ইনসাইড থট

আগস্ট ট্রাজেডি: অলৌকিক ভাবে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা

প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ১৭ অগাস্ট, ২০২৩


Thumbnail

কিছুটা জেদ করেই শেখ হাসিনা পশ্চিম জার্মানিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই সিদ্ধান্তই তাঁর ও শেখ রেহানার প্রাণ রক্ষা করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু কার্লসরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টহাউসে অবস্থানরত তাঁর জামাতা ওয়াজেদ মিয়াকে ফোন করেন। তিনি ওয়াজেদ মিয়াকে জানান, ওই মাসের শেষের দিকে রেহানা ও নিজের দুই ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে হাসিনা জার্মানি যাবে। ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ‘কয়েক মাস পর আমি দেশে ফিরতে পারি। হাসিনার অত টাকাপয়সা খরচ করে জার্মানি আসা ঠিক হবে না। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমার ছেলে জয়কে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। ও সারাক্ষণ তোমার কথা বলে, তোমার খোঁজ করে এবং তোমার কাছে যেতে চায়। কথাগুলো বলে বঙ্গবন্ধু ফোনটা শেখ হাসিনাকে দেন। শেখ হাসিনাকেও ওয়াজেদ মিয়া একই কথা বলেন। শেখ হাসিনা তখন ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, ‘তুমি যতই আপত্তি করো না কেন, আমি জার্মানি চলে আসবই।

জার্মানিতে গবেষণাকাজে ওয়াজেদ মিয়ার তখন প্রায় সাড়ে তিন মাস পার হয়েছে। প্রবাসে স্ত্রী শেখ হাসিনা ও দুই ছেলেমেয়ে জয় আর পুতুলকে দেখার আকুতি থাকলেও শুধু খরচের বিষয় চিন্তা করে তিনি তাঁদের সেই সময় জার্মানিতে যেতে নিষেধ করেছিলেন।

 

পেছনের কথা

১৯৭৫ সালের ২৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জ্যামাইকায় কমনওয়েলথ জোটের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পথে ফ্রাঙ্কফুর্টে সাত ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করেন। এর চার দিন আগে পশ্চিম জার্মানির বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব তারিক করিম ফ্রাঙ্কফুট রাইন মাইন বিমানবন্দরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযাত্রীদের যাত্রাবিরতিকালীন বিশ্রাম ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথিদের জন্য ডিভিআইপি লাউঞ্জের ব্যবস্থা করা হয়। যাত্রাবিরতির দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসপ্রধান, ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে নিয়োজিত বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলার, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা অনিল দাশগুপ্ত প্রমুখ দেখা করেন।

ফ্রাঙ্কফুর্টে যাত্রাবিরতি শেষে বঙ্গবন্ধু লুফৎহানসার একটি বিমানে জ্যামাইকা রওনা হন। বিমানবন্দরে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাঁকে বিদায় জানান। এ সময় দূতাবাসের প্রথম সচিব তারিক এ করিমও রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডান পাশে ছিলেন রাষ্ট্রদূত আর বাঁ পাশে ছিলেন তারিক এ করিম তাদের একটু সামনে ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে আন্তরিক আতিথেয়তার জন্য রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানান। রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তখন তারিক এ করিমকে দেখিয়ে বলেন, ‘স্যার, আমি কিছুই করিনি, সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ পাওয়ার কথা ওরই। বঙ্গবন্ধু এ সময় তারিক এ করিমের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন, ‘শিগগিরই আমার দুই কন্যা জার্মানিতে আসবে। তোমরা ওদের একটু দেখে রেখো।

প্রায় ৪৫ বছর পর সেই কথা স্মরণ করতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে তারিক এ করিম বলেন, তিনি কি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যারা যখন জার্মানি আসবে, তারপরই তিনিসহ তাঁর পরিবারের জীবনে নেমে আসবে নৃশংস নিশ্চিত সেই মৃত্যুর থাবা!

এর আগে মার্চ মাসে একদিন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব ও প্রেস অ্যাটাশে আমজাদুল হককে জানান, ১৩ মার্চ সকালের দিকে বঙ্গবন্ধুর জামাতা এম এ ওয়াজেদ মিয়া ফ্রাঙ্কফুর্টে আসবেন। কার্লসরুয়ের পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রে তিনি পোস্টডক্টরাল করার জন্য আসছেন। রাষ্ট্রদূত চৌধুরী আমজাদুল হককে অনুরোধ করেন ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে যেতে এবং ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে কিছুটা সময়ও কাটিয়ে আসতে। সেদিন আমজাদুল হক বিমানবন্দরে যান ও ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটান। তখন কথা প্রসঙ্গে জানতে পারেন তাঁরা দুজনই রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা ও সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। দুজনই কলেজের মুসলিম হোস্টেলে থাকতেন। আমজাদুল হক পরে বেশ কয়েকবার বন থেকে কার্লসরুয়ে গিয়ে ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।

ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালের ১৩ মার্চ সকালের দিকে ফ্রাঙ্কফুর্টে এসে পৌঁছান। তিনি জার্মানিতে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের বৃত্তি নিয়ে কার্লসরুয়ে পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রে পোস্টডক্টরাল গবেষণার কাজে।  এর আগে তিনি ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কার্লসরুয়ে জার্মানির অন্যতম প্রাচীন শহর। ১৭১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শহরটি বাতেন ভুর্টেমবের্গ রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। চমৎকার স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পুরোনো কেন্না ও উদ্যান শহরটির এক বড় বৈশিষ্ট্য। জার্মানির সুপ্রিম কোর্ট ও বিখ্যাত পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্লসরুয়ে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এখানেই অবস্থিত। শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেও এই শহরটির পরিচিতি রয়েছে। এখানে আছে সাতটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রের অবস্থান।

সেদিন (১৩ মার্চ) আমজাদুল হক ছাড়াও সেই সময় কার্লসরুয়ে পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রে কর্মরত ড. সৈয়দ রেজা হোসেন ও আমিরুল ইসলাম (বাবুল) ও বিমানবন্দরে যান। আমজাদুল হক তাঁর গাড়িতে করে ওয়াজেদ মিয়াসহ তাঁদের কার্লসরুয়ে পৌঁছে দেন।

পরমাণু গবেষণাকেন্দ্রে পৌঁছানোর পর বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু দাপ্তরিক কাজকর্ম সম্পন্ন করার জন্য ওয়াজেদ মিয়াকে কেন্দ্রের গাড়িতে করে প্রশাসনিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তিনি যান নিউট্রন ফিজিকস ও পরমাণু চুল্লিবিষয়ক কেন্দ্রে। সেখানে ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও খ্যাতনামা পরমাণুবিজ্ঞানী ড. কার্ল ভিটজের (Karl Writz) সঙ্গে দেখা করে তিনি তাঁর গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ ছাড়া কার্ল ভিটজের সহকারী প্রফেসর কুশলের সঙ্গেও তিনি পরিচিত হন।

কার্ল ভ্রিটজ তখন পশ্চিম জার্মানির পরমাণু কমিশনের সদস্য। এ ছাড়া তিনি জার্মান সরকারের পারমাণবিক অস্ত্রবিষয়ক চুক্তির পরামর্শক এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত পারমাণবিক ফোরামের সদস্য ছিলেন। তাঁর গবেষণা কাজের জন্য তিনি ১৯৭৫ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির সর্বোচ্চ সম্মানসূচক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘ফেরডিন্ট ক্রয়েজ’—এ ভূষিত হন। ওয়াজেদ মিয়ার সৌভাগ্য যে তাঁর পূর্বতন একাডেমিক রেকর্ড তাঁকে স্বনামধন্য অধ্যাপক কার্ল ভ্রিটজের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করার সুযোগ করে দিয়েছিল।

১৯৭৫ সালের মধ্য মার্চে ওয়াজেদ মিয়া যখন কার্লসরুয়ে আসেন, তখন অল্প বাঙালি ছাত্রগবেষক ওই শহরে থাকতেন। তাঁরা মাঝেমধ্যে একসঙ্গে মিলে রান্নাবান্না করতেন ও আড্ডা দিতেন। ওই গবেষণাকেন্দ্রে তখন বলবীর গোয়েল নামে একজন ভারতীয় পরমাণুবিজ্ঞানী চাকরি করতেন। তার সঙ্গে ওয়াজেদ মিয়ার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ ছাড়া কার্লসরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিষয়ক গবেষক শহীদ হোসেনের সঙ্গেও ওয়াজেদ মিয়ার সখ্য হয়। ওয়াজেদ মিয়া লেকচারার অতিথি ভবনের একটি সিঙ্গেল রুমে উঠেছিলেন। তাঁর কাছাকাছি ছাত্রাবাসে থাকতেন শহীদ হোসেন। ছুটির দিনে তাঁরা প্রায়ই গেস্টহাউস লাগোয়া চমৎকার পুরোনো একটি পার্কে গিয়ে বসতেন। মাঝেমধ্যে শহরের প্রধান সড়ক কাইজার স্ট্রাসেতেও হাঁটতেন। ওয়াজেদ মিয়া মাঝেসাঝে পাইপ টানতেন। সেই স্ট্রাসে বা রাস্তার একটি চুরুট ও পাইপসামগ্রীর দোকানের সামনে তিনি প্রায়ই দাঁড়াতেন আর কোনো একটি পাইপ দেখিয়ে বলতেন, ওই পাইপটি আমাকে কিনতে হবে। সেই সময় জার্মান গাড়ি কোম্পানি ভক্সওয়াগন গলফ নামে নতুন মডেলের একটি গাড়ি বের করেছিল। সেই নতুন গাড়ির মডেলটিও ওয়াজেদ মিয়ার খুব পছন্দসই ছিল। একদিন কথা প্রসঙ্গে শহীদ হোসেনকে ওয়াজেদ মিয়া জানান, কিছুদিন পর তিনি ওই গাড়িটি কিনতে চান। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি একদিন কার্লসরুয়েতে দীর্ঘ সময় ধরে তুষারপাত হয় ওয়াজেদ মিয়া আর শহীদ হোসেন তুষারপাতের মধ্যেই নিকটবর্তী কার্ল ভিলহেমের কেল্লার দিকে যান এবং কেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। প্রথম দিকে ওয়াজেদ মিয়া রান্না করা নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। শহীদ হোসেন এসব বিষয়ে তাঁকে সহযোগিতা করেন।

শেখ হাসিনা তাঁর দুই সন্তান ও বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই পশ্চিম জার্মানিতে পৌঁছান। সেদিন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আবার আমজাদুল হককে ফ্রাঙ্কফুর্ট যেতে বলেন। খুব ভোরের ফ্লাইটে তাঁরা ফ্রাঙ্কফুর্টে পৌঁছাবেন বলে আমজাদুল হক ও ওয়াজেদ মিয়া আগের রাতে একটি হোটেলে রাত যাপন করেন। সেই রাতে রাজশাহীর কলেজের স্মৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধকালে দিল্লিতে পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে আমজাদুল হকের পক্ষত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর অবস্থান গ্রহণ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। আমজাদুল হক এই লেখককে বলেছেন, খুব সোজা সরল ও স্পষ্টভাষী ছিলেন ওয়াজেদ মিয়া। আলাপচারিতায় ওয়াজেদ মিয়া আমজাদুল হককে জানান, কয়েক দিন পরেই তিনি বনে আসবেন এবং হাসিনাদের আশপাশের কয়েকটি দেশ ঘুরিয়ে দেখাবেন। রাষ্ট্রদূত চৌধুরীও আমজাদুল হককে জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বনে দুই দিন থেকে ব্রাসেলসে রাষ্ট্রদূত সানাউল হক ও প্যারিসে রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহএর ওখানে বেড়াতে যাবেন। সম্ভব হলে রোমেও যাবেন ।

শেখ রেহানা তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে বড় বোন শেখ হাসিনা তাঁকে বলেন তাঁর সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণে যাওয়ার জন্য। তাঁদের পশ্চিম জার্মানি বেড়াতে আসা প্রসঙ্গে শেখ রেহানা এক স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘আমার দুলাভাই ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ করছিলেন। আপার পাঁচ বছরের জয় আর ছোট্ট পুতুলকে নিয়ে জার্মানিতে যাওয়ার কথা। আমার সামনে তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। আপা বললেন, নিরিবিলি পড়তে পারবি ওখানে গেলে। আর কতকী দেখবি, কত কিছু কিনে দেব, প্যারিস নিয়ে যাব। ইউরোপ ঘুরে দেখতে পারবি গাড়িতে। আমারও লোড হলো

৩০ জুলাই ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নেমেই শেখ হাসিনা আমজাদুল হকের সামনেই শেখ কামালের বিয়েতে ওয়াজেদ মিয়ার উপস্থিত না হওয়া নিয়ে অনুযোগ করেন। অনুযোগটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। শেখ কামালের বিয়ে হয়েছিল ১৫ জুলাই। এর তিন দিন পর ১৮ জুলাই শেখ জামালের বিয়ে হয়। বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু দুবার ওয়াজেদ মিয়াকে ফোন করেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চিঠি লেখেন। লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সেলর নুরুল মোমেন খান, রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশ থেকে (তখন তিনি বাংলাদেশে ছিলেন) ও আমজাদুল হক ফোনে ওয়াজেদ মিয়াকে তাঁর শ্যালকদের বিয়েতে যোগ দিতে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিয়েছিলেন।

কিন্তু ওয়াজেদ মিয়া ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাঁর দুই শ্যালকের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তিনি একাডেমিক প্ল্যান ও স্কলারশিপের শর্তগুলোর বিষয়ে খুব সতর্ক ছিলেন। তিনি চাননি ইনস্টিটিউটের শর্তের বাইরে গিয়ে কিংবা পরিচালক কার্ল ভিটজের অনুমতি ছাড়া কিছু করতে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, জার্মানিতে বিদেশি কোনো ছাত্রের পক্ষে ওই ধরনের সম্মানীয় একজন প্রফেসরের অধীনে পোস্টডক্টরেট করা ৪৫ বছর আগে যেমন কঠিন ছিল, আজও তাই হয়ে গেছে।

অনুমতির ব্যাপারে প্রফেসর ভ্রিটজের অনমনীয় ও অনড় অবস্থান গ্রহণ করায় ওয়াজেদ মিয়া শ্যালকদের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশে না আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। আমজাদুল হক জানান, ওই সময় তাঁর সঙ্গে কার্লসরুরে অবস্থানরত ওয়াজেদ মিয়ার একাধিকবার ফোনে কথা হয়েছিল। পোস্টডক্টরাল চলারশিপের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শক্তি কমিশনের কঠিন শর্ত, প্রফেসর ভ্রিটজের অনমনীয় এবং সবার অনুরোধের পরও ১৫ জুলাই শেষ কামালের বিয়েতে তাঁর উপস্থিত হতে না পারা। এসব কিছু নিয়ে তখন ভীষণই মানসিক দোলাচলে ছিলেন ওয়াজেদ মিয়া।

(সূত্র: ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড প্রবাসে বঙ্গবন্ধু কন্যার দুঃসহ দিন)


আগস্ট ট্রাজেডি   শেখ হাসিনা   শেখ রেহানা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবরে গাফ্ফার ভাই সাংঘাতিক ভাবে ভেঙে পড়েন


Thumbnail

১৯ মে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যু দিবস। ২০২২ সালের আজকের দিনে তিনি আমাদেরর ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাঙালী এমন একজন সন্তান হারিয়েছে যার স্থান কোনদিন পূরণ হবে না। তাঁর সাথে আমার অনেক সময় আমার আলাপ হয়েছে। তার সবকিছু লেখা উচিত না, সম্ভবও না।

এক এগারোর সময় আমার ছেলে ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছিল। সেখান থেকে সে আমার এবং আমার স্ত্রীর নামে একটা দাওয়াত আয়োজন করে। কারণ এক এগারোর সময় আমার বিদেশের ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধ না থাকলেও আমার একটা দায় ছিল যা হয়তো যেতে দেবে না। যখন আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিই তখন আমাকে একজন বুদ্ধি দিল যে আমার মেডিকেল ডকুমেন্টসগুলো যাতে আমি যেকোন মাধ্যমে পাঠিয়ে দেই। কারণ সাথে নিলে হয়তো আমাকে চেকআপ করতে হতে পারে। আমি সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র সুলতান সজিব ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর লন্ডনে যাওয়ার একদিন একটা রেস্টুরেন্টে গফ্ফার ভাই, সুলতান ভাই, আমি এবং মোকাম্মেল সাহেব একসাথে বসি। তখন আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে গাফ্ফার ভাই বললেন, বঙ্গবন্ধুর ছায়াতে যে কোন মানুষকেই খুব বড় মনে হতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারা শূন্য। তিনি আরও বিস্তারিত বললেন, যে যত বড় নেতাই হোন না কেন, যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর ছায়াতে থাকলে হয়, না হলে হয় না। অর্থাৎ এগুলো আসলে বঙ্গবন্ধুরই বুদ্ধি থেকে অংশ পায়। যেমন বর্তমানে আমরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সাথে মেশার পর অনেক কিছু জানি এবং আমাদের অনেকে সালামও করে। এই সালামটা আসলে তারা আমাদের না বঙ্গবন্ধুর কন্যাকেই দেই। শেখ হাসিনার সালামটা পাই আমরা। যদি দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একটু মুখ কালো করে আমাদের সাথে কথা বলে তাহলে পরেরদিন সালামের সংখ্যা কমে যাবে। এ হচ্ছে বাস্তবিকতা। এটা গফ্ফার ভাইয়ের সাথে আমার একটা শিক্ষা। 

আরেকটা বিষয় আমি বলি, বঙ্গবন্ধুর সময় তিনি (আব্দুল গাফফার চৌধুরী) বঙ্গবন্ধুর অভ্যুদয় নামে একটা বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করতো আমিনুল হক বাদশা এবং মোজাম্মেল আলীসহ আরও কয়েকজন মিলে। সেই পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধু একসময় আমাকে লোকের মাধ্যমে জানায় যে, লন্ডনে একটি বাড়ি কিনলে সে বাড়ির কিছু অংশ ভাড়া দিয়ে আমার চলে যাবে। কিন্তু তা আমার নামে কিনতে হবে যাতে সে সম্পত্তি চিরকাল আমাদের থাকে। আমাকে তখন এফআরসিএস করার জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পাঠিয়েছেন সেজন্য আমি তখন ব্যস্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে সেসময় আমার যোগাযোগ তো দূরের কথা, যারা এইসব খবর দিতে পারে তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ ছিল। শুধুমাত্র সুলতান শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। এবং আমি এ ব্যাপারে রাজি হলাম না। সুতরাং বাড়ি কেনা হয়নি। ঐ পত্রিকা থাকতে তখন  বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনা করে তিনি একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন সম্ভবত ১৯৭৫ সালের জুন মাসের দিকে। তখন এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়টি জানানো হলে, তিনি বললেন, ‘বাচ্চাটিকে পাঠিয়ে দে’। ঐ পত্রিকাকে বললো, ‘তোদের কাছে যে টাকা পয়সা আছে তাই দিয়ে ওকে একটা বিলেত থেকে পাঠিয়ে দে দেশে। তো উনি আসলো। কি আলাপ হলো সে ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। কিন্তু যাওয়ার কিছুদিন পর আরও একটি আর্টিকেল লিখলেন। তার মূল সুর হচ্ছে এই যে, বঙ্গবন্ধুকে বিপ্লবীরা ধ্বংস করার চেষ্টা করছে কিন্তু আমরা সকলে সেটা বুঝেও কিছু করতে পারছি না। মোটামুটি একটা একই রকম লেখা ১৯৭২ সালে শেখ ফজলুল হক মণি। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদেরকে ধ্বংস করা হচ্ছে।’ তবে তিনি খুব সন্তুষ্ট হননি। এটা ঠিক যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর শোনার সাথে সাথে গাফ্ফার ভাই সাংঘাতিক আকারে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। গাফ্ফার ভাইয়ের আঘাতটা আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের সকলের চেয়ে বেশি। যা তার পরবর্তী লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে। 

এক এগারোর সময় যখন তার সাথে আমার আলাপ হয় তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে অনেক কথায় বললেন। যে বঙ্গবন্ধুর ছায়াতলে অনেকে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু তিনি একটি কথা কখনো বলেনি যে, বঙ্গবন্ধু লোক চিনতে ভুল করেছেন বা এমন কিছু। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ষড়যন্ত্রদের যদি চেনা যায় তাহলে তো তারা ষড়যন্ত্র করত পারবে না। এবং ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রে মনে হতো যে, আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেক ষড়যন্ত্রকারী অবস্থান নিয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে তারা বড় ভূমিকা পালন করবে। বিদেশী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিলো, জিয়াউর রহমান সাহেবের ষড়যন্ত্র ছিলো। ভেতরের ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ে কিন্তু আওয়ামী লীগ এখনো সেইভাবে পর্যালোচনা করছে বলে মনে হয় না। 

আজ গাফ্ফার ভাই চলে গেছেন। অনেক কারণে চিরকাল তিনি মানুষের হৃদয়ে থাকবেন। তাঁর ভিতরে সবচেয়ে বড় যে কারণটি তা হলো, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো এ গানটির জন্য। কিন্তু এর সাথে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে কঠিন সময়ে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্লেষণ দিয়ে আওয়ামী লীগকে সবসময় কিভাবে ক্ষতি হতে পারে সে সম্পর্কে সতর্ক করতেন। সুতরাং আমার মনে হয় আজকে গফ্ফার ভাইয়ের কথা মনে করতে গিয়ে একথা বলতেই হবে যে, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কাছের প্রতিটি লোকও কিন্তু তার প্রমাণিত লোক এবং চিরকাল তাঁর সাথে থাকবে ব্যক্তিগতভাবে আমি তা বিশ্বাস করি না। বরং অনেক লোক যারা এর চেয়ে বিশ্বস্ত ছিল তারা আস্তে আস্তে নিভৃতে চলে যাচ্ছে। এবং অনেকে পৃথিবী ছেড়েই চলে যাচ্ছে। সুতরাং আমার মনে হয় এ বিষয়টি নিয়ে আমি বলবো, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনারও চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। আজকে গাফ্ফার ভাইয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগের একজন শুভাকাঙ্খী হিসেবে যেকোন সময় তিনি যেভাবে স্পষ্ট বলতেন সেই কারণের জন্য।

আব্দুল গাফফার চৌধুরী  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

উপজেলায় ভোটার কম কেন?


Thumbnail

#সবচেয়ে বেশি ক্ষেতলালে ৭৩ ভাগ
#শতকরা মাত্র ১৭ ভাগ মিরসরাইতে

১৩৯ টি উপজেলার মধ্যে ৩০টি উপজেলায় শতকরা ৩০ ভাগের কম ভোট পড়েছে। আর শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ভোট পড়েছে মাত্র ২৩ টি উপজেলায়। সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে ইভিএমে ভোট নেয়া উপজেলাগুলোতে। ২০টি উপজেলায় ইভিএমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনোটিতেই ৫০ ভাগ ভোটও পড়েনি। ইভিএমে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে পাবনার সুজানগর উপজেলায়, শতকরা ৪৯.৭৮ ভাগ। এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আব্দুল ওয়াহাব, তার প্রাপ্ত ভোট ৬২ হাজার ৭৫২। নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী শাহীনুজ্জামান পেয়েছেন ৫৮ হাজার ৪৪১। মাত্র ৪ হাজার ৩১১ ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ায় বলা যায় ভোটের লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। কারণ প্রথম ধাপের খুব কম উপজেলাতেই প্রতিদ্বন্ধীতামূলক নির্বাচন হয়েছে, অন্তত ভোটের ফলাফল তাই বলে। ইভিএমে সবচেয়ে কম শতকরা মাত্র ২২.৭০ভাগ ভোট পড়েছে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায়। এখানে বিজয়ী মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন পেয়েছেন ৪৭ হাজার ৮০৭ ভোট। আর মাত্র ৩ হাজার ৮২৩ ভোটে হেরেছেন মো. রাশেদ ইউসুফ। ভোটের লড়াই ভালো হলেও হতাশার ব্যাপার হচ্ছে এখানকার ৪ লাখ ৫৬ হাজার ২২২ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লাখ ৩ হাজার ৫৫৬ জন। কেন এতো কম ভোটার? প্রশ্নের জবাব কে খুজবে নির্বাচন কমিশন, দলীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক প্রার্থী না দিয়ে অংশগ্রহনকারী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নাকি অন্য কেউ ? দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষাথীরা কি গবেষণা করবেন?    

সবচেয়ে বেশি শতকরা ৭৩.১৬ ভাগ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট ক্ষেতলাল উপজেলায়। এখানে ৯৫ হাজার ১৯১ ভোটের মধ্যে পড়েছে ৬৯ হাজার ৬৩৯টি। জয়ী দুলাল মিয়া সরকার পেয়েছে ৩০ হাজার ৪০০ ভোট আর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী তাইফুল ইসলাম তালুকদার ২২ হাজার ৯০০ ভোট। এখানে তৃতীয় হয়েছেন সর্বশেষ উপজেলা চেয়ারম্যান মুস্তাকিম মন্ডল। যিনি পেয়েছেন ১৪ হাজার ৯২৮ ভোট। এই তিনজনই আওয়া লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নাকি আরেকজনও ছিলেন, নাজ্জাষী ইসলামের ভোট নাকি পেয়েছেন নামমাত্র ভোট,টেকেনি জামানতও। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো প্রার্থীরা ভোটারদের জয়ী দুলাল মিয়া ক্ষেতলাল পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর তাইফুল ইসলাম এর আগে ১৯৯০ ও ২১০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। মুস্তাকিম মন্ডল ২০১৮ সালে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এখানে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ ছিল, কারণ বর্তমান ও সাবেক দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেও দুলাল মিয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে প্রথম থেকেই। তিনি জয়ী হলেও অন্য দুজনও ভালো ভোট পেয়েছেন। টাকা খরচেও নাকি কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। এই এলাকার সাংসদ জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন প্রত্যক্ষভাবে কারো পক্ষে নেননি বলেই জানালেন জয়পুরহাটের দুজন সাংবাদিক। তবে প্রথম দিকে তার একজনের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন থাকলেও পরবর্তীতে দলের নেতাকর্মী বা ভোটারদের কোনো একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে তিনি এমপি হিসেবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। আর সুষ্ঠু ভোটের জন্য কয়েকজন প্রশংসা করলেন জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলমের। হায় অন্য উপজেলাগুলোতে এমন হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে “ ভোটারহীন নির্বাচনের’’ অপবাদ সইতে হতো না। আওয়ামী লীগ প্রধান যে বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের কৌশল হিসেবে দলের নেতাদের মধ্যেই উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্ধিতামূলক করতে চেয়েছিলেন তাও সফল হতো, যদি প্রথম ধাপের নির্বাচনের মধ্যে ৭০ টির অবস্থা ক্ষেতলাল উপজেলার মত হতো। তবে উল্লেখ করতেই হয় ক্ষেতলালে ভোটের হার বেশি হলেও ভোটারের উপস্থিতি অনুযায়ী খুবই খারাপ ভোট হয়েছে একই জেলার আক্কেলপুর উপজেলায়। ভোট পড়েছে মাত্র শতকরা ১৯.৯৩ ভাগ। ১ লাখ ২২ হাজার ৮৪২ ভোটের মধ্যে ভোটার হাজির হয়েছিলেন ২৪ হাজার ৪৮৮ জন। যার মধ্যে মোকসেদ আলি মন্ডল ১৯ হাজার ৫৩৯ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রার্থী নুরন্নবী আরিফ ভোট পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৮৮। বলা যায় নূন্যতম প্রতিদ্বন্ধিতা হয়নি এখানে। এই জেলার অন্য একটি উপজেলা কালাইতে ভোট পড়েছে ৬৯.৭৫ ভাগ। 

এবার বলি সবচেয়ে কম, শতকরা মাত্র ১৭ ভাগ ভোট পড়া চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কথা। এখানে মোহাম্মদ এনায়েত হোসেন নয়ন ৩৩ হাজার ৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত, আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমান পেয়েছেন ২০ হাজার ৭৬৭ ভোট। এখানে আরো তিনজন চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন। এদের মধ্যে ফেরদৌস হোসেন আরিফ ৩ হাজার ৪৩৪, উত্তম কুমার র্শমা ৩ হাজার ৩৪৬ এবং মোহাম্মদ মোস্তফা ৬৬৫ ভোট পেয়েছেন। এই উপজেলায় মোট ভোটারের সংখ্যা  ৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫৭টি । এই উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের এলাকা। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি নিজের ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেলকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য সুপারিশ করে দলের মনোনয়নে তাকে এমপি করতে পেরেছেন। তখন উপজেলা আওয়ামী লীগের যারা তার জন্য কাজ করেছেন তারা এবারের উপজেলা নির্বাচনে সরাসরি কোনো চেয়ারম্যান প্রার্থীর জন্য প্রচারে নামেননি। আর প্রতিদ্বান্ধতা হয়েছে যে দুজনের মধ্যে তাদের দুজনই চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা। এনায়েত হোসেন নয়ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আর শেখ আতাউর রহমান সাধারন সম্পাদক । তিনি কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একএম জাহাঙ্গীর ভূইয়ারি একটি বিতর্কিত বক্তব্য নির্বাচনে দারুণভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। স্থানীয় পত্রিকার খবর অনুযায়ী তিনি ২৯ এপ্রিল একটি সমাবেশে শেখ আতাউর রহমানের পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “ আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রিয়নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ‍সুযোগ্য সন্তান মাহবুব উর রহমান রুহেলকে জিতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোনো অপকর্ম ছাড়া ভোট কেন্দ্র খোলা রাখবো।’’ এই বক্তব্যের জন্য তাকে কেন্দ্র থেকে শোকজ করা হয়েছে। আবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর নিজেই উপজেলা নির্বাচনে আগ্রহী ছিলেন। স্থানীয় দুজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে বর্তমান সাংসদের পরোক্ষ সমর্থন নাকি ছিল এনায়েত হোসেন নয়নের পক্ষেই। ফলে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বুঝতে পারেনি দল কাকে চায়, আর যেহেতু দলীয় প্রতীকও ছিল না, তাই তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী ছিল না। আর মাঠের বিরোধীদল বিএনপি বর্জন করেছে, জাতীয় পার্টি উপজেলা নির্বাচনে থেকেও নাই। ফলে ৩ লাখ ৭২ হাজার ভোটারের মাত্র ৬৩ হাজার ২৬৬ ভোট দিয়েছেন মিরসরাইয়ের উপজেলা নির্বাচনে। 
কেন ভোটারের উপস্থিতি কম? তা নিয়ে কারো মাথা-ব্যাথা নেই। সাধারন মানুষের ভাবনা এমন যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তাদের ভোট দেয় না দেয়ায় কিছুই আসে যায় না। দেশের দুই বড় দলের একটি আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও তারা দলীয় প্রার্থী না দিয়ে উন্মুক্ত করেছে,দেয়নি প্রতীকও। বিএনপি আছে বর্জনে। জাতীয় পার্টি নিজেরাই বিপর্যস্ত। একটি পৌরসভায় স্থানীয় মানুষ যেভাবে তার সেবা পায়,উপজেলা পরিষদ থেকে নাগরিক সেবা কম,উন্নয়নের কাজও বেশি হয় ইউনিয়ন পরিষদে। ফলে ভোটারের আগ্রহ কম। তারই প্রতিফলন পড়েছে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ভোটে। এখন দেখা যায় দ্বিতীয় পর্বে কাল ২১ মে ভোটে কেমন ভোটার আসে ভোট কেন্দ্রে?


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

আমার চোখে দেখা ১৭ মে, ১৯৮১


Thumbnail

আমি ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিলেতে এফআরসিএস ডিগ্রি লাভ করার প্রায় এক বছর পর দেশে ফিরি। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ফেরার পরে তখন আমি একধরনের দোটানায় ছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে। যার কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল তিনি নেই। তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বেঁচে আছেন, তারাও দেশে নেই। আমি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমি হাসপাতালে যাই, কাজ করি। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা তখন জেলে। যারা বাইরে ছিলেন তারা আমার কাছে আসতেন। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ছাত্রলীগ ও বিএমএ’র জুনিয়র ডাক্তারদের সাথেই তখন আমার সময় কাটে। ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর নেতৃত্বে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আমার বাসায় আসতো। তাদের সাথে কথা বলে অন্তত পক্ষে এটা মনে হতো যে, ঠিকই দেশে ফিরেছি। কিন্তু তারপরও একটা অপূর্ণতার ভাব ছিল। 

শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় এবং ১৭ মে তিনি দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তখন দেশের ভেতরে বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় যা শুনতাম তাতে আমার নিজের মনে হতো, তিনি বোধহয় দেশে না আসলেই ভালো হতো। কারণ, আমার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তখন উৎপন্ন হয়েছিল। আর এই ধারণাটি ছিল, আসার সাথে সাথে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে! তাই ভাবলাম অন্তত বিদেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বেঁচে থাকুক এটাই বড় কথা। কিসের রাজনীতি, কিসের কি? বঙ্গবন্ধু নেই। সত্যিকার অর্থে বলা চলে আমি একপ্রকার রাজনীতিবিমুখ ছিলাম তখন।
 
তারপর যখন ১৭ মে আসলো তখন আমি ভাবলাম, এয়ারপোর্টে যাই। এয়ারপোর্টে আমাকে একজন বুদ্ধি দিল, একটু দূরে গাড়ি রেখে হেটে যাওয়ার জন্য। আমি তাই করলাম। তখন প্রথমদিকে খুব বেশি লোকজন নজরে পড়েনি। কিন্তু যখন বিমান নামলো এবং নেত্রী শেখ হাসিনা বিমান থেকে নামলেন তখন চতুর্দিকে হঠাৎ দেখি লক্ষ লক্ষ লোক। আমার তখন চোখ দিয়ে তখন পানি। এখনও তাহলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের প্রতি ভালোবাসা মানুষের যায়নি। 

এর আগে আমার মনে হতো যে, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছি। আর স্বপ্ন দেখতে যদি কেউ ভুলে যায় তাহলে সে মানুষের বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমার সত্যিকার মানসিক অবস্থা তখন এমনই স্বপ্নহীন ছিল। স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষের এমন ভালোবাসা দেখে আমার তখন মনে হলো এই বুঝি আবার জীবিত হলাম। তখনও শেখ হাসিনার সাথে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি। কারণ সেই সময় তাঁর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। 

মানুষের ভিতরে যে ভাবাবেগ তা পরদিন মানুষের সঙ্গে মিশে বুঝলাম। তখন একটা সুক্ষ্ম মিল আমি খুঁজে পেলাম। তাহলো, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি যখন পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে আসেন, তখন আমরা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জনগণ যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, আমাদের স্বাধীনতা সম্পূর্ণতা পেল। ঠিক তেমনি একটা ভাব আমার মনে হল। তখন মাত্র শেখ হাসিনা এসেছেন। শুধুমাত্র তাকে দেখার ফলে জনগণের মধ্যে একটা উজ্জ্বীবিত ভাব এলো। যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতারা এদের সবার ভেতরে একটি গণজোয়ারের ভাব লক্ষ্য করা গেল। 

এত বছর পরে আজ আমি বলছি, সেদিন আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি এই শেখ হাসিনা নেত্রী শেখ হাসিনা হবেন, দার্শনিক শেখ হাসিনাতে রূপান্তরিত হবেন। এবং তাঁর দর্শন দ্বারা বাংলাদেশে সোনার বাংলা হিসেবে গঠন করতে পারবে। সেদিন আমার মধ্যে আবেগ ছিলোৎ কিন্তু এই চিন্তাগুলো ছিল না। তারপর ধীরে ধীরে তিনি কীভাবে দেশ গড়েছে তা সমস্ত লোকই জানে। সেই ১৭ মে যে জনসাধারণ তাকে একটু দেখবার জন্য গিয়েছিল, তাদের মনের ভাষা, মুখের ভাব এসব যদি অনুভব করা যায় তাহলে বোঝা যায়, সত্যি বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে সেদিন প্রবেশ করেছিল। এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা তিনি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শীতা এবং দার্শনিক ভিত্তির কারণে জনগণের আশা আকাঙ্খাকে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং বাংলাদেশকে আজ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার দারপ্রান্তে। 

সেই ১৭ মে’র কথা যদি চিন্তা করি, তখন অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে এতোদূর পর্যন্ত দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবে তা চিন্তা করিনি। এখন যেমন তিনি সমস্ত বিশ্বে নন্দিত বিশ্বনেতা। সেই তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। সেই ১৭ মে’র কথা আজকে মনে পড়ে। আমি প্রার্থনা করি দার্শনিক শেখ হাসিনাকে যেন সৃষ্টিকর্তা ভালো রাখেন এবং দেশ গড়ার সুযোগ যেন তিনি অনেকদিন পান।  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রত্যাবর্তনের পর সেদিন তিনি যা বলেন


Thumbnail

কাঁদতে কাঁদতে আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত বিপ্লবী সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় আসেন বিকেল চারটা বত্রিশ মিনিটে । যাত্রা বিরতিতে কলকাতা বিমান বন্দরে বসে অঝোরে কেঁদেছেন। বিমানে কেঁদেছেন পাঁচ ছয় বার। এয়ারক্রাফট থেকে নামার আগে আব্দুর রাজ্জাক যখন তাঁকে ফুলের মালা দেন, তখনও  তিনি কাঁদছিলেন।  

প্রকৃতিও সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল।  পৌনে পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রকৃতি তাঁর কষ্টের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। কুর্মিটোলা থেকে তিনি যান বনানী গোরস্থানে। সেখানে যেয়ে আবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বনানী থেকে তিনি যান শেরে বাংলা নগরে। সেখানে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ জনতা অপেক্ষা করছিল। কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বক্তব্য রাখেন।

কি বলেছিলেন তিনি লাখ লাখ জনতার সমাবেশে? হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া ফলাও করে এসব খবর সেদিন কোন পত্রিকা বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। ৪৩ বছর আগের সে সব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াও আজ কষ্টসাধ্য। সেদিনের ভাষণের যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।  

আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাই বোন, আরো অনেক প্রিয়জন।  ভাই রাসেল, আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। স্বামী সংসার ছেলে রেখে আমি আপনাদের কাছে এসেছি।

বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতা নেতা হবার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসাবে, মেয়ে হিসাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসাবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।

আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাসহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। বিচার চাই বাংলার মানুষের কাছে, আপনাদের কাছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে না। ওদের কাছে বিচার চাইবো না। ক্ষমতাসীনরা বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার পরিজন হত্যা করে বলেছিল, জিনিসপত্রের দাম কমানো ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আজকে দেশের অবস্থা কি? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দিনে দুপুরে মানুষ খুন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে।  সাধারণ মানুষ খেতে পারছে না, আর একশ্রেণীর লোক প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে।

ক্ষমতার গদি পাকাপোক্ত করার জন্য ওরা আগামী দিনে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করবে। আবার বাংলার মানুষ শোষণের শৃংখলে আবদ্ধ হচ্ছে। আমি চাই বাংলার মানুষের মুক্তি। শোষণের মুক্তি। বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছিলেন। আজ যদি বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, তবে আমার কাছে মৃত্যুই শ্রেয়। আমি আপনাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করে মরতে চাই।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেম চালু করতে চেয়েছিলেন তা যদি বাস্তবায়িত হতো, তবে বাংলার মানুষের দুঃখ আর থাকতো না। সত্যিকার অর্থেই বাংলা সোনার বাংলায় পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তববায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমার আর কিছু পাবার নেই। সব হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি; আপনাদের ভালবাসা নিয়ে, পাশে থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য। আপনারা আমার সাথে শপথ করুন, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করবো।  

স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রাম করি।

আপনাদের ভালবাসার আশা নিয়ে আমি আগামী দিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে।

(তথ্যসূত্র: সংবাদপত্রে শেখ হাসিনার বক্তৃতা: ১৯৮১-১৯৮৬; প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩)


প্রত্যাবর্তন   আওয়ামী লীগ   শেখ হাসিনা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে জিয়ার অপতৎপরতা


Thumbnail

আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে কেবল আওয়ামী লীগ তাদের নেতা-কর্মীরাই নয়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই খুশি হয়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট ছাপিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল।বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক/ সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান:” শিরোনামে প্রচারিত সেই লিফলেটে লেখা ছিল: “প্রিয় ভাই বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীর মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।

ওই লিফলেটে আরো লেখা ছিল: “আমাদের সকল ভরসার স্থল জাতির জনক আজ নেই। জনতার মুক্তির দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনাপর্বে তিনি বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন সাম্রাজ্যবাদ দেশীয় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র চক্রান্তে। কিন্তু মহামানবের মৃত্যু নেই, মুক্তির দিশারী বেঁচে থাকেন মুক্তি সংগ্রামের প্রাণশক্তিরূপে।...তিনি আমাদের কর্ম চেতনার হাতিয়াররূপে নির্মাণ করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর এই কর্মসূচীকে আমরা বহন করে চলেছি মানুষের মুক্তির মিছিলে। আর এই মিছিলের অগ্রসেনানী শেখ হাসিনা।

প্রচারপত্রে আরও বলা হয়েছিল: “...ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।...আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশাজনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে প্রত্যাবর্তন। বাঙালী জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।

দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিপুল প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ স্বস্তিতে ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার আশঙ্কায় সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা শঙ্কিত বোধ করছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরূদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিএনপির এক সভায় শেখ হাসিনাকে বিদেশি শক্তির তল্পিবাহক বলে অভিহিত করা হয়। একই দিনে আরেকটি সভা থেকে বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, বাকশালিরা ভারতের গোলাম। তারা বিদেশি সৈন্যের সহায়তায় ক্ষমতায় বসতে চায়। যে দলের প্রধান দিল্লিতে, সে দল জনগণের কল্যান করতে পারে না। সাতাশে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর খুনী মুশতাক গংদের মুখপত্র সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে বলা হয়েছিল, ইন্দিরার নীলনকশা এখন বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, “৭৫ এর পর তারা দিল্লি লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচেষ্টা চালায়। লন্ডনে জমে ওঠে দিল্লির সেবাদাসদের আড্ডা। তারাই আজ বাকশালী কমিটির ছত্রচ্ছায়ায় দেশে ফিরছে। সমস্ত কিছু ঠিক করে হাসিনাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।

সে সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রপতি বনে যাওয়া জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের খবরে সে সময়কার জিয়া সরকারের ভিতরে উদ্বিগ্নতার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে গিয়েছিল ; আওয়ামী লীগ (মালেক), আওয়ামী লীগ (মিজান)- ওরকমভাবেই পরিচালিত হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর আর্দশের কর্মীরা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। তেমন একটি সময় ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়াকে তৎকালীন জিয়া সরকার মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে তাইশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনকরা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন তৎকালিন জাতীয় সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না

বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেনশেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।পরদিন মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনজননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা জানিয়ে দেন তাঁকে যদি হত্যা করার চেষ্টাও করা হয় তাহলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন গণআকাঙ্খার কাছে নতি স্বীকার করেশেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠনশেখ হাসিনা আসার আগেই তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।

দীর্ঘ 'বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলে লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্যদিয়ে তাদের নেত্রীকে বরণ করে নেন। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে বিমানবন্দরে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা সেদিন মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। সকাল থেকেই শহরজুড়ে কেবলি মিছিল আর মিছিল। সেদিন শেখ হাসিনাকে সম্বর্ধনা জানাতে ঢাকা শহরে প্রায় ১৫ লাখ লোক উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের ঢাকা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের বন্দীশালা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন, সেদিনটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিল। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শেরেবাংলানগর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা।  বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।

কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমান অবতরণ করবে সেদিকে নজর রেখে লক্ষাধিক মানুষ মধ্যাহ্ন থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকেই বিমানবন্দরে কোন নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। হাজার হাজার মানুষ ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে নিয়োজিত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে প্রথমে দেয়ালের উপর ওঠে। একই সময়ে বিমানবন্দর ভবনের দোতলায় কন্ট্রোল টাওয়ারের যেখানে স্থান করা সম্ভব সেখানেই জনতা উঠে যায়। সবারই উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখা। পুলিশ বারবার চেষ্টা করেও তাদের সরাতে পারে নি। বিমানবন্দরের বাইরে অসংখ্য মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

সাদা-কালো রঙের প্রিন্টের শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যখন ৪টা ৩২ মিনিটে সিঁড়ি দিয়ে বিমান থেকে সজ্জিত ট্রাকে নামছিলেন; তখন লাখো জনতার কণ্ঠে গগনবিদারী স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক এভাবেই– 'শেখ হাসিনা তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব', 'শেখ হাসিনা, স্বাগত শুভেচ্ছা' 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' বিমান থেকে ভিআইপি লাউঞ্জ পর্যন্ত হাসিনাকে নিয়ে আসতে ট্রাকটির ১৫ মিনিট সময় লাগে। সবমিলিয়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়। পরিবেশ উচ্ছ্বাসের, পরিবেশ আনন্দে অশ্রু ফেলার। বিমান থেকে নামার আগে দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক যখন শেখ হাসিনার গলায় মালা দিচ্ছেলেন, তখন তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। কলকাতা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা আসার পথেও শেখ হাসিনা পাঁচ-ছয়বার অঝোরে কেঁদেছিলেন।

বিকেল চারটার দিকেই আকাশে কালো মেঘ ছিল। পৌনে পাঁচটায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে মিছির শুরু হবার পরপরই চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়। রাত আটটা পর্যন্ত সেদিন মুষলধারে বিরতীহীন বৃষ্টি ঝরেছিল। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেইসাথে তীব্র ঝড়। প্রকৃতি ভয়াল রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। এরই মাঝে ট্রাকে রাস্তার দুপাশের জনতার কণ্ঠে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান। বর্ষণসিক্ত শেখ হাসিনা ঝড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে যাচ্ছিলেন বনানী হয়ে শেরেবাংলানগরের সভাস্থলে। বনানী গোরস্থানে শেখ হাসিনার মা নিহত পরিজনের কবর জিয়ারত করেন। কবরস্থানে তিনি কান্নায় আকুল ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কবরে শায়িত মাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, আমাকে কেন রেখে গেলে?’

কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত আট মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লাগার কথা খুব বেশি হলে ত্রিশ মিনিট। প্রায় তিনঘন্টায় শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরের সভাস্থলে পৌছিয়েছিলেন। তখনও চারদিক অন্ধকার, মুষলধারে বৃষ্টি। একদিকে প্রবল বর্ষণ, সেই সঙ্গে কালবৈশাখী ঝড়। ঝড়বৃষ্টিতে নগরজীবন তখন প্রায় বিপন্ন, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে গেছে। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সভাস্থলে তখনো লক্ষ লক্ষ লোক উপস্থিত।  শেখ হাসিনাকে তারা দেখবেনই। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তিনি গণসম্বর্ধনা সভার মঞ্চে এলেন।

লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে আয়োজিত সমাবেশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।"

বক্তৃতাদানের এক পর্যায়ে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেননি শেখ হাসিনা। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, "আজকের জনসভায় লাখো চেনা মুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।"

বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা পাথেয় করে আমি আগামীদিনের যাত্রা শুরু করতে চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত চার রাষ্ট্রীয় নীতি বাস্তবায়ন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করে দেবো।

১৭ মে রাতে শেখ হাসিনা ছোট ফুপুর বাসায় ছিলেন। সেই সময়েও শেখ হাসিনাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চাইতো না। বাধ্য হয়েই তিনি তখন কিছুদিন ছোট ফুপুর বাসায়, কিছুদিন মেঝো ফুপুর বাসায় থাকতেন। দেশে ফিরে তিনি ধানমন্ডিতে নিজেদের বাসায় গেলে সেখানে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। যে কারণে বাড়ির বাইরের সামনের চত্বরে বসে পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া মিলাদ পড়েন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত ধানমন্ডির বাসাটা সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যকেই বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।

১৮ মে সকালে শেখ হাসিনা দলীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন এবং পরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্জন করেন। ওইদনই বিকেলে তিনি পিতা শেখ মুজিবের কবর জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তিনি খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বাড়ির গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্রন্দনরত শেখ হাসিনাকে অনেকে সান্ত্বনা দেন। তিনি সেখানে সমাধিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের  মাজার  জিয়ারত করেন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

২০ মে গোপালগঞ্জের ঈদগাঁ ময়দানে মেখ হাসিনার সম্মানার্থে এক গণসম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল।   সেই সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতির দূরে থেকে আমি ঘর-সংষার করছিলাম। আপনাদের ডাকে সবকিছু ছেড়ে এসেছি। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার জীবর দান করতে চাই।তিনি আরো বলেছিলেন, “গত ছয় বছরে দেশের মানুষের কোনরকম উন্নতি তো আমি দেখি নি। মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কৃষক-শ্রমিক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য পাচ্ছে না।তিনি উত্তাল জসমুদ্রের কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, “তবে কেন বঙ্গবন্থু, শেখ মনি চার নেতাকে হত্যা করা হলো?”

লেখক: . আবুল হাসনাৎ মিল্টন: সভাপতি, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগ।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন