১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। ’৭১ সালের এই দিনে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়। সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায় এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম মন্ত্রিসভা দায়িত্ব গ্রহণ করে। বৈধ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মুজিবনগর’। ইতিহাসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ সরকারকে ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। আমার বিবেচনায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১০ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল সময়কালটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএমএ এবং এমপিরা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম নির্বাচিত হন উপরাষ্ট্রপতি। আর তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করতে তিনি এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের পর তাজউদ্দীন আহমদই তার (বঙ্গবন্ধুর) দেখানো পথে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যান। স্বাধীন বাংলাদেশকে বাস্তবতায় রূপ দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাজউদ্দীন আহমদ অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর প্রধান এ সেনাপতি ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। একসময় তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েন। অনেকের সঙ্গে আমিও একমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসতই। জাতির পিতা সেভাবেই বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে সংগঠিত করেছেন। ’৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা অনেকটাই পূরণ করেছিলেন। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ’৭১-এর পর থেকেই আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি কুচক্রী মহল বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদের তুলনা করার অর্বাচীন ও অপ্রয়োজনীয় চেষ্টা করে। ফলে, তাজউদ্দীন আহমদের কৃতিত্ব বড় করলে বঙ্গবন্ধুর অবদান খাটো করা হবে এরকম একটি ভ্রান্ত এবং বিভ্রান্তিকর ধারণা আওয়ামী লীগের মধ্যে পেয়ে বসে। এ কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে উপেক্ষিত হতে থাকেন তাজউদ্দীন আহমদ, মুজিবনগর সরকার। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার ৯ মাসে বহুমাত্রিক যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধ। মুজিবনগর সরকারে খুনি মোশতাক চক্রের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ। মুজিব বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব। এসব প্রতিকূলতা জয় করে এগোতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারকে। অনেক ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ কঠোর ছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। কোনো ছাড় দেননি। এ জন্যই বাংলাদেশ বিজয় লাভের পর তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধিতাকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে, চাটুকার এবং ষড়যন্ত্রকারীরা ঘিরে ফেলে বঙ্গবন্ধুকে। খুনি মোশতাক আর বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ছাত্রনেতারা একজোট হন তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে। তাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিপক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বানানোর ষড়যন্ত্র ক্রমেই সফল হতে থাকে। তাজউদ্দীন চাটুকারিতা করতে পারেন না। ভুল তথ্য দিয়ে নেতাকে বিভ্রান্ত করতে পারেন না। নেতাকে অপ্রিয় সৎ পরামর্শ দিতে পিছপা হন না। ফলে ধীরে ধীরে তিনি অপ্রিয় মানুষ হতে থাকেন। খুনি মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমানের মতো চাটুকার তোষামোদকারী ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর চারপাশে জাঁকিয়ে বসেন। তাজউদ্দীন সম্পর্কে এত নেতিবাচক এবং অসত্য তথ্য বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয়, একপর্যায়ে দুই নেতার সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করে। সৃষ্টি হয় দূরত্ব। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদের কাছে কখনো শুনতে চাননি ’৭১-এর ৯ মাস যুদ্ধের মেরুকরণ। কার কী ভূমিকা ছিল। বরং তাকে নানা মনগড়া কল্পকাহিনি শুনিয়েছে খুনি মোশতাক এবং ছাত্রনেতারা। অভিমানী, ব্যক্তিত্ববান তাজউদ্দীনও যেচে বঙ্গবন্ধুকে সেই সময়ের ঘটনাগুলো বলেননি। ফলে মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একপক্ষীয় খণ্ডিত বক্তব্য পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকাকালে কখনো মুজিবনগরের আম্রকাননে যাননি। তাকে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আত্মপ্রকাশের স্থানে না যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছিল। দুই নেতার দূরত্বের মধ্যেই ১৯৭৪ সালে তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন বঙ্গবন্ধু। তাজউদ্দীন উপেক্ষার শেষপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ান। রাজনীতিতে কোণঠাসা হতে হতে তিনি অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর তাজউদ্দীন গ্রেপ্তার হয় প্রমাণ করেন নেতার যোগ্য সহচরদের আসল পরিচয় দুঃসময়ে। ৩ নভেম্বর ’৭৫-এ জেলে শহীদ হয়ে তিনি প্রমাণ করেন, আদর্শবানরা কঠিন সময়ে প্রাণ দেয়, চাটুকাররা বিশ্বাসঘাতক হয়। ৭৫-পরবর্তী সময়ে জোহরা তাজউদ্দীন যদি আওয়ামী লীগের হাল না ধরতেন, তাহলে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে তাজউদ্দীনের পুনর্মূল্যায়নও হতো না। আজ তাজউদ্দীন জাতীয় চার নেতার সম্মান পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বগাথা আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন। কিন্তু আমার কাছে তাজউদ্দীন আহমদ শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতীক। সৎ মেধাবী, আদর্শের প্রশ্নে অটল নেতাকর্মীদের প্রতীক তাজউদ্দীন। যেসব রাজনীতিবিদ চাটুকারিতা আর তোষামোদ করে পদ-পদবি হাসিল করতে চান না, তারাই তাজউদ্দীন। নেতার ভালোর জন্য নেতাকে যৌক্তিক সমালোচনা এবং অপ্রিয় পরামর্শ দিতে যারা পিছপা হন না, তারাই তাজউদ্দীন। নেতার নির্দেশ বাস্তবায়নে যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে তারাই তাজউদ্দীন। রাজনীতিতে যারা ত্যাগী, পরীক্ষিত, আদর্শবান তারাই তাজউদ্দীন। কঠিন সময়ে যারা পালায় না বা রংবদল করে না, দৃঢ় প্রত্যয়ে নেতার আদর্শের জন্য লড়াই করে, তারাই তাজউদ্দীন। যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতাকর্মীরা অমূল্য সম্পদ। এরাই দলকে এগিয়ে নেয়। বিজয়ী করে। আওয়ামী লীগে সারা দেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাজউদ্দীন আহমদের মতো নিঃস্বার্থ, ত্যাগী কর্মী, নেতা। এরাই আওয়ামী লীগের প্রাণভোমরা। এদের জন্যই ’৭৫-এর পর কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আমি এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করি। দুঃসময়ে তাজউদ্দীনরাই লড়াই করে আর সুসময়ে তারা দূরে সরে যায়, উপেক্ষিত হন। অনাদরে অবহেলায় দীর্ঘশ্বাস নেন। সুসময় এলেই আওয়ামী লীগে ভিড় করে অতিথি পাখিরা, চাটুকার, সুবিধাভোগীরা। আগে এসব মতলববাজ শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রের চারপাশে ঘুরঘুর করত। এখন তৃণমূল পর্যন্ত এরা ছড়িয়ে পড়েছে। দুঃসময়ের তাজউদ্দীনরা সুসময়ে এসে নব্য মোশতাকদের কাছে ভীষণ কোণঠাসা। আওয়ামী লীগ আজকের অবস্থানে এসেছে কতগুলো কঠিন সময় পার করে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। আওয়ামী লীগে বিভক্তি, আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল গঠন। ’৯১-এর নির্বাচনে বিপর্যয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডবে নির্যাতিত আওয়ামী লীগ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ২০০৭ সালে এক-এগারো। এই প্রতিটি কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে দুটি ধারা লক্ষ করেছি। একটি ধারার নেতাকর্মীরা কঠিন সময়ে নেতার পাশে অবিচল থেকেছে। নেতার নির্দেশ পালন করেছে। আদর্শের জন্য লড়াই করেছে। নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করেও আপস করেনি। আরেকটি ধারা, কঠিন সময়ে পালিয়েছে। আদর্শ বিকিয়ে দিয়ে নেতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। নেতার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। আপস করেছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগে একটা অদ্ভুত প্রজাতি রয়েছে। এরা অনেকটা সাইবেরিয়া থেকে আসা শীতের পাখিদের মতো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই এরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে। ক্ষমতাকেন্দ্রের চারপাশ দখল করে। মধু খায়। মধুর কথায় নেতাদের বশীভূত করে। তাদের চাটুকারিতা আর ভণ্ডামিতে নেতারা সম্মোহিত হন। তখন কঠিন দিনের তাজউদ্দীনদের চেনে না নেতারা। গত ১৪ বছরে এই ‘নব্য’রাই ক্ষমতাবান হয়ে গেছে। বিভিন্ন সংকটে যারা লড়াই করেছে তারা এখন বিতাড়িত। বিভিন্ন সংকটে যারা বিভ্রান্ত ছিলেন, তারাও এখন নব্য আওয়ামী লীগারদের পেছনে চলে গেছে। এদের কেউ কেউ অবশ্য এখন নব্য আওয়ামী লীগারদের মতো বীভৎস তোষামোদির পথ বেছে নিয়েছে। ফলে ন্যায়নিষ্ঠ নেতাকর্মীরা এখন বহুদূরে। শুধু সরকারে না, তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কমিটিগুলো এখন হঠাৎ বনে যাওয়া আওয়ামী লীগারদের দখলে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত। যখনই সুবিধাবাদী, তোষামোদকারী, চাটুকাররা আওয়ামী লীগে প্রভাবশালী হয়েছে, তখনই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটি বিপর্যয়ে পড়েছে। বিপর্যয়ে অপাঙ্ক্তেয় ত্যাগীরা এসে হাল ধরেছে, চাটুকার নব্য মোশতাকরা হয় পালিয়েছে না হয় দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংকটের কথা বলছেন। ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন। নির্বাচনে আগে চক্রান্ত হবে বলে দলের নেতাকর্মীদের সতর্ক করছেন। এখনই সময়। আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করার। চাটুকারদের দূরে সরিয়ে ত্যাগী পরীক্ষিতদের সামনে আনার। নব্য মোশতাকরা যেন সরকারপ্রধানকে ঘিরে ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিত করার। ক্ষমতাকেন্দ্রে মতলববাজদের হটিয়ে যোগ্যদের আনার এই তো সময়। না হলে দেরি হয়ে যাবে। নব্য আওয়ামী লীগাররা শুধু ক্রিম খাবে। এরাই নব্য মোশতাক। আর দুঃসময়ের কাণ্ডারিরা সংকট উত্তরণে মরণপণ লড়াই করবে। যেমন করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালে। মুজিবনগর দিবসে তাই ত্যাগী, আদর্শবান, নির্ভীক নেতাকর্মীদের দিন। নব্য মোশতাক আর লুটেরাদের প্রতিহত করার দিন। আওয়ামী লীগ কি পারবে সেটা করতে?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে
বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর,
সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার
বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়?
একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে
নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির
নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ
করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন
ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল।
বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে
কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।
কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা
কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের
জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও
না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু
ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ
থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী
জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক
অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য
কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন,
‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প
চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে
একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য
বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে
মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার
পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক
দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে
সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮
সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির
সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার
নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের
দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত
নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র
ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।
যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব
দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি
রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত।
ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে
বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং
ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা
প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে
কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই
কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী।
অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।
বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের
মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য
নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে
পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর
নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন।
সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না।
জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন
চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে
বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম
আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের
মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে
অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।
বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার
অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে
তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ
বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির
মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে
সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে
খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে
উত্তর নেই।
খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক।
অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের
উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায়
না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই
হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর
ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের
মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই
আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী?
নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া
বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন,
‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো
না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির
জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর।
দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস
করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে
যাবে।
জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা
গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব
থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের
কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের
প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি
মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে।
’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ
থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে
বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা।
আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।
এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা
পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল
তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান
নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল,
তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ
উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো
মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের
মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি,
আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে
আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন
প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির
জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে
প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।
আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট
আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা।
ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী
লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন,
দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত
গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা
করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা
থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র
পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা
নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান
ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ।
বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই
বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা
দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি উপজেলা নির্বাচন শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দেয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যদি হন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী, তাহলে তো কথাই নেই। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেনশনে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। আমার জন্য ৩০ এপ্রিল ছিলো তেমন একটি দিন। কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। গত বছর ১৭ মে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বললেন, এবার কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করতে হবে ঘটা করে। তার মতে জাতিসংঘের এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের বিরাট অর্জন।
ওবায়দুল কাদের বেশ কদিন ধরে দাপটে ছিলেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করতেন এবং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর সতর্কবার্তা জারি করতেন। বিশেষ করে উপজেলা নির্বাচনে আত্মীয় স্বজনরা যেন প্রার্থী না হয় সে ব্যাপারে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন এবং যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ্যতা, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কীভাবে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন সেটির দিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ।