মাধুরী দীক্ষিত। ভারতে চলচ্চিত্রের মস্ত তারকা। সিমি গারেওয়াল শোতে এসে তার জীবনের অনেক প্রসঙ্গ নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন। সিমি ওই শোতে মাধুরীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমার রাজনীতি করার ইচ্ছা আছে কি না? উত্তরে মাধুরী জানতে চান, রাজনীতি করতে হবে কেন? সিমি বলেছিলেন, মানুষের সেবা করার জন্য বা বড় কোনো মহৎ কাজ করার জন্য। উত্তরে মাধুরী বলেন, ‘মানুষের সেবা কিংবা মহৎ কোনো কাজ রাজনীতি না করেও করা যায়। প্রত্যেকে তার অবস্থান থেকেই দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে পারেন।’ হিন্দি সিনেমার এ জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকের কাজের আলাদা আলাদা ক্ষেত্র আছে। সেই জায়গায় থেকেই কাজ করা উচিত। এতে দেশের মঙ্গল, জনগণের কল্যাণ।’
মাধুরীর এ বক্তব্যটি নতুন করে মনে পড়ল সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী শোবিজের তারকাদের হুমড়ি খাওয়া দেখে। গত ৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনের জন্য আওয়ামী লীগ মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল। তিন দিনে আওয়ামী লীগ ১ হাজার ৫৪৯টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে। শুধু ফরম বিক্রি করেই টানা চার মেয়াদে থাকা দলটির আয় প্রায় ৮ কোটি টাকা। মাত্র ৪৮টি আসনের বিপরীতে এত বিপুলসংখ্যক মনোনয়ন লাভে আগ্রহীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। প্রতিটি আসনের জন্য ৩২ জনের বেশি নারী মনোনয়নপ্রত্যাশী। অবশ্য এ রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী হওয়ার ঘটনা আওয়ামী লীগের নতুন নয়। টানা ক্ষমতায় থাকা, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন, ইত্যাদি নানা কারণে বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট প্রাপ্তির এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ দেশে এখন যেন সবাই আওয়ামী লীগ। সংরক্ষিত ৪৮টি আসনের জন্যও তাই আগ্রহীদের সংখ্যা বেড়েছে। সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টন করা হয় জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে। বাংলাদেশে যারা নারী আন্দোলনের নেতৃত্বে, যেসব নারী বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন, তারা এই ‘পিঠা ভাগ নীতির’ তীব্র বিরোধী। ৫০টি সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান থাকলেও, এ বিষয় তারা একমত। ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে যাকে খুশি নারী সংসদ সদস্য বানিয়ে, নারীর ক্ষমতায়নের জায়গাটা নষ্ট হচ্ছে। যারা সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হন, তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন। অধিকাংশ নারী সংসদ সদস্যরা এখনো সংসদে ‘অলংকার’ হিসেবেই বিবেচিত হন। যেটি সরকারের নারীর ক্ষমতায়ন নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। তারপরও আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য রাখার চেষ্টা করে। ত্যাগী, পরীক্ষিত, মাঠে রাজনীতি করা নারীদের সামনে আনার সুযোগ কাজে লাগায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা অবদান রেখেছেন তাদের সংসদে আনার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে তৃণমূলের নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত আসনকে ব্যবহার করতে একটা প্রচেষ্টা নেয় সবসময়। এ কারণে গত তিনবারে দেখা গেছে, রাজনীতিবিদদের বাইরেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা অনেক নারীকে সংসদে আনা হয়েছে। একই মুখ বারবার সংরক্ষিত আসনে জায়গা পায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু এর মাধ্যমে অনেকে সম্ভবত একটা ভুল বার্তা পেয়েছেন। বিশেষ করে শোবিজের প্রায় অবসরে যাওয়া, কর্মহীন কলাকুশলীরা। তারা মনে করেছেন, সংসদ বোধহয় রাজনীতিবিদদের জায়গা না। এটাকে তারা ক্লাব বা সমিতি মনে করেন। সংসদ সদস্য হওয়া মানে এলিট ক্লাবের সদস্য হওয়া। তাই টেলিভিশন, সিনেমায় অভিনয় করার কারণে তাদের যে পরিচিতি, সেটি ব্যবহার করে তারা সংসদ সদস্য হতে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠছেন দিনে দিনে। এবার যে ১ হাজার ৫৪৯ জন মনোনয়ন লাভের জন্য ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছেন, তাদের বেশিরভাগই রাজনীতিবিদ। কিন্তু জনপরিচিতির কারণে শোবিজের তারকাদের নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে। আমাদের গণমাধ্যম ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় ক্ষতবিক্ষত একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদের চেয়ে শোবিজের প্রায় পরিত্যক্ত নায়িকার ফরম তোলার দৃশ্য কাভার করতে বিশেষ মনোযোগী। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডবে হিংস্রতা ও বর্বরতার সাক্ষ্য বহনকারী নারীর মলিন মুখ, টেলিভিশন ক্যামেরায় ধরা পড়ে না। টিভি ক্যামেরা খোঁজে বিয়ের সাজে আসা নায়িকার গ্ল্যামারস হাসি। আওয়ামী লীগের ৪৮টি আসনে মনোনয়নে আগ্রহী শোবিজের তারকার সংখ্যা কম করে হলেও পঞ্চাশ। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ চেহারা দেখেও যদি সব সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেয়, তাহলেও অন্তত দুজন নায়িকা বাদ পড়বেন। শোবিজের সবাই যদি সংসদে যান তাহলে আমাদের নাটক সিনেমা কিংবা ওটিটির কী হবে? এমনিতে সিনেমার বারোটা বেজে গেছে। নাটকের মান নিয়েও অনেক প্রশ্ন। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ঘৃণা ও সন্ত্রাসের সংস্কৃতিকে উসকে দিচ্ছে। এখন সংস্কৃতিকর্মীদের অনেক কাজ। সংস্কৃতির মাধ্যমে ধর্ষণ, দুর্নীতি ও সামাজিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে জাগরণ সৃষ্টি করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে তাদেরই। কিন্তু এ দায়িত্ব না নিয়ে কেন রাজনীতির মাঠে তাদের পদচারণা? তাদের কজন আদর্শের টানে আওয়ামী লীগে নৌকা ভিড়িয়েছেন তা নিয়ে দেশের জনগণের ঘোরতর সন্দেহ আছে। গত ১০ বছরে শোবিজের নারী-পুরুষ মিলে যে আওয়ামী-বলয় তৈরি করেছেন, তারা কজন ‘অতিথি পাখি’ আর কজন ‘সুবিধাবাদী’ তা সময়ই সব বলে দেবে। দুঃসময়ে তাদের কজন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক থাকে তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। আমার এ সন্দেহের কারণ হলো, এসব তারকা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ফটোসেশন করেই চলে যান তদবিরে। কেউ টেন্ডারের তদবির করেন, কেউ করেন ব্যাংক লোনের, কেউ চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুদানের। এসব কথিত তারকার রাজনীতি করার সঙ্গে নগদ প্রাপ্তির লোভ সম্পর্কিত। সন্দেহ হয়, আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় আছে, এজন্যই এ তারার মেলা। ক্ষমতা কেন্দ্রে থেকে নানারকম সুযোগ-সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসেবেই তাদের ‘আওয়ামী প্রেম’ কি না, সে প্রশ্ন অনেকের। কারণ পেশাগত জীবনে তাদের বেশিরভাগই কর্মহীন। টুকটাক যা কাজ করেন, তা দিয়ে এরকম বিলাসী জীবন সম্ভব নয়। অভিনয়ের কষ্টের চেয়ে রাজনীতি এখন অনেক সহজ। তাই রাজনীতিই এখন তাদের পেশা।
১৯৮৪
সালে যখন সবে সাংবাদিকতা
শুরু করি, তখন বঙ্গবন্ধু
সাংস্কৃতিক জোটের একটি অনুষ্ঠান কাভার
করতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম।
সেখানে আলমগীর কুমকুম, কবরী সারোয়ার এবং
ফারুক ছাড়া পরিচিত কোনো
মুখ দেখিনি। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ এ অনুষ্ঠানে ইনডেমনিটি
অধ্যাদেশ বাতিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার
বিচার দাবি করেন। এরশাদের
সেই জমানায় বড় বড় সব
তারকার ভিড় থাকত বঙ্গভবনের
নানা অনুষ্ঠানে। রাজসভায় শুধু কবি ছিলেন
না, গায়ক, নায়িকা, গায়িকা কোনো কিছুরই অভাব
ছিল না। এরশাদও খুবই
রোমান্টিক ছিলেন। শোবিজের তারকাদের তিনি বিশেষ যত্নআত্তি
করতেন। এরশাদের পতনের পর এরশাদ ভক্ত
এরকম বেশ কজন গণলাঞ্ছনার
শিকার হন। কিন্তু তারা
ভোল পাল্টাতে সময় নেননি। দ্রুত
তারা জিয়ার সৈনিকে পরিণত হন। ’৯১ থেকে
’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি
জমানায় টেলিভিশন আর্কাইভ ঘাঁটলেই দেখা যাবে আমাদের
টেলিভিশনে জিয়া ভক্তের কী
বাম্পার ফলন হয়েছিল। এভাবেই
শোবিজের তারকারা যখন যার তখন
তার নীতিতে থেকেছেন। তাই এবার যারা
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন তাদের অনেকেই কখনো তারেক জিয়া,
কখনো গয়েশ্বর রায়ের সঙ্গে ফটোসেশন করেছেন। কিছু দুষ্ট লোক
এসব আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
ছড়িয়ে দিচ্ছে। কে ‘জাসাস’ আর
কে ‘জিসাস’ করেছে, সেসব খবরও এখন
প্রকাশ্যে। তারকারা অবশ্য এটাতে বিব্রত নন। কারণ তারা
অভিনয়শিল্পী। চারপাশের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানো অভিনয়
শিল্পের একটি বড় যোগ্যতা।
২০০১ সালে যারা ‘হাওয়া
ভবন’ কিংবা ‘খোয়াব ভবনে’ যেতেন, তারা চরিত্রের প্রয়োজনে
যেতেন। এখন যারা আওয়ামী
লীগের বিভিন্ন জায়গায় যান সেটাও চিত্রনাট্যের
দাবি। তারকা বেচারা কী করবেন। যারা
মনোনয়ন ফরম কিনেছেন, তাদের
সবাই যে এ কিসিমের
তা বলাটা হবে রীতিমতো অন্যায়।
তাদের অনেকেই কবরী কিংবা ফারুকের
মতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী। দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের পাশে ছিলেন। দুয়েকজনের
কথা লিখতেই হয়। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী
বন্যা। বন্যা আপাকে আমার মনে হয়
বঙ্গবন্ধু এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরকে ধারণ করা এক
পরিপূর্ণ বাঙালি ব্যক্তিত্ব। সারা জীবন রবীন্দ্রসংগীতের
মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয়কে তুলে ধরেছেন। অসাম্প্রদায়িক
চেতনাকে লালন করেছেন হৃদয়
দিয়ে। শমী কায়সার শহীদ
শহীদুল্লা কায়সারের কন্যা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সারা জীবন আপসহীন।
২০০১ সালের একটি ঘটনা আমি
বিভিন্ন সময়ে স্মরণ করি।
এখানেও করতে চাই। সেবারই
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি সরকার
তার মেয়াদ পূর্ণ করল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান
লতিফুর রহমানের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা
হস্তান্তর করলেন শেখ হাসিনা। তখনই
বিএনপি প্রচার শুরু করল ‘সাবাশ
বাংলাদেশ’ শিরোনামে বিএনপি নির্মিত নির্বাচনী তথ্যচিত্র। এটিএন বাংলায় এটি প্রচারের পর
হৈচৈ শুরু হলো। আওয়ামী
লীগের ঘুম ভাঙল। পাল্টা
প্রামাণ্যচিত্র বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তাৎক্ষণিকভাবে। বর্তমান
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ
আলী, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফ, বর্তমান হুইপ ইকবালুর রহিম
আর নঈম নিজামকে দায়িত্ব
দেওয়া হলো ‘সাবাশ বাংলাদেশের’
জবাব দেওয়ার জন্য। কাউকে না পেয়ে তারা
এলেন আমার সিদ্ধেশ্বরীর অফিসে।
তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা প্রায়
অপ্রস্তুত অবস্থায় শুরু করলাম ‘জয়
বাংলা বাংলার জয়’ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ।
‘সাবাশ বাংলাদেশের’ উপস্থাপক ছিলেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। আমি একজন উপস্থাপকের
সন্ধানে তারকাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলাম। উপস্থাপনার দরকার নেই, শুধু মুক্তিযুদ্ধের
চেতনার পক্ষে কথা বলার জন্য
করজোড়ে অনুরোধ জানালাম কতজনকে। সবাই ফিরিয়ে দিলেন
শুধু শমী কায়সার ছাড়া।
ওই নির্বাচনী প্রামাণ্যচিত্রে উপস্থাপনার জন্য বিএনপি জোট
আমলে সব চ্যানেলে নিষিদ্ধ
হয়েছিলেন শমী কায়সার। প্রচণ্ড
জনপ্রিয় এ শিল্পীর ক্যারিয়ার
ধ্বংস করেছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। কিন্তু শমী সমঝোতা করেননি।
আপস করেননি। শহীদের সন্তানরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে
না। তারানা হালিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার
বিভাগের (আইন) মেধাবী শিক্ষার্থী।
তিনি যুবলীগে যোগ দেন ১৯৯৪
সালে, আওয়ামী লীগের কঠিন সময়ে। যখন
আওয়ামী লীগের পরিচয় দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ। কোনো কিছু প্রাপ্তির
প্রত্যাশায় নয়, আদর্শের প্রতি
ভালোবাসায় তিনি ওই সিদ্ধান্ত
নেন। তাদের মধ্যে অতিচাটুকারিতা দেখা যায় না।
তাদের আওয়ামী লীগ প্রমাণের জন্য
অতি অভিনয়েরও দরকার হয় না। আওয়ামী
লীগে যারা ’৭৫ দেখেছেন, ’৯১
বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়েছেন, ২০০১ সালে সর্বস্ব
হারিয়েছেন, ২০০৭ সালে আওয়ামী
লীগ সভাপতির পক্ষে লড়াই করেছেন, তারা
হঠাৎ বনে যাওয়া আওয়ামী
লীগের বাড়াবাড়ি দেখলে ভয় পান। শোবিজের
তারকারা কেন এমপি হতে
চান? নাটক, চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও তো মানুষের জন্য,
দেশের জন্য কাজ করা
যায়। জনগণের মধ্যে জাগরণ সৃষ্ট করা যায়। সাম্প্রদায়িকতা,
সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে
লড়াইয়ে সংস্কৃতি সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। শোবিজের
তারকাদের বহু কিছু করার
আছে দেশের জন্য। সেটা না করে
তাদের এমপি হতে হবে?
জাতীয় সংসদে কি মধু আছে?
সংস্কৃতি জগৎ থেকে নিশ্চয়ই
সংসদে প্রতিনিধি দরকার। এরই মধ্যে আসাদুজ্জামান
নূর এবং ফেরদৌস সংসদে
প্রতিনিধিত্ব করছেন। নারী সংসদ হিসেবে
আরও এক-দুজন আসতেই
পারেন। কিন্তু এভাবে এত তারকা কেন
নারী কোটায় সংসদ সদস্য হতে
আগ্রহী হলেন? কিছু পাওয়ার আশায়,
নাকি শোবিজ জগতে তাদের প্রয়োজন
ফুরিয়ে গেছে বলে?
লেখক:
নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে
জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে
দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির
স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি
অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই
মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা
ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী
লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে
বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার
মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী
লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে
না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে
প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে
সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।
আরও পড়ুন: আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার
কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার
সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ
করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া
অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা
কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি
নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের
সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি
একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত,
ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক
কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত।
ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি
অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম
হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয়
কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত
মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল।
কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর
বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়
কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে
আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর
সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান
ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও
আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন
নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা
হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে।
এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন
না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের
বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে
পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল।
যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক
দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই
অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি
২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ
ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির
কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা
তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের
শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান।
চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়,
তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি
নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল
দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই।
দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই।
সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ
হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির
চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান
একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই
কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র
ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে
বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।
শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৪ দল আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।