২০৭১ সালে কেমন হবে বাংলাদেশ? চলুন ঘুরে আসি টাইম মেশিনে-
১.
২০৭১ সাল। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত, আধুনিক, শান্তিময় এবং পরিবেশবান্ধব দেশটির স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। দেশটির নাম বাংলাদেশ। শতবর্ষ আগে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই দেশটি ছিলো ক্ষুধা দারিদ্রের প্রতীক। দুভিক্ষের দেশ। আজ এই দেশটি সারা বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল। সারা বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ দরিদ্র মানুষ বাংলাদেশ থেকে কোন না কোন সহায়তা পায়। ২৬ মার্চ দেশটির স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মধ্যে দিয়ে শতবর্ষ পূর্তি শুরু হয়, ১৬ ডিসেম্বর দেশটির বিজয় দিবস দিয়ে বছর ব্যাপী অনুষ্ঠানের শেষ হচ্ছে। সমাপনী অনুষ্ঠানে ধনী গরীব সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা এসেছেন। অনুষ্ঠানে ধনী গরীবের ভেদাভেদ করা হয়নি। বরং যে সব দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল তাদের আলাদা সম্মান দেয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে দারিদ্রে জর্জরিত ইউরোপের দেশগুলো থেকে সরকার প্রধানরা এসেছেন। গৃহযুদ্ধে বিভক্ত জর্জরিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এসেছেন। আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা পর্বের পর সবাই জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পাস্তক অর্পন করলেন। তারপর চা চক্র। চা চক্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলার কসরত চালাচ্ছেন। অনেক কষ্টে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি চলে এলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে দেখে একটু ম্লান হাসি দিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কাছে চলে এসে সুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন ‘আমরা আপনাদের দরিদ্র মানুষের ত্রানের জন্য যে এক হাজার কোটি টাকা দিয়েছিলাম, তাতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে জেনেছি।’ মুহূর্তেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেল। বললেন ‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিষ্টার, দুর্নীতির কোন অভিযোগ প্রমাণিত নয়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘তাছাড়া আপনাদের দেশে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। গুম, হত্যা এগুলো কিন্তু বাংলাদেশ বরদাস্ত করে না।’ কাচুমাচু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মাথা নাড়লেন। বললেন ‘সামনে শীত, ত্রান সাহায্য না পেলে বহু মার্কিনী মারা যাবে।’ প্রধানমন্ত্রী একটু ভাবলেন, বললেন ঠিক আছে আপনি আমাদের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলুন। এর মধ্যেই তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই বাংলাদেশের প্রদানমন্ত্রীর কাছে চলে আসেন গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী। বললেন বাংলাদেশের সাহায্যের জন্য গ্রীসের জনগণ কৃতজ্ঞ। সাহায্য একটু বাড়ালে ভালো হয়। এভাবে একে একে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ হলো। অনুষ্ঠান শেষ হলো আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনাকে স্মরণ করার মধ্যে দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সূচনা করেছিলেন। যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ। আর এটা সম্ভব করেছে প্রাণশক্তিতে ভরা এদেশের অমিত সাহসী মানুষ।
২.
রংপুরের কৃষক বিজয়ের শতবর্ষের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর, স্কাইপে ক্ষেতের কৃষকদের সাথে কথা বললেন, ক্ষেতে একটু পানি ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিলেন। বলে রাখা ভালো, ২০৫২ সাল থেকে বাংলাদেশ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে না। বিশ্বের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা ২০৪১ সাল থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উপায় নিয়ে কাজ করে। ২০৪৮ এ গোটা বাংলাদেশকে বৃষ্টির পানির আওতায় আনা হয়। বৃষ্টি হলে, বৃষ্টির পানি চলে যায় সংরক্ষণ ভান্ডারে। সারাদেশে এরকম ১০ কোটি রিজারভার গড়ে তোলা হয়েছে। এখন কেউ নদী, পুকুর এবং মাটির নীচের পানি ব্যবহার করে না। রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি দিয়ে কৃষি, খাবার পানিসহ সব পানির প্রয়োজন মেটানো হয়।
বাংলাদেশে জমি বিভাজন আল নেই। বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে শুধু ফসলের মাঠ। সারা বছর এখানে নানা রকমের শস্য উৎপাদিত হয়। প্রত্যেক কৃষি জমির মালিক ভার্চুয়াল ডাটা এবং স্যাটেলাইটের সাহায্যে তার জমির ফসলের খোঁজ খবর নেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনবদ্য আবিস্কারে গত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব সার ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার হয় না। ইউরিয়া, ফসফেট সহ কৃত্রিম সার ব্যবহার না করে, মানুষ ও পশুর বর্জ্য দিয়ে পরিবেশ বান্ধব সারই কৃষির চেহারা পাল্টে দিয়েছে। কৃষক স্যাটেলাইটে জেনে নেন, আবহাওয়ার খবর। সে অনুযায়ী তিনি কৃষি শ্রমিকদের পরামর্শ দেন। কৃষি শ্রমিকরা অধিকাংশই বিদেশী। বেশীরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের হত দরিদ্র রাষ্ট্র থেকে এসেছে। এদের উপর অনেক দয়া হয় কৃষক রহমতের। বাবার কাছে শুনেছেন প্র-পিতামহ মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশের কাজ করতো। তার সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো। একসময় অত্যাচারে কষ্টে তার প্র-পিতামহ মারা যান। এজন্য রহমত কোন বিদেশী শ্রমিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না। বরং তিনি সব সময় বিদেশী কৃষি শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা চিন্তা করেন। কারণ রহমত জানে বাংলাদেশকে পাল্টে দিয়েছে এদেশের মানুষ। তাই মানুষকে অবহেলা করতে নেই।
৩.
চট্টগ্রামের শিল্পপতি ওমর। বিশ্বের একশো একুশটি দেশে তার শিল্প কারখানা। প্রায় এককোটি লোক এসব শিল্পে কাজ করে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সবগুলো কারখানায় এর সঙ্গে তিনি ভার্চুয়াল কনফারেন্স করেন। বাংলাদেশের সৌর বিদ্যুৎ প্রযুক্তি এবং পরিবেশ বান্ধব কৌশল এখন সারা বিশ্বের আরাধ্য। ২০৫০ সাল থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে শুধু মাত্র সৌরশক্তি এবং পানি ব্যবহার করে। কয়লা ও গ্যাস ব্যবহার করে পরিবেশ বিনাস করার আত্মঘাতী প্রবণতা বন্ধ করে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ওমর কোন কারখানায় গ্যাস, তেল বা কয়লা ব্যবহার করে না। ওমর সবদেশে প্রযুক্তি হস্তান্তর করে ফ্যাক্টরী গুলো করেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার পোশাক শিল্পগুলোতে বিশেষ নকশায় পোষাক তৈরী করা হয়েছে। লাল-সবুজের সমন্বয়ে এই পোষাক এখন বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
ওমরের প্রত্যেকটা কারখানা যেন একেকটা বিশাল ফাইভস্টার হোটেল। এখানে কোয়ালিটি কন্ট্রোলের কাজ করে চুয়েট এর আবিস্কার ‘ফ্যাক্টরী রোবট’। ওমর বিজয়ের শতবার্ষিকীতে ঘোষণা করেন, তার ফ্যাক্টরীর লাভের দশ শতাংশ ইউরোপ, আমেরিকার ও মধ্যপ্রাচ্যের দারিদ্র বিমোচনের জন্য দান করবেন। ওমর শুনেছেন, এক সময় বাংলাদেশের মানুষও অনেক গরীব ছিলো, না খেয়ে থাকতো। বাংলাদেশকে বলা হতো বটমলেস বাসকেট। ওমর হাসেন। জাতির পিতা এবং তার কন্যা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনার ছবিতে স্যালুট করেন। আর নিজেই বিড় বিড় করে আবৃত্তি করেন ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই’। ওমরের মতো এরকম শতাধিক বাঙালী শিল্প উদ্যোক্তাদের হাতেই আজ শিল্পন্নোত বাংলাদেশ। বিশ্বের শিল্পখাতে বাংলাদেশের অবদান ২১ ভাগ।
বাংলাদেশে ২০১৬ থেকে যে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তা শুধু প্রযুক্তিনির্ভর ছিলো না। বরং মানবশক্তির সাথে প্রযুক্তির মেলবন্ধন ছিলো এই শিল্প বিপ্লবের মূল সূর। এজন্যই মেশিন আর হাতের বৈরীতা হয়নি হয়েছে সক্ষতা। বাংলাদেশের শিল্প বিপ্লব মানুষের জয়গান।
৪.
বাংলাদেশের সবগুলো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেন অতুলনীয় স্থাপত্যের এক অনুপম প্রদর্শনী। একে তো বিজয়ের শত বার্ষিকী, অন্যদিকে এসময় বাংলাদেশের অপূর্ব আবহাওয়ার কারণে পর্যটক উপচে পরে। পর্যটক আসে ব্রাজিল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক ও চীনের মতো উন্নত দেশগুলো থেকে । বাংলাদেশ বিমান বায়ুচালিত। এটাও বিশ্বে অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের আবিস্কার। বাতাসকে শক্তি বানিয়ে বিমান চালানোর এই আবিস্কার বিশ্বে পরিবেশ রক্ষায় অনন্য অবদান রেখেছে। সিলেটের সুনামগঞ্জে যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্রাজিলের পর্যটক আলবার্তো পেরেইরা নামলেন, তা মনে হবে লেক। শাপলা ফুটে আছে চারপাশে। ইমিগ্রেশন চেক করে তিনি উঠলেন এক সোলার পাওয়ার সসারে। আকাশ থেকে বাংলাদেশটা যেন একটা ছবি, সবুজ আর সবুজ। রাঙ্গামাটির পাঁচতারা হোটেলে নামলে তাকে দেয়া হলো অর্গানিক গ্রীন টি। তাকে বলা হলো বাংলাদেশে স্বাগতম। কিন্তু এই দেশে পরিবেশ বিনাশী কোন কাজ আইনত: নিষিদ্ধ। গাছের পাতাও ছেড়া যাবে না। পেরেইরা ভাবলেন, আহরে আমার দেশটা কবে এমন হবে।
বাংলাদেশে সব যানবাহন সৌরবিদ্যুৎ চালিত অথবা বাস্প চালিত। কোথাও কোন দূষণ নেই, ময়লা নেই। হোটেল রুমে বসে আলবাতো ‘বাংলাদেশের ইতিহাস বইটা নিয়ে মগ্ন হলেন। অবাক বিস্ময়ে জানলেন, একশো বছর আগে এই দেশটা ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর একটি। অনাহারে মানুষ মারা যেতো, প্রাকৃতিক দূর্যোগে থাকতো অসহায়.......। রুম সার্ভিসের বেলে সম্বিত ফিরলো তার। ছেলেটা মার্কিন নাগরিক। এখানে তিন বছর ধরে কাজ করে। আলবার্তো তাকে জিজ্ঞেস করলো, এখানে কেমন লাগে। ছেলেটি উচ্ছাসিত ভাবে জানালো খুব ভালো। আলবার্তো তাকে জানালো এদেশের কোন জিনিসটা ভালো। উত্তরে বেল বয় ছেলেটা বললো ‘মানুষ’। এখানকার মানুষ অনেক ভালো, অতিথি পরায়ন, সহানুভূতি প্রবণ।
৫.
বিজয় দিবসের পর দিনই বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সাতটি (জি-৭) দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশে। বিশ্বের সবচেয়ে নয়নাভিরাম শহর ফরিদপুরে। দেশগুলো হলো, বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভিয়েতনাম। এরা সবাই বাংলাদেশের বিজয় শতবার্ষিকীর অনুষ্টানে যোগ দিতে বাংলাদেশ এসেছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গ্রুপ সেভেনের বৈঠকে প্রথমেই ইউরোপজুড়ে দুর্ভিক্ষ এবং গৃহযুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী সংহিংসতায় সহস্রাধিক মানুষ নিহত হবার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানায় গ্রুপ সেভেন। বৈঠকে অবিলম্বে গৃহযুদ্ধ বন্ধের আহবান জানানো হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী গৃহযুদ্ধ নিরসনে নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আরো বাঙালী সৈন্য বাড়ানোর অনুরোধ করেন। উত্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর দুকোটি পঞ্চাশ লাখ সদস্য শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত। তিনি সমঝোতা এবং ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ দর্শণের আলোকে আপোষ ফমূলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বর্ণবাদী সরকার গুলোর উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে হবে। চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, বর্ণবাদী তৎপরতা বন্ধ না করলে মার্কিন ও ইউরোপে সাহায্য বন্ধ করতে হবে। সভায় মধ্যপ্রাচ্যের দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশ দশ লাখ কোটি টাকার নগদ সহায়তার ঘোষণা দেন। আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর চা চক্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী একটু খোঁচা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কি মনে হয় না আপনি মধ্যপ্রাচ্যে সাহায্যের ব্যাপারে একটু বেশী হাতখোলা।’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসেন। বলেন ‘আপনার কি মনে হয় না, ইউরোপ আর আমেরিকার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের এই দূদর্শা। আর ইউরোপ আমেরিকার সংকট তো তাদের নিজেরই সৃষ্টি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাথা নাড়েন, ‘তা বটে। কিন্তু এক সময় মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রচুর শ্রমিক কাজ করতো। সেজন্য’.... ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথা শেষ করার আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘ ‘সেটাতো আপনার দেশেরই বেশী ছিলো। আমাদের লোকজন কাজ করতো। জীবনের সব আনন্দ স্বপ্ন উজাড় করে দিয়ে পরিশ্রম করেছে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রীও আবেগপ্রবণ হয়ে পরেন। বলেন ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ কি জানেন? উত্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘এদেশের মানুষ।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্মতি সূচক মাথা নাড়েন।
৬.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি। বিদ্যুৎ নেই দুই ঘণ্টা। ম্যানহাটনের ফিফথ এভিন্যুতে আশ্রয় শিবিরে বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা: জালাল চিকিৎসা দিচ্ছেন বর্ণবাদী দাঙ্গায় গুরুতর আহত কয়েকজনকে। জো রবার্ট গুরুতর আহত। তার মাথা ফেটে গেছে। জরুরী অপারেশন করা দরকার। ডা: জালাল তার স্যাটেলাইট কানেকটিভিটিতে (এক ধরণের আধুনিক ফোন) যোগাযোগ করলেন বাংলাদেশের সঙ্গে। জানালেন দ্রুত বিদ্যুৎ দরকার। ডা: জালালকে জানানো হলো ৫ সেকেন্ডের মধ্যে বিদ্যুৎ পাবে। বিদ্যুৎ এলো। চারপাশে অসংখ্য আহত মানুষের আর্ত চিৎকার। বাংলাদেশের চিকিৎসক দল দ্রুত চিকিংসা শুরু করলো। আহতদের অধিকাংশই কালো মানুষ। সাদারা দল বেঁধে তাদের বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। মারা গেছে শতাধিক। সারা রাত ধরে ডা: জালাল এবং তার দল আহতদের সেবা করলেন। সকাল নাগাদ জো রবাটের জ্ঞান ফিরলো। ডা: জালাল তার পাশে দাঁড়ালেন। জো কৃতজ্ঞতার হাসি ছড়িয়ে বললো-‘থ্যাংক ইউ এ্যান্ড ইয়োর কান্ট্রি’। ডা: জালাল গর্বিতভাবে বললেন ‘ইউ আর ওয়েলকাম’। রবাট জানতে চাইলো, ‘বাংলাদেশ শুনেছি শান্তির দেশ, কোন হানাহানি নেই, সন্ত্রাস নেই।’ ডাক্তার তার পাশে বসলেন। ব্যান্ডেজ দেয়া মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ‘শোন, ৫০-৬০ বছর আগে বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটতো।’ কিন্তু সে সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস দমনে কঠোর হন। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছিলেন। আজ তার ফল আমরা পাচ্ছি।’ এক সময় নিউইয়র্ক শহর ঘুমুতো না। আজ এটা অন্ধকারেই থাকে।’ রবাট জানতে চাইলো কিভাবে বদলে গেল বাংলাদেশ। উত্তরে ডা: জালাল গৌরবের হাসি দিয়ে বলেন, মানুষের অফুরান শক্তি আর আত্ম বিশ্বাসে।
৭.
পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম, চিত্রকর্ষ শহর ঢাকা। ঢাকার গুলশান হলো বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয় বহুল এলাকা। ঢাকা নেভার স্লিপ। প্রকৃতি আর আধুনিকতার এক অনবদ্য মেলবন্দ্বন ঘটেছে এই শহরে। গত দশ বছরে এই শহরে একটিও অপরাধ হয়নি। এমনকি একটি চুরিও না। এই শহরের লেকে প্রমোদ ভ্রমনের চেয়ে বড় বিনোদন পৃথিবীতে কম আছে। নানা বর্ণের নৌকায় ভ্রমন করা যায়। উদভ্রান্ত এক তরুণ তেম্নি এক নৌকায় বসে আছে। তাকে বিমর্ষ লাগছে। নৌকায় অন্যরা যখন লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করছে, তখন সে আনমনা। হঠাৎ সে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো থমকে গেলো। মূর্তির মতো দাড়িয়ে রইলো, নড়তে পারছে না। নৌকায় উপস্থিত সবাই বুঝলো তার উপর স্যাটেলাইট থেকে জ্যামার বসানো হয়েছে। সে কোন খারাপ কাজ করার চিন্তা করেছিল। নৌকা বনানী লেক স্টেশনে নামতেই তাকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুজন সদস্য ধরলো। স্ক্যানার দিয়ে তার শরীরে পরশ বুলিয়ে দিতেই সে আবার স্বাভাবিক হলো। দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ধরে নিয়ে গেলো। নৌকায় উপস্থিত বিদেশীরা বুঝতেই পারলো না কি হয়েছে। নৌকায় বসা এক তরুণকে বিদেশী পর্যটক জিজ্ঞেস করলো, কি হলো ব্যাপারটা। তরুণটি বললো-বাংলাাদেশ পর্যবেক্ষণ করছে ১০০টি স্যাটেলাইট টাওয়ার। এই টাওয়ারে আছে ‘এমজেড আই’ যন্ত্র। এটা হলো মাইন্ড রিডার এবং বডি জ্যামার। এই দেশে যে কোন মানুষের মন যখন অপরাধ প্রবণ হয় তখন তা ‘এমজেডআই’ এর মাইন্ড রিডার মেশিনে ধরা পরে। এটা ধরা পরার সাথে সাথে বডি জ্যামার দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়া হয়। এরপর পুলিশ তাকে নিয়ে যায়, সংশোধন করে ছেড়ে দেয়।’ কথাগুলো বলার সময় তরুণের চোখ ঠিকরে গৌরবের দ্রুতি বেরুচ্ছিল।’ বিদেশী বিস্ফোরিত চোখে জিজ্ঞেস করলো ‘এম জেড আই’ মানে কি? ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বাংলাদেশের একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী।’ তরুণের উত্তর। ‘তিনি কি এই যন্ত্র আবিস্কার করেছিলেন?’ বিদেশী জানতে চায়? ‘না, তিনি তরুণদের উজ্জীবিত করতেন, অনুপ্রাণিত করতেন বিজ্ঞান শিক্ষায়, গণিত শিক্ষায়। বিদেশের দামী চাকরী ছেড়ে তিনি বাংলাদেশে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল তরুণ বিজ্ঞানী কুড়ি বছর আগে এই যন্ত্র আবিস্কার করে। গত ১৫ বছর ধরে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার চলছে। ঐ তরুণরা মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এর নাম দিয়েছে ‘এম জেড আই’। এখন তাই অপরাধ শূন্য বাংলাদেশ।’ বিদেশী নিজেও যেন এই দেশে এসেছে ভেবে গর্ব অনুভব করে।
৮.
অষ্ট্রেলিয়ার কয়েকটি শহরে ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অষ্ট্রেলিয়া সফর অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার স্বার্থে এই মুহূর্তে অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সরকারের মতামত চেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেট ল্যাবে সব মন্ত্রীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল কনফারেন্সে বসেছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনার শেষ, অষ্ট্রেলিয়া সফর এজেন্ডা এলো। প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ থামলেন। ১০ মিনিটের জন্য মিটিং স্থগিত করলেন। সবগুলো স্ক্রিন বন্ধ হয়ে গেলো। প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ থামলেন। প্রধানমন্ত্রী কনফারেন্স রুম থেকে বেরুলেন, হঠাৎ স্মৃতি আচ্ছন্ন হয়ে পরলেন। চলে গেলো ৫৫ বছর আগে। যখন তিনি মাত্র ৬ বছরের শিশু। ক্রিকেট পাগল বাবার আদুরে কন্যা। বাবা দিনরাত কি পরিশ্রম করতেন, তার একমাত্র মেয়েকে খুশী করার জন্য। মেয়েটি সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করতো বাবা কখন আসবে। যে দিন বাংলাদেশের ক্রিকেট থাকতো, সেদিন বাসায় যেন উৎসব। মেয়েকে কোলে নিয়ে বাবার ক্রিকেট উদযাপন। সব সময় বাবা মেয়েকে জিজ্ঞেস করতো ‘মা আজ কে জিতবে’। মেয়ে অবলীলায় বলতো ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ জিতলে বাবা কাঁদতো, আনন্দের কান্না। মেয়ের জন্য গিফট। আর হারলে বাবার চেহারার দিকে তাকানো যেতো না। এরকম একটা সময়ে অষ্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশে আসার কথা ছিলো। তারা এলো না। তারা জানালো বাংলাদেশে যাওয়া অষ্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের জন্য নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের জন্য ছিলো সেদিনটা চরম অপমানের, দু:খের। বাবার খুব মন খারাপ ছিলো সেদিন। শুধু বাবার কেন প্রতিটি বাঙালীই সেদিন কষ্ট পেয়েছিল। আজ সেই অষ্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ যাবে কিনা, সে নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আকাশের দিকে তাকালেন। মনে হলো তার বাবার সাথে কথা বলছেন, কিংবা বাবার মতো অসংখ্য ক্রিকেট পাগল বাঙালীর সঙ্গে, যারা সেদিন আহত হয়েছিল, অপমানিত হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী চোখ মুছলেন, স্যাটেলাইটে সিগন্যাল পাঠালেন কনফারেন্স ওপেন করার জন্য। সবাই যেখানে আছে সেখান থেকে কনফারেন্স এ অংশ নিচ্ছেন। আলোচনায় অধিকাংশ মন্ত্রী অষ্ট্রেলিয়ার না যাবার পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী স্বরণ করালেন ২০১৫ সালের কথা। যখন অষ্ট্রেলিয়া এলো না তখন আমাদের পূর্বসূরীদের কেমন লেগেছিল। কি কষ্ট পেয়েছিল এদেশের ক্রিকেট পাগল মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর আবেগতাড়িত ভাষণের পর সবাই রাজী হলো। বলা হলো, বায়োনিক স্পেসসীপের কাভারেজ দেয়া হবে বাংলাদেশের সব খেলায়। এই স্পেস শীপ দশমিক শূণ্য এক সেকেন্ডের মধ্যে অপরাধ সংঘটিত এলাকায় অপরাধ বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘যারা আমাদের একসময় অবজ্ঞা করেছে অবহেলা করেছে আমরা তাদের সম্মান দেখাবো।’ এটাই মানুষের ধর্ম।
৯.
মিটিং শেষ করে প্রধানমন্ত্রী তার রুমে গেলেন। কটা দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। শতবর্ষ উদযাপন, বিদেশী অতিথিদের সময় দেয়া ইত্যাদি। আজ অনেকদিন পর এক টুকরো অবসর। এই অবসরে আবার প্রধানমন্ত্রী ছোট বেলায় চলে গেলেন। রোজ সকালে স্কুলে যাবার জন্য বেরুতেন বাবার সঙ্গে। বলা যায় বাবার গলা জড়িয়ে স্কুলে যেতেন। রাস্তায় থাকতো তীব্র যানযট। অস্থির হয়ে ছোট্ট মেয়েটি বাবাকে বলতো ‘বাবা বাংলাদেশ কবে উন্নত হবে।’ বাবা বলতো ‘২০৪১ সালে বা তার আগেও।’ বাবা কখনও আশা হারাননি সব সময় মেয়েকে বলবেন ‘বাংলাদেশ সবার সেরা। একদিন এদেশ সবচেয়ে উন্নত হবে।’ মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে বাবার কথা শুনতো। প্রধানমন্ত্রী একাই হাসেন। চোখে জল আসে। তার বাবার মতো অসংখ্য বাবা, অসংখ্য মা যাদের পরিশ্রম, দেশের প্রতি ভালোবাসা আর গভীর আত্মবিশ্বাস বাংলাদেশকে আজ বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের সাফল্য গাঁথা হলো আসলে অসংখ্য সাধারণ মানুষের অসাধারণ গল্পের যোগফল। বাবা কখনো প্রমিজ ব্রেক করেননি। বাংলাদেশ সেরা হবে এই প্রমিজটাও সত্যি হয়েছে। বাংলাদেশ আজ পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের আরেক নাম পূর্ণতা। কোথায় বাবা? মনে পড়ে তার মায়ের কথা। মা বলেছিল, আমরা মরে গেলে প্রজাপতি হয়ে তোমার আশে পাশে থাকবো। যখন দেখবে দুটো প্রজাপতি পাশাপাশি তখন বুঝবে এটাই আমরা। প্রধানমন্ত্রী বারান্দায় যান। অনেক পাখী আছে। ফুল ফুটে আছে বাগানে। এর মধ্যেই দুটো প্রজাপতি পাশাপাশি একটা ফুলের উপর বসে আছে। প্রধানমন্ত্রী হেসে ফেলেন, নিজের অজান্তেই বলে উঠেন ‘জয় বাংলা’।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
বাংলাদেশ স্বাধীনতা বিজয় শতবর্ষ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে
বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর,
সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার
বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়?
একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে
নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির
নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ
করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন
ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল।
বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে
কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।
কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা
কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের
জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও
না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু
ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ
থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী
জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক
অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য
কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন,
‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প
চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে
একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য
বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে
মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার
পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক
দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে
সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮
সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির
সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার
নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের
দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত
নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র
ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।
যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব
দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি
রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত।
ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে
বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং
ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা
প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে
কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই
কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী।
অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।
বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের
মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য
নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে
পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর
নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন।
সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না।
জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন
চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে
বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম
আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের
মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে
অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।
বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার
অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে
তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ
বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির
মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে
সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে
খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে
উত্তর নেই।
খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক।
অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের
উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায়
না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই
হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর
ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের
মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই
আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী?
নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া
বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন,
‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো
না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির
জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর।
দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস
করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে
যাবে।
জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা
গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব
থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের
কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের
প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি
মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে।
’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ
থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে
বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা।
আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।
এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা
পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল
তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান
নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল,
তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ
উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো
মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের
মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি,
আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে
আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন
প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির
জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে
প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।
আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট
আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা।
ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী
লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন,
দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত
গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা
করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা
থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র
পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা
নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান
ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ।
বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই
বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা
দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি উপজেলা নির্বাচন শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ্যতা, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কীভাবে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন সেটির দিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।