ইনসাইড থট

এখন চীন এবং ভারতের সময়


Thumbnail

আমি আমার মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে প্রথমে কয়েকটি বিষয় পরিস্কার করতে চাই। এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে, "সাম্রাজ্যবাদ" বোঝায় "রাষ্ট্রীয় নীতি, অনুশীলন, বা ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করা, বিশেষ করে সেই বিস্তার করা সরাসরি আঞ্চলিক অধিগ্রহণ বা অন্যান্য এলাকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ লাভের মাধ্যমে।" তদুপরি, সাম্রাজ্যবাদ "সর্বদা শক্তির ব্যবহার, সামরিক বা অর্থনৈতিক বা কিছু সূক্ষ্ম রূপের কৌশল প্রয়োগ করার সাথে জড়িত।" অন্য কথায়, সাম্রাজ্যবাদ হল একটি নিজ দেশের সীমানার বাইরের অন্য দেশের ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক সুবিধা বল পুর্বক দখলের প্রচেষ্টা বা লুটপাট করা।

তারপর আসুন দেখা যাক কেন শতাব্দী ধরে একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন বা শক্তি দ্বারা একই লক্ষ্যে প্রতিস্থাপিত হয় অন্য সাম্রাজ্যবদী তাঁর কিছু প্রধান বা মূল কারণ গুলো। বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রধান কারণ গুলো হতে পারে: ১) অতিরিক্ত সম্প্রসারণ এবং সামর্থের অতিরিক্ত সামরিক ব্যয়; ২) অর্থনৈতিক সমস্যা এবং মুদ্রাস্ফীতি, ৩) সরকারী দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা; ৪) ফলাফল সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য দুর্বল হওয়া; ৫) ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের অবক্ষয়; ৬) অন্যান্য শক্তির উত্থান।

এবার আসুন শতাব্দী ধরে কিছু সাম্রাজ্যিক শক্তির উত্থান-পতনের কথা বলা যাক।

রোমান সাম্রাজ্য: রোমান সাম্রাজ্য, একটি প্রাচীন সাম্রাজ্য যা রোম শহরকে কেন্দ্র করে বিস্তার করে। যে সাম্রাজ্য ২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান প্রজাতন্ত্রের মৃত্যুর পরে এবং ৫ম শতাব্দীতে পশ্চিমের সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত গ্রহণের পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার সর্বোচ্চ মহিমান্বিত সময়ের মধ্যে, রোমান সাম্রাজ্য আটলান্টিক মহাসাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্য শক্তির পতন শুরু হয়। রোমান সাম্রাজ্য এত বিশাল হয়ে ওঠে যে সেই বিস্তারিত বিশাল সাম্রাজ্যে শাসন করা কঠিন হয়ে পড়ে, সর্বোপরি অকার্যকর এবং অসংলগ্ন নেতৃত্ব সমস্যাটিকে আরো বড় করে তুলে। পশ্চিম রোমের ভাগ্য তৃতীয় শতাব্দীর শেষভাগে আংশিকভাবে খর্ব হয়, যখন সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান সাম্রাজ্যকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন - মিলান শহরে অবস্থিত পশ্চিম সাম্রাজ্য এবং বাইজেন্টিয়ামের পূর্ব সাম্রাজ্য, যা পরে কনস্টান্টিনোপল নামে পরিচিত। যদিও এই বিভাগটি স্বল্প মেয়াদে সাম্রাজ্যকে আরও সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য করে তুলেছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দুটি অংশ আলাদা হয়ে যায়। পূর্ব ও পশ্চিম বাইরের হুমকির মোকাবিলায় পর্যাপ্তভাবে একসঙ্গে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, এবং প্রায়ই তাদের মধ্যে সম্পদ এবং সামরিক সাহায্য বিতরন এবং অধিগ্রহণ নিয়ে বিবাদ শুরু হয়।

সাম্রাজ্যের এই বিশাল অঞ্চল শাসন ​​করার জন্য প্রয়োজনিয় একটি প্রশাসনিক এবং সময় মত সমন্বিত সরঞ্জামের/লজিস্টিক পদ্ধতি দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এমনকি তাদের চমৎকার রাস্তা ব্যবস্থা থাকা সত্তেও দ্রুত বা কার্যকরভাবে যোগাযোগ করা অসম্ভব হয়ে উঠে। রোম সাম্রাজ্যের স্থানীয় বিদ্রোহ এবং বাইরের আক্রমণ থেকে তার সীমানা রক্ষা করার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে যথেষ্ট সৈন্য এবং সম্পদের প্রয়োজন হতে থাকে। আর্থিক চাহিদা মেটাতে সাম্রাজ্যকে তাদের স্বর্ণমুদ্রায় স্বর্ণের পরিমাণ কমাতে হয়, যারফলে তাদের মুদ্রা মূল্য আর আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করে, মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয়। সাম্রাজ্যের সামরিক রক্ষণাবেক্ষণে বেশি বেশী তহবিল ব্যায় করতে বাধ্য হওয়ায়, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়ে এবং রোমের বেসামরিক অবকাঠামো ভেঙে পড়ে।

ক্রমাগত যুদ্ধ, অতিরিক্ত ব্যয় এবং দুর্নীতি সাম্রাজ্যের কোষাগারকে উল্লেখযোগ্যভাবে হালকা করে এবং নিপীড়নমূলক কর এবং মুদ্রাস্ফীতি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানকে প্রশস্ত করে। করদাতাকে এড়ানোর আশায়, ধনী শ্রেণীর অনেক সদস্য এমনকি গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে নিজেদের স্বাধীন এলাকা স্থাপন করে। রোমের অর্থনীতি এবং এর সামরিক শক্তি ঐতিহ্যগতভাবে মুলত দাসদের উপর নির্ভর ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় শতাব্দীতে যখন রাজত্ব সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায়, তখন রোমের ক্রীতদাস এবং অন্যান্য যুদ্ধের ধন সরবরাহ শুকিয়ে যেতে শুরু করে। রোমান সাম্রাজ্য তার গৌরব ও আধিপত্য হারাতে শুরু করে।

অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, ১৫৬৬-১৯২২: অটোমান সাম্রাজ্য একসময় বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ছিল। প্রথম সুলেমান, দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট তার রাজত্বকে উসমানীয় মহিমার শিখরের নিয়ে যায়। ১৫০০ এর দশকে অটোমান সাম্রাজ্য যখন তার শীর্ষে, তখন সেই সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যে একটি। নিয়ন্ত্রণ করত একটি বিস্তৃতি এলাকা, তার ঘাঁটি কেবল এশিয়া মাইনরে নয় বরং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার অনেক অংশও অন্তর্ভুক্ত ছিল। দানিউব থেকে নীল নদ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল সেই সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রন। তারা একটি শক্তিশালী সামরিক, লাভজনক বাণিজ্য, এবং স্থাপত্য থেকে শুরু করে জ্যোতির্বিদ্যা পর্যন্ত ক্ষেত্রগুলিতে চিত্তাকর্ষক সাফল্য অর্জন করে।

কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। যদিও অটোমান সাম্রাজ্য ৬০০ বছর ধরে টিকে ছিল, আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, দীর্ঘ, ধীর পতন শুরু হয়। সাম্রাজ্যের নিজের মধ্যে ধীর কিন্তু অবিচলিত দুর্বলতার লক্ষণগুলো তার পতনের সূচনা করে। পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল সুলতানদের ক্ষমতা ও ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান অভাব। তারা ১৬ এবং ১৭ শতকে সাম্রাজ্যে জর্জরিত ক্রমবর্ধমান কঠিন সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। ১৬ শতকের শেষের দিকে অর্থনৈতিক অসুবিধা শুরু হয়, যখন ডাচ এবং ব্রিটিশের সমপসারন আর আধিপত্য, মধ্যপ্রাচ্যের মধ্য দিয়ে অটোম্যানের পুরানো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ গুলি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রদেশগুলোর সমৃদ্ধি হ্রাস পায়। আমেরিকা থেকে ইউরোপে মূল্যবান ধাতুর আগমন এবং পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীনতার কারণে মুদ্রাস্ফীতির শুরু হয় আর তার কারণে অটোমান অর্থনীতি ব্যাহত এবং নষ্ট হতে শুরু করে। নিজস্ব মুদ্রা অবনমনের কারনে কোষাগার বেশি রাজস্ব হারায়, সাথে সাথে মুদ্রাস্ফীতি আরও খারাপ হতে থাকে। ফলে শাসক দ্রুত কর আরো বৃদ্ধি এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। বেতনের উপর নির্ভরশীল সবাই কম বেতন পাওয়ার কারনে, চুরি আর দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। দেশ ও সেনাবাহিনী পরিচালনার চাহিদা মেটাতে কোষাগারের আরো উপার্জনের প্রয়োজন দেখা দেয়, সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। যদিও ইতিহাসবিদরা সম্পূর্ণ একমত নন তবে এখানে কিছু কারণ উল্লেখ করা যায়: ১) মূলত খুব কৃষিপ্রধান ছিল সাম্রাজ্য; ২) জাতিগত, ভাষা, অর্থনীতি এবং ভূগোলের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যের অসাধারণ বৈচিত্র্যের কারণে এটি যথেষ্ট সমন্বিত ছিল না; ৩) এর জনসংখ্যা ছিল স্বল্প শিক্ষিত; ৪) অন্যান্য দেশ ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্রাজ্যকে দুর্বল করা; ৫) রাশিয়ার সাথে একটি ধ্বংসাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হওয়া; ৬) জার্মানিকে সমর্থন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভুল দিক বেছে নেয়া।

ইউনাইটেড নেদারল্যান্ডস প্রজাতন্ত্রের পতন: নিয়ন্ত্রিত বিদেশী অঞ্চল এবং বাণিজ্য পোস্টগুলি নিয়ে গঠিত ডাচ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য, ডাচ চার্টার্ড কোম্পানিগুলির - প্রধানত ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ডাচ পশ্চিম ভারত কোম্পানি— দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। পরবর্তীকালে ডাচ রিপাবলিক (১৫৮১-১৭৯৫), এবং ১৮১৫ সালের পর নেদারল্যান্ডসের আধুনিক রাজ্য দ্বারা পরিচালিত হয়। সাম্রাজ্য ১৭ সালে একটি বিশ্ব শক্তির অবস্থান অর্জন করে। দুই শতাব্দীতে বিকেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হল্যান্ড প্রদেশ এবং অরেঞ্জের রাজপুত্রদের মধ্যে বারবার স্থানান্তরিত হয়েছে, যারা স্ট্যাডহোল্ডার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং কেন্দ্রীয়করণের একটি বৃহত্তর মাত্রার প্রতিনিধিত্ব করেন। এই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ, ১৭ শতকে ডাচ প্রজাতন্ত্রের উচ্চতাকে বাধা দেয়নি, যা নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, ক্যারিবিয়ান এবং আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে নতুন বাণিজ্য পথের সন্ধানে, ডাচ নৌযানরা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তাসমানিয়া এবং উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলের কিছু অংশের মতো দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। ডাচরা ছিল ইউরোপের প্রথম দিকের সাম্রাজ্য, স্পেন ও পর্তুগালকে ডাচদের অনুসরণ করে। তাদের বিপুল সংখ্যক সমুদ্রগামী জাহাজের থাকার কারণে তারা ব্যবসায়িক ব্যবসায় উৎকর্ষ লাভ করে। ডাচরা ছিল সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে সফল এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও সংস্কৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য, গণিত এবং দর্শনের অর্জনগুলি এর সমৃদ্ধিতে অবদান রাখে। ডাচ প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক অফ আমস্টারডামের অর্থের মূল্যের একটি আন্তর্জাতিক পরিমাপ তৈরি করে, যার ফলে আমস্টারডাম ইউরোপের আর্থিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই "স্বর্ণযুগে" প্রজাতন্ত্র তার সম্পদের অনুপাতের বাইরে একটি বিশ্ব ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলে, আন্তর্জাতিক অর্থের কেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হয এবং একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে।

অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের ফলে ডাচ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়, যার ফলে ডাচ প্রজাতন্ত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে তার অনেক ঔপনিবেশিক সম্পত্তি এবং বাণিজ্য একচেটিয়া অধিকার হারায়। ইংল্যান্ডই প্রথম বুঝতে পেরেছিল যে ডাচ প্রজাতন্ত্র দ্রুত ইংরেজদের বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে উঠছে এবং তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে সমুদ্রপথে ডাচ বাণিজ্য আক্রমণ করাই উত্তম হবে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ বাণিজ্য প্রতিযোগিতার সাথে এবং ইংরেজ ও ডাচদের মধ্যে একটি জোট তৈরির নিষ্ফলতা তিনটি অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের কারণ হয়। ১৭৯৫ সালে ডাচ গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং ফরাসি সেনাদের আক্রমণের প্রভাবে প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে। দীর্ঘ যুদ্ধের কারনে ডাচ প্রজাতন্ত্রের নৌবহর অবহেলিত হয় এবং ডাচ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। সর্বশেষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক পলাশীর যুদ্ধে মুঘল বাংলার বিরুদ্ধে তাদের বিজয়, ইংরেজ সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটায়।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর তার পতন: ১৯তম এবং ২০ শতকের প্রথম দিকে, ব্রিটেন পৃথিবীর অনেক অংশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, এটি বিখ্যাতভাবে বলা হত যে, "ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনই সূর্য অস্ত যায় না।" তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের পর থেকে, সেই সূর্য ক্রমাগতভাবে দিগন্তের দিকে ডুবে যাচ্ছে। আজ সূর্যাস্ত সত্যিই তাদের হাতের মুঠোয়।

সবচেয়ে বিস্তৃতভাবে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ভারত থেকে ফিজি, পশ্চিম সামোয়া এবং টোঙ্গা পর্যন্ত ৫৭টি উপনিবেশ, আধিপত্য, অঞ্চল বা সুরক্ষার অংশ নিয়ে গঠিত হয়। ব্রিটিশ গবেষক স্টিফেন লুসকম্বের গণনা অনুসারে, লন্ডন থেকে, ব্রিটিশরা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ শাসন করত এবং বিশ্বের ভূমির প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকায় তাদের শাসন প্রসারিত হয়।

১৭৮৩ সালে আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে ব্রিটেন উত্তর আমেরিকায় মত তার কিছু প্রাচীন এবং সবচেয়ে জনবহুল উপনিবেশ হারায়। ব্রিটিশদের মনোযোগ তখন এশিয়া, আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে চলে যায়। নেপোলিয়নিক যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর (১৮০৩-১৮১৫) ব্রিটেন ১৯শতকের প্রধান নৌ ও সাম্রাজ্যিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় এবং তার সাম্রাজ্যের অধিকারকে প্রসারিত করে। তারা চীন এবং জাপান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলে বাণিজ্যর ছাড় অনুসরণ করে। আপেক্ষিক শান্তির সময়কাল (১৮১৫-১৯১৪) যে সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বব্যাপী আধিপত্যে পরিণত হয়।

২০ শতকের শুরুতে, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেনের অর্থনৈতিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে। ব্রিটেন এবং জার্মানির মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্তেজনা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটা প্রধান কারণ, যে যুদ্ধ কালিন সময়ে ব্রিটেন তার সাম্রাজ্যের জনশক্তি, সেনাবাহিনী এবং ধনসম্পদ উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যুদ্ধ তার সামরিক, আর্থিক এবং জনশক্তি সম্পদের উপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করে। যদিও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই তার বৃহত্তম আঞ্চলিক ব্যাপ্তি অর্জন করেছিল, কিন্তু ব্রিটেন তার বিশ্বের প্রধান শিল্প বা সামরিক শক্তির পদ হারায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটেনের উপনিবেশগুলো জাপান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায়। ব্রিটেন এবং তার মিত্রদের চূড়ান্ত বিজয় সত্ত্বেও, ব্রিটিশ প্রতিপত্তির ক্ষতি সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে। ১৯৪৫ সালে জাপান পরাজিত হওয়ার আগে পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার পিঠ ভেঙে জাপানি সেনারা ভারতের গেট এবং অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে যাওয়ার পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডনের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। দুটি বিশ্বযুদ্ধের কারনে সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত এবং আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একটি জাতীয়তাবাদী উত্থান আর ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান থেকে প্রত্যাহার ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ঘটায়। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকট বিশ্বশক্তি হিসেবে ব্রিটেনের পতন নিশ্চিত করে এবং ১ জুলাই ১৯৯৭ সালে হংকংকে চীনের কাছে হস্তান্তর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটায়। বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অবকাঠামো এবং অর্থনীতি অটুট থাকে, বরং সমৃদ্ধ হয়। ঠান্ডা মাথার যুদ্ধ (Cold War) কালে পাশ্চাত্যের প্রধান স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত যুক্তরাজ্যকে স্থানচ্যুত করে।

বর্তমানের আমেরিকান সাম্রাজ্য আর ভবিষ্যৎ: আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে আমেরিকান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মিডিয়া এবং সামরিক প্রভাব বিস্তারকে বোঝায়। এই সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন রঙ, আকৃতি এবং কর্মের সাথে ঘটছে।এই সাম্রাজ্যবাদ অন্তর্ভুক্ত আর বিস্তৃত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক বিজয়; গানবোট কূটনীতি; অসম চুক্তি; পছন্দের দল বা দেশ গুলির ভর্তুকি; শাসন পরিবর্তন; বা ব্যক্তিগত কোম্পানীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশ, বা তাদের স্বার্থগুলি হুমকির সম্মুখীন হলে সম্ভাব্যভাবে কূটনৈতিক বা জোরপূর্বক হস্তক্ষেপ করেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ২০ শতকের গোড়ার দিকে পুয়ের্তো রিকো এবং ফিলিপাইনের উপনিবেশ থেকে শুরু করে কিউবা, পানামা এবং লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলির সুরক্ষা এবং চীনের মতো উন্মুক্ত দ্বার নীতির মত বিভিন্ন রূপ নিয়েছিল। আনুষ্ঠানিক উপনিবেশগুলি মার্কিন-নিযুক্ত ঔপনিবেশিক গভর্নরদের দ্বারা শাসিত এবং মার্কিন সেনাদের দ্বারা সমর্থিত ছিল। আমেরিকা প্রোটেক্টরেট এবং বিদেশী সরকারগুলির তার তত্ত্বাবধানের খোলা দরজা নীতিগুলি মেনে চলা সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ করে। এই চলার পথে কোন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের হুমকির ক্ষেত্রে, মার্কিন মেরিনদের মোতায়েনের মাধ্যমে বিদেশে ব্যবসার সম্প্রসারণকে উন্নীত করে। মার্কিন সাম্রাজ্য-নির্মাণে এই সমস্ত সাম্রাজ্যিক রূপ, বিদেশী জাতি এবং আমেরিকা উভয়ের জন্য জটিল সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অনেক বিদেশী অঞ্চল বা দেশকে স্বাধীনতা লাভের অনুমতি দেয়। উধারন সরুপ, ফিলিপাইন (১৯৪৬), মাইক্রোনেশিয়ার ফেডারেটেড স্টেটস (১৯৮৬), মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ (১৯৮৬), এবং পালাউ (১৯৮৪)। কিছু অঞ্চল বা দেশ যেমন গুয়াম, এবং পুয়ের্তো রিকো, সমস্ত অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধা ছাড়াই মার্কিন নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। যাইহোক, স্বাধীনতা মঞ্জুর করা সেই প্রাক্তন অঞ্চল বা দেশের বেশিরভাগেই মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, কখনও কখনও যেমন জাপানের ওকিনাওয়া, স্থানীয় জনপ্রিয় মতামত না থাকা সত্ত্বেও।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সাম্রাজ্য যার বিশ্বব্যাপী ৩৬টিরও বেশি দেশে ৮০০ মত সামরিক ঘাঁটি আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প এবং কৃষি তার ব্যবহারের প্রয়োজনের বাইরে অনেক বেশী বেড়েছে। জেমস জি ব্লেইনের মতো শক্তিশালী ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বিশ্বাস করেন যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য বিদেশী বাজারগুলি বজায় রাখা এবং প্রসারিত করার জন্য আমেরিকার আরও আক্রমনাত্মক বৈদেশিক নীতি প্রচার করে অপরিহার্য।

যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শারীরিকভাবে পশ্চিম ইউরোপ জয় করতে পারেনি, তবে এটি ফরাসিদের "কোকা কোলা-উপনিবেশ" এর অভিযোগ করা থেকে বিরত করেনি। আজ পশ্চিমা দেশগুলো মার্কিন বাণিজ্য দ্বারা আচ্ছন্ন। আজ, বিশ্বের ব্যবসার মূল্য ডলার, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের অর্থের প্রধান রিজার্ভ ব্যাংক। এগুলো আমেরিকান সাম্রাজ্যকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে। তাদের আধিপত্যের, পথ, নির্দেশন বা নির্দেশ অনুসরণ করা ছাড়া ধনী বা দরিদ্র, উন্নয়নশীল বা উন্নয়নশীল দেশ, বা ইউনাইটেড নেশন এজেন্সি সহ বহুপাক্ষিক সংস্থার খুব বেশি বিকল্প নেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনী দেশে দেশে আক্রমণ, দখল সহ অবকাঠামো এবং জনগণের ব্যাপক ধ্বংস করেছে। তাদের বড় যুদ্ধগুলি সুপরিচিত: কোরিয়া, পানামা, ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান। ছোট ছোট হস্তক্ষেপের ক্রমাগত প্রবাহ আগেও ছিল, আজও আছে। ১৯৪৫ সাল থেকে, মার্কিন সশস্ত্র বাহিনী ৬৭টি দেশে ২১১ বারের বেশী সংঘাত বা সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য বিদেশে তার সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। কখনও, বা কোথাও যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আধিপত্য, স্বার্থের চ্যালেঞ্জের বা হুমকির সম্মুখীন হলে বিভিন্ন দেশে অভ্যুত্থান বা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে শাসন পরিবর্তন করেছে। আপনি চাইলে একে সাম্রাজ্যবাদ বা শান্তিরক্ষা বলতে পারেন, তবে স্পষ্টতই এটি এমন একটি দেশ নয় যে নিজের স্বার্থ রক্ষা এবং আধিপত্য বজায় রাখা ছাড়া সেই দেশ নিঃস্বার্থভাবে অন্য কিছু করেছে। বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে, অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও শক্তিশালী হচ্ছে। তারা আর হুকুম অনুসরণ না করার সাহস দেখাচ্ছ, পারস্পরিক সম্মান এবং সুবিধার সম্পর্ক দাবি করছে।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আলফ্রেড ম্যাককয় স্বীকার করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর প্রভাবশালী বিশ্বশক্তি নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে এর অংশ ছোট হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে, গ্লোবাল গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টের ( গ্লোবাল জিডিপি) মার্কিন অংশ ১৯৬০ সালের ৪০% থেকে কমে আজ ২২% নেমে এসেছে। মূলত, আমেরিকার অর্থনৈতিক ভূমিকা আগে যা ছিল এখন তার প্রায় অর্ধেক। ধারনা করা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে, চীন এগিয়ে যাবে এবং বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হবে।

একটি অসাধারণ নতুন পেন্টাগন সমীক্ষা এই উপসংহারে পৌঁছেছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার মার্কিন-সমর্থিত কাঠামো "বিপর্যস্ত" এবং এমনকি "ধ্বংস" হতে পারে, যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বিষয়ে তার "প্রাধান্য" এর অবস্থান হারাতে পারে। এই সমিক্ষা বলে যে এই নতুন "প্রাথমিকতা-পরবর্তী" পরিবেশে মার্কিন শক্তিকে রক্ষা করার জন্য তাদের প্রস্তাবিত সমাধানটি এখনও অবশ্য একই রকম: আরও নজরদারি, আরও প্রচারণা ("উপলব্ধির কৌশলগত হেরফের") এবং আরও সামরিক সম্প্রসারণবাদ বজায় রাখা। নথিটি উপসংহারে পৌঁছেছে যে বিশ্ব একটি মৌলিকভাবে পরিবর্তনের নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে মার্কিন শক্তি হ্রাস পাচ্ছে, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা উন্মোচিত হচ্ছে এবং সর্বত্র সরকারের কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।মনে করা হচ্ছে ডলারের আধিপত্য ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।

এই সময় কি চীন ও ভারতের?

স্মরণ করা যেতে পারে যে ১০০বছর আগে, ঔপনিবেশিক এবং আধা-ঔপনিবেশিক নিপীড়নের কারণে ভারত এবং চীন উভয়ই অনুন্নত ছিল। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারতের স্বাধীনতা এবং চীনের আধা-ঔপনিবেশিক অবস্থা থেকে স্বাধীনতার পরেই এই দুই দেশে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিন শুরু হয়।

নতুন সহস্রাব্দের সূচনা, চীন এবং ভারত, এশিয়ার দুটি বৃহত্তম দেশ বিরোধপূর্ণভাবে নিজেদেরকে এমন দেশ হিসাবে খুঁজে পায় যেখানে তারা পুরানো এবং নতুন উভয়ের প্রতিনিধিত্ব করছে। উভয় জাতি তাদের প্রাচীন সভ্যতার জন্য গর্বিত এবং একই সাথে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের জন্যও গর্বিত। অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রবর্তন এবং বহির্বিশ্বের জন্য অর্থনীতি উন্মুক্ত করার পর থেকে চীন উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখতে সফল হয়েছে। চীন এখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশ এবং পারমাণবিক প্রযুক্তিতে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছে। মহাকাশ ও ইলেকট্রনিক উদ্ভাবনে চীন পিছিয়ে নেই। বৈমানিক, জাহাজ নির্মাণ আর মোটর গাড়ি শিল্প অন্যদের চ্যালেঞ্জ করছে। চীন বড় আর্থিক ঋণদাতা হয়ে উঠেছে এবং ঋণ খেলাপি হওয়া থেকে কাটিয়ে উঠতে ঋণী দেশগুলোকে সাহায্য করছে। এটি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। সরকারি ব্যয় অব্যাহত রাখার জন্য আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলি চীন থেকে অর্থ ধার নিচ্ছে। চীনও সেসব দেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। চীন আজ শুধু পারমাণবিক শক্তিই নয়, তার সামরিক ও নৌ শক্তি ধীরে কিন্তু উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য তৈরি করছে। চীন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং শীঘ্রই বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে। চীনের অর্থনীতির অবস্থা আজ বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণ অনেকটা নির্ধারণ করে।

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, ভারতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মসৃণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতের অর্জনও বিস্ময়কর। গত দশকে এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার মোটামুটি বেশি ছিল। ভারত একটি বিস্তৃত শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাত উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে একটি শীর্ষস্থানীয় অবস্থান দখল করেছে। পরমাণু শক্তি, মহাকাশ এবং ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে ভারতের উন্নয়ন যথেষ্ট মাত্রায় পৌঁছেছে। তার সফ্টওয়্যার উত্পাদন বিজ্ঞাপন রপ্তানির দ্রুত বৃদ্ধির সাথে, ভারত শীঘ্রই একটি "সফ্টওয়্যার সুপার পাওয়ার" হয়ে উঠছে। ভারত আজ একটি পারমাণবিক শক্তি এবং তার সামরিক শক্তি প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হচ্ছে। ভারত নিজস্ব সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যকে পেছনে ফেলে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে ভারত। অদূর ভবিষ্যতে ভারত আরো অন্যান্য অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।

উভয় দেশের জনসংখ্যার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে যা শীঘ্রই মিলিত হয়ে ১ বিলিয়নেরও বেশি লোকে পরিণত হবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমানভাবে ক্রয় ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক শক্তির সাথে চীন আর ভারতের অর্থনীতি চলবে, টিকিয়ে রাখা যাবে। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য চীন ও ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। ধাপে ধাপে পশ্চিমা বা অতীত এবং বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সাথে তাদের ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। এই নতুন শতাব্দীতে, চীন এবং ভারত উভয়ই বিশ্বশক্তিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ ফুটবল গেমসের উদ্বোধনীতে গায়িকা সাকিরার গানটি মনে পড়ে, তিনি "এখন এটা আফ্রিকার সময় (its time for Africa)” গান গেয়েছিলেন। আমি মনে করি আমরা "এখন চীন এবং ভারতের সময় এসেছে" এই গানটিতে স্বাক্ষর করা শুরু করতে পারি। আশা করি এই দুই দেশ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে এবং একই ভুল করবে না। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা এবং দুঃসাহসিকতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সময়ের সাথে এটি সর্বদা পরাজিত হয়েছে। আরো আশা করি এই দুই দেশ তাদের মধ্যে সামরিক সম্প্রসারণ এবং যুদ্ধে অর্থ অপচয় করবে না বরং সকলের সাথে, পারস্পরিক শ্রদ্ধার সাথে, শান্তিপূর্ণ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের একটি পরিবেশের দিকে মনোনিবেশ করবে। একই সময়ে, তাদের অগ্রগতি এবং পরবর্তী বিশ্ব শক্তির যোগদানকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করার জন্য অতীতের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মৃত্যুর শেষ লাথিটি উভয় দেশই সহ্য আর বিনা দন্দ্বে পরাস্ত করতে সক্ষম হবে। উভয় দেশ তাদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একটি বহু-মেরুর বিশ্বকে উন্নীত করবে যেখানে উত্তর বা দক্ষিণ, পূর্ব বা পশ্চিমের প্রতিটি দেশ একে অপরের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করতে পারবে, তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সাহায্য করতে এবং পরস্পর লাভবান হতে পারবে। মানব উন্নয়নে অংশীদার হয়ে, এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রচারে অংশীদার হবে।

(উপরের নিবন্ধটি বিভিন্ন প্রকাশনা এবং নিবন্ধ থেকে প্রস্তুত করা। এটি শতাব্দীর পুরানো ইতিহাসের একটি খুবই সরল বর্ণনার ছোট সংস্করণ হতে পারে, কিন্তু প্রধান লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদ চিরকাল স্থায়ী হয় না তা দেখানোর একটি সাহসী বা নির্বোধ প্রচেষ্টা।)

Prof Dr Quazi Monirul Islam, MBBS, MPH, FRCOG
Epidemiology Department, Prince of Songkla University, Hat Yai, Thailand
Senior Specialist, International Centre for Migration, Health and Development
Former Senior Specialist (Maternal and Newborn), Liverpool School of Tropical Medicine, UK
Former WHO Director and Country Representative to Thailand and Namibia



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

আমার চোখে দেখা ১৭ মে, ১৯৮১


Thumbnail

আমি ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেতে এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করার প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরি। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরার পরে তখন আমি একধরনের দোটানায় ছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। যার কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল তিনি নেই। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে আছেন, তারাও দেশে নেই। আমি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমি হাসপাতালে যাই, কাজ করি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা আমার কাছে আসতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ছাত্রলীগ ও বিএমএ’র জুনিয়র ডাক্তারদের সাথেই তখন আমার সময় কাটে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর নেতৃত্বে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আমার বাসায় আসতো। তাদের সাথে কথা বলে অন্তত পক্ষে এটা মনে হতো যে, ঠিকই দেশে ফিরেছি। কিন্তু তারপরও একটা অপূর্ণতার ভাব ছিল। 

শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় এবং ১৭ মে তিনি দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন দেশের ভেতরে বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় যা শুনতাম তাতে আমার নিজের মনে হতো, তিনি বোধহয় দেশে না আসলেই ভালো হতো। কারণ, আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তখন উৎপন্ন হয়েছিল। আর এই ধারণাটি ছিল, আসার সাথে সাথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে! তাই ভাবলাম অন্তত বিদেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বেঁচে থাকুক এটাই বড় কথা। কিসের রাজনীতি, কিসের কি? বঙ্গবন্ধু নেই। সত্যিকার অর্থে বলা চলে আমি একপ্রকার রাজনীতিবিমুখ ছিলাম তখন।
 
তারপর যখন ১৭ মে আসলো তখন আমি ভাবলাম, এয়ারপোর্টে যাই। এয়ারপোর্টে আমাকে একজন বুদ্ধি দিল, একটু দূরে গাড়ি রেখে হেটে যাওয়ার জন্য। আমি তাই করলাম। তখন প্রথমদিকে খুব বেশি লোকজন নজরে পড়েনি। কিন্তু যখন বিমান নামলো এবং নেত্রী শেখ হাসিনা বিমান থেকে নামলেন তখন চতুর্দিকে হঠাৎ দেখি লক্ষ লক্ষ লোক। আমার তখন চোখ দিয়ে তখন পানি। এখনও তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের প্রতি ভালোবাসা মানুষের যায়নি। 

এর আগে আমার মনে হতো যে, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আর স্বপ্ন দেখতে যদি কেউ ভুলে যায় তাহলে সে মানুষের বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমার সত্যিকার মানসিক অবস্থা তখন এমনই স্বপ্নহীন ছিল। স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন ভালোবাসা দেখে আমার তখন মনে হলো এই বুঝি আবার জীবিত হলাম। তখনও শেখ হাসিনার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি। কারণ সেই সময় তাঁর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। 

মানুষের ভিতরে যে ভাবাবেগ তা পরদিন মানুষের সঙ্গে মিশে বুঝলাম। তখন একটা সুক্ষ্ম মিল আমি খুঁজে পেলাম। তাহলো, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসেন, তখন আমরা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জনগণ যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, আমাদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণতা পেল। ঠিক তেমনি একটা ভাব আমার মনে হল। তখন মাত্র শেখ হাসিনা এসেছেন। শুধুমাত্র তাকে দেখার ফলে জনগণের মধ্যে একটা উজ্জ্বীবিত ভাব এলো। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতারা এদের সবার ভেতরে একটি গণজোয়ারের ভাব লক্ষ্য করা গেল। 

এত বছর পরে আজ আমি বলছি, সেদিন আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এই শেখ হাসিনা নেত্রী শেখ হাসিনা হবেন, দার্শনিক শেখ হাসিনাতে রূপান্তরিত হবেন। এবং তাঁর দর্শন দ্বারা বাংলাদেশে সোনার বাংলা হিসেবে গঠন করতে পারবে। সেদিন আমার মধ্যে আবেগ ছিলোৎ কিন্তু এই চিন্তাগুলো ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে তিনি কীভাবে দেশ গড়েছে তা সমস্ত লোকই জানে। সেই ১৭ মে যে জনসাধারণ তাকে একটু দেখবার জন্য গিয়েছিল, তাদের মনের ভাষা, মুখের ভাব এসব যদি অনুভব করা যায় তাহলে বোঝা যায়, সত্যি বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে সেদিন প্রবেশ করেছিল। এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শীতা এবং দার্শনিক ভিত্তির কারণে জনগণের আশা আকাঙ্খাকে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং বাংলাদেশকে আজ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার দারপ্রান্তে। 

সেই ১৭ মে’র কথা যদি চিন্তা করি, তখন অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে এতোদূর পর্যন্ত দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবে তা চিন্তা করিনি। এখন যেমন তিনি সমস্ত বিশ্বে নন্দিত বিশ্বনেতা। সেই তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সেই ১৭ মে’র কথা আজকে মনে পড়ে। আমি প্রার্থনা করি দার্শনিক শেখ হাসিনাকে যেন সৃষ্টিকর্তা ভালো রাখেন এবং দেশ গড়ার সুযোগ যেন তিনি অনেকদিন পান।  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রত্যাবর্তনের পর সেদিন তিনি যা বলেন


Thumbnail

কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও  তিনি কাঁদছিলেন।  

প্রকৃতিও সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল।  পৌনে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতি তাঁর কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। কুর্মিটোলা থেকে তিনি যান বনানী গোরস্থানে। সেখানে যেয়ে আবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বনানী থেকে তিনি যান শেরে বাংলা নগরে। সেখানে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ জনতা অপেক্ষা করছিল। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বক্তব্য রাখেন।

কি বলেছিলেন তিনি লাখ লাখ জনতার সমাবেশে? হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া ফলাও করে এসব খবর সেদিন কোন পত্রিকা বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। ৪৩ বছর আগের সে সব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াও আজ কষ্টসাধ্য। সেদিনের ভাষণের যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।  

আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই বোন, আরো অনেক প্রিয়জন।  ভাই রাসেল, আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আমি আপনাদের কাছে এসেছি।

বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা নেতা হবার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসাবে, মেয়ে হিসাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসাবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।

আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলার মানুষের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার পরিজন হত্যা করে বলেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমানো ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কি? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দিনে দুপুরে মানুষ খুন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে।  সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না, আর একশ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে।

ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃংখলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তবে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকতো না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তববায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি; আপনাদের ভালবাসা নিয়ে, পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। আপনারা আমার সাথে শপথ করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।  

স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি।

আপনাদের ভালবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।

(তথ্যসূত্র: সংবাদপত্রে শেখ হাসিনার বক্তৃতা: ১৯৮১-১৯৮৬; প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩)


প্রত্যাবর্তন   আওয়ামী লীগ   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে জিয়ার অপতৎপরতা


Thumbnail

আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল।বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।

ওই লিফলেটে আরো লেখা ছিল: “আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তি সংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে।...তিনি আমাদের কর্ম চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।

প্রচারপত্রে আরও বলা হয়েছিল: “...ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।...আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশাজনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে প্রত্যাবর্তন। বাঙালী জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বস্তিতে ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কায় সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শঙ্কিত বোধ করছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরূদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির এক সভায় শেখ হাসিনাকে বিদেশি শক্তির তল্পিবাহক বলে অভিহিত করা হয়। একই দিনে আরেকটি সভা থেকে বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, বাকশালিরা ভারতের গোলাম। তারা বিদেশি সৈন্যের সহায়তায় ক্ষমতায় বসতে চায়। যে দলের প্রধান দিল্লিতে, সে দল জনগণের কল্যান করতে পারে না। সাতাশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুনী মুশতাক গংদের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে বলা হয়েছিল, ইন্দিরার নীলনকশা এখন বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, “৭৫ এর পর তারা দিল্লি লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচেষ্টা চালায়। লন্ডনে জমে ওঠে দিল্লির সেবাদাসদের আড্ডা। তারাই আজ বাকশালী কমিটির ছত্রচ্ছায়ায় দেশে ফিরছে। সমস্ত কিছু ঠিক করে হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।

সে সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের খবরে সে সময়কার জিয়া সরকারের ভিতরে উদ্বিগ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে গিয়েছিল ; আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান)- ওরকমভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর আর্দশের কর্মীরা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেমন একটি সময় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়াকে তৎকালীন জিয়া সরকার মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে তাইশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনকরা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালিন জাতীয় সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না

বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেনশেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।পরদিন মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনজননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জানিয়ে দেন তাঁকে যদি হত্যা করার চেষ্টাও করা হয় তাহলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন গণআকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করেশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনশেখ হাসিনা আসার আগেই তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।

দীর্ঘ 'বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলে লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে তাদের নেত্রীকে বরণ করে নেন। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকেই শহরজুড়ে কেবলি মিছিল আর মিছিল। সেদিন শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা জানাতে ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের ঢাকা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বন্দীশালা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন, সেদিনটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা।  বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।

কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান অবতরণ করবে সেদিকে নজর রেখে লক্ষাধিক মানুষ মধ্যাহ্ন থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকেই বিমানবন্দরে কোন নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। হাজার হাজার মানুষ ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে নিয়োজিত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে প্রথমে দেয়ালের উপর ওঠে। একই সময়ে বিমানবন্দর ভবনের দোতলায় কন্ট্রোল টাওয়ারের যেখানে স্থান করা সম্ভব সেখানেই জনতা উঠে যায়। সবারই উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখা। পুলিশ বারবার চেষ্টা করেও তাদের সরাতে পারে নি। বিমানবন্দরের বাইরে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

সাদা-কালো রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যখন ৪টা ৩২ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে সজ্জিত ট্রাকে নামছিলেন; তখন লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই– 'শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব', 'শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা' 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' বিমান থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত হাসিনাকে নিয়ে আসতে ট্রাকটির ১৫ মিনিট সময় লাগে। সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়। পরিবেশ উচ্ছ্বাসের, পরিবেশ আনন্দে অশ্রু ফেলার। বিমান থেকে নামার আগে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক যখন শেখ হাসিনার গলায় মালা দিচ্ছেলেন, তখন তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা আসার পথেও শেখ হাসিনা পাঁচ-ছয়বার অঝোরে কেঁদেছিলেন।

বিকেল চারটার দিকেই আকাশে কালো মেঘ ছিল। পৌনে পাঁচটায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে মিছির শুরু হবার পরপরই চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। রাত আটটা পর্যন্ত সেদিন মুষলধারে বিরতীহীন বৃষ্টি ঝরেছিল। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেইসাথে তীব্র ঝড়। প্রকৃতি ভয়াল রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। এরই মাঝে ট্রাকে রাস্তার দুপাশের জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান। বর্ষণসিক্ত শেখ হাসিনা ঝড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে যাচ্ছিলেন বনানী হয়ে শেরেবাংলানগরের সভাস্থলে। বনানী গোরস্থানে শেখ হাসিনার মা নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি কান্নায় আকুল ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কবরে শায়িত মাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, আমাকে কেন রেখে গেলে?’

কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত আট মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগার কথা খুব বেশি হলে ত্রিশ মিনিট। প্রায় তিনঘন্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরের সভাস্থলে পৌছিয়েছিলেন। তখনও চারদিক অন্ধকার, মুষলধারে বৃষ্টি। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন তখন প্রায় বিপন্ন, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সভাস্থলে তখনো লক্ষ লক্ষ লোক উপস্থিত।  শেখ হাসিনাকে তারা দেখবেনই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসম্বর্ধনা সভার মঞ্চে এলেন।

লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সমাবেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।"

বক্তৃতাদানের এক পর্যায়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, "আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।"

বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা পাথেয় করে আমি আগামীদিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করে দেবো।

১৭ মে রাতে শেখ হাসিনা ছোট ফুপুর বাসায় ছিলেন। সেই সময়েও শেখ হাসিনাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। বাধ্য হয়েই তিনি তখন কিছুদিন ছোট ফুপুর বাসায়, কিছুদিন মেঝো ফুপুর বাসায় থাকতেন। দেশে ফিরে তিনি ধানমন্ডিতে নিজেদের বাসায় গেলে সেখানে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া মিলাদ পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ধানমন্ডির বাসাটা সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যকেই বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।

১৮ মে সকালে শেখ হাসিনা দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন এবং পরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্জন করেন। ওইদনই বিকেলে তিনি পিতা শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তিনি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বাড়ির গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্রন্দনরত শেখ হাসিনাকে অনেকে সান্ত্বনা দেন। তিনি সেখানে সমাধিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের  মাজার  জিয়ারত করেন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

২০ মে গোপালগঞ্জের ঈদগাঁ ময়দানে মেখ হাসিনার সম্মানার্থে এক গণসম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল।   সেই সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংষার করছিলাম। আপনাদের ডাকে সবকিছু ছেড়ে এসেছি। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার জীবর দান করতে চাই।তিনি আরো বলেছিলেন, “গত ছয় বছরে দেশের মানুষের কোনরকম উন্নতি তো আমি দেখি নি। মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কৃষক-শ্রমিক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য পাচ্ছে না।তিনি উত্তাল জসমুদ্রের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, “তবে কেন বঙ্গবন্থু, শেখ মনি চার নেতাকে হত্যা করা হলো?”

লেখক: . আবুল হাসনাৎ মিল্টন: সভাপতি, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাৎপর্যপূর্ণ


Thumbnail

আজ ১৭ মে, প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৪৩তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে তারা খুনিদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।

পশ্চিম জার্মানি থেকে সেই সময় ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন শেখ হাসিনার স্বামী পরমানু বিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়া। ২৪ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। ২৫ আগস্ট সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লি পৌছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান।

বিমানন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। সেখানে কারো সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরিচয় না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাদের। সেই সময় ভারতীয় পত্রিকায় বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোন খবরাখবর ছাপা হচ্ছিল না। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একরকম অন্ধকারে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। দিল্লিতে পৌছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানে শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের পুরো ঘটনা জানতে পারেন।

১৯৭৯ ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে। আব্দুর রাজ্জাক কাবুলে যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং যুবনেতা আমির হোসেন আমু দিল্লিতে যান। তাদের সবার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিতে রাজি করানো।

পরবর্তী সময়ে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ১৬ ফেব্রয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ ২৪ ফেব্রæয়ারি আব্দুল মালেক উকিল, . কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ঢাকা থেকে দিল্লিতে পৌছান। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করেন তারা।

দেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে রাতে দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তখনকার রাজনীতির মতোই প্রকৃতিও সেদিন ছিল ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ছিল কালবৈশাখী হাওয়া, বেগ ছিল ঘন্টায় ৬৫ মাইল। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও সেদিন গতিরোঘ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল।

মুষলধারে বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন নেত্রী কখন আসবেন এই প্রতীক্ষায়। অবশেষে বিকাল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জনসমুদ্রের জোয়ারে এসে পৌছান শেখ হাসিনা। তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাস্তাগুলো রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে।

তখন স্বাধীনতার অমর শ্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনীতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কন্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল-পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।

আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল-সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।

তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। তিনি আরো বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত¡ থেকে বঞ্চিত হয়। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার; বঙ্গবন্ধু হত্যা জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হৃত গণতান্ত্রীক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মানবতার জননী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে; যা মোটেও সহজ কাজ নয়। এসব একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সম্ভব হচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন, দারিদ্রসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, পোশাক শিল্প, ঔষধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি পরিশ্রমের ফসল। এরই মধ্যে উদ্বোধন হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র, বহুল কাঙ্খিত পদ্মা সেতু এবং ঢাকা মেট্রোরেল। এছাড়া চলমান রয়েছে দেশের মেগা সব প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে আসুন আমরা দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যা হবে জাতির জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণের একমাত্র পথ।

১৯৮১ সালের ১৭ মে তার দুঃসাহদী সিদ্ধান্তের কারণেই আওয়ামী লীগ আজ দল হিসেবে অনেক বেশি শক্তিশালী। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত বছর সরকারপ্রধান হতে পারেননি। এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। দলটি আজ তার নেতৃত্বে সামরিক শাসনের স্মৃতি পেছনে ফেলে দেশকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। তার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে, জাতি হিসেবে বাঙালিকে এবং দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়।


শেখ হাসিনা   স্বদেশ প্রত্যাবর্তন   সমৃদ্ধ বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার তাৎপর্যময় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন


Thumbnail

১৭ মে বাঙালি জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। তবে শুধু স্মরণীয় বললে হয়ত তার তাৎপর্য ম্লান হতে বাধ্য। ১৯৮১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৬ বছর পর শেখ হাসিনা বাধ্যতামূলক নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ২০০৭ সালে ৭ মে স্বল্প-সময়ের বিদেশ বাসের পর বহু বাধা বিঘ্ন ঠেলে তিনি দেশে ফিরে আসেন; যদিও ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে না আসলে ২০০৭ সালের ৭ মে অপ্রাসঙ্গিক হতো।

এই দুটি উপলক্ষ ছাড়া বহুবার তিনি বিদেশ গিয়েছেন, আবার ফিরেছেন। তবে ঐ দুটি তারিখে তিনি দেশে না আসলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানটি মুসলিমলীগের ন্যায় হয়ত টিম টিম করে বেঁচে থাকত; যার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশ হারিয়ে যেত। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশন সম্ভব না হলেও দেশটি একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হতো। রাজাকাররা চিরস্থায়ী রাজা বাদশাহ হয়ে সবার শিরে চেপে বসত। মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হোত, মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ তিব্বতের দালাইলামার সম-অনুসারী কাঞ্চা ও কাঞ্চিতে রূপান্তরিত হতো। দেশে থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে খুন করা হতো। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকতনা। ক্রমশ: প্রতিটি মানুষ ইসলামাবাদের গোলামে পরিনত হতো, ধর্মের ধ্বজাধারীগণ দেশটা কে চষে বেড়াত, বাংলাভাষা ও জাতি বিলুপ্তির পথে যেত।

দেশে প্রত্যাবর্তনের পর দীর্ঘ সময় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন না। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের উপর এতটা চাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষরা সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন এনে দেশটাকে ইসলামী রিপাবলিকের দিকে ঠেলে দিতে পারেনি। তিনি ফিরে না এলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে যেত। আমাদের দেশটা হতো একান্তই সাম্প্রদায়িক দেশ।

শেখ হাসিনা ফিরে না আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান শান্তিটুকুও প্রতিষ্ঠিত হোত না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন হওয়া ছিল অকল্পনীয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা হোত দা-কুড়ালের। আজকে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমরা ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছি। বিশ্বের বুকে একটা মর্যাদাবান জাতি হিসাবে আবির্ভূত হবার কিংবা মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের দিন গনিয়ে আসত না।

আবারও বলছি শেখ হাসিনা দেশে না ফিরলে আওয়ামী লীগের ভাগ্য হোত মুসলিম লীগের ভাগ্য। আর অন্যান্য সব কিছুর আকর হোত এই ক্ষমতাহীনতা। বিষয়টা একটু বিশ্লেষণ করছি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সব রাজনৈতিক দল বিলোপ করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালের ১ আগষ্ট থেকে দেশে ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়। সেই আগষ্টে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনে প্রয়াস নেয়া হয় এবং সাথে শুরু হয় দলীয় উচ্চাসন নিয়ে কামড়া কামড়ি। দলের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই জেলে। সে সময় প্রয়োজন ছিল ঐক্যের কিন্তু তখনই দলের শীর্ষ পদ দখলের উলঙ্গ প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়। মোল্লা জালাল ও মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত আহ্বায়ক কমিটি আপোষকামিতা ও তৃণ মূলে অগ্রহণযোগ্যতার কারণে তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ১৯৭৭ সালের ৩রা এপ্রিলের কাউন্সিল অধিবেশনে তদ্রুপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলেও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে একটা দায় সারা গোছের কমিটি করা হয়। তিনি এক বছরও নেতৃত্বে থাকতে পারেন নি। ১৯৭৮ সালের ৩রা মার্চ পূর্বের ন্যায় নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতে মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পুনরায় কাউন্সিলে পূর্ববত অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এবারেও যখন জোড়াতালি দিয়ে কমিটি গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে ও দল ছিন্ন ভিন্ন হবার উপক্রম হয় তখন সাধারণ কর্মীরা শেখ হাসিনার নামে শ্লোগান দিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনাকে দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করে। সেদিন তাকে সভাপতি নির্বাচিত না করলে দল বহুধা বিভক্ত হোত, কেউ মিজান আওয়ামীলীগ, কেউ বাকশাল কিংবা কেউ বা বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে ও তার উত্তরাধিকারীত্ব দাবী করে বহু নামের আওয়ামী লীগ গঠন করে দালালী বলবত রেখে আত্ম—তরক্কি করতে পারত। সেনা আশ্রিত দলে পরোক্ষভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে আশ্্রয় নিতে নিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি নি:শেষ হয়ে যেত। দেশটাতে এমন সেনাশাসন চিরায়ত হয়ে যেত।

শেখ হাসিনা দেশে আসার কারণে তার দল অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পাঁচ পাঁচবার ক্ষমতায় এসেছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্প্রসারিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসায় যারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে উল্লাসিত হয়েছিল তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস—চ্যান্সেলর, প্রো—ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার হয়েছে, ব্যাংক বীমার চেয়ারম্যান, ডাইরেক্টর হয়েছে, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হয়েছে। আরও কত কি? ব্যক্তির পর্যায় ছাড়িয়ে সামষ্ঠিক পর্যায়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি নব মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে।


বিষয়গুলোর একটু গভীরে যাচ্ছি:

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার:

নির্বাসিত জীবন থেকে দলীয় নেতাদের বিশেষ অনুরোধে ও কর্তব্যবোধে তাড়িত হয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এলেন। দেশে ফেরার দিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি ছিল। দুর্যোগ উপেক্ষা করেও বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষ তাদের মহান নেতার কন্যাকে দেখতে ও স্বাগত জানাতে ভীড় জমালেন। দেশে ফিরে আসার আগেই তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।

দেশে প্রত্যাবর্তনের ৬ বছরের মাথায় অর্থর্াৎ ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মত নির্বাচিত হলেন ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে বসলেন। জনস্বার্থ বিবেচনা করে তিনি ১৯৮৮ সালে পদত্যাগও করেন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করা হয়, তিনি সেই জোটের প্রধান ছিলেন। এরশাদ শাসনামলে তিনি বেশ কয়েকবার গৃহবন্দি ছিলেন। শারীরিক আক্রমণের শিকারও হয়েছিলেন। তবুও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনিই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯০ সালে ১৫ দলের নেত্রী শেখ হাসিনার প্রচণ্ড গণআন্দোলনে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তার জনপ্রিয়তা ও অনমনীয়তার কারণে সবাই ধরে নিয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী হবেন। শতাংশের হারে বেশি ভোট পেয়েও সুক্ষ্ণ কারচুপির কারণে তিনি বিএনপি অপেক্ষা কম সিট পেলেন; যে কারণে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর আকর্ষণীয় পদটি থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। জাতি বঞ্চিত হল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নেতৃত্ব থেকে এবং তার মূল্যও জাতিকে দিতে হলো বহুভাবে। তারপর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন।

জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবার পর শেখ হাসিনা জনমঙ্গল নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অংশ হিসাবে সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত ও পুনর্গঠিত করেন। এ’সব কমিটিতে মন্ত্রীর পরিবর্তে কোন সাংসদকেই চেয়ারম্যান করা হয়ে থাকে।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রশাসন ও নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ফলে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ হ্রাস পেয়েছে ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার:

শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে না আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়—মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হতো। বিচারের প্রক্রিয়াটি ১৯৯১ সালে পুনরায় শুরু হয়। ঘাতক দালাল নিমূর্ল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহবায়িকা ও সদস্য—সচিব নির্বাচনে শেখ হাসিনার সক্রিয় সমর্থন ছিল। আন্দোলনে শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ প্রধান শরিক সংগঠন হিসেবে যোগ দেয়। আন্দোলনকারী শক্তিসমূহ বিশেষতঃ বুদ্ধিজীবীগণ অফুরন্ত অনুপ্রেরণা লাভ করে। শেখ হাসিনা না থাকলে জামায়াতের ন্যায় ক্যাডার ভিত্তিক সশস্ত্র ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই কঠিন ছিল। ১৯৯২ সালেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০১ জন সংসদ সদস্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তা স্পীকারের কাছে পেশ করেন। তার আন্দোলনের ফলশ্রম্নতিতে গণ আদালতের ২৪ জন তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহীর মুক্তি এবং গোলাম আজমের বিচার সহ ৪ দফা প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয়।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি অনতি বিলম্বে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচারের সকল সাংবিধানিক বাধা দূর করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে একে একে অভিযুক্তদের বিচার শুরু করেন। আজ পর্যন্ত ১০ জন শীর্ষ মানবতা বিরোধীসহ অনেকের বিচার কাজ একাধিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল প্রায় সকলকেই আদালত মৃত্যু দন্ডাদেশ দিয়েছে, কেউ কেউ কারাবন্ধি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি:

তাঁর প্রথমবারের সরকারের বিশাল অর্জন হচ্ছে ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তি এবং সন্তুলারমার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন। এ’গুলো ছিল অনেক পুরানো সমস্যা। পানি সমস্যা পাকিস্তান আমলের আর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রায় ২৪ বছরের পুরানো ছিল। আত্নঘাতি ও ভ্রাতৃঘাতি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছে; স্বাধীনতা—সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছিল এবং বহির্বিশ্বে মানবিক ও অসা¤প্রদায়িক বাঙালির ভাবমূর্তিকে চুরমার করে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সংকট সৃষ্টি করেছিল। শেখ হাসিনা তার কৌশলী নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে এই অঞ্চলকে দেশের মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্তকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। গঙ্গার পানি চুক্তি ও পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্তসহ প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্কের ভিত্তি রচিত হয়েছে। শান্তি চুক্তির পাশাপাশি ছিটমহল সমস্যা ও সমুদ্র সীমা সমস্যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও দেশের আয়তন বৃদ্ধি করেছে। আমরা ব্লূ—ইকোনোমির স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পেয়েছি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার:

তার আমলের অপর একটি অর্জন হচ্ছে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল যা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের পথ সুগম করেছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ঘাতকদের বিচার না করে প্রচলিত আদালতেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু ২০০২ সালে বি এন পি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এই বিচারের রায় কার্যকরী না করলেও শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে তা কার্যকরী করেন। জাতির প্রত্যাশা মোতাবেক শেখ হাসিনা বিশেষ আদালতে নিষ্পত্তি না করে প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে বিচার কার্য শেষ করে দূরদর্শিতা নয়, রাষ্ট্র নায়ক সুলভ আচরণের প্রমাণ আরও একবার রাখলেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না আসলে দেশটা হতো মিনি পাকিস্তান। ভাষা—সংস্কৃতি যেত তলিয়ে। শুধু ভাষা সংস্কৃতি রক্ষা নয়, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে জাতিসংঘের ঘোষণা আদায়ও তাঁর অনন্য কৃতিত্ব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা তার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল কিন্তু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার কারণে তার পূর্ণাঙ্গতা দেয়া সম্ভব হয়নি।

দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও সোহ্রাওয়াদীর্ উদ্যানে স্বাধীনতা স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে। বাঙালির মনন বাংলা একাডেমির কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়াও আত্মিক পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রথম বারের জন্যে বাংলা একাডেমির জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়েছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন:

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা ধরে কাজ শুরু করেছিল। বিশ্বকে পেছনে ফেলে সহস্রাব্দ উন্নয়নের সবক’টি লক্ষ্য মাত্রা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাংলাদেশ অর্জন করেছে। ম্যাক্রো —মাইক্রো অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় অনন্য দক্ষতা দিয়ে তিনি প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রেখেছেন। নিম্নের সারনীতে অর্থনৈতিক চাল—চিত্রের সামান্য পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে ঃ

শিরোনাম

2005-06

2017-18

2022-2023

২০২৪ এর প্রস্তাবিত লক্ষ্যমাত্রা

জিডিপি প্রবৃদ্ধি

5.40%

7.86%

7.50%

7.97%

মাথাপিছু আয় (মার্কিন ডলারে)

427.00

1751.00

2793

2750.00

জাতীয় সঞ্চয় (জিডিপির শতাংশে)

27.70

29.00

31.00

37.00

বিনিয়োগ (জিডিপির শতাংশে)

24.70

30.50

32.00

37.00

বাজেট (কোটি টাকায়)

64,683.00

4,64,000.00

-

10,00,000.00

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

3.88

34.00

35.00

50.00

রপ্তানী আয় (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

10.05

36.60

55.56

72.00

আমদানি (বিলিয়ন মার্কিন ডলারে)

14.70

56.00

-

110.00

দরিদ্র জনংখ্যা (শতকরা হারে)

41.51

21.50

18.13

12.30

অতি দরিদ্র জনসংখ্যা (শতকরা হারে)

25.10

11.30

5.6

4.50

বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা (মেগাওয়াটে)

3,782.00

20,400.00

27500.00

28,000.00

 

সামাজিক নিরাপত্তার জাল বিস্তার:

দুঃস্থ মানুষের মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দিতে তার সরকার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও বহু নির্মাণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। একটি বাড়ি, একটি খামার এক অনন্য কর্মসূচি। বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্যে কর্মসংস্থান ব্যাংক তাদের লেনদেন কাজ শুরু করেছে। বন্যা ও বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্ম অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করে শেখ হাসিনা দেশি ও বিদেশিদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার প্রথম শাসনামলে যেখানে বিদেশি পত্রিকার পূর্বাভাস ছিল যে আকস্মিক বন্যায় দু’কোটি মানুষ মারা যাবে, সেখানে মালের ক্ষতি মাত্রাতিরিক্ত হলেও মানুষ মরেছে ২ হাজারেরও অনেক কম, তাও কয়জন না খেয়ে মরেছে সে তথ্য বিরোধী পক্ষও উপস্থাপন করতে পারেনি। তিনি দেশে না এলে কি এমনটি হতো?

সামাজিক মঙ্গল:

তাঁর শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে তা পূর্বে কোন আমলে এমনটি হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বব্যাপী দুর্যোগ ও দুর্ভোগ, স্বদেশের হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, জ্বালাও—পোড়াও এর মধ্যেও উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, মানুষের গড় আয়ু ৭৩ —এ ছুঁই ছুঁই করছে, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে প্রতিবেশী ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে, সুপেয় পানীয় জল সরবরাহে ঈর্ষান্বিত সফলতা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যে ভেজাল নিরোধ প্রয়াস ও চিকিৎসা ব্যবস্থা জনগণের দোর গোড়ায় পৌঁছিয়ে দেয়ার কারণে এমনটি অর্জন করেছে। তেমনি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে অন্যান্য ক্ষেত্রে, যার মাঝে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী বাহিনী প্রেরণ অন্যতম।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা:

শেখ হাসিনার প্রথমামলের সরকার ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছিল। সেই কবে ম্যালথাস নামক একজন ধর্মযাজক বলেছিলেন যে, ‘জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে আর খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে’। আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলাম স্কুল জীবনে এবং এক জাতীয় হতাশা ও নৈরাশ্য আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমার ছেলে বেলায় বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটির মত; আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল এখন যা আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি। তখন জন্মের হার ছিল বেশি, শিশু মৃত্যুর হার ছিল বেশী, ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ছিল অনেক কম। বর্তমানে জনসংখ্যা বেড়েছে সেদিনের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ। আবাদী জমির পরিমাণ বিবিধ কারণে অন্ততঃ এক—তৃতীয়াংশ কমেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ৪০ লক্ষ টন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দুটো বন্যা হয়েছে।

পরবর্তীতে দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি উত্তর বঙ্গের মঙ্গা বিতারণ কর্মসূচিকে বেগবান করা হয়। বর্তমানে মঙ্গা ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে পাটের জীবন—বৃত্তান্ত উৎঘাটিত হয়েছে। বিভিন্ন রকমের উচ্চ ফলনশীল ও দ্রুত ফলনশীল খাদ্যের উদ্ভাবন ঘটিয়ে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। একটি বাড়ী — একটি খামার কর্মসূচির পূর্ণসূচনার কারণে এবং ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বন্টন কর্মসূচি খাদ্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। 

ডিজিটাল বাংলাদেশ:

কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ উপহার দেবেন কিন্তু ২০১৩ সালের মধ্যে সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সব জেলায় ই—সার্ভিস সেন্টার চালু হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল স্বাস্থ্য—সেবা, ই—কমার্স ও ই—গভর্নেন্স উল্লেখযোগ্য হারে চালু হয়েছে। তিন কোটি ৮৬ লাখ মানুষ ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছে। আর মোবাইলে থ্রি—জি সেবা চালু করা হয়েছে। এখন আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ; যার রূপায়ন ক্রমশ: দৃশ্যমান হচ্ছে।

শেষ কথা:

শেখ হাসিনা আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। তিনি দেশে ফিরে না এলে তার তেমন কোন ক্ষতি ছিল না। দেশে না ফিরলে তার ব্যক্তি জীবন ও সন্তানদের জীবন মোটামুটি সচ্ছলভাবে চলে যেত। দেশে ফিরে এসে তিনি নিজের জীবন ও সন্তানদের জীবনকে সংকটাপন্ন করেছেন। সংকটাপন্ন করেছেন বোনের জীবন। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এমন নেতা আছেন কিনা যিনি ২৩ বার হামলার শিকার হয়েও বেঁচে আছেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আল্লাহতায়ালা বঙ্গবন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের গোলামী জিঞ্জির ভাঙার জন্যে আর শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশকে কোন উচ্চতর মাত্রায় পৌছে দিতে।

 

লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন