বিদ্যুতের
দাম বাড়িয়ে যেদিন (২৯ ফেব্রুয়ারি) প্রজ্ঞাপন
জারি করা হলো, সেদিন
রাতেই ভয়ংকর দুর্ঘটনায় বেইলি রোডে প্রাণ হারালেন
বহু নিরীহ মানুষ। বাংলাদেশে গ্যাস দুর্ঘটনা, আগুন লাগা ইত্যাদি
নানা বিপর্যয়ে মানুষের মৃত্যু যেন এখন এক
স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কয়েক মাস পরপর
গ্যাস বিস্ফোরণ, বিদ্যুতের শর্টসার্কিট, রহস্যময় আগুনে বহু প্রাণ যায়।
কিছুদিন চলে হৈচৈ। গঠিত
হয় তদন্ত কমিটি। অনিয়ম বন্ধে অঙ্গীকারের দীর্ঘ তালিকা তৈরি হয়। কিছু
মানবিক বিপর্যয়ের গল্প আমরা সংবাদপত্রে
পড়ি। ব্যস, তারপর সব ঠিকঠাক।
সবকিছু
চলে আগের মতোই। কেউ
দায় নেয় না, কারও
বিচার হয় না, অনিয়ম
বন্ধ হয় না। আমরা
অপেক্ষা করি, আরেকটি বড়
দুর্ঘটনার। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর জাতীয় মানবাধিকার
কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন—মনে হচ্ছে অন্ধকার
যুগে বাস করছি। এসব
দুর্ঘটনায় যারা মারা যান,
তাদের খবর পরে কেউ
রাখে না। প্রতি বছর
ঘটা করে এরকম বিপর্যয়
আমাদের সামনে আসে। মানুষের মৃত্যু
হয়, আমরা আর্তনাদ করি।
তারপর...। নিমতলী, চুড়িহাট্টা,
বনানী এফআর টাওয়ার, বঙ্গবাজার,
নিউমার্কেট, মগবাজার দুর্ঘটনার এই তালিকা দীর্ঘ।
এসব ঘটনা প্রমাণ করেছে
আমাদের জীবন কত তুচ্ছ,
মূল্যহীন। এসব ট্র্যাজেডিতে যারা
মারা গিয়েছিলেন তাদের পরিবারগুলোর খবর কজন রেখেছে?
এসব হৃদয়বিদারক ঘটনার পর সরকার কোথাও
কোথাও নিহত পরিবারকে যৎসামান্য
আর্থিক সহায়তা দেয়। কিন্তু এত
নগণ্য যে, যারা এসব
চেক বা টাকা হস্তান্তর
করেন, তারাও লজ্জায় কুণ্ঠিত থাকেন।
বেইলি
রোডে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া পরিবারের
জন্য এখন পর্যন্ত কোনো
আর্থিক অনুদানের ঘোষণা জানা যায়নি। বেশিরভাগ
দুর্ঘটনার পর নিহতদের পরিবার
পায় একদিনের সান্ত্বনা। সাধারণ মানুষের চোখের জল আর মিডিয়ার
প্রচারণা। কোথাও এক লাখ, কোথাও
পঞ্চাশ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া
হয়। জেলা প্রশাসক কিংবা
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে। এক
লাখ টাকায় কত কেজি চাল
কিনতে পাওয়া যায়? কত কেজি
পেঁয়াজ হয় এই টাকায়?
বাজারে জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে একটি জীবনের দাম
মেলালে দেখা যায়, জীবনের
মূল্যই সবচেয়ে সস্তা, সুলভ। এরকম হিসাব মাথায়
এলো এ কারণে যে,
মুদ্রাস্ফীতির চাপে মানুষ এখন
পিষ্ট। বাজারে গিয়ে আমাদের মতো
মধ্যবিত্তের দম বন্ধ হয়ে
আসে। ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে
বাজারের ফর্দ।
এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো।
প্রতিমন্ত্রী অবশ্য একে মূল্যবৃদ্ধি বলতে
শরম পান। তিনি বলেন
দাম সমন্বয়। বাংলাদেশে দাম সমন্বয় এক
অদ্ভুত গণিত। সমন্বয়ে শুধু মূল্য বাড়ে,
কমে না। পেট্রোল, অকটেনের
দাম সমন্বয় করা হয়েছিল, কিন্তু
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও দাম
কমেনি বাংলাদেশে। এই দেশে কোনো
কিছুর দাম বাড়লে সেটি
আর কমে না। স্থিতিশীল
থাকলেই মানুষ স্বস্তি পায়। সামনে রোজা।
সবকিছুর দাম বাড়ছে লাফিয়ে
লাফিয়ে। দৃশ্যত বাজারের ওপর কারও কোনো
নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজারের ওপর
সরকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় কি
না, তা নিয়েও আজকাল
জনগণের সন্দেহ। গত মেয়াদে বাণিজ্যমন্ত্রী
ছিলেন এক অর্বাচীন বাঁচাল।
পাঁচ
বছরে তিনি বাজার ব্যবস্থাপনার
সর্বনাশ করেছেন। বাজারকে তুলে দিয়েছেন সিন্ডিকেটের
হাতে। সেই সিন্ডিকেট এখন
দানবে পরিণত হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের অভিযান হয় বটে। কিন্তু
ফল হয় হিতে-বিপরীত।
জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়ে।
মজুতদাররা আরও সতর্ক হয়ে
যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মজুতদার ও সিন্ডিকেটকে গণধোলাই
দিতে। এ থেকে বোঝা
যায় সিন্ডিকেট কত শক্তিশালী। আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনী হয় সিন্ডিকেটের কাছে
বশীভূত অথবা অসহায়। এজন্য
জনগণের প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু সিন্ডিকেটের কাছে জনগণও অসহায়।
গত পাঁচ বছরে টিপু
মুন্সির উদ্ভট মন্ত্রিত্বের অবসানের পর আশা করেছিলাম
এবার একজন দক্ষ, যোগ্য
মন্ত্রী দেওয়া হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে।
সরকার এই মন্ত্রণালয়ের একজন
দায়িত্বশীল নেতাকে দেবে। এরকম বহু ব্যক্তি
আওয়ামী লীগে আছেন, যারা
ব্যবসায়ী, মজুতদারদের বেপরোয়া মুনাফার লাগাম টেনে ধরতে পারবেন।
কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীও
দেওয়া হলো না। অনভিজ্ঞ
এক তরুণের হাতে তুলে দেওয়া
হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়টি। নতুন বালক পুকুরে
সাঁতার কাটতে গিয়ে যেমন পানিতে
হাবুডুবু খায়, বর্তমান বাণিজ্য
প্রতিমন্ত্রীর হয়েছে সেই হাল। নতুন
সরকারের কথা আর কাজের
অসামঞ্জস্যতা এখানে বিকটভাবে ধরা দেয়। আওয়ামী
লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে
ঘোষণা করেছিল যে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ
তাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার।
১১ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর দ্রব্যমূল্যে নিয়ন্ত্রণকে
প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল সরকারের
পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রত্যেকেই
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের অগ্রাধিকারের কথা বলেছেন। কিন্তু
সরকারের এ আগ্রহের প্রতিফলন
দেখা যায়নি মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টনে। এটি যদি সরকারের
কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ
ইস্যুই হয়, তাহলে এখানে
কেন সিনিয়র মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হলো না? এরকম
সংকট মোকাবিলা দলের সাধারণ সম্পাদক
কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতার
এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলে জনগণ আশ্বস্ত
হতো। তারা বুঝত যে,
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সত্যিই আন্তরিক। কিন্তু তা হয়নি। তা
ছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি শুধু সিন্ডিকেটের কারণে
হয় না। বিদ্যুতের দাম
বাড়লে চালের দাম বাড়বেই। চালের
দাম বাড়লে শাকসবজির দাম বাড়বে। পুরো
বাজার অস্থির হবে। পরিবহন সেক্টরে
চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে
পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।
একটি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আরেকটি পণ্যের দাম বাড়ার কারণ।
সরকার বাজার ব্যবস্থাপনা, পরিবহন খাতে নৈরাজ্য এসব
বন্ধের উদ্যোগ না নিলে দ্রব্যমূল্যের
লাগাম টেনে ধরতে পারবে
না। টানা চতুর্থবারের মতো
সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ
সরকার ঘোষণা দিয়ে কিছু জিনিসের
দাম বাড়াচ্ছে। সরকারি সেবা সংস্থাগুলোতে যেন
মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যে
ওয়াসা সাধারণ মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে
পারে না, তারা পানির
দাম বাড়াতে চায়।
বিদ্যুতের
দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের মূল্য আরেক দফা বাড়ানোর
কথা শোনা যাচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত
চিনিকলগুলো চিনির মূল্য বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে আবার সরে
এসেছে বটে, কিন্তু ততক্ষণে
অঘটন যা হওয়ার তা
হয়ে গেছে। সরকারের এসব সিদ্ধান্তের প্রভাব
চাল-ডাল-পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের
বাজারে পড়বেই। এটা অর্থনীতির সাধারণ
সূত্র। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ভর্তুকি
সংস্কৃতি থেকে সরকার বেরিয়ে
আসতে চাইছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি বন্ধে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ ঋণদাতাদের বড় চাপ আছে।
সরকারের রাজস্ব আহরণ ঠিকঠাকমতো হচ্ছে
না। ঋণে জর্জরিত অর্থনীতি
বাঁচাতে জনগণের ওপর চড়াও হওয়ার
সহজ পথ বেছে নিয়েছে
সরকার। ভর্তুকি কমিয়ে, কর বাড়িয়ে ঘাটতি
মেটানোর কৌশল পুরোনো ও
বস্তাপচা। এর মধ্যে কোনো
সৃজনশীলতা নেই। এই পথ
গণবিরোধী ও স্ববিরোধীও বটে,
একদিকে সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, অন্যদিকে
আবার সরকারই সেবা খাতে মূল্য
বাড়াচ্ছে।
সরকারের
পক্ষ থেকে কেউ কেউ
বলছেন, সংকট মোকাবিলায় বাধ্য
হয়েই সরকারকে এটা করতে হচ্ছে।
সরকার উপায়হীন। কিন্তু আসলে কি সরকার
উপায়হীন? সরকারের হাতে কি আর
কোনো বিকল্প ছিল না? আমি
মনে করি, সংকট মোকাবিলায়
সরকারের কাছে আরও বিকল্প
আছে। জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি
না করেই সরকার অর্থনৈতিক
সংকট কাটাতে পারে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকার
কঠোর হচ্ছে না কেন? ইচ্ছাকৃত
খেলাপিরা জনগণের টাকা লুণ্ঠন করে
রাজার হালে আছে। ব্যাংক
লুটের টাকায় তারা বিলাসী জীবন
কাটাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ সংসদেও
জায়গা করে নিয়েছে। এসব
লুটেরার বিরুদ্ধে সরকার কেন অসহায়? খেলাপি
ঋণের সংস্কৃতি কমিয়ে আনলে অর্থনীতি চাঙ্গা
হয়। অর্থ পাচারকারী লুটেরাদের
ব্যাপারে সরকার নির্মোহ এবং কঠোর হতে
পারছে না কেন? কারা
অর্থ পাচার করেছে সবাই জানে। বিদেশে
কার কোথায় সম্পদ কারও অজানা নয়।
সুইস ব্যাংকে টাকা উদ্ধারে সরকার
কি কোনো ব্যবস্থা নিতে
পেরেছে? কদিন আগে ব্লুমবার্গের
একটি প্রতিবেদন নিয়ে দেশ-বিদেশে
হৈচৈ হলো। সাবেক এক
মন্ত্রীর লন্ডনে সম্পদের ফিরিস্তি দেখে গোটা জাতি
হতবাক। কিন্তু এ খবর প্রকাশের
পর সরকার নীরব কেন? ২
হাজার ৭০০ কোটি টাকা
লন্ডনে গেল কোন পথে?
আওয়ামী লীগ সরকার কেন
এসব অনিয়মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে? এসব অপকর্মের ভাগীদার
হচ্ছে। খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার
আর দুর্নীতি বন্ধ করলে বাংলাদেশের
অর্থনীতির এ বিবর্ণ চেহারা
থাকবে না; এটা সবাই
জানে। কিন্তু তারপরও সরকার এসব দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা না নিয়ে কেন
জনগণের ওপর নিত্যনতুন বোঝা
চাপিয়ে দিচ্ছে?
কালো
অর্থনীতিতে বলা হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয়
জিনিসপত্রের দাম যখন বাড়ে
তখন ঘুষের রেটও বাড়ে। বাংলাদেশেও
এখন ঘুষের পরিমাণ বেড়েছে। টেন্ডার থেকে শুরু করে
চাকরি, ব্যবসা থেকে পদোন্নতি সর্বত্র
মূল্যবৃদ্ধির আওয়াজ শোনা যায়। রাজনীতিতেও
মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ বোঝা যায়।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কোন কোন প্রার্থী শতকোটি টাকা খরচ করে বিজয়ী হয়েছেন, এমন খবর রাজনীতির আড্ডায় কান পাতলেই শোনা যায়। রাজনৈতিক দলের কোনো কমিটিতে ঢুকতেও এখন আগের চেয়ে বেশি টাকা গুনতে হয়। মূল্যবৃদ্ধি কোথায় নেই? চাল থেকে নুন। মাছ-মাংস-ডিম-দুধ। বিদ্যুতের দাম থেকে বাসের ভাড়া। স্কুলের বেতনসহ হাসপাতালের চিকিৎসা। এমনকি ভিক্ষুকের দানেও এখন মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ। এমন কোনো পণ্য নেই যার মূল্য বৃদ্ধি হয়নি। শুধু একটি ছাড়া—একমাত্র জীবনের মূল্য কমছে। মানুষের দাম বাড়ছে না। এক কেজি পেঁয়াজের চেয়েও সস্তা মানুষের জীবন। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই মানুষের জীবন ক্রমেই মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। গাজায়, মধ্যপ্রাচ্যে, ইউক্রেনে। মানবতার আর্তনাদ আজ বিশ্বজুড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যু যেন পাখির পালক পড়ার মতো। আমরা যেন বাস করছি এক মৃত্যু উপত্যকায়। আপনি সাবধানে গাড়ি নিয়ে আধুনিক সড়কে বাড়িতে ফিরতে যাবেন, হঠাৎ নির্মাণাধীন রড, ইট কিংবা গার্ডার পড়বে আপনার ওপর। কেউ আপনার মৃত্যুর দায় নেবে না। আপনি মূল্যহীন। আপনার সন্তানকে আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাবেন সুন্নতে খতনার জন্য। তার মৃত্যু হবে অবহেলা, অযোগ্য চিকিৎসকের হাতে। জীবন মূল্যহীন। কফি পানের জন্য আপনি কোনো অভিজাত রেস্তোরাঁয় যাবেন। আপনি ফিরবেন লাশ হয়ে। এভাবেই মানুষের জীবন হয়ে যাচ্ছে মূল্যহীন। সবকিছু দামি, বাড়ছে সবকিছুর দাম, তুচ্ছ শুধু মানুষের জীবন।
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
আরও পড়ুন: কুড়ি বছর পর আবারো আওয়ামী লীগের ‘ট্রাম্প কার্ড’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিভক্ত, কোন্দলে
জর্জরিত আওয়ামী লীগ দল গোছাতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে একটি ছিল উপজেলা নির্বাচনে
দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করা। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি মন্ত্রী-এমপির
স্বজনদের উপজেলায় প্রার্থী না করার আহ্বান জানায়; কিন্তু দলের ওই নির্দেশনা মানেননি
অনেকেই। যেসব মন্ত্রী, এমপির স্বজনরা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দু-একজন ছাড়া কেউই
মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা
ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ৩০ এপ্রিল
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সারা দেশে আওয়ামী
লীগের তৃণমূলের দৃষ্টি সেদিন ছিল গণভবনে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত গণভবনে
বৈঠকে উপজেলা প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, সাংগঠনিক বিষয় নিয়েই কোনো আলোচনা হয়নি। বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রী তার থাইল্যান্ড সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। একজন সংবাদকর্মী
প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার
মর্মার্থ হলো, এখনই চটজলদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। আওয়ামী
লীগ কোনো শাস্তির সিদ্ধান্তই চটজলদি নেয় না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র তা অনুমোদন করে
না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির কোনো নেতাকর্মী সংগঠনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে
প্রথমে তাদের কারণ দর্শানো হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটিতে
সবকিছু পর্যালোচনা করে, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। একটি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া
অনুসরণ করা হয়।
কিন্তু বিএনপিতে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এক ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবে, তাদের আজীবন বহিষ্কার করা হবে। কয়েক বছর ধরেই বিএনপি শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। উপজেলা নির্বাচনেও প্রথম দফায় ৭৩ জন, পরবর্তী সময়ে আরও ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের একটি প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সবার সামনে খুন করলেও, পুলিশ যদি অপরাধী ভেবে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গুলি করে, সেটা হলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাকে অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। দীর্ঘদিন বিরোধী দলে থেকে বিএনপি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার।
আরও পড়ুন: আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার
কিন্তু দলেই প্রতিনিয়ত বিচারহীনতার
সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে। যে কোনো অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ
করা উচিত। কিন্তু বিএনপি কিছুদিন ধরে যে গণবহিষ্কারের উৎসব করছে, তা কি আইনি প্রক্রিয়া
অনুসরণ করে? যারা বহিষ্কৃত হয়েছেন, তাদের কি কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল? তারা
কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন? কেন্দ্রীয় কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে কি গোটা বিষয়টি
নিয়ে আলোচনা হয়েছে? উপজেলায় যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের কাউকে ন্যূনতম আত্মপক্ষ সমর্থনের
সুযোগ দেওয়া হয়নি। দপ্তর থেকে সেসব হতভাগাকে বহিষ্কারের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি
একটি গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যেমন গর্হিত, অনাকাঙ্ক্ষিত,
ঠিক তেমনি এই বহিষ্কার। বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে। অথচ দলের ভেতর চলছে অগণতান্ত্রিক
কার্যক্রম। বিএনপির জন্য অবশ্য ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভ্যাস জন্মগত।
ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়া সেনাপ্রধান হয়েছিলেন। তিনি
অবৈধ প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। এরপর যারা তার জন্য ন্যূনতম
হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের বিচার ছাড়াই জিয়া নির্মমভাবে হত্যা করতেন। কেন্দ্রীয়
কারাগারে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করা হয়েছিল হাজার হাজার নিরীহ সৈনিককে। যুদ্ধাহত
মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) তাহেরকে এরকম বিচারের নামে প্রহসন করেই হত্যা করা হয়েছিল।
কাজেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিএনপির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। জিয়ার মৃত্যুর পর
বেগম জিয়া এবং এখন তারেক জিয়াও সেই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন।
গণতান্ত্রিক চিন্তা থেকে দেখলে, বিএনপির গণবহিষ্কার সমর্থন যোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এটি করতে পারে না। আওয়ামী লীগ যেভাবে একজন নেতা বা কর্মীকে শাস্তি দেয়; সেটিই সঠিক। কিন্তু এর বিপরীতে কোন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর, দলকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারে; সে তর্ক হতেই পারে। বিএনপির এক নেতা বলেছিলেন, দলে শৃঙ্খলা রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ফলে অন্যরা শিক্ষা পাবে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার সাহস পাবে না। এ কঠোর অবস্থান নাকি দলকে শক্তিশালী করবে। সত্যি কি তাই? এর জবাব পাওয়া যায় ১ মে প্রকাশিত ‘দৈনিক কালবেলায়’। ‘বিএনপিতে বহিষ্কার বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—‘বহিষ্কারের পর পদ ফিরে পেতে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে ধরনা দেন। অনেক ক্ষেত্রে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়ে থাকে।’ কী তাজ্জব কথা! রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনেছি, কমিটি ও পদ-বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। কিন্তু বিএনপি এখন রাজনীতিতে ‘বহিষ্কার বাণিজ্য’ শুরু করল। নেতাদের অভিনব উপার্জনের এই পথ আবিষ্কারের জন্য দলটির শীর্ষ নেতাকে পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে। অতীতে এরকম অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা দলের সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তাদের দলে মহাসমারোহে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যেমন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। তিনি কখন বিএনপিতে থাকেন আর কখন বহিষ্কৃত হন, সেই হিসাব মেলানো মুশকিল। প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথাই ধরা যাক। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে তিনি মন্ত্রিত্ব হারালেন। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন।
আরও পড়ুন: আদর্শবানরা ক্ষমতায় বিনয়ী হন, অযোগ্যরা বদলে যায়
কিন্তু ২০০১ সালে আবার বীরদর্পে ফিরে
আসেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নানা বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠেন। এক-এগারোর
সময় বিএনপিতে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রয়াত আবদুল মান্নান
ছাড়া সবাই বিএনপিতে ফিরে এসেছিলেন। দুষ্ট লোকেরা বলে, মান্নান ভূঁইয়া বেঁচে থাকলে তিনিও
আবার বিএনপিতে ফেরত আসতেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী কিংবা অলি আহমদদের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন
নেতারা ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে বিএনপিতে ফেরত যাননি; কিন্তু তাদের দলে ফেরাতে কম চেষ্টা
হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বিএনপিতে ‘বহিষ্কার’ আর ‘সাধারণ ক্ষমা’র লুকোচুরি খেলা চলছে।
এ যেন শুধু যাওয়া-আসার খেলা। কে কখন দল থেকে ছাঁটাই হচ্ছেন, কে দলে ফিরছেন, কেউ জানেন
না। একই অপরাধের জন্য একজনকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে অন্যজনকে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কার। দলের
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যখন উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপির স্থানীয় নেতাদের
বহিষ্কার করা হচ্ছে, তখন একই অপরাধে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে দেওয়া হচ্ছে
পুরস্কার। বিএনপিতে গঠনতন্ত্র বলতে কিছু নেই। এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলছে দল।
যার ফলে সংগঠনে অবিশ্বাস, আতঙ্ক এবং হতাশা দানা বেঁধেছে। চরম পন্থা যে একটি রাজনৈতিক
দলের সাংগঠনিক শক্তিকে ক্ষয় করে বিএনপি তার প্রমাণ। বিএনপিতে মৃত্যুদণ্ড তাই ক্রমেই
অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘বহিষ্কার’ অস্ত্র ব্যবহার করে কদাচিৎ। লতিফ সিদ্দিকীর মতো গুরুতর এবং স্পর্শকাতর অপরাধ না করলে, আওয়ামী লীগ এই চরম শাস্তি প্রয়োগ করে না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতা কাপুরুষতা করে অথবা লোভে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল, শেখ হাসিনা ফিরে এসে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেননি। দলে তাদের ধীরে ধীরে অপাঙক্তেয় করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও আবদুল মান্নান কিংবা মেজর জেনারেল (অব.) শফিউল্লাহ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। এক-এগারোতে যারা প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছিল, তাদের বিএনপি স্টাইলে গণবহিষ্কার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট যে চার নেতা শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাদের ২০০৯ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। জাঁদরেল নেতারা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আলংকারিক পদে জায়গা পেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেন। প্রয়াত মুকুল বোস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো তারকা নেতাদের বহিষ্কার না করে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়। তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়ংকর। দলে থেকেও তারা গুরুত্বহীন, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হন। কর্মীদের উপেক্ষা আর টিপ্পনী সহ্য করে তাদের দল করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে তারা অপমানিত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন। তিল তিল করে তাদের সাজা দেওয়া হয়। এই শাস্তি সহ্য করতে না পেরে মান্না, সুলতান মনসুর, আবু সাইয়িদের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। দল ত্যাগের পর তারা রীতিমতো রাজনৈতিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের প্রায়শ্চিত্ত নানা মেয়াদে। অপরাধের গুরুত্ব এবং মাত্রা বিবেচনা করে প্রায়শ্চিত্তের সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেককে ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন প্রয়াত মুকুল বোসের প্রায়শ্চিত্তকালীন সময় শেষ হলে, তাকে উপদেষ্টা পরিষদে ফিরিয়ে আনা হয়। লঘু অপরাধে অনুশোচনার শাস্তি ভোগ করা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এখন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। আবার সাবের হোসেন চৌধুরী প্রায়শ্চিত্ত শেষ করে এখন মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: প্রচণ্ড তাপদাহে ১৪ দলে স্বস্তির বৃষ্টি
২০০৯ সালে মনোনয়ন না পাওয়া প্রয়াত খ
ম জাহাঙ্গীর পরবর্তী সময়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রায়শ্চিত্ত শাস্তির
কয়েকটি তাৎপর্য আছে। প্রথমত, এই শাস্তির ফলে নেতাদের আত্মোপলব্ধির সুযোগ বটে। তারা
তাদের ভুল এবং বিভ্রান্তি উপলব্ধির সুযোগ পান। ফলে তারা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের
শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলের অন্য নেতারা একটি সতর্ক সংকেত পান।
চূড়ান্ত সুবিধাবাদ এবং আদর্শহীনতা একজন রাজনৈতিক নেতার ক্যারিয়ার কীভাবে গিলে খায়,
তার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে চর্চা হয়। অন্য কেউ দলের এবং নেতৃত্বের
বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পরিণাম উপলব্ধি করেন। তৃতীয়ত, এর ফলে দলের প্রধান নেতার প্রতি
নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সাজার কৌশলের পার্থক্য দল
দুটির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, আতঙ্ক নেই।
দলে দ্বন্দ্ব, বিভক্তি আছে, কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই।
সুবিধাবাদী আছে, আদর্শহীনতা আছে; কিন্তু প্রধান নেতার প্রতি আনুগত্যের ঘাটতি নেই। প্রতিপক্ষ
হীন রাজনীতির মাঠে ‘কোন্দল’ই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তৎপর রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপির
চরম শাস্তির কৌশল নেতাকর্মীদের আতঙ্কের ঘরে বন্দি করেছে। সারা জীবন দলের জন্য অবদান
একটি ভুলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দলে হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মতো। দলে সবাই
কুণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। গণতন্ত্র চর্চার বদলে ষড়যন্ত্র
ডালপালা মেলেছে। যোগ্যতার বদলে চাটুকারিতা, তোষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে
বিএনপি সংগঠনটি অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।
শুধু রাজনীতি নয়, কোনো ক্ষেত্রেই চরম শাস্তি সমাধান নয়। আর সেই শাস্তি যদি উপযুক্ত বিচার ছাড়াই হয়; তাহলে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, ঠিক একই কারণে, একটি ভুলেই দল থেকে বহিষ্কার মধ্যযুগীয় বর্বরতার শামিল। গণতান্ত্রিক ধারা বিশ্বাস করলে চরম অপরাধীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তার কথাও শুনতে হবে। একটি গণতন্ত্র বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ফ্যাসিস্ট কায়দায় চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
১৪ দল আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটল না। উপজেলা নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করল না আওয়ামী লীগ। বরং কৌশলী অবস্থান নিয়ে ‘অপরাধী’দের উৎকণ্ঠায় রাখল। বিএনপি অবশ্য সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া শুরু করেছে। উপজেলায় প্রার্থী হওয়া বিএনপির শতাধিক স্থানীয় নেতা এরই মধ্যে বহিষ্কৃত হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর সর্বোচ্চ শাস্তি হলো ‘বহিষ্কার’। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছিলেন, ‘বিনা বিচারে আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এটা ক্রসফায়ার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড।’ বিএনপি এখন শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতিতে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ধীরে চলো নীতিতে। কোনটা সঠিক কৌশল?
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।