১৭ জুলাই। নিরুত্তাপ ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনের ভোট গ্রহনের শেষ পর্যায়। অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র খাঁ খাঁ করছে। বিকেল সাড়ে তিনটা। বনানী একটি কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম গেলেন, শেষ মুহুর্তের তদারকির জন্য। ততোক্ষণে নির্বাচনের ফলাফল কি হতে যাচ্ছে, তা মোটামুটি নির্ধারিত। এ সময় ঘটে অঘটন। কিছু অতি উৎসাহীরা (কিংবা ষড়যন্ত্রকারীরা) হামলা করে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে। পুলিশ নিরাপদ দূরত্বে থেকে তামাশা দেখে। হিরো আলমকে কিল ঘুষি মারার দৃশ্য দ্রুত ছড়িয়ে পরে টেলিভিশনে, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে। এটি এখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিক এবং সংগত কারণেই এর নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ। তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নেই, বিএনপি এই অপকর্মটি করেছে। সেক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি করলো? বিএনপিতো চাইবেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। একটা ইস্যু তৈরী করতে। সেক্ষেত্রে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের উচিত ছিলো এব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা। সেটি কি করতে পেরেছে সংশ্লিষ্টরা?
ঘটনা ঘটে যাবার পর এর অনেক রকম ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। নানা রকম আবিষ্কারের অতি উৎসাহী খেলা চলছে। হিরো আলমই আগে আক্রমন করেছেন, এমন প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এসব কোনটাই গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণ মানুষ এসব বিশ্বাস করছে না। আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক ছাড়া সবার ধারণা আওয়ামী লীগের উচ্ছৃঙ্খল কিছু কর্মী এই কান্ড ঘটিয়েছে। একজন প্রার্থীকে সুরক্ষা দেয়া, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের। এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা কোন ভাবেই উপেক্ষা করার উপায় নেই। সকলেই জানে, ঢাকা-১৭ উপ নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক মহলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, তা প্রমাণের শেষ সুযোগ এই নির্বাচন। ঢাকায় সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় এই উপ-নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। মার্কিন প্রতিনিধিদল সদ্য বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বিএনপি সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল একদফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এরকম বাস্তবতায় একটি সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া ছিলো নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার এবং নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। হিরো আলমের উপর হামলার ঘটনা যারাই ঘটাক না কেন, এর দায় সরকারের উপরই এসে বর্তেছে। বিএনপি এখন তাদের দাবীর পক্ষে এক অব্যর্থ অস্ত্র হাতে পেল। আন্তর্জাতিক মহল যারা বংলাদেশে একটি অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা এই ঘটনায় উল্লাসিত।
গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারকে বিভিন্ন ভাবে বিব্রত করছে কিছু অতি উৎসাহী নব্য আওয়ামী লীগ। নানা সময়ে এরা এমন কান্ড করেছে যে সরকারের মাথা হেট হয়েছে। কিন্তু এখন সময়টা ভিন্ন। জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের মুখে এধরনের বালখিল্যতার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এই ঘটনার পর পুলিশ বেশ ক’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। ঘটনার নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। সরকার দলের সমর্থক করুক, বিএনপি করুক, কিংবা হিরো আলম আলোচিত হবার জন্য এই ঘটনা ঘটাক-তা পক্ষপাতহীন ভাবে খুঁজে বের করতে হবে। সরকার দলের সমর্থকরা যদি কেউ এমন কান্ড করে, তাহলে বুঝতে হবে এরা ষড়যন্ত্রকারী। কখনও ধর্ষণ, কখনও চাঁদাবাজি, কখনোবা দুপক্ষের মারামারি। এরা সরকারের জন্য ভয়ংকর ব্যাধি। আওয়ামী লীগ বা সরকারের কোন উপকারে এরা আসে না, আসবে না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি খুশী হতাম, ঘটনার পর যদি আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী হিরো আলমকে দেখতে যেতেন, তাকে সহানুভূতি জানাতেন। ঘটনার পর তার সংবাদ সম্মেলন আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু একজন সদ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিলো আরো বেশি। ঘটনার পর প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য ছিলো দায়িত্বশীল। কিন্তু এরপর হিরো আলম কেন্দ্রিক ঘটনা নিয়ে শুরু হলো চাটুকারিতার প্রতিযোগিতা। কোন কোন নেতা এমন বক্তব্য দিচ্ছেন যাতে মনে হচ্ছে হিরো আলমই অপরাধী। চাটুকারদের আবোল-তাবোল বক্তব্য আওয়ামী লীগকেই জনগণের কাছে হাস্যকর করেছে। এখানে দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েও লাভ নেই। বনানী বিদ্যানিকেতনের সামনে ১৭ জুলাইয়ের ঘটনা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত এবং দুর্ভাগ্যজনক। এনিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি না করে দরকার নির্ভেজাল তদন্ত। প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করা। এই ঘটনাটিকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। আমি একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেও মনে করি না। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত এবং অনিশ্চিত করার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এই ঘটনা। এরা বাইরের হোক বা সরকারের ঘরের লোক হোক, এরা গণতন্ত্রের শত্রু। এরকম ছোট ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছে। তাই এই ঘটনা অন্য খাতে নেয়ার সুযোগ নেই। একে হালকা ভাবে নিলে কিংবা পাশ কাটাতে চাইলে সরকারেরই ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। কেউ নিজের ক্ষতি করতে চায় না। হিরো আলমকে পিটিয়ে, তাকে বিশ্বে পরিচিত করে আওয়ামী লীগের কোন লাভ নেই। বরং ক্ষতি। কিন্তু অতি উৎসাহী এবং চাটুকারদের বক্তব্য এবং কর্মকান্ড এই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকেই কাঠ গড়ায় দাড় করাচ্ছে। অতি উৎসাহী এবং চাটুকারদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কতিপয় বাঁচাল মন্ত্রী।
তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় ‘আপদ’ হলো কতিপয় দায়িত্ব জ্ঞানহীন অর্বাচীন মন্ত্রীর কথাবার্তা। এদের মধ্যে লাগামহীন অতিকথনের প্রতিযোগিতা হলে কে চ্যাম্পিয়ন হবে তা বলা মুশকিল। তবে একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যে অসংলগ্ন কথা বলার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছেন, তা দেশের সাধারন জনগণের অজানা নয়। তিনি কখনো বলেন ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর মতো।’ আবার রেগে গেলে বলেন ‘গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঢং।’ একবার তিনি বললেন ‘ভারতকে বলেছি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে।’ পরদিন রেগে বললেন ‘কি তাজ্জব। এমন কথা বলিনি। সাংবাদিকরা আমার বক্তব্য টুইষ্ট করেছে।’ হিরো আলমের ঘটনার সময় তিনি দেশে ছিলেন না। বিদেশ থেকে আসার পর তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের মুখোমুখি হলেন। গণমাধ্যমের তিনি খুবই প্রিয়। কারণ যেকোন বিষয়ে অকূটনৈতিক সুলভ মেঠো বক্তব্য তিনি গড়গড় করে বলে ফেলেন। মিডিয়ার জন্য নানা উপাদেয়, মুখরোচক খোরাক দিতে তিনি সিদ্ধ হস্ত। গত বুধবার (১৯জুলাই) ১২ দেশের দূতাবাসের বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি রেগে গেলেন। তিনি নির্বাচনে একজন প্রার্থীর উপর হামলার ঘটনায় সঙ্গে তুলনা করলেন আমেরিকায় লোক মরে যাওয়ার ঘটনার। উত্তেজিত মন্ত্রী বললেন, আপনারা কেন তাদের জিজ্ঞাসা করেন না? প্রতিদিন বিভিন্ন দেশে লোক মারা যায়। তখন তারা কেন বিবৃতি দেয় না? আর বাংলাদেশ হলেই মগের মুল্লক পায় ওরা। এভাবে বিবৃতি দেয়া গ্রহণযোগ্য নয়।’ ওমা একি কথা শুনি আজ মন্ত্রীর মুখে। এই মন্ত্রী কদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে উচ্ছ্বাসিত হলেন। উজরা জেয়া বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না, এনিয়ে মন্ত্রীর খুশি দেখে তো আওয়ামী লীগের কর্মীরা বলতে শুরু করলো, বিএনপির সাথে যুক্তরাষ্ট্র নেই। এই মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দুর্দিনে উদ্বাস্তু অবস্থায় তাকে ঠাই দেয়ার কথা স্মরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পরলেন। ‘যতোখুশী বিদেশী পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাতে’ উন্মুক্ত মন্ত্রী হিরো আলমের উপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ১২ দেশের বিবৃতিতে ক্ষুদ্ধ কেন, বুঝলাম না। ১২ দেশের বিবৃতির সমালোচনা করে মন্ত্রী কি আওয়ামী লীগকেই ঐ ঘটনার জন্য আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করালেন না? দুটি কারণে তার বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং অপ্রাসঙ্গিক। প্রথমত: সব দেশেই নানা কারণে মানুষ মারা যায়। সব ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে বিশ্ব আলোড়িত হয় না। যুক্তরাষ্ট্র, কিংবা ফ্রান্সের উদাহারণ মন্ত্রী দিয়েছেন। বাংলাদেশেও তো জমি-জমা, নানা স্বার্থে মানুষ মারা যায় প্রতিদিন। এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিবৃতি দেয় না। ঐ সব আইন শৃঙ্খলা জনিত অপরাধ। নির্বাচনে একজন প্রার্থীর উপর হামলার ঘটনা আর সহিংসতায়, দূর্ঘটনায় মৃত্যু এক নয়। এতটুক বোঝার বোধ-বুদ্ধি যদি একজন মন্ত্রীর না থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই। দ্বিতীয়ত: নির্বাচন নিয়ে গত একবছরের বেশি সময় ধরে কূটনীতিকরা নানা তৎপরতায় লিপ্ত। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এধরনের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এনিয়ে কখনো শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। বরং সরকারের পক্ষ থেকে এধরনের হস্তক্ষেপকে স্বাগত! জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন দূতাবাসের আমন্ত্রণে বৈঠক করেছে। এই তো কদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের পাঁচ তারকা হোটেলে খাইয়ে দাইয়ে আশ্বস্ত করেছে, নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু হবে। বিদেশীরা তত্ত্ববধায়ক সরকার চায় না এনিয়ে আলোচিত বাঁচালমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের উল্লাস দেশবাসী দেখেছে। তখন আপনি উল্লাসিত হলেন, শিহরিত হলেন, আর এখন আপনি গোস্বা করলেন কেন? যখন সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ আছে তখন পশ্চিমা দেশগুলোকে ক্ষেপিয়ে তোলা কি পাগলামী না পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, তা ভেবে দেখা দরকার।
বাংলাদেশের
গণতন্ত্র এক কঠিন পরীক্ষার
মুখোমুখি। সংবিধানের ধারা অব্যাহত থাকবে
কিনা, তা এখন সবচেয়ে
বড় প্রশ্ন। আবার দেশে একটা
অসাংবিধানিক শাসন আনার ষড়যন্ত্র
চলছে। বিএনপিকে সামনে রেখে সেই নীল
নকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা
চলছে। এই ষড়যন্ত্র নসাৎ
করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু
নির্বাচনই হলো বাংলাদেশের জন্য,
সরকারের জন্য সবচেয়ে বড়
চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জকে আরো
কঠিন করে তুলছে সরকারের
ভেতর থাকা অতিউৎসাহী, চাটুকার
এবং বাঁচালরা। এরা অর্বাচীন না
ষড়যন্ত্রের অংশ তা নিয়ে
আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। এরা একদিকে যেমন
সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিভ্রান্ত
করছে। অন্যদিকে, জনগণের কাছে সরকারের আস্থা
নষ্ট করছে। আগামী কয়েকমাস এদের লাগাম টেনে
ধরতে হবে। না হলে
সর্বনাশ হবে আওয়ামী লীগের,
সরকারের এবং জনগণের।
সৈয়দ
বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত
হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী
লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা
যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন
তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই
তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী
আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন
কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী
হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে
৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের
নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির
আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন
যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হবে?
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী
লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী
দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে
তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন,
তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত
কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের
মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত
কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।