এডিটর’স মাইন্ড

রাতভর বৈঠক: বিএনপি কি নির্বাচন কমিশনের সাথে কথা বলবে?

প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্দোলনের কৌশল এবং নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে গতকাল রাতভর বিএনপির নেতাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়েছে। লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া ঢাকায় বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে জুমে বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকে বিভিন্ন নেতারা তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তারেক জিয়া তাদের বক্তব্য শুনেছেন। তবে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। মজার ব্যাপার হল যে অধিকাংশ নেতাই এখন নির্বাচনের তফসিলের পর আন্দোলনের বদলে একটি কৌশলগত অবস্থান গ্রহণের জন্য তারেককে পরামর্শ দিয়েছেন। তবে তারেক জিয়া এই পরামর্শের ব্যাপারে কোন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এমন কোন খবর পাওয়া যায়নি। 

বিএনপির নেতারা মনে করছেন যে, এখন নির্বাচনের তফসিল যেভাবে ঘোষণা করা হয়েছে তাতে নির্বাচন করা অসম্ভব। আবার যদি নির্বাচন না করা হয় তাহলে সরকার একতরফা ভাবে নির্বাচন করবে এবং এখন তারা যেভাবে প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা নিয়েছে তাতে সেই নির্বাচন ২০১৪ এর মতো না। বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের মাঠে এনে আওয়ামী লীগ একটি সাজানো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে বলেই মনে করছেন বিএনপির অনেক নেতা। এরকম নির্বাচন যদি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করে ফেলে তাহলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতার কোন সমস্যা হবে না। 

বিএনপির অধিকাংশ নেতাই মনে করছেন যে, এভাবে আন্দোলন করে আর যাই হোক নির্বাচন ঠেকানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী—এরকম আলোচনায় বিএনপির অধিকাংশ নেতারাই কৌশলগত কারণে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। তবে এই মতামতের দুটি অংশ রয়েছে। কোনো কোনো নেতা বলেছেন, কৌশলগত কারণে তারা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিবে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করবে। নির্বাচনের তফসিল পেছানোর জন্য অনুরোধ করা হবে এবং মনোনয়নপত্র জমাও দেওয়া হবে। এরপর সরকার যে নির্বাচন নিয়ে কারচুপি গুলো করে বা অনিয়মগুলো করে সেগুলো আন্তর্জাতিক মহলে উপস্থাপন করা হবে। জনগণের কাছে দেখানো হবে এবং একটা পর্যায়ে প্রয়োজন হলে নির্বাচন থেকে বিএনপি সরে আসবে। আবার অন্যরা মনে করছেন যে নির্বাচন থেকে সরে না এসে এরকম একটি অবস্থান অবস্থা নিয়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এবং যে কটি আসন পাওয়া যায় তা নিয়ে আবার নতুন করে আন্দোলন গড়ে তোলাটাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু বিএনপির কোনো নেতা প্রশ্ন করেছেন যে, বিএনপি যদি নির্বাচনেই যাবে তাহলে এত রক্তক্ষয়ের দরকার কি ছিল? এত আন্দোলনের প্রয়োজন কি ছিল? সরকার চাইছে না বিএনপি নির্বাচনে আসুক, এজন্য বিএনপি নেতা কর্মীদের ওপর জেল, জুলুম ও হামলা ইত্যাদি করা হয়েছে বলে কোনো কোনো নেতা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন যে এখন সরকার বিএনপিকে ন্যূনতম ছাড় দেবে না। অথচ যদি আগে আমরা দরকষাকষি করতাম তাহলে আছে কিছু ছাড় পাওয়া যেত। অন্তত দলের শীর্ষনেতারা গ্রেপ্তার এড়াতে পারত। তাহলে নির্বাচনের মাঠে বিএনপি ভাল করত। 

তবে লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়া এখন পর্যন্ত নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষেই তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আন্দোলন এ ভাবেই চলবে এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলনকে অব্যাহত রাখতে হবে। তবে বিএনপি নেতাদের সিংহভাগই এখন তারেকের সঙ্গে একমত নন। কারণ আরও ৫০ দিন আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো শক্তির রসদ কোনোটাই বিএনপির হাতে নেই। এরকম একটি বাস্তবতায় শেষ পর্যন্ত বিএনপি যদি নির্বাচনে যাওয়ার কৌশল নেয় সেটাই তাদের জন্য ভাল হবে। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে বিএনপির একজন নেতা নির্বাচন কমিশনের সাথে কথা বলার প্রস্তাব দিয়েছেন যেন তফসিল পিছানো যায় যায়। এই প্রস্তাবের ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তারেক জিয়া জানিয়েছেন যে, তিনি দুই একদিনের মধ্যেই এ সম্পর্কে তার অভিমত জানাবেন।

বিএনপি   তারেক জিয়া   নির্বাচন কমিশন   নির্বাচনের তফসিল  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

সরকারের ভেতর কী হচ্ছে?

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ৩১ মে, ২০২৪


Thumbnail

বুধবার (২৯ মে) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর দুইজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছাটাই হয়েছেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২, অন্যজন প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব। টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু চার মাসের মাথায় তাদের চুক্তি বাতিল হলো। সাবেক সেনাপ্রধান এবং সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই দুই কর্মকর্তার ছাটাই নানা প্রশ্ন সামনে এনেছে। এটি কী সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের একটি অংশ নাকি অস্থিরতার প্রকাশ? হঠাৎ করেই দুর্নীতির ইস্যু জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে এসেছে। এটি কী সরকারের জন্য চাপ না কৌশলের অংশ? একের পর এক ঘটনার পর আকাশে বাতাসে না প্রশ্ন। সরকারের ভেতর কী হচ্ছে?

টানা চতুর্থ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের বয়স মতে সাড়ে চার মাস। কিন্তু এর মধ্যেই সরকারের ভেতর সমন্বয়হীনতা প্রকট হয়ে উঠেছে। সরকারের কাজ-কর্মে স্ববিরোধিতাও স্পষ্ট। সরকারের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা। কোথায় যেন ছন্দপতন। এর মধ্যেই দুর্নীতির ইস্যু সবার আলোচনার প্রধান বিষয়। সব কিছু কী ঠিক আছে?

২০ মে, সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের কথাই ধরা যাক। এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ঢাকায় চলবে না, এ সিদ্ধান্ত তাকে জানানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বললেন, স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকার একটি উপায় হলো ব্যাটারি চালিত এই অটোরিকশা। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে হুট করে এভাবে রাজধানীতে অটো রিকশা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী। এদের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়নেরও নির্দেশনা দিলেন।  

ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চলে। এগুলোর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, কোন আইন, রুট পারমিট নেই। কীভাবে অটোরিকশা গুলো শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে বিদ্যুৎ সংকটের এই সময়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা গুলো অবৈধভাবে বিপুল বিদ্যুৎ ব্যবহার করতো। এটি বন্ধের জন্য আইন প্রণয়ন এবং ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাকে রাস্তা থেকে প্রত্যাহারের একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু তা না করে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান নেতা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে না। ১৭ মে থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছিলো। হুট করে নেয়া এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অটোরিকশা চালকরা রাজপথে নেমে আসেন। তাদের দাবি, তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন। এটিই তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। অটোরিকশা চালকদের মূল দাবি ছিল যে, বিকল্প ব্যবস্থা না করে অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত তাদেরকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেবে। জীবিকা এবং কর্মসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলবে। এই অবস্থা চলে দুইদিন। দুই দিনের মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে অটোরিকশা চালকদের আন্দোলন বন্ধের জন্য কোন সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে এলেন। প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কারণে ঢাকা শহরে একটি আসন্ন শ্রেণী পেশার আন্দোলন থেকে সরকার রক্ষা পেল। প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রী যদি বোঝেন যে, স্বল্প আয়ের মানুষকে কর্মহীন করে হুটহাট এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। তাহলে মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেন বোঝেন না। ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিল? তাহলে কী প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে এরকম অনেক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়?

সরকারের মন্ত্রীরা প্রায় বলেন তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া ভাঁজা মাছটিও উল্টে খান না। বাজারে এমন একটি আবহ তৈরি করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া কোন মন্ত্রী যেন কোন কাজই করেন না। কিন্তু এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে কীভাবে হলো? 

শুধু যে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটছে, তা না। হর হামেশাই সমন্বয়ের সংকট এখন দৃশ্যমান। দেশে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে এখন লুকোচুরি কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছতার নীতি অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। সংসদ সদস্যদের বিনা শুল্কে গাড়ী কেনার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যেই ডিসি-ইউএনওদের জন্য ২৬১ টি বিলাস বহুল গাড়ী কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কার স্বার্থে এই গাড়ী কেনা? কৃচ্ছতা নীতি কী তাহলে আমলাদের জন্য প্রযোজ্য নয়? বিনা প্রয়োজনে বিদেশে না যাওয়ার অনুশাসন দেয়া হয়েছে। অথচ আমলাদের বিদেশ যাত্রার উৎসব অর্থবছরের শেষে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাজেটে বিদেশ ভ্রমণের খাত আছে, তাই টাকা উড়াও। প্রয়োজন থাক আর না থাক। 

টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণ করা আওয়ামী লীগ সরকারের সমন্বয়ের সংকট ক্রমশ একটি ব্যাধি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কদিন আগেই শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী চাকরির বয়স সীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে একটি চিঠি দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বাড়বে কী কমবে, বা চাকরিতে অবসরের মেয়াদ কত হবে এটি সরকারের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে কোথাও ঘোষণা করেনি যে, তারা ক্ষমতায় এলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বৃদ্ধি করবে। কিন্তু হুট করেই তরুণ শিক্ষা মন্ত্রী চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বৃদ্ধির জন্য একটি চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দিলেন। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দলের পরামর্শ ছাড়া এধরনের চিঠি তার সহকর্মীকে নিতে পারে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। একজন মন্ত্রী সরকার পরিচালনায় একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি একদিকে যেমন গোপনীয়তার শপথ নেন। তেমনি পক্ষপাতহীন দায়িত্ব পালনেরও শপথ গ্রহণ করেন। তাই শিক্ষা মন্ত্রী যখন এধরনের কোন চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেন এখন তা সরকারের ভেতর এক ধরনের সমন্বয়হীনতারই প্রকাশ। এই ঘটনার ফলে সরকারি চাকরিতে আগ্রহী তরুণরা উৎসাহিত হয়েছে, তাদের আন্দোলনের গতি বেড়েছে। গত কিছুদিন ধরে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। শিক্ষা মন্ত্রীর প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। সরকার আপাতত চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা বাড়ানোর চিন্তা ভাবনা করছে না বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। নানা কারণে এখন সরকার চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে চায় না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক কী ভুল সেটি আলাদা বিষয়। কিন্তু একজন মন্ত্রী, যিনি সরকারের একজন নীতিনির্ধারকও বটে, তিনি সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে চিঠি লিখেন কীভাবে? সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ এ করার ক্ষেত্রে তার অসংখ্য যুক্তি থাকতে পারে। এটি দলীয় ফোরাম বা মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি উত্থাপন করতে পারতেন। দলীয় ফোরামে এটি নিয়ে আলোচনা হলেই বিষয়টি সুষ্ঠু এবং গণতান্ত্রিক হতো। এতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। কিন্তু মন্ত্রী যখন সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য বিষয়টি প্রকাশ্যে উত্থাপন করেন তখন জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠে সরকারের ভেতর কী হচ্ছে? সরকার কী ফ্রি স্টাইলে চলতে পারে?

সমন্বয়হীনতার এরকম নজীর অনেক। সাম্প্রতিক সময়ে মেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপ করা হবে কি না এ নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এনবিআরের কাছে এক চিঠি লিখে মেট্রোরেলের ভাড়ার উপর এখনই যাতে ভ্যাট আদায় না করা হয় সেজন্য অনুরোধ জানায়। এনবিআর সেই অনুরোধ নাকচ করে দেয়। এনবিআরের বক্তব্য হলো এখন মেট্রোরেল জনপ্রিয় হয়েছে কাজেই এখান থেকে ১৫% হারে ভ্যাট আদায় করাই সঠিক হবে। এনবিআরের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, এনবিআর এর এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে সাংবাদিকদের জানান। এনবিআর আর সেতু মন্ত্রীর লড়াই এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। এবারের বাজেটে এনবিআরের পক্ষ থেকে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির জন্য যে সমস্ত প্রস্তাবনা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে মেট্রোরেলে ১৫% ভ্যাটের বিষয়টিও অন্তর্ভূক্ত। এটি জানার পর সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এনবিআরের সিদ্ধান্তকে ভুল হিসেবে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। প্রশ্ন হলো, এনবিআর কি সরকারের বাইরের কিছু? এনবিআর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। সরকারের দুই প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ্য যুদ্ধ কেন? এতে কার লাভ? এর ফলে জনগণের মধ্যে ধারণা হচ্ছে, সরকারের চেইন অব কমান্ড নেই।

এনবিআর এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। এটিই গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এই মত পার্থক্য মাঠে আলোচনার বিষয় না। মত পার্থক্য প্রকাশ্যে বিতর্কেরও কোন বিষয় নয়। এনবিআর বা সড়ক পরিবহন এবং সেতু মন্ত্রণালয় কী অনুধাবন করত পেরেছে এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। সরকারের সমন্বয়হীনতা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়। এই বিষয়টি অনেক শোভন এবং সুন্দরভাবে করা যেতে পারতো। এনবিআরের চেয়ারম্যান, অর্থমন্ত্রী, সেতু মন্ত্রী এবং মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আলাদা ভাবে বৈঠক করতে পারতেন। যে যার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে পারতেন এবং শেষ পর্যন্ত যদি তারা ঐক্যমতে না হয় তাহলে সকলে মিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারতেন। আমাদের সৌভাগ্য হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ, দায়িত্বশীল একজন মানুষ। তিনি দিনরাত ২৪ ঘণ্টা দেশের কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেন। তার একটি অভাবনীয় ক্ষমতা রয়েছে। তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়। এরকম একজন প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার পর কেন দু’টি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করে জনগণের বিভ্রান্ত করেন? 

গত ২০ মে মধ্যরাতের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনা প্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে স্যাংশন দেয়। মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, এটি ব্যক্তির বিষয়। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আগেই সরকারকে অবহিত করা হয়েছিল বলেই তিনি উল্লেখ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হবে না। কিন্তু তার পরদিনই হুমকি দিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বললেন, নিশিরাতের স্যাংশনের পরোয়া করি না। আজিজ আহমেদের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তাহলে কার বক্তব্য সঠিক? কোনটি সরকারের বক্তব্য? এখন আজিজ আহমেদ বেনজীররকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কথায় বাহাস চলছে। তারা যেন একেকজন ধোঁয়া তুলসীর পাতা। কারো কারো অতি কথনে জাতি বিভ্রান্ত। আসলে কী হচ্ছে?

একটি সরকার সামষ্টিক রূপ। সরকারের মধ্যে বিভিন্ন বিভাগ, মন্ত্রণালয় এবং নানারকম প্রতিষ্ঠান জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমন্বয় থাকা উচিত। মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে একে অন্যের মধ্যে সমন্বয় থাকা উচিত এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা জরুরী। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় যদি কেউ তার ভিন্ন মত বা অবস্থান প্রকাশ্যে বলেন সেক্ষেত্রে তার লাভ হতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী করে। যেটি এখন আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি। যেমন পেঁয়াজের মজুত কত বা পেঁয়াজের উৎপাদন কত এ নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবের সাথে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব নাই। বাজারে কাঁচা মরিচের দাম হু হু করে বাড়ছে। কাঁচা মরিচের চাহিদা কত তা নিয়ে একেক মন্ত্রণালয়ের একেক হিসেব। বাজার এখন সিন্ডিকেটের দখলে বলে চিৎকার চেঁচামেচি করা হচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেট বন্ধ করা কার দায়িত্ব এবং সিন্ডিকেট বন্ধের জন্য কারা কাজ করবে সেটা নিয়ে এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের ‘পিলো পাসিং’ খেলা চলে। সরকারের মধ্যে যদি ছোট ছোট অনেকগুলো সরকারের উদ্ভব ঘটে তাহলে সেটি বিপজ্জনক। মন্ত্রীরা যদি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে সরকার কে চালায়? 

টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মধ্যে একটি বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা যেকোন সংকট সমাধানের জন্য নিজেরা দায়িত্ব নিচ্ছে না এবং একে অন্যকে দোষারোপ করার একটি প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। আত্মতুষ্টিতে বলীয়ান সরকার বেনজীরের সম্পদ জব্দ করা নিয়েও তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। কিন্তু বেনজীর তো একদিনে এই বিপুল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেনি। তখন তো কেউ কিছু করেনি। এখন এতো হৈ চৈ কেন? সরকার কি নিজের ফাঁদে পা দিচ্ছে? অন্ধকারে সরকার কী লক্ষ্যহীন ভাবে পথ হাতড়াচ্ছে?

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

তারেক জিয়াকে কী দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে?

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ২৭ মে, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গণভবনে কোটালীপাড়া উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বলেছেন, এখন একটাই কাজ তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় আনা। এই কথাটি তিনি খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন কিছু বলেন তখন নিশ্চয়ই তার কার্যকারণ থাকে এবং ভেবে চিন্তে তিনি কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি দূরদর্শীসম্পন্ন একজন দার্শনিক চিন্তাবিদও বটে। আজকে সবাই যা ভাবে তিনি তা ভাবেন অনেক আগেই। আগামীকালের ভাবনা তিনি আজকে করেন। আর এ কারণেই তিনি একজন দক্ষ এবং বিশ্বমানের রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী কোন প্রেক্ষাপটে কেন হঠাৎ করে তারেক জিয়ার প্রসঙ্গটি সামনে আনলেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এ নিয়ে নানামুখী আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময় এই বক্তব্যটি দিয়েছেন, যখন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য তারিখ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগামী ৪ জুলাই নতুন পার্লামেন্ট দিয়েছেন। এই সময় যুক্তরাজ্যের টানা ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টি একটি চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। এই নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি অনিবার্য বলেই মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে কদিন আগে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি তৃতীয় স্থান দখল করেছে। লেবার পার্টির ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় আগামী দিনে তাদের ক্ষমতায় আসার বার্তা দিয়েছে বলেই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন।

আর এরকম একটা পরিস্থিতিতে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে আগাম নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। ঋষি সুনাক সেই দাবি শুনেছেন কিনা তা জানা যায়নি, তবে তিনি আগামী নির্বাচন নিয়ে একটি বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন যে, শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হলে কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থা আরও খারাপ হবে, এরকম বাস্তবতা বিবেচনা করে তিনি আগাম নির্বাচন দিয়েছেন। কিন্তু তার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরপরই ৭৮ জন কনজারভেটিভ এমপি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার জন্য ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে ঋষি সুনাকের নেতৃত্ব একটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। আর এই বাস্তবতায় শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে লেবার পার্টি যে দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় আসতে চাইছে সেটি অনেকের কাছে স্পষ্ট।

এরকম পরিস্থিতিতে লেবার পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে আওয়ামী লীগ বহুমুখী সুবিধা পাবে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকী ব্রিটিশ এমপি এবার নির্বাচনেও তার জয়ের প্রায় অনিবার্য বলেই মনে করা হচ্ছে। আর তিনি যদি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন এবং লেবার পার্টি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তিনি যে মন্ত্রী হবেন তা অনিবার্য। কারণ এরই মধ্যেই লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভায় তিনি অন্তর্ভুক্ত আছেন।

আর লেবার পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ৭৫’র নারকীয় ঘটনার পর লেবার পার্টির সংসদ সদস্যরাই জাতির পিতার হত্যার বিচার চেয়ে ছিলেন এবং সেটি নিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল ব্রিটিশ এমপিদের উদ্যোগে। আর এসব বাস্তবতা থেকেই লেবার পার্টি ব্রিটেনে সরকার গঠন করলে তারেককে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সহজ হবে বলেই অনেকে মনে করছেন। এরকম একটি বাস্তবতা থেকেই প্রধানমন্ত্রী হয়ত তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

তারেক জিয়া  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আনার, আজিজ, বেনজীর: কীসের ইঙ্গিত

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৭ মে, ২০২৪


Thumbnail

এক.

তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ে সপ্তাহজুড়ে তোলপাড় দেশ। একজন জনপ্রতিনিধি। একজন সাবেক সেনাপ্রধান। তৃতীয় ব্যক্তি সাবেক পুলিশপ্রধান। ভিন্ন ভিন্ন কারণে এবং ঘটনায় তারা আলোচনায়। তিন ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু তিন ঘটনায় এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অনিয়ম। একজন জীবন দিয়ে তার অন্ধকার জগতের দরজা খুলে দিয়েছেন। একজন ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন। তৃতীয়জনের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। এ তিনটি ঘটনার পর একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে—জনগণের সেবার দায়িত্ব কারা পাচ্ছেন? দুর্নীতিবাজরা, চোরাকারবারি, ক্ষমতা অপব্যবহারকারীরা কীভাবে জনপ্রতিনিধি হচ্ছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাচ্ছেন? এ ধরনের ব্যক্তিদের হাতে জনগণ কতটা নিরাপদ?

দুই.

প্রথমেই জনপ্রতিনিধি প্রসঙ্গে খানিকটা আলোকপাত করা যাক। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে কলকাতায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। গত বুধবার এ খবরটি নিশ্চিত করে কলকাতা পুলিশ। গত ১২ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ১৮ মে থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। আনার হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে এখন পর্যন্ত যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা লোমহর্ষক। হিন্দি সিনেমার মতো। এ হত্যাকাণ্ডের পর চোরাচালানের ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’র চাঞ্চল্যকর সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ২৪ মে ‘কালবেলা’র খবরে বলা হয়েছে, ‘চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে স্বর্ণ চোরাচালানের ২০০ কোটি টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ ছাড়া সীমান্তকেন্দ্রিক চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণও খুনের আরেক কারণ হিসেবে কাজ করেছে...।’ আনার হত্যাকাণ্ড নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। বাংলাদেশে ও ভারতে সন্দেহজনক ব্যক্তিরা আটক হয়েছেন। নিশ্চয়ই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হবে শিগগির। তিনবারের সংসদ সদস্য আনারের মৃত্যুর পর তার জীবনের অন্ধকার অধ্যায় সামনে এসেছে। সন্দেহ নেই, প্রয়াত এ সংসদ সদস্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুর পর এলাকার জনগণের মধ্যে যে আবেগ এবং শোক দেখা গেছে, তা অভূতপূর্ব। কিন্তু মৃত্যুর পর জানা গেল তিনি চোরাচালান চক্রের একজন ‘গডফাদার’ ছিলেন। ওই এলাকার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন এই সংসদ সদস্য। এটি যে কোনো গোপন বিষয়, তা নয়। ওপেন সিক্রেট। সবাই জানতেন। আওয়ামী লীগেও নিশ্চয়ই বিষয়টি অজানা নয়। সবকিছু জেনেশুনে একজন চোরাকারবারিকে কীভাবে তিন-তিনবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিল? ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ এর মধ্যে ২০১৪ এবং এ বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণই করেনি। তাই এমনটি বলার কোনো সুযোগ নেই যে, জেতার জন্য ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কৌশলগত কারণে আপস করতে হয়েছে। এসব নির্বাচনে সৎ, পরিচ্ছন্ন মানুষকে সামনে আনার সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতদের মনোনয়ন দিয়ে রাজনীতিকে শুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি। বিভিন্ন স্থানে এরকম করাও হয়েছে। তাহলে কেন সর্বহারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন চোরাকারবারিকে বারবার মনোনয়ন দেওয়া হলো? কার স্বার্থে এ ধরনের বিতর্কিত, অন্ধকার জগতের লোকজনকে জনপ্রতিনিধি বানানো হয়? আনারের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর একটি বিষয় সামনে এসেছে, আমাদের জনপ্রতিনিধি কারা হচ্ছেন? কারা আমাদের ‘ভাগ্যবিধাতা’ হয়ে সংসদে যাচ্ছেন। এর আগেও একজন আদম ব্যবসায়ীকে সংসদে আনা হয়েছিল। বিদেশে তিনি গ্রেপ্তার হন। পরে জানা যায়, আওয়ামী লীগের প্রয়াত এক নেতাকে বিপুল অর্থ দিয়ে তিনি ‘স্বতন্ত্র’ভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্ত্রীকেও টাকার দাপটে সংসদ সদস্য বানিয়েছিলেন। আমরা প্রায়ই বলি, জাতীয় সংসদ ব্যবসায়ীদের দখলে। রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই। কিন্তু রাজনীতি এখন কি ক্রমশ কালো টাকার মালিক, অন্ধকার জগতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে? ভবিষ্যতের রাজনীতি কি মাফিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করবে?

তিন.

জেনারেল আজিজ আহমেদ সাবেক সেনাপ্রধান। তিন বছর সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালনের পর ২০২১ সালের জুনে তিনি অবসরে যান। ২০ মে সোমবার মধ্যরাতের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ক্ষমতার অপব্যবহার, তিন ভাইয়ের অপরাধ ধামাচাপা দিতে প্রভাব খাটানো এবং ভাইদের সেনা কেনাকাটায় অবৈধ সুযোগ দেওয়ার অভিযোগে জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছে, তা নতুন নয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরায় এ নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করেছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনের ভেতর ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আবিষ্কার করা হয়েছিল। এ কথা সত্য, আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের বিরুদ্ধে বহুল আলোচিত ওই প্রামাণ্যচিত্রে অযৌক্তিক এবং অন্যায়ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে জড়ানোর একটি কুৎসিত চেষ্টা ছিল। এ কারণেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে সেনাপ্রধান এবং তার ভাইদের বিভিন্ন অপকর্মগুলোর নিরপেক্ষ ও নির্মোহ তদন্ত করা ছিল সরকারের দায়িত্ব। সরকার অভিযোগগুলো আমলেই নেয়নি। বিশেষ করে নাম, ঠিকানা, পিতৃপরিচয় পরিবর্তন করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নেওয়ার মতো বিষয়গুলো প্রমাণিত। এসব জালিয়াতি ও প্রতারণার বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আজিজ আহমেদ এবং তার ভাইদের অপরাধ তাদের ব্যক্তিগত। রাষ্ট্র বা সরকার কেন তার দায় নেবে? চাকরি জীবনে জেনারেল আজিজ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। সেনাপ্রধান হওয়ার আগে তিনি বিজিবির মহাপরিচালক ছিলেন। দুই জায়গাতেই তার ব্যাপারে নানা মুখরোচক আলোচনা শোনা যায়। সরকারের ঘনিষ্ঠ এরকম একটি ধারণা দিয়ে তিনি দাপট দেখিয়েছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে বিস্তর অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব অভিযোগ তদন্ত তো দূরের কথা, আমলেই নেওয়া হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে আমাদের গৌরবের সশস্ত্র বাহিনী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের অহংকার, দেশের গর্ব। এখনো এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে জনগণের আস্থা আশাতীত। হত্যা ও রাজনীতির উচ্চাভিলাষ থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি চৌকস, পেশাদার বাহিনী হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। ২০০৯ সাল থেকে সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক মানের একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেনাপ্রধানরা অবসরের পর নিভৃত জীবনযাপন করেন। দায়িত্ব পালন করে তাদের পেশাদারিত্ব, সততা ও নিষ্ঠা তরুণদের জন্য অনুকরণীয় হয়। কিন্তু জেনারেল আজিজদের সময়ে ব্যাপারটি তেমন ছিল না। বিজিবির প্রধান বা সেনাপ্রধান হিসেবে তার অনেক কর্মকাণ্ডেই পেশাদার অফিসাররা অস্বস্তিতে পড়েছেন। বিব্রত হয়েছেন। সেনাপ্রধানের চেয়ে সরকারের ঘনিষ্ঠ—এ পরিচয়টি তার ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে উঠেছিল। আজিজ আহমেদ সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্য ছিলেন কি না, সেটা ভিন্ন বিতর্ক। আমি সে বিতর্কে যাব না। তবে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তির জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পদের সঙ্গে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা ও সম্মান জড়িত। আজিজ আহমেদের কর্মকাণ্ড অনেক আগেই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত ছিল। তার বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগগুলোকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। আমার প্রশ্ন, শীর্ষ পদে যাওয়ার পর একজন ব্যক্তি কেন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার দাপটে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন? কেন তার লাগাম টেনে ধরা হয় না? এ ধরনের স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কি যথেষ্ট সতর্ক? কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত কি না, আজিজ আহমেদের ঘটনার পর সেই বিতর্ক সামনে এসেছে।

চার.

বৃহস্পতিবার (২৩ মে) ঢাকার একটি বিশেষ আদালত সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী, কন্যার সব স্থাবর সম্পদ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই আদেশ। গত কিছুদিন ধরেই সাবেক এই পুলিশপ্রধানের বিপুল অবৈধ সম্পদ নিয়ে তোলপাড় চলছিল। একটি জাতীয় দৈনিকে তার দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি হাইকোর্টের দৃষ্টিতে আনেন একজন আলোচিত সংসদ সদস্য। হাইকোর্টে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে। দুই মাসের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত নির্দেশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনকে। তদন্তের স্বার্থেই দুদক বেনজীর এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ ক্রোক করার আবেদন করে। বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের যখন ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, তখন আমি আশা করেছিলাম তিনি এর কড়া প্রতিবাদ জানাবেন। কিন্তু তা না করে সাবেক এই পুলিশপ্রধান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘ এক বক্তৃতা দেন, যা ছিল অনেকটাই আত্মরক্ষামূলক। তার ওই বক্তব্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর জুতসই জবাবও ছিল না। তাই এখন দেখার বিষয়, দুদক তদন্ত করে কী পায়। বেনজীর আহমেদ দুর্নীতি করেছেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু মেধাবী এই পুলিশ কর্মকর্তার বেপরোয়া হয়ে ওঠার নানা কেচ্ছা-কাহিনি অলিগলিতে আলোচনা হয়। পুলিশের প্রায় কর্মকর্তাই তার পরিবর্তনের বিস্মিত। এক সময় চৌকস, দক্ষ এই পুলিশ কর্মকর্তার বদলে যাওয়া নিয়ে রীতিমতো সিনেমা হতে পারে। হলি আর্টিসানের ঘটনায় তিনি যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, তা সত্যি অতুলনীয়। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরাই হতাশার সুরে বলেন, পুলিশপ্রধান হওয়ার পর তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। নানা রকম বিতর্ক এবং অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড ক্ষমতার দাপটে তিনি যা খুশি তা-ই করেছেন বলেও অনেক মন্তব্য করেন। পুলিশপ্রধান থাকা অবস্থায় তার লাগামহীন দুর্নীতি সরকারের বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়েছিল। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষপদে থাকা একজন ব্যক্তির এসব কাণ্ড সরকারের জন্যও বিব্রতকর। এখন দেখার বিষয়, বেনজীর আহমেদের পরিণতি কী হয়।

পাঁচ.

আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায়। এ সময় দেশ পরিচালনায় সরকার অনেক শীর্ষ পদে বহুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। অনেকের সততা ও নিষ্ঠা এখনো অনুকরণীয় উদহারণ। আবার কেউ কেউ শীর্ষ পদে গিয়ে এমনসব কাণ্ড করেছেন যে, সরকারই তাদের কাজে বিব্রত হয়েছেন। দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা বিভিন্ন শীর্ষ পদে গেছেন তারাই বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সমালোচিত হয়েছেন। এর ফলে সরকারও ইমেজ সংকটে পড়েছে।

এই তিনটি ঘটনার একটি সহজ সমীকরণ আমার কাছে স্পষ্ট। পক্ষপাত করে, রাজনৈতিক বিবেচনায় বা প্রভাবিত হয়ে যোগ্যতার বাইরে কাউকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া উচিত নয়। হোক না তা জনপ্রতিনিধি কিংবা পুলিশপ্রধান। ইদানীং অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন পাওয়ার কথা বেশ চালু হয়েছে। অযোগ্যরা তদবির করে, চাটুকারিতার মাধ্যমে অথবা সরকারকে নানাভাবে প্রভাবিত করে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন। এরাই বিতর্কিত হচ্ছেন, সরকারকেও করছেন বিব্রত। এদের লোভ, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট। এই তিন ঘটনা আমাদের একটি সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাই তা হলো গুরুত্বপূর্ণ পদে বা দায়িত্বে লোক বাছাই করতে হবে নির্মোহভাবে, শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে। না হলে ক্ষতি হবে সরকারের, দেশের।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


আনার   আজিজ   বেনজির   দুর্নীতি   নিষেধাজ্ঞা   হত্যা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

চীন থেকে ফিরেই ভারতের সমালোচনায় মেনন

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ২৬ মে, ২০২৪


Thumbnail

চীন থেকেই ফিরে ভারতের সমালোচনায় মুখর হলেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন। সাম্প্রতিক সময়ে ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি চীন নিয়ে যান। এ সফরের উদ্দেশ্য কি ছিল বা কেনই বা চীন তাদেরকে জামাই আদর দিয়ে নিয়ে গেছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানায়নি ইদানিং সুবিধাভোগী নেতারা। তবে চীন থেকে ফিরে আসার পর যেন রাশেদ খান মেননের মগজ ধোলাই হয়েছে তা দিব্যি বোঝা গেল। চীন থেকে ফেরার পরেই তিনি এখন ভারত বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। 

গতকাল ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত অভিন্ন পানি বন্টণ: প্রেক্ষিত পদ্মা ও তিস্তা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি গঙ্গার পানি চুক্তি ও তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে ভারতের তীব্র সমালোচনা করেন। এই অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষ থেকে যে তিস্তা মহা পরিকল্পনার জন্য যে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাকে জুতা মেরে গরু দান বলে অভিহিত করেন। এছাড়াও তিনি গঙ্গার পানি চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখন মাওলানা ভাসানীর মতো ফারাক্কা মিছিল করার মতোও গুরুত্ব আরোপ করেন। শুধু তাই নয়, ভারতের সঙ্গে যে অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে তার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তীব্র হিসেবে ধরা পরে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করে রাশেদ খান মেনন গঙ্গা এবং তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে এতো মরিয়া হলেন কেন? 

বাংলা ইনসাইডারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চীন দীর্ঘদিন ধরেই কুড়িগ্রাম অঞ্চলে তিস্তা নদীর চারপাশে জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব দিচ্ছিলো। ১০০ কোটি ডলারের এই প্রস্তাবের মূল বিষয়টি ছিল বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পানি থেকে এই জলাধারগুলোকে ভরানো হবে এবং শুষ্ক মৌসুমে এই পানিগুলো দিয়ে শুষ্কতা কাটানো হবে। তবে ভারত এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করছিল। এবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের সময় ভারত একটি ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’র এক বিকল্প প্রস্তাব দেয় এবং সেখানে ভারত অর্থায়ন করার জন্য প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে পানি বণ্টনের একটা সমাধান হবে বলে অনেকে মনে করেন। ভারতের পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়েছে যে, নির্বাচনের পর তারা বাংলাদেশের সঙ্গে পানি চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত ফয়সালা করবে। 

সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেক আগ্রাসী হয়ে গেছে। বিভিন্ন লোভনীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে চীন আসছে। যদিও বাংলাদেশ এখন চীনের সাথে বিনিয়োগের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করছে। নতুন করে বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশ একটু রক্ষণশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর এ কারণেই চীন এখন বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক মিত্রের সন্ধান করছে। যারা বাংলাদেশে ভারত বিরোধীতা উষ্কে দিবে এবং ভারতের সমালোচনার মাধ্যমে চীনকে সামনে আনবে। চীন ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই এখন প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যেন চীন পন্থীদের প্রভাব বাড়ে সে চেষ্টা করছে। ১৪ দলের নেতাদের চীন সফরের পর এই সংবাদ সম্মেলন তারই ইঙ্গিত বহন করে। 

এখন ৫০ সদস্যের একটি আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল চীনে অবস্থান করছেন। এবং তারা ফিরে আসার পর পরই কাজী জাফর উল্লাহর নেতৃত্বে আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল চীন সফর করবে। সবকিছু মিলিয়ে রাজনীতিতে চীন প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে যেন রাজনীতিবিদরা ভারত বিরোধীতায় নামেন এবং চীনের প্রকল্পের স্বার্থগুলো বাস্তবায়িত হয়। আর এই কারণেই রাশেদ খান মেনন এখন নতুন করে আবার চীন পন্থী হিসেবে নিজেকে যালাই করে নিলেন। চীনে রাজনীতিবিদদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি মগজ ধোলাই করার জন্য- এ প্রশ্নটি এখন সামনে এসেছে। 


ওয়ার্কার্স পার্টি   রাশেদ খান মেনন   চীন   ভারত  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

দুর্নীতিবাজরা প্রধানমন্ত্রীর লোক হতে পারে না

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ২৪ মে, ২০২৪


Thumbnail

সাবেক সেনাপ্রধান এবং সাবেক পুলিশ প্রধানকে নিয়ে এখন সারা দেশ জুড়ে তোলপাড় চলছে। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি আদালত ক্রোক পরোয়ানা জারি করেছে। বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী এবং কন্যার নামে থাকা ৮৩ টি বিভিন্ন স্থাবর সম্পত্তি দলিল জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এছাড়া তাদের ব্যাংক একাউন্টও জব্দ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেনজীর আহমেদ অত্যন্ত দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগ চাউর হয়েছিল। এখন বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। 

সোমবার (২০ মে) মধরাতের পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের দেয়া বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে ‘ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। এর ফলে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে যে অভিযোগ গুলো উত্থাপন করা হয়েছে সে অভিযোগগুলো বহুল প্রচারিত এবং পুরোনো। অভিযোগগুলো প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ঐ দিন আল জাজিরা ‘অল প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রামাণ্য চিত্র প্রচার করেছিল। ঐ প্রামাণ্য চিত্রটি নির্মাণ করেন ডেভিড বাগম্যান, তাসনিম খলিল এবং জুলকার নাইন। এরা তিনজনজনই বিতর্কিত, মতলববাজ এবং একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য পরিচিত। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে জোর করে যুক্তিহীন ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে টেনে আনার করার চেষ্টা হয়েছিল। আজিজ আহমেদ এবং তার তিন ভাইকে প্রধানমন্ত্রীর লোক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এ প্রতিবেদনে। ঐ সময় ঐ প্রতিবেদন নিয়ে দেশে বিদেশে হৈ চৈ হয়। 

মার্কিন ঘোষণার পর সাবেক সেনাপ্রধান তার মতো করে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, বিজিবির মহাপরিচালক এবং সেনাবাহিনীর প্রধান থাকা অবস্থায় কোন রকম দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেননি। গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এটিও বলেছেন যে, এ ঘটনা সরকারকেও হেয় করে। 

আজিজ আহমেদের নিষেধাজ্ঞার ঘটনাটি এমন এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করলো যখন দুই দেশ সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার  প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। কদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফর করেছেন। এ সফরে তিনি অতীতের তিক্ততা ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়েছেন। লু এর সফরের পর সরকারের মধ্যে ছিলো স্বস্তি ভাব। বিএনপির মধ্যে হতাশা। তবে ডোনাল্ড লু তার সফরে সুস্পষ্টভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। আর তিনি ফিরে যাবার পর পরই যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সেনাপ্রধানের উপর এই নিষেধাজ্ঞার বার্তাটি ঘোষণা করলো। বাংলাদেশে সাবেক সেনাপ্রধানের এই নিষেধাজ্ঞার ঘটনাটি নিয়ে নানারকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি এই ঘটনার পর স্ববিরোধী অবস্থান নিয়েছে। দলের মহাসচিব মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, এতে বিএনপির কিছু যায় আসে না। তার মতে এই নিষেধাজ্ঞা একধরনের বিভ্রান্তি। এটিকে তিনি বলেছেন ‘আই ওয়াশ’। আবার দলটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটিকে সরকারের দায় হিসেবে প্রচার করছে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য দুরকম।পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টিকে সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোন বিষয় নয় বলেই মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানিয়েছিল বলে উল্লেখ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মন্তব্যও ছিলো একই রকম। কিন্তু বুধবার ওবায়দুল কাদের কথা বললেন উল্টো সুরে। ‘নিশি রাতের স্যাংশন পরোয়া করিনা’ বলে হুংকার দিলেন কাদের। আমি মনে করি এটি ব্যক্তির উপর নিষেধাজ্ঞা। দুই দেশের সম্পর্কের উপর এটি কোন প্রভাব ফেলবে না। ব্যক্তির অপরাধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এরকম নিষেধাজ্ঞা হরহামেশাই দেয়।

তবে এই নিষেধাজ্ঞার বহুমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে। জেনারেল আজিজ আহমেদ বাংলাদেশে একজন আলোচিত বিতর্কিত এবং সমালোচিত ব্যক্তি। ২০২১ সালের জুনে সেনাপ্রধানের পদ থেকে তিনি অবসরের পর নিভৃত জীবন যাপন করছেন বটে, কিন্তু তিনি সেনাপ্রধান এবং বিজিবির মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় তার কর্মকান্ড নিয়ে নানামুখী আলাপ আলোচনা এখনও চলমান। তার তিন ভাইকে নিয়ে সত্য-মিথ্যা নানা গল্প বিভিন্ন মহলে আলোচনা হয়। অনেকের ধারণা আজিজ আহমেদের কারণেই তারা বেপোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন। 

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর কেউ কেউ একটি সরল সমীকরণ আনার চেষ্টা করছেন। তারা বলছে যে, আজিজ আহমেদ এইসব অপকর্ম করেছেন সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। বিতর্কিত এবং যুদ্ধ অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক ডেভিড ব্যাগম্যান ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা আল জাজিরার প্রতিবেদনে আজিজ আহমেদকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই প্রামাণ্য চিত্রকে সামনে এনে অনেকে অপপ্রচারের নতুন এজেন্ডা গ্রহণ করেছে। কিন্তু নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করলে আল জাজিরার প্রতিবেদনে এটিই ছিলো সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে আজিজ আহমেদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কের বিষয় আমলে নেয় নি। নির্মোহভাবে তার অনিয়ম গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো যে, আজিজ আহমেদ কি প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন? প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পায় এবং প্রশ্রয়ে কি তিনি এই কথিত অপরাধগুলো করেছিলেন? এর উত্তর 'না'। প্রধানমন্ত্রী তার দায়িত্ব পালনকালে বেশ কয়েকজন সেনাপ্রধান পদে নিযুক্ত করেছেন। তাদের অনেকে সততা, ন্যায় নিষ্ঠার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একটি পদে ভালো বা খারাপ করা ব্যক্তির বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর নয়।  

কোন দুর্নীতিবাজ প্রধানমন্ত্রীর লোক হতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতির ব্যাপারে সুস্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন তিনি কোন রাজনৈতিক দলের না, তাকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। সরকার নানারকম সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তবতার কারেণ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান করতে পারছে না একথা সত্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন দুর্নীতিবাজকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন এমন কথা কেউ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে পারবেন না। দুর্নীতিবাজদের কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ট বলে প্রচার চালানোর এক নোংরা খেলা ইদানিং প্রকট হয়েছে। এটি পরিকল্পিত মিথ্যাচার। এর উদ্দেশ্যে একটি জনগণের আস্থার জায়গা নষ্ট করা। বিজিবি বা সেনাপ্রধান হিসেবে আজিজ আহমেদ কোন অপরাধ করলে, তার দায় একান্তই তার, অন্য কারো নয়। 

তবে একথা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই আজিজ আহমেদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে কঠিন সময়ে বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বিশেষ করে তার তিন ভাইয়ের যে হত্যা মামলার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সে হত্যা মামলার ইতিহাসটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হারিছ , আনিস ও জোসেফের কর্মকান্ড বিবেচনা করলে সেটি অপরাধ মনে হবে। কিন্তু ৭৫’ পরবর্তী বাংলাদেশের বাস্তবতায় যদি দেখা যায় তাহলে সেটি বীরত্ব, প্রতিরোধ যুদ্ধ। তারা সেই সময় ৭৫ এর ঘৃণ্য আত্ম স্বীকৃত খুনীদের দল ফ্রিডম পার্টিকে প্রতিরোধের জন্য জীবন বাজী রেখেছিলেন । জোসেফ, হারিছ, আনিছের মতো অনেকেই সেদিন ৭৫’ এর ঘাতকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ৭৫’এর পর প্রতিরোধ যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? রাষ্ট্রদ্রোহী না বীর দেশপ্রেমিক? আওরঙ্গ, লিয়াকত বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। তারা কি সন্ত্রাসী? তাদের কৌশল ভুল হতে পারে, তাদের প্রতিবাদের ভাষা ভুল হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটি ছিলো আদর্শিক লড়াই, অস্তিত্বের যুদ্ধ। আনিছ, হারিছ কিংবা জোসেফের মতো কিছু সাহসী তরুণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীরা কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছিল। তারা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে হত্যার সাহস পায়নি। আনিছ, হারিছ জোসেফরা সেই সময় যদি ফ্রিডম পার্টির বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে না নিতেন তাহলে আত্মস্বীকৃত ৭৫’র খুনীরা বাংলাদেশ দখল করে নিতো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি মানুষও থাকতো না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। যে কথিত হত্যাকান্ড নিয়ে আজিজ আহমেদের তিন ভাইকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং দন্ডিত করা হয়েছিল, সেই হত্যাকান্ডের পুরো বিচার প্রক্রিয়া হয়েছিল বিএনপির আমলে। যারা ফ্রিডম পার্টি এবং ৭৫’ এর খুনীদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। ঐ বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যে দেশে কর্ণেল তাহেরের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পঙ্গু অবস্থায় ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয় সেই দেশে ফ্রিডম পার্টির সশস্ত্র ক্যাডারকে প্রতিরোধ করার জন্য কাউকে হত্যা মামলার আসামি করাটা অস্বাভাবিক নয়। যিনি নিহত হয়েছিলেন তিনি ছিলেন ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসী, বহু মানুষের হত্যা দায়ে অভিযুক্ত। হারিছ, আনিছ, আজিজরা সেই সময় যেটা করেছেন সেটি কতটা রাজনৈতিক, কতটা সন্ত্রাসী তার বিচারের ভার ইতিহাসের। কিন্তু সেই সময় ৭৫’ এর খুনীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা ছিলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর একারণেই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে মিথ্যা হয়রানি মূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা এবং এসমস্ত মামলায় যারা দন্ডিত হয়েছেন তাদেরকে ছেড়ে দেয়া নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছে। আওয়ামী লীগ সাহসের সাথে এই দায়িত্ব পালন করেছে। ঘাতকদের বুলেট থেকে বাঁচার জন্য যদি কেউ সহিংস হয়ে উঠে তবে সেটি আত্মরক্ষা, অপরাধ নয়। কাজেই হারিছ, আনিস, জোসেফকে মুক্ত করার বিষয়টি কোন ভাবেই দুর্নীতির সাথে যুক্ত করা উচিত না। এটি একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। এটি অস্বীকার করার কোন কারণ নেই তার ভাইদের ত্যাগ এবং ৭৫’ পরবর্তী সময়ে তাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের কারণেই আজিজ আহমেদ সরকারের দৃষ্টিতে এসেছেন এবং তার পদোন্নতি ঘটেছে। এমনকি একারণেই হয়তো তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পেয়েছেন। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের বাস্তবতা। রাজনৈতিক বিশ্বস্ততা এবং আনুগত্য অনেক গুলো স্পর্শকাতর নিয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়।

দ্বিতীয় বিষয় হলো আজিজ আহমেদ যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি কি করেছেন? তিনি কি দুর্নীতি করেছেন? তিনি কেনাকাটার ক্ষেত্রে তার ভাইদেরকে প্রাধান্য দিয়েছেন? তার ভাইদের পরিচয় পাল্টে দিয়ে তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়েছেন? তার ভাইয়েরা অনৈতিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন আজিজ আহমেদের নাম ভাঙ্গিয়ে? এসমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মতো করে নির্মোহভাবে তদন্ত করেছে। আল জাজিরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উপস্থাপন করেছে। এই বিষয়ের সাথে সরকারের কোন সম্পৃক্ততা নেই। সরকার এই ব্যক্তির দুর্নীতির দায় কেন নিবে? এ ধরনের পদে থেকে দুর্নীতি করতে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে অন্য কারো সহযোগিতা লাগেনা। ব্যক্তি আজিজ যখন একটি পদে গেছেন তখন যদি তিনি কোন দুর্নীতি করে থাকেন, তিনি কোন অন্যায় করে থাকেন তার সব দায়-দায়িত্ব একমাত্র তারই। তার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সরকারের নয়। শুধু আজিজ আহমেদ কেন এখন সাম্প্রতিক সময়ে অনেকের দুর্নীতির থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসছে। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির বিশাল ফিরিস্তি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই দুর্নীতির অভিযোগ হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। হাইকোর্ট বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন হাইকোর্টের নির্দেশে বেনজির আহমেদের দুর্নীতির অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে। ইতোমধ্যে আদালতের মাধ্যমে বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের সব স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ পেয়েছে দুদক। এর ফলে দুর্নীতির ব্যাপারে যে সরকার নির্মোহ এবং প্রভাবমুক্ত সেটি আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। বেনজীর আহমেদকে পুলিশ প্রধান করাটা ছিলো সরকারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু পুলিশ প্রধান হয়ে তিনি যদি কোন অন্যায় করে থাকেন, যদি কোন দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তবে সেটি তার অপরাধ। এর দায় সরকার নেবে কেন? 

প্রধানমন্ত্রী টানা ১৫ বছর এবং মোট ২০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ২০ বছরে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে শত শত নিয়োগ দিয়েছেন। দায়িত্ব পেয়ে কেউ ভালো কাজ করেছেন, কেউ খারাপ কাজ করেছেন। কেউ দুর্নীতি করেছে, কেউ সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। কেউ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, কেউ আবার ছিলেন অযোগ্য। যে যেই কাজ করেছেন তার পুরষ্কার বা তিরস্কার তিনিই পাবেন। আনিছ, হারিছ, জোসেফের দন্ড মওকুফ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাদের নাম পাল্টানো, পরিচয় গোপন করে ভোটার কার্ড বা পাসপোর্ট গ্রহণ ব্যক্তিগত অনিয়ম, অপরাধ। বাংলাদেশে ডা. সাবরিনার মতো অনেকেই এধরনের অপকর্ম করেছে। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা জালিয়াতি করে পাসপোর্ট করেছে, সংগ্রহ করেছে জাতীয় পরিচয় পত্র। এটি সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা। এসব অনিয়ম করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর লোক হওয়ার দরকার নেই। সত্যিকারের প্রধানমন্ত্রীর লোকরা এই সব অনিয়ম করে না। কোন নির্দিষ্ট দায়িত্ব পেয়ে যারা দুর্নীতি করছেন, যারা অনিয়ম করছেন এটি একেবারেই তাদের সিদ্ধান্ত, তাদের লোভ। এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হবে তাদেরকেই। আমরা জানি যে, বিভিন্ন জায়গায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন অনেক ব্যক্তি ছিলেন বা আছেন যারা দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। অন্তত সাধারণ মানুষ তাই মনে করে। তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না বলেও অভিযোগ আছে। এটি সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন সহ সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় হতে হবে। উদ্যোগী হতে হবে। আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে সে অভিযোগগুলো দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন যাতে নিরপেক্ষ তদন্ত করে তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের আশে পাশে যেসমস্ত লোক ছিলেন বা আছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যেসমস্ত দুর্নীতির অভিযোগ আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায় সেই অভিযোগগুলোর নির্মোহ তদন্ত দরকার। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী যে টানা ক্ষমতায় আছেন এবং তিনি যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তার অন্যতম কারণ তিনি দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেন না। তিনি নিজে দুর্নীতির সঙ্গে জড়ান না। তার কট্টর সমালোচকরাও তাকে দুর্নীতিবাজ বলতে পারবে না। আর এই বাস্তবতায় যারা বিভিন্ন দায়িত্ব পেয়ে বা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেই দুর্নীতি করেন তারা প্রধানমন্ত্রীর লোক হতে পারে না, তারা বিশ্বাসঘাতক। প্রধানমন্ত্রীর লোকরা দুর্নীতি করে এই ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর লোক তারাই যারা দায়িত্ববান, সৎ যারা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে চান। প্রধানমন্ত্রীর লোক তারাই যারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে, সততার সাথে পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর লোক তারাই যারা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদর্শ অনুসরণ করে। যারা দুর্নীতিবাজ, চাটুকার, লোভী, অর্থ পাচার করে, লুটেরা তারা কখনোই প্রধানমন্ত্রীর লোক না। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন