নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ০৭ নভেম্বর, ২০২১
আজ ভয়াল ৭ নভেম্বর, ইতিহাসের আরো একটি কালো দিন। বাংলাদেশে বিভক্ত-বিভাজনের যে রাজনীতি, সে রাজনীতির বড় একটি বাঁক হলো সাত নভেম্বর। এদিনের ঘটনা জাতীয় রাজনীতিকে যে প্রক্রিয়ায় আক্রমণ করে ওলটপালট করে দেওয়া হয়, তার রেশ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশের রাজনীতি। তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের নামে ১৯৭৫ সালের এদিনে শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ফলে এ দিনটিকে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস বলেও পালন করে থাকেন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন পৃথক নামে দিনটি পালন করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং সমমান প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে দিনটি পালন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল দল ও সংগঠনগুলোর অনেকে দিনটিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে। আর জাসদ দিনটিকে স্মরণ করে সিপাহী-জনতা দিবস হিসেবে।
সাত নভেম্বর যা ঘটেছিল তার কোনো ভাবেই গণতান্ত্রিক ছিল না। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একটি সরকার পরিবর্তন হবে শুধুমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে, অন্য কিছুর মাধ্যমে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের ক্ষমতার পটপরিবর্তন ঘটে। গণতন্ত্রের বদলে বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসে স্বৈরাতন্ত্র। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অস্থিরতা চলছিল। সেই অস্থিরতার একটি পরিণতি ছিল সাত নভেম্বর।
সাত নভেম্বরের আগে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছিল। এবং নভেম্বরের প্রথমদিকে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে। এ সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্যু, পাল্টা ক্যু, নিয়ম, নীতি, শৃঙ্খলা, কোনো কিছুই ছিল না। কিন্তু জাসদ এই সময়ে খালেদ মোশারফের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং এই সময়ে জাসদের গণবাহিনী এবং সৈনিক সংস্থা তাদের সমর্থিত সৈনিকদের অ্যাকটিভ করে। এই সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বেই তারা জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে নেয় এবং একটিা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। স্বাধীন বাংলাদেশে ৭ নভেম্বর প্রথম প্রকাশ্যে হত্যার শিকার হন ২ জন সেক্টর কমান্ডার ও ১ জন সাব সেক্টর কমান্ডার। আর এই ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ২১ জুলাই ১৯৭৬ সালে স্বাধীন দেশে প্রথম ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন আরেকজন সেক্টর কমান্ডার। এছাড়া সেনাবাহিনীর ভেতরে ১৩ জন হত্যার শিকার হন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কোনও সেক্টর কমান্ডারকে সরাসরি কোন যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হতে হয়নি। আর তাই হত্যার নৃশংস ভয়াবহতা ৭ নভেম্বরকে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে পরিণত করেছে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা।
এ অভ্যুত্থানে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। দেশের রাজনীতিতে অস্ত্র ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার যে মধ্যযুগীয় স্বৈরাচারী নীতি, তার সূত্রপাত ঘটে ৭ নভেম্বর। দিনটি বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার দিন। বাংলাদেশে যেন এ ধরণের ঘটনা আর কখনোই না ঘটে।
মন্তব্য করুন
পবিত্র মাহে রমজান মুমিন মুসলমানের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই মাসে বর্ষিত হয় রহমতের বারিধারা। এই মাসে কিছু গুণাবলি অর্জনের দীক্ষা নেন মুমিন। যে শিক্ষাগুলো ধারণ করলে জীবন হয় আলোকিত। আল্লাহ তাআলা বরকতময় রমজান মাসকে মুসলিম উম্মাহর জন্য রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের উসিলা বানিয়েছেন। রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কিছু বিশেষ গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন- যা পরবর্তী সময়ে তার যাপিত জীবনে একটি উত্তম চরিত্রের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দান করে।
মুসলিস উম্মাহর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) ওপর কোরআন নাজিলের পবিত্র মাস রমজান। এ মাসেই মানুষের জন্য জীবন বিধান হিসেবে কোরআন নাজিল করা হয়েছে। পবিত্র রমজানে একজন রোজাদার যেসব গুনগুলো অর্জন করবেন তাই আজকের আলোচনা বিষয়বস্তু।
তাকওয়া অর্জন
রোজার প্রধান শিক্ষা তাকওয়া অবলম্বন করা। তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা ও ভয় করা। পরিভাষায়- মহান আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার ও পাপাচার হতে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলে। আর দীর্ঘ এক মাস প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বান্দাকে তাকওয়া অবলম্বন করার যোগ্যতা তৈরি করেন মহান আল্লাহ তায়ালা। সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্যও তাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা: আয়াত- ১৮৩)
মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাস রমজান
রমজানে মসজিদের সঙ্গে রোজাদারের সম্পর্ক স্থায়ী হয়। কোনো মুমিন মুসলমানের জন্য এমনটি হওয়া উচিত নয় যে, সে শুধু রমজানেই নামাজ পড়তে মসজিদে যাবে। বরং বছরজুড়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করার সম্পর্ক এই রমসজানে তৈরি হবে। যেন মুমিনের জন্য দুনিয়াতেই মসজিদ হবে জান্নাতের সর্বোত্তম নমুনা।
বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষার মাস রমজান
বরকতময় রমজান কোরআন নাজিলের মাস। মাসটি কোরআন শেখার জন্য বিশেষ সহায়ক। রমজানে কোরআনের সঙ্গে তৈরি হোক স্থায়ী সম্পর্ক। কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক যেন রমজান কেন্দ্রিক না হয়। রমজানে কোনো ইসলামিক স্কলার কিংবা কোনো ব্যক্তির উপদেশ যেন এমন না হয় যে,- ‘কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে বা না জানলে ‘কুল হুওয়াল্লাহ’ সুরা বা ‘সুরা ইখলাস’ কিংবা কোনো দোয়া-জিকিরের অজিফা দুই শত বার কিংবা চার শত বার পড়ুন!’
বরঞ্চ তাদের বক্তব্য যেন হয় এমন যে, রমজান মাস হলো কোরআন শেখার সর্বোত্তম মাস। কোরআন পড়তে না জানলে ২/৪/৬ কিবাং হাজার বার কোনো সুরা, দোয়া পড়ার তালিম নয়; বরং আউজুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ থেকে শুরু করে এক আয়াত, দুই আয়াত, একটি সুরা, দুই সুরা, এক পারা, দুই পারা- এভাবে কোরআন শেখানো বা শেখার উপদেশই সর্বোত্তম। কোরআন নাজিলের মাস রমজানেই মুমিন মুসলমানের জন্য তেলাওয়াত শেখার সর্বোত্তম সুযোগ।
নবীজী হযরত মুহাম্মদ (সা:) বলেন, কোরআন ও রোজা আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও মনের খায়েশ মিটানো থেকে বিরত রেখেছিলাম।’ কোরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। অতএব আমাদের সুপারিশ কবুল করুন।’ তখন আল্লাহ তাআলা সুপারিশ কবুল করে নিবেন (মুসনাদে আহমদ)।
সহিহ মুসলিমে আবু উমামা আল বাহিলি (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (সা:) বলেন, ‘তোমরা কোরআন পড়ো, কেননা তেলাওয়াতকারীদের জন্য কোরআন সুপারিশকারী হিসেবে আসবে’ (সহিহ মুসলিম: ৮০৪)।
সহমর্মিতা
মহানবী (সা:) রমজান মাসকে ‘সহমর্মিতার মাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। দীর্ঘদিন রোজা রাখার কারণে রোজাদারের মধ্যে দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত হয়। সহমর্মিতা জ্ঞাপন করার জন্য মহানবী (সা:) রমজান মাসে অধিক পরিমাণে দান করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা:) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজান মাসে তিনি আরও অধিক দানশীল হয়ে ওঠতেন...’ (সহি বুখারী: ৬)।
ধৈর্যধারণ
হাদিসে রমজান মাসকে ‘ধৈর্যের মাস’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। রোজাদারের সামনে সুস্বাদু খাবার থাকলেও তিনি আহার করেন না, রূপসী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সহবাস করেন না। এমনকি আচার-আচরণেও ধৈর্যধারণ করেন।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার’ (বুখারি: ১৯০৪)।
ইখলাস
রোজা এমন একটি ইবাদত, যা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই পালন করা হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে পানাহার ও যৌনাচার করার সুযোগ পরিহার করেই রোজা রাখেন একজন রোজাদার। এজন্যই হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য। কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব।’ (সহি বুখারী: ১৯০৪)।
ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব
রমজানে ধনী-গরীব, সাদা-কালো একসঙ্গে তারাবির নামাজ, একই দস্তরখানে সম্মিলিতভাবে ইফতার করা এবং জাকাত ও সদকাতুল ফিতর প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি হয়। এই ভ্রাতৃত্ববোধ মুসলমানদের প্রতি সৃষ্টিকর্তার একান্ত অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শন সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎ পথ লাভ করতে পারো।’ (সুরা আল ইমরান: ১০৩)।
নাজাত পাওয়ার মাস রমজান
রমজান মাসে দেখে দেখে পুরো কোরআন পড়ার যোগ্যতা অর্জন করার মাধ্যমে রমজানের রহমত মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার চেষ্টা করা। তাই রমজানের শুরু থেকেই কোরআন শেখার মেহনত করা জরুরি। প্রয়োজনে আরবি ২৯ হরফ শেখার মাধ্যমে তা শুরু করা যেতে পারে।
কোরআন শেখার হুকুম হচ্ছে ফরজ। বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শেখা সবার উপর ফরজ। কোরআন শেখার জন্য কোনো অজুহাত-ওজরের প্রয়োজন নেই। আর কোনো ওজর দিয়ে পার পাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। কোরআন শেখার মাধ্যমে রমজান মাসে আল্লাহর কাছে নাজাত পাওয়ার চেষ্টা করাই হবে সর্বোত্তম নেক আমল ও ইবাদত।
কোরআন শেখার কাজে শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবার জন্য সমান গুরুত্ব বহন করে। তাই সবার জন্য পুরো কোরআন তথা সুরা ফাতেহা থেকে নাস পর্যন্ত দেখে দেখে বিশুদ্ধভাবে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করা জরুরি। আর রমজানই হোক সবার জন্য কোরআন শেখার সর্বোত্তম সময়।
তবে কোনো লোক নিজে মিথ্যাবাদী। কথা ও কাজে মিথ্যা ত্যাগ করে না। কিন্তু সে কোরআন তেলাওয়াত করছে। তার কোরআন তেলওয়াত আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করবেন না। মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লানত বা অভিশাপ। আবার কোনো লোক নিজে অন্যের উপর অত্যাচারী। মানুষের উপর জুলুম করছে। হয়ত সেও কোরআন পড়ছে। তার কোরআন তেলওয়াতও আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করবেন না। অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর লানত। এভাবে কোরআন তেলাওয়াতকারী নিজেই নিজের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর কাছে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ধ্বংস প্রার্থনা করে। তাই কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি।
মুমিন মুসলমানের উচিত, রমজানে মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া, কোরআন তেলাওয়াত শেখা, নাজাত পাওয়া এবং কোরআনের লানত থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা। নিজেদের মিথ্যা ও অত্যাচার থেকে মুক্ত থাকাও জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের রোজায় মসজিদমুখী হওয়ার অভ্যাস গঠন করার তাওফিক দান করুন। বিশুদ্ধ কোরআন তেলাওয়াত শেখার সুযোগ দান করুন। কোরআনের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকতে বদগুণগুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মন্তব্য করুন
রমজান বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত ও অনুকম্পার মাস
এই রমজান। তাই এই রমজান মাসে
প্রতিটি মুসলিম উম্মাহর অত্যধিক নেক আমল ও জিকির-আজকার
করা উচিত। এবারের রমজান মাসে বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মুসলিম রোজা রাখবেন।
ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাস প্রায় ১০ দিন করে
এগিয়ে আসে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশে তীব্র গরমে রোজা শুরু হয় এবং শেষ
দিকে অনেকটা শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। সাধারণত, গ্রীষ্মকালে দিন অনেক বড় হয় এবং
শীতকালের দিকে যত এগোয়, দিনের
ব্যপ্তি তত কমতে থাকে।
যে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোজার বিধান মোতাবেক সেহেরি থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকার যে রীতি তা সময়ানুপাতে কম
বা বেশি হয়ে থাকে।
যে দেশগুলোতে সবচেয়ে
কম সময় রোজা
এবারের রমজানে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে রোজা রাখার সময় হবে সবচেয়ে কম। চিলির মুসলিমরা গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ১১ ঘণ্টা রোজা
রাখবেন অর্থাৎ পানাহার থেকে বিরত থাকবেন। এছাড়া বিশ্ব মানচিত্রের দক্ষিণের দেশগুলো, যেমন- নিউজিল্যান্ড,
আর্জেন্টিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও
রোজার সময় কম। দেশগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ১১ থেকে ১২
ঘণ্টা রোজা রাখতে হবে।
যেসব দেশে রোজার সময় সবচেয়ে দীর্ঘ
নরডিক দেশ আইসল্যান্ডে এবার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রোজা থাকবেন রোজাদাররা। দেশটিতে গড়ে প্রায় ১৬ ঘণ্টা ৫০
মিনিট রোজা রাখতে হবে তাদের। তিউনিসিয়ার মুসলিমরা রোজা রাখবেন প্রায় ১৫ ঘণ্টা। এছাড়া
মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১৩ থেকে ১৪
ঘণ্টা রোজা রাখতে হবে।
যেসব দেশে রাতই হয় না, তারা
কীভাবে রোজা রাখেন?
পৃথিবীর কিছু দেশের দিন ২০ ঘণ্টারও বেশি
সময় হয়ে থাকে। তবে ২০ ঘণ্টারও বেশি
সময় ধরে তো রোজা রাখা
সম্ভব না। তাহলে এক্ষেত্রে কী করেন তারা? ফতোয়ার
মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেসব দেশে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের ব্যবধান ৩ ঘণ্টার চেয়ে
কম, তারা অন্য কোনও শহরের ইফতার ও সেহেরির সময়
অনুসরণ করতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মক্কা শহরের সময়সূচী অনুসরণ করে রোজা পালন করে থাকেন। এমন দেশের একটি হলো গ্রিনল্যান্ড। এখানকার মুসলিমরা সৌদি আরবের মক্কার সময় অনুসরণ করে সেহেরি ও ইফতার করেন।
রোজার সময়ের কিছু ব্যতিক্রম
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা আরও অদ্ভুত হয়ে থাকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মহাকাশচারী সুলতান আল নেয়াদি রমজান
মাসে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকবেন। এমতাবস্থায় তারা ২৪ ঘণ্টায় প্রায়
১৬ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে
পাবেন। এ বিষয়ে আল
নেয়াদি বলেন, ‘আমাকে পরিব্রাজক হিসেবে গণ্য করা হবে। রোজা রাখা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।’
বাধ্যতামূলক না হলেও মক্কার
সময় অনুসরণ করে কয়েকটি রোজা রাখবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
সাধারণত, আইসল্যান্ড এবং গ্রীনল্যান্ডের মুসলমানরা প্রায় ২১ ঘন্টা রোজা রাখেন। নরওয়েতে ১৯ ঘন্টা এবং ব্রিটেনে ১৮ ঘন্টা রোজার সময়। কানাডার মুসলিমরা প্রায় ১৭ ঘন্টা পানাহার থেকে বিরত থাকবে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এবং পৃথিবীর দক্ষিণাঞ্চলে রোজার সময় ১১ ঘন্টা ৩৫ মিনিট।
এছাড়াও, ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়াতে রোজার সময় ১২ ঘন্টা থেকে ১৩ ঘন্টা। জিম্বাবুয়ের হারারেতে ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ এবং কেপ টাউন-এ ১১ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা। আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্স-এ ১২ ঘন্টা রোজার সময়। নিউজিল্যাণ্ডের ক্রাইস্টচার্চ- এ ১২ ঘন্টা, প্যারাগুয়ে এবং উরুগুয়েতে ১১ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা রোজার সময়।
(সূত্র: ট্র্যাভেল ব্লগ ওয়েগো, আল আরাবিয়া নিউজ, দ্য ন্যাশনাল)।
রোজা রমজান বিশ্ব রোজার সময় কম বেশি
মন্তব্য করুন
রমজান বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত ও অনুকম্পার মাস এই রমজান। তাই এই রমজান মাসে অত্যধিক নেক আমল ও জিকির-আজকার করা উচিত। এতে বিপুল পরিমাণে সওয়াব লাভ হবে। সেই সঙ্গে মিথ্যা কথা না বলা, অপচয় ও অপব্যয় না করা, বেশি বেশি না খাওয়া, রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত না করাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। কিন্তু আসলে রমজানে আমরা কি করছি- এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
তবে রমজান মাসের ফজিলত হাসিল করার জন্য এমন কিছু কাজ রয়েছে, যা থেকে বিরত থাকা দরকার। এখানে সে ধরনের কিছু বিষয়ের কথা ইসলামের আলোকে বিস্তারিত তুলে ধরে হচ্ছে।
বিলম্বে ইফতার করা: আল্লাহর রাসুল (সা.) দেরিতে ইফতার করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, সময় মতো দ্রুত ইফতার করলে উম্মাহ কল্যাণের ভেতর থাকবেন।
সেহেরি না খাওয়া: সেহেরি অনেক বরকতময় খাবার। রাসুল (সা.) সেহেরি খেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেহেরি খেতে না পারলে অন্তত অল্প কিছু হলেও খেয়ে নেওয়া উত্তম।
কেনা-কাটায় ব্যস্ত না থাকা: রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই রমজানের সময় যেন কোনোভাবে হেলায়-ফেলায় নষ্ট না হয়; সেদিকে সর্বাত্মক খেয়াল রাখতে হবে। অনেকে রমজানের শেষ দিনগুলোতে কেনা-কাটায় মেতে ওঠে। অথচ এমন না করা উচিত; বরং শেষ মুহূর্তের আমলে মগ্ন থাকা চাই।
মিথ্যা বলা ও অন্যান্য পাপ কাজ না করা: সত্য মুক্তি দেয় এবং মিথ্যা ধ্বংস ডেকে আনে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা মুসলমানদের কর্তব্য। এছাড়াও সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকা চাই। এটা মুমিনের প্রাত্যহিক কাজ। তবু রমজানে বেশি সতর্কতা কাম্য।
অপচয় ও অপব্যয় না করা: অপচয় কিংবা অপব্যয় করা খুবই বাজে ও গর্হিত অভ্যাস। পবিত্র কোরআনে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য স্থানে অপচয় করতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে অপচয় রোধ করতে গিয়ে কৃপণতা অবলম্বন করবে। মহান আল্লাহ কৃপণদের পছন্দ করেন না। অপচয় ত্যাগ করার অর্থ হলো মধ্যপন্থা অবলম্বন করা।
হক নষ্ট না করে কোরআন খতম করা: কোরআন তেলাওয়াতের অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছ। পবিত্র কোরআনে কারিম অর্থসহ বুঝে বুঝে খতম করা ও কিংবা তেলাওয়াত করা উত্তম। খেয়াল রাখতে হবে যে, কোরআন তেলাওয়াতের সময় যেন কোরআনের হক নষ্ট না হয়। তাড়াহুড়ো কিংবা অসুন্দরভাবে খতম করা অনুচিত।
জামাতের ফরজ আদায়ে অলসতা না করা: রমজান মাসে রোজাদাররা সব কাজকর্ম স্থগিত রেখে দূরদূরান্ত থেকে নামাজের সময় মসজিদ অভিমুখে যাত্রা করেন। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে সমবেত হয়ে জামাতে নামাজ আদায় করেন। এভাবে রোজাদার মুসল্লিরা মসজিদে নামাজ পড়তে এলে তাঁদের পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। আর এতে ২৭ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। তবে সতর্ক থাকতে হবে যেন নামাজ জামাতে আদায়ে অলসতা তৈরি না হয়।
বেশি বেশি না খাওয়া: সেহেরি ও ইফতারে কিছুতেই এমন খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়, যা পরবর্তী সময় স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। আবার এত অল্প আহারও করবে না যে রোজা রাখতে অসুবিধা হয়। কেননা স্বাস্থ্য-সচেতনতাও ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর ইবাদত করার জন্য শক্তি ও স্বাস্থ্য প্রয়োজন। তাই সুস্থ-সবল মুমিন আল্লাহর অধিক প্রিয়।
রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত না করা: রিয়া হলো- লোকদেখানো ও আত্মপ্রদর্শনকারী কাজ বা আমল। রিয়া করা শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম। শিরক হলো দুই প্রকার। শিরকে আকবার বা বড় শিরক। আর শিরকে আসগার বা ছোট শিরক। আর এ রিয়া হলো ছোট শিরক। ফলে রিয়া থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।
বেশি বেশি না ঘুমানো: অনেকের ধারণা, যত বেশি ঘুম তত বেশি শরীর ভালো থাকবে। অথচ একজন সুস্থ ও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন সাত ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। এরচেয়ে বেশি সময় ঘুমালে কিন্তু তা নানা সমস্যা ডেকে আনতে পারে। বেশি ঘুম মাথাব্যথা, পিঠে ব্যথার কারণ হতে পারে। এমনকি দেখা দিতে পারে ডায়াবেটিসের মতো অসুখও। তাছাড়া বেশি ঘুম হতে ডিপ্রেশনেরও কারণ।
পণ্যের দাম বাড়াতে সংকট তৈরি না করা: ভোক্তাদের জিম্মি করা জায়েজ নেই। কেউ তা করে ‘বিত্তশালী’ হয়ে গেলেও কোনো লাভ নেই। তার অবৈধ সম্পদ জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে। দুনিয়ার জীবনেও তার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। উপরন্তু উপার্জন হারাম হওয়ার কারণে নামাজ, রোজা, হজ, দান-সদকা কিছুই কবুল হবে না। মজুদদারি ও কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে কোটিপতি হলেও তার জন্য দারিদ্র্য অবধারিত।
অশ্লীল ছবি-নাটক ইত্যাদি না দেখা: বর্তমানে সব রকম নাটকের পূর্ণতা নারীদের ছাড়া হয় না। নারী দিয়ে নাটকগুলো সাজানো হয়। আর নারীদের ছবি দেখা স্পষ্ট হারাম। এসব নাটকের উদ্দেশ্য শিক্ষা, ইসলাম প্রচার কিংবা উপদেশ গ্রহণ নয়। বরং খেল-তামাশা ও অবৈধ আনন্দ উপভোগ করা। অতএব, এসব দেখা থেকে সব সময় বেঁচে থাকা জরুরি।
বেহুদা কাজে রাত না জাগা: রাতে দেরি করে ঘুমাতে নিষেধ করেছেন নবীজি (সা.)। রাসুল (সা.) এশার নামাজের পর গল্পগুজব ও গভীর রাত পর্যন্ত সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর তাগিদ দিতেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণজনক কাজে রাত জাগতে নিরুৎসাহিত করা হয়নি। তাই কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কারণে রাত জাগতে মানা নেই। তবে অযথা গল্প-গুজব, অহেতুক নেট ব্রাউজিং ও গুরুত্বহীন কাজে সময় নষ্ট উচিত নয়। বরং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া আবশ্যক।
দুনিয়াবী ব্যস্ততায় মগ্ন না থাকা: ইবাদতের মাস রমজানে বেশি বেশি আমলের কথা রয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকেই ব্যস্ত থাকি দুনিয়াবি কাজে। এটা কাম্য নয়। এ মাসে বেশি বেশি দোয়া-ইস্তেগফার করা উচিত। হাদিসে এসেছে, ‘ইফতারের মূহূর্তে আল্লাহ তাআলা বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়া রমজানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে।’ (জামিউস সাগির, হাদিস : ৩৯৩৩)
বিদআত না করা: ইসলামের পরিভাষায় বিদআত বলা হয়, দ্বিনের মধ্যে এমন বিষয় সৃষ্টি করা, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না; বরং পরে তা উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিদআতের বিরুদ্ধে মহানবী (সা.) অত্যন্ত কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বিদআত জাহান্নামে নিয়ে যায় বলেছেন। তাছাড়া কিয়ামতের দিন বিতআতকারী চরমভাবে লাঞ্ছিত হবে। তাই সব সময় বিদআত থেকে দূরে থাকতে হবে।
মন্তব্য করুন
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা শুরু করে তখন ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়িতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করেন। ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ - এতটা রক্তমাখা সূর্যোদয় হয়ত এদেশের মানুষ কখনো দেখেনি, কিন্তু এ এক নতুন সূর্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূর্য। হাজার বছরের সংগ্রামমুখর বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের এই দিনে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করে।
বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের মাস মার্চ। বিশ্ব মানচিত্রে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক নতুন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় এই মাসেই। এই মার্চ মাসেই বাঙালির ওপর ভয়ঙ্কর নারকীয় গণহত্যা চালায় তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী । উত্তাল এই মার্চেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র ষষ্ঠবিংশ পর্বে থাকছে ২৬ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটকের আগেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি তারবার্তা পাঠান। ইপিআরের ওয়ারলেস বার্তায় প্রচার করা হয় তার স্বাধীনতার ঘোষণা।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ডে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি, যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি ছোড়া হল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হল আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘ঘোষণায় বলা হয়, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে’।’
ওয়্যারলেস বার্তায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া করেসপনডেন্ট ডেভিড লোশাক লিখেছেন, ঘোষণাকারীর গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে দেশের সংবিধানেও।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ্যান্ডবিল আকারে ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয় ৷ আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের ইপিআর সদর দপ্তর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়্যারলেস মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন ৷ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান এদিন দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ৷
মুক্তিযুদ্ধ ও জনগণকে সংগঠিত করতে এই কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রই প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাভিত্তিক তারবার্তার আদলে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেন এম এ হান্নান, সুলতানুল আলম, বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল-ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কবি আবদুস সালাম এবং মাহমুদ হাসান ৷
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী লিখেছেন, ২৬ মার্চ সকাল ৯টায় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। এদিন অস্ট্রেলিয়ার বেতারে (এবিসি) ঢাকার গণহত্যার খবর প্রচার করা হয়। এদিকে ঢাকায় সেনানিবাসের ভেতরে আদমজী কলেজ থেকে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ সেখানে তাকে সারাদিন আটক রেখে সন্ধ্যায় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় ৷
সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলার চলমান আন্দোলনকে ‘দেশদ্রোহিতা’ আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগকে ‘নিষিদ্ধ’ করেন। রাতে গণহত্যা শুরুর পরপরই বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ শুরু করে বাঙালিরা। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও পিলখানা ইপিআরে সশস্ত্র প্রতিরোধ পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্রের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। চট্টগ্রাম ও নওগাঁ, জয়দেবপুর বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় এদিন।
এদিকে ২৫শে মার্চ রাতে শুরু করা গণহত্যা ২৬ মার্চেও চালিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ঢাকায় কারফিউ ঘোষণা করে ভবন, বস্তি, বাজারে ভারী মেশিনগান ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করা হয়। শহরের ঘনবসতির অনেক এলাকায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ও গুলি করে বাঙালিদের হত্যা করা হয়।
২৫ তারিখ রাত থেকে ২৬ তারিখ ভোর পর্যন্ত ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট, ভারী মর্টার, হালকা মেশিনগানসহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মী হত্যার এক উন্মত্ততা চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হল, সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল, সূর্যসেন হল, মহসীন হল, ফজলুল হক হল, রোকেয়া হলসহ শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে ড. জি সি দেব, ড. মুনিরুজ্জামান, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাসহ (আহত হয়ে পরে মারা যান) নয়জন শিক্ষককে ঘরে ঢুকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে চালানো হয় পৈশাচিক বর্বরতা। পরে হলের অন্তত একটি কক্ষে ছয়জন ছাত্রীর নগ্ন মরদেহ পা-বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। ওই গণহত্যায় শহীদদের বেশিরভাগের মরদেহ বিভিন্ন হল সংলগ্ন মাঠে মাটিচাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালিয়ে দেওয়া হয়। সেনারা সকালে ক্যাম্পাসে থাকা জীবিত কর্মচারীদের দিয়ে শহীদদের মৃহদেহ গর্তে ফেলতে বাধ্য করে এবং তাদেরও লাশের স্তূপের পাশে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে খুন করে।
২৫ মার্চ রাতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও হয়নি। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় তেমন ১৯৫ জনের নাম আছে; যাদের মধ্যে জগন্নাথ হলের ৬৬ জন। সেদিন ভোরে অর্থাৎ ২৬ মার্চ, পাকিস্তানিদের গুলিতে ঘরের মাঝেই প্রাণ হারান মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন দের স্ত্রী যোগমায়া, সদ্যবিবাহিত বড় ছেলে রণজিৎ ও পুত্রবধূ রীনা রানী। অসুস্থ মধুসূদন দে লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাঁচালেও ঘণ্টাখানেক পর পাকিস্তানিরা আবার ফিরে এসে তাকে ধরে নিয়ে জগন্নাথ হলের মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী, শিক্ষকদের সঙ্গে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
এদিন ভোর বেলা ৩৬ এলিফেন্ট রোডের বাসায় আগরতলা মামলার ২ নম্বর অভিযুক্ত পাকিস্তানি নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। তার মরদেহ জিপে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি।
(সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ‘৭১ এর দশমাস’, বিবিসি, ডয়চে ভেলে, তোফায়েল আহমেদ-এর সাক্ষাৎকার)।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ
মন্তব্য করুন
একাত্তরের
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ
বাঙালির ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার
নজির। ২০১৭ সাল থেকে এ দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’
হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে। একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে ঢাকায়
চালানো ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
বাঙালির মুক্তির
সংগ্রামের মাস মার্চ। বিশ্ব মানচিত্রে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক নতুন
একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় এই মাসেই। এই মার্চ মাসেই বাঙালির ওপর ভয়ঙ্কর নারকীয় গণহত্যা
চালায় তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী । উত্তাল এই মার্চেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।
‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র
পঞ্চবিংশ পর্বে থাকছে ২৫ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ।
২৬ মার্চ
প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। ২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। মুজিব-ইয়াহিয়া
আলোচনা পণ্ড হয়ে গেছে- এ খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ায় বীর বাঙালি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে নেতার নির্দেশের অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার
ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন।
আওয়ামী লীগের
পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের
জন্য সময় নির্ধারণের কথা ছিল এদিন। ইয়াহিয়ার সহযোগী জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা প্রতিশ্রুতি
দিয়েছিলেন ফোন করে জানাবেন। সারাদিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারা টেলিফোনের অপেক্ষায়,
কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি।
এদিন সকালে
প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো
প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন,
‘পরিস্থিতি সঙ্কটজনক’।
ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকের পরই জেনারেল ইয়াহিয়া গোপনে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের
সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আবদুল
হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ উচ্চপদস্থ সেনা কর্তাদের
সঙ্গে।
এদিন বেলা
১১টার দিকে একটি হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর
জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ ও মেজর জেনারেল ওমরসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন
সেনা কর্মকর্তা রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস সফর করেন। বিকাল
থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারে টহল দিতে থাকে, সব ধরনের সামরিক সংস্থার সদস্যদের
বার্তা দিতে থাকে অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে।
প্রেসিডেন্ট
জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই গোপনে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি
বিমানবন্দরে চলে যান। তিনি নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নামতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর
হয়ে ওঠে তার বাহিনী। এদিকে ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায়
বঙ্গবন্ধুর কাছে। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে উপস্থিত দলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থক,
ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে
সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে
সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী। এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ
ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’
দাবানলের
মত ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায় যে ইয়াহিয়া ‘ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে’। বাঙালি বুঝে ফেলে- কিছু একটা ঘটবে।
রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট হলেও বাঙালি প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল
২৫ মার্চ। প্রতিরোধে সম্পৃক্ত থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, কিছু একটা হতে চলেছে সে আন্দাজ
ছিল ষোলআনা। বিকাল থেকেই পথে পথে ব্যারিকেড দিয়ে বাংলার মানুষ জানান দিতে চেয়েছিল,
কোনও আক্রমণ সহজ হবে না। সমান শক্তিকে প্রতিরোধ করবে জনতা। যখন বাঙালি প্রতিরোধ শুরু
করছে, তখন প্রতিরোধের স্বর নিশ্চিহ্ন করতেই ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলার পরিকল্পনা হয়েছে।
রাত ১০টার
দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে রওনা হয়।
শহরমুখী সেনাবাহিনীর মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেইটে।
সেখানে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছিল
পথ আটকানোর জন্য। মুক্তিকামী বেপরোয়া প্রতিরোধোন্মুখ জনতার মাঝ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উঠছিল।
গুলি করে
এ প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে যায়। রাত সাড়ে ১০টা
নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে
পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারিদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে। এ আক্রমণের
সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া
হয়।
রাত সাড়ে
১১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে
পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে। ব্যারাকে অবস্থানরত
বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করে। একই সময়ে পরিকল্পনা
অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআর-এর ওপর
হামলা করে। ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু
করেন।
পিলখানা ইপিআর
ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ
সমগ্র ঢাকাতে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ; বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় রাতের অন্ধকারে
গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আওয়াজে প্রকম্পতি পুরো শহর। সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালায়।
রাত ১টার
পর পাকিস্তানের সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অনেকেই আত্মগোপনে যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু যাননি। তিনি
বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।’ মধ্যরাতেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক
৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিআরের ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ডাক
দেন।
ইংরেজিতে
ঘোষণার বক্তব্য ছিল—‘এটাই
হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।
বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানেই আছো এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার
সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত
না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ একইসঙ্গে তিনি বাংলায় যে বার্তা পাঠান সেটি হলো, ‘পাকিস্তান
সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং
শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি।’
বঙ্গবন্ধুর
গ্রেপ্তার সম্পর্কে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে সৈয়দ বদরুল আহসান রচিত ‘ফ্রম রেবেল টু
ফাউন্ডিং ফাদার’
বইকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। লেখকের বর্ণনায়, ‘কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর
একটা দল ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছাতেই সেনা সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু
করে। শেখ মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সদস্য গুলিতে মারা যান।’
বঙ্গবন্ধু
দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন ‘ফায়ারিং বন্ধ কর।’
সাংবাদিক
বি জেড খুসরু তার বই ‘মিথস অ্যান্ড ফ্যাক্টস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’- এ লিখেছেন ‘গুলি বন্ধ হওয়ার পরে
কর্নেল খান বাসায় ঢোকেন। দোতলায় যান। মুজিব একটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেখ
মুজিবকে কর্নেল নির্দেশ দেন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি জানতে চেয়েছিলেন পরিবারকে
বিদায় জানিয়ে আসতে পারেন কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে
এসেছিলেন তিনি।’
খুসরু আরও
লিখেছেন, ‘কর্নেলকে শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করেন, আসার আগে আমাকে জানানো হল না কেন? কর্নেল
উত্তর দিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী আপনাকে দেখাতে চেয়েছিল যে আপনাকে গ্রেপ্তারও করা যেতে
পারে।’
জেড এ খান
‘দা ওয়ে ইট ওয়াজ’
বইতে লিখেছেন, ‘শেখ সাহেবকে গ্রেপ্তার করার পরে ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ
পাঠিয়েছিলেন, ‘বিগ বার্ড ইন কেইজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন’।’
পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘ওই রাতে মুজিবের সঙ্গে থাকা সব পুরুষকে
আমরা গ্রেপ্তার করে এনেছিলাম। পরে চাকর বাকরদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আদমজী স্কুলে
সবাইকে ওই রাতে রাখা হয়েছিল। পরের দিন ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’
গ্রেপ্তারের
তিন দিন পরে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করে মেজর সালিক লিখেছেন,
‘পরে আমার বন্ধু মেজর বিলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম গ্রেপ্তার করার সময়েই মুজিবকে
খতম করে দিলে না কেন? বিলাল বলেছিল, জেনারেল টিক্কা খান ব্যক্তিগতভাবে ওকে বলেছিলেন
যে কোনও উপায়ে শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে হবে।’
গণহত্যার
এই রাতে সেনাবাহিনী অগ্নিসংযোগ করে দৈনিক ইত্তেফাক, পিপলস, গণবাংলা ও সংবাদ-এর কার্যালয়ে।
(সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর ‘৭১ এর দশমাস’, বিবিসি বাংলা)।
উত্তাল মার্চ দিনগুলো বাঙালি ভয়ঙ্কর অপারেশন সার্চলাইট ২৫ মার্চ ১৯৭১
মন্তব্য করুন
রোজার প্রধান শিক্ষা তাকওয়া অবলম্বন করা। তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা ও ভয় করা। পরিভাষায়- মহান আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার ও পাপাচার হতে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলে। আর দীর্ঘ এক মাস প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বান্দাকে তাকওয়া অবলম্বন করার যোগ্যতা তৈরি করেন মহান আল্লাহ তায়ালা। সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্যও তাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা: আয়াত- ১৮৩)
ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাস প্রায় ১০ দিন করে এগিয়ে আসে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশে তীব্র গরমে রোজা শুরু হয় এবং শেষ দিকে অনেকটা শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। সাধারণত, গ্রীষ্মকালে দিন অনেক বড় হয় এবং শীতকালের দিকে যত এগোয়, দিনের ব্যপ্তি তত কমতে থাকে। যে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোজার বিধান মোতাবেক সেহেরি থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকার যে রীতি তা সময়ানুপাতে কম বা বেশি হয়ে থাকে।
বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের মাস মার্চ। বিশ্ব মানচিত্রে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক নতুন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় এই মাসেই। এই মার্চ মাসেই বাঙালির ওপর ভয়ঙ্কর নারকীয় গণহত্যা চালায় তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী । উত্তাল এই মার্চেই জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। ‘উত্তাল মার্চের দিনগুলো’র পঞ্চবিংশ পর্বে থাকছে ২৫ই মার্চের ঘটনাপ্রবাহ। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। ২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা পণ্ড হয়ে গেছে- এ খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ায় বীর বাঙালি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে নেতার নির্দেশের অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন।