গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেছে। কিন্তু এ নির্বাচনে হেরেও জিতেছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন উৎসব করতে পারে, ঠিক তেমনি এ নির্বাচন আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে সতর্কবার্তা দিল। গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে দলটি। এ আন্দোলনের কৌশল হিসেবে সব নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখছে বিএনপি। আগে বিএনপির জনপ্রিয় নেতারা স্থানীয় প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখার স্বার্থে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হতেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সে ব্যাপারেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে বিএনপি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদেরও আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল খুবই সোজাসাপ্টা। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বিএনপি ভোট বর্জন করলেই নির্বাচন নিরুত্তাপ হবে। জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবে না। ফলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপির কৌশল কাজে লেগেছে। চট্টগ্রামের একটি উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৪ শতাংশের মতো। বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়—এটি প্রমাণের জন্যই বিএনপি ভোট থেকে দূরে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক। যুক্তরাষ্ট্র ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও তারা বিএনপির ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের দাবিকে সমর্থন জানায়নি। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শর্তপূরণের জন্য প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ জরুরি। বিএনপি কূটনীতিকদের বোঝাতে চাইছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় উত্তাপহীন, জনগণ সেই নির্বাচনে অংশ নেয় না, প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দল মিলে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এরকম উত্তেজনাহীন নির্বাচন যত হবে, তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালো হবে। কিন্তু গাজীপুরে বিএনপির কৌশল ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, উৎসবমুখর, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যে করা যায়, গাজীপুর তার প্রমাণ। এটি আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তির। এর ফলে বিএনপি ছাড়াই আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে এগোতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি গত এক বছর ধরেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। তিনি বারবার বলছেন, নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। যুক্তরাজ্যের মতো নির্বাচন হবে বাংলাদেশে—এমন বক্তব্য তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। শেখ হাসিনা এটিও বলেছেন, জনগণ ভোট দিলে সরকার গঠন করব। আর ভোট না দিলে ক্ষমতা ছেড়ে দেব। এটি যে কথার কথা নয়, গাজীপুর সিটি নির্বাচন তার প্রমাণ। এ নির্বাচনে পর্দার আড়ালে অনেক নাটক হয়েছে। অতি উৎসাহীরা নানাভাবে প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ জোর করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়ার ফর্মুলা নিয়েও দৌড়াদৌড়ি করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা অর্বাচীনদের এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এমনকি কোনো কোনো নেতাকে আওয়ামী লীগ সভাপতি সতর্ক করে দিয়েছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কারচুপির চেষ্টা করলে তিনি কাউকে ছাড়বেন না। ফলে গাজীপুর নির্বাচনে কোনো কেলেঙ্কারি হয়নি। শেখ হাসিনা নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ দেননি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ধারায় যদি বাকি চারটি নির্বাচন হয়, তাহলে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি মুখ থুবড়ে পড়বে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব বলা যৌক্তিক হবে। গাজীপুর নির্বাচন প্রমাণ করেছে, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনের একমাত্র ফ্যাক্টর বিএনপির অংশগ্রহণ নয়। বিএনপি ছাড়াও যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, গাজীপুর তার বিজ্ঞাপন। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য বিশাল স্বস্তির। এ নির্বাচনের আগের দিনই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় সৃষ্টিকারীদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়। এরকম সতর্কবার্তার পর প্রথম পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকার খুব ভালোমতোই পাস করেছে। নির্বাচন নিয়ে চাপ বিএনপির কাঁধে তুলে দিতে গাজীপুর নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাই প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের চেয়ে এ নির্বাচন সরকারের জন্য একটি বড় বিজয়। গাজীপুর হেরেও জিতেছে আওয়ামী লীগ।
গাজীপুরের নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা বাড়াবে। কিন্তু নানা কারণে এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তির। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তা। গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ এবং বিভক্তির ভয়ংকর রূপ প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগই যে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ, তা প্রমাণ হয়েছে গাজীপুরে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ এবার মনোনয়ন দেয় দলের প্রবীণ নেতা আজমত উল্লাকে। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর গাজীপুরে জনপ্রিয়। আওয়ামী লীগের তরুণরা তাকে পছন্দ করে। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ জনগণের মধ্যে জাহাঙ্গীরের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এ বাস্তবতাগুলো উঠে আসেনি। জনমতের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর আলমকে ‘কোণঠাসা’ করতে গিয়ে প্রভাবশালী নেতারা আওয়ামী লীগকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন। আজমত উল্লাকে মনোনয়ন আরও সুন্দর এবং শালীনভাবে দেওয়া যেত। যেমনটি করা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রে। সেখানে আওয়ামী লীগের দুই প্রতিপক্ষ নেতাকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুজনের সঙ্গে কথা বলে একটি সমঝোতা করে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল। গাজীপুরে তেমনটি করা হলো না কেন? ২০১৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে অহংকার এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করেন, দল যাকে ইচ্ছা মনোনয়ন দেবে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে প্রভাব খাটিয়ে জিতিয়ে আনবে। গাজীপুরেও সেই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। রাজনীতি হুমকি, ধমকের বিষয় নয়। একটি সমঝোতার কৌশল। এ চিরন্তন সত্যটা আওয়ামী লীগ ভুলেই গিয়েছিল। জাহাঙ্গীর এবং তার মা যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন, তখন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ‘দমন নীতি’ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। ভয় দেখিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে রাজনীতিতে জয়ী হওয়া যায় না। জাহাঙ্গীরের (এবং তার মা) বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ভুল কৌশল প্রয়োগ করেছেন। ভোটের আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা, দুদকে তলব, তার কর্মীদের ওপর পেশিশক্তি প্রয়োগ—সবই জনগণের মধ্যে জায়েদা খাতুনের পক্ষে এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীরা এটা পছন্দ করেননি। ভোটের দিন দেখা গেছে, নৌকার কার্ড গলায় ঝুলিয়ে তারা ঘড়ি মার্কায় ভোট দিয়েছেন। আওয়ামী লীগে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে সব নেতাই প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং তার পরামর্শকরা গাজীপুরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তার ফলও ভালো হয়নি। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কারও ক্রীতদাস নয়। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর তার মাকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গেছেন। কান্নাকাটি করেছেন। ভোটারদের সহানুভূতি আদায় করেছেন। যেটি আওয়ামী লীগের আদি নির্বাচন কৌশল। ভোটে জয়ী হওয়ার জন্য আজমত উল্লা ভোটার নয়, নানা শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। জাহাঙ্গীরের সমর্থদের গ্রেপ্তার, কাউকে কাউকে হুমকি দিতেও শোনা গেছে। জাহাঙ্গীরের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না। এমন পরিকল্পনার নিপুণ বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন ঢাকা থেকে আসা কিছু নেতা। তারা বিশ্বাসও করেননি, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন এরকম অভাবনীয় নিরপেক্ষ হবে। ভোটের স্বাভাবিক সহজ কৌশলকে আওয়ামী লীগ পাত্তা দেয়নি। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর বুঝিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনের অঙ্ক তিনি ভালোই বোঝেন। জাহাঙ্গীর তার মায়ের পক্ষে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটকে একাট্টা করেছেন। নীরব সমর্থদের সংগঠিত করেছেন। নিরপেক্ষ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পেরেছেন। গাজীপুরের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত প্রশাসন নিরপেক্ষ ছিল। নির্বাচন কমিশন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবকিছু উজাড় করে কাজ করেছে। ফলে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপর্যয় হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুর থেকে আওয়ামী লীগ কি শিক্ষা নেবে? ২৫ মের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো প্রার্থী বাছাই। প্রার্থী যদি যথাযথ না হয়, জনপ্রিয় না হয়, তাহলে ভরাডুবি অনিবার্য। জাতীয় নির্বাচনের বাকি ছয় মাস। এখনো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে সময় আছে। এখন যারা জনবিচ্ছিন্ন সংসদ সদস্য, দলের বাইরে সাধারণ জনগণের সঙ্গে যারা সম্পর্কহীন, তাদের বাদ দেওয়ার এখনই সময়। গাজীপুর শেখাল, জনবিচ্ছিন্ন, বিতর্কিত প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। এ নির্বাচনের দ্বিতীয় শিক্ষা হলো—তৃণমূলের শক্তিতে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলটিকে প্রশাসননির্ভরতা কমাতে হবে। আগামী ভোটে প্রশাসন আর পুলিশ দিয়ে পার করা যাবে না। জনগণের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে যেতে হবে। ভোটাররাই রাজনৈতিক দলের আসল শক্তি। নতুন মার্কিন নীতিমালার পর অতি আওয়ামী লীগার হয়ে ওঠা প্রশাসনের লোকজন যে আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো ঝুঁকি নেবেন না, তার অনুধাবন করতে হবে দলের প্রার্থীদের। এ উপলব্ধি যত দ্রুত হয়, ততই তাদের জন্য মঙ্গল।
২০০৮-এর নির্বাচনের পর বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটার হয়েছেন। এমন প্রার্থী দিতে হবে যাতে তরুণরা আকৃষ্ট হন। ভোট একটি রাজনৈতিক বিজ্ঞান। এখানে গণিত গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের হিসাব ঠিকঠাক মতো করেই প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হবে আওয়ামী লীগকে।
আগামী নির্বাচন হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর শেষ নির্বাচন। একটি অসাধারণ, অনবদ্য এবং অনন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তিনি কোনো আপস করবেন না। একবিন্দুও ছাড় দেবেন না। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি সেটি ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা চাটুকার, সুবিধাভোগী, মতলববাজরা কি সেই বার্তাটা পেয়েছেন? না পেয়ে থাকলে সামনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত
হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী
লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা
যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন
তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই
তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী
আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন
কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী
হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে
৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের
নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির
আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন
যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হবে?
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী
লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী
দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে
তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন,
তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত
কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের
মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত
কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।