এডিটর’স মাইন্ড

নির্বাচন বনাম অনির্বাচিত সরকার

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

গত ১৫ নভেম্বর বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন। এবার জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করা হলো এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে। তফসিলের দিন বিএনপি অবরোধ ডেকেছিল। তফসিল ঘোষণার পরদিন ১৬ নভেম্বর কয়েকটি বাম দল হরতাল ডাকে। যদিও এসব অবরোধ এবং হরতাল এখন আর কেউ মানে না, কিন্তু জনমনে কিছুটা হলেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বিএনপি নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখান করেছে। বিএনপির সাথে সুর মিলিয়ে কিছু সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলও এই নির্বাচনী তফসিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে তফসিল ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনী তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছেন। 

গত ২৮ অক্টোবর থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সহিংস আন্দোলন করেছে বিএনপি। ২৮ অক্টোবর থেকেই পুরনো রূপে ফিরে গেছে দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। পুলিশ কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যা করা, হাসপাতাল হামলা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা কোন রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। কিন্তু বিএনপি এরকম সন্ত্রাসী তৎপরতাই বেছে নিয়েছে দাবি আদায়ের জন্য। কিন্তু এপথে যে দাবি আদায় বা সরকারের পতন হবে না এটি বোঝার জন্য পন্ডিত হবার দরকার নেই। শুরুতেই বিএনপির আন্দোলন মুখ থুবড়ে পরেছে। বলা হচ্ছিল তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে বিএনপি চমক দেখাবে। সারাদেশ অচল করে দেবে। কোন কোন গণমাধ্যমে বিএনপি অসহযোগ আন্দোলনের যেতে পারে বলেও খবর দিচ্ছিল। কিন্তু জনগণ সমর্থন না দিলে কঠোর আন্দোলন যে নির্মম কৌতুকে পরিণত হয়, বিএনপির এবারের আন্দোলন তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বিএনপি অবশ্য নিজেদের শক্তিতে কিংবা জনগণের সমর্থনে সরকার পতনের খোয়াব দেখেনি। বরং তারা মনে করতো কোন ম্যাজিক হবে। সাত-সমুদ্দুরের ওপার থেকে কোন দেবদূত আওয়ামী লীগের কল্লা ছিঁড়ে খাবে। গত দুবছর ধরেই এমন আলামত দেখা যাচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপর নাখোশ এমন একটি মনোভাব গত দুবছর ধরেই গুঞ্জারিত হচ্ছিল আকাশে-বাতাসে। 

গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বাংলাদেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘোষণা করেছে ভিসানীতি। গত সেপ্টেম্বরে এই ভিসানীতি কার্যকর হয়েছে বলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হয়। এই সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে ঢাকায় এসেছেন একাধিক মার্কিন প্রতিনিধি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহে আওয়ামী লীগ উৎকণ্ঠিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি সহ একাধিক নেতা বিরক্তি প্রকাশ করতেও কার্পণ্য করেননি। অনেকেই মনে করেন, এবার যুক্তরাষ্ট্র দেখে নেবে। ২০১৪ কিংবা ২০১৮’র মতো কোন নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কত প্রকার ও কি কি নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে তার তালিকা বুক পকেটে নিয়ে অনেকে টকশোতে তোলপাড় করেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ কেউ বাংলাদেশে একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। এই যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা তখন তাদের একান্ত অনুগত সুশীল এবং বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তারা তো আরেকটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসছে এই খুশীতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন। সুশীলদের কেউ কেউ নতুন স্যুট টাই পর্যন্ত কিনে ফেলেছিলেন। কিন্তু এতো আয়োজন, এতো মহড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে কিংবা আরো নির্দিষ্ট করে বললে শেখ হাসিনাকে টলাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সংবিধান সম্মত ভাবে নির্বাচনের প্রশ্নে অটল থেকেছে। নানা প্রলোভন হুমকি উপেক্ষা করেছে। শেখ হাসিনা যদি এরকম দৃঢ় এবং আত্মপ্রত্যয়ী না থাকতেন, তাহলে হয়তো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাই হতো না। দেশ এক অনিশ্চয়তার অন্ধকার টানেলে প্রবেশ করতো। বিশেষ করে নির্বাচন তফসিল ঘোষণার আগে পিটার হাসের তৎপরতায় অনেকে শঙ্কিত হয়েছিলেন। ডোনাল্ড লু এর চিঠি নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তফসিল ঘোষণার দিন সকালেও গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের অফিসে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছিল সংলাপ না তফসিল কোনটা আগে। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা সুখের নয়। নির্বাচনের তফসিল পেছানো, তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচন না হওয়া বাংলাদেশে নতুন নয়। 

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারিও একটি জাতীয় নির্বাচন হবার কথা ছিলো। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করে। নির্বাচন পিছিয়ে যায় দুই বছর। কাজেই তফসিল ঘোষণা মানেই নির্বাচন হয়ে যাবে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আগামী ৫০ দিন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খেলা শেষ হয়ে গেছে বলে যদি কেউ মনে করেন তাহলে ভুল করবেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আসলে খেলা শুরু হলো। আগামী ৫০ দিন এদেশে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। বিএনপির হরতাল অবরোধ কেউ মানছে না, তাই তারা হাল ছেড়ে দেবে— এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। ইতোমধ্যেই তারা আন্দোলনকে সন্ত্রাসের চোরাগলিতে নিয়ে গেছে। সামনে তারা চোরাগুপ্তা হামলা, টার্গেট কিলিং বাড়াবে, এটা নিশ্চিত। তাদের অনেক ক্যাডাররাই ঘাপটি মেরে বসে আছে বলে খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে, দীর্ঘ ৫ বছর পর বিএনপি-জামায়াতের প্রকাশ্য প্রেম নতুন শঙ্কা তৈরী করেছে। জামায়াত একটি সশস্ত্র ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠন। এই সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক গুলো জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। এরা যে মাঠে নামবে না, তা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে। নির্বাচনের আগে বড় ধরনের নাশকতা করে বিএনপি-জামায়াত যে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করতে পারে, এই আশঙ্কা অমূলক নয়। জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করা হবে। ভয়ে এবং অনাগ্রহে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাবে না। নির্বাচন হবে প্রশ্নবিদ্ধ। তখনই পশ্চিমারা হৈ চৈ শুরু করবে। নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবে না। সৃষ্টি হবে গ্রহণযোগ্যতার সংকট। এমন পরিকল্পনার কথাও কান পাতলেই শোনা যায়। জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচন প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত বিভক্ত হয়, তাহলে ভোট উৎসব আরো বিবর্ণ হবে। যারা বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়, তাদের টার্গেট ভোটকে তামাশা বানানো। এই নির্বাচনে এরকম এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা হবে। এরকম ঘটনা ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে তারা হস্তক্ষেপে প্ররোচিত করবে তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কি এতো সহজে হাল ছেড়ে দেবে? বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নির্বাচন হবে আর যুক্তরাষ্ট্র তা মেনে নেবে? যুক্তরাষ্ট্র চুপ-চাপ থাকাও অনেক সময় বিপদজ্জনক। 

গত ১০ নভেম্বর দিল্লীতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠক হয়েছে। সেখানে দুই প্রভাবশালী দেশ একমত হয়নি। তাই তফসিল ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতার ভয়ঙ্কর অর্থও থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কি করবে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগামী নির্বাচন শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে হওয়া না হওয়া অনেকটাই নির্ভর করবে মার্কিন মনোভাবের উপর। বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন কৌশলের উপর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে আশার কথা হলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রাম এখন আমাদের একার নয়। ৭১ এর বন্ধুরাও আছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এই লড়াইয়ে কে জেতে তা জানার জন্য অপেক্ষা কতে হবে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। এখন যুদ্ধটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগকে সতর্ক থাকতে হবে। অতি উৎসাহীরা যেন ভোট কারচুপি বা বিনা ভোটে এমপি হবার আত্মঘাতী চেষ্টা না করেন, সেজন্য সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন নিয়ে দেশ দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষ চায় অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে। আবার অসাংবিধানিক যুগে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে। এজন্য তারা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে। অন্যপক্ষ চায়, গণতন্ত্র এবং সংবিধান সুরক্ষা করতে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন এখন আর কোন দলের জয় পরাজয়ের বিষয় নয়। গণতন্ত্র থাকা না থাকার নির্বাচন।

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

স্পর্শকাতর পদে নিয়োগ বিতর্ক ও জবাবদিহি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১০ জুন, ২০২৪


Thumbnail

বেনজীর-আজিজ কার সৃষ্টি—এ নিয়ে এখন রাজনীতির মাঠ গরম। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এখন এই ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে। বিএনপি বলছে, বহু বেনজীর আছে সরকারের ভেতর। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর পদে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের নিয়ে এই বিতর্ক নতুন নয়। আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েও। পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হননি। আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি সময় চেয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে ১৫ দিন সময় দিয়েছে। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে তিনি দুদকে উপস্থিত হবেন কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদকে নিয়েও চলছে বিতর্ক। বিরোধী দল বলছে, ‘আজিজ-বেনজীর সরকারের সৃষ্টি।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘তারা আওয়ামী লীগের কেউ নন। যোগ্যতার বলেই তারা এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাদের অপরাধের দায় সরকার নেবে না।’ আজিজ-বেনজীর বিতর্কের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বরখাস্ত দুই কর্মকর্তার নানা অপকর্মের কাহিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখরোচক বিষয় হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এসব স্পর্শকাতর পদে কীভাবে নিয়োগ হয়? নিয়োগ পাওয়ার পর তারা কী করছেন না করছেন, তার খোঁজ কে রাখে? তারা তো দায়িত্বে থেকেই অপকর্ম করেছেন। সরকার তখন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনেনি কেন? তখনই যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো তারা ‘দানব’ হয়ে উঠত না। আজকে এ ধরনের সমালোচনাও হজম করতে হতো না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে গাজী হাফিজুর রহমান লিকু দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে এসেও তার চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। প্রথম মেয়াদে থাকা অবস্থাতেই তাকে নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন—এমন বিস্তর অভিযোগ আছে। সবাই এসব জানত। তার পরও তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একই পদে। কেন? লিকুর অপকর্মের কাহিনি কি প্রধানমন্ত্রীকে কেউ জানিয়েছিল? তাকে আর দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হবে না, এই পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীকে কেউ দিয়েছিল?

শুধু লিকু নয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস বিভাগের একজন কর্মকর্তার নজিরবিহীন কাণ্ড পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। ওই কর্মকর্তারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নানা রকম অনিয়ম করার সাহস তারা পান কোত্থেকে? যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এ রকম একজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যারা কাজ করেন তাদের সততা, নৈতিকতা ও আদর্শিক অবস্থান প্রশ্নাতীত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এসব স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব নিয়ে অনেকে দুর্নীতির দোকান খুলছেন, স্বেচ্ছাচারিতার মহোৎসব করছেন। কীভাবে তারা ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’ হচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এখনই তাদের চিহ্নিত না করলে ভবিষ্যতে বড় ক্ষতি হবে।

গুরুত্বপূর্ণ পদে ‘ভুল’ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে বিপদে পড়ার ইতিহাস পুরোনো। সব সরকারই চাটুকারদের খপ্পরে পড়েছে। মতলববাজরা সব সরকারকেই বিভ্রান্ত করে গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছে। এতে ওই সরকারেরই সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে। ভুল ব্যক্তিরা দেশ, জনগণ এবং সরকারের জন্য বিপজ্জনক। ইতিহাসে এটি বারবার প্রমাণিত। কিন্তু আমরা ইতিহাস থেকে শিখি না।

খুনি খন্দকার মোশতাক আজীবন অযোগ্য, কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই খুনি ষড়যন্ত্র করেছিলেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এ কথা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবাই জানতেন। কিন্তু তার পরও মোশতাককে স্বাধীনতার পর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করা হয়। তাজউদ্দীনকে হটিয়ে তিনিই হন বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে খুনি মোশতাক নানা ছলাকলা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে আসেন, বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রকারী কখনোই বঙ্গবন্ধুর আপন লোক ছিলেন না। ইতিহাসে নিকৃষ্টতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে যে ইতিহাসধিক্কৃত। খুনি মোশতাক পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কী করেছেন, তা জাতি জানে। ভুল লোককে বিশ্বাস করলে, গুরুত্ব দিলে পরিণতি কী হয়—খুনি মোশতাক সম্ভবত তার সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার বিভিন্ন ভুল লোককে, অযোগ্য, আদর্শহীন, লোভাতুর, মতলববাজদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। এখনো চারপাশে তাকালে দেখা যায় অনেক ভুল লোক নানা ছলাকলা করে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে যাচ্ছেন। তাদের নিয়োগ কীভাবে হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলে না। সবাই গোপনে হা-হুতাশ করে। তারা রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য বিপজ্জনক।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন জিয়াউর রহমান। হত্যা, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জিয়া তার অবৈধ ক্ষমতা পোক্ত করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন প্রতিপক্ষকে। কোনো শত্রু রাখতে চাননি। যে তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম শব্দ উচ্চারণ করেছে, তাকে তিনি ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি কোনো মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে সেনাপ্রধান করেননি। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত এক দুর্নীতিবাজ সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু সেই দুর্নীতিবাজ এরশাদই জিয়াউর রহমানের ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। জিয়াউর রহমান হত্যার পেছনে এরশাদের হাত আছে কি না, তা পরিষ্কার হতো মঞ্জুর হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় পেলে। কিন্তু সেই মামলার রায় আজও হয়নি। এরশাদ তার জীবদ্দশায় এই মামলার রায় বাধাগ্রস্ত করতে সব চেষ্টা করেন। বিএনপিও রহস্যময় কারণে জিয়া হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটনে আগ্রহ দেখায়নি।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিশ্বাস করতেন আমলাদের। রাজনীতিবিদদের তিনি মোটেই আমলে নিতেন না। আমলাদের ওপর নির্ভর করেই তিনি ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। আমলাদের ক্ষমতাবান করেছিলেন। কিন্তু এরশাদের পতনের পর তার প্রিয় দুই আমলা এম কে আনোয়ার ও কেরামত আলী ডিগবাজি দেন। এরশাদভক্ত এই দুই আমলার বিএনপিতে যোগ দিতে সময় লেগেছে এক সপ্তাহের কম। শুধু আমলা কেন, এরশাদের চারপাশে থাকা কোনো চাটুকারই শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকেনি। ডিগবাজি দিয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেমের মতো চাটুকাররা বদলে যেতে সময় নেননি।

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া বিশ্বাস এবং আস্থা রেখেছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ওপর। প্রচণ্ড ক্ষমতাবান মন্ত্রী ছিলেন হুদা। বিরোধী দলকে নোংরা, অশ্লীল এবং কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করাই ছিল তার প্রধান কাজ। এই নাজমুল হুদাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে বোমা ফাটান। সরকারকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। নাজমুল হুদা খালেদা জিয়ার দুর্দিনে তার পাশে থাকেননি। সুদিনে দুর্নীতি করেছেন।

১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন দেশকে একটি সুশাসন দিতে, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে। এ কারণেই তিনি ১৯৯১ সালে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন। এটি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই ভুল ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করার পরিণাম কী হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের অজানা নয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের ভূমিকা কী ছিল, তা ইতিহাস সাক্ষী। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসেছিল বিপুল বিক্রমে। বিএনপি-জামায়াত জোট ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত চেয়েছিল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে। এ কারণে একের পর এক দলীয়করণ করেছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রাষ্ট্রীয় প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছিলেন তারেক রহমান হাওয়া ভবনের মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনকে বানিয়েছিলেন এক তামাশার কেন্দ্র। এম এ আজিজের মতো অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে বিএনপি নিজেদের ক্ষতি করে। ক্ষমতা পোক্ত রাখার জন্য খালেদা জিয়া, তারেক রহমান সাতজনকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো একজন ব্যক্তিত্বহীনকে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন করেছিলেন। খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন, এমন চাটুকার বঙ্গভবনে থাকলে তিনি নিরাপদ। এসব করেই বিএনপি তার সর্বনাশ ডেকে আনে। আজ বিএনপি হাজারবার অনুশোচনা করে কেন তারা মইন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেছিল। ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার বেদনায় অনেকে এখনো আর্তনাদ করে ওঠেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের উদাহরণ অনেক দেওয়া যায়। ভুল ব্যক্তি কখনোই কারও জন্য উপকারী হয় না। তারা নিজের আখের গোছানো ছাড়া কিছুই করতে পারে না। কোনো কাজেই আসে না। ষড়যন্ত্র করে, না হয় বিপদে সটকে পড়ে। ভুল ব্যক্তিরা সবসময় অযোগ্য হয়, আদর্শহীন হয়। তারা কোনো সময় ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকে না, তারা কোনো সময় রুখে দাঁড়ায় না। সুসময়ে তাদের মিষ্টি কথায় মজেছেন তো ঠকেছেন। দুঃসময়ে দেখা যায় তাদের আসল রূপ।

অতীতে ভুল ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ দেওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগ সরকারের কম নয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মতো দুর্নীতিবাজকে নিয়োগ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই সিনহাকে এক-এগারোর সময় দুর্নীতির দায়ে বিচারপতি পদ থেকে অপসারণের জন্য বঙ্গভবনে চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। পরে ড. কামালের কৃপায় তিনি বেঁচে যান। এরকম অবিশ্বাসী, বহুরূপী মানুষ আওয়ামী লীগের চরম ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য, চাটুকার, দুর্নীতিবাজদের নিয়োগদানের প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। কেউ কেউ মনে করতেই পারেন, গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর পদের নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেই হয়। কাজেই এখানে অন্য কারও কিছু করার নেই। আমি এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে একদম একমত নই। এটি প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ নষ্টের আরেকটি ষড়যন্ত্র। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ থাকতেই পারে এবং প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দ এসব নিয়োগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রধানমন্ত্রী যাকে পছন্দ করছেন তার ঠিকুজি উদ্ধার করা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব। কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। যোগ্যতার পাশাপাশি তার আদর্শিক অবস্থান, সততা এবং অতীত কার্যক্রম নিরীক্ষা জরুরি। যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছেন, যারা বিভিন্ন সংস্থায় আছেন তাদের প্রধান কর্তব্য হলো সঠিক, যোগ্য এবং আদর্শবান ব্যক্তিরা এসব পদে যাচ্ছেন কি না, তা নজরদারিতে রাখা। চাটুকারিতা আর ‘জি হুজুর’ না করে সঠিক তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া। লক্ষ রাখা, এমন কোনো ব্যক্তি কোনো পদে যাচ্ছেন না তো, যার ব্যক্তিগত ইমেজ বা অতীত প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব পালনরত ব্যক্তিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি।

আমি মনে করি, যোগ্যতার চেয়ে একজন ব্যক্তির আদর্শিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। একজন সৎ মানুষ অসৎ ব্যক্তির চেয়ে দায়িত্ববান হন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য নিরাপদ নয়। রাজাকারের সন্তানরা কোনো দিন আওয়ামী লীগের পক্ষের হবে না। উচ্চপদে বসলেই তারা সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত করে অস্বস্তিতে ফেলে। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে তা সরকারের জন্যই ক্ষতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বেনজীর তার সর্বশেষ উদাহরণ। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। দেশে এখন সবাই আওয়ামী লীগ। সরকারের পক্ষে চাটুকারিতা করা মতলববাজদের অভাব নেই। আওয়ামী লীগে ভালোর জন্য দায়িত্বশীল এবং সঠিক সমালোচনাকারীদের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। দলে সরকারের মধ্যে এখন সত্য বলার লোকের অভাব। সবাই তোষামোদে ব্যস্ত। কেউ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেন না। ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মতো সাহসী মানুষ এখন নেই বললেই চলে। এর ফলে অযোগ্য, চাটুকার, দুর্নীতিবাজ, আদর্শহীন মতলববাজরা সরকারের চারপাশে ঢুকে পড়েছে বন্যার পানির মতো। সর্বনাশের বীজ বোনা হচ্ছে সবার অলক্ষ্যে।


দুর্নীতি দমন কমিশন   বেনজীর   আজিজ   বিএনপি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ভারতের নির্বাচন থেকে বাংলাদেশ যা শিখতে পারে

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৭ জুন, ২০২৪


Thumbnail

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সারা বিশ্বে এখন চর্চা হচ্ছে। রোববার টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিবেন নরেন্দ্র মোদী। তবে এবার বিজেপি একক ভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। এনডিএ জোটকে নিয়ে দিল্লির মসনদে বসতে হয়েছে নরেন্দ্র মোদীকে। লোকসভা নির্বাচনে জিতেও হেরেছেন মোদী এবং তার দল বিজেপি। অন্যদিকে এই নির্বাচনে কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছে ৯৯ টি আসন। বিজেপির চেয়ে উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলটি অনেক পিছিয়ে। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট নির্বাচনে ২৩৪ টি আসন পায়। আসন বিবেচনায় কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে গেছে। কিন্তু হেরেও নির্বাচনে জয়ের আনন্দ উপভোগ করছে কংগ্রেস এবং তার মিত্ররা। ভারতে জোট সরকারগুলোর ইতিহাস খুব একটা সুখের নয়। জনগণের কাছে তাদের অঙ্গীকার পূরণের চেয়ে, জোটের শরীকদের মন রক্ষায় তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। কথায় কথায়, উঠতে-বসতে শরীকরা ধমক দেয়। সরকার থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দেয়। তাই রোববার গঠিত এনডিএ জোট সরকার কতদিন টিকবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে এই নির্বাচনকে সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের অনবদ্য কাব্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতের নির্বাচন আসলে জনগণের ক্ষমতায়নের বিজয়, গণতন্ত্রের জয়। এক্সিট পোল, জরীপ, পূর্বানুমানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে ভারতের জনগণ। এই নির্বাচন বিজেপি এবং কংগ্রেসের জন্য শিক্ষা। শুধু কংগ্রেস, বিজেপি না সারা বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই নির্বাচন একটি শিক্ষণীয় মডেল। ভারত প্রমাণ করলো গণতন্ত্র কেন সেরা শাসন পদ্ধতি। 

বাংলাদেশে ধুঁকতে থাকা গণতন্ত্রের জন্য এই নির্বাচন দৃষ্টান্ত। এই নির্বাচন থেকে অনেক কিছুই পেতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতি। এই নির্বাচন বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের জন্য শিক্ষণীয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কথাই ধরা যাক। এই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেই পারে। ভারতের নির্বাচন অনেক বিষয়েই আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তা এবং অনুপ্রেরণাও বটে। নির্বাচনের আগে বিজেপি কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোটকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল। অতি আত্ম-বিশ্বাসী বিজেপি নেতারা চারশো আসনের আওয়াজ তুলেছিল। কংগ্রেসের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে গেছে বলেও কৌতুক করেছিলেন ডাক সাইটে বিজেপি নেতারা। রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী হয়েছিলেন উপহাসের পাত্র। কিন্তু ভোটাররা বিজেপির দর্পচূর্ণ করে দিয়েছে। জনগণ বিজেপির দম্ভের জবাব দিয়েছে ভোটের ব্যালটে। অতি অহংকার যে কোন দলের জন্য ক্ষতিকর। এটা ভারতের নির্বাচনের অন্যতম শিক্ষা। টানা চারবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের মধ্যেও অহংকার এবং অতি আত্মবিশ্বাস এখন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিজেপির মতো আওয়ামী লীগের নেতারাও বিরোধী দল নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করেন। আওয়ামী লীগের কারো কারো একমাত্র কর্ম সকাল-সন্ধ্যা বিএনপিকে গালমন্দ করা। কিন্তু জনগণ যে এটা পছন্দ করে না, ভারত তার প্রমাণ। ভারতের নির্বাচন থেকে তাই আওয়ামী লীগকে সংযত হবার শিক্ষা নিতে হবে। কাউকে ছোট ভাবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি থেকে আওয়ামী লীগকে সরে আসতেই হবে। 

গত দশ বছর ভারতে চলেছে ‘মোদী ম্যাজিক’। বিজেপি নয়, নরেন্দ্র মোদীর একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে। মোদী একাই তৃতীয়বার বিজেপিকে ক্ষমতায় আনবে এমন একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিলো দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু তারপরও তারা জোটকে অবহেলা করেনি। জোটের দলগুলোকে উপেক্ষা করেনি। এনডিএ জোটের ছোট ছোট দল গুলোকেও সম্মান দিয়েছে। আত্ম বিশ্বাসী হলেও নিতীশ আর নাইডুকে ইন্ডিয়া জোট থেকে বের করে এনে নিজেদের ছাতার নীচে জায়গা দিয়েছে। যে কারণে সরকার গঠনে কোন রকম ঝুট ঝামেলা হয়নি। আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় এসে, ১৪ দলীয় জোটকে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। মহাজোট বলতে এখন কিছু নাই। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ মহাজোটের শরীকদের নিয়েই মন্ত্রীসভা গঠন করেছিল। ২০১৪ সালেও মহাজোট এবং ১৪ দলীয় জোট আওয়ামী লীগের কাছে ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে জোটে অরুচি শুরু হয় আওয়ামী লীগের। এবছরের নির্বাচনে জোটকেই বিড়ম্বনা মনে করে আওয়ামী লীগ। ১৪ দলকে তো ভিক্ষা দেয়ার মতো কয়েকটি আসন দিয়েছিল। সেখানেও হানা দেয় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ তার আদর্শিক জোটের গুরুত্ব হয়তো নতুন করে অনুভব করবে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের পর। জোটের প্রতি সম্মান শুধু বিজেপি দেখায় নি, কংগ্রেসও দেখিয়েছে। মূলত: ইন্ডিয়া জোটের কারণেই নতুন জীবন পেয়েছে কংগ্রেস। ভারতের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, একক দলীয় রাজনীতির চেয়ে জোটবদ্ধ ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় বন্ধুহীন আওয়ামী লীগ আশা করি, ভারতের পর জোটের গুরুত্ব অনুভব করবে। ছোট ছোট দলগুলোকে কাছে টানবে।

ভারতের নির্বাচনের পর সব থেকে আলোচিত বিষয় ‘মোদী ম্যাজিকের অকার্যকারিতা’। সারা বিশ্বেই আলোচনা হচ্ছে মোদী ম্যাজিক কি শেষ হয়ে গেল? রাজনীতি কোন ম্যাজিক বা আবেগ চিরস্থায়ী না। জনগণের কাছে একটি রাজনৈতিক দলকে জনপ্রিয় হতে হয় কাজ দিয়ে। আওয়ামী লীগের মধ্যে এখন শেখ হাসিনা নির্ভরতা প্রবলভাবে। কংগ্রেস ‘রাহুল গান্ধী’ নির্ভরতা থেকে সরে এসেছে বহু আগেই। এবারের নির্বাচনে বিজেপির ত্রাতা হিসেবে মোদী টনিক কাজে লাগেনি। তাই আওয়ামী লীগকেও শেখ হাসিনা নির্ভরতা থেকে বেরুতে হবে। সংগঠনের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। দলে বিভক্তি দূর করে শক্তিশালী করতে হবে। শৃংখলা ফেরাতে হবে।

আমি মনে করি ভারতের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়। কট্টর হিন্দুত্ববাদকে প্রত্যাখান করেছে ভারতের জনগণ। এই নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের পক্ষে রায় দিয়েছে জনগণ। বাংলাদেশের জনগণও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে হৃদয় থেকে লালন করে। এদেশের মানুষও ধর্ম ভীরু, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মেও নামে বাড়াবাড়ি ঘৃণা করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান দল নিঃসন্দেহে বিএনপি। কিন্তু ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যেন এখন পথ হারা। বিপন্ন মানুষ যেমন বাঁচার জন্য খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, ঠিক তেমনি বিএনপি এখন অস্তিত্বের প্রয়োজনে জামায়াত সহ ধর্মান্ধ, মৌলবাদীদের দিকে আবার ঝুঁকছে। কিন্তু ভারতের নির্বাচন বিএনপিকে জানিয়ে দিলো, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা এই অঞ্চলে নেই। বিএনপি যদি আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করতে ধর্ম কার্ড খেলে তাহলে তা তাদের জন্যই হবে বুমেরাং।

এই নির্বাচন থেকে বিএনপি আশাবাদী হতেই পারে। বিশেষ করে কংগ্রেস যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিএনপি মনে করতেই পারে সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। আন্দোলন এবং সংগঠন গড়ে তোলার অব্যাহত চেষ্টার ফল কংগ্রেস পেলে বিএনপি কেন পাবে না? অবশ্যই পাবে। কিন্তু সেজন্য বিএনপিকে কংগ্রেসের রাজনীতির কিছু বাঁক বদলকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে হবে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন রাহুল গান্ধী। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কংগ্রেস নির্বাচন করে নতুন সভাপতি। এটি কেবল কংগ্রেসের জন্যই ইতিবাচক হয়নি, রাহুল গান্ধীকেও দেয় নতুন জীবন। সাধারণ জনগণ বুঝতে পারেন রাহুল গান্ধী নেতৃত্বের জন্য লালায়িত নন। এতে রাহুল গান্ধী সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরী হয়। আমার বিবেচনায় এটা কংগ্রেসের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। বিএনপির নেতৃত্ব ২০১৪, ২০১৮ এবং এবছরের নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে। এই তিন নির্বাচনেই বেগম জিয়া এবং তারেক জিয়ার সিদ্ধান্ত ও কৌশল ছিলো ভুল। বিএনপির নেতারাও স্বীকার করেন ২০১৪ তে বিএনপি নির্বাচনে গেলে ভালো করতো। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ‘সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের’ যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা গ্রহণ করলে, বিএনপির রাজনীতির আজ এই হাল হতো না। ২০১৮ সালে তাদের মনোনয়ন বাণিজ্য, জামায়াতকে ২০ আসন দেয়া এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট’ গঠন ছিলো আত্মঘাতী রাজনীতি। আর এবছর বিএনপির নির্বাচন বর্জন, তথাকথিত ‘অসহযোগ আন্দোলন বিলাশ’ ছিলো বাস্তবতা বিবর্জিত। একের পর এক ভুল করার পরও বিএনপির নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া এখন অকার্যকর। দলের নেতৃত্ব তারেক জিয়ার হাতে। কিন্তু তিনি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। কোন ব্যর্থতার দায়িত্ব তিনি নেন না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ তিনি ছাড়েন না। তারেক জিয়া বিদেশে বসে কিভাবে দলের প্রধান নেতা সে প্রশ্ন দেশে-বিদেশে। রাহুল গান্ধীর কাছ থেকে তিনি কি শিক্ষা নেবেন? ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে তিনি কি সরে দাঁড়াবেন। বিএনপিকে বাঁচাতে কি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুলভ সাহসী সিদ্ধান্ত নেবেন? নাকি নিজের বিত্ত বৈভবের লোভে তিনি পদ আঁকড়ে থাকবেন। আমরা জানি, লন্ডনে তারেক জিয়া আরাম আয়েশের বিলাসী জীবন কাটান। তার এই রাজকীয় জীবনের অর্থ আসে বিএনপির কল্যাণে। আর একারণেই তিনি পদ ছাড়তে রাজী না। কিন্তু কংগ্রেসের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলে তিনি উপকৃত হবেন, বিএনপি বাঁচবে। এপ্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। রাহুল গান্ধী গত ১০ বছর নিরলস পরিশ্রম করেছেন। ‘পাপ্পু ভাই’ থেকে তিল তিল করে নিজেকে একজন পরিণত রাজনীতিবীদ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তার ‘ভারত জোড়ো’ পদযাত্রা রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গত ১০ বছরে তিনি চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। সামনে থেকে লড়াই করেছেন। রাহুল গান্ধী পালিয়ে থাকেন নি। গ্রেপ্তারের ভয়ে বিদেশে আশ্রয় নেন নি। রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জন্ম, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জন্য শিক্ষা হতে পারে। তারেক জিয়া যদি বিশ্বাস করেন তিনি একজন দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ নন তাহলে তার সামনে দু’টি পথ। যে দুটি পথ রাহুল গান্ধী দেখিয়েছেন। প্রথম পথ হলো বিদেশে থাকা অবস্থায় তিনি দলের নেতৃত্বে থেকে সরে দাঁড়াবেন। দেশে আছেন এমন কাউকে নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন। দ্বিতীয়ত, নেতৃত্ব রাখতে চাইলে তিনি দেশে আসবেন। মামলা মোকাবেলা করবেন। জেলে যাবেন। সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন। একজন রাজনীতিবীদ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবেন। তারেক জিয়াকেই প্রমাণ করতে হবে তিনি রাজনীতিতে দুর্নীতির বরপুত্র নন।

ভারতের নির্বাচনে বিরোধী দল ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এনেছেন। বিজেপি নির্বাচনে ক্ষমতা অপব্যবহার করছে, প্রশাসন, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে বিস্তর অভিযোগ ছিলো বিরোধী পক্ষের। বিরোধী নেতাদের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়েছে, মামলা হয়েছে। ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম শরিক আম-আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল নির্বাচনের আগে। এসব নানা অভিযোগের পরও বিরোধী দল নির্বাচনের মাঠ ছাড়েনি। নির্বাচন বর্জন করেনি। প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। মাটি কামড়ে থেকেছে। বাংলাদেশের বিরোধী দল গুলোর জন্য এটি একটি বড় শিক্ষা। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণের শক্তির উপর আস্থা রাখতে হয়। অন্যায় অত্যাচারের জবাব দেয়ার একমাত্র উপায় হলো ভোট। ভোটে আস্থা না রাখা মানে গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারানো। বিএনপি সহ বিরোধী দল গুলো বিগত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দু’টিতেই ভোট বর্জন করে। তারা জনগণের শক্তির উপর আস্থা রাখতে পারেনি। বিশেষ করে এবারের নির্বাচন বর্জন ছিলো বিএনপির গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সব প্রভাবশালী দেশ গুলো চেয়েছিল নির্বাচন হোক অংশগ্রহণমূলক। নির্বাচনে যেন কারচুপি, পক্ষপাত এবং অনিয়ম না হয় সেজন্য তারা নানারকম চাপ দিয়েছিল সরকারকে। এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার একটি সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিলো প্রধানমন্ত্রীর। যেকোন মূল্যে একটি সুন্দর নির্বাচন করার ব্যাপারে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বিএনপি এবং বিরোধী দল গুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ভারতের নির্বাচনের ফলাফলের পর কি তারা একটুও অনুতপ্ত নন? 

ভারতের নির্বাচন আওয়ামী লীগ বিএনপি সহ সব রাজনৈতিক দলগুলোকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা দিলো তা হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদল সম্মিলিত সম্পৃক্ততার ফল। আওয়ামী লীগ একা নির্বাচন করে গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারবে না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন করে গণতন্ত্র ফেরাতে পারবেনা। বিরোধী দল হীন গণতন্ত্র অকার্যকর এবং অর্থহীন। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি ট্রেড ইউনিয়ন নয়। কথায় কথায় ‘খেলবো না’ বলা কোন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণই শেষ কথা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ তা চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিলো। ভারতের নির্বাচন শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের তাবৎ গণতন্ত্রকামী মানুষকে দিয়েছে নতুন আস্থার আলো।

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

১৪ দলে ভাঙনের সুর

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ০৭ জুন, ২০২৪


Thumbnail

১৪ দলকে পুনর্গঠন এবং সক্রিয় করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকে ১৪ দলের নেতাদের মান অভিমান ভাঙানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেন। গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৪ দলের বিভিন্ন নেতারা আবেগঘন কথাবার্তা বলেন, হতাশার কথা বলেন। তাদেরকে কীভাবে অবজ্ঞা, অবহেলা করা হচ্ছে তার ফিরিস্তিও তুলে ধরেন। বিশেষ করে নির্বাচনে ১৪ দলকে উপেক্ষার বিষয়টি সামনে চলে আসে। 

প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ধৈর্য্যের সঙ্গে সবার বক্তব্য শুনেছিলেন। এরপর তিনি ১৪ দলকে সক্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর পরপরই ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে ১৪ দলের নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং তারা বিভিন্ন বিষয়ে ধীরে ধীরে কর্মসূচি পালনের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরমধ্যেই গতকাল বাজেটের পর ১৪ দলের মধ্যে ভাঙনের সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি এই বাজেটের তীব্র সমালোচনা করেছেন। রাশেদ খান মেনন এই বাজেটকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এর ফলে দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিকরা সুবিধা পাবে, সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে। একই রকম অবস্থান গ্রহণ করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনিও এই বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করেছেন। 

অতীতে কোন সময় আওয়ামী লীগের শরিকরা বাজেট নিয়ে সরাসরি ভিন্নমত পোষণ করেনি। বাজেট নিয়ে তাদের ভিন্ন মত তারা জোটের ফোরামে আলোচনা করেছেন এবং সেই অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ চিত্রটা ভিন্ন। বাজেটের পরপরই রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু মুখ খুলেছেন। তারা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই প্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে যে, তাহলে কী ১৪ দল ভেঙে যাচ্ছে? একটি জোটের মধ্যে শরিকরা সরাসরি কী সরকারের অবস্থান বা প্রধান দলের অবস্থানের সমালোচনা করতে পারে? 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেট নিয়ে সমালোচনার সঙ্গে ১৪ দলের ভাঙনের কোন সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব অর্থনৈতিক কৌশল এবং নীতি রয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির একটি অর্থনৈতিক অবস্থান আছে। তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মনে করছে, বাজেট সঠিক হয়নি। অন্যদিকে জাসদও বাজেটকে ইতিবাচকভাবে দেখছে না। সেটা প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু ১৪ দলীয় জোট একটি আদর্শিক জোট। এই জোটের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পৃক্ত রয়েছে। কাজেই আদর্শিক জোট সামান্য ভুল বোঝাবুঝি থেকে ভেঙে যাবে এমনটি মনে করেন না কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষকই। 

তবে এখন যেহেতু জাসদ, সাম্যবাদী দল বা ওয়ার্কার্স পার্টি সরকারে নেই, কাজেই তাদের স্বাধীন অবস্থান রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো ১৪ দলের শরিক সবাই নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়েছেন এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যারা যে দলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবেন সেই দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না, অবস্থান গ্রহণ করতে পারবেন না। সেটা করলে তাহলে তা ‘ফ্লোর ক্রসিং’ হিসেবে বিবেচিত হবে। কাজেই ১৪ দলের শরিকরা যদি শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে বাজেটের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে সেখানে একটি অন্যরকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। 

তবে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল স্বাধীন সত্তা। যে কোন বিষয়ে তাদের মতামত দেওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে তারা বাজেটের পক্ষেই অবস্থান নিবে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা আশা প্রকাশ করেছেন।

১৪ দল   আওয়ামী লীগ   বাজেট   হাসানুল হক ইনু   রাশেদ খান মেনন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ শেষ হয়ে গেল’

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৩ জুন, ২০২৪


Thumbnail

চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ শেষ হয়ে গেল। যারে যেদিকে পাঠাই কেবল চুরি করে।... দুর্নীতি, দুর্নীতি, উহঃ আল্লাহ। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব। এত দুর্নীতিবাজ যে আগে কোথায় ছিল, জানি না।না, এটি সাম্প্রতিককালের কোনো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য নয়। ১৯৭৩ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই মন্তব্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি যেন বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এখন কোনো অনুষ্ঠানে বা জনসভায় একই বক্তব্য দেন, তাহলে তিনিও বিপুল করতালিতে অভিষিক্ত হবেন, সন্দেহ নেই। শুক্রবার রাতে টেলিভিশনে বিমানবন্দরে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনিশ্চিত অপেক্ষায় থাকা মানুষের কান্না দেখেছিলাম। নিজের অজান্তেই কখন অশ্রুসজল হয়েছিলাম, জানি না। এই গরিব মানুষের সঙ্গে কারা প্রতারণা করেছে? সরকারের ভেতরে থাকা কিছু সংসদ সদস্য, তাদের স্ত্রী কন্যা। এই ৩০ হাজার মানুষকে পথে বসানোর দায় কে নেবে? প্রতারিত এই মানুষের আর্তনাদ শুনে বঙ্গবন্ধুর উক্তি মনে পড়ল।

শুধু এই বক্তব্য নয়, বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নে বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। চারপাশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চিৎকার করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলেসোনার বাংলাগড়া সম্ভব হবে না। জাতির পিতা তার জীবদ্দশায় পালিত শেষ স্বাধীনতা দিবসের বক্তব্য দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চের এই বক্তৃতায় দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচন করেন জাতির পিতা।

শুধু আর্থিক অনিয়মকারীরাই নয়, আদর্শচ্যুত মতলববাজদেরও দুর্নীতির সংজ্ঞায় এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ, যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ।

এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। ... ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে। এত চোরের চোর, এই চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে, তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই চোরদের তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।

কে বলে বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য পঁচাত্তরের? মুখে বলুন আর না বলুন-প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এই বক্তব্যের সত্যতা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করেছেন। শুধু জনগণ নয়, তিনিও এখনচাটার গোষ্ঠীরযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। শেখ হাসিনাযারে যেখানে পাঠাচ্ছেন কেবল চুরি করছে সাম্প্রতিককালে আজিজ আহমেদ, বেনজীর আহমেদ, মালয়েশিয়ায় রিক্রুটিং সিন্ডিকেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর চুনোপুঁটি ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের যেসব কেচ্ছা-কাহিনি বেরোচ্ছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যাকেও ইদানীং অসহায় মনে হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এটুকু, বঙ্গবন্ধু তার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান প্রকাশ্যে বলতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে আর্তনাদ করতেন, শেখ হাসিনা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনিনীলকণ্ঠী চারপাশের দুর্নীতিবাজদের অত্যাচার সহ্য করেন, যতক্ষণ না তারা সীমা লঙ্ঘন না করে।

সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের কথাই ধরা যাক। যোগ্যতা, দক্ষতা এবং বিশ্বস্ততার বিবেচনায় বেনজীর তার চাকরি জীবনে সবকিছু পেয়েছেন। চাকরি জীবনের একটা বড় সময় ধরে মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে তার সুনাম ছিল। কিন্তু তিনি পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে যত ওপরের দিকে উঠছেন, ততই বেপরোয়া এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠেছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন তার যে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করছে, তা রীতিমতোরত্নভান্ডার শীর্ষ পদে একজন ব্যক্তি যখন লোভে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন, তখন সরকার বা রাষ্ট্র কী করবে? শীর্ষ পদে গিয়ে লাগামহীন দুর্নীতি একজন ব্যক্তির একান্তই নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তারা রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য ক্ষতিকর।

তবে কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই, সরকার বেনজীরের কথিত দুর্নীতির দায় এড়াতে পারে না। দেশে রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানদার পর্যন্ত সাবেক এই পুলিশপ্রধানের দুর্নীতির কেচ্ছা-কাহিনি জানত। তাহলে সরকার এই অপকর্মের বিন্দু-বিসর্গও জানত না, এটা হতে পারে না। সরকার কি বেনজীর আহমেদকে ভয় পেত? তিনি কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন? নাকি সরকার জেনেশুনে এসব অন্যায় প্রশ্রয় দিয়েছে। সবাই নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। কদিন আগে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বিস্মিত এবং হতবাক। বলছিলেন, ‘চুরি কমবেশি সবাই করে। কিন্তু এটা তো লুণ্ঠন! এতটা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। রকম বক্তব্য অনেকের। তারা বলেছেন, বেনজীরের এই অধ্যায় তাদের অজানা ছিল।

আমি মনে করি, এটি সুশাসন এবং জবাবদিহির ব্যর্থতা। বেনজীর আহমেদকে পুলিশপ্রধান করে কি তাকে পুলিশ বাহিনীর জমিদারি বা ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছিল? তিনি কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন? কেউ কেন তাকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় বেনজীর আহমেদের নাম এসেছিল। কিন্তু সেটিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা চাকরিতে থেকে কীভাবে বোট ক্লাবের হর্তাকর্তা হন, নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু সে প্রশ্ন আমলে নেওয়া হয়নি। সীমা লঙ্ঘনের সব সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর সবার ঘুম ভেঙেছে। এখানেও সন্দেহ। বেনজীর যখন বিদেশে সপরিবারে পালিয়ে গেলেন, তারপর শুরু হলো হৈচৈ? সরকারের ভেতর থেকেই কি কেউ তাকে আগাম তথ্য দিয়েছে? পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে? তার পরও দুদক এবং সরকারের এই অবস্থানকে আমি স্বাগত জানাই। এর ফলে আমাদের দুটি উপকার হলো।

প্রথমত, বেনজীরের বিরুদ্ধে এখনকার তৎপরতা সুস্পষ্টভাবে সবার জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা। অন্যায় করলে একদিন না একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে-এই চিরন্তন সত্যটা সামনে এলো। বেনজীর একজন না। বেনজীর একটি ব্যক্তি না। বেনজীরের মতো বহু বিতর্কিত ব্যক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন বা ছিলেন। বেনজীররা রাষ্ট্রের জন্য দানব। তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। ঘটনা এসব দানবের জন্য একটা সতর্কবার্তা। বেনজীর আহমেদের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে যে কোনো দুর্নীতিবাজের যে কোনো সময় একই পরিণতি হতে পারে।ক্ষমতাজোয়ার-ভাটার মতো। ভাটার সময় কেউ পাশে থাকে না। যেমন বেনজীর, আজিজ, তুষার, লিকুর পাশে কেউ নেই। এর ফলে দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে রাখা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। এই ঘটনার পর শীর্ষপদে দুর্নীতি করার আগে যে কেউ দশবার চিন্তা করবে।

দ্বিতীয়ত, জনগণের বিচার। যে কোনো বিচারের দুটি দিক আছে। একটি আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার, যা দুদক এখন করছে। সাবেক পুলিশপ্রধানের অবৈধ সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনুসন্ধানে যখন সম্পদের অস্বাভাবিক স্ফীতি লক্ষ করেছে, তখন কমিশন আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। দুই দফায় বেনজীর এবং তার পরিবারের বিপুল সম্পদ জব্দ করার আবেদন করেছে। দুদক জুন সাবেক পুলিশপ্রধানকে তলব করেছে। জুন তলব করেছে স্ত্রী সন্তানদের। এভাবেই ধাপে ধাপে আইনি প্রক্রিয়া এগোবে। দুদক তদন্ত শেষে অভিযোগগুলো আদালতে জমা দেবে। চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ, যুক্তি-তর্ক, সাক্ষ্য-প্রমাণের পর বিচারক রায় দেবেন বেনজীর আহমেদ দোষী না নির্দোষ। এর আগে আইনের দৃষ্টিতে তাকে অপরাধী বলা যাবে না। কিন্তু আইনের এই প্রক্রিয়ার বাইরেও একটি বিচার আছে, তা হলো জনভাবনা, জনমত। যেটাকে আমরা বলিপাবলিক ট্রায়াল যে কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের নাগরিক ওই ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব একটি মতামত গ্রহণ করে। জনগণের মধ্যে একটি সামষ্টিক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। আইনের প্রক্রিয়ার আগেই সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কাউকে দোষী বা নির্দোষ হিসেবে রায় দেয়। বেনজীর আহমেদের ব্যাপারে জনরায় তার বিরুদ্ধে। সপ্তাহজুড়ে ঘটনায় জনগণের মধ্যে একটি বিজয়ী ভাব লক্ষণীয়। তারা মনে করে, বেনজীর আহমেদ দুর্নীতিবাজ। দুদকের অ্যাকশনে তারা খুশি। জনতার আদালতে বিচারের আগেই বেনজীর অপরাধী। আমি মনে করি, ধরনের মানুষের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় শাস্তি। এই সামাজিক ঘৃণা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও মানুষের সম্মিলিত কোরাস।

বেনজীর কি একা? তিনিই কি উচ্চপদে থাকা একমাত্র কর্মকর্তা, যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ? না। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন স্তরে রকম অনেক বেনজীর আছেন। যাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি দীর্ঘ। এসব ব্যক্তিকে সবাই চেনে, জানে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, শুধু বেনজীরকে কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে, অন্যরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধেশূন্য সহিষ্ণুতা নীতিঘোষণা করেছে। তাই ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখতে চায় জনগণ। শুধু একটি ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হলে তার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে বলে ধরে নিতে হবে। জনগণ শুধু এক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির তদন্ত চায় না, সব দুর্নীতিবাজের মুখোশ উন্মোচন চায়। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তি চায়, অর্থ পাচারকারীদের বিচার চায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট।

প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও একই রকম বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অপরাধী যত প্রভাবশালী হোন, সরকারের সাপোর্ট পাবে না।বেনজীর আহমেদের ঘটনায় আশাবাদী হয়ে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও তদন্ত দাবি করেছেন কয়েকজন আইনজীবী। তারা দুদকে ব্যাপারে চিঠিও দিয়েছেন। দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় হলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো অবস্থান এখন নানাভাবে দৃশ্যমান।

গত বুধবার (২৯ মে) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুজন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। দুজনের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর। চুক্তি নবায়নের মাত্র চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল করা হলো। অনেকেই মনে করেন, এটাও অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের আরেকটি প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও শুদ্ধি অভিযান হচ্ছে-এমন সংবাদে আমরা আন্দোলিত। কিন্তু আমরা ঘর পোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। বিভিন্ন সময়ে নানা রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে হৈচৈ হয়েছে। তারপর সবকিছু থেমে গেছে। ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় সারা দেশে তোলপাড় হলো। আওয়ামী লীগের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা পদ হারালেন। অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। গণমাধ্যমে কয়েকদিন তাদের অবৈধ বিপুল সম্পদের ফিরিস্তি প্রকাশিত হলো। তারপর সব সুনসান। সে সময় যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের কারও সাজা হয়েছে? নিয়ে কেউ এখন কথা বলে না।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংক লুণ্ঠনের পর ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু কী হয়েছে তার পরিণতি? আমরা কি আবদুল হাই বাচ্চুর কিছু করতে পেরেছি? খেলাপি ঋণ এখন এভারেস্টের চেয়েও উঁচু। কারও কিছু হয়নি।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হলো, এর সঙ্গে জড়িত সরকারের ঘনিষ্ঠরা। যাদের কারণে ৩০ হাজার মানুষ পথে বসল, তাদের কি বিচার হবে? অর্থ পাচার নিয়ে কথা তো কম হলো না। কিন্তু একজন অর্থ পাচারকারীকেও এখনো আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দুই বছর আগে সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু আমলারা এতই ক্ষমতাবান, ১৯৭৯ সালের আইনটি তারা বন্দি করে রেখেছেন। এই আইন যদি কার্যকর থাকত, তাহলে কি বেনজীর এত বেপরোয়া হতেন? দুর্নীতিবাজদের এক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। আগে রাজনীতিবিদরা কিছু দুর্নীতিবাজ পুষতেন। নির্বাচন, রাজনৈতিক খরচ মেটানোর জন্য। এখন দুর্নীতিবাজরা রাজনীতিবিদ পোষেণ, তাদের অবৈধ সম্পদ পাহারা দেওয়ার জন্য। রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ এখন দুর্নীতিবাজদের পালিত, অনুগত। তাই বেনজীর, আজিজ নাটকের সমাপ্তি কোথায়, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিছুদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে আমরা আবার অন্য এক ইস্যুতে ঝাঁপ দেব? দুর্নীতিবাজরা বুক ফুলিয়ে আবার ঘুরে বেড়াবে?

আমরা যেন দুর্নীতির এক দুষ্টচক্রের জালে বন্দি। দুর্নীতির এক বীভৎস প্রতিযোগিতা চলছে দেশজুড়ে। বঙ্গবন্ধুর মতোই প্রধানমন্ত্রী যাকে যে দায়িত্বে দিচ্ছেন, তিনিই যেন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন।চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষশেষ হয়ে যাচ্ছে। কার ওপর আস্থা রাখবেন শেখ হাসিনা?

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


দুর্নীতি   বীভৎস   প্রতিযোগিতা   দেশজুড়ে  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

সরকারের ভেতর কী হচ্ছে?

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ৩১ মে, ২০২৪


Thumbnail

বুধবার (২৯ মে) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর দুইজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাটাই হয়েছেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২, অন্যজন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব। টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল হলো। সাবেক সেনাপ্রধান এবং সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই দুই কর্মকর্তার ছাটাই নানা প্রশ্ন সামনে এনেছে। এটি কী সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের একটি অংশ নাকি অস্থিরতার প্রকাশ? হঠাৎ করেই দুর্নীতির ইস্যু জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে এসেছে। এটি কী সরকারের জন্য চাপ না কৌশলের অংশ? একের পর এক ঘটনার পর আকাশে বাতাসে না প্রশ্ন। সরকারের ভেতর কী হচ্ছে?

টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের বয়স মতে সাড়ে চার মাস। কিন্তু এর মধ্যেই সরকারের ভেতর সমন্বয়হীনতা প্রকট হয়ে উঠেছে। সরকারের কাজ-কর্মে স্ববিরোধিতাও স্পষ্ট। সরকারের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা। কোথায় যেন ছন্দপতন। এর মধ্যেই দুর্নীতির ইস্যু সবার আলোচনার প্রধান বিষয়। সব কিছু কী ঠিক আছে?

২০ মে, সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের কথাই ধরা যাক। এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ঢাকায় চলবে না, এ সিদ্ধান্ত তাকে জানানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বললেন, স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকার একটি উপায় হলো ব্যাটারি চালিত এই অটোরিকশা। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে হুট করে এভাবে রাজধানীতে অটো রিকশা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী। এদের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়নেরও নির্দেশনা দিলেন।  

ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চলে। এগুলোর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, কোন আইন, রুট পারমিট নেই। কীভাবে অটোরিকশা গুলো শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে বিদ্যুৎ সংকটের এই সময়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা গুলো অবৈধভাবে বিপুল বিদ্যুৎ ব্যবহার করতো। এটি বন্ধের জন্য আইন প্রণয়ন এবং ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাকে রাস্তা থেকে প্রত্যাহারের একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু তা না করে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান নেতা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে না। ১৭ মে থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছিলো। হুট করে নেয়া এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অটোরিকশা চালকরা রাজপথে নেমে আসেন। তাদের দাবি, তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন। এটিই তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। অটোরিকশা চালকদের মূল দাবি ছিল যে, বিকল্প ব্যবস্থা না করে অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত তাদেরকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেবে। জীবিকা এবং কর্মসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলবে। এই অবস্থা চলে দুইদিন। দুই দিনের মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে অটোরিকশা চালকদের আন্দোলন বন্ধের জন্য কোন সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে এলেন। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কারণে ঢাকা শহরে একটি আসন্ন শ্রেণী পেশার আন্দোলন থেকে সরকার রক্ষা পেল। প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রী যদি বোঝেন যে, স্বল্প আয়ের মানুষকে কর্মহীন করে হুটহাট এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। তাহলে মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেন বোঝেন না। ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিল? তাহলে কী প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে এরকম অনেক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়?

সরকারের মন্ত্রীরা প্রায় বলেন তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া ভাঁজা মাছটিও উল্টে খান না। বাজারে এমন একটি আবহ তৈরি করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া কোন মন্ত্রী যেন কোন কাজই করেন না। কিন্তু এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে কীভাবে হলো? 

শুধু যে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটছে, তা না। হর হামেশাই সমন্বয়ের সংকট এখন দৃশ্যমান। দেশে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে এখন লুকোচুরি কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছতার নীতি অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। সংসদ সদস্যদের বিনা শুল্কে গাড়ী কেনার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যেই ডিসি-ইউএনওদের জন্য ২৬১ টি বিলাস বহুল গাড়ী কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কার স্বার্থে এই গাড়ী কেনা? কৃচ্ছতা নীতি কী তাহলে আমলাদের জন্য প্রযোজ্য নয়? বিনা প্রয়োজনে বিদেশে না যাওয়ার অনুশাসন দেয়া হয়েছে। অথচ আমলাদের বিদেশ যাত্রার উৎসব অর্থবছরের শেষে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাজেটে বিদেশ ভ্রমণের খাত আছে, তাই টাকা উড়াও। প্রয়োজন থাক আর না থাক। 

টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করা আওয়ামী লীগ সরকারের সমন্বয়ের সংকট ক্রমশ একটি ব্যাধি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কদিন আগেই শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী চাকরির বয়স সীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে একটি চিঠি দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বাড়বে কী কমবে, বা চাকরিতে অবসরের মেয়াদ কত হবে এটি সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে কোথাও ঘোষণা করেনি যে, তারা ক্ষমতায় এলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বৃদ্ধি করবে। কিন্তু হুট করেই তরুণ শিক্ষা মন্ত্রী চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বৃদ্ধির জন্য একটি চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দিলেন। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দলের পরামর্শ ছাড়া এধরনের চিঠি তার সহকর্মীকে নিতে পারে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। একজন মন্ত্রী সরকার পরিচালনায় একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি একদিকে যেমন গোপনীয়তার শপথ নেন। তেমনি পক্ষপাতহীন দায়িত্ব পালনেরও শপথ গ্রহণ করেন। তাই শিক্ষা মন্ত্রী যখন এধরনের কোন চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেন এখন তা সরকারের ভেতর এক ধরনের সমন্বয়হীনতারই প্রকাশ। এই ঘটনার ফলে সরকারি চাকরিতে আগ্রহী তরুণরা উৎসাহিত হয়েছে, তাদের আন্দোলনের গতি বেড়েছে। গত কিছুদিন ধরে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। শিক্ষা মন্ত্রীর প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। সরকার আপাতত চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বাড়ানোর চিন্তা ভাবনা করছে না বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। নানা কারণে এখন সরকার চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে চায় না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক কী ভুল সেটি আলাদা বিষয়। কিন্তু একজন মন্ত্রী, যিনি সরকারের একজন নীতিনির্ধারকও বটে, তিনি সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে চিঠি লিখেন কীভাবে? সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ এ করার ক্ষেত্রে তার অসংখ্য যুক্তি থাকতে পারে। এটি দলীয় ফোরাম বা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি উত্থাপন করতে পারতেন। দলীয় ফোরামে এটি নিয়ে আলোচনা হলেই বিষয়টি সুষ্ঠু এবং গণতান্ত্রিক হতো। এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। কিন্তু মন্ত্রী যখন সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য বিষয়টি প্রকাশ্যে উত্থাপন করেন তখন জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠে সরকারের ভেতর কী হচ্ছে? সরকার কী ফ্রি স্টাইলে চলতে পারে?

সমন্বয়হীনতার এরকম নজীর অনেক। সাম্প্রতিক সময়ে মেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপ করা হবে কি না এ নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এনবিআরের কাছে এক চিঠি লিখে মেট্রোরেলের ভাড়ার উপর এখনই যাতে ভ্যাট আদায় না করা হয় সেজন্য অনুরোধ জানায়। এনবিআর সেই অনুরোধ নাকচ করে দেয়। এনবিআরের বক্তব্য হলো এখন মেট্রোরেল জনপ্রিয় হয়েছে কাজেই এখান থেকে ১৫% হারে ভ্যাট আদায় করাই সঠিক হবে। এনবিআরের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, এনবিআর এর এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে সাংবাদিকদের জানান। এনবিআর আর সেতু মন্ত্রীর লড়াই এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। এবারের বাজেটে এনবিআরের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির জন্য যে সমস্ত প্রস্তাবনা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে মেট্রোরেলে ১৫% ভ্যাটের বিষয়টিও অন্তর্ভূক্ত। এটি জানার পর সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এনবিআরের সিদ্ধান্তকে ভুল হিসেবে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। প্রশ্ন হলো, এনবিআর কি সরকারের বাইরের কিছু? এনবিআর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। সরকারের দুই প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ্য যুদ্ধ কেন? এতে কার লাভ? এর ফলে জনগণের মধ্যে ধারণা হচ্ছে, সরকারের চেইন অব কমান্ড নেই।

এনবিআর এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। এটিই গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এই মত পার্থক্য মাঠে আলোচনার বিষয় না। মত পার্থক্য প্রকাশ্যে বিতর্কেরও কোন বিষয় নয়। এনবিআর বা সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয় কী অনুধাবন করত পেরেছে এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। সরকারের সমন্বয়হীনতা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়। এই বিষয়টি অনেক শোভন এবং সুন্দরভাবে করা যেতে পারতো। এনবিআরের চেয়ারম্যান, অর্থমন্ত্রী, সেতু মন্ত্রী এবং মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আলাদা ভাবে বৈঠক করতে পারতেন। যে যার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারতেন এবং শেষ পর্যন্ত যদি তারা ঐক্যমতে না হয় তাহলে সকলে মিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারতেন। আমাদের সৌভাগ্য হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ, দায়িত্বশীল একজন মানুষ। তিনি দিনরাত ২৪ ঘণ্টা দেশের কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেন। তার একটি অভাবনীয় ক্ষমতা রয়েছে। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়। এরকম একজন প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার পর কেন দু’টি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করে জনগণের বিভ্রান্ত করেন? 

গত ২০ মে মধ্যরাতের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনা প্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে স্যাংশন দেয়। মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, এটি ব্যক্তির বিষয়। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আগেই সরকারকে অবহিত করা হয়েছিল বলেই তিনি উল্লেখ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হবে না। কিন্তু তার পরদিনই হুমকি দিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বললেন, নিশিরাতের স্যাংশনের পরোয়া করি না। আজিজ আহমেদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তাহলে কার বক্তব্য সঠিক? কোনটি সরকারের বক্তব্য? এখন আজিজ আহমেদ বেনজীররকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কথায় বাহাস চলছে। তারা যেন একেকজন ধোঁয়া তুলসীর পাতা। কারো কারো অতি কথনে জাতি বিভ্রান্ত। আসলে কী হচ্ছে?

একটি সরকার সামষ্টিক রূপ। সরকারের মধ্যে বিভিন্ন বিভাগ, মন্ত্রণালয় এবং নানারকম প্রতিষ্ঠান জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমন্বয় থাকা উচিত। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে একে অন্যের মধ্যে সমন্বয় থাকা উচিত এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা জরুরী। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় যদি কেউ তার ভিন্ন মত বা অবস্থান প্রকাশ্যে বলেন সেক্ষেত্রে তার লাভ হতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করে। যেটি এখন আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি। যেমন পেঁয়াজের মজুত কত বা পেঁয়াজের উৎপাদন কত এ নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবের সাথে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব নাই। বাজারে কাঁচা মরিচের দাম হু হু করে বাড়ছে। কাঁচা মরিচের চাহিদা কত তা নিয়ে একেক মন্ত্রণালয়ের একেক হিসেব। বাজার এখন সিন্ডিকেটের দখলে বলে চিৎকার চেঁচামেচি করা হচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেট বন্ধ করা কার দায়িত্ব এবং সিন্ডিকেট বন্ধের জন্য কারা কাজ করবে সেটা নিয়ে এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের ‘পিলো পাসিং’ খেলা চলে। সরকারের মধ্যে যদি ছোট ছোট অনেকগুলো সরকারের উদ্ভব ঘটে তাহলে সেটি বিপজ্জনক। মন্ত্রীরা যদি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে সরকার কে চালায়? 

টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মধ্যে একটি বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা যেকোন সংকট সমাধানের জন্য নিজেরা দায়িত্ব নিচ্ছে না এবং একে অন্যকে দোষারোপ করার একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। আত্মতুষ্টিতে বলীয়ান সরকার বেনজীরের সম্পদ জব্দ করা নিয়েও তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। কিন্তু বেনজীর তো একদিনে এই বিপুল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেনি। তখন তো কেউ কিছু করেনি। এখন এতো হৈ চৈ কেন? সরকার কি নিজের ফাঁদে পা দিচ্ছে? অন্ধকারে সরকার কী লক্ষ্যহীন ভাবে পথ হাতড়াচ্ছে?

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন