয়েছেন, আবার ফিরেছেন। তবে ঐ দুটি তারিখে তিনি দেশে না আসলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানটি মুসলিমলীগের ন্যায় হয়ত টিম টিম করে বেঁচে থাকত; যার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ হারিয়ে যেত। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশন সম্ভব না হলেও দেশটি একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হতো। রাজাকাররা চিরস্থায়ী রাজা বাদশাহ হয়ে সবার শিরে চেপে বসত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হোত, মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ তিব্বতের দালাইলামার সম-অনুসারী কাঞ্চা ও কাঞ্চিতে রূপান্তরিত হতো। দেশে থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে খুন করা হতো। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকতনা। ক্রমশ: প্রতিটি মানুষ ইসলামাবাদের গোলামে পরিনত হতো, ধর্মের ধ্বজাধারীগণ দেশটা কে চষে বেড়াত, বাংলাভাষা ও জাতি বিলুপ্তির পথে যেত।

দেশে প্রত্যাবর্তনের পর দীর্ঘ সময় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন না। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের উপর এতটা চাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষরা সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন এনে দেশটাকে ইসলামী রিপাবলিকের দিকে ঠেলে দিতে পারেনি। তিনি ফিরে না এলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যেত। আমাদের দেশটা হতো একান্তই সাম্প্রদায়িক দেশ।

শেখ হাসিনা ফিরে না আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান শান্তিটুকুও প্রতিষ্ঠিত হোত না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন হওয়া ছিল অকল্পনীয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা হোত দা-কুড়ালের। আজকে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমরা ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছি। বিশ্বের বুকে একটা মর্যাদাবান জাতি হিসাবে আবির্ভূত হবার কিংবা মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের দিন গনিয়ে আসত না।

আবারও বলছি শেখ হাসিনা দেশে না ফিরলে আওয়ামী লীগের ভাগ্য হোত মুসলিম লীগের ভাগ্য। আর অন্যান্য সব কিছুর আকর হোত এই ক্ষমতাহীনতা। বিষয়টা একটু বিশ্লেষণ করছি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সব রাজনৈতিক দল বিলোপ করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালের ১ আগষ্ট থেকে দেশে ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়। সেই আগষ্টে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনে প্রয়াস নেয়া হয় এবং সাথে শুরু হয় দলীয় উচ্চাসন নিয়ে কামড়া কামড়ি। দলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই জেলে। সে সময় প্রয়োজন ছিল ঐক্যের কিন্তু তখনই দলের শীর্ষ পদ দখলের উলঙ্গ প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়। মোল্লা জালাল ও মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত আহ্বায়ক কমিটি আপোষকামিতা ও তৃণ মূলে অগ্রহণযোগ্যতার কারণে তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ১৯৭৭ সালের ৩রা এপ্রিলের কাউন্সিল অধিবেশনে তদ্রুপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলেও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে একটা দায় সারা গোছের কমিটি করা হয়। তিনি এক বছরও নেতৃত্বে থাকতে পারেন নি। ১৯৭৮ সালের ৩রা মার্চ পূর্বের ন্যায় নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতে মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পুনরায় কাউন্সিলে পূর্ববত অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এবারেও যখন জোড়াতালি দিয়ে কমিটি গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে ও দল ছিন্ন ভিন্ন হবার উপক্রম হয় তখন সাধারণ কর্মীরা শেখ হাসিনার নামে শ্লোগান দিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনাকে দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করে। সেদিন তাকে সভাপতি নির্বাচিত না করলে দল বহুধা বিভক্ত হোত, কেউ মিজান আওয়ামীলীগ, কেউ বাকশাল কিংবা কেউ বা বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে ও তার উত্তরাধিকারীত্ব দাবী করে বহু নামের আওয়ামী লীগ গঠন করে দালালী বলবত রেখে আত্ম—তরক্কি করতে পারত। সেনা আশ্রিত দলে পরোক্ষভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে আশ্্রয় নিতে নিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি নি:শেষ হয়ে যেত। দেশটাতে এমন সেনাশাসন চিরায়ত হয়ে যেত।

শেখ হাসিনা দেশে আসার কারণে তার দল অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পাঁচ পাঁচবার ক্ষমতায় এসেছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্প্রসারিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসায় যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে উল্লাসিত হয়েছিল তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস—চ্যান্সেলর, প্রো—ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার হয়েছে, ব্যাংক বীমার চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টর হয়েছে, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হয়েছে। আরও কত কি? ব্যক্তির পর্যায় ছাড়িয়ে সামষ্ঠিক পর্যায়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি নব মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে।


বিষয়গুলোর একটু গভীরে যাচ্ছি:

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার:

নির্বাসিত জীবন থেকে দলীয় নেতাদের বিশেষ অনুরোধে ও কর্তব্যবোধে তাড়িত হয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এলেন। দেশে ফেরার দিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি ছিল। দুর্যোগ উপেক্ষা করেও বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ তাদের মহান নেতার কন্যাকে দেখতে ও স্বাগত জানাতে ভীড় জমালেন। দেশে ফিরে আসার আগেই তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।

দেশে প্রত্যাবর্তনের ৬ বছরের মাথায় অর্থর্াৎ ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মত নির্বাচিত হলেন ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসলেন। জনস্বার্থ বিবেচনা করে তিনি ১৯৮৮ সালে পদত্যাগও করেন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করা হয়, তিনি সেই জোটের প্রধান ছিলেন। এরশাদ শাসনামলে তিনি বেশ কয়েকবার গৃহবন্দি ছিলেন। শারীরিক আক্রমণের শিকারও হয়েছিলেন। তবুও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯০ সালে ১৫ দলের নেত্রী শেখ হাসিনার প্রচণ্ড গণআন্দোলনে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তার জনপ্রিয়তা ও অনমনীয়তার কারণে সবাই ধরে নিয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন। শতাংশের হারে বেশি ভোট পেয়েও সুক্ষ্ণ কারচুপির কারণে তিনি বিএনপি অপেক্ষা কম সিট পেলেন; যে কারণে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর আকর্ষণীয় পদটি থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। জাতি বঞ্চিত হল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নেতৃত্ব থেকে এবং তার মূল্যও জাতিকে দিতে হলো বহুভাবে। তারপর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন।

জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবার পর শেখ হাসিনা জনমঙ্গল নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অংশ হিসাবে সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত ও পুনর্গঠিত করেন। এ’সব কমিটিতে মন্ত্রীর পরিবর্তে কোন সাংসদকেই চেয়ারম্যান করা হয়ে থাকে।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রশাসন ও নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ফলে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ হ্রাস পেয়েছে ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার:

শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে না আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়—মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হতো। বিচারের প্রক্রিয়াটি ১৯৯১ সালে পুনরায় শুরু হয়। ঘাতক দালাল নিমূর্ল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহবায়িকা ও সদস্য—সচিব নির্বাচনে শেখ হাসিনার সক্রিয় সমর্থন ছিল। আন্দোলনে শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ প্রধান শরিক সংগঠন হিসেবে যোগ দেয়। আন্দোলনকারী শক্তিসমূহ বিশেষতঃ বুদ্ধিজীবীগণ অফুরন্ত অনুপ্রেরণা লাভ করে। শেখ হাসিনা না থাকলে জামায়াতের ন্যায় ক্যাডার ভিত্তিক সশস্ত্র ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই কঠিন ছিল। ১৯৯২ সালেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০১ জন সংসদ সদস্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তা স্পীকারের কাছে পেশ করেন। তার আন্দোলনের ফলশ্রম্নতিতে গণ আদালতের ২৪ জন তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহীর মুক্তি এবং গোলাম আজমের বিচার সহ ৪ দফা প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয়।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি অনতি বিলম্বে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচারের সকল সাংবিধানিক বাধা দূর করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একে একে অভিযুক্তদের বিচার শুরু করেন। আজ পর্যন্ত ১০ জন শীর্ষ মানবতা বিরোধীসহ অনেকের বিচার কাজ একাধিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল প্রায় সকলকেই আদালত মৃত্যু দন্ডাদেশ দিয়েছে, কেউ কেউ কারাবন্ধি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি:

তাঁর প্রথমবারের সরকারের বিশাল অর্জন হচ্ছে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তি এবং সন্তুলারমার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন। এ’গুলো ছিল অনেক পুরানো সমস্যা। পানি সমস্যা পাকিস্তান আমলের আর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রায় ২৪ বছরের পুরানো ছিল। আত্নঘাতি ও ভ্রাতৃঘাতি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছে; স্বাধীনতা—সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছিল এবং বহির্বিশ্বে মানবিক ও অসা¤প্রদায়িক বাঙালির ভাবমূর্তিকে চুরমার করে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সংকট সৃষ্টি করেছিল। শেখ হাসিনা তার কৌশলী নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে এই অঞ্চলকে দেশের মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্তকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। গঙ্গার পানি চুক্তি ও পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্তসহ প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়েছে। শান্তি চুক্তির পাশাপাশি ছিটমহল সমস্যা ও সমুদ্র সীমা সমস্যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও দেশের আয়তন বৃদ্ধি করেছে। আমরা ব্লূ—ইকোনোমির স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পেয়েছি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার:

তার আমলের অপর একটি অর্জন হচ্ছে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল যা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের পথ সুগম করেছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ঘাতকদের বিচার না করে প্রচলিত আদালতেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু ২০০২ সালে বি এন পি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এই বিচারের রায় কার্যকরী না করলেও শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে তা কার্যকরী করেন। জাতির প্রত্যাশা মোতাবেক শেখ হাসিনা বিশেষ আদালতে নিষ্পত্তি না করে প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে বিচার কার্য শেষ করে দূরদর্শিতা নয়, রাষ্ট্র নায়ক সুলভ আচরণের প্রমাণ আরও একবার রাখলেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না আসলে দেশটা হতো মিনি পাকিস্তান। ভাষা—সংস্কৃতি যেত তলিয়ে। শুধু ভাষা সংস্কৃতি রক্ষা নয়, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে জাতিসংঘের ঘোষণা আদায়ও তাঁর অনন্য কৃতিত্ব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা তার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল কিন্তু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার কারণে তার পূর্ণাঙ্গতা দেয়া সম্ভব হয়নি।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও সোহ্রাওয়াদীর্ উদ্যানে স্বাধীনতা স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে। বাঙালির মনন বাংলা একাডেমির কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়াও আত্মিক পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রথম বারের জন্যে বাংলা একাডেমির জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়েছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন:

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা ধরে কাজ শুরু করেছিল। বিশ্বকে পেছনে ফেলে সহস্রাব্দ উন্নয়নের সবক’টি লক্ষ্য মাত্রা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাংলাদেশ অর্জন করেছে। ম্যাক্রো —মাইক্রো অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় অনন্য দক্ষতা দিয়ে তিনি প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রেখেছেন। নিম্নের সারনীতে অর্থনৈতিক চাল—চিত্রের সামান্য পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে ঃ

শিরোনাম

2005-06

2017-18

2022-2023

২০২৪ এর প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রা

জিডিপি প্রবৃদ্ধি

5.40%

7.86%

7.50%

7.97%

মাথাপিছু আয় (মার্কিন ডলারে)

427.00

1751.00

2793

2750.00

জাতীয় সঞ্চয় (জিডিপির শতাংশে)

27.70

29.00

31.00

37.00

বিনিয়োগ (জিডিপির শতাংশে)

24.70

30.50

32.00

37.00

বাজেট (কোটি টাকায়)

64,683.00

4,64,000.00

-

10,00,000.00

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

3.88

34.00

35.00

50.00

রপ্তানী আয় (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

10.05

36.60

55.56

72.00

আমদানি (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

14.70

56.00

-

110.00

দরিদ্র জনংখ্যা (শতকরা হারে)

41.51

21.50

18.13

12.30

অতি দরিদ্র জনসংখ্যা (শতকরা হারে)

25.10

11.30

5.6

4.50

বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা (মেগাওয়াটে)

3,782.00

20,400.00

27500.00

28,000.00

 

সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তার:

দুঃস্থ মানুষের মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দিতে তার সরকার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বহু নির্মাণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। একটি বাড়ি, একটি খামার এক অনন্য কর্মসূচি। বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্যে কর্মসংস্থান ব্যাংক তাদের লেনদেন কাজ শুরু করেছে। বন্যা ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্ম অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করে শেখ হাসিনা দেশি ও বিদেশিদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার প্রথম শাসনামলে যেখানে বিদেশি পত্রিকার পূর্বাভাস ছিল যে আকস্মিক বন্যায় দু’কোটি মানুষ মারা যাবে, সেখানে মালের ক্ষতি মাত্রাতিরিক্ত হলেও মানুষ মরেছে ২ হাজারেরও অনেক কম, তাও কয়জন না খেয়ে মরেছে সে তথ্য বিরোধী পক্ষও উপস্থাপন করতে পারেনি। তিনি দেশে না এলে কি এমনটি হতো?

সামাজিক মঙ্গল:

তাঁর শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে তা পূর্বে কোন আমলে এমনটি হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ ও দুর্ভোগ, স্বদেশের হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, জ্বালাও—পোড়াও এর মধ্যেও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, মানুষের গড় আয়ু ৭৩ —এ ছুঁই ছুঁই করছে, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে প্রতিবেশী ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে, সুপেয় পানীয় জল সরবরাহে ঈর্ষান্বিত সফলতা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যে ভেজাল নিরোধ প্রয়াস ও চিকিৎসা ব্যবস্থা জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছিয়ে দেয়ার কারণে এমনটি অর্জন করেছে। তেমনি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে অন্যান্য ক্ষেত্রে, যার মাঝে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী বাহিনী প্রেরণ অন্যতম।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা:

শেখ হাসিনার প্রথমামলের সরকার ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছিল। সেই কবে ম্যালথাস নামক একজন ধর্মযাজক বলেছিলেন যে, ‘জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে’। আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলাম স্কুল জীবনে এবং এক জাতীয় হতাশা ও নৈরাশ্য আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমার ছেলে বেলায় বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটির মত; আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এখন যা আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি। তখন জন্মের হার ছিল বেশি, শিশু মৃত্যুর হার ছিল বেশী, ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল অনেক কম। বর্তমানে জনসংখ্যা বেড়েছে সেদিনের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ। আবাদী জমির পরিমাণ বিবিধ কারণে অন্ততঃ এক—তৃতীয়াংশ কমেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ৪০ লক্ষ টন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দুটো বন্যা হয়েছে।

পরবর্তীতে দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি উত্তর বঙ্গের মঙ্গা বিতারণ কর্মসূচিকে বেগবান করা হয়। বর্তমানে মঙ্গা ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে পাটের জীবন—বৃত্তান্ত উৎঘাটিত হয়েছে। বিভিন্ন রকমের উচ্চ ফলনশীল ও দ্রুত ফলনশীল খাদ্যের উদ্ভাবন ঘটিয়ে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। একটি বাড়ী — একটি খামার কর্মসূচির পূর্ণসূচনার কারণে এবং ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বন্টন কর্মসূচি খাদ্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। 

ডিজিটাল বাংলাদেশ:

কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দেবেন কিন্তু ২০১৩ সালের মধ্যে সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সব জেলায় ই—সার্ভিস সেন্টার চালু হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল স্বাস্থ্য—সেবা, ই—কমার্স ও ই—গভর্নেন্স উল্লেখযোগ্য হারে চালু হয়েছে। তিন কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছে। আর মোবাইলে থ্রি—জি সেবা চালু করা হয়েছে। এখন আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ; যার রূপায়ন ক্রমশ: দৃশ্যমান হচ্ছে।

শেষ কথা:

শেখ হাসিনা আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। তিনি দেশে ফিরে না এলে তার তেমন কোন ক্ষতি ছিল না। দেশে না ফিরলে তার ব্যক্তি জীবন ও সন্তানদের জীবন মোটামুটি সচ্ছলভাবে চলে যেত। দেশে ফিরে এসে তিনি নিজের জীবন ও সন্তানদের জীবনকে সংকটাপন্ন করেছেন। সংকটাপন্ন করেছেন বোনের জীবন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমন নেতা আছেন কিনা যিনি ২৩ বার হামলার শিকার হয়েও বেঁচে আছেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আল্লাহতায়ালা বঙ্গবন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের গোলামী জিঞ্জির ভাঙার জন্যে আর শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশকে কোন উচ্চতর মাত্রায় পৌছে দিতে।

 

লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন