এডিটর’স মাইন্ড

ইফতার পার্টির রাজনীতি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল। দুটির অবস্থান দুই মেরুতে। আওয়ামী লীগ যা বলবে এবং করবে তার উল্টো বলা এবং করাটাই বিএনপির রাজনীতি। একইভাবে যে কোনো বিষয়ে বিএনপির অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান গ্রহণই আওয়ামী লীগের ‘পবিত্র দায়িত্ব’। সবক্ষেত্রেই তারা এরকম পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। কোনো বিষয়ই এ দুটি দল একমত নয়। এমনকি মৌলিক ইস্যুতেও তাদের অবস্থান দুই মেরুতে। এবার ইফতার নিয়েও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পরস্পর বিপরীত অবস্থান চোখে পড়ল।

পবিত্র রমজান মাসের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে বড় ইফতার পার্টি না করার অনুরোধ করলেন। তিনটি কারণে প্রধানমন্ত্রী আড়ম্বরপূর্ণ ইফতার পার্টি না করার জন্য দেশবাসীকে অনুরোধ করেন। প্রথমত, গাজায় মুসলিম নির্যাতন। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে চলছে অস্থিরতা। ইসরায়েলের তাণ্ডবে গাজার মুসলমানরা চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে। এবার পবিত্র রমজান তাদের জন্য এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। গাজার মানবিক বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশ এবার ইফতার বিলাসিতা করছে না। অনেক মুসলিম দেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইফতারের আড়ম্বর পরিহার করে প্রতিটি মুসলমান যেন গাজার মুমূর্ষু মানবতার পাশে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মুসলমানরাও এবার ইফতার সংযমের নীতি অনুসরণ করছে। ইফতার পার্টির পয়সা বাঁচিয়ে গাজায় পাঠানো হচ্ছে মানবিক ত্রাণ। পৃথিবীর বহু দেশ এমনটি করছে। বিশ্বে মুসলিম উম্মাহর এ অবস্থানের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আর সে কারণেই তিনি বড় ইফতার পার্টি না করার অনুরোধ জানান দেশবাসীকে। বড় ইফতার পার্টি না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের দ্বিতীয় কারণ ছিল দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।

কিছুদিন ধরে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তরাও এখন জিনিসপত্রের দামে দিশেহারা। এরকম বাস্তবতায় টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তাদের প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার অনুধাবন করতে পেরেছে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট। তারা ভালো নেই। রমজানে কিছু মুনাফালোভীর অনৈতিক লাভের নেশা আরও বেড়েছে। কিছু মানুষের যখন ন্যূনতম খাবার জোগাড় করাই দুরূহ হয়ে উঠেছে, তখন ইফতার পার্টির নামে বিলাসিতার প্রদর্শনী কষ্টে থাকা মানুষের সঙ্গে তামাশার শামিল। বড় ইফতার পার্টি আসলে গরিব মানুষের সঙ্গে উপহাস, তাদের অপমান করা। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি যেমন অসহনীয়, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও ব্যাধিগ্রস্ত। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অর্থনীতি পথ হারিয়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার জন্য সরকার কিছুদিন ধরেই সবক্ষেত্রে ‘কৃচ্ছ্র’ নীতি অনুসরণ করছে।

এ নীতির জন্যই প্রধানমন্ত্রী বড় ইফতার পার্টি না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তৃতীয়ত, পবিত্র রমজান মাস সংযমের মাস। জাঁক-জমকপূর্ণ ইফতার পার্টি আসলে রমজানের মূল চেতনার পরিপন্থি। কিছু কিছু বিত্তবান ইফতারের নামে যে অপচয় করেন, তা দিয়ে বহু ক্ষুধার্ত মানুষকে রমজান মাসে পেটপুরে খাওয়ানো যায়। এটাই ইসলামের চেতনা। কিন্তু তা না করে এ রমজানে অনেকে অপচয়ের বীভৎস উৎসবে মেতে ওঠে। এটি গর্হিত, অনুচিত। প্রধানমন্ত্রী এ চেতনার আলোকেই দেশবাসীকে সংযমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইফতার পার্টি না করার আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি নিজেই এ ধরনের ইফতার আয়োজন থেকে বিরত থেকেছেন। গত কয়েক বছর থেকে প্রধানমন্ত্রী রমজানের পবিত্রতা ও সংযমকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ইফতার পার্টির বিলাসিতা থেকে সরে এসেছে গণভবন।

এবারও একই পথে হেঁটেছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগও এবার কোনো ইফতার পার্টির আয়োজন করছে না। কয়েক বছর আগেও রোজায় সরকারি অফিসগুলোতে ইফতার পার্টির ধুম পড়ত। ইফতার পার্টির অত্যাচারে পাঁচতারকা হোটেলে, রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া পাওয়াই দুষ্কর হয়ে যেত। ইফতার পার্টির নামে চলত নীরব চাঁদাবাজি। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, কর্মচারী সংগঠন ও ইউনিয়ন ‘ইফতার পার্টি’-কে রীতিমতো মৌসুমি ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছিল। রমজানের পবিত্রতার বদলে ইফতার পার্টির অতিশয্য ছিল বেপরোয়া। এবার ইফতার পার্টির মহামারি থেকে জাতি অনেকটাই মুক্ত হয়েছে। এবার রমজানের একটা সৌম্য পবিত্র চেহারা লক্ষ করা যাচ্ছে। সংযম বিলাস অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশিরভাগ মানুষ ইফতার পার্টির সংস্কৃতি থেকে সরে এলেও বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি ইফতার পার্টি অব্যাহত রেখেছে। প্রথম রোজা থেকেই বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে নিয়মিত ইফতার পার্টির আয়োজন করছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ রমজানে দলটি পাঁচশো ইফতার পার্টি করবে। ইফতার পার্টিতে মোনাজাতের আগে তারা সরকার এবং আওয়ামী লীগকে গালমন্দ করছে। সরকারের অত্যাচারে মানুষ যে দুঃখের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সে কথা চিৎকার করে জানাচ্ছে। তারপর প্লেটে সাজানো আকর্ষণীয় ইফতারে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। বিএনপির ইফতার পার্টিতে একটা উৎসব উৎসব ভাব। নেতারা একে অন্যকে আলিঙ্গন করছেন। রসের আলাপে, হাসিতে লুটিয়ে পড়ছেন প্রায় অবসরে থাকা নেতারা। বিএনপির নেতারা বলছেন, ইফতার পার্টির মাধ্যমে তারা দলকে চাঙ্গা করছেন। এক নেতা বলছিলেন, ইফতার পার্টি এক ধরনের রাজনৈতিক জনসংযোগ। বিএনপির ভাষায় এটি নাকি ঐতিহ্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, বিএনপির নেতারা যেসব কথা বলেন, তাতে কি তাদের ইফতার পার্টি করা শোভা পায়? ইফতার উৎসব করার মতো পরিস্থিতি কি বিএনপির আছে? বিএনপির প্রধান নেতা বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ।

দ্বিতীয় রোজার দিন তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে পরদিন তিনি আবার ফিরোজায় ফিরে আসেন। বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা লন্ডনে পলাতক। একটি মামলায় তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। অর্থ পাচার মামলায় হাইকোর্ট তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। বিএনপির তৃতীয় প্রধান নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও অসুস্থ। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। একটি পরিবারের সব অভিভাবক যখন অসুস্থ হন অথবা বিপদে থাকেন তখন সেই পরিবারে উৎসব কি সম্ভব, না করা উচিত? বিএনপি নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কদিন আগে বিএনপির একজন নেতার সাক্ষাৎকার শুনেছিলাম। অত্যন্ত আবেগপ্রবণ কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, ‘বিএনপির যেসব নেতাকর্মী কারাগারে আছেন, তাদের পরিবারগুলো অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।’ বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলছিলেন, ‘বিএনপির সবাই আসলে কারাবন্দি। অধিকারহীন।’ বিএনপির আরেক নেতা এককাঠি সরেস। তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশই নাকি একটি কারাগার। এখানে সবাই অধিকারহীন। বিএনপির নেতাদের অমানবিক অবস্থার কথা প্রতিদিন শুনি।

একবার মির্জা ফখরুল ইসলাম বিএনপির কর্মীদের মানবেতর অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা এখন ঢাকায় রিকশা চালায়, মির্জা ফখরুলের এই বর্ণনা শুনে আমার ফকির আলমগীরের কণ্ঠে গাওয়া ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইল্যা আমারে’ গানটির কথা মনে পড়ে। ‘মায়ের ডাক’ বলে বিএনপি নিয়ন্ত্রিত একটি বিতর্কিত সংগঠনের কথা আমরা জানি। এই সংগঠন গুম নিয়ে কথা বলে। নির্বাচনের আগে গুমের তালিকা নিয়ে এরা রীতিমতো হৈচৈ ফেলেছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসও এদের কথায় আবেগ সামলে রাখতে পারেননি। ছুটে গিয়েছিলেন মায়ের ডাকের নেত্রীর বাসায়। কথিত গুম হওয়া মানুষের পরিবারগুলোকে নিয়ে বিএনপি এবং সুশীলরা মাঝেমধ্যেই নাটক করে। প্রতি বছর এ নাটক মঞ্চায়নের সময় কিছু কোমলমতি শিশুকে আনা হয়। এ শিশুরা পুতুল নাচের পুতুলের মতো আচরণ করে। তাদের বয়স বাড়ে না। বিএনপি নেতারা এ শিশুদের দেখিয়ে আর্তনাদ করেন। তাদের জীবনে আনন্দ নেই বলে হতাশার ঢেউ তোলেন সবাই। বিএনপির যদি হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে থাকে, তাদের পরিবার যদি অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটায়, তাহলে তারা ইফতার উৎসব করে কীভাবে? বিএনপির ভাষায় তাদের বহু নেতাকর্মী গুম হয়েছে। বিএনপি বলে গুম হওয়া পরিবারগুলোর জীবন বিবর্ণ, উৎসবহীন। তাই যদি সত্যি হবে, তাহলে তো বিএনপির ইফতার পার্টি করা রীতিমতো অপরাধ।

দলের কর্মীদের দুর্দশায় রেখে নেতারা যখন লেডিস ক্লাবে মুরগির রান চিবোন, তখন কি মনে হয় না, তারা অসহায় কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন? বিএনপি নেতারা যখন শীতাতপ বেষ্টনীর মধ্যে থেকে ঠান্ডা রুহ আফজায় চুমুক দেন, তখন কি তাদের একবার ভ্রমেও মনে হয় না কর্মীদের রক্ত চুষে নিচ্ছেন। বিএনপি যা বলে, তার একবিন্দুও যদি তারা বিশ্বাস করে তাহলে তো দলটির এরকম ঘটা করে ইফতার উৎসব করার কথা নয়। প্রতিদিন শোকের মাতম করার কথা। কিন্তু তারা করছে। সংযমের মাসে অসংযমের উৎসব। কেন? এটা কি এজন্যই যে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ইফতার পার্টি করতে বারণ করেছেন, তাই বিএনপিকে ইফতার পার্টি করতেই হবে। এটি তো অবশ্যই একটি বড় কারণ। কিন্তু এর বাইরেও এরকম মুমূর্ষু অবস্থাতেও বিএনপির ইফতার পার্টি করার কিছু ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় ইফতার পার্টি সংস্কৃতি ছিল না।

বঙ্গবন্ধু, ভাসানী কিংবা এ কে ফজলুল হক তাদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ইফতার পার্টি করেননি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি দানবদের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলনে, বেশিরভাগ রোজাই করেছেন কারাগারের চার দেয়ালে। মুক্তিযুদ্ধের পরও ঘটা করে ইফতার পালন করতেন না জাতির পিতা। বাংলাদেশে ইফতার পার্টি কালচার শুরু হয় সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমানের সময়ে। জিয়া সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ক্ষমতা দখল করার পর তার খায়েশ হলো সমাজের বিভিন্ন স্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার, সেজন্য তিনি রাতে গুরুত্বপূর্ণ লেখক, বুদ্ধিজীবী, সুশীলকে ডেকে পাঠাতেন তার বাসভবনে। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। শেষে ওই বুদ্ধিজীবীকে তার (জিয়ার) দলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতেন। মাহফুজ উল্লাহর লেখা ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ; পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’ গ্রন্থে দেখা যায়, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে জিয়াকে পরিচিত করাতে ‘ইফতার পার্টি’কে বেছে নেয়। ইফতার পার্টির উদ্দেশ্য ছিল জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে ‘চাঙা’ করা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিএনপিতে ভেড়ানো।

১৯৭৭ সালের রমজানে নিয়মিত ইফতার পার্টির আয়োজন শুরু হয়। এই ইফতার পার্টির মাধ্যমে জিয়া তার ১৯ দফা এবং নতুন রাজনীতির প্রচারণা শুরু করেন। এটা ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল। রাজনৈতিক জনসংযোগ। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সেই পুরোনো খেলা জিয়া ইফতার পার্টির মাধ্যমে নতুন করে শুরু করেন। জিয়ার পর এরশাদ ইফতার পার্টির পরিধি ব্যাপ্তি এবং জৌলুস আরও বাড়িয়ে দেন। এভাবেই ইফতার পার্টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারের একটি অংশ হয়ে যায়। গণবিচ্ছিন্ন শাসকরা ইফতার কালচারের মাধ্যমে জনগণের আকর্ষণ লাভের চেষ্টা করেন। আর ধর্ম ব্যবসায়ীরা ইফতারের মাধ্যমে নিজেদের ধর্মপ্রাণ জাহির করার চেষ্টা চালায়। ধর্ম, ইফতার হয়ে ওঠে রাজনীতির হাতিয়ার। এ কারণেই বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি ‘ইফতার পার্টি’ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

এখনো তারা ইফতার পার্টির উৎসব অব্যাহত রেখেছে। আওয়ামী লীগও ধর্মীয় অনুভূতির কথা বিবেচনা করে ইফতারের রাজনীতি শুরু করে। জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তারাও সাচ্চা মুসলমান। তবে ভালো কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী দুই বছর ধরে এ ভ্রান্ত রাজনীতি থেকে সরে এসেছেন। রমজান মাস সংযমের, আত্মশুদ্ধির। কিন্তু এ মাসে ইফতার পার্টি, সেহরি পার্টির নামে যা হয় তা শুধু অপচয় নয়, বিলাসিতা নয়, ধর্মেরও অবমাননা। ইফতার পার্টির রাজনীতি বন্ধ হওয়া দরকার অবিলম্বে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে ইফতার পার্টি তার আরও জৌলুস হারিয়েছে। এর আবেদনও কমে গেছে। এই তো গত শুক্রবার (১৫ মার্চ) এক পাঁচতারকা হোটেলে জাতীয় পার্টির মহাসমারোহে ডাকা ইফতার পার্টি ফ্লপ হলো। এটি একটি উদহারণ। এভাবে ইফতার পার্টি ক্রমেই রাজনীতিতে গুরুত্বহীন এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে বলে আমি আশাবাদী।


লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


ইফতার পার্টি   রাজনীতি   রমজান   বিএনপি   আওয়ামীলীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

শাজাহান খানরা কি আওয়ামী লীগও খাবেন?

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। 

আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রেীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেজন্য অপেক্ষা করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তবে আওয়ামী লীগের স্বজনপ্রীতি যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তাতে এ দলটি এখন সত্যি সত্যি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। এতদিন মনে করা হতো, আওয়ামী লীগ সভাপতির কথা সবাই এক বাক্যে শোনে। দলের ভিতর যতই বিভক্তি এবং কোন্দল থাকুক না কেন, দলের সভাপতির নির্দেশনা সকলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। কিন্তু বাস্তবতা যে তা নয়, উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক হেভিওয়েট নেতাই সেটি প্রমাণ করলেন। 

আওয়ামী লীগের এই ছন্নছাড়া অবস্থার জন্য কে দায়ী সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে, আওয়ামী লীগে যারা শেখ হাসিনার নির্দেশনা মানেন না, যারা শেখ হাসিনাকে অসম্মান করলেন তাদের কী আওয়ামী লীগ করার অধিকার আছে? আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা যদি অবাধ্য হতেন, দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করতেন সেটি অন্য কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা, সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক নেতারা যখন দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত, দলের সভাপতির সিদ্ধান্ত অমান্য করেন তখন তা অগ্রহণযোগ্য এবং উদ্বেগের।  

আওয়ামী লীগে এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরী হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের ভিতর নানা রকম সুবিধাবাদী ও অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো নিজেদের আখের গোছানো, নিজেদের ক্ষমতাবান করা। এবার পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগ্রাসী উদ্দীপনা যে কিছু কিছু নেতার মধ্যে দেখা গেছে, তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এসমস্ত নেতাদের দলের প্রতি ন্যূনতম কমিটমেন্ট নেই, দায়িত্ববোধ নেই। আওয়ামী লীগ সভাপতিকে তারা ততটুকুই মানেন, যতটুকু নিজেদের স্বার্থের জন্য প্রয়োজন হয়। এরা আওয়ামী লীগের জন্য বোঝা।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম হলো নীতি নির্ধারক ফোরাম। এ প্রেসিডিয়ামের অন্যতম দুইজন সদস্য শাজাহান খান ও ড. আব্দুর রাজ্জাক। এ দুই জনই স্বজনদের তাদের নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী করেছেন। আব্দুর রাজ্জাক তার খালাতো ভাইকে প্রার্থী রাখার ব্যাপারে অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন। যুক্তিটা হলো এরকম যে, খালাতো ভাই আগে থেকেই উপজেলা চেয়ারম্যান । কাজেই তার জন্য এই নির্দেশনা প্রযোজ্য হবে না। তিনি আত্মীয় কিনা সেটি বড় কথা নয়। আগে থেকেই যেহেতু তিনি চেয়ারম্যান সেহেতু এবারও তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচন করতেই পারেন। এতে কোন সমস্যা নেই। ড. রাজ্জাকের এই যুক্তিটি অদ্ভুত এবং অন্যায্য। গতবার উপজেলা নির্বাচন করেছেন বলে এবার আত্মীয়রা উপজেলা নির্বাচন করার সার্টিফিকেট পাবেন এরকম আজগুবি যুক্তি রাজনীতির মাঠে অচল। গতবার আওয়ামী লীগ স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এরকম অবস্থান গ্রহণ করেনি। শেখ হাসিনা স্বজনদেরকে নির্বাচন করা যাবে না- এমন নির্দেশনাও দেননি। বিষয়টি স্বজনদেরকে প্রার্থী করা নয়, শেখ হাসিনার নির্দেশনা। 

৭৫’ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উত্তরাধিকার একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে ছিলো সবসময়। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে ততই আত্মীয়করণ এবং স্বজন প্রীতি একটি ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের জন্য ক্যান্সার। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা যে যেখানে পেরেছেন তাদের স্ত্রী-পুত্র, ভাই-শালা-শালী সবাইকে আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢুকিয়েছেন। চর দখলের মত এলাকা দখলের অভিযান চালাচ্ছেন কিছু কিছু পরিবার। এভাবে বাংলাদেশের বহু এলাকায় বহু পরিবার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে। বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতির অজানা নয়। এবার শেখ হাসিনা কেন আত্মীয় স্বজনদেরকে নির্বাচনে দাঁড়াতে বাঁধা দিচ্ছেন, তার পিছনে একটি দার্শনিক ভিত্তি আছে। আর এই দার্শনিক ভিত্তিটি যারা বুঝতে পারেন না তারা সত্যিকারের আওয়ামী লীগ করেন না। শেখ হাসিনার নীতি এবং আদর্শকেও অনুসরণ করেন না। আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছু নেতাকর্মী যারা ত্যাগী, আদর্শবান এবং আদর্শিক চর্চা করে বেড়ে উঠেছেন তারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে না। তারা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানান না। আওয়ামী লীগের মধ্যে যেসমস্ত নেতারা সুবিধাবাদী, সুসময়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন এবং যোগ্যতা ছাড়াই বড় নেতা হয়েছেন তারাই আওয়ামী লীগ সভাপতির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো এই যে, তারাই এখন আওয়ামী লীগে ক্ষমতাবান, তারাই এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে বেশী প্রভাবশালী। 

শাজাহান খানের কথাই ধরা যাক। তিনি জাসদের রাজনীতি করতেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে যে দলটি সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছিল সেটি হলো জাসদ। জাসদের গণবাহিনী জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে নাশকতার রাজনীতি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ৭৫’ এর ১৫ আগস্ট সৃষ্টির পিছনে রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি করেছিল জাসদ। এখন জাসদের অনেকেই আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ। অনেক জাসদের পরিত্যক্ত বিপ্লবী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। চাটুকারিতা আর পদলোহনের এক রুচীহীন সংস্কৃতির চর্চা করছেন তারা প্রতিনিয়ত। কিন্তু এই জাসদ ৭২’ থেকে ৭৫’ এ কি করেছে সেই ইতিহাস অনেকের কাছে অজানা। শাজাহান খান ছিলেন সেই দলে যারা ৭২’ থেকে ৭৫’ পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অগণতান্ত্রিক, ন্যাক্কারজনক, অবৈধ সব পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। শাজাহান খানরা শুধুমাত্র আখের গোছানোর জন্য এবং রাজনীতিতে পাকা পোক্ত অবস্থানকে নিশ্চিত করার জন্যই আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। আওয়ামী লীগও ৭৫’ পরবর্তী রাজনীতিতে অনেক সমঝোতা করেছে। কারণ ৭৫’ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে যে ধর্মান্ধ মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যেভাবে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল সেরকম বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের সামনে আর কোন বিকল্প ছিলো না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ন্যূনতম বিশ্বাসী সকলকে একত্রিত করার রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছিল। আর একারণেই জাসদ, বাসদসহ বিভিন্ন বিভ্রান্ত বামদলকেও আওয়ামী লীগে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। শাজাহান খান তেমনই একজন নেতা। এলাকায় তার জনপ্রিয়তা থাকার কারণে নির্বাচনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগে শাজাহান খানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু শাজাহান খান হিসেবে ভালোই জানেন। হিসেব নিকেশ করেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর তার প্রাপ্তির ঝুলি ইতিমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। তিনি মন্ত্রী হয়েছেন, তিনি পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এখন তার উত্তরসূরীরা যেন তার সিংহাসন দখল করতে পারে সেজন্য তিনি তার ছেলেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রার্থী করেছেন। শাজাহান খানের পুত্রের এই প্রার্থী হওয়াটাকে স্থানীয় জনগণ ভালো চোখে নিচ্ছে না। আওয়ামী লীগও এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নেয়নি। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শাজাহান খানকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন। গত বুধবার ধানমন্ডি কার্যালয়ে শাজাহান খান গিয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করতে। এসময় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনি তো দলের কথা শুনলেন না, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তও মানলেন না।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। শাজাহান খানরা কখনোই আওয়ামী লীগের কথা মানে না। দলের সিদ্ধান্ত মানে না। তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যেটি প্রয়োজন সেটিই তারা করতে পারেন। শাজাহান খান আওয়ামী লীগ থেকে কি কি খেয়েছেন তার ফিরিস্তি আমি এখন দেবো না। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগকে খেয়ে ফেলবেন কিনা সেই প্রশ্ন এখন উঠছে। শাজাহান খান একটি প্রতীক মাত্র। যারা অন্য দল থেকে এসেছে। দলছুট অনুপ্রবেশকারী তাদের একটা বড় অংশই যে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য, রাজনৈতিক এবং আর্থিক ফায়দা লোটার জন্যই এই ধরনের রাজনৈতিক ডিগবাজি দিয়েছেন তা মোটামুটি স্পষ্ট। শুধু শাজাহান খান একা নন। এরকম নেতার সংখ্যা আওয়ামী লীগে কম না। যারা জীবনে কোনদিন রাজনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করেননি। দলের জন্য, আদর্শের জন্য কোন ঝুঁকি নেননি। সুসময়ে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে দলকে বিতর্কিত করেছেন, তাদের কর্মকান্ডের কারণে আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায় থেকেও বিপর্যস্ত। 

ড. আব্দুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক ইতিহাস ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ এর মত। তিনি আওয়ামী লীগে এসেছেন। এমপি হয়েছেন। ২০০৯ সালে মন্ত্রী হয়েছেন, ২০১৮ সালে মন্ত্রী হয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন, নীতি নির্ধারকে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু তিনি কি বলতে পারবেন, আওয়ামী লীগকে তিনি কি দিতে পেরেছেন? নির্বাচনের আগে তার বিরোধী দলের নেতাদের ছেড়ে দেয়া নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য সারাদেশকে হতবাক করেছিলো। আওয়ামী লীগ সভাপতি কেবল একটি দলের সভাপতি নন। তিনি আওয়ামী লীগের দলের ঐক্যের প্রতীক, আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি একমাত্র পথের দিশারী। এরকম একজন নেতার অবাধ্য হওয়াটা বিস্ময়কর। যারা আওয়ামী লীগে থেকে শেখ হাসিনার নির্দেশ অমান্য করেন তারা একালের মোশতাক। ২০০৭ সালের এক এগারোর সময় আওয়ামী লীগ সভাপতিকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কোন কোন নেতা ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তারা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বড় সেই ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিল দলের তৃণমূল। তৃণমূলের ভালোবাসা আর তৃণমূলের ঐক্যের কারণে ২০০৭ সালে মাইনাস ফর্মুলা সফল হয়নি। এবার অন্যরূপে শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত ও দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সবচেয়ে শক্তি যে তৃণমূল, সে তৃণমূলকেই অকার্যকর, দুর্বল করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। তৃণমূলকে করা হচ্ছে হতাশ। এবার যে উপজেলা নির্বাচনে ‘আত্মীয় করণ’ হলে আওয়ামী লীগের তৃণমূল বিলুপ্তিরই একটি প্রক্রিয়া। এই শাজাহান খানরা যখন তাদের এলাকায় পরিবারতন্ত্র কায়েম করবেন, তখন তৃণমূলরা দূরে ছিটকে যাবে। এই তৃণমূল শেখ হাসিনার হৃৎপিন্ড, শেখ হাসিনার রক্ত প্রবাহ। এই তৃণমূলই হলো আওয়ামী লীগের শক্তি, আওয়ামী লীগের সাহস। এখন পরিকল্পিতভাবে শাজাহান খানরা আওয়ামী লীগের তৃণমূল ধ্বংসের মিশনে নেমেছেন। আসলে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে শাজাহান খানরা কার স্বার্থ সিদ্ধি করছেন সেটি এখন দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগের তৃণমূল যদি দুর্বল হয়ে যায়, তৃণমূল যদি শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তৃণমূল যদি স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাহীন হয়ে যায় তাহলেই শেখ হাসিনা দুর্বল হয়ে যাবেন। শেখ হাসিনাকে তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে আবার মাইনাস ফর্মুলা বাস্তবায়ন করা যাবে। তৃণমূলকে শেখ হাসিনা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই বাংলাদেশে রাজনীতিতে বিরাজনীতিকরণ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তাহলেই আওয়ামী লীগ মুখ থুবড়ে পড়বে, আওয়ামী লীগ অস্তীত্বের সংকটে পরবে। শাজাহানরা কি তাহলে আওয়ামী লীগকেও খেয়ে ফেলবেন?  

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে স্ত্রী-পুত্র, ভাই, শালাদের উৎপাত

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২২ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।

এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না। আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।

দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন। এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।

শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়। এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয় নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের মতো উন্মোচিত করেছে।

উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয় কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন, সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।

উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায় জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি। যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।

সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার। তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।

প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন। নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি। ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন। এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত, পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।

এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন। শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

 

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


আওয়ামী লীগ   রাজনীতি   বিএনপি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কঠোর শেখ হাসিনা: সিদ্ধান্ত না মানলে সব হারাবেন মন্ত্রী-এমপিরা

প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ২০ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।

আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে ৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে?

আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন, তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।

তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।   


শেখ হাসিনা   উপজেলা নির্বাচন   আওয়ামী লীগ   মন্ত্রী-এমপি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।

আকর্ষণহীন, উত্তেজনাহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এখন শুরু হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের প্রক্রিয়া। যথারীতি উপজেলা নির্বাচনেও বিরোধী দল নেই। শেষ মুহুর্তে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। স্বতন্ত্রভাবেও উপজেলা নির্বাচনে কেউ অংশ নিলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে তিন ধাপে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। প্রথম ধাপের মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার শেষ দিনে দেখা গেল বিএনপির বেশ কিছু স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু এর পর পরই এলো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন, তাদের বেশীর ভাগই মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেবেন বলেই ধারণা করা যায়।। উপজেলা নির্বাচন এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের স্ত্রী, সন্তান, ভাই-ভাতিজা, শালা-মামাদের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। আবারও আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের লড়াই। মানুষের সামনে বিকল্প নেই। সাধারণ ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে কেন যাবে? বিএনপির এই ‘ভোট বর্জন’ কৌশল কি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ারই অংশ? 

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচন বর্জন, অসহযোগ আন্দোলনও সফল হয়নি। শুধুমাত্র ভোটাররা নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়েছেন। যে নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত, সেখানে ভোট দিয়ে কি হবে-এরকম একটি মানসিকতা পল্লবিত হয় ভোটারদের মধ্যে। নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নষ্ট হতে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকেই। ঐ নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করেছিল। সে সময় ১৫৩ টি আসনে জনগণ ভোটই দিতে পারেনি। বিএনপির বর্জন দেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ২০১৮’র নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এবারও অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী ভোট দিতে যাননি। জনগণের সামনে কোন বিকল্প ছিলো না। অথচ ঐতিহ্যগত ভাবেই এই অঞ্চলের মানুষ নির্বাচন পাগল। ভোটকে তারা উৎসব মনে করে। সেই উৎসব এখন ভাঙ্গা হটের মতো। দেশের অর্ধেকের বেশী নাগরিক জীবনে ভোটই দেননি। একটি ভোট যে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার, এটিই এদেশের মানুষ এখন ভুলতে বসেছে। এটি বিরাজনীতিকরণের সবচেয়ে বড় উপসর্গ। তাবৎ পন্ডিতরা জনগণের ভোটের অধিকার হরণের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে। বিএনপি তো প্রতিদিন মুখস্থ বুলীর মতো, গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার নিয়ে আওয়ামী লীগকে গালাগালি করছে। কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষা, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপির কি কোন দায়িত্ব নেই? বিএনপি কি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? নাকি তৃতীয় পক্ষের কাছে ক্ষমতা তুলে দেয়ার মিশনে বিএনপি একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সে প্রসঙ্গে এখন যেতে চাই না। 
এবছরের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি কি পেল? এবার অবাধ, সুষ্টু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপর প্রচন্ড চাপ ছিলো। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, হুশিয়ারির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীনদের অবাধ, সুষ্টু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করতেই হতো। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর জনগণের কাছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিলো। পশ্চিমা দেশ গুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীর মনোযোগ দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছিল। সব কিছু মিলিয়ে এবার ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করা ছিলো অসম্ভব, অলীক কল্পনা। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলো। জনগণ ভোটের মাঠে নানা চিন্তা, মত ও পথের প্রার্থী পেলেন না। বিএনপি বলতেই পারে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না- এটা নিশ্চিত হয়েই তারা নির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া বিএনপির এই অনুমান কে মানবে? বিএনপির নির্বাচন বর্জনে দলটির ক্ষতি হয়েছে। জনগণের ক্ষতি হয়েছে। লাভ হয়েছে সুশীল সমাজের। এই নির্বাচন জনগণের মধ্যে রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পর্কে অনীহা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরীর কাজ হয়েছে আরো ত্বরান্বিত। ২০০৭ সালে এরকম রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করেই সুশীলরা ক্ষমতা দখল করেছিল। 

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। তারপর থেকেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে সুশীল সমাজ। এজন্য বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও চেষ্টা করছেন সম্মানিত কিছু সুশীল। কিন্তু বিএনপি যদি রাজনীতির পথেই থাকতো, তাহলে নির্বাচনে যেতো। তাদের অভিযোগ জনগণের সামনে তুলে ধরতো। ভারতে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনেও বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে দমন পীড়ন, নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপন করেছে। আম-আদমী পার্টির প্রধান নেতা কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রকে সাসপেন্ড করা হয়েছে পার্লামেন্ট থেকে। কংগ্রেস অভিযোগ করছে, বিজেপি নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাই বলে কংগ্রেস, আম-আদমী পার্টি কিংবা তৃণমূল কি নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছে? না, বরং তারা এই অভিযোগ গুলোকেই নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছে, জনগণের কাছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর যে হতাশা এবং অস্থিরতা তা দেখে আমার মতো অনেকেই মনে করছিল, দলটির ভুল ভাঙ্গবে, আত্ম উপলব্ধি হবে বিএনপির। ভুল শোধরানোর জন্য হলেও উপজেলা নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অংশগ্রহণের জন্য অনবদ্য এক সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, উপজেলা নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করবে না। ফলে বিএনপিও এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছাড়া অংশগ্রহণ করলে ভোটে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরী হতো। বিএনপি এবং তার গোপন এবং প্রকাশ্য মিত্ররা নির্বাচনে অংশ নিলে গণতন্ত্রের রক্তশূন্য শরীরে রাজনীতির রক্ত সঞ্চালিত হতো। উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ‘রাজনীতি’ কে আরো দুর্বল এবং মুমূর্ষু করলো। বিএনপি দেশে গণতন্ত্র চায় না। জনগণের অধিকারও চায়না। তারা শুধুমাত্র চায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। এটা যেমন সত্য, তেমনি এর বিপরীতে প্রশ্ন উঠতেই পারে আওয়ামী লীগ কি মুক্ত, সুস্থ রাজনীতি চায়? আওয়ামী লীগ কি গণতন্ত্রের বিকাশ চায়? রাজনীতি হত্যার উৎসবে কি আওয়ামী লীগও সামিল নয়? 

টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কৌশল যেভাবে রপ্ত করেছে, ঠিক সেভাবে কি সংগঠনকে নীতি ও আদর্শের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে? আওয়ামী লীগের ভেতরে কি কোন রাজনীতি আছে? আদর্শ চর্চা আছে? প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই কি নিজেকে হত্যা করছে না? সারা দেশে এখন আওয়ামী লীগ কয়েক ভাগে বিভক্ত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলটি কোন্দল বিভক্তিকে সাংগঠনিক স্বীকৃতি দেয়। দেশে এখন কোন বিরোধী দল নেই। কোথাও সরকারের সমালোচনা নেই। সবাই সরকারকে ‘সাধু সাধু’ করে। আওয়ামী লীগ এখন একাধিক টীম হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে খেলছে। কোন্দলকে দেয়া হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। বিএনপি-জামায়াতের দরকার নেই, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাই একে অন্যের চরিত্র হনন করছে, রক্ত ঝরাচ্ছে, খুন করছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তারা এসব কোন্দলকে পাত্তা দিতেই রাজি নন। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন আত্ম তুষ্টির সর্বোচ্চ চূড়ায়। কোন বাস্তবতা উপলব্ধি করে না। তাদের মতে, বিরোধী দল নেই, তাই একাধিক গ্রুপ থাকলে দল শক্তিশালী হবে। কর্মী বাড়বে। দলে ভারসাম্য থাকবে। একজন এমপি বলছিলেন, সবাই তো শেখ হাসিনার। যে জিতবে, সেই আপন। যে হারবে, সে জয়ীকে চাপে রাখবে। এরকম ‘চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স’ কৌশল চলছে আওয়ামী লীগ। এটাই নাকি ভালো। কিন্তু এটি যে কি ভয়ংকর দর্শন তা বুঝতে আওয়ামী লীগকে আরেকটি দুঃসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর ফলে বিশ্বস্ত, ত্যাগী, দল ও নেতার জন্য সব কিছু উৎসর্গ করার মতো নেতা-কর্মী শূন্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ। নেতা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, নেতার জন্য জীবন দেবো-এই মনোভাব আওয়ামী লীগ থেকে উঠে গেছে বহু আগেই। আওয়ামী লীগে এখন ‘নব্য মোশতাক’ তৈরী হচ্ছে মাশরুমের মতো। নেতার সামনে স্তুতি, আড়ালে সমালোচনা-এটাই এখন আওয়ামী সংস্কৃতি। সব নেতা, পাতি নেতা জানেন, মূল নেতা তার বিকল্প রেখেছেন। তিনি দলে অপরিহার্য নন। কাল নেতার হাত সরে গেলেই সে ‘জিরো’। মূল নেতার তিনি একান্ত আপন নন। এই উপলব্ধি তাকে লোভী করে। দুর্নীতিবাজ করে। আদর্শহীন এক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদে পরিণত করে। এই উপলব্ধির কারণেই সে সংগঠন ভালোবাসেনা, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে না। আওয়ামী লীগের ক’জন নেতা এখন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন? কাজের চেয়ে মূল নেতার নেক নজরে থাকাটাই তাদের জন্য লাভজনক। এজন্য আওয়ামী লীগে চলছে আখের গোছানোর উৎসব। যে যেভাবে পারছে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতরা হয় বৈষয়িক হয়ে উঠেছেন। টাকা-কড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য মনোযোগী হচ্ছেন, অথবা দূরে, নিভৃতে চলে যাচ্ছেন অবহেলায়, হতাশায়। দল করো, পদ দখল করো, নির্বাচন করো, টাকা বানাও-আওয়ামী লীগের এই অধ্যায় সমাপ্ত প্রায়। এরপর শুরু হয়েছে, ছেলে, বউ, শালা, মামা, ভাগিনাদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতা। যার এক ঝলক দেখা যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা বড় অংশ এখন সাধারণ মানুষকে ‘মানুষ’ মনে করে না। তাদের পাত্তাও দেয় না। নেতারা চার পাশে রাখেন স্তাবকদের। কিছু একটা বলেই চাটুকারদের দিকে তাকান। তারা অনুগত ভৃত্যের মতো মাথা নাড়েন এবং হাসেন। 

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও আজ বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীদের মতো। এরা জনসম্পৃক্তহীন, উদ্বাস্তু। জনবিচ্ছিন্নতার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচারের গর্ভে জন্ম নেয়া জাতীয় পার্টি। এই সুযোগে রাজনীতির মরা লাশ কুড়ে কুড়ে খাওয়ার অপেক্ষায় মৌলবাদী শকুন। তরুণদের মধ্যে রাজনীতির আগ্রহ নেই। আরো সোজা সাপটা বললে, তরুণরা রাজনীতিকে রীতিমতো ঘৃণা করে। একারণেই ‘রাজনীতি মুক্ত’ ক্যাম্পাসের দাবী এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। যারা ছাত্র রাজনীতি করেন, তাদের মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র নেতাদের ভয় পান বটে, কিন্তু সম্মান করেন না। রাজনীতি এখন সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। এভাবেই সর্বত্র রাজনীতিকে কলংকিত করার উৎসব চলছে। রাজনীতি মানেই খারাপ-এটা প্রমাণের এক ভয়ংকর খেলা শুরু হয়েছে। যার মূল লক্ষ্য হলো গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো। আবার অগণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা। কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে ক্ষমতার চাবি তুলে দেয়া। তেমন পরিস্থিতির দিকেই কি ছুটছে বাংলাদেশ?     

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

পদ হারানোর ঝুঁকিতে আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য

প্রকাশ: ০২:০০ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন। 

আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদকের টেলিআলাপের পরপরই ওবায়দুল কাদের ধানমন্ডির ৩ নম্বর কার্যালয়ে যান এবং সেখানে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে তিনি যারা যারা নিকট আত্মীয় স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করেছে, তাদের তালিকা তৈরি করার জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেন। 

একই সাথে তিনি এটাও জানান যে, যদি কেউ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নিজের নিকট আত্মীয় স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরকম একটি বক্তব্যের পরপরই আওয়ামী লীগের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। 

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমে শুধু বিষয়টি অবহিত করেননি, তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকের পর অন্তত তিনজন আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং কথা বলে তাদের নিকট আত্মীয় স্বজনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। 

উল্লেখ্য, ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই  হারুন অর রশীদ হীরা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা থেকে এবার নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তার এই প্রার্থীতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। 

ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির সাথেও টেলিফোনে কথা হয়েছে বলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বাংলা ইনসাইডারকে নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়াও আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহজাহান খান এমপির ছেলে আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর সদর উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। তার সাথেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কথা বলেন এবং তাকেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য পরামর্শ দেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেও আলাপ করেছেন বলে জানা গেছে। তার ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচরে প্রার্থী হয়েছেন। 

এই সমস্ত স্বজনরা যদি শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করে সে ক্ষেত্রে কী করা হবে? এ রকম প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং এদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও জানা গেছে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা প্রেসিডিয়াম এবং এই প্রেসিডিয়ামের দুজন সদস্য যখন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের নিজেদের আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থী করেছেন তখন অন্যরা সেটা মানবে কীভাবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছেন। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে একটি দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান গ্রহণ করতে চায় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেক হাসিনা বলেছেন, যারাই এ সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, এর আগেও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদেরকে দল থেকে পদ হারানো বা বহিষ্কারের নজির রয়েছে। আওয়ামী লীগের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী যখন দল থেকে বহিষ্কৃত হন তখন তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। কাজেই শেষ পর্যন্ত যদি এই উপজেলা নির্বাচনে স্বজনদের অবস্থান নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না নেয়া হয় তাহলে এই দুই নেতা বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।

আওয়ামী লীগ   উপজেলা নির্বাচন   ড. আব্দুর রাজ্জাক   শাহজাহান খান  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন