মন্তব্য করুন
বেনজীর-আজিজ কার সৃষ্টি—এ নিয়ে এখন রাজনীতির মাঠ গরম। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এখন এই ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে। বিএনপি বলছে, বহু বেনজীর আছে সরকারের ভেতর। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর পদে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের নিয়ে এই বিতর্ক নতুন নয়। আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েও। পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হননি। আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি সময় চেয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে ১৫ দিন সময় দিয়েছে। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে তিনি দুদকে উপস্থিত হবেন কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদকে নিয়েও চলছে বিতর্ক। বিরোধী দল বলছে, ‘আজিজ-বেনজীর সরকারের সৃষ্টি।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘তারা আওয়ামী লীগের কেউ নন। যোগ্যতার বলেই তারা এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাদের অপরাধের দায় সরকার নেবে না।’ আজিজ-বেনজীর বিতর্কের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বরখাস্ত দুই কর্মকর্তার নানা অপকর্মের কাহিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখরোচক বিষয় হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এসব স্পর্শকাতর পদে কীভাবে নিয়োগ হয়? নিয়োগ পাওয়ার পর তারা কী করছেন না করছেন, তার খোঁজ কে রাখে? তারা তো দায়িত্বে থেকেই অপকর্ম করেছেন। সরকার তখন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনেনি কেন? তখনই যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো তারা ‘দানব’ হয়ে উঠত না। আজকে এ ধরনের সমালোচনাও হজম করতে হতো না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে গাজী হাফিজুর রহমান লিকু দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে এসেও তার চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। প্রথম মেয়াদে থাকা অবস্থাতেই তাকে নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন—এমন বিস্তর অভিযোগ আছে। সবাই এসব জানত। তার পরও তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একই পদে। কেন? লিকুর অপকর্মের কাহিনি কি প্রধানমন্ত্রীকে কেউ জানিয়েছিল? তাকে আর দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হবে না, এই পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীকে কেউ দিয়েছিল?
শুধু লিকু নয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস বিভাগের একজন কর্মকর্তার নজিরবিহীন কাণ্ড পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। ওই কর্মকর্তারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নানা রকম অনিয়ম করার সাহস তারা পান কোত্থেকে? যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এ রকম একজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যারা কাজ করেন তাদের সততা, নৈতিকতা ও আদর্শিক অবস্থান প্রশ্নাতীত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এসব স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব নিয়ে অনেকে দুর্নীতির দোকান খুলছেন, স্বেচ্ছাচারিতার মহোৎসব করছেন। কীভাবে তারা ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’ হচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এখনই তাদের চিহ্নিত না করলে ভবিষ্যতে বড় ক্ষতি হবে।
গুরুত্বপূর্ণ পদে ‘ভুল’ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে বিপদে পড়ার ইতিহাস পুরোনো। সব সরকারই চাটুকারদের খপ্পরে পড়েছে। মতলববাজরা সব সরকারকেই বিভ্রান্ত করে গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছে। এতে ওই সরকারেরই সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে। ভুল ব্যক্তিরা দেশ, জনগণ এবং সরকারের জন্য বিপজ্জনক। ইতিহাসে এটি বারবার প্রমাণিত। কিন্তু আমরা ইতিহাস থেকে শিখি না।
খুনি খন্দকার মোশতাক আজীবন অযোগ্য, কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই খুনি ষড়যন্ত্র করেছিলেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এ কথা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবাই জানতেন। কিন্তু তার পরও মোশতাককে স্বাধীনতার পর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করা হয়। তাজউদ্দীনকে হটিয়ে তিনিই হন বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে খুনি মোশতাক নানা ছলাকলা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে আসেন, বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রকারী কখনোই বঙ্গবন্ধুর আপন লোক ছিলেন না। ইতিহাসে নিকৃষ্টতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে যে ইতিহাসধিক্কৃত। খুনি মোশতাক পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কী করেছেন, তা জাতি জানে। ভুল লোককে বিশ্বাস করলে, গুরুত্ব দিলে পরিণতি কী হয়—খুনি মোশতাক সম্ভবত তার সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার বিভিন্ন ভুল লোককে, অযোগ্য, আদর্শহীন, লোভাতুর, মতলববাজদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। এখনো চারপাশে তাকালে দেখা যায় অনেক ভুল লোক নানা ছলাকলা করে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে যাচ্ছেন। তাদের নিয়োগ কীভাবে হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলে না। সবাই গোপনে হা-হুতাশ করে। তারা রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য বিপজ্জনক।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন জিয়াউর রহমান। হত্যা, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জিয়া তার অবৈধ ক্ষমতা পোক্ত করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন প্রতিপক্ষকে। কোনো শত্রু রাখতে চাননি। যে তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম শব্দ উচ্চারণ করেছে, তাকে তিনি ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি কোনো মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে সেনাপ্রধান করেননি। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত এক দুর্নীতিবাজ সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু সেই দুর্নীতিবাজ এরশাদই জিয়াউর রহমানের ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। জিয়াউর রহমান হত্যার পেছনে এরশাদের হাত আছে কি না, তা পরিষ্কার হতো মঞ্জুর হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় পেলে। কিন্তু সেই মামলার রায় আজও হয়নি। এরশাদ তার জীবদ্দশায় এই মামলার রায় বাধাগ্রস্ত করতে সব চেষ্টা করেন। বিএনপিও রহস্যময় কারণে জিয়া হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটনে আগ্রহ দেখায়নি।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিশ্বাস করতেন আমলাদের। রাজনীতিবিদদের তিনি মোটেই আমলে নিতেন না। আমলাদের ওপর নির্ভর করেই তিনি ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। আমলাদের ক্ষমতাবান করেছিলেন। কিন্তু এরশাদের পতনের পর তার প্রিয় দুই আমলা এম কে আনোয়ার ও কেরামত আলী ডিগবাজি দেন। এরশাদভক্ত এই দুই আমলার বিএনপিতে যোগ দিতে সময় লেগেছে এক সপ্তাহের কম। শুধু আমলা কেন, এরশাদের চারপাশে থাকা কোনো চাটুকারই শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকেনি। ডিগবাজি দিয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেমের মতো চাটুকাররা বদলে যেতে সময় নেননি।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া বিশ্বাস এবং আস্থা রেখেছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ওপর। প্রচণ্ড ক্ষমতাবান মন্ত্রী ছিলেন হুদা। বিরোধী দলকে নোংরা, অশ্লীল এবং কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করাই ছিল তার প্রধান কাজ। এই নাজমুল হুদাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে বোমা ফাটান। সরকারকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। নাজমুল হুদা খালেদা জিয়ার দুর্দিনে তার পাশে থাকেননি। সুদিনে দুর্নীতি করেছেন।
১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন দেশকে একটি সুশাসন দিতে, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে। এ কারণেই তিনি ১৯৯১ সালে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন। এটি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই ভুল ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করার পরিণাম কী হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের অজানা নয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের ভূমিকা কী ছিল, তা ইতিহাস সাক্ষী। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসেছিল বিপুল বিক্রমে। বিএনপি-জামায়াত জোট ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত চেয়েছিল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে। এ কারণে একের পর এক দলীয়করণ করেছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রাষ্ট্রীয় প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছিলেন তারেক রহমান হাওয়া ভবনের মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনকে বানিয়েছিলেন এক তামাশার কেন্দ্র। এম এ আজিজের মতো অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে বিএনপি নিজেদের ক্ষতি করে। ক্ষমতা পোক্ত রাখার জন্য খালেদা জিয়া, তারেক রহমান সাতজনকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো একজন ব্যক্তিত্বহীনকে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন করেছিলেন। খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন, এমন চাটুকার বঙ্গভবনে থাকলে তিনি নিরাপদ। এসব করেই বিএনপি তার সর্বনাশ ডেকে আনে। আজ বিএনপি হাজারবার অনুশোচনা করে কেন তারা মইন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেছিল। ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার বেদনায় অনেকে এখনো আর্তনাদ করে ওঠেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের উদাহরণ অনেক দেওয়া যায়। ভুল ব্যক্তি কখনোই কারও জন্য উপকারী হয় না। তারা নিজের আখের গোছানো ছাড়া কিছুই করতে পারে না। কোনো কাজেই আসে না। ষড়যন্ত্র করে, না হয় বিপদে সটকে পড়ে। ভুল ব্যক্তিরা সবসময় অযোগ্য হয়, আদর্শহীন হয়। তারা কোনো সময় ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকে না, তারা কোনো সময় রুখে দাঁড়ায় না। সুসময়ে তাদের মিষ্টি কথায় মজেছেন তো ঠকেছেন। দুঃসময়ে দেখা যায় তাদের আসল রূপ।
অতীতে ভুল ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ দেওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগ সরকারের কম নয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মতো দুর্নীতিবাজকে নিয়োগ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই সিনহাকে এক-এগারোর সময় দুর্নীতির দায়ে বিচারপতি পদ থেকে অপসারণের জন্য বঙ্গভবনে চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। পরে ড. কামালের কৃপায় তিনি বেঁচে যান। এরকম অবিশ্বাসী, বহুরূপী মানুষ আওয়ামী লীগের চরম ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য, চাটুকার, দুর্নীতিবাজদের নিয়োগদানের প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। কেউ কেউ মনে করতেই পারেন, গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর পদের নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেই হয়। কাজেই এখানে অন্য কারও কিছু করার নেই। আমি এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে একদম একমত নই। এটি প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ নষ্টের আরেকটি ষড়যন্ত্র। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ থাকতেই পারে এবং প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দ এসব নিয়োগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রধানমন্ত্রী যাকে পছন্দ করছেন তার ঠিকুজি উদ্ধার করা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব। কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। যোগ্যতার পাশাপাশি তার আদর্শিক অবস্থান, সততা এবং অতীত কার্যক্রম নিরীক্ষা জরুরি। যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছেন, যারা বিভিন্ন সংস্থায় আছেন তাদের প্রধান কর্তব্য হলো সঠিক, যোগ্য এবং আদর্শবান ব্যক্তিরা এসব পদে যাচ্ছেন কি না, তা নজরদারিতে রাখা। চাটুকারিতা আর ‘জি হুজুর’ না করে সঠিক তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া। লক্ষ রাখা, এমন কোনো ব্যক্তি কোনো পদে যাচ্ছেন না তো, যার ব্যক্তিগত ইমেজ বা অতীত প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব পালনরত ব্যক্তিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি।
আমি মনে করি, যোগ্যতার চেয়ে একজন ব্যক্তির আদর্শিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। একজন সৎ মানুষ অসৎ ব্যক্তির চেয়ে দায়িত্ববান হন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য নিরাপদ নয়। রাজাকারের সন্তানরা কোনো দিন আওয়ামী লীগের পক্ষের হবে না। উচ্চপদে বসলেই তারা সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত করে অস্বস্তিতে ফেলে। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে তা সরকারের জন্যই ক্ষতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বেনজীর তার সর্বশেষ উদাহরণ। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। দেশে এখন সবাই আওয়ামী লীগ। সরকারের পক্ষে চাটুকারিতা করা মতলববাজদের অভাব নেই। আওয়ামী লীগে ভালোর জন্য দায়িত্বশীল এবং সঠিক সমালোচনাকারীদের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। দলে সরকারের মধ্যে এখন সত্য বলার লোকের অভাব। সবাই তোষামোদে ব্যস্ত। কেউ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেন না। ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মতো সাহসী মানুষ এখন নেই বললেই চলে। এর ফলে অযোগ্য, চাটুকার, দুর্নীতিবাজ, আদর্শহীন মতলববাজরা সরকারের চারপাশে ঢুকে পড়েছে বন্যার পানির মতো। সর্বনাশের বীজ বোনা হচ্ছে সবার অলক্ষ্যে।
দুর্নীতি দমন কমিশন বেনজীর আজিজ বিএনপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৪ দল আওয়ামী লীগ বাজেট হাসানুল হক ইনু রাশেদ খান মেনন
মন্তব্য করুন
‘চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ শেষ হয়ে গেল। যারে যেদিকে পাঠাই কেবল চুরি করে।... দুর্নীতি, দুর্নীতি, উহঃ আল্লাহ। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব। এত দুর্নীতিবাজ যে আগে কোথায় ছিল, জানি না।’ না, এটি সাম্প্রতিককালের কোনো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য নয়। ১৯৭৩ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই মন্তব্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি যেন বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এখন কোনো অনুষ্ঠানে বা জনসভায় একই বক্তব্য দেন, তাহলে তিনিও বিপুল করতালিতে অভিষিক্ত হবেন, সন্দেহ নেই। শুক্রবার রাতে টেলিভিশনে বিমানবন্দরে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনিশ্চিত অপেক্ষায় থাকা মানুষের কান্না দেখেছিলাম। নিজের অজান্তেই কখন অশ্রুসজল হয়েছিলাম, জানি না। এই গরিব মানুষের সঙ্গে কারা প্রতারণা করেছে? সরকারের ভেতরে থাকা কিছু সংসদ সদস্য, তাদের স্ত্রী ও কন্যা। এই ৩০ হাজার মানুষকে পথে বসানোর দায় কে নেবে? প্রতারিত এই মানুষের আর্তনাদ শুনে বঙ্গবন্ধুর উক্তি মনে পড়ল।
শুধু এই বক্তব্য নয়, বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নে বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। চারপাশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চিৎকার করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ‘সোনার বাংলা’ গড়া সম্ভব হবে না। জাতির পিতা তার জীবদ্দশায় পালিত শেষ স্বাধীনতা দিবসের বক্তব্য দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চের এই বক্তৃতায় দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচন করেন জাতির পিতা।
শুধু আর্থিক অনিয়মকারীরাই নয়, আদর্শচ্যুত মতলববাজদেরও দুর্নীতির সংজ্ঞায় এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ, যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ।
এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। ... ঘরে ঘরে আপনাদের দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। এই দুর্নীতিবাজদের যদি খতম করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দুঃখ চলে যাবে। এত চোরের চোর, এই চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে, তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এই চোরদের তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।’
কে বলে বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য পঁচাত্তরের? মুখে বলুন আর না বলুন-প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এই বক্তব্যের সত্যতা প্রতিমুহূর্তে অনুভব করেছেন। শুধু জনগণ নয়, তিনিও এখন ‘চাটার গোষ্ঠীর’ যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। শেখ হাসিনা ‘যারে যেখানে পাঠাচ্ছেন কেবল চুরি করছে’। সাম্প্রতিককালে আজিজ আহমেদ, বেনজীর আহমেদ, মালয়েশিয়ায় রিক্রুটিং সিন্ডিকেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর চুনোপুঁটি ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের যেসব কেচ্ছা-কাহিনি বেরোচ্ছে, তাতে বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যাকেও ইদানীং অসহায় মনে হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এটুকু, বঙ্গবন্ধু তার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান প্রকাশ্যে বলতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে আর্তনাদ করতেন, শেখ হাসিনা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিনি ‘নীলকণ্ঠী’। চারপাশের দুর্নীতিবাজদের অত্যাচার সহ্য করেন, যতক্ষণ না তারা সীমা লঙ্ঘন না করে।
সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের কথাই ধরা যাক। যোগ্যতা, দক্ষতা এবং বিশ্বস্ততার বিবেচনায় বেনজীর তার চাকরি জীবনে সবকিছু পেয়েছেন। চাকরি জীবনের একটা বড় সময় ধরে মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে তার সুনাম ছিল। কিন্তু তিনি পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে যত ওপরের দিকে উঠছেন, ততই বেপরোয়া এবং দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠেছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন তার যে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করছে, তা রীতিমতো ‘রত্নভান্ডার’। শীর্ষ পদে একজন ব্যক্তি যখন লোভে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন, তখন সরকার বা রাষ্ট্র কী করবে? শীর্ষ পদে গিয়ে লাগামহীন দুর্নীতি একজন ব্যক্তির একান্তই নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তারা রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য ক্ষতিকর।
তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই, সরকার বেনজীরের কথিত দুর্নীতির দায় এড়াতে পারে না। দেশে রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানদার পর্যন্ত সাবেক এই পুলিশপ্রধানের দুর্নীতির কেচ্ছা-কাহিনি জানত। তাহলে সরকার এই অপকর্মের বিন্দু-বিসর্গও জানত না, এটা হতে পারে না। সরকার কি বেনজীর আহমেদকে ভয় পেত? তিনি কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন? নাকি সরকার জেনেশুনে এসব অন্যায় প্রশ্রয় দিয়েছে। সবাই নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। কদিন আগে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বিস্মিত এবং হতবাক। বলছিলেন, ‘চুরি কমবেশি সবাই করে। কিন্তু এটা তো লুণ্ঠন! এতটা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি।’ এ রকম বক্তব্য অনেকের। তারা বলেছেন, বেনজীরের এই অধ্যায় তাদের অজানা ছিল।
আমি মনে করি, এটি সুশাসন এবং জবাবদিহির ব্যর্থতা। বেনজীর আহমেদকে পুলিশপ্রধান করে কি তাকে পুলিশ বাহিনীর জমিদারি বা ঠিকাদারি দেওয়া হয়েছিল? তিনি কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন? কেউ কেন তাকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় বেনজীর আহমেদের নাম এসেছিল। কিন্তু সেটিকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা চাকরিতে থেকে কীভাবে বোট ক্লাবের হর্তাকর্তা হন, এ নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু সে প্রশ্ন আমলে নেওয়া হয়নি। সীমা লঙ্ঘনের সব সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর সবার ঘুম ভেঙেছে। এখানেও সন্দেহ। বেনজীর যখন বিদেশে সপরিবারে পালিয়ে গেলেন, তারপর শুরু হলো হৈচৈ? সরকারের ভেতর থেকেই কি কেউ তাকে আগাম তথ্য দিয়েছে? পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে? তার পরও দুদক এবং সরকারের এই অবস্থানকে আমি স্বাগত জানাই। এর ফলে আমাদের দুটি উপকার হলো।
প্রথমত, বেনজীরের বিরুদ্ধে এখনকার তৎপরতা সুস্পষ্টভাবে সবার জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা। অন্যায় করলে একদিন না একদিন কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে-এই চিরন্তন সত্যটা সামনে এলো। বেনজীর একজন না। বেনজীর একটি ব্যক্তি না। বেনজীরের মতো বহু বিতর্কিত ব্যক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন বা ছিলেন। বেনজীররা রাষ্ট্রের জন্য দানব। তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। এ ঘটনা এসব দানবের জন্য একটা সতর্কবার্তা। বেনজীর আহমেদের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে যে কোনো দুর্নীতিবাজের যে কোনো সময় একই পরিণতি হতে পারে। ‘ক্ষমতা’ জোয়ার-ভাটার মতো। ভাটার সময় কেউ পাশে থাকে না। যেমন বেনজীর, আজিজ, তুষার, লিকুর পাশে কেউ নেই। এর ফলে দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে রাখা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। এই ঘটনার পর শীর্ষপদে দুর্নীতি করার আগে যে কেউ দশবার চিন্তা করবে।
দ্বিতীয়ত, জনগণের বিচার। যে কোনো বিচারের দুটি দিক আছে। একটি আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার, যা দুদক এখন করছে। সাবেক পুলিশপ্রধানের অবৈধ সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনুসন্ধানে যখন সম্পদের অস্বাভাবিক স্ফীতি লক্ষ করেছে, তখন কমিশন আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। দুই দফায় বেনজীর এবং তার পরিবারের বিপুল সম্পদ জব্দ করার আবেদন করেছে। দুদক ৬ জুন সাবেক পুলিশপ্রধানকে তলব করেছে। ৯ জুন তলব করেছে স্ত্রী ও সন্তানদের। এভাবেই ধাপে ধাপে আইনি প্রক্রিয়া এগোবে। দুদক তদন্ত শেষে অভিযোগগুলো আদালতে জমা দেবে। চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ, যুক্তি-তর্ক, সাক্ষ্য-প্রমাণের পর বিচারক রায় দেবেন বেনজীর আহমেদ দোষী না নির্দোষ। এর আগে আইনের দৃষ্টিতে তাকে অপরাধী বলা যাবে না। কিন্তু আইনের এই প্রক্রিয়ার বাইরেও একটি বিচার আছে, তা হলো জনভাবনা, জনমত। যেটাকে আমরা বলি ‘পাবলিক ট্রায়াল’। যে কোনো একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের নাগরিক ওই ঘটনা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব একটি মতামত গ্রহণ করে। জনগণের মধ্যে একটি সামষ্টিক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে। আইনের প্রক্রিয়ার আগেই সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কাউকে দোষী বা নির্দোষ হিসেবে রায় দেয়। বেনজীর আহমেদের ব্যাপারে জনরায় তার বিরুদ্ধে। সপ্তাহজুড়ে এ ঘটনায় জনগণের মধ্যে একটি বিজয়ী ভাব লক্ষণীয়। তারা মনে করে, বেনজীর আহমেদ দুর্নীতিবাজ। দুদকের অ্যাকশনে তারা খুশি। জনতার আদালতে বিচারের আগেই বেনজীর অপরাধী। আমি মনে করি, এ ধরনের মানুষের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় শাস্তি। এই সামাজিক ঘৃণা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও মানুষের সম্মিলিত কোরাস।
বেনজীর কি একা? তিনিই কি উচ্চপদে থাকা একমাত্র কর্মকর্তা, যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ? না। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন স্তরে এ রকম অনেক বেনজীর আছেন। যাদের দুর্নীতির ফিরিস্তি দীর্ঘ। এসব ব্যক্তিকে সবাই চেনে, জানে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, শুধু বেনজীরকে কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে, অন্যরা কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি’ ঘোষণা করেছে। তাই ঘোষণার বাস্তবায়ন দেখতে চায় জনগণ। শুধু একটি ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হলে তার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে বলে ধরে নিতে হবে। জনগণ শুধু এক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির তদন্ত চায় না, সব দুর্নীতিবাজের মুখোশ উন্মোচন চায়। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তি চায়, অর্থ পাচারকারীদের বিচার চায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও একই রকম বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অপরাধী যত প্রভাবশালী হোন, সরকারের সাপোর্ট পাবে না।’ বেনজীর আহমেদের ঘটনায় আশাবাদী হয়ে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও তদন্ত দাবি করেছেন কয়েকজন আইনজীবী। তারা দুদকে এ ব্যাপারে চিঠিও দিয়েছেন। দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় হলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো অবস্থান এখন নানাভাবে দৃশ্যমান।
গত বুধবার (২৯ মে) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুজন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। এ দুজনের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর। চুক্তি নবায়নের মাত্র চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল করা হলো। অনেকেই মনে করেন, এটাও অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের আরেকটি প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও শুদ্ধি অভিযান হচ্ছে-এমন সংবাদে আমরা আন্দোলিত। কিন্তু আমরা ঘর পোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। বিভিন্ন সময়ে নানা রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে হৈচৈ হয়েছে। তারপর সবকিছু থেমে গেছে। ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় সারা দেশে তোলপাড় হলো। আওয়ামী লীগের অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা পদ হারালেন। অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। গণমাধ্যমে কয়েকদিন তাদের অবৈধ বিপুল সম্পদের ফিরিস্তি প্রকাশিত হলো। তারপর সব সুনসান। সে সময় যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের কারও সাজা হয়েছে? এ নিয়ে কেউ এখন কথা বলে না।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংক লুণ্ঠনের পর ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু কী হয়েছে তার পরিণতি? আমরা কি আবদুল হাই বাচ্চুর কিছু করতে পেরেছি? খেলাপি ঋণ এখন এভারেস্টের চেয়েও উঁচু। কারও কিছু হয়নি।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হলো, এর সঙ্গে জড়িত সরকারের ঘনিষ্ঠরা। যাদের কারণে ৩০ হাজার মানুষ পথে বসল, তাদের কি বিচার হবে? অর্থ পাচার নিয়ে কথা তো কম হলো না। কিন্তু একজন অর্থ পাচারকারীকেও এখনো আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দুই বছর আগে সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু আমলারা এতই ক্ষমতাবান, ১৯৭৯ সালের আইনটি তারা বন্দি করে রেখেছেন। এই আইন যদি কার্যকর থাকত, তাহলে কি বেনজীর এত বেপরোয়া হতেন? দুর্নীতিবাজদের এক সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। আগে রাজনীতিবিদরা কিছু দুর্নীতিবাজ পুষতেন। নির্বাচন, রাজনৈতিক খরচ মেটানোর জন্য। এখন দুর্নীতিবাজরা রাজনীতিবিদ পোষেণ, তাদের অবৈধ সম্পদ পাহারা দেওয়ার জন্য। রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ এখন দুর্নীতিবাজদের পালিত, অনুগত। তাই বেনজীর, আজিজ নাটকের সমাপ্তি কোথায়, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিছুদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে আমরা আবার অন্য এক ইস্যুতে ঝাঁপ দেব? দুর্নীতিবাজরা বুক ফুলিয়ে আবার ঘুরে বেড়াবে?
আমরা যেন দুর্নীতির এক দুষ্টচক্রের জালে বন্দি। দুর্নীতির এক বীভৎস প্রতিযোগিতা চলছে দেশজুড়ে। বঙ্গবন্ধুর মতোই প্রধানমন্ত্রী যাকে যে দায়িত্বে দিচ্ছেন, তিনিই যেন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছেন। ‘চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ’ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কার ওপর আস্থা রাখবেন শেখ হাসিনা?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
দুর্নীতি বীভৎস প্রতিযোগিতা দেশজুড়ে
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বেনজীর-আজিজ কার সৃষ্টি—এ নিয়ে এখন রাজনীতির মাঠ গরম। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এখন এই ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে। বিএনপি বলছে, বহু বেনজীর আছে সরকারের ভেতর। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর পদে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের নিয়ে এই বিতর্ক নতুন নয়। আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েও। পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হননি। আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি সময় চেয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে ১৫ দিন সময় দিয়েছে। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে তিনি দুদকে উপস্থিত হবেন কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদকে নিয়েও চলছে বিতর্ক। বিরোধী দল বলছে, ‘আজিজ-বেনজীর সরকারের সৃষ্টি।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘তারা আওয়ামী লীগের কেউ নন। যোগ্যতার বলেই তারা এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাদের অপরাধের দায় সরকার নেবে না।’ আজিজ-বেনজীর বিতর্কের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বরখাস্ত দুই কর্মকর্তার নানা অপকর্মের কাহিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখরোচক বিষয় হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এসব স্পর্শকাতর পদে কীভাবে নিয়োগ হয়? নিয়োগ পাওয়ার পর তারা কী করছেন না করছেন, তার খোঁজ কে রাখে? তারা তো দায়িত্বে থেকেই অপকর্ম করেছেন। সরকার তখন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনেনি কেন? তখনই যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো তারা ‘দানব’ হয়ে উঠত না। আজকে এ ধরনের সমালোচনাও হজম করতে হতো না।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সারা বিশ্বে এখন চর্চা হচ্ছে। রোববার টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিবেন নরেন্দ্র মোদী। তবে এবার বিজেপি একক ভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। এনডিএ জোটকে নিয়ে দিল্লির মসনদে বসতে হয়েছে নরেন্দ্র মোদীকে। লোকসভা নির্বাচনে জিতেও হেরেছেন মোদী এবং তার দল বিজেপি। অন্যদিকে এই নির্বাচনে কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছে ৯৯ টি আসন। বিজেপির চেয়ে উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলটি অনেক পিছিয়ে। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট নির্বাচনে ২৩৪ টি আসন পায়। আসন বিবেচনায় কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে গেছে।
১৪ দলকে পুনর্গঠন এবং সক্রিয় করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকে ১৪ দলের নেতাদের মান অভিমান ভাঙানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেন। গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৪ দলের বিভিন্ন নেতারা আবেগঘন কথাবার্তা বলেন, হতাশার কথা বলেন। তাদেরকে কীভাবে অবজ্ঞা, অবহেলা করা হচ্ছে তার ফিরিস্তিও তুলে ধরেন। বিশেষ করে নির্বাচনে ১৪ দলকে উপেক্ষার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
‘চাটার গোষ্ঠীর যন্ত্রণায় মানুষ শেষ হয়ে গেল। যারে যেদিকে পাঠাই কেবল চুরি করে।... দুর্নীতি, দুর্নীতি, উহঃ আল্লাহ। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাব। এত দুর্নীতিবাজ যে আগে কোথায় ছিল, জানি না।’ না, এটি সাম্প্রতিককালের কোনো রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য নয়। ১৯৭৩ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই মন্তব্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি যেন বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা।
বুধবার (২৯ মে) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর দুইজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাটাই হয়েছেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২, অন্যজন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব। টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল হলো। সাবেক সেনাপ্রধান এবং সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই দুই কর্মকর্তার ছাটাই নানা প্রশ্ন সামনে এনেছে। এটি কী সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের একটি অংশ নাকি অস্থিরতার প্রকাশ? হঠাৎ করেই দুর্নীতির ইস্যু জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে এসেছে। এটি কী সরকারের জন্য চাপ না কৌশলের অংশ? একের পর এক ঘটনার পর আকাশে বাতাসে না প্রশ্ন। সরকারের ভেতর কী হচ্ছে?