পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরির আবেদন করেছে গ্রামের এক তরুণ। কম্পিউটারের দোকানে যখন সে অনলাইনে ফরম ফিলাপ করছিল, তখন ওই দোকান থেকেই তাকে বলা হয়েছিল ঘুষ ছাড়া চাকরি হবে না। বেচারা তাই চাকরি পেতে ধরনা দেয় স্থানীয় এমপির কাছে। সংসদ সদস্য খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া একেবারে স্বচ্ছ। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কিছু ধাপ অতিক্রম করলে চাকরি হয়। তারপরও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষকে ছেলেটির নাম এবং আবেদনপত্রের কপি পাঠিয়ে দিলেন। অনুরোধ করলেন, দেখার জন্য। সংসদ সদস্য চাকরি প্রার্থীকে আশ্বস্ত করে বিদায় দিলেন। সংসদ সদস্যের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তরুণ আশাহত, বিরক্ত। এমপি সাহেব এত খাতির করলেন, এসপিকে ফোন করে দিলেন, তারপরও ছেলেটি খুশি নয় কেন? জিজ্ঞেস করলেই ছেলেটি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘এমপি সাহেব তো টাকার কথা কইলো না। টাকা ছাড়া আবার চাকরি হয় নাকি।’ আমি স্তম্ভিত। আমার এ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম, আওয়ামী লীগের নেতা, সাতবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য মির্জা আজমকে। তিনি বললেন, ‘শুধু এটুকুই নয়। এরকম চাকরি প্রার্থীরা পরে যাবে দালালের কাছে। দালালকে টাকা না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবে না।’ মির্জা আজম বলছিলেন, ‘যতক্ষণ না সে কাউকে টাকা দেবে ততক্ষণ সে চাকরি পাবে এমন আশ্বাসে বিশ্বাস করবে না।’
ঘুষ বা দুর্নীতি ছাড়া চাকরি হয় এটা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে না। আমরা যেমন বাতাসের মধ্যে বসবাস করি। প্রতিমুহূর্তে শ্বাস-প্রশ্বাস নেই; ঠিক তেমনি বাংলাদেশে এখন আমরা দুর্নীতির মধ্যে বসবাস করছি। নিয়মনীতির মধ্যে কিছু হয় এটা দেশের খুব কম মানুষই মনে করে। বাজারে সিন্ডিকেট দুর্নীতি। ব্যবসায়ে দুর্নীতি। হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে ঘুষ দিতে হয়। ভালো স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে পেছনের দরজা দিয়ে তদবির করতে হয়। চাকরি পেতে ঘুষ দিতে হয়। পদোন্নতি জন্য ঘুষ লাগে। ব্যাংকের ঋণ পেতে উৎকোচ লাগে। বিপদে থানায় গিয়ে সাহায্য চাইলে টাকা-কড়ি ফেলতে হয়। ইদানীং বিভিন্ন পদক পেতেও নাকি পকেটে হাত দিতে হয়। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, রাজনীতি করাই ভালো। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতাবান। এখানে ঘুষের বালাই নেই। রাজনীতি করলে বরং শর্টকাটে বড়লোক হওয়া যায়। কিন্তু এখন ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল যে দলই করুন, টাকা লাগবে, ঘুষ লাগবে। দুর্নীতি ছাড়া পদ পাবেন না। বড় বড় রাজনৈতিক দলে কমিটি বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। মনোনয়নবাণিজ্য নিয়ে এখন কথাবার্তা বলতে কেউ শরম পান না। জন্ম থেকে মৃত্যু—দুর্নীতির আবর্তে আমরা। আপনার সন্তান জন্ম নিল। জন্মনিবন্ধন করতে যাবেন, টাকা ঢালুন দ্রুত পেয়ে যাবেন। মৃত্যু সনদ পেতেও আপনার প্রতি কেউ দয়া দেখাবে না। এজন্যও অন্য পথে যেতে হবে। ঢাকা শহরে কবরে জায়গা পেতেও অন্য পথ লাগে। সাধারণ মানুষ এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। কাজের বিনিময়ে ঘুষ কর্মসূচি বরং অনেকের পছন্দ। একে এখন মানুষ বলে ‘স্পিড মানি’। চাকরি পেতে, টেন্ডার পেতে, ব্যাংক ঋণ পেতে, সরকারি সেবা পেতে ঘুষ লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। যদি কেউ নিজ যোগ্যতায় কোনো ‘স্পিড মানি’ ছাড়া চাকরি পান তাহলে তা বিরাট খবর। ‘ঘুষ ছাড়াই চাকরি পেলেন...’ পত্রিকার পাতায় ফলাও করে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবির সঙ্গে সংবাদ বের হয়। কেউ প্রশ্ন করে না এটাই তো স্বাভাবিক, এটা আবার খবর হয় কীভাবে? অবশ্য এসব স্পিড মানি বা ঘুষকে আজকাল কেউ অপরাধ মনে করেন না। ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ গ্রন্থে ড. আকবর আলি খানের একটি নিবন্ধের শিরোনাম ‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ অর্থনীতি। ওই নিবন্ধে ড. খান, অক্সফোর্ডে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগদান করা মাইকেল ক্যারেটের স্মৃতিকথা উদ্ধৃত করেছেন। মাইকেল ক্যারেট যখন আসানসোল মহকুমা প্রশাসক ছিলেন, সে সময়ে একজন পাঞ্জাবি ঠিকাদারের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের ঘটনা তার স্মৃতি কথাতে লিপিবদ্ধ করেছেন এভাবে—“হুজুর হচ্ছেন মহানুভব ব্যক্তি। এই দুর্ভাগা দেশে তিন কিসিমের লোক আছে। আছেন সজ্জন যাঁরা ঘুষ খান না, যেমন আপনি। আছে বদলোক যারা ঘুষ খায় এবং (আমার চোখের দিকে চেয়ে)। আছে ‘শুয়োরের বাচ্চারা’ যারা ঘুষ নেয় অথচ ঘুষ প্রদানকারীকে কোনো সাহায্য করে না।”
এখন এই বাংলাদেশেও অবশ্য তিন ধরনের লোক আছেন। কিন্তু যারা ঘুষ খান না, তাদের এখন আর সজ্জন মনে করা হয় না। বরং এখন মনে করা হয়, যিনি ‘ঘুষ’ নেন না তিনি অযোগ্য, অপদার্থ, কোনো কাজ করেন না। পরিবারেও ঘুষ না খাওয়া ব্যক্তিটির কোনো সম্মান নেই। পরিবারে তিনি রীতিমতো ‘বোকা’ আহম্মক। ঘুষ না খাওয়ার কারণে তার বিত্তহীনতা রীতিমতো অপরাধ। কাজেই ঘুষ না খাওয়া ব্যক্তিরা এ জামানায় রীতিমতো ‘গণশত্রু’। আর ‘শুয়োরের বাচ্চা’দের সংখ্যাও এখন বেড়েছে। সব থেকে ভালো তারাই যারা ঘুষ নেন এবং কাজ করে দেন। সমাজে এদের ব্যাপক সুনাম। এরাই এখন সজ্জন ব্যক্তি।
তবে যে কোনো সাধারণ নাগরিককে এসব দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে, তারা বলবেন—‘এসব কিছুই নয়। এটা বরফ স্তূপের উপরিভাগ মাত্র।’ বড় বড় পুকুর চুরি, রাষ্ট্রীয় লুণ্ঠন বন্ধ না করলে, এসব বন্ধ হবে না। যারা দুর্নীতি করে দেশকে খোবলা বানিয়ে ফেলছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে এসব দুর্নীতি আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে।
ব্যাংক ঋণের নামে কারা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো খালি করে দিয়েছে, তাদের আমরা সবাই চিনি। তাদের নাম হরহামেশাই পত্রিকার পাতায় স্বর্ণাক্ষরে ছাপা হয়। টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার। চার মেয়াদে তিনজন অর্থমন্ত্রী পেয়েছে বাংলাদেশ। তারা প্রত্যেকেই দায়িত্ব নিয়ে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শুধু কথাই হয়েছে, কাজ হয়নি। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংক লুট নিয়ে কিছুদিন হৈচৈ হয়েছে। টাকা উদ্ধার হয়নি। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের টাকা লুট করে (ঋণ নিয়ে) কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিন অথবা বিদেশে চলে যান। ব্যস, কেউ আপনার টিকিটি ধরতে পারবে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থ পাচার। রিজার্ভ কমে যাওয়া, ডলার নিয়ে হাহাকার। এসবের প্রধান কারণ আসলে অর্থ পাচার। দেশের অর্থ কারা বিদেশে পাচার করেছে সবাই জানে। বিদেশে কারা বিপুল বিত্তের পাহাড় গড়েছে, সরকারের অজানা নয়। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, ‘কানাডায় অনেক বাংলাদেশি বাড়ি কিনেছেন। আমরা মনে করলাম, রাজনীতিবিদরাই বোধহয় এসব বাড়িঘরের মালিক। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখলাম, আমলাদেরই সম্পদ বেশি।’ তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর দেশে হৈচৈ পড়ে, বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ড. মোমেন বলেন, ‘আমরা নাম প্রকাশ করব।’ কিন্তু পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল, এখন পর্যন্ত দেশের মানুষ জানতে পারেনি, কানাডার বেগমপাড়ায় কারা অবৈধ সম্পদের মালিক। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার বাড়বাড়ন্তের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচিত। কিন্তু এসব চিহ্নিত অর্থ পাচারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, তাদের তালিকা প্রাপ্তির উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ বলেখ্যাত দেশগুলোতে কারা বিনিয়োগ করেছেন সে তথ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব চিহ্নিত অর্থ পাচারকারীর বিরুদ্ধে শুধু কথাই হয়েছে, ব্যবস্থা হয়নি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেলেই শোনা যায় বাংলাদেশিদের বিত্তবৈভবের খবর। প্রবাসী বাঙালিরা দর্শনীয় স্থান দেখানোর মতো করে দেখান কোনটা কার বাড়ি, কার শপিং মল। সরকার কেন এসব অর্থ পাচারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না?
আমলাদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেল। আমলারা এই নির্দেশ অবলীলায় বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন। আমলাদের দুর্নীতির বিচারের পথ বন্ধ করা হয়েছে, আইন করে। গত বছর ধরেই আমলাতন্ত্রের কাছে সরকার অসহায় আত্মসমর্পণ করছে কেন?
এসেনসিয়াল ড্রাগের জমি কেনা নিয়ে দুর্নীতি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি কেনায় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কথা হয়েছে, কাজ হয়নি। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে যারা দুর্নীতি চিহ্নিত করেছেন, তাদের বদলি করা হয়েছে। বর্তমান সরকারকে এ দেশের জনগণ ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতি লুটপাটে অতিষ্ঠ হয়েছিল এ দেশের মানুষ। বিএনপি ‘হাওয়া ভবন’ তৈরি করে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল। সরকারের ভেতর আরেকটি সরকার তৈরি হয়েছিল সেই সময়। যার নাম ‘হাওয়া ভবন’। ২০০৮-এ আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের প্রধান কারণ ছিল তারেক রহমান এবং তার বন্ধুদের লুণ্ঠন। কিন্তু গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ তারেক রহমান, গিয়াস উদ্দিন আল মামুনদের দুর্নীতির বিচার কতটুকু করতে পেরেছে? বিএনপি আমলে সিএনজি কেলেঙ্কারি, খাম্বা দুর্নীতির বিচার হলো না কেন? বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে যারা হাওয়া ভবনে নিয়মিত যাতায়াত করত, দুর্নীতি ও লুটপাটের মূল হোতা ছিল, তাদের কেউ কেউ এখন এই সরকারেরও ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। এরাই এসব দুর্নীতির বিচারের পথে বাধা। হাওয়া ভবনের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির বিচার না হওয়ার ফলে, আওয়ামী লীগের ভেতর সুবিধাবাদী, দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হয়েছে। দুর্নীতির বিচার হয় না—এ বিশ্বাস তাদের মধ্যে প্রোথিত হয়েছে। এরা ধীরে ধীরে দুর্নীতির জাল বিস্তার করে, এখন সরকারকেই রীতিমতো জিম্মি করেছে। এ অবস্থা থেকে সরকার এবং আওয়ামী লীগকে বের হতেই হবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি ঘোষণা করেছে। ইশতেহারের ৩(চ)-তে বলা হয়েছে—‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হলো দুর্নীতি। দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। শুধু আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা হবে।”
নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি বন্ধে আওয়ামী লীগ চারটি অঙ্গীকার করেছে। এর মধ্যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য ও দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। প্রশাসনে দুর্নীতি নিরোধের জন্য ভূমি প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, আদালত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ক্ষেত্রে সূচিত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ করার অঙ্গীকার আছে নির্বাচনী ইশতেহারে।
এ অঙ্গীকার পূরণে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাষ্ট্রপতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন ভাষণ দিয়েছেন। এই ভাষণে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত। তাই এটি সুস্পষ্ট যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির এ বক্তব্য সরকারেরই অবস্থান। এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকার যে আন্তরিক, তা কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।
১১ জানুয়ারি নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আমি মনে করি সব সমস্যার মূল উৎস দুর্নীতি। দ্রব্যমূল্য রোধ করতে গেলে দুর্নীতি কমাতেই হবে। নির্মোহ ও কঠোরভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান করলে বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমতে বাধ্য। খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে পক্ষাপাতহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই অর্থনীতিতে সুদিন ফিরিয়ে আনা যায়। গ্যাসের জন্য হাহাকার বন্ধ হবে দুর্নীতি কমালেই। অন্য কিছু করার দরকার নেই, শুধু দুর্নীতি বন্ধ করলেই দেশের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর জট খুলবে। আবার সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে। যেসব দেশে একটি দল বা একজন সরকারপ্রধান দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন বা আছেন, তারা সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেই জনআস্থা অর্জন করেছেন। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ তার বড় উদাহরণ। এ সরকারকে জনপ্রিয়তা নিয়ে টিকে থাকতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হতেই হবে। গত ১৫ বছর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। এবার জনগণ কাজ দেখতে চায়।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
মন্তব্য করুন
ডোনাল্ড লু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে
জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে
দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির
স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি
অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই
মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা
ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী
লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে
বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার
মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী
লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে
না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে
প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে
সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।
আরও পড়ুন: আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার
কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার
সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ
করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া
অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা
কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি
নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের
সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি
একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত,
ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক
কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত।
ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি
অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম
হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয়
কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত
মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল।
কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর
বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়
কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে
আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর
সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান
ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও
আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন
নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা
হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে।
এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন
না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের
বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে
পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল।
যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক
দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই
অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি
২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ
ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির
কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা
তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের
শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান।
চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়,
তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি
নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল
দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই।
দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই।
সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ
হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির
চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান
একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই
কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র
ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে
বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।
শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৪ দল আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আবার বাংলাদেশ সফরে আসছেন। নানা কারণে ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে অত্যন্ত আলোচিত একটি নাম। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে তাঁর তৎপরতা বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি একাধিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাঁর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং বেশ কিছু কথাবার্তা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।