এডিটর’স মাইন্ড

ষড়যন্ত্রের আগুনে পুড়বে গণতন্ত্র?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৮ এপ্রিল, ২০২৩


Thumbnail

এপ্রিল সকালে ঘুম থেকে উঠেই পেলাম দুঃসংবাদ। বঙ্গবাজারে আগুন। প্রথমে এর ভয়াবহতা বুঝতে পারিনি। কিন্তু টেলিভিশনে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলাম। দুপুর পর্যন্ত আগুনের দাপটে পুড়ে ছাই হয়ে গেল অন্যতম বড় পাইকারি মার্কেটের প্রায় হাজার দোকান। সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসলেন হাজারখানেক ব্যবসায়ী। যথারীতি বঙ্গবাজারের আগুনের পরও গবেষণা শুরু হয়েছে। এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তা নিয়ে জোর আলাপ, বিতর্ক থেমে নেই।  আর সব বিপর্যয়ের পর যেভাবে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয় ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আগে থেকেই বলে দেওয়া যায় তদন্ত কমিটি কী রিপোর্ট দেবে। শুরু হবে দোষারোপের ব্লেম গেম। জনগণ এসব দেখে বিরক্ত হবে। নিজেদের অসহায় ভাববে। এমনিতেই ঢাকা শহরকে বেশির ভাগ নগরবাসীমৃত্যুকূপ ভাবেন। সেই ভাবনার মিছিলে আরও কিছু মানুষ যুক্ত হবেন। শহরে যে কোনো সময়ে যে কোনো স্থানে, যে কেউ দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। বিপর্যস্ত হতে পারে। অনিরাপদ, মৃত্যুপুরী শহরে যেন কোনো অভিভাবক নেই। ২০২৩ সালকে এখন পর্যন্ত বলা যায় নাগরিক বিপর্যয় এবং দুর্ঘটনার বছর। একের পর এক বিস্ফোরণ হচ্ছে, আগুন লাগছে। নাগরিক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। নিরাপত্তাহীন আতঙ্কিত মানুষ সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে, ক্ষুব্ধ হচ্ছে। একের পর এক ধরনের বিস্ফোরণ এবং আগুনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে প্রশ্ন উঠছে, সরকার কী করছে। জনজীবনের নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ- এরকম কথা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এখন গলা ফাটিয়ে বলছে। আর সরকারের ভিতর বসে থাকা কিছু নাদুসনুদুস কর্তা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলছে- স্রেফ দুর্ঘটনা, নাশকতার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তাহলে বাংলাদেশ এখন দুর্ঘটনার দেশ। দেশে প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো দালানকোঠা, বড় মার্কেটে আগুন লাগে। এটাই কি প্রমাণ করতে চাইছে কেউ কেউ? সরকারের ওপর জনআস্থা নষ্ট এবং ক্ষোভ সৃষ্টির জন্যই কি এসব আগুন এবং বিস্ফোরণের ঘটনা? সায়েন্স ল্যাবরেটরি, সিদ্দিকবাজারের পর বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনাকে যদি কেউ নিছক দুর্ঘটনা বলেন তাহলে তিনিও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত বলে আমি সন্দেহ করব। নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে যে বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলছে নাশকতা তারই একটি ধারা। এক্ষুনি যদি সরকার এর উৎসমূল খুঁজে বের করতে না পারে তাহলে সামনে এরকম কিংবা এর চেয়ে বীভৎস ঘটনা ঘটবে। সরকারকে দুর্বল এবং বিব্রত করার এটি খুব ভালো অস্ত্র। এর ফলে জনগণের মধ্যে সরকার সম্পর্কে সহজেই নেতিবাচক ধারণা তৈরি করা যায়। সরকারের গায়ে ব্যর্থতার তকমা লাগানোর এটি অন্যতম সহজ পথ। জন্যই ২০১৩-২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট আগুন সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছিল। পেট্রলবোমা, বাসে আগুন এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা করেছিল। যেন জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়। জনগণ সরকারের প্রতি আস্থা হারায়। সমস্যা হলো রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে নাশকতা করলে তার দায় সরাসরি আন্দোলনকারীদের ওপর বর্তায়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ পোড়ানোর দায় বর্তেছিল বিএনপির ওপর। ফলে দলটির ওপর মানুষ বিরক্তি প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি। তাদের আন্দোলন জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ওই সময়ে সন্ত্রাসী রাজনৈতিক কর্মসূচির চিরবিদায় হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত নয়, সব রাজনৈতিক দলই এখন সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি এড়িয়ে চলে। রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল থেকে সহিংসতা, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ বিদায় নিয়েছে বটে; কিন্তু তা কি এখন দুর্ঘটনা এবং নাশকতার আদলে ফিরে এসেছে? প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিরোধী দল জ্বালাও-পোড়াও করলে তাদের বদনাম হয়। আর দেশে হঠাৎ বিস্ফোরণ হলে, আগুন লাগলে সরকারের যোগ্যতা এবং দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই খুঁজে দেখতে হবে এসব ঘটিয়ে সরকারকে দুর্বল করার কোনো আয়োজন চলছে কি না। কারণ নির্বাচনের আগে সরকার যত দুর্বল হবে তত নির্বাচন করার কাজটি কঠিন হয়ে যাবে। অনির্বাচিত এবং অসাংবিধানিক সরকারের ক্ষমতায় আসার পথ উন্মুক্ত হবে।

আগুন যে শুধু বঙ্গবাজারে তা নয়, দ্রব্যমূল্যের বাজারেও আগুন। রোজার মধ্যে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে মানুষের হা-হুতাশ অনেক ক্ষেত্রেই গর্জনের মতো শোনা যাচ্ছে। বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এর মধ্যে কিছু কিছু মন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলার উপক্রম করেছে। এক মন্ত্রী বলেছেন, ‘এবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে। তার কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেছি। ২০১৯ সালে যারা মন্ত্রী হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই জনবিচ্ছিন্ন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন। এটা আরেকবার প্রমাণ হলো ওই মন্ত্রীর কথায়। মন্ত্রী যেদিন দ্রব্যমূল্যের সহনীয় মাত্রা নিয়ে তার অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেন, ঠিক সেদিনই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাল মার্চে মুদ্রাস্ফীতির হার ১০-এর কাছাকাছি ( দশমিক ৩৩) আর মুদ্রাস্ফীতি নিয়েও আরেক মন্ত্রী তামাশা করলেন। তিনি মুদ্রাস্ফীতির হার ১০ শতাংশে উন্নীত না হওয়ায় সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। সৃষ্টিকর্তাই যদি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে সরকারের কাজ কী? এতসব মন্ত্রী-আমলারই বা দরকার কী? বাজারে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য বঙ্গবাজারের আগুনের মতোই ভয়াবহ। পার্থক্য হলো- বঙ্গবাজারের আগুন দৃশ্যমান কিন্তু বাজারের আগুন খালি চোখে দেখা যায় না। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা আগুন দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন। বঙ্গবাজারের আগুন ফায়ার ব্রিগেড পানি দিয়ে নিভিয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের আগুন নেভাবেন কী দিয়ে? বঙ্গবাজারের আগুন একটা নির্দিষ্ট এলাকায় সীমিত। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের আগুন নিয়ন্ত্রণহীন। আগুন নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত হয়ে এখন উচ্চবিত্তের গায়েও আঁচ লাগাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি যে শুধু বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বেসামাল হয়েছে এমনটি ঠিক নয়, এর মধ্যে কারসাজি আছে, কিছু ব্যবসায়ীর অনৈতিক মুনাফার লোভ আছে, আছে সিন্ডিকেটের দুরভিসন্ধি। সরকারের কিছু প্রতিষ্ঠান বিক্ষিপ্তভাবে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে বটে। কিন্তু এসব অভিযান এতই সমন্বয়হীন এবং দায়সারা যে, এর ফলে বাজারে কোনো ইতিবাচক ফল দৃশ্যমান হচ্ছে না। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা হলো- সরকারের মধ্যে কারও কারও সত্য এবং বাস্তবতাকে ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা। জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে- সত্যকে স্বীকার করে করণীয় নির্ধারণ করাটা জরুরি ছিল। সেটি করা হয়নি। ছোট ছোট অনেক ইতিবাচক কাজ সমন্বিতভাবে করা যেত। যেমন এবার রোজার শুরু থেকেই মৎস্য প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সুলভ মূল্যে মাংস, মুরগি, ডিম, দুধ বিক্রি করেছে। ঢাকা শহরে উদ্যোগটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস স্বল্পমূল্যে বিক্রি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় একটু উদ্যোগ নিলেই শাক-সবজি, ফলমূল সুলভ মূল্যে বিক্রির উদ্যোগ নিতে পারত। করোনাকালেকৃষকের বাজার নামে একটি উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছিল। যেখানে কৃষকরা সরাসরি তাদের কৃষিপণ্য এনে বিক্রি করত। এসব পণ্যের দাম কম এবং মানেও ভালো। জনগণের মধ্যেকৃষকের বাজার ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু এবার কৃষি মন্ত্রণালয় ধরনের কোনো উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নেয়নি। কেন নেয়নি তার ব্যাখ্যা নেই।

সমন্বিত বহুমাত্রিক উদ্যোগ বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। দ্রব্যমূল্যের আগুনের দায় সরাসরি সরকারের ঘাড়ে বর্তাচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিশ্বে কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে আগ্রহী নয়। বিশ্বের দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনাতেও উৎসাহী নয়। সাধারণ মানুষ চায় তার আয়ের মধ্যেই খেয়ে-পরে বাঁচতে। এটির দায়িত্ব সরকারের। সরকারের মধ্যে কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন অযোগ্য মন্ত্রী, চাটুকার আমলা এবং সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিকে অসহনীয় করে তুলেছেন। এদের কেউ কেউ কেবল প্রকৃত তথ্যই আড়াল করছেন না, সরকারপ্রধানকে ভুল তথ্যও দিচ্ছেন। এর ফলে সরকারের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রে দ্রব্যমূল্যকে হাতিয়ার বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ইস্যুকেজাতীয় থেকেআন্তর্জাতিক করা হয়েছে। এখানেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার যথেষ্ট যোগ্যতা এবং পরিপক্বতার পরিচয় দিতে পারেনি। সুশীল সমাজের একটি অংশ দ্রব্যমূল্যকে সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। ১৯৭৪- যেমন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ এবং দ্রব্যমূল্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই নীলনকশার বাস্তবায়ন করতে গিয়েই বাসন্তী নাটক সাজানো হয়েছিল। এবারও কিছু পত্রিকা একই নাটক মঞ্চস্থ করতে চাইছে। আর সুশীল নিয়ন্ত্রিত ওই সংবাদপত্রের ফাঁদে পা দেয় সরকার। অবশ্য আমার মনে হয় ওই পত্রিকাটিকে ব্যবহার করে, এটি আসলে সুশীলদের বিছানো ষড়যন্ত্রের জাল। সেই জালে সরকার জড়িয়ে যায়। ওই পত্রিকা নিয়ে ঘটনায় সরকারের লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি। একটি সংবাদপত্র ভুল সংবাদ পরিবেশন এবং গর্হিত অপরাধ করেও এখন প্রায়বীর এর মর্যাদা পাচ্ছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে। সাপের লেজে পা দিলে তা যেমন ছোবল দেবেই, তেমনি সুশীলদের লেজে পা দিয়ে সরকার নিজেকে বিপদগ্রস্ত করল কি না তা সময়ই বলে দেবে। তবে এখন এটুকু বলা যায়, সরকারের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা কিছু সুশীলবান্ধব কর্তা সরকারকে বিব্রতকর এবং কোণঠাসা করছে। ভুল প্রতিবেদন, স্বাধীনতাকে কটাক্ষ, শিশু নিপীড়নের জন্য পত্রিকাটির যেখানে দুঃখিত লজ্জিত হওয়া উচিত সেখানে অসত্য, উসকানিমূলক তথ্য প্রকাশকেই তারা এখননির্ভীক সাংবাদিকতা হিসেবে ব্র্যান্ডিং করছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বের নজর কেড়েছে তারা। বিশ্বে তারা সফলভাবে প্রচার করতে পেরেছে ক্ষুধা, অভাব, দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রতিবেদনের কারণে বাংলাদেশের গণমাধ্যম হেনস্তার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে অভাব-অনটন, ক্ষুধা প্রকট, অনটনের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে দেয় না সরকার। কেউ যদি সাহস করেও এসব প্রচার করে তাহলে তার ওপরখড়গ নেমে আসে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো স্পর্শকাতর বিতর্কিত কালো আইন দিয়ে গণমাধ্যমকে শায়েস্তা করে এবং অপপ্রচারের শেষ ভাগে যথারীতিনির্বাচন প্রসঙ্গ আসে। শেষে গিয়ে বলা হচ্ছে- সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিরোধী মত দমন করছে। গণমাধ্যমকে মত প্রকাশ করতে দিচ্ছে না। কালো আইনের অপপ্রয়োগ করছে। কোনো কিছু না করেইসরকার অপরাধী আর অপরাধ করেও সুশীলদের মুখপত্র পত্রিকা জাতির বিবেক, দেশপ্রেমী। ২৬ মার্চের একটি গণমাধ্যমের দায়িত্বহীন, ইচ্ছাকৃত উসকানিমূলক সংবাদ প্রকাশের পর যে ঘটনাপ্রবাহ তাতে স্পষ্ট সরকার পিছু হটেছে। ফাঁদে আটকে গেছে। হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- পত্রিকাটি শিশু নিপীড়নের অপরাধ করেছে। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শিশু নির্যাতনের মামলা না দিয়ে কেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা হলো? সরকারের প্রভাবশালী একাধিক মন্ত্রী বলেছেন, পত্রিকাটি স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করেছে। আরেকটি বাসন্তী অধ্যায় সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এটি রাষ্ট্রদ্রোহ। তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা না করে কেন বিতর্কিত, সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলো? মামলায় একজন সংবাদকর্মীকে গ্রেফতার করতে মধ্যরাতে কেন তার বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গেল? সকালে গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো? আমার মনে হয় সুশীলদের পক্ষে একটি গোষ্ঠী সরকারের ভিতর শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আছে। এরা সরকারের ভিতরে থেকে ষড়যন্ত্র করছে। একই ঘটনা দেখা যায় . মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রেও। তার অর্থ পাচার তদন্ত, শ্রমিক ঠকানোর মামলাগুলো এগোচ্ছে না। এটাও সাপের লেজে পা দেওয়ার মতো। নিয়ে . ইউনূস আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নালিশ-সালিশ করছেন। সরকার ঠিকঠাক মতো . ইউনূসের অপপ্রচার মোকাবিলা করতে পারছে না। আগামী নির্বাচনের আগে ঘটনাগুলো প্রভাব ফেলবে। তারই এক ঝলক দেখা গেল সুশীল মুখপত্র সংবাদপত্রকে কেন্দ্র করে ঘটনায়। পরিকল্পিতভাবে ওই পত্রিকা এবং তার সম্পাদককেসাহসী যোদ্ধা বানানো হলো। অথচ তারা যে কান্ডটি করেছেন তাতে তাদের মুখে চুনকালি লাগার কথা। শুধু এটিই প্রথম নয়, সুশীলদের মুখপত্র বাংলা এবং ইংরেজি সংবাদপত্র দুটিকে সরকারি কিছু মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় এভাবে একাধিকবারজাতীয় বীর বানানো হয়েছে। পত্রিকার একজন সংবাদকর্মী সচিবালয়ে রীতিমতো চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লেন। সে সময় তার মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়াটা ছিল যথার্থ। কিন্তু তা না করে তাকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখেচোরকেহিরো বানানো হলো। চুরির অপরাধ করেও ওই সাংবাদিক আন্তর্জাতিকভাবে সাহসী, নিপীড়িত সাংবাদিকেরতকমা পেলেন। মেডেল পেলেন। সুশীলদের নিয়ন্ত্রিত ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদক এক টকশোতে গিয়ে অপরাধ কবুল করলেন। স্বীকার করলেন, ডিজিএফআইর কাছ থেকে তথ্য পেয়ে তা যাচাই-বাছাই না করেই তিনি প্রকাশ করেছেন। ওই অসত্য, ভিত্তিহীন তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আত্মস্বীকৃত অপসাংবাদিক। যে কোনো সম্পাদক ধরনের স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর পেশা ছেড়ে দেন কিংবা স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যান। সাংবাদিকতার নৈতিক অধিকার হারান। কিন্তু অতি উৎসাহী আওয়ামী আনাড়িরা ওই ঘটনার পর এমন শিশুসুলভ বালখিল্যতা করল যে, ‘গোয়েন্দাদের দালাল সম্পাদক নর্দমা থেকে উঠে সরোবরে অবগাহন করলেন। ঘটনাগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে। মনে হতে পারে সরকার এবং আওয়ামী লীগের বিচার, বুদ্ধি দক্ষতার অভাব। আদতে এটি পরিকল্পিত। নির্বাচন বানচালের নীলনকশার অংশ। সরকারের ভিতর সুশীলদের এজেন্ট এবং নব্য মোশতাকরা জেনেবুঝেই এসব করছে। এজেন্ট এবং ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যে পত্রিকা পড়েন না বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। যে পত্রিকা মাইনাস ফর্মুলার প্রবক্তা। আওয়ামী লীগ সরকার দলের কোন কোন মন্ত্রী-নেতা সেখানে কলাম লিখে ধন্য হন, কারা সেখানে বিজ্ঞাপন দেন, তাদের অনুষ্ঠানে সরকারের কারা উপস্থিত হন- সেই তালিকা তৈরি করলেই ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা যাবে। সুশীলদের মুখপত্র দুটিকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পাদপ্রদীপে আনতে ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। এসব ঘটনার পর পত্রিকা দুটি সরকারের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের লাইসেন্স পেল। . ইউনূসও বাংলাদেশ সরকারবিরোধী প্রচারণায় আদাজল খেয়ে নামলেন। তারা বুঝলেন তাদের ধরার কেউ নেই। তাদের বিদেশি মুরব্বিরা ঘটনার পর যেভাবে হইচই করেছেন তাতে সরকার জনগণ উভয়ই বুঝল এদের খুঁটি কোথায়। নির্বাচনের আগে সরকারের বিরুদ্ধে দাগানোর জন্য কামান গোলাবারুদসহ প্রস্তুত করা হলো। আরও কত কামান গোপনে প্রস্তুত কে জানে? এরা এখন নির্বাচন বানচালের প্রচারণায় যুক্ত হবে। যার প্রমাণ ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। এপ্রিল বঙ্গবাজার যখন পুড়ছে ঠিক তখন এক-এগারোর কুশীলব এবং বিএনপিপন্থি সুশীলদের এক ভার্চুয়াল মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হলো। সুজনের উদ্যোগেপ্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, সাংবিধানিক কাঠামো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। ওই বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে সুশীলরা প্রকাশ্য অবস্থান ঘোষণা করেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে ওই গোলটেবিলে প্রশ্ন তোলা হয়। পুরো গোলটেবিলের আবহ ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যেন দেশে নির্বাচন না হয়। গোলটেবিল বৈঠক একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে তা হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে নির্বাচন বানচালের মাস্টারপ্ল্যানটি আসলে সুশীল সমাজের। বিএনপি উপলক্ষ মাত্র। তারা পার্শ্বচরিত্র। মাঠের আসল খেলোয়াড় সুশীলরা। সুশীলদের মাঠে নামিয়েছে তাদের পশ্চিমা প্রভুরা। লক্ষণীয় ব্যাপার পশ্চিমা মহল, সুশীল এবং বিএনপি এখন একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে। অভিন্ন লক্ষ্য তাদের। পশ্চিমা দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে না। তারা বলছে, আগামী নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ। তারা সরকার নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সুশীলরা বলছেন, বর্তমান সরকার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চায় না। সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয় না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ করছে।গুম নাটকের বিষয়টি তো আছেই। কাজেই নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ আবহ তৈরি করতে হবে। এদের কেউ কেউ দুই বছর নির্বাচন পেছালেও কোনো ক্ষতি নেই- মর্মেফতোয়া পর্যন্ত দিচ্ছেন। আর বিএনপি, সুশীল এবং পশ্চিমাদের শেখা বুলি আওড়াচ্ছে তোতা পাখির মতো। তারা বলছে, ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করবে না। ব্যস, এটি বলে তারা পাঁচতারকা হোটেলে ইফতার উৎসব করছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে গায়ে বাতাস দিয়ে ঘুরছে। আমার বিবেচনায় ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় তারা স্রেফ একটিগুটি অথবা বিএনপি পুতুল নাচের পুতুল। তাদের যেভাবে নাচানো হচ্ছে সেভাবেই তারা নাচতে রাজি। কারণ বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য হলো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করা। নিজেদের ক্ষমতায় বসা নয়।সুষ্ঠু নির্বাচন এর আওয়াজ তুলে আসলে আগামী নির্বাচন অনিশ্চিত করতে চায় সুশীল এবং তাদের গডফাদাররা। আর এটি অর্জন করতে হলে সরকারকে কোণঠাসা, অজনপ্রিয় এবং দুর্বল করতে হবে। জনগণের থেকে সরকারকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। সে জন্যই বঙ্গবাজারে আগুন, নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন। জন্যই সরকারের ভিতরে আত্মঘাতী তৎপরতা।  নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসছে ততই ষড়যন্ত্রের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে সরকার। ষড়যন্ত্রের আগুনের শিখা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে উদ্যত। নির্বাচন না হলেই বঙ্গবাজারের মতো পুড়ে ছাই হবেগণতন্ত্র আগুন থেকেগণতন্ত্র কি রক্ষা পাবে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

মামা-ভাগ্নের নির্বাচনে ধান কাটার উৎসব

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১০ মে, ২০২৪


Thumbnail

দেশের মানুষের এমনিতেই নাভিশ্বাস অবস্থা। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ সংকটে চেয়েও বড় অস্থিরতা হলো জিনিস পত্রের দাম। অস্থির সময়ে মানুষের জন্য বিনোদনের কোন খোরাক নেই। তবে প্রধান নির্বাচন কাজী হাবিবুল আউয়াল মানুষের জন্য অস্বস্তির তাপদাহে এক পশলা বৃষ্টির মতো, বিনোদনের খোরাক যোগালেন। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত ১৩৯ টি উপজেলার নির্বাচনের পর সাংবাদিকদের তিনি বললেন, ‘ধান কাটার কারণে অনেক ভোটার ভোট দিতে আসেননি।’ নিষ্প্রাণ উপজেলা নির্বাচনে সিইসির বক্তব্যই একমাত্র চমক। 

উপজেলা নির্বাচন উত্তেজনাহীন হয়েছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। আগে উপজেলা নির্বাচনগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা ছিলো, স্থানীয় জনগণের মাঝে নানারকম হিসেব-নিকেশ এবং মেরুকরণ হতো। এবার তেমনটি হয়নি। সবাই জানে কেন উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিলো। প্রতিপক্ষহীন খেলা কখনও উত্তেজনাপূর্ণ হয় না। দর্শকদের আগ্রহও থাকেনা। বিরোধীদল হীন নির্বাচনও ভোটারদের জাগাতে পারেনা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেই নানারকম বেসামাল কথা-বার্তা বলতে হয়। কাজী হাবিবুল আউয়াল এতোদিন অনেকটাই সংযত ছিলেন। কিন্তু এখন তার সংযমের বাঁধ সম্ভবত ভেঙ্গে গেছে। উপজেলা নির্বাচন যখন হচ্ছিল তখন কত নির্বাচনী এলাকায় ধান কাটা চলছিল সে হিসেব কি কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছে আছে? তিনি কি জানেন, ধান কাটার জন্য কতজন কৃষক নিয়োজিত থাকেন? 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ শুমারীতে সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা কত সে হিসেবটা নিশ্চয়ই সিইসির জেনে নেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু ধান কাটার উৎসব হোক বা আম পাড়ার উৎসবই হোক, বাস্তবতা হলো উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ ছিলো না। তার প্রধান কারণ হলো, এ নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ অংশগ্রহণ করেনি। বিরোধী পক্ষ ছাড়া নির্বাচন যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না সেটি বারবার প্রমাণিত, আর এটিই বাস্তবতা। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত এই নির্বাচনেও যেন একাধিক আওয়ামী লীগের প্রার্থী দাঁড়াতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর সেই সুযোগ নিয়ে এবার নির্বাচনের উৎসব হয়েছে ‘মামা-ভাগ্নের নির্বাচন’। 

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার কথাই ধরা যাক। এখানে নির্বাচন হয়েছে প্রথম ধাপে। এই উপজেলার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী এবং কবির হাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার শিউলির ছেলে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরী। সাবাব চৌধুরী নির্বাচনে আনারস প্রতীক নিয়ে ৩৭,৬৪৮ ভোট পেয়েছেন। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বর্তমান চেয়ারম্যান দোয়াত-কলম প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনাম সেলিম পেয়েছেন ৩৬,৯৪৫ ভোট। ৭০৩ ভোটের ব্যবধানে মামাকে হারিয়ে দিয়েছেন ভাগ্নে। স্থানীয় রাজনীতিতে অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনাম সেলিমকে মামা ডাকতেন সাবাব। ‘মামা-ভাগ্নে নির্বাচনে’ ভাগ্নে জিতেছে, মামা হয়েছে কুপোকাত। এভাবে সারাদেশেই উপজেলা নির্বাচন এখন মামা-ভাগ্নের নির্বাচন। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল এমপি-মন্ত্রীরা যাতে আত্মীয় স্বজনদেন প্রার্থী না করে। ধারণা করা হয়েছিল যে, একরামুল করিম চৌধুরীদের মত ব্যক্তিদেরকে নিশানা করেই আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। 

প্রধানমন্ত্রী গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, একই পরিবারের সবাই যদি সবকিছু দখল করে তাহলে কর্মীরা কি করবে। নোয়াখালীতে তাই ঘটেছে। নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী, কবিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী আর ছেলে হলেন সুবর্ণচর উপজেলার চেয়ারম্যান। ফলে নোয়াখালীতে একরামুল করিম চৌধুরীর রাজত্ব এখন ঠেকায় কে। শুধু যে নোয়াখালীতে এমন ঘটনা ঘটেছে তা নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেই এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের লড়াই হয়েছে। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাদের কুপোকাত করে দিয়েছে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। আওয়ামী লীগের এই প্রীতি ম্যাচে ৩৬ শতাংশ ভোট তো অনেক বেশী।  

একটি নির্বাচনে সাধারণ মানুষ বা ভোটাররা কেন ভোট দেবেন? সাধারণত মানুষের সামনে যখন অনেকগুলো বিকল্প থাকবে তখন মানুষ ভোটের মাধ্যমে একটি বিকল্প পছন্দ করে নেবেন। নানা মত, নানা পথের যে বৈচিত্র্য, সেই বৈচিত্র্যই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। যদি সকল রাজনৈতিক দল একই মতামত প্রকাশ করে, অভিন্ন চিন্তাভাবনার অনুসারী হয় এবং ক্ষমতাই যদি তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্র হয়না, তাতে মানুষেরও আগ্রহ থাকেনা। বিরোধী দল লাগাতারভাবে নির্বাচন বর্জনের ফলে এরকম একটি পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে। বিএনপি কেন উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলো সেটি একটি বড় প্রশ্ন। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি থেকে যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘণ করে অংশগ্রহণ করেছেন তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু দলের বিদ্রোহীরা বহিষ্কারাদেশ মাথায় নিয়েই নির্বাচন করেছেন। প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দেখা গেছে যে ৭ টি উপজেলায় বহিষ্কৃতরা বিজয়ী হয়েছেন। যদি বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে এ বিধি নিষেধ আরোপ না করতো তাহলে নির্বাচনগুলো আরো উৎসবমুখর হতো এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়তো। সবচেয়ে বড় কথা হতো ভোটারদের সামনে ভালো মন্দ বাছাই করার সুযোগ তৈরি হতো। যেসমস্ত উপজেলাগুলোতে বিএনপির প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছেন সেই উপজেলাগুলোতে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি ছিলো। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে চিংড়ি মাছ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম। এখানে ভোটের হার অন্যান্য উপজেলাগুলোর চেয়ে তুলনামূলক বেশি। বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, যখন একটি বিরোধী পক্ষ নির্বাচনে থাকে তখন সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ে। দুপক্ষের প্রচারণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী একটি আবেগ বা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন নির্বাচনটি শুধু হয়ে যায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিষয় বা প্রীতি ম্যাচের মত, নির্বাচন যখন মামা-ভাগ্নের লড়াইয়ে পরিণত হয় তখন মানুষ নিজেকে অধিকারহীন ভাবে, মানুষ ভোটে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নির্বাচনের ফলাফল তার জীবন এবং ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আনবে না, এরকম একটি বোধ তাদের মধ্যে প্রোথিত হয়। আর এরকম একটি পরিস্থিতির কারণেই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ  কমে যাচ্ছে। 

এজন্য দায়ী কে? ক্ষমতাসীন দল, নির্বাচন কমিশন নাকি বিরোধী রাজনৈতিক দল? ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা। জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রকাশ যাতে ভোটের মাধ্যমে হয় সেটির জন্য একটি অনুকূল আবহ সৃষ্টি করা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখা, প্রশাসন যেন নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে তা নিশ্চিত করা। অবাধ ও সুষ্ঠু উপজেলা নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের এ ব্যাপারে কোন ঘাটতি ছিলোনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে চেয়েছেন উপজেলা নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। তবে ভালো উদ্যোগ ভন্ডুল করতে আওয়ামী লীগে অতি উৎসাহীদের অভাব নেই। আওয়ামী লীগের ভেতর যারা ‘জমিদারতন্ত্র’ কায়েম করতে চায়, এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, নির্বাচনী এলাকায় জনগণকে পায়ের নীচে রেখে লুটপাটের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পুরোপুরি বিপক্ষে। নির্বাচন মানেই তাদের কাছে গদী দখল, একারণেই তারা ‘মাই ম্যান’-দেরকে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী করেছে, অনেকে ‘মাই ম্যান’দেরকে ভরসা করতে পারেনি। তারা আত্মীয় স্বজনদেরকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করে এলাকা দখল এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মিশনে নেমেছে। যদিও আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয় স্বজনদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলো, কিন্তু আওয়ামী লীগের এই নির্দেশনা মাঠে বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ মন্ত্রী-এমপিরা এখন এতই ক্ষমতাধর হয়ে গেছেন যে, তারা দলের নির্দেশনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন। যদি শেষ পর্যন্ত উপজেলাগুলোতে আত্মীয় স্বজনদের প্রার্থীতা না দিতেন তাহলে উপজেলা নির্বাচনটি আরো প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ও উৎসবমুখর হতো বলেই আমি মনে করি। কারণ এর ফলে অন্য প্রার্থীরা সমান সুযোগ পেতেন, ভোটারদের কাছে যেতেন। যেসস্ত নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রী-এমপিদের নিজস্ব ব্যক্তি এবং আত্মীয় স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন সেসমস্ত নির্বাচনী এলাকাগুলোতে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা হয়েছে, প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা হয়েছে, ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। ফলে ভোটাররা কুণ্ঠিত হয়েছেন। এতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ তারা হারিয়ে ফেলেছেন। কাজেই আওয়ামী লীগ অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চাইলেও মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শুভ চিন্তাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে কিছু লোভী, অপরিণামদর্শী মন্ত্রী-এমপি এবং প্রভাবশালী নেতা। 

নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে যে আন্তরিক, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং গঠনমূলক নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটা চেষ্টা চালিয়েছিলো। কিন্তু  মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশন শুধুমাত্র রেফারি মাত্র। নির্বাচনের আসল খেলোয়াড় হলো ভোটার রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে না পারে, প্রার্থীরা যদি জনগণকে ভোটকেন্দ্রে না নিয়ে যেতে পারে তাহলে শুধু নির্বাচন কমিশনের একা কিছু করার নেই। নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের তদারকি করতে পারে মাত্র। 

এবার বিরোধী দলের দায়িত্ব কতটুকু তা একটু খতিয়ে দেখা যাক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি দল বা ক্ষমতাসীন দলের যতটুকু দায়িত্ব ঠিক ততটুকু দায়িত্ব বিরোধী দলেরও। আধুনিক গণতন্ত্রে মনে করা হয় ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব অনেক বেশী। কারণ সরকারের ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়া, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা সামনে নিয়ে এনে, সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করাই বিরোধী দলের প্রধান কাজ। আর একারণেই আধুনিক গণতন্ত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ‘ছায়া সরকার’ গঠন করে। এই ছায়া সরকারের মাধ্যমেই তারা সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে এবং জনগণের কাছে তা তুলে ধরে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। কিন্তু আমাদের বিরোধী দলগুলো কি করছে? সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি এখন আস্তে আস্তে অস্তিত্বের সংকটে বিলীন প্রায়। এই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে জাগরণ তৈরি করার কোন চেষ্টা তারা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। উপজেলা ব্যবস্থাটি জাতীয় পার্টির সৃষ্টি। এই উপজেলা নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির আলাদা আবেগ থাকার কথা ছিল। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে শুধু ম্রিয়মানই দেখা যায়নি, জাতীয় পার্টির অনীহা ছিলো চোখে পড়ার মতো। 

বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন না করে যত না ভুল করেছে তার চেয়ে বেশি ভুল করেছে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নিয়ে। কারণ এ নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলকে সংগঠিত করার সুযোগ ছিল বিএনপির সামনে। বিএনপি তাদের নেতা-কর্মীদের হতাশা কাটিয়ে  তোলার জন্য উপজেলা নির্বাচনকে ব্যবহার করতে পারতো। আর উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি যদি দলগতভাবে অংশগ্রহণ করতো তাহলে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের জন্য তারা একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারতো। কিন্তু বিএনপি সে পথে হাটেনি। এটি কি বিএনপির রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নাকি ইচ্ছে করেই এটি করেনি? আমার বিবেচনায় এটি বিএনপি ইচ্ছে করেই নির্বাচন বর্জনের পথে হেটেছে। এটি তাদের কৌশলগত অবস্থান। কারণ বিএনপি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাঁধাগ্রস্থ করতে চায়। গণতন্ত্রকে ধ্বংসের বড় উপায় হলো নির্বাচন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলা। ভোটারদের অনাগ্রহী করা এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে জনগণের মধ্যে অনীহা সৃষ্টি। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি নিবিড়ভাবে সে কাজটি করে যাচ্ছে। আর সেকারণেই আস্তে আস্তে নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন মামা-ভাগ্নের নির্বাচনে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। উপজেলা নির্বাচন তার সর্বশেষ প্রমাণ। আর নির্বাচন গুরুত্বহীন হলেই অগণতান্ত্রিক শাক্তি সুযোগ পায়। অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা গ্রহণের পায়তারা করে। বিএনপি হয়তো গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এরকম একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই তৃতীয় পক্ষের হয়ে কাজ করছে। সব নির্বাচনকে তারা তামাশা বানানোর চেষ্টা করছে। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আবার ঢাকায় কেন ডোনাল্ড লু?

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ০৮ মে, ২০২৪


Thumbnail

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আবার বাংলাদেশ সফরে আসছেন। নানা কারণে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে অত্যন্ত আলোচিত একটি নাম। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে তাঁর তৎপরতা বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি একাধিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাঁর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং বেশ কিছু কথাবার্তা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

ডোনাল্ড লু নির্বাচনের আগে একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য তিনি বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন। যখন ২৮ অক্টোবর বিএনপি সারা ঢাকা শহরে তাণ্ডব চালায়, এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে গেলেও ডোনাল্ড লু’র একটি চিঠি নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে ধর্না দিয়েছিলেন। অবশ্য ডোনাল্ড লু’র এই চিঠিকে আমলে নেননি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। 

ডোনাল্ড লু’র এই রাজনৈতিক সংলাপের বার্তাকে অনেক বিলম্বে দেওয়া বলে অভিহিত করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এরপর দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে একটি পরিবর্তিত নীতি এবং অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ এই বক্তব্য রেখেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বার্তা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ রকম একটি অবস্থা যখন বিরাজমান তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন ঢাকা সফর করছেন- এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। 

জানা গেছে, ১৪ থেকে ১৬ পর্যন্ত দুই দিনে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে সরকারি এবং বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এছাড়াও তিনি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। আর এবার ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফর কী বার্তা দেবে তা নিয়ে নানারকম জল্পনা কল্পনা চলছে। 

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফর। সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়া এবং বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অবস্থানকে সম্প্রসারণ করাই ডোনাল্ড লু এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলেই একাধিক কূটনৈতিক সূত্র দাবি করেছে। 

বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশেষ করে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকার যে দরপত্র আহ্বান করেছে সেখানে যেন মার্কিন কোম্পানিগুলো সুবিধা করতে পারে সে সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী। তবে এর পাশাপাশি বাংলাদেশের মানবাধিকার, বিরোধী দলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড লু’র সফর নিয়ে যত মাতামাতি হতো বা যে আতঙ্ক তৈরি হতো এবারে সেই পরিস্থিতি হচ্ছে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ডোনাল্ড লু   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের সাজা প্রায়শ্চিত্ত, বিএনপির মৃত্যুদণ্ড

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৬ মে, ২০২৪


Thumbnail

শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?

আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।

এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।

কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।

আরও পড়ুন:  আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার

কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত। ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল। কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।

গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।

আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে। এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল। যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই অকেজো হয়ে যাচ্ছে।

৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।

আরও পড়ুন:  প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি

২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান। চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়, তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই। দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই। সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।

শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।


সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com

 


আওয়ামী লীগ   বিএনপি   জাতীয় সংসদ নির্বাচন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৩ মে, ২০২৪


Thumbnail

একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন। যেহেতু কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্যোগকে জাতিসংঘ ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাই এমন একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি করা সমীচীন নয়, শোভনও নয়। সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি করতে চাই। তুমি যোগাযোগ কর। আমি বঙ্গভবনে যোগাযোগ করলাম। রাষ্ট্রপতি চিকিৎসা শেষে মাত্র যুক্তরাজ্য থেকে ফিরেছেন। একান্ত সচিব বললেন, ‘আমি দেখছি।’ দুদিন পর সময় পাওয়া গেল। আমি এবং সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী গেলাম বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি হবার পর এটা ছিলো আমার তৃতীয় সাক্ষাৎ। তিনবারের কোন বারেই তার আন্তরিকতার ঘাটতি পাইনি। দেশে সর্বোচ্চ পদে যাবার পরও তিনি সেই হাসিখুশী, বন্ধুসুলভ, প্রাণবন্ত, নির্ভেজাল মানুষ। সদ্য চিকিৎসা শেষ করে তিনি দেশে ফিরেছেন। জরুরী রাষ্ট্রীয় কাজ ছাড়া কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কিন্তু আমাদের অনুরোধ তিনি ফেললেন না। সচিবকে ডেকে একটা তারিখ ঠিক করতে বললেন। সেই থেকে এই আয়োজনের ব্যস্ততা। অবশেষে ৩০ এপ্রিল একটা সফল এবং গোছানো অনুষ্ঠান করলো ক্রিয়েটিভ মিডিয়া। অনুষ্ঠান শেষে ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। রাতের খাবারের পর সোফায় শরীর ছেড়ে দিয়ে আধো ঘুমে টেলিভিশন সংবাদ দেখার চেষ্টা করছি। রাত বাজে সাড়ে দশটা। এমন সময় রাষ্ট্রপতির ফোন। আমি বেশ বিস্মিত হয়েই ফোন ধরলাম। রাষ্ট্রপতি বললেন ‘বোরহান খুব সুন্দর অনুষ্ঠান করেছেন। ধন্যবাদ।’ আমি আপ্লুত, হতবিহম্বল। রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘অনুষ্ঠানে আপনাকে খুঁজলাম। পেলাম না। দেখা হলো না, তাই ফোন করলাম।’ আমি জানালাম পর্দার পিছনে থেকে অনুষ্ঠান তদারকি করছিলাম। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি ফোন রাখলেন। দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির বিনয়, উদারতা মুগ্ধ করার মতো। আজকাল এই আচরণ অভাবনীয়। আমার জন্য এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর সম্প্রতি পূর্ণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে বঙ্গভবনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। মোঃ সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি হওয়াটাই ছিলো এক চমক এবং বিস্ময়কর ঘটনা। নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এনিয়ে নানা আলোচনা ছিলো। বিভিন্ন রথী মহারথীদের নাম সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে কোথাও মোঃ সাহাবুদ্দিনের নাম ছিলো না। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গুলশানে আমি নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘স্বপ্নেও ভাবিনি আমি রাষ্ট্রপতি হবো।’ আমাকে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন এভাবে ‘পরদিন পাবনা যাবো। এজন্য সেলুনে গেছি, চুল কাটাতে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, কি করছি। আমি জবাব দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন আমার ব্যাংকে কোন লোন আছে কিনা, ক্রেডিট কার্ডের বকেয়া ইত্যাদি।’ তিনি বললেন, ‘তখনও আমি ভাবিনি, এরকম কিছু হচ্ছে।’ 

একটা কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের জন্য সেই সময়টা ছিলো কঠিন, অনিশ্চয়তায় ভরা। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ রাঙানী, বিরোধী দলের আন্দোলন, সুশীলদের চক্রান্ত। সব কিছু মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, সেটিই ছিলো এক বড় প্রশ্ন। এরকম পরিস্থিতি সব সময়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলের দরজা খুলে দেয়। চক্রান্ত ডাল মেলা মেলে। বাংলাদেশে অবৈধ ক্ষমতা দখলে প্রায়ই বঙ্গভবন হয় ষড়যন্ত্রের আঁতুড় ঘর। ২০০৭ সালের এক এগারো যার সর্বশেষ উদহারণ। সুশীলদের পক্ষ থেকে ‘নিরপেক্ষ এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য’ কাউকে রাষ্ট্রপতি করার আহ্বান ছিলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো চাইছিলো এমন কাউকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখতে যার মাধ্যমে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী মেটানো যায়। 

আওয়ামী লীগের জন্য নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিলো অগ্নি পরীক্ষা। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগ যে ভুল করেছিল তার মাশুল চরম ভাবে দিতে হয়েছিল দলটিকে। কে নতুন রাষ্ট্রপতি হবেন, এনিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই ছিলেন অন্ধকারে। এরকম এক সময় আলোচনার বাইরে থাকা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। এটি ছিলো আচমকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আসন্ন চক্রান্ত মোকাবেলার জন্যই বেছে নিয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তিকে যিনি বিশ্বস্ত, বিচক্ষণ এবং আদর্শের প্রশ্নে আপোষহীন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তার জীবনে কোন দিন আদর্শচ্যুত হননি। জাতির পিতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রতিবাদ করেছেন। রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারাভোগ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। তবে আদর্শের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিলো পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময়। ডাক সাইটে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা চেয়েছিলেন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের কাল্পনিক দুর্নীতির অভিযোগকে প্রশ্রয় দিতে। তারা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে কলংকিত করার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। মোঃ সাহাবুদ্দিন তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানও নন। একজন সদস্য মাত্র। দায়িত্ববানরা যেকোন পরিস্থিতিতেই আদর্শের প্রশ্নে অটল হিমালয়ের মতো দাঁড়াতে পারেন তার প্রমাণ সে সময় রেখেছিলেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। দুদকের কমিশনার থেকে একাই তিনি রুখে দেন ষড়যন্ত্র। কিন্তু এনিয়ে তিনি হৈ চৈ করেননি। আত্ম অহংকারে বেসামালও হননি। আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আমার দায়িত্ব। কোন কিছু প্রাপ্তির জন্য এটি আমি করিনি।’ সারাজীবন এভাবে নীরবে, নিভৃতে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন এই মানুষটি। আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন কোন প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়াই। মোঃ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কেন্ডিক প্রসাদ ষড়যন্ত্রের মুখ বন্ধ করে দেন শেখ হাসিনা। যারা মোঃ সাহাবুদ্দিনকে ন্যূনতম চেনে তারা জানেন, আর যাই হোক নীতির প্রশ্নে তাকে এক চুলও টলানো যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্য প্রয়োজনে তিনি জীবন দেবেন। 

আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনার দূরদর্শী, বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিলো একটি টার্নিং পয়েন্ট। এর মাধ্যমে নির্বাচন বিরোধী ষড়যন্ত্র জোট হতচকিত হয়ে যায়। দায়িত্ব নিয়ে মোঃ সাহাবুদ্দিন নির্বাচন কেন্ডিক উত্তাপ সামাল দেন ঠান্ডা মাথায়। তার অভিভাবকত্বে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। একবার ভাবুন তো, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের সময় ভীরু, কাপুরুষদের কেউ যদি রাষ্ট্রপতি হতেন, তাহলে কি এভাবে নির্বিঘ্নে সব কিছু হতো? সংশোধিত শ্রম আইনে স্বাক্ষর না করে তিনি বুঝিয়েছেন বঙ্গভবন দায়িত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় কথা মোঃ সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার একজন যোগ্য অভিভাবক হিসেবে একবছরে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ক্ষমতার দম্ভ তাকে স্পর্শ করতে পারে নি। রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ পদ তার বিনয়, সৌজন্যতাকে ম্লান করতে পারেনি। এখনও তিনি যেন সেই প্রাণখোলা মানুষটি। কিন্তু নীতির প্রশ্নে অটল। ৩০ এপ্রিলের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মহামূল্যবান একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন ‘শুধু কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাই হলো ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ।’ এই বার্তাটি তিনি সকলের কাছে পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান। আমি মনে করি এই নির্দেশনাটি মহামূল্যবান। এটিই এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রধান করণীয়।  

মোঃ সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি হবার পরও ঠিক আগের মতোই আছেন। জনবিচ্ছিন্ন হননি। নিরাপত্তার শৃংখল থেকেও তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সূতোটা কাটেননি। এই জীবনে তো বহু মানুষ দেখলাম, যারা ক্ষমতা পেলে এমন দম্ভ দেখান যে, মনে হয় সারাজীবন এরকম ক্ষমতাবানই থাকবেন। ক্ষমতাহীন অবস্থায় যারা বুকে টেনে নিতেন, ক্ষমতা পেয়েই তারা অচেনা মানুষ হয়ে যান। এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। যারা অযোগ্য, চাটুকার, মতলববাজ তারাই ক্ষমতা পেয়ে দিশেহারা হন। অতীত ভুলে যান। উপকারীকে এড়িয়ে চলেন। কৃতজ্ঞহীন এক অমানবিক মানুষে পরিণত হন। এদের একজনের গল্প বলি।  

তিনি বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পেয়ে হতাশায় মুষড়ে পরলেন। প্রায় প্রতিদিন আমার অফিসে আসতেন। তার পরিবারের কাছে কিভাবে তিনি ছোট হলেন তার বিবরণ দিতেন কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে। দুপুরে আমার অফিসেই খাবার টেবিলে মনোনয়ন না পাওয়ার বেদনায় আক্রোশ ঝাড়তেন মুরগীর রান চিবিয়ে। শেখ হাসিনা তাকে মূল্যায়ন করলো না, এনিয়ে তার কি গোস্বা। কিছুদিনের মধ্যেই খবর এলো তাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হচ্ছে। এক বিকেলে উচ্ছ্বাসিত ভাবে এলেন অফিসে। প্রধানমন্ত্রী তার ফাইল অনুমোদন করেছেন। এখন রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলেই সরকারি আদেশ জারী হবে। রীতিমতো ঘামছেন। রাষ্ট্রপতি তখন যুক্তরাজ্যে। বিভিন্ন জন তাকে নানান তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেন না, ফলে তার অস্থিরতাও কমছে না। তার এই অবস্থা দেখে আমি সরাসরি ফোন করলাম রাষ্ট্রপতিকে। তিনি যুক্তরাজ্যে আছেন জেনেও। তিনি ফোন ধরে বললেন, ‘বোরহান আমি হাসপাতালে, আমার টেস্ট চলছে, জরুরী কিছু? আমি ঐ উপাচার্যের ফাইল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘আমি একটু আগেই ফাইলে স্বাক্ষর করেছি।’ আমার এই ধৃষ্টতা এবং বাড়াবাড়িতে তিনি এতটুকু বিরক্ত হলেন না। বরং নতুন উপাচার্যকে অভিনন্দন জানালেন। একজন মানুষ কতটা খাটি, নির্ভেজাল এবং আন্তরিক হলে এটা সহ্য করে। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এই বিনয়ের কারণ তিনি আদর্শবান, যোগ্য। আর যে ব্যক্তি এমপি না হতে পেরে উপাচার্য হলেন, তিনি কদিন পর বিরাট মানুষ হয়ে গেলেন। তার কথা বার্তা, আবার আচরণে মুহূর্তে অন্যরকম হয়ে গেল। আমি তার কাছে আবর্জনা হয়ে গেলাম। 

আমার এক অনুজ প্রতিম সাংবাদিক দেশ টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ফারুক আমাকে এক বিকেলে ফোন করলেন। অনুরোধ করলেন, ঈদের অনুষ্ঠানে নতুন উপাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়। আমি যেন তাকে বলে দেই। আমি উপাচার্যকে ফোন করলাম। তিনি ফোন ধরলেন না। আগে যিনি দিনে কয়েকবার ফোন করতেন। ফোন না পর্যন্ত বার বার ফোন করেই যেতেন, তিনি আমার ফোন রিসিভ না করাতে আমি এতোটুকু দুঃখিত হইনি। ভাবলাম নিশ্চয়ই ব্যস্ত। উপাচার্য বলে কথা। নিশ্চয়ই ফ্রি হলে ফোন করবেন। কিন্তু তিনি ফোন ব্যাক করলেন না। পরদিন বিকেলে আবার ফারুকের অনুরোধ। এবার আমি ফারুককে রেখেই উপাচার্যকে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে। বললেন, ‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমি ভীষণ ব্যস্ত।’ আমি একটু বিস্মিত হলাম। ধাতস্থ হয়ে ফারুকের প্রস্তাব বললাম। আমি যেন মহা অন্যায় করেছি। তিনি বললেন, ‘এসব এখন হবে না। আমি ব্যস্ত।’ আরো কিছু কথা শোনার পর আমি বললাম ‘ভাগ্যিস আপনি শুধু উপাচার্য হয়েছেন, মন্ত্রী এমপি হননি।’ কদিন আগে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ক্রোড়পত্রে মাষ্টার হেডে প্রধানমন্ত্রীর ছবিই বাদ দিয়েছেন। উপাচার্য হয়েই তিনি নিরপেক্ষ হবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই মাইনাস করলেন? অযোগ্যরা ক্ষমতায় গেলে এভাবেই সম্ভবত বদলে যায়, অহমিকার এক মুখোশ পরে। এই ব্যক্তি একা না। এরকম ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী ক্ষমতা যাদের মাথা খারাপ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। এর কারণ তারা ক্ষমতা লোভী, অযোগ্য। রাষ্ট্রপতি হলেন একজন অসাধারণ সাধারণ মানুষ। ক্ষমতা যার মৌলিকত্ব, অকৃত্রিম আন্তরিকতা কেড়ে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তিনি যে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি গত এক বছরে কাজ দিয়েই তা প্রমাণ করেছেন মোঃ সাহাবুদ্দিন। 
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ০২ মে, ২০২৪


Thumbnail

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেন যে, ১৪ দল বিলুপ্ত হয়নি, ১৪ দল আছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সাফ জানিয়ে দিলেন, খুব শীঘ্রই তিনি ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। 

প্রধানমন্ত্রী এটিও বলেছেন যে, ১৪ নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। ১৪ দলের সমন্বয়ক নিয়মিত ১৪ দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এছাড়াও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ১৪ দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। 

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ১৪ দলের নেতাদেরকে উল্লসিত করেছে। তীব্র তাপদাহে যেন তাদের কাছে এক স্বস্তির বৃষ্টি। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর ১৪ দলের শরিকরা এতিম হয়ে পড়েছিল। তারা কোথাও পাত্তা পাচ্ছিল না। মন্ত্রিসভাতে যেমন ১৪ দলের কাউকে রাখা হয়নি, ঠিক তেমনই সংরক্ষিত নারী আসনে যে ৪৮ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেখানও ১৪ দলের কোন প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি। ১৪ দলের নেতাদের এ বার নির্বাচনে বড় ধরনের ভরাডুবি ঘটেছে। হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ফজলে হোসেন বাদশার মতো ১৪ দলের হেভিওয়েট নেতারা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন। এরপর ১৪ দলের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ১৪ দলের নেতারা সেই সময় থেকেই আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। এর মধ্যে ১৪ দলের বৈঠক নিয়ে কিছু কথাবার্তা হলেও শরিকরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং ১৪ দলের অন্তত তিনজন নেতা গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে সংশয় প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, ১৪ দল শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না তা নিয়ে তারা শঙ্কিত।

২০০১ সালে নির্বাচনের বিপর্যয়ের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আওয়ামী লীগ এই ১৪ দলীয় জোট গঠন করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ভূমিধ্বস বিজয়ের পর ১৪ দলের সদস্যদেরকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়েছিল। সেই সময় দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে গঠিত মন্ত্রিসভাতেও ১৪ দলের নেতা রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুকে রাখা হয়েছিল। এরপর থেকেই ১৪ দলের শরিকদেরকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়। 

এবার নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে শরিকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তিক্ততা সৃষ্টি হয় এবং তিক্ত অবস্থা রেখেই আওয়ামী লীগ ১৪ দলের শরিকদের জন্য মাত্র ৬টি আসন দেয়। শেষপর্যন্ত জোটের স্বার্থে ১৪ দল নির্বাচনে ওই কয়েকটি আসন নিয়ে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সেখানে ১৪ দলের অধিকাংশ নেতার বিপুল ভরাডুবি হয়। বিশেষ করে হাসানুল হক ইনু, ফজলে হোসেন বাদশা এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বিপর্যয় ১৪ দলকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়। এমনকি শিরীন আখতারকে পরবর্তীতে সংরক্ষিত আসনের এমপি করা হবে- এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বলেও জাসদের নেতারা দাবি করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিরীন আখতারও সংরক্ষিত কোটায় এমপি হতে পারেননি। এরকম অবস্থায় ১৪ দলের মধ্যে চাপা ক্ষোভ, অসন্তোষ এবং হতাশা ছিল দৃশ্যমান। কিন্তু আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করলেন যে, তিনি ১৪ দলের সঙ্গে বসবেন। 

তিনি বলেছেন, কার্যনির্বাহী কমিটির সঙ্গে বৈঠক করার পর তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর তিনি ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ১৪ দলের এই বৈঠকের নেতাদেরকে উল্লসিত করেছে। তারা এখন আশায় বুক বেঁধে আছেন। 

১৪ দলের নেতারা আসলে কর্মীহীন, অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে লতাপাতার মতো জড়িয়ে থেকে তারা কোন রকম অস্তিত্ব রক্ষা করতে চেষ্টা করছেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগ যদি তাদের থেকে ছাতা সরিয়ে নেয় তাহলে এই দলগুলো মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি আজ তাদেরকে জীবিত করার যেন মহৌষধ দিলেন।

১৪ দল   আওয়ামী লীগ   প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন