প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন লন্ডনে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সেখানে রোড শো উদ্বোধন করলেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালি ও ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘বাংলাদেশে চমৎকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ রয়েছে।’ দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর যখন এই চমৎকার উদ্যোগ, সেদিন বাংলাদেশে ঘটল অন্যরকম এক ঘটনা। হঠাৎ করেই ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হলো। বলা হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়াতেই নাকি এমনটা করা হয়েছে। ভালো কথা। তাহলে, প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাজ্য সফরের আগে কেন দামটা বাড়ানো হলো না? কিংবা প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে এ মূল্যবৃদ্ধি করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো? এ প্রশ্ন করলাম এজন্য যে এ ঘটনা কি কাকতালীয় না স্যাবোটাজ, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রী যখন রোডশো করছেন, সে সময় বাংলাদেশ অচল! গণপরিবহন বন্ধ। চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ। পণ্য পরিবহন বন্ধ। লঞ্চ বন্ধ। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে যারা বাংলাদেশমুখী হবেন, তারা তাৎক্ষণিকভাবে কী বার্তা পাবেন? তারা জানলেন, এখানে কথায় কথায় ধর্মঘট করা যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে মাল আটকে থাকে। বিপিসি জানাল, এ মূল্যবৃদ্ধি ছয় মাস পরও করা যেত। তাহলে এ তাড়াহুড়ো কেন? কেন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হলো না? কেন গণশুনানি ছাড়াই মূল্যবৃদ্ধি? প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের সময় কেন? এটা কি তাঁর আহ্বানকে ব্যর্থ করার জন্য?
প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে তেলেসমাতি কাণ্ড হলো, তাতে আমার মনে হয় সরকারের ভেতরে একটি শক্তিশালী অংশ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিপক্ষ হয়ে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। তাঁর শত্রুরাও এ কথা স্বীকার করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই তো সেদিন জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬-এ প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের অন্যতম প্রেরণাদায়ী প্রভাবশালী নেতা হিসেবে বিবেচিত হলেন। বাংলাদেশ যে এখন ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত, এটা শেখ হাসিনার অবদান। কিন্তু শেখ হাসিনার অর্জন, তাঁর স্বপ্নগুলোকে বিনষ্ট করতে যেন একটি মহল তৎপর। আর সে মহলটি অন্য রাজনৈতিক দল নয়, খোদ সরকারের ভিতরই দৃশ্যমান। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন এবং উন্নয়ন কৌশল খুব স্পষ্ট, স্বচ্ছ। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করেন, লালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে চান। এটাই তাঁর রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নও খুব সহজ এবং সোজাসাপটা। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই জাতির পিতার সারা জীবনের স্বপ্ন। এজন্য তিনি বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। জুলুম, নির্যাতন সহ্য করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল কথা ছিল জনগণকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। সারা জীবন তিনি ছিলেন জনগণের পক্ষে। শেখ হাসিনাও তাই। জনকল্যাণ এবং জনগণের ক্ষমতায়ই তাঁর রাজনীতির মূল সুর। কিন্তু ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের একটি অংশ যা করল তা রীতিমতো নিষ্পেষণ। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। যারা এটা করেছে তারা একটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালীদের প্রকাশ্য ও গোপন প্রেম-প্রণয় রয়েছে। এরাই বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ। বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যা হলো তা ভয়ঙ্কর। প্রথমে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানালেন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা। এরপর এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যা বললেন তা পিলে চমকানোর মতো। তাঁর মতে আমাদের দেশে ডিজেলের মূল্য কম হওয়ায় ডিজেল ভারতে পাচার হয়। তাহলে আমাদের সীমান্তরক্ষীরা ব্যর্থ? আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পাচার রোধে অক্ষম? সরকারের কাজ পাচার বন্ধ করা। পাচার রোধে মূল্যবৃদ্ধি যেন অনেকটা চোরের ভয়ে গহনা বেঁচে দেওয়ার মতো। আমাদের মন্ত্রীরাই পারেন এ রকম দায়িত্বহীন মন্তব্য করতে। কাল কি ওই মন্ত্রী বলবেন- রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে এজন্য গাড়ি চালাবেন না? কদিন পর এ রকম যুক্তিও কি দেওয়া হবে- রাস্তায় ছিনতাই হয় তাই ঘর থেকে বেরোবেন না? ঘটনা এখানেই শেষ নয়, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা যে শেখ হাসিনার সঙ্গে ষড়যন্ত্র তা স্পষ্ট হলো এর পরের ঘটনাপ্রবাহে। মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবহন মালিক, কাভার্ড ভ্যান মালিক ইত্যাদি নানা মালিকের সমিতি একযোগে ধর্মঘটের ঘোষণা দিল। মন্ত্রীরা নির্বিকার! জনগণকে জিম্মি করা হলো। আমরা সবাই জানি এসব মালিক সমিতির নেতা কারা। এসব মালিক সমিতি সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সংগঠন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন এসব সমিতি সে দলের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে। আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং এমপি পরিবহন খাতের গডফাদার। তাঁর ইশারায় মালিক-শ্রমিকরা এক ঘাটে পানি খান। অর্থাৎ সরকারের একটি অংশ জনগণকে জিম্মি করল। ৫ নভেম্বর শুক্রবার। সারা দেশে একযোগে ১৭টি ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষা। এর মধ্যে গণপরিবহন বন্ধ। কিছু মন্ত্রীর কাজ হলো শুধু কথা বলা। এঁদের কথা এতই কর্কশ ও বিরক্তিকর যে আওয়ামী লীগের কর্মীরাও আজকাল এদের কথায় কানে তুলা দেন। ব্যস, বকাউল্লা বকে গেলেন। পাতানো খেলার মতো বলতে থাকলেন ‘হুঁশিয়ার, সাবধান!’ মালিক সমিতির নেতারা মুচকি হাসলেন। তাঁরা জানেন এসব স্রেফ কথার কথা। যথারীতি মালিকপক্ষের দাবি মেনে নেওয়া হলো। সরকার কার প্রতিনিধি- জনগণের না মালিক পক্ষের? কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আছে যার দাম বাড়লে বাজারে চেইন রিঅ্যাকশন হয়। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ল। সে ঢেউ আছড়ে পড়ল কাঁচাবাজারে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্য নিয়ে যেন এক হরিলুটের খেলা চলছে। শাকসবজি, পিঁয়াজ-কাঁচা মরিচ থেকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলেছে। বাজার দেখার কেউ নেই। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সে আগুনকে আরও ভয়াবহ করল। করোনার সময় থেকেই মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এ সময় ডিজেলের দাম বাড়িয়ে জন অসন্তোষ সৃষ্টির জন্যই কি এ তৎপরতা? জনগণকে জিম্মি করতে দেওয়ার সুযোগ কেন মালিকদের দেওয়া হচ্ছে? টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। সব সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বলা হচ্ছে সরকার শক্তিশালী। বিপুল জনসমর্থন আছে সরকারের। ঘরে বাইরে সরকারের ক্ষমতা দৃশ্যমান বটে। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয় মেয়াদে থাকা একটি সরকার কিছু সিন্ডিকেটের কাছে এত অসহায় কেন? শুধু ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি নয়, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্য করি যে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন এবং নির্দেশ দেন তার উল্টো কাজ করাটা যেন আওয়ামী লীগ ও সরকারের একটা অংশের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এরা যেন শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিপক্ষ। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কথাই ধরা যাক। দুর্গোৎসবে যা ঘটেছে তা অগ্রহণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী সব সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের জন্য শেখ হাসিনা যা করেছেন, অন্য কোনো সরকারপ্রধান তা করেননি। কিন্তু শেখ হাসিনার এ অর্জন ম্লান করতে যেন মরিয়া সরকারের প্রশাসন। প্রতি বছর দুর্গোৎসবে পূজামণ্ডপে তিন স্তরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়। এবার রাখা হয়নি কেন? কুমিল্লার ঘটনার পর সরকারের ঘুম ভাঙল অনেক দেরিতে, কেন? সর্বত্র প্রশাসন এত নির্লিপ্ত, উদাসীন কেন? গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করল? জাতির পিতা সারা জীবন অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে গেছেন। শেখ হাসিনাও তা করেন। কিন্তু তাঁর সরকারের মন্ত্রী, আমলা, প্রশাসনের কজন এ চেতনা ধারণ করেন? প্রশাসনে এখন বকধার্মিকের আধিক্য চোখে পড়ে। এদের কারণেই সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন তা কি আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৫০ বছরে বাংলাদেশ নতুন বন্ধু পেয়েছে, তার নাম পাকিস্তান। সরকারের ভিতর প্রভাবশালী একটি অংশ যেন পাকিস্তানের সঙ্গে রোমান্সের জন্য ব্যাকুল। পাকিস্তানের কাছে পাওনা টাকার হিসাবে নেই। বাংলাদেশে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে নজরদারি নেই। পাকিস্তানের জন্য পুরনো প্রেম যেন উথলে উঠেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে সরকারের ভিতর যারা মরিয়া তারাই শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ।
বাংলাদেশে এখন লাজলজ্জাহীন তৈল মর্দন প্রতিযোগিতা চলছে। শেখ হাসিনাকে এমন কোনো উপাধি নেই যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। তাঁর প্রশংসা, স্তুতিতে মন্ত্রী, আমলারা মুখে ফেনা তোলেন। কিন্তু বাস্তবে কাজ করেন তাঁর নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী। শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। সরকারের একটি অংশের একমাত্র কাজ জনগণকে যে কোনো প্রকারে কষ্ট দেওয়া। করোনাকালে তার ভূরি ভূরি নজির আছে। গার্মেন্টস চলবে, গণপরিবহন বন্ধ কিংবা অর্ধেক গাড়ি চলবে- এর মতো উদ্ভট সিদ্ধান্ত শুধু জনগণকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই। শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতি করা যাবে না। বাস্তবে দুর্নীতির এক নীরব প্রতিযোগিতা চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৭ ফাইল গায়েব হলো। দু-এক দিন তোড়জোড় দেখলাম, এখন তা বন্ধ। ফাইল রক্ষার দায়িত্ব আমলাদের, অথচ পিয়ন-দারোয়ানদের নিয়ে টানাহেঁচড়া করে লোক দেখানো নাটক হলো। শেখ হাসিনা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চেয়েছেন তা-ও তিন মাস হলো। এটা ধামাচাপা দিতে আমলারা এখন চাটুকারিতায় আরও বেশি মনোযোগী হয়েছেন। অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বলার চেষ্টা করেন, শেখ হাসিনা যা চান তা-ই হয়। কথাটা সঠিক নয়। শেখ হাসিনার অনেক আকাঙ্খার উল্টো কাজ করছে সরকারের একটি অংশ এবং প্রশাসন। শেখ হাসিনার আকাঙ্খাগুলোকে যদি প্রশাসন বুঝত তাহলে এভাবে ডিজেলের দাম বাড়াত না, এভাবে পূজামণ্ডপে হামলা হতো না। এভাবে ফাইল চুরির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হতো না। শেখ হাসিনার একমাত্র শক্তি হলো জনগণ। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে প্রতিপক্ষ ভয় পায়। সরকারের ভিতর একটি অংশ এখন শেখ হাসিনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তাঁর জনপ্রিয়তা নষ্টের চক্রান্ত চলছে। এজন্য বাজারে ছড়ানো হয়- শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই হয় না। মন্ত্রীরা ঘুষ খান শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে? আমলারা বেগমপাড়ায় বাড়ি বানান প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে? নীরবে পর্দার আড়ালে চলছে এক সর্বনাশা খেলা। এ খেলায় শেখ হাসিনার দুঃসময়ের আপনজনদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনে সৎ, যোগ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের আড়াল করা হচ্ছে। শেখ হাসিনাকে বায়ু বাবলের মতো চাটুকার বলয় ঘিরে ফেলেছে। শুধু সরকার কেন, আওয়ামী লীগের একটি অংশও যেন শেখ হাসিনার বিপরীত স্রোতে চলছে। আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ বন্ধে গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী না হলেও ৫০ বার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু দলের নেতারা সে নির্দেশ কি মানছেন? শেখ হাসিনা বলেছেন, বিদ্রোহী প্রার্থী দেওয়া যাবে না। মন্ত্রী-এমপিরাই এ বক্তব্যের পর দ্বিগুণ উৎসাহে বিদ্রোহী প্রার্থী দিচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা। এরা মারামারি করছেন। খুনোখুনি করছেন। আওয়ামী লীগের বাইরের শত্রুর দরকার নেই। আওয়ামী লীগের প্রধান শত্রু এখন আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা বলেছেন, রাজনীতি ত্যাগের, ভোগের নয়। তিনি যা বলেন তা করেন। ৪০ বছর দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রায় ১৮ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করছেন। একটি কলঙ্কের দাগ তাঁর গায়ে লাগেনি। তাঁর চরম শত্রুও শেখ হাসিনার সততা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না। কিন্তু শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে ওয়ার্ড নেতার বাসায় টাঁকশাল থাকে! গত ১৩ বছরে আওয়ামী লীগে যারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা কি শেখ হাসিনার অনুসারী? যখনই শেখ হাসিনা দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেন, তখন বিএনপি-জামায়াত জুজুর ভয় দেখানো হয়। আওয়ামী লীগের নেতারা ভাঙা রেকর্ডের মতো বিএনপিকে গালাগালি করেন। বিএনপি ষড়যন্ত্র করছে বলেও খিস্তি করেন। বিএনপি নামের এক ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ দেখিয়ে নিজেদের অপকর্ম আড়ালের চেষ্টা করছেন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। এরাই শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ।
মাঝেমধ্যে ’৭৫-এর আগের দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জাসদকে সামনের প্রতিপক্ষ দেখিয়ে খুনি মোশতাকরা দলে এবং সরকারে সিঁধ কাটছিল। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি, পাটের গুদামে আগুন, সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। এসব ঘটিয়ে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে জাতির পিতার অসামান্য অবদানকে জনদৃষ্টির আড়াল করা হয়েছিল। শূন্য থেকে বঙ্গবন্ধু কীভাবে দেশকে গড়ে তুলছিলেন সে কথা জনগণকে বুঝতে দেওয়া হয়নি। জাসদকে মাঠে নামানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে। বড় করে দেখানো হয়েছিল নানা বিশৃঙ্খলা। এ রকম একটি পরিস্থিতিতেই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘটানো হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদরা ছিটকে পড়েছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে। ষড়যন্ত্রকারীরা ঘিরে ফেলেছিল বঙ্গবন্ধুকে। দলে এবং সরকারে। আমরা কি সে রকম একটা পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে? পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় পরিসরের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে বাংলাদেশে। এসবের সুফল পাবে এ দেশের জনগণ। বদলে যাবে বাংলাদেশ। তার আগে দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে, যেখানে পদ্মা সেতুর নির্মাণে মানুষের আবেগকে হত্যা করা হচ্ছে বরং পিঁয়াজের দাম বাড়ায় জনগণ ক্ষুব্ধ। মেট্রোরেলের সুবিধার চেয়ে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মানুষ বিরক্ত। প্রধানমন্ত্রীর বন্দনা করতে করতে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা অপশক্তি কি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত?
আমার এ উদ্বেগের কারণ একটাই। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা আর শেখ হাসিনা এখন সমার্থক। শেখ হাসিনা ছাড়া এই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ভরা। তাই শেখ হাসিনার আসল প্রতিপক্ষ কারা, তা এখনই চিহ্নিত করতে হবে। কারণ বাইরের শত্রুর চেয়ে ঘরের শত্রু ভয়ংকর!
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
মন্তব্য করুন
প্যারিসে এক ধরনের পেশা
আছে। এ পেশাকে বলা
হয় ‘পিকচার গাইড’। যে কোনো
ছবি দেখে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এই গাইডরা বাতলে
দেন। যে কোনো ছবির
ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দিতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে এরকম বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষক নেই।
থাকলে নির্ঘাৎ আমার মতো অনেকেই এসব গাইডের কাছে যেতেন দুটি ছবির ব্যাখ্যার জন্য। একটি ছবি গত ২২ মার্চ
বুধবারের। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছয় আওয়ামী লীগ
নেতার হাস্যোজ্জ্বল ফটোসেশন। এ ছবিতে আওয়ামী
লীগের সব নেতাই কেতাদুরস্ত
পোশাক। স্যুট-কোট পরিহিত। মুজিব কোটে কেউ নেই (পোশাকে কী আসে যায়)। তাদের চেহারার
মধ্যে একটা বিজয় বিজয় ভাব। যেন মস্ত কিছু অর্জন করেছেন। দ্বিতীয় ছবিটা ১৬ মার্চ ভারতীয়
রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে বিএনপির পাঁচ নেতার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এ ছবিতে বিএনপি
নেতাদের হাসিটা বেশ চওড়া। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ভারত জয়ের পর যেমন প্রশস্ত
হাসি দিয়েছিলেন। বিএনপি নেতাদের হাসিটা অনেকটা সেই আদলের। বিএনপি নেতারা কি তাহলে ভারত
জয় করলেন? ওইদিন ভারতীয় দূতাবাসে নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিবসহ পাঁচ নেতা। বেশ কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সরকার আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের
টানাপোড়েন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে রীতিমতো তুলোধোনা করা হয়েছে। এর মাত্র দুদিন
পর আওয়ামী লীগ নেতাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় মধ্যাহ্নভোজ কী বার্তা দিল?
কে কাকে বশে আনল? আবার বলা হয়, বিএনপি আন্দোলনে সুবিধা করতে পারছে না ভারতের জন্য।
বিএনপি নেতারাও একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন—‘ভারতই এ সরকারকে টিকিয়ে
রেখেছে।’
কোনো কোনো নেতা তো আওয়ামী লীগ
সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার বলতেও দ্বিধা করেননি। এমন ভারতবিদ্বেষী বিএনপির ‘দেশপ্রেমিক’
নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে কী পেলেন? তারা
কি ভারত জয় করলেন, নাকি
ভারতের ‘পুতুল’
হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন? বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ‘বন্ধু’
রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এবং প্রভুত্ব কি আবার প্রতিষ্ঠিত
হতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্য কি দূতাবাস পল্লিতেই
নির্ধারিত হবে? কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তো এরকম ছিল
না। স্বাধীনতার পর সদ্য স্বাধীন
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নেতারা মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা বাংলাদেশ সফরে এলেন। তাজউদ্দীন আহমদকে আমলারা বললেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে মন্ত্রীরই যাওয়া উচিত। তাজউদ্দীন আহমদ বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদায় মন্ত্রীর অনেক নিচে। একজন যুগ্ম সচিবকে তিনি পাঠিয়েছিলেন ম্যাকনামারাকে রিসিভ করার জন্য। ৭ জুন ১৯৭২
সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক কারও এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’
সত্যিই বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ নাক গলাতে পারেনি। নাক গলাতে না পারলেও তারা
ষড়যন্ত্র করেছে। ৭৫-এর ১৫
আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে আন্তর্জাতিক মদদ এবং ষড়যন্ত্রের কথা এখন সবাই জানে। মার্কিন দলিলপত্রেই তখন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিস্টার বুস্টারের ভূমিকার কথা জানা যায়। ৭৫-এর পর
থেকেই পশ্চিমা দূতাবাসগুলো ক্ষমতাবান হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তারা মোড়ল মুরুব্বি বনে যান। বাংলাদেশের ক্ষমতাবদলের লাটাই চলে যায় দূতাবাসপাড়ায়। অনির্বাচিত স্বৈরশাসকরা মনে করে, জনগণ নয়, রাষ্ট্রদূতরাই ক্ষমতার উৎস। বিদেশি প্রভুদের খুশি রাখলেই ক্ষমতার মসনদ ঠিকঠাক থাকবে এরকম একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় জনভিত্তিহীন শাসকদের মধ্যে। শুরু হয় বিদেশি প্রভুদের
পদলেহনের সংস্কৃতি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে খুশি না করতে পারলে
ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না এমন একটি
চিন্তা রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। এর পেছনে অবশ্য
অর্থনৈতিক কারণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ৭৫-এর পর
বাংলাদেশের অর্থনীতি পরনির্ভরতার পথে যাত্রা শুরু করে। বাজেট, উন্নয়ন সবকিছুই দাতাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ভিক্ষা নিলে তো প্রভুদের কথা
শুনতেই হবে। শর্তের জালে বন্দি হয় আমাদের রাজনীতি,
অর্থনীতি এবং উন্নয়ন ভাবনা। সাহায্য বা ঋণের চেয়ে
শর্তের ফর্দ লম্বা হতে থাকে। কিন্তু এখান থেকেই বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর
তার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করেন। কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য বিশ্বব্যাংক চাপ দেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ গ্রহণ করেননি সদ্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি
বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা, সম্মান এবং স্বাতন্ত্র্যকে কূটনীতিতে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন। এরই ফলে গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির মতো স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি নিজেই একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গ্যাস বিক্রি করতে তিনি রাজি হননি। এ জন্যই ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী
লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। আমার বিবেচনায় ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে,
বিএনপির ‘নতুন নেতা’
তারেক জিয়া ‘বিদেশি প্রভু’দের তুষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন যে যা চেয়েছে,
সবকিছুতেই সায় দিয়েছিলেন তারেক জিয়া। ক্ষমতায় গেলে তাদের প্রেসক্রিপশন এবং পরামর্শ মেনে চলার মুচলেকা দিয়েই বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া এক কথা আর
তার বাস্তবায়ন অন্য কথা। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া
হয়েছিল, ক্ষমতায় এসে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার উল্টো করা শুরু হয়। যেমন ভারতের কথাই ধারা যাক। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের
কাছে ভারতের প্রধান চাওয়া হলো, বাংলাদেশ যেন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়। কিন্তু
৭৫-এর পর থেকে
২০০৮ সালের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকারই ভারতের এ অনুরোধ রাখেনি।
নানাভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলগুলো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নিরাপদ চারণভূমিতে পরিণত হয়। ১০ ট্রাক অস্ত্রের
চালান তার বড় প্রমাণ। শুধু
ভারতের সঙ্গে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বিএনপির ওয়াদা ভঙ্গের ঘটনা ঘটে। আর এরকম পরিস্থিতি
২০০৬ সাল থেকেই কূটনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় নতুন তৎপরতা।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেউ না, তৃতীয়পক্ষকে ক্ষমতায় আনতে সবুজ সংকেত দেয় প্রভাবশালী দেশগুলো। এক-এগারোর অনির্বাচিত
সরকার ক্ষমতায় আনতে বাংলাদেশের অবস্থিত কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসের ভূমিকা, এখন কোনো গোপন বিষয় নয়। আবার সুশীলদের নিয়ন্ত্রিত এক-এগারো সরকারের
সীমাহীন ব্যর্থতা, অযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোই বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের তাগিদ দেয়। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তিনি খোলামেলাভাবে এই প্রসঙ্গটি এনেছেন।
তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারত
সফরে গেল প্রণব মুখার্জি তাকে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেন। যুক্তরাষ্ট্রও বুঝতে পারে ‘সুশীল’রা কথাবার্তায় যতই
পটু হোক না কেন, দেশ
পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থ। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের
নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত এক-এগারো সরকারের
আসল শক্তি ছিল বিদেশি প্রভাবশালী দেশগুলো। জনগণনির্ভর না থাকায়, এক-এগারো সরকার আসলে দূতাবাসগুলোর কথায় চলত। তাদের নির্দেশেই তারা নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। এ সময় শেখ
হাসিনার দৃঢ় অবস্থান এবং অর্থনীতিতে বিস্ময়কর অগ্রগতির কারণে বিদেশি দূতাবাসগুলোর প্রভাব কমতে থাকে। আওয়ামী লীগ দূতাবাসগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলেও রাজনৈতিক বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়ার নীতি শুরু করে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করেন। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেন কেউ হস্তক্ষেপ না করে, তা
নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন।
ড. ইউনূস এবং
গ্রামীণ ব্যাংক, সংবিধান সংশোধন করে তা ৭২-এর
আদলে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ইত্যাদি ইস্যুতে কূটনৈতিকপাড়াকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। উপরন্তু ২০১৪ ও ’১৫ সালে
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের নামে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও কেউ পছন্দ করেনি। কূটনৈতিক অঙ্গনে এর নেতিবাচক প্রভাব
পড়ে। বিএনপির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সম্পর্ক, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদে বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মীর ঝোঁক দূতাবাসগুলোতে বিএনপিকে অনাহূত করে দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় একঘরে বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে
নেতা হিসেবে ভাড়া করে। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দূতাবাস পল্লিতে আবার তৎপরতার সুযোগ পায় বিএনপি। ড. কামালের সঙ্গে
ঐক্য বিএনপির চোখ খুলে দেয়। জনগণ না ‘বিদেশি প্রভু’দের স্বপক্ষে আনাটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডায় পরিণত হয়। এরপর থেকে ঘরে-বাইরে কূটনৈতিক তৎপরতাই বিএনপির প্রধান কাজ। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশকে বিষিয়ে তুলতে তারা যেমন লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তেমনি বাংলাদেশের কূটনৈতিকপাড়ায় তাদের দৌড়ঝাঁপ ফটোসেশন বেড়েছে। অনেকেই মনে করে ভারত বিএনপিকে পছন্দ করে না। বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন, ভারত চাইলেই আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে। এ জন্য ২০১৮
সালেও ভারতের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। ভারত এখনো বিএনপিকে আস্থায় নেয় না, এটা ভুল প্রমাণ করতে দলটির নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়ে নিজেদের ধন্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে দিনে একবার অন্তত কথা বলেছেন বিএনপি কোনো না কোনো নেতা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি কী প্রমাণ করতে
চায়? জনগণ নয়, দূতাবাস তাদের ক্ষমতায় আনবে? এটা দেখে সম্ভবত আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ভয় পেয়েছেন। তারা
ভাবছেন, কূটনৈতিক তৎপরতায় বিএনপি যদি আওয়ামী লীগকে কুপোকাত করে দেয়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র
নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে নাজেহাল করে ফেলবে। চাপে জর্জরিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে কী না পারে।
এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ইদানীং শোনা যায়। এ জন্য স্যুট
কোট পরে মার্কিন দূতাবাসে আওয়ামী লীগের ধরনা মনে হচ্ছে, টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একমাত্র বাধা যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপি ব্যস্ত ‘ভারত’কে খুশি করাতে,
আওয়ামী লীগ ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাগ ভাঙাতে। তাই, ডিনার, লাঞ্চ আর ককটেলের উৎসব
চলছে দূতাবাস পল্লিতে। দুই প্রধান দল কি আবার
জনগণের বদলে দূতাবাসগুলোকে ক্ষমতা বদলের নিয়ন্তা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে? তাহলে জনগণ কী করবে? দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
জামায়াত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
২৫ মার্চের কালরাত।
‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর চালাল বর্বর গণহত্যা। এটাকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পর সবচেয়ে বড় পৈশাচিকতা। জাতিগত
নিধনের এ নৃশংসতা গোটা
বিশ্বকে স্তব্ধ করেছিল। সায়মন ড্রিং-এর মাধ্যমে বিশ্ব
জেনেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ংকর তান্ডবের কিছুটা। আজও বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বীভৎসতার কথা স্মরণ করে শিউরে ওঠে। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন কী করেনি পাকিস্তানিরা
সেদিন। এ ভয়ংকর নিধন
কর্মসূচির মধ্য দিয়েই শুরু হয় ৯ মাসের
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। নিরস্ত্র বাঙালি জাতি জাতির পিতার নির্দেশে ‘যার যা কিছু আছে,
তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে’। ’৭১-এর
গণহত্যা এবং বর্বরতার নিন্দা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সে দেশের বৃহত্তর
জনগোষ্ঠী ছিল মানবতার পক্ষে। কেনেডির মতো অনেক মানবিক মার্কিন রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ছিলেন পাকিস্তানিদের পক্ষে। গণহত্যার পক্ষে। পাকিস্তানি বর্বরতায় ছিল তার সরাসরি সমর্থন। তার বিশ্বস্ত হেনরি কিসিঞ্জার জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি। এটি ভুল প্রচারণা।’ মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র সেদিন মানবাধিকার হরণকারী, লুণ্ঠনকারী দখলদারদের সমর্থন দিয়েছিল। সহযোগিতা করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঠেকাতে কী করেননি? কিন্তু
মার্কিন সহযোগিতার পরও বীর বাঙালির কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনী। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার অদম্য স্পৃহাকে যে কেউ পরাজিত
করতে পারে না তা প্রমাণিত
হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। প্রবল মার্কিন বিরোধিতার পরও আমরা পাই রক্তে ভেজা পবিত্র পতাকা। আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু ’৭১-এর বিজয়ের
পরও বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন টিকতে না পারে সে
জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। ১৯৭৪ সালে ঠুনকো অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গম রপ্তানি বন্ধ
করে। সংকটে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়। জাসদ, গণবাহিনী, সর্বহারা দিয়ে দেশে সৃষ্টি করা হয় অস্থিরতা। স্বাধীনতাবিরোধী
অপশক্তিকে দিয়ে চলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে
অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র। ’৭৫-এর ১৫
আগস্ট বাংলাদেশে রচিত হয় আরেকটি নৃশংসতার
কালো অধ্যায়। জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রের এ সংক্রান্ত দলিলপত্রগুলো
উন্মুক্ত করা হয়েছে। এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ’৭৫-এর বর্বরতায়
যুক্তরাষ্ট্রের সায় ছিল। তারা ষড়যন্ত্রকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং মদদ দিয়েছিল। সংবিধান লঙ্ঘন করে খুনি মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। খুনিদের বাঁচাতে খুনি মোশতাক এবং জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো কালো আইন বানিয়েছিল। এ আইনকে ইতিহাসের
নিকৃষ্টতম মানবাধিকার হরণকারী আইন বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কোনো
দলিলে এরকম জঘন্য একটি আইনের নিন্দা করেনি। এসব কথা মনে পড়ল গত ২০ মার্চ
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্ট ২০২২-এ বাংলাদেশ সংক্রান্ত
৬১ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি পড়ে। মনের অজান্তেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার শেষ পঙ্ক্তিটি ঠোঁটে এসে গেল- ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
যে যুক্তরাষ্ট্র ’৭১-এ পাকিস্তানি
গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণকে মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করেনি। ’৭৪-এ বাংলাদেশকে
দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ’৭৫-এ জাতির
পিতার হত্যাকারীদের সমর্থন দিয়েছে- তারাই আজ বাংলাদেশের মানবাধিকারের
বিচারক হয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিক্তিতে মাপার মহান দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। সত্যি কী বিচিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের
মানবাধিকার রিপোর্টের তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমত, এ রিপোর্ট গতানুগতিক
গৎবাঁধা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরনো রিপোর্ট হুবহু কপি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রিপোর্টের কিছু বিষয় ইঙ্গিতবাহী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কিছু মন্তব্য, আকাক্সক্ষা রিপোর্টে লেখা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে। তৃতীয়ত, তথ্যের উৎসের ব্যাপারে পক্ষপাত। বিতর্কিত এবং অসত্য তথ্যের ওপর নির্ভর করে রিপোর্টে বেশ কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই হয়নি।
এ রিপোর্টের কিছু কিছু বিষয় গতানুগতিক এবং পুরনো রিপোর্টগুলোর অনুরূপ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে নতুন কোনো কথা নেই। বেশ কিছু স্থানে গত বছরের রিপোর্টই যেন পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। একইভাবে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে, সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার প্রসঙ্গেও মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে নতুন কিছু নেই। মানবাধিকার রিপোর্ট-২০২২ এর কিছু কিছু মন্তব্য এবং সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবাহী। ৬১ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ সংক্রান্ত মানবাধিকার রিপোর্ট শুরুই হয়েছে ২০১৮-এর নির্বাচন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। রিপোর্টের শুরুতে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশি ক্ষমতা ন্যস্ত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়। পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে মনে করেন না। এ নির্বাচনে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্ট এবং ভোটারদের হুমকিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়।’ মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট মূলত বছরওয়ারি মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ। ২০২২ সালে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তার ওপরই এ রিপোর্ট সীমাবদ্ধ থাকা সমীচীন। কিন্তু ২০২২ সালের রিপোর্টে কেন ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো? মজার ব্যাপার হলো, ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রায় হুবহু মন্তব্য করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত ২০১৮-এর মানবাধিকার প্রতিবেদনে। তাহলে চার বছর আগের প্রসঙ্গ নতুন করে উপস্থাপনের কারণ কী? ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন। গত চার বছরে দুই ডজনের বেশি মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। অর্থাৎ ২০১৮-এর নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাহলে এখন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কী? নির্বাচনের আগে সরকারকে চাপে ফেলা? আর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা তো ১৯৯১ সালেই সংবিধান সংশোধনীতে বৃদ্ধি করা হয়। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এতদিন পর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন কেন? বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত প্রস্তাবকে সমর্থনের জন্য?
রিপোর্টে একাধিক জায়গায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের আন্দোলনকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন জানানো হয়েছে। পুরো রিপোর্টে ‘অধিকার’ ‘মায়ের ডাকে’র মতো বিএনপি নিয়ন্ত্রিত সংগঠনগুলোর বক্তব্যকেই গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ৪ পৃষ্ঠায় গুম প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১৬ জনের গুমের দাবি করেছে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন। সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো দাবি করেছে জোরপূর্বক নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যক্তিরা মূলত বিরোধী দলের নেতা-কর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী।’ স্পষ্টতই এটি মায়ের ডাক পরিবেশিত তথ্য। যে ১৬ জনের কথা দাবি করা হয়েছিল তাদের প্রত্যেকেই ফিরে এসেছেন। এদের কেউ বিএনপি নেতা নন, এমনকি কর্মীও নন। ফিরে আসা অন্তত চারজন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত দুজন সেনাবাহিনীর বহিষ্কৃত কর্মকর্তা। যাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ প্রমাণিত। এরা তাদের নিজস্ব বয়ানে সেটি স্বীকারও করেছেন। মায়ের ডাকের তালিকায় একজনের নাম ছিল যিনি নিজেই পরে স্বীকার করেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে তিনি পালিয়ে গেছেন। এরকম একটি অসম্পূর্ণ এবং একপেশে প্রতিবেদন কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় তা এক বিস্ময় বটে। ‘অধিকার’ সংগঠনটির প্রধান আদিলুর রহমান খান, বিএনপিপন্থি আইনজীবী। সাবেক জাসদ নেতা আদিলুর ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতের ঢাকা তা-বের পর একটি অসত্য, বিকৃত প্রতিবেদনের জন্য তার সংগঠন সমালোচিত। ওই সময়ে হেফাজতের একাধিক ব্যক্তির নিহত হওয়ার গুজব প্রচার করে ‘অধিকার’। পরে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, রিপোর্টটি ছিল ভুয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মনগড়া। দেশে উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই অধিকার এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এহেন গুজব সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট গুরুত্ব পেয়েছে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে। ‘মায়ের ডাক’ আরেকটি বিএনপি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন একজন বিএনপি নেতার বোন। ‘মায়ের ডাক’ গুম নিয়ে যতগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার আধিকাংশই পরবর্তীতে অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন প্রতিবেদনে বিএনপির প্রতি পক্ষপাত উথলে উঠছে। কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিএনপির প্রতি প্রায় প্রকাশ্য সমর্থন জানানো হয়েছে। কোথাও কোথাও বিএনপি নেতারা মাঠে যে ভাষায় কথা বলেন, সেই একই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। রিপোর্টের ১৩ পৃষ্ঠায় বেগম জিয়ার দন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘২০১৮ সালে দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাতের মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছরের কারাদন্ড হয়। এ মামলাটি ২০০৮ সালে দায়ের করা। আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে খালেদা জিয়াকে দূরে সরিয়ে রাখতেই এ রায় দেওয়া হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞরা বলেন, খালেদা জিয়ার জামিন নিষ্পত্তিতে আদালত ধীরগতির নীতি নিয়ে চলছে।’ অথচ বাস্তবতা হলো- বেগম জিয়ার আইনজীবীরাই স্বীকার করছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার ব্যাপারে তারা ‘ধীরে চলো নীতি’ গ্রহণ করেছেন। এতিমখানা দুর্নীতি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আপিল বিভাগে হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে শুনানিতে বিএনপির আইনজীবীরা অনাগ্রহী। বিএনপি যখন বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করছে তখন তার দায় সরকারের ওপর চাপানোর উদ্দেশ্য কী? বেগম জিয়া যে দুটি মামলায় দন্ডিত হয়েছেন সে দুটোর রায় হয় দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে। তার আইনজীবীরা বারবার উচ্চ আদালতে গেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ পেয়েছেন। তারপরও যদি এ রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ হয় তাহলে ন্যায়বিচার কী?
মার্কিন প্রতিবেদনের ২১ পৃষ্ঠায় পড়লে মনে হতেই পারে এটি বোধহয় বিএনপির কোনো লিফলেট। এখানে বলা হয়েছে- ‘বিএনপির কর্মসূচি পালনে নিয়মিতভাবেই অনুমতি দেওয়া হয় না অথবা বাধা দেওয়া হয়।’ তাহলে সব বিভাগীয় শহরে বিএনপি জাঁকজমকপূর্ণ সমাবেশ করল কীভাবে? এখনো প্রতি শনিবার বিএনপি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগে পালাক্রমে সমাবেশ, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে কেমন করে? প্রতিবেদনের ৩১ পৃষ্ঠায় ৭ ডিসেম্বর বিএনপি কার্যালয়ের সামনের ঘটনা উঠে এসেছে খন্ডিতভাবে। ১০ ডিসেম্বরে বিএনপিকে যে স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সেখানে সমাবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ৭ তারিখে নয়াপল্টনে অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা করে বিএনপি। বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় ১৬ বস্তা চাল, ডাল। ব্যস্ত রাস্তায় অবস্থান নিয়ে জনজীবন অচল করে দেওয়া কি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে? অথচ এ বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। একই পৃষ্ঠায় বিএনপি মহাসচিবের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা এখনো অমীমাংসিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এ ৮৬টি মামলার ৬১টির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রাখা হয়েছে, সেই তথ্যটি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এ রিপোর্টে।
এ রিপোর্টে একটি ভয়ংকর দিক হলো আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টির ওপর আঘাতের চেষ্টা। প্রতিটি দেশেই নিজস্ব রীতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ রয়েছে। বাংলাদেশে পারিবারিক বন্ধন হাজার বছরের পুরনো। পরিবার, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, বিয়ে আমাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে গভীর করেছে। প্রাচ্যের পরিবার প্রথা, রক্ষণশীল প্রেম বিয়ে, রোমান্টিকতা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি মূল্যবোধকে এখন পশ্চিমা বিশ্ব শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ঐতিহ্যগতভাবেই এখানে সমকামিতা, সমলিঙ্গের বিয়ে ইত্যাদি বিষয়কে বিকৃতি মনে করা হয়। আমাদের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি এসবকে লালন করে না। সমকামিতা বা সমলিঙ্গের সম্পর্ককে এ দেশের প্রায় সব মানুষ বিকৃতি মনে করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়েও এটি আমাদের রুচি এবং সংস্কৃতির চেতনার সঙ্গে প্রোথিত। অথচ ৬১ পৃষ্ঠার মানবাধিকার প্রতিবেদনে অন্তত এক ডজনবার এসব পাশ্চাত্য বিকৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইন্ধন আছে। আমাদের চিরায়ত, সহজাত সামাজিক সম্পর্কের ভিতর এসব পশ্চিমা হতাশাজনিত কারণে সৃষ্ট অনৈতিক এবং রুচিহীন সম্পর্ক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। এমনকি এ প্রতিবেদনে নাস্তিকতাকে সমর্থন এবং তাদের অধিকারের প্রতিও এক ধরনের সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায়। এসব ব্যক্তি উগ্র মৌলবাদীদের মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে থাকে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। অর্থাৎ পাশ্চাত্য হতাশা, বিকৃতি এবং কুরুচি অনুপ্রবেশের এক ধরনের প্ররোচনা আছে এ প্রতিবেদনে। অন্যদিকে আবার যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায় মার্কিন প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টটি তাদের দ্বৈত ও স্ববিরোধী নীতির এক প্রকাশ।
এ প্রতিবেদনের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো জামায়াতপ্রীতি। এ সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানের বড় পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১, ২০০২ এবং ২০০৪ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে জামায়াতকে একটি উগ্র দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এবার প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে একেবারে ইউটার্ন নিয়েছে। প্রতিবেদনের ১৩ পৃষ্ঠায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিরোধী দলের সদস্যদেরই বিচারে দন্ডিত করা হয়েছে। ’৭১-এ গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সে জন্যই কি তাদের এ আর্তনাদ। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে কোনো মানদন্ডে আন্তর্জাতিক মানের। ন্যায়বিচারের প্রতিটি ধাপ যথাযথ অনুসরণ করেই এ বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্র কি তাহলে ’৭১-এর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনকে আবারও সমর্থন দিল? তারা কি ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব? এ জন্যই এত আক্রোশ?
মার্কিন প্রতিবেদনের ৩০ ও ৩১ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি যেন মাত্রা ছাড়া। এখানে বলা হয়েছে- ‘বিরোধী কর্মীরা ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত। সর্ববৃহৎ মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সংবিধানে স্বীকৃত বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত।’ রিপোর্টে ভুলভাবে বলা হয়েছে সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াত নামে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়াও এখন বন্ধ। অথচ পুরো ব্যাপারটি হয়েছে সর্বোচ্চ আদালত এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন। এ জামায়াতকে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ‘শত্রু’ মনে করত। আগের একাধিক রিপোর্টে এদের তালেবানদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত জামায়াত নারী স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পথে অন্তরায়। তাদের অধিকারের জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের এত আগ্রহ কেন? এটা কি আফগানিস্তান নাটকের পুনরাবৃত্তি? ‘কমিউনিজম’ ঠেকাতে আফগানিস্তানে তালেবানদের পেলে-পুষে বড় করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই তালেবানদের হাতেই আফগানিস্তান তুলে দিয়ে তারা পালিয়েছে। এখন বাংলাদেশে কি একই নিরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করতে চায় বিশ্ব মোড়ল? ’৭১-এ যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, সেই দেশটি আজ বিশ্বের বিস্ময়। উন্নয়নের রোল মডেল। এ কারণেই কি যুক্তরাষ্ট্রের এত রাগ, ক্ষোভ। এ উন্নয়নও তো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরেক পরাজয়। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই কি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে চায়? পুরো প্রতিবেদনটি নির্মোহভাবে পড়লে মনে হতেই পারে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা আছে। নির্বাচনকে ঘিরে একটি অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত আছে মার্কিন প্রতিবেদনে। তাহলে নির্বাচন বানচাল করে কোন ‘হামিদ কারজাই’কে ক্ষমতায় বসাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যার অনিবার্য পরিণতি হবে মৌলবাদীদের উত্থান। মার্কিন প্রতিবেদন কি তারই সংকেত?
মন্তব্য করুন
২৬ নভেম্বর ২০০৬। একই সাথে রাষ্ট্রপতি এবং তত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন ড: ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। সংবিধানের সব বিকল্প শেষ না করেই রাষ্ট্রপতির প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলো হাইকোর্টে। একই সাথে উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ ছাড়াই রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধতা এবং চুড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে নির্বাচনী তফসীল ঘোষনা না করার সিদ্ধান্ত চেয়ে তিনটি রীট মামলা দায়ের করা হলো হাইকোর্টে। তিনটি রীট আবেদনের শুনানী চললো তিনদিন ধরে। শুনানী শেষে ৩০ নভেম্বর তিনটি রীটের উপর আদেশ দেয়ার কথা। এসময় বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আর্শীবাদ পুষ্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এক নজীর বিহীন কান্ড করে বসলেন। তিনি তিনটি রীটের শুনানীর কার্যক্রম স্থগিত করে, মামলার সব নথি তলব করলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিচার বিভাগের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপের এটি ছিলো বিএনপি-জামাতের আরেকটি বাজে দৃষ্টান্ত। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল এই ‘ভয়ংকর’ কান্ড সম্পর্কে বলেছিলেন ‘আমার ২০ বছরের ওকালতি এবং ২০ বছরের বিচারক জীবনে যে মামলার শুনানী হয়ে গেছে এবং কেবল আদেশের অপেক্ষায় আছে সেখানে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ দেখিনি।” এটি প্রথম এবং একমাত্র বিচার বিভাগের কার্যক্রমে বিএনপির হস্তক্ষেপ ছিলোনা। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে ‘বিএনপির ভাবমূর্তি’ রক্ষার জন্য অন্তত ১২ বার বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল।
প্রধান বিচারপতির ঐ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির এজলাসে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। কিন্তু সেই সময় বিএনপি এবং জামাতপন্থী আইনজীবীরা সহিংস হয়ে ওঠেন। তারা শুরু করেন ভাঙ্গচুর। চড়াও হন আইনজীবীদের উপর। বাইরে থেকে ভাড়া করা লোক এনে সন্ত্রাস চালালো সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে। ভাঙ্গচুর এবং অগ্নি সংযোগ করা হয় গাড়ী এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সুপ্রীম কোর্টের এই নারকীয় তান্ডব বাংলাদেশে এক-এগারোর অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঠিক ১৭ বছর পর আবার সুপ্রীম কোর্টকে কলংকিত করলো বিএনপি-জামাত। সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে আবার তান্ডব হলো সুপ্রীম কোর্টে। ১৫ ও ১৬ মার্চ ছিলো সুপ্রীম কোর্টের নির্বাচন। ১৪ মার্চ, নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত সাবেক বিচারপতি সৈয়দ মনসুর চৌধুরী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর রাত আটটার দিকে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সমিতির কনফারেন্স কক্ষে যান বিএনপি জামাতপন্থী শতাধিক আইনজীবী। তারা ভাঙ্গচুর এবং ব্যালট পেপার ছিনতাই করে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এই আশংকায় নির্বাচনের দিন ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে। এর মধ্যেই ১৫ মার্চ সকালে বিএনপি-জামাত পন্থী আইনজীবীরা নির্বাচন বানচালের জন্য শুরু করেন আক্রমনাত্মক আচরন। তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। বিকেল ৩টার দিকে শুরু হয় সহিংসতা। গত ১৫ মার্চ আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনা ২০০৬ সালের নভেম্বরের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিলো। তাহলে কি আবার একটি এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই সুপ্রীম কোর্ট আক্রান্ত হলো?
শুধু সুপ্রীম কোর্ট কেন? এক-এগারোর কুশীলবরা ২০০৬ এবং ২০০৭ সালের শুরুতে যা যা ঘটিয়েছিল, এখন বাংলাদেশে তার পূনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়া এখন দৃশ্যমান। এক-এগারোর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। তারা বৈঠকের পর বৈঠক করতেন। রাজনৈতিক সমঝোতার আড়ালে দুপক্ষের বিরোধকে উস্্কে দিতেন। সুশীল সমাজের সাথে নিয়মিত পরামর্শ করতেন। এখন সেই একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কদিন আগেই বিএনপির নেতারা দল বেঁধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তাদের কাছে গিয়ে নালিশের সুরে বললেন ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি যাবে না।’ তাদের নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী পূণ:ব্যক্ত করলেন। কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশনেও নিয়মিত ধর্না দিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে হিতোপদেশ দিচ্ছেন প্রায় নিয়মিত। একথা সঠিক যে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক এটা সব নাগরিকের প্রত্যাশা। তারা এক উৎসব মূখর পরিবেশে ভোট দিতে চান। কিন্তু একটি দল যদি নির্বাচনে আসতে না চায় তাহলে জনগন আশাহত হওয়া ছাড়া আর কি বা করতে পারে। নির্বাচন কমিশন কি কাউকে টেনে হিঁচড়ে বা হাতে পায়ে ধরে নির্বাচনে আনতে পারে? নাকি ক্ষমতাসীন দলই বিরোধী দলকে আদর আপ্যায়ন করে ক্ষমতায় বসাতে পারে? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি দলের নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া সেই দলের একান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে ভোট বর্জন করেছিল। আবার ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে কোন শর্ত ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কাজেই বিএনপি তাদের তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী ২০১৮ সালেই পরিত্যাগ করেছে। এখন তারা কেন নতুন করে এই দাবী উত্থাপন করছে? বিএনপি কি নির্বাচন করার জন্য এই দাবী করছে, নাকি নির্বাচন বন্ধ করতে? দেশে আরেকটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার রাজনৈতিক পটভূমি সৃষ্টির জন্যই কি বিএনপির আন্দোলন? বর্তমান সময়ে এই প্রশ্ন গুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
২০০৭ সালে এক-এগারো আনার আগে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন ড: ইউনূস এবং সুশীল সমাজ। ২০০৬ সালে ড: মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরুস্কার পান। এর পরপরই তিনি শুরু করেন রাজনৈতিক দলগঠনের প্রক্রিয়া। কিন্তু এই উদ্যোগ অংকুরেই বিনষ্ট হয়। কিন্তু ড: ইউনূস এতে থেমে থাকেননি। তিনি ‘নাগরিক সংলাপে’র আড়ালে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য মাঠে নামেন। ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’ শিরোনামে এক সুশীল প্রেসক্রিপশন দেন ড: মুহম্মদ ইউনূস। মূলত: ড: ইউনূসের নেতৃত্বে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার প্রক্রিয়াই ছিলো এক-এগারোর প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু শেষ মুহুুর্তে ড: ইউনূস তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হননি। তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের লিখিত গ্রন্থ ‘শান্তির স্বপ্নে, সময়ের স্মৃতি চারন’ থেকে জানা যায়; ড: মুহম্মদ ইউনূসকে তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি স্বল্প সময়ের জন্য নয় বরং ১০ বছরের জন্য দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। এজন্যই তার পছন্দের ব্যক্তি ড: ফখরুদ্দিন আহমেদকে তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা হয়েছিল। এখন আবার আলোচনায় ড: ইউনূস। তার পক্ষে ৪০ জন বিশ্ব ব্যক্তিত্বের বিবৃতির পর এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, ড: ইউনূস হাত পা গুটিয়ে নেই। আগামী নির্বাচনে তিনি একটা ফ্যাক্টর। অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তিনি যে চেষ্টা তদ্বির শুরু করেছেন, সেটি আর গোপন নেই। এক-এগারোর সময় বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ছিলেন খুবই তৎপর। তাদের কথা-বার্তা, আর্তনাদ, আকুতি বলেই দিচ্ছিল যে, তারা তৃষ্ণার্ত। ক্ষমতায় আসতে চান। কিন্তু ভোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার সক্ষমতা তাদের ছিলো না। তাই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তারা। এখনও সুশীলদের তৎপরতা ২০০৬-০৭ সালের মতোই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন নিয়ে তাদের বেদনা যেন অন্তহীন। এখন যে সব সুশীরা গণতন্ত্র এবং সুশাসন নিয়ে কথা বলেন, এদের কেউ কেউ এক-এগারো সরকারের উপদেষ্টা, স্থায়ী প্রতিনিধি কিংবা নীতি নির্ধারক ছিলেন। তখন তারা কি করেছিলেন, যদি একটু স্মৃতির ঝাপসা হয়ে যাওয়া আয়নাটা পরিস্কার করে দেখতেন। তখন কোথায় ছিলো মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায় বিচার, আইনে শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা? এখন সেই সুশীলদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তারা দায়িত্ব না নিলে শিগ্্গীরই দেশটা রসাতলে চলে যাবে।
এক-এগারো আনতে যারা সক্রিয় ছিলেন সে সময় তারা আবারও তৎপর। একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই কি আবার সুপ্রীম কোর্টের ঘটনা? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। গত ১৩ মার্চ কাতার সফরের উপর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়। তিনি চাপে আছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন ‘কোন চাপ নেই যা শেখ হাসিনাকে দেয়া যায়’। দেশের মানুষ জানে, কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করার মানুষ শেখ হাসিনা নন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঐ সংবাদ সম্মেলনে এটাও বলেছেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ সেই ষড়যন্ত্রের আলামত দেখা যাচ্ছে। সুপ্রীম কোর্টের ঘটনা বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ড, পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা, সুশীলদের দৌড়ঝাপ সব একই সূত্রে গাঁথা। সম্মিলিত শক্তি চেষ্টা করবে নির্বাচন বানচাল করতে। তাহলেই অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পথ তৈরী হবে। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ধারা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান। বাংলাদেশে এখন যে গণতন্ত্র আছে তাতে অনেক দূর্বলতা দেখা যায়। অনেক সমস্যা, ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। কিন্তু এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও অনির্বাচিত এবং অসাংবিধানিক সরকারের চেয়ে ভালো। তাই গণতন্ত্রকে বোতল বন্দী করার নীলনক্সা রুখতে হবে। যারা এক-এগারোর মঞ্চ বানানোর কাজে আদা জল খেয়ে নেমেছেন, তাদের থামাতেই হবে। অবশ্য এক-এগারোর কুশীলব দের জন্য কাল মাক্সের একটি বাণী প্রযোজ্য। মার্ক্স বলেছিলেন ‘ইতিহাসে একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি কখনো হয় না।’ তাই মাক্সীয় সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে আরেকটি এক-এগারো হবে না। অন্তত: যতোক্ষন রাজনীতির মাঠে অতন্ত্র প্রহরীর মতো জেগে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্তব্য করুন
ভারতীয় দূতাবাসে নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিবসহ পাঁচ নেতা। বেশ কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সরকার আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে রীতিমতো তুলোধোনা করা হয়েছে। এর মাত্র দুদিন পর আওয়ামী লীগ নেতাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় মধ্যাহ্নভোজ কী বার্তা দিল? কে কাকে বশে আনল? আবার বলা হয়, বিএনপি আন্দোলনে সুবিধা করতে পারছে না ভারতের জন্য। বিএনপি নেতারাও একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন—‘ভারতই এ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে।’ কোনো কোনো নেতা তো আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার বলতেও দ্বিধা করেননি। এমন ভারতবিদ্বেষী বিএনপির ‘দেশপ্রেমিক’ নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে কী পেলেন? তারা কি ভারত জয় করলেন, নাকি ভারতের ‘পুতুল’ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?
স্বাধীনতা বিরোধী একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলাম। জামায়াতে ইসলামের রাজনৈতিক নিবন্ধন নাই। দলীয় প্রতীক নিয়ে দলটি নির্বাচন করতে পারে না। কিন্তু এবার মার্কিন প্রতিবেদনে জামায়াতের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ধারণা করা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে বসে যে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার এবং লবিং করছেন, কোটি কোটি ডলার খরচ করছেন, তার ফল ভোগ করতে শুরু করেছে জামায়াত।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক বছরের কম সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ যে 'একলা চলো' নীতি গ্রহণ করেছে এবং প্রধান টার্গেট বিএনপিকে করেছে তা ভুল রাজনৈতিক কৌশল বলে অনেকেই মনে করছে। আওয়ামী লীগের মিত্রহীন হয়ে যাওয়া বিশেষ করে সুশীল সমাজের সাথে সম্পর্কের অবনতি আওয়ামী লীগের ভুল সিদ্ধান্ত বলে কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গতিপথে পাঁচটি ভুল চিহ্নিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর এই ভুলগুলো হলো;
হেনরি কিসিঞ্জার জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি। এটি ভুল প্রচারণা।’ মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র সেদিন মানবাধিকার হরণকারী, লুণ্ঠনকারী দখলদারদের সমর্থন দিয়েছিল। সহযোগিতা করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঠেকাতে কী করেননি? কিন্তু মার্কিন সহযোগিতার পরও বীর বাঙালির কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার অদম্য স্পৃহাকে যে কেউ পরাজিত করতে পারে না তা প্রমাণিত হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। প্রবল মার্কিন বিরোধিতার পরও আমরা পাই রক্তে ভেজা পবিত্র পতাকা। আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু ’৭১-এর বিজয়ের পরও বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন টিকতে না পারে সে জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে।
শুরু করেন ভাঙ্গচুর। চড়াও হন আইনজীবীদের উপর। বাইরে থেকে ভাড়া করা লোক এনে সন্ত্রাস চালালো সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে। ভাঙ্গচুর এবং অগ্নি সংযোগ করা হয় গাড়ী এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সুপ্রীম কোর্টের এই নারকীয় তান্ডব বাংলাদেশে এক-এগারোর অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঠিক ১৭ বছর পর আবার সুপ্রীম কোর্টকে কলংকিত করলো বিএনপি-জামাত। সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে আবার তান্ডব হলো সুপ্রীম কোর্টে। ১৫ ও ১৬ মার্চ ছিলো সুপ্রীম কোর্টের নির্বাচন। ১৪ মার্চ, নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত সাবেক বিচারপতি সৈয়দ মনসুর চৌধুরী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।