কিউবার প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যার
বন্ধু, তার শত্রুর দরকার নেই।’ এ কথাটি যে কত বড় সত্য তা বাংলাদেশ এখন খুব ভালো করেই
বুঝতে পারছে। জো বাইডেনের সঙ্গে সেলফি, নৈশভোজে আমন্ত্রণের পর গত শুক্রবার সন্ধ্যায়
ভিসা নীতি প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যক্তি
এবং তাদের পরিবারের ওপর যখন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে
অবস্থান করেছিলেন। সেদিনই তিনি জাতিসংঘে ভাষণ দেন। ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির কয়েক ঘণ্টা
আগেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া। যুক্তরাষ্ট্র
সম্ভবত এমনই। তাদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আড়ালে থাকে নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের ভয়ংকর
প্রতিজ্ঞা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ শুরুর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিল, বাংলাদেশ
নিয়ে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাইডেনের মিষ্টি কথা স্রেফ সৌজন্যতা। ‘বাংলাদেশের
সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চমৎকার’ সম্পর্ক ব্লিঙ্কেনের এমন মধুর বাণী স্রেফ কথার কথা। ভারত
কিংবা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের মত বদলাতে পারেনি। বাংলাদেশে
যুক্তরাষ্ট্র তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের মিশনে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে সত্যি কি যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বসাতে চায়? যারা হবে তাদের একান্ত অনুগত।
যেমনটি তারা করেছে পাকিস্তানে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার হাতবদলের একমাত্র উপায় হলো নির্বাচন। বাংলাদেশের
সংবিধান অনুযায়ী, আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত
নির্বাচন হবে কি না, হলেও তা কীভাবে হবে এ নিয়ে এখন নানা বিতর্ক, নানা আলোচনা। বিশেষ
করে গত শুক্রবার কয়েকজনের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে
অনিশ্চয়তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে একটি অসাংবিধানিক
বা অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। গণতন্ত্রের মৃত্যু হবে। বাংলাদেশকে একাধিকবার
এরকম দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। বাংলাদেশকে কি আবার সেই পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? মার্কিন
ভিসা নিষেধাজ্ঞা তারই যেন এক বার্তা।
বিএনপি একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে। প্রতিদিনই সমাবেশ, রোডমার্চের মতো নানা কর্মসূচিতে
ব্যস্ত ১৬ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। বিএনপি বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন
হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন
নয়, এমন একটি অনড় অবস্থান নিয়েছে দলটি। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও একই দাবিতে
আন্দোলন করেছিল। বিএনপির তীব্র আন্দোলনের পরও সরকার সে সময় নির্বাচন করতে সক্ষম হয়।
২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থীরা ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছিলেন,
তখন সবাই মনে করেছিল এ সংসদ বেশি দিন টিকবে না। দ্রুতই আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ শেষ পর্যন্ত
পূর্ণ মেয়াদে কার্যকর থাকে। এটিই বাংলাদেশে ’৭৫-পরবর্তী প্রথম সংসদ যেখানে দেশের প্রধান
দুটি দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) একটির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও মেয়াদ পূর্ণ করে। এর আগে
১৯৮৬-এর নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। ’৮৭-তে সংসদ ভেঙে দেন এরশাদ। ’৮৮-এর নির্বাচন
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলই বর্জন করে। ’৯০-এ গণআন্দোলনে এরশাদের পতন হলে, ওই সংসদও
বিলুপ্ত হয়। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে
বিরোধী দলগুলো তখন একাট্টা হয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন
করছিল। বিরোধী দলের দাবিতে উপেক্ষা করে বেগম জিয়া একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটেন। কিন্তু
আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বেগম জিয়া সংসদ ভেঙে দিতে বাধ্য
হন। ওই সংসদ একটি কাজ করেছিল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে
সন্নিবেশিত করেছিল, যা ২০১১ সালে সংবিধান থেকে অপসারিত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি
অংশগ্রহণ করেছিল দলীয় সরকারের অধীনেই কিন্তু ওই নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপিদলীয় সরকারের
অধীনে আর কোনো নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন
করছে দলটি। এবার অবশ্য প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশের
গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন এবং দুর্নীতি পশ্চিমাদের জন্য বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের
কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়
ইউনিয়নের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা চরমে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হতে হবে,
অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের দাবিকে সমর্থন করেনি। কিন্তু ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্বাচন
কে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটাই এখন বিএনপির শক্তির প্রধান উৎস। বিএনপি মনে করছে,
২০১৪ সালের মতো এবার আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করলে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা তা
মেনে নেবে না। ফলে এ নির্বাচনের আগে-পরে নানা নিষেধাজ্ঞা দেবে। বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক
সম্পর্ক গুটিয়ে নেবে। একতরফা নির্বাচন করলেও সরকার টিকতে পারবে না—এমন হিসাবেই বিএনপি
নেতারা ফুরফুরে আত্মবিশ্বাসী। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
গত ২০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনকে লেখা এক চিঠিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক
না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বাজেটের অজুহাত দেখিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে
আনুষ্ঠানিক চিঠিতে বলা হলেও এর পেছনে অন্য তাৎপর্য আছে। গত ৬ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ সফর করে। ওই সফরে তারা প্রধান
প্রধান রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে
কথা বলেন। নির্বাচন নিয়ে আপাতত বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা
নেই, এমন ধারণা থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ সিদ্ধান্ত নিল বলে আমার ধারণা। ইইউ শুধু যে
বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই নয়, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি
ইস্যুতে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে সম্প্রতি গৃহীত এক
প্রস্তাব বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের
সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। সেখানে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পায়। এ রপ্তানি সংকুচিত হলে
কিংবা জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে। এমনিতেই
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রতিদিন কমছে। এরকম পরিস্থিতিতে
ইইউ বাণিজ্য সংকোচন নীতি নিলে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো। তাহলে কি ইউরোপীয়
ইউনিয়ন বুঝেশুনেই হুমকি দিয়ে রাখল। ইইউ গণতন্ত্রকে মানবাধিকারের অন্যতম শর্ত মনে করে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত কি আগামী নির্বাচন ব্যাপারে তাদের অনাস্থার
প্রকাশ। একতরফা নির্বাচন করলে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবেই
কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে এ প্রস্তাব। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ যদি নির্বাচনকে
স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে একতরফা (বিএনপিকে বাদ দিয়ে) নির্বাচনের ভার কি সরকার বইতে পারবে?
২২ সেপ্টেম্বরে কয়েকজনের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর বিভিন্ন মহলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
মুখে যে যাই বলুক, একটা ভয় সঞ্চারিত হয়েছে সরকারের ভেতর। আগামী ৭ অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে। বিএনপি ছাড়া নির্বাচন যে যুক্তরাষ্ট্র
মেনে নেবে না, এটা এখন স্পষ্ট। প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন নিয়েই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের
শেষ অবস্থান জানাবেন। যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন চায় না, এমন বক্তব্য
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই দেওয়া হচ্ছে। ‘বাংলাদেশে একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে
চায় যুক্তরাষ্ট্র—এমন অভিযোগ এসেছে শাসক দলের পক্ষ থেকেও। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বলেছে,
তারা বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে
যাই বলা হোক না কেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার জন্য বিশ্ব মোড়লের যে ভূমিকা
আছে, তার অস্বীকার করবে না কেউই। বিএনপি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান
অবলীলায় একবিন্দুতে মেলানো যায়। বিএনপি বলছে, তারা শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে
না। আর পরোক্ষভাবে পশ্চিমারা বলছে, বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। তাহলে
বিএনপি যদি নির্বাচন বর্জন করে আর পশ্চিমা দেশগুলো যদি বলে বাংলাদেশের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক
হচ্ছে না। এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। সে ক্ষেত্রে কী হবে? গণতন্ত্র কি নির্বাসনে যাবে?
দেশে আবার একটি অসাংবিধানিক শাসন কায়েম হবে?
কয়েকজন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ ব্যাপারে
প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশিদের ওপর মার্কিন ভিসা নীতিতে ভয় পাওয়ার
কিছু নেই। বাইরের দেশ থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হলে বাংলাদেশের জনগণও
তাদের নিষেধাজ্ঞা দেবে।’ মার্কিন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী। ঝুঁকি
নিয়ে হলেও বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়াবাড়ি নিয়ে তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন।
আত্মমর্যাদা এবং সম্মানের অবস্থান ধরে রেখেছেন। কিন্তু সরকারের মধ্যে অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর
অবস্থানের বিপরীত কর্মকাণ্ড করছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
ভূমিকা বিতর্কিত, বিভ্রান্তিকর। সকালে তারা এক কথা বলে, বিকেলে বলে আরেক কথা। মার্কিন
নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রী যেন মতামত দেওয়ার প্রতিযোগিতায়
লিপ্ত হলেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, ‘নির্বাচনের আগে আর কোনো ভিসা নিষেধাজ্ঞা
আসবে না।’ এ তথ্য তিনি কোত্থকে পেলেন? আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিউইয়র্কে বসে বললেন,
তিনি নাকি ভিসা নিষেধাজ্ঞায় ‘ভেরি মাচ হ্যাপি (খুব খুশি)।’ একাধিকবার তিনি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ
সম্পর্ক নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তা দায়িত্বহীনই শুধু নয়, কূটনীতির জন্য বিপজ্জনকও বটে।
বিশেষ করে দিল্লিতে জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছবি তোলার পর ড. মোমেন যা বলেছেন,
তারপর তিনি কীভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকেন, তা ভেবে পাই না। যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে
প্রতিনিয়ত ভুল বার্তা দিয়ে তিনি সরকারকে বিভ্রান্ত করছেন কি না, সে প্রশ্ন এখন উঠতেই
পারে। সরকারের ভেতর বেশ কিছু মার্কিনপ্রেমী আসলে খুনি মোশতাকের ভূমিকায় অবতীর্ণ কি
না, তা ভাবতেই হবে। আওয়ামী লীগের কিছু হাইব্রিড নেতা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে
নিজেদের গুরুত্ব বাড়ান। অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের কারও সঙ্গে ফটোসেশন করেই, সবকিছু ঠিক
হয়ে যাওয়ার বার্তা দেন। সকাল-বিকেল মার্কিন দূতাবাসে ধরনা দেন। পিটার ডি হাসকে রাজার
মর্যাদা দিয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে ধন্য হন। এরা এখন কী বলবেন? ‘যুক্তরাষ্ট্রকে
চটানো যাবে না’—আওয়ামী লীগে সারাক্ষণ যারা এ বার্তা দেন, ব্লিঙ্কেনকে মেইল দিয়ে যেসব
নব্য আওয়ামী নেতা ‘মার্কিন বশীকরণ’ বটিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দেন, তাদের মতলব কী? এরা
আসলে কার এজেন্ট। দলের ভেতর এসব অপরিণামদর্শী বাচালদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কি পারবেন
দেশে একটি নির্বাচন করতে? নাকি মার্কিন অভিপ্রায়ের বাস্তবায়ন চলছে সরকারের ভেতরেই?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে
বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর,
সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার
বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়?
একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে
নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির
নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ
করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন
ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল।
বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে
কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।
কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা
কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের
জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও
না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু
ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ
থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী
জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক
অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য
কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন,
‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প
চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে
একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য
বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে
মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার
পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক
দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে
সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮
সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির
সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার
নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের
দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত
নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র
ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।
যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব
দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি
রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত।
ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে
বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং
ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা
প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে
কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই
কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী।
অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।
বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের
মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য
নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে
পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর
নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন।
সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না।
জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন
চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে
বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম
আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের
মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে
অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।
বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার
অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে
তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ
বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির
মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে
সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে
খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে
উত্তর নেই।
খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক।
অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের
উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায়
না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই
হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর
ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের
মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই
আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী?
নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া
বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন,
‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো
না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির
জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর।
দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস
করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে
যাবে।
জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা
গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব
থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের
কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের
প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি
মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে।
’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ
থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে
বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা।
আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।
এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা
পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল
তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান
নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল,
তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ
উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো
মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের
মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি,
আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে
আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন
প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির
জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে
প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।
আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট
আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা।
ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী
লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন,
দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত
গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা
করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা
থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র
পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা
নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান
ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ।
বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই
বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা
দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি উপজেলা নির্বাচন শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ্যতা, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কীভাবে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন সেটির দিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ।