নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ১৯ জুন, ২০২১
ভাটি বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের কেন্দ্রস্থলের যে স্থানটিতে `দি আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন` প্রতিষ্ঠিত হয় এ জমিটা সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ`র নিজের ক্রয়কৃত জমি। জানা যায়, ১৯৫৪ সালে ওস্তাদ এখানে ৫৪ শতক জমি ক্রয় করেন। ১৮৬২ সালে শিবপুরে জন্ম নেয়া ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ`র বয়স তখন ৯২ বছর। ধারনা করা হয়, জন্মভূমির তিতাস-মোড়ানো সুন্দরতম মহকুমা শহরের এ জায়গাটিতে তিনি স্হায়ীভাবে বসবাস করতে চেয়েছিলেন। পরে তিনি তাঁর মত পাল্টে ভারতের মাইহার রাজ্যেই স্হায়ী হন। মূলতঃ পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ও নিরাপত্তার প্রশ্নেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নেন বলে আমাদের সংগীত-সংবিৎ গবেষকগন মতামত দেন।
২) এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে বলে রাখা ভালো যে,
সঙ্গীতাঙ্গনটি প্রথম ০৭ বৈশাখ ১৩৮২ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জনাব তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী কর্তৃক উদ্বোধন করা হয়। যাত্রাকালে এর নাম ছিল `সুর সম্রাট শ্রী আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন `। বর্তমানে এখানে একটি মাঝারি সাইজের অডিটোরিয়ামের সাথে একটি পরিপাটি স্হায়ী মঞ্চসহ মোটামুটি নান্দনিকতার আবহে সংস্কৃতি চর্চা চলমান আছে। সংগীতের আসর, কবিতা আবৃত্তি , চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, নাটক, সিনেমাসহ নতুন প্রজন্মের কোলাহলে বলা যায় সারা বছরই মুখরিত থাকে। যদিও এর দৃশ্যমান সম্প্রসারণ বা রূপান্তরিত কোন অবয়ব নেই।
৩) ২০১০ সালে জেলাপ্রশাসক হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যোগদান করেই সেখানকার শিল্প- সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে কথাবার্তা শুনে আসছিলাম। এতে আমার নিজেরও খানিকটা আগ্রহ ছিল। সেসময় স্হানীয় একজন প্রবীন শিক্ষক, গবেষক ও সাংবাদিক জনাব মুহম্মদ মুসা আমার সামনে নানাবিধ তথ্য-উপাত্তের ভান্ডার মেলে ধরেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে এ শহরের ভূমিকা, কথাসাহিত্য, কবিতা, গীতিকাব্য, মলয়া সংগীত, বাউল গানের দার্শনিক গভীরতা ইত্যাদি বিষয়ে বই পুস্তক, কাগজ পত্র, পত্রিকার প্রতিবেদন তথা ঐতিহাসিক ও বাস্তবভিত্তিক ডকুমেন্টস সরবরাহ করে আমাকে দ্রুত হৃদ্ধ ও সমৃদ্ধ হতে বেশ সহযোগিতা করেন। সাম্প্রতিক কালে প্রয়াত তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তখন তাঁর এবং আরও কয়েকজন মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারী ব্যক্তিত্বের পরামর্শ ও সংগ্রহের সমাহার থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর সঙ্গীতাঙ্গন সংলগ্ন একটি কক্ষে আমার হাতে উন্মোচিত হয়ে `সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘর` চালু হয়। উদ্বোধন কালে এ জাদুঘরে রক্ষিত হয়েছিল ওস্তাদজীর ব্যবহৃত বেশকিছু বিরল দ্রব্যাদি। যেমন ;সরোদ, বেহালা, সন্তুর, এস্রাজ, সৌদি আরবের বাদশাহপ্রদত্ত জায়নামাজ, মাইহার রাজ্যের রাজা প্রদত্ত গালিচা, কিছু বাদ্যযন্ত্র ও আসবাবপত্র।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ২০১৬ সালে এক মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আকস্মিক তান্ডবের শিকার হয় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘর। এবং তাদের প্রথম টার্গেটে পরিনত হয় এ আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন। সেদিন তারা কেবল ভাংচুর করেই নিবৃত হয়নি, আগুনে পুড়িয়ে ধংসস্তুপে পরিণত করে জাদুঘরটি।
৪) পরবর্তীতে বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রাম হিসেবে আমি যোগদান করলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই সংস্কৃতিজনদের পক্ষ থেকে পুনঃউদ্যোগ নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টা ও সাধ্যাতীত শ্রমের বিনিময়ে এবং একই সাথে আমার স্বতঃস্ফুর্ত আর্থিক সহায়তায় পূর্বে সংরক্ষিতজিনিসপত্রের রেপ্লিকা যোগাড় করে ২০১৮ সালের ১৭ মে তারিখে জাদুঘরটি পুনরায় উদ্বোধন করা হয়।একই স্থানে আমি দ্বিতীয়বারের মতো ওস্তাদের নামীয় জাদুঘর চালু করি। তখন পাথরের গায়ে লেখা হল,
"সন্ত্রাসী হামলায় ধ্বংসকৃত সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘরের পুনঃ সংস্কার ও পুনর্গঠন শেষে শুভ উদ্বোধন করেন -- ---ইত্যাদি, যা বিগত ২৮ মার্চ একই শ্রেণী গোষ্ঠীর আকস্মিক তান্ডবে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এদের পাশবিকতা আর উল্লাস-নৃত্যের তালে তালে, আঘাতে আঘাতে লুপ্ত হয়ে যায় ওস্তাদের শেষ চিহ্নবিন্দু। যেন তাঁর স্বদেশে স্বজাতির হাতেই বিলীন হল স্বঅস্হিত্ব। অথচ কী আশ্চর্য! এমন শঙ্কা ওস্তাদ আলাউদ্দিন তাঁর জীবনাবসানের প্রায় তিন দশক আগেই করেছিলেন!
৫) তবে একটি অদ্ভুত বিষয় আমি অতি নিভৃতে লক্ষ করেছি, অতীতেও বিভিন্ন সময়ে এ শহরে নানা ইস্যুতে মৌলবাদী হেফাজতী বা স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী কর্তৃক আচমকা, আকস্মিক মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে লাঠি ধরিয়ে রাস্তায় নামিয়ে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপূরনীয় ক্ষতি করেছে। কখনোই তারা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি। সাধারণ মানুষ, ছাত্র সমাজ, সাংস্কৃতিক কর্মী বা রাজনৈতিক দলের সমর্থক কেউ বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি বা আসার সাহস দেখাতে পারেনি। এটি যুথবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ মানুষের একধরনের নৈতিক দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু নয় বলে আমি মনে করি। এতেও বিস্তর ভাবনার অবকাশ আছে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, "ঐক্যবদ্ধ নিরস্ত্র মানুষের চেয়ে শক্তিশালী কোন বাহিনী নেই "।
৬) একটি ছোট্ট গল্প দিয়ে আজকের লেখাটি শেষ করলে মন্দ হবে না। কারন, কাকতালীয় ভাবে আজই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ`র ছেলে জগৎ বিখ্যাত সুরসাধক ও একাত্তরের `কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ` এ অংশ নেয়া শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান এর মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালে ৮৭ বছর বয়সে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আত্মার চির শান্তি কামনা করছি। তাঁর আত্মজীবনীই আমার দোহাই।
"১৯২৫-২৬ সাল হবে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সাথে তাঁর শিশুপুত্র আলী আকবর খান। মূলতঃ কবির অসুস্থতার খবর পেয়ে তাঁকে দেখতেই ঠাকুর বাড়িতে যাওয়া। দু`জন নানা বিষয়ে কথা বলছেন, আলী আকবর এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। একটু পরে তার জন্য রসগোল্লা আনা হল। আলী আকবর হঠাৎ করে এসে রসগোল্লা মুখে দিয়ে তার হাতে লেগে থাকা রস রবি ঠাকুর এর দাড়িতে মুছে ফেলে। এতে কবি একেবারে স্বাভাবিক থাকলেও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ভীষণ বিব্রত ও শর্মিন্দাবোধ করলেন। এমনকি ভবিষ্যতে যখনি তিনি এ ঘটনা মনে করেছেন তখনই
পুত্র আলী আকবর খানকে ভৎর্সনা করতে ভুলেন নি"।
উল্লেখ করা যায়, ওস্তাদজী কবিকে `গুরুদেব` আর কবি `ওস্তাদ` বলে সম্বোধন করতেন। তবে বয়সে কবি এক বছরের বড় ছিলেন।
আমার সীমাহীন সৌভাগ্য যে, সরকারের এমন বর্ণাঢ্য চাকরিতে থাকার সুবাদে সুরের ইন্দ্রজালে বিশ্বকে বেঁধে রাখার কিংবদন্তি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ`র নামে গড়ে উঠা মিউজিয়ামটি দু`বার উদ্বোধন করি। আর আমার চরম দুর্ভাগ্য যে, দু`বারই ঢাকায় বসে টেলিভিশনের পর্দায় অশ্রুসিক্ত হয়ে নিজের সৃষ্টি অপরের হাতের নিষ্ঠুরাঘাতে নিমিষেই নিঃশেষ হতে দেখি।
১৯ জুন ২০২১ খ্রি,
০৫ আষাঢ় ১৪২৮ বঙ্গাব্দ।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৮:১৫ এএম, ১৬ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৮:১২ এএম, ১৬ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৮:০৭ এএম, ১৬ মে, ২০২৪
মন্তব্য করুন
সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতে বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক অভাবনীয়, অনন্য এবং যুগান্তকারী একটি মডেল। শিশু স্বাস্থ্য, মাতৃ স্বাস্থ্য এবং কিশোরীদের স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। নবজাতকের মৃত্যু, মাতৃ মৃত্যু কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনুসরণ শুরু করেছে। গত বছর ১৭ মে কমিউনিটি ক্লিনিক ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিসিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়। ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ সারা বিশ্বের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রত্যাশী জনগণের জন্য ‘আলোক বর্তিকা’।
আজকে আমরা ১৭ মে নিয়ে কথা বলছি। যেদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। আবার গত বছর এই দিনে তাঁর চিন্তা প্রসূত কমিউনিটি ক্লিনিককে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজকে আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, উন্নয়নশীল বাংলাদেশের কথা বলছি, যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি, একদিন উন্নত বাংলাদেশ হব বলে স্বপ্ন দেখছি এই সবকিছু শেখ হাসিনার স্বপ্ন, শেখ হাসিনার ইনিশিয়েটিভ। বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৭৮১ সালে পলাশি যুদ্ধে ইতিহাসের ঘৃণিত সেনাপতি মির্জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজ উদ্দৌলার বিদায়ের মধ্য দিয়ে ২০০ বছরের গোলামী আমাদের ললাটে এসেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও বাঙালী এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা পায়নি। যার পটভূমিতে বীরদর্পে আবির্ভূত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ থেকে ৭৫’ বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে স্বাধীনতার লাল পতাকা উড়েছিল বাঙালী আশায় বুক বেধেছিল।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিয়োগান্তের ঘটনায় জাতি ছিল দিক নির্দেশনাহীন। নারকীয় এই ঘটনায় জনগণ হয়ে পড়েন দিশেহারা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করার কোন শক্তি সাহস ছিল না। দলের অনেক বড় বড় নেতাও ছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ধানমন্ডির ৩২ বাড়ি ছিল কবরের নীরবতা। সমগ্র জাতি তখন অন্ধকারে। সামরিক বুটে পিষ্ঠ গণতন্ত্র। নির্বাসনে সংবিধান আর মানুষের মৌলিক অধিকার। বাক স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না। এমনকি বঙ্গবন্ধু নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের মৌলিক চরিত্রকেই বদলে ফেলা হয়। বিশেষ করে পাকিস্তানি ধারায় সামরিক শাসনের সংস্কৃতির প্রবর্তন ঘটে দেশে। সাম্প্রদায়িকতা ফিরে আসে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে। একের পর এক স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা ঘটতে থাকে দেশে। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। ঠিক এমন প্রতিকূল সময় ১৯৮১ সালের ১৭ মে সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তস্নাত মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন বাঙালির মুক্তির মহানায়কের যোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা।