২১ এপ্রিল, ১৯৭৭।
মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বঙ্গভবনে তার বেডরুমে গভীর নিদ্রায়। হঠাৎ বুটের শব্দ। চিৎকার চেঁচামেচি। নিদ্রা ভঙ্গ হলো রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের। ঘুম ভাঙতেই প্রচণ্ড শব্দ। কিছু সৈনিক তার বেডরুমের দরজা ভেঙে ফেলল। রাষ্ট্রপতি তখনো বিছানা থেকে পুরোপুরি উঠতে পারেননি। স্টেনগান তাক করে রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে ধরলেন সশস্ত্র সামরিক ব্যক্তিরা। নেতৃত্বে জিয়াউর রহমান। বিচারপতি সায়েম ভয়ে কাঁপছেন। বয়োবৃদ্ধ মানুষ। এরকম পরিস্থিতি ছিল তার চিন্তারও বাইরে। জিয়ার হাতে একটি কাগজ। ধমকের সুরে বললেন, ‘সাইন হেয়ার।’ রাষ্ট্রপতি একটু বিব্রত। ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী এটা। জিয়া
বললেন, ‘ইউ আর সিক।
অসুস্থতার কারণে আপনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে রিজাইন
করছেন।’ বিচারপতি সায়েম একটু ধাতস্থ হলেন। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললেন, ‘আমি তো গত সপ্তাহেই
স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছি। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।’ এবার জিয়া তার বুকে স্টেনগান তাক করলেন। কঠোর স্বরে বললেন ‘সাইন’। আবু সাদাত
মোহাম্মদ সায়েম দেখলেন উপায় নেই। জীবন অথবা রাষ্ট্রপতির পদ যে কোনো
একটি তাকে ত্যাগ করতেই হবে। কম্পিত হাতে তিনি কাগজ এবং কলম তুলে নিলেন। স্বাক্ষর করলেন। কাগজটা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন জিয়া। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন বিচারপতি সায়েমকে। এর মাত্র কয়েক
মিনিট পর সেনাপ্রধান, সামরিক
একনায়ক জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন। মধ্যরাতে জিয়ার বঙ্গভবন দখলের বিবরণ উঠে এসেছে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিজের লেখা গ্রন্থে। ‘অ্যাট বঙ্গভবন : লাস্ট ফেস’ শীর্ষক এ গ্রন্থটি এখন
বাজারে পাওয়া যায় না। এর এক বাংলা
অনুবাদ আছে বটে। কিন্তু সেটি সেন্সর করা। বাংলা অনুবাদে জিয়ার বঙ্গভবন দখলের কাহিনি নেই। মূল ইংরেজি বইটি বিএনপি ’৯১ সালে ক্ষমতায়
এসে নিষিদ্ধ করে। বঙ্গভবন ঘিরে স্বাধীনতার পর যত ন্যক্কারজনক
ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ভাগ্য খুব সুখকর নয়। বেশির ভাগ রাষ্ট্রপতি তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। দুজন রাষ্ট্রপতি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশে যারা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তাদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের রাষ্ট্রপতি যারা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার আওতায়। তারা ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। এদের মধ্যে তিনজন সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। যদিও তিনটি ভোটই ছিল বিতর্কিত এবং প্রহসনমূলক। অন্য এক ধরনের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন যারা সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে। অনেকটা অলঙ্কারিক। এখন বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এখন অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রের অভিভাবক তিনি। দেশের এ সর্বোচ্চ পদটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ চলতি বছর একজন রাষ্ট্রপতিকে বরণ করবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। কার অপেক্ষায় বঙ্গভবন?
এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা খুব শিগগিরই পাব। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রপতি পদের অতীত ইতিহাস তিক্ততায় ভরা। নানাভাবে গণতন্ত্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হয়েছে বঙ্গভবনে। তাই বঙ্গভবনের নতুন বাসিন্দা নির্বাচন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। ‘মুজিবনগর সরকারে’ রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে। তাজউদ্দীন আহমদ কৌশলগত কারণেই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ১০ জানুয়ারি। কালবিলম্ব না করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেন। রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু। ১২ জানুয়ারি নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। প্রায় দুই বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। এরপর ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি হন মোহাম্মদ উল্লাহ। ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে মোহাম্মদ উল্লাহ মন্ত্রী হন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পর মোহাম্মদ উল্লাহ খুনি মোশতাকের অধীনে উপ-রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রপতি পদকে হাস্যকর বা খেলো করার ক্ষেত্রে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ উল্লাহ অন্যতম। এক সময় তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারান। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে থাকার পর একজন ব্যক্তি কীভাবে মন্ত্রী, উপ-রাষ্ট্রপতি হন? এসব ব্যক্তিত্বহীন, লোভী বঙ্গভবনে প্রবেশ করলে তা রাজনীতি এবং দেশের জন্য বিপদের কারণ হয়।
১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারির পর দেশে নতুন সরকারব্যবস্থা চালু হয়। সব রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু মাত্র ২০২ দিনের মাথায় দেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। বিজয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয় বাংলাদেশে। খুনি মোশতাকের রাষ্ট্রপতি অধ্যায়কে সর্বোচ্চ আদালত অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছেন। কাজেই খুনি মোশতাকের ৮৩ দিনের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকে আমি স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। মোশতাকের পর ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সায়েম। তার পরিণতির কথা দিয়েই এ লেখা শুরু করেছিলাম। অস্ত্রের মুখে সায়েমকে হটিয়ে সেনাপ্রধান জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। আমার বিবেচনায় এটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কারণ সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় তার রাষ্ট্রপতি হওয়াটা ছিল গুরুতর সাংবিধানিক অপরাধ। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যে অস্ত্রের জোরে জিয়া ক্ষমতায় বসেছিলেন সেই অস্ত্রই তার করুণ পরিণতি ডেকে আনে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নির্মমভাবে নিহত হন। উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য তিনি অযোগ্য ছিলেন। বিচারপতি সাত্তারকে নির্বাচনে যোগ্য করতে সংবিধানে সংশোধনী করা হয়। ১৯৮১-এর ১৫ নভেম্বর সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে পরাজিত করে বিচারপতি সাত্তার নির্বাচনে জয়ী হন। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার ও বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট কারচুপি এবং জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। আবার আক্রান্ত হয় বঙ্গভবন। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে সামরিক ক্যু সংঘটিত হয় বাংলাদেশে। গদিচ্যুত হন বিচারপতি সাত্তার। ক্ষমতা দখল করে এরশাদ পুতুল রাষ্ট্রপতি বানান। বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। কিন্তু আসল ক্ষমতার মালিক ছিলেন এরশাদ। এরশাদ তার অবৈধ স্বৈরশাসনের প্রতিটি ধাপে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। ১০ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে এরশাদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এরশাদ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রায় সাত বছর দায়িত্ব পালন করেন এ সামরিক একনায়ক। যদিও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং অবৈধ ক্ষমতার দখলদার হিসেবে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ৯ বছর। এরপর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে এক স্বল্পমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এটি ছিল স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের ফসল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রায় এক বছর দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন। ’৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। প্রধান দুই দল একমত হয়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার রক্তাক্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রচণ্ডভাবে সংকুচিত হয়। বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদকেই মর্যাদাহীন করে ফেলে। এ সম্পর্কে প্রয়াত ড. আকবর আলি খান তার ‘অবাক বাংলাদেশ, বিচিত্র ছলনা জালে রাজনীতি’ গ্রন্থে ‘বঙ্গভবনে বাঁটকু : নির্বাহী বিভাগ কি ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে’র পথে চলছে?’ শিরোনামে প্রবন্ধে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে এর খানিকটা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি :
‘‘১৯৯১ সালের শেষদিকে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে অর্থনৈতিক পরামর্শক (Economic Minister) পদ থেকে বদলি হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগ দিই। অর্থ বিভাগে যোগ দেওয়ার দুই-তিন দিন পর অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি কোনো একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন এবং তাঁকে অপসারণ করে তাঁর জায়গায় জ্যেষ্ঠতম উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করে ফাইল পেশ করতে পরামর্শ দেন। আমি অফিসে ফিরে আসি এবং সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সন্তুষ্ট হই যে, মন্ত্রীর অভিযোগসমূহের অনেকাংশেরই সত্যতা রয়েছে। আমি যুগ্ম সচিবকে অবিলম্বে মন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে ফাইল প্রস্তুত করতে অনুরোধ করি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফাইল আমার টেবিলে চলে আসে। নথিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য একটি সারসংক্ষেপ পেশ করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পরিবর্তন-সংক্রান্ত ফাইল রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে হতো। কিন্তু এরশাদের পতনের পর সংবিধান সংশোধন করে মন্ত্রিসভা শাসিত সরকার সাংবিধানিকভাবে চালু করা হয়। সংবিধান সংশোধন হলেও তখনো কার্যবিধিমালা সংশোধিত হয়নি। সংবিধান সংশোধনের আগের কার্যবিধিমালায় নির্দেশ ছিল যে, ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে। যেহেতু তখনো সংবিধান ও কার্যবিধিমালার মধ্যে অসঙ্গতি ছিল, সেহেতু এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়োজন আছে কি না, সে সম্পর্কে ক্যাবিনেট ডিভিশনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্যাবিনেট বিভাগ জানায় যে, যতদিন পর্যন্ত কার্যবিধিমালা সংশোধিত না হবে ততদিন পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিতে হবে। যুগ্ম সচিব আমাকে নথি দেখালেন। আমি সন্তুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রপতির জন্য তৈরি করা সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিই।
পরের দিন মন্ত্রী অফিসে আসার পর তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আমাকে খবর দিলেন যে, আমি যেন মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করি। আমি মন্ত্রীর কক্ষে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থমন্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমি কেন রাষ্ট্রপতির জন্য সারসংক্ষেপ পেশ করলাম? দেশে যে মন্ত্রিসভা শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেটা সম্পর্কে কি আমি অবগত নই? সেই প্রসঙ্গেই তিনি ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন যে, আমি কি মনে করি বঙ্গভবনে উপবিষ্ট বাঁটুক সত্যি সত্যিই দেশ পরিচালনা করছেন? আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এ কাজ করা হয়েছে বলার পর তাঁর রাগ গিয়ে পড়ল আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর। তিনি আইন সচিবকে টেলিফোনে গালিগালাজ করলেন এবং আমাকে বললেন যে, নথি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো যাবে না। আমি বললাম, আপনি লিখে দেন যে প্রধানমন্ত্রীর জন্য সারসংক্ষেপ পেশ করা হোক। তিনি লিখে দিলেন এবং তদনুসারে আবার নথি তাঁর কাছে ফিরে গেল এবং তাঁর ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ব্যবস্থা গৃহীত হলো।
বিভাগীয় কাজের সমাধান ঠিকই হলো, কিন্তু আমার মনে একটা বড় খটকা জেগে উঠল। তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সম্পর্ক ভালো ছিল না। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি খর্বাকৃতির ছিলেন। কিন্তু বাঁটকু শব্দটি ব্যবহার করে অর্থমন্ত্রী শুধু খর্বাকৃতিকেই পরিহাস করেননি, এর ভিতর অর্থমন্ত্রীর রাজনৈতিক দর্শনও নিহিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, মন্ত্রিসভা শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গৌণ। মন্ত্রিসভার সদস্যরা যদি দৈত্যের মতো ক্ষমতাবান হন তাহলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেহাত বাঁটকুর মতো।’’ (গ্রন্থ : অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি; পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৬)।
আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৭১ সালে স্থানীয় পর্যায়ের রাজাকার ছিলেন। এর মাধ্যমে বিএনপি দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদকে গুরুত্বহীন করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবদুর রহমান বিশ্বাস তার মেয়াদ পূর্ণ করেন। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা রাষ্ট্রপতি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনা সংসদীয় গণতন্ত্রকে কার্যকর করার চেষ্টা করেন। সংসদে চালু করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব। সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেন। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদকেও মর্যাদাবান করেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রের অভিভাবক পদে নির্বাচন করেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। দেশের প্রথম ব্যক্তিকে শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ রাখতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে। শেখ হাসিনাই রাষ্ট্রপতিকে সম্মান জানানোর রেওয়াজ চালু করেন। বিদেশ সফর করে এসে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তাকে বিভিন্ন পরিস্থিতি অবহিত করার জন্য বঙ্গভবনে যাওয়ার রীতি চালু করেন শেখ হাসিনা। বাঁটকু রাষ্ট্রপতিকে তিনি ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’ করেন। ক্ষমতা বড় কথা নয়, রাষ্ট্রপতির সম্মান তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। সংবিধানের মর্যাদা এবং সাংবিধানিক পদের স্বীকৃতি প্রদানের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে রীতিমতো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে তিনি সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের একটি কারণ বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের বিতর্কিত ভূমিকা। তথাকথিত দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ পদে আনলে কী হয়, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার বড় উদাহরণ। ২০০১ সালের অক্টোবর নির্বাচনে বিপুল জয় পায় বিএনপি। বিএনপি রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেয় দলের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। কিন্তু বিএনপি রাষ্ট্রপতি চায় একজন ‘বাঁটকু’। একজন গ্রহণযোগ্য, সত্যিকারের অভিভাবক রাষ্ট্রপতি বিএনপি মেনে নেয়নি। দায়িত্ব নিয়েই অধ্যাপক চৌধুরী অনেক ‘লম্বা’ হয়ে গিয়েছিলেন। এ জন্যই তাকে ছেঁটে ফেলার উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাসীন বিএনপি। অবস্থা বেগতিক দেখে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ২০০২ সালের ২১ জুন নিজেই সরে দাঁড়ান। তার পদত্যাগের পর আরেকজন ‘বাঁটকু’ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য খুঁজে বের করতে বিএনপি সময় নেয় ৭৭ দিন। ততদিন স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপির আবিষ্কৃত নতুন ‘বাঁটকু’ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ। বিএনপি নেতারা যাকে ‘ইয়েস উদ্দিন’ বলে টিপ্পনী কাটতেন। তিনিও সংকটকালে ব্যক্তিত্বহীন, ভাঁড়ে পরিণত হয়েছিলেন। আজ্ঞাবহ হতে গিয়ে পুরো দেশকেই সংকটের গভীরে ঠেলে দিয়েছিলেন ‘ইয়েস উদ্দিন’। দুই বছর অনির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের বুকের ওপর যে চেপে বসেছিল তার প্রধান কারণ ড. ইয়াজ উদ্দিনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব। বিএনপির সবচেয়ে ক্ষতি করেছিল দ্বিতীয় বাঁটকু এ রাষ্ট্রপতি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। এবার শেখ হাসিনা বেছে নেন দলের অভিভাবক, রাজনীতিতে বিচ্যুতিহীন আদর্শবাদী নেতা জিল্লুর রহমানকে। এক-এগারোর সংকটেই অবশ্য জিল্লুর রহমান তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতার কল্যাণে জাতির একজন অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন। সবার আস্থা, বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়েছিল গোটা দেশ। একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্র নামক পরিবারের প্রধান। তার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেয় আবদুল হামিদকে। তৃণমূল থেকে বেড়ে ওঠা অন্তঃপ্রাণ এক রাজনীতিবিদ। সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেন। সহজ সরল কথায় বঙ্গভবনের সুউচ্চ দেয়াল উপড়ে তিনি জনতার স্রোতে মিশে যেতে পারেন। আদর্শবান কিন্তু একেবারে সাদামাটা একজন মানুষ। দুই মেয়াদে প্রায় ১০ বছর তাঁর বঙ্গভবনে বসবাস এখন সমাপ্তির পথে।
স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রপতিদের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করলাম শঙ্কা থেকে। বঙ্গভবনে ভুল মানুষ যখনই প্রবেশ করেছে তখনই গণতন্ত্র হুমকিতে পড়েছে। অগণতান্ত্রিক শাসকরা একান্ত অনুগতদের বঙ্গভবনে ঢুকিয়ে সর্বোচ্চ পদকে হেয় করেছে। আমরা যেমন মোহাম্মদ উল্লাহর মতো লাজ-লজ্জাহীন রাষ্ট্রপতি চাই না, তেমনি অস্ত্র হাতে কেউ কেউ বঙ্গভবন দখল করে দেশপ্রেমের বাদ্য বাজাক তা-ও প্রত্যাখ্যান করি। আমরা যেমন নাম-পরিচয়হীন কোনো ‘বাঁটকু’ রাষ্ট্রপতি হোক চাই না, তেমনি আবার কোনো সুশীল ছদ্মবেশী সাবেক আমলা অতি নিরপেক্ষতার শক্তিতে ‘বঙ্গভবন’ বিতর্কিত করুক সেটিও চাই না। রাষ্ট্রপতি এ রাষ্ট্রের প্রথম নাগরিক। একজন রাজনীতিবিদ। আদর্শবান ব্যক্তি, যার সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক থাকবে। জনগণ যাকে আপন মানুষ ভাববে। তেমন ব্যক্তি আওয়ামী লীগের আছে। বঙ্গভবনের টিকিট তাকে দিলেই ‘গণতন্ত্র’ সুরক্ষিত হবে। ভুল মানুষের হাতে বঙ্গভবনের চাবি গেলে আবার ‘গণতন্ত্র’ নির্বাসনে যাবে। সামনে কঠিন সময়। বঙ্গভবনের বাসিন্দা নির্বাচন এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে
বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর,
সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার
বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়?
একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে
নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির
নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ
করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন
ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল।
বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে
কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।
কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা
কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের
জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও
না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু
ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ
থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী
জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক
অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য
কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন,
‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প
চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে
একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য
বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে
মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার
পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক
দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে
সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮
সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির
সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার
নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের
দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত
নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র
ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।
যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব
দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি
রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত।
ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে
বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং
ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা
প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে
কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই
কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী।
অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।
বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের
মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য
নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে
পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর
নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন।
সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না।
জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন
চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে
বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম
আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের
মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে
অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।
বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার
অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে
তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ
বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির
মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে
সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে
খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে
উত্তর নেই।
খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক।
অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের
উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায়
না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই
হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর
ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের
মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই
আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী?
নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া
বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন,
‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো
না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির
জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর।
দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস
করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে
যাবে।
জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা
গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব
থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের
কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের
প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি
মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে।
’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ
থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে
বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা।
আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।
এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা
পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল
তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান
নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল,
তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ
উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো
মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের
মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি,
আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে
আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন
প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির
জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে
প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।
আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট
আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা।
ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী
লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন,
দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত
গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা
করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা
থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র
পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা
নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান
ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ।
বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই
বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা
দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি উপজেলা নির্বাচন শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ্যতা, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কীভাবে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন সেটির দিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।