গত
৫ জুলাই ‘কালবেলায়’ একটি খবর আমাকে
আতঙ্কিত করেছে। শুধু আমি কেন,
যে কোনো বিবেকবান নাগরিক
এ খবরে আতঙ্কবোধ করবেন।
‘চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সচিবের নির্বাচনী
প্রচার’—শিরোনামে প্রতিবেদনে, দায়িত্ব পালনরত এক সচিব তার
নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদের ছুটিতে গিয়ে
রাজনৈতিক সমাবেশ করেছেন। যদিও ওই সচিব
এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি
জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে এলাকার
সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন মহলের
সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তার বিভিন্ন
বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, তিনি নির্বাচনী
প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। তবে
এ সচিব একা নন,
একটু খোঁজ নিলেই দেখা যায় অন্তত
২০০ আমলা এখন নির্বাচনের
মাঠে। তাদের বেশিরভাগই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের টিকিট চান। অবসরে চলে
যাওয়া আমলারাই মনোনয়ন মিছিলে এগিয়ে। অনেকে আছেন যারা অবসরকালীন
প্রস্তুতির ছুটিতে থেকেই নির্বাচনী মাঠে। একজন আমলা ৫৯
বছর বয়সে পিএলআর বা
অবসরকালীন ছুটিতে যান। এক বছর
তাকে রাষ্ট্র বেতন-ভাতাসহ সব
সুযোগ-সুবিধা দেয়। এ সময়
তিনি একজন সরকারি কর্মচারী।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ তার জন্য
সমভাবে প্রযোজ্য। এ সময় তিনি
কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
কিন্তু একজন সদ্য অবসরে
যাওয়া মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ একাধিক অবসর-প্রস্তুতি ছুটিতে
থাকা আমলারা এখন রাজনীতি মাঠ
দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের বাধা দেওয়া তো
দূরের কথা, এ নিয়ে
কেউ প্রশ্ন তুলছেন না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে
থাকা একজন সরকারি চিকিৎসক
আওয়ামী লীগের কমিটিতেও ঢুকে পড়েছেন। আগামী
নির্বাচনে সরকারের ওই বেতনভুক কর্মচারী
ফরিদপুরের একটি আসন থেকে
প্রার্থী হবেন বলেও গুঞ্জন
রয়েছে। যেভাবে মনোনয়নযুদ্ধে বীরদর্পে আমলারা ময়দানে নেমেছেন, তাতে আমি উদ্বিগ্ন
ও শঙ্কিত। রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান দখলের
পর এবার কি আমলারা
জাতীয় সংসদও দখল করবেন?
নির্বাচনী
আইন অনুযায়ী, একজন সরকারি কর্মকর্তা
চাকরি থেকে অবসরের তিন
বছর নির্বাচন করতে পারেন না।
কিন্তু এ আইনকে চ্যালেঞ্জ
করে একাধিক রিট পিটিশন এখন
হাইকোর্টে। ধারণা করা হচ্ছে, এ
আইন বাতিলের ব্যাপারে আমলারা একজোট হয়েছেন। ২০০৯ সাল থেকেই
বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রে আমলাতন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত। ২০১৮ সালের নির্বাচনের
পর আমলারা এখন সবকিছু নিজেদের
করায়াত্তে নিয়েছেন। ব্যাংকপাড়ায় আমলাতন্ত্রের পতাকা সগৌরবে উড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থেকে শুরু করে
প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের
চেয়ারম্যান সাবেক সচিব বা আমলা।
এমনকি কৃষি ব্যাংক কিংবা
রাজশাহী কৃষি ব্যাংকের মতো
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো পর্যন্ত আমলাদের হাত থেকে রক্ষা
পায়নি। সাধারণ বীমা, জীবন বীমার মতো
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আমলাদের অবসরোত্তর ক্লাবে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রায় সব কমিশনের দায়িত্ব
এখন আমলাতন্ত্রের হাতে ন্যস্ত। তাদের
চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যায় না। অতএব,
নির্বাচন কমিশন থেকে দুর্নীতি দমন
কমিশন; পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে শুরু করে
তথ্য অধিকার কমিশন—সর্বত্র আমলাদের জয়-জয়কার। আমলারা
সব জানেন, সব পারেন। তারা
ছাড়া এসব কমিশন রক্ষা
করবে কে?
আমলাদের
মধ্যে একশ্রেণির আমলা আছেন সৌভাগ্যবান
এবং অতিশয় চতুর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার
সঙ্গে সঙ্গে তারা আওয়ামী লীগার
হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ এমন
কথাবার্তা বলেন, যা শুনলে মনে
হয়, তারা শেখ হাসিনার
চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ।
কিন্তু একটু কষ্ট করে
এসব মহান আমলার অতীত
অনুসন্ধান করলে পাওয়া যায়
অন্য ইতিহাস। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও
তারা বেশ আরাম-আয়েশে
ছিলেন। তখন সাফারি স্যুট
পরে, দিব্যি জিয়ার মতো পোশাক পরে
চাকরি করেছেন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম একদিন বিশেষ
কাজে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি
বিভাগের সচিবের দপ্তরে গেলেন। সচিব হাত কচলিয়ে
আওয়ামী লীগের নেতাকে স্বাগত জানালেন। বললেন, স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন? মির্জা আজম বললেন, আপনাকে
চেনা চেনা লাগছে। আগে
কোথায় দেখা হয়েছিল বলুন
তো। সচিব এবার বিগলিত
হাসি হেসে বললেন, স্যার
আমি তো আপনার নির্বাচনী
এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। এবার চেয়ার থেকে
লাফিয়ে উঠলেন আওয়ামী লীগের ছয়বারের এমপি। বললেন, আপনি সেই বিএনপির
ক্যাডার না। যিনি ২০০১
সালের নির্বাচনের আগে আমাকে গ্রেপ্তার
করেছিলেন। আপনি সচিব হয়ে
গেলেন কীভাবে? মির্জা আজম ওই ঘটনার
বিবরণ দিয়েছিলেন এভাবে, ২০০১-এর নির্বাচনের
আগে হঠাৎ করেই মনোনয়ন
জমা দেওয়ার আগের দিন মির্জা
আজমকে গ্রেপ্তার করা হয়। একটি
মামলায় হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট (বর্তমানে যিনি গুরুত্বপূর্ণ সচিব)
তার জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর
আদেশ দেন। অর্থাৎ পরদিন
আওয়ামী লীগের এ প্রার্থী আর
মনোনয়ন জমা দিতে পারবেন
না। ফলে বিএনপি প্রার্থীর
বিজয় নিশ্চিত। বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্দেশে বিএনপির ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ওই আমলা। শেষ
পর্যন্ত জনগণের ঘেরাওয়ের মুখে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
প্রত্যাহার করেন অন্য একজন
ম্যাজিস্ট্রেট। মির্জা আজম মনোনয়নপত্র জমা
দেন। নির্বাচন করেন এবং প্রতিকূল
পরিবেশে নির্বাচন করেও জয়ী হন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ
ক্ষমতায় আসার পর ওই
আমলা ভোল পাল্টাতে সময়
নেননি। তরতর করে পদোন্নতি
পেয়ে তিনি সচিব হয়েছেন।
মির্জা আজম বিএনপি ক্যাডারের
বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেছেন। তাতে লাভ হয়নি।
প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এরকম কমবেশি মুখোশধারীরা
এখন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তাদের মধ্যে চাটুকারিতা এবং তৈল মর্দনের
প্রতিযোগিতায় যারা ভালো করেন,
তাদের জন্য তো পুরস্কার
আর পুরস্কার। এক মহাপ্রভাবশালী আমলা,
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়
শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে
কাটালেন। দেশে ফিরে সিঁড়ি
বেয়ে তরতর করে উঠে
গেলেন আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ শিখরে। এরপর পেলেন চুক্তিভিত্তিক
নিয়োগ। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই
বাগিয়ে নিলেন বিদেশে লোভনীয় চাকরি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আবার
এলে তিনি উপদেষ্টা হবেন।
আর আওয়ামী লীগ যদি প্যাদানি
খায়, তিনি বিদেশেই থেকে
যাবেন। কোনো কিছুই তাকে
স্পর্শ করতে পারবে না।
এরকম সুযোগসন্ধানী আমলার সংখ্যা এখন বাড়ছে। দেশে
যখন অর্থনৈতিক সংকট তীব্র, তখন
অর্থের দায়িত্বে থাকা আমলা বিদেশে
লোভনীয় নিয়োগ নিলেন। দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজের ক্যারিয়ারই
তার কাছে মুখ্য। আমলারা
এরকমই। সুবিধাবাদীরা বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। তাদের অবসর
গ্রহণের ফুরসত নেই। যারা চুক্তিতে
নিয়োগ পান না, তাদেরও
হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের
বিভিন্ন কমিশন এবং নানা প্রতিষ্ঠান
আছে তাদের অবসরকালীন সময় কাটানোর জন্য।
রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান দখল
করে নিয়েছেন আমাদের সর্ববিষয়ে পণ্ডিত আমলারা। এমন কোনো বিষয়
নেই যাতে তাদের পাণ্ডিত্য
নেই, দক্ষতা নেই। ২০২০ সাল
থেকে জেলার দায়িত্বে আমলারা। করোনা মোকাবিলায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সে সময় সচিবদের
জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল,
মাঠপ্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্যই এ
‘সাময়িক সিদ্ধান্ত’। কিন্তু এখন
করোনা নেই, জেলার দায়িত্বে
আমলারা বহাল তবিয়তে আছেন।
আমলারা কিছু পেলেই হলো।
তা সারা জীবনের জন্য
নিজেদের দখলে রাখার ফন্দি-ফিকির হলো আমলাতন্ত্রের অব্যর্থ
আবিষ্কার। জেলার দায়িত্বে থাকা আমলারা ধীরে
ধীরে অনুভব করলেন, তিনিই তো সব। জেলার
এমপির তো কোনো ক্ষমতাই
নেই। সচিবের কথায় জেলা প্রশাসক
ত্রাণ বণ্টন করেন, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। সচিব ভাবলেন, এমপির
আর দরকার কি? আমিই তো
এমপি হতে পারি। জেলা
প্রশাসক বা ইউএনও দেখলেন,
এমপি, কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যানের কথা শুনে তো
লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি।
সচিবের নির্দেশ শুনলে তো পদোন্নতি হবে।
আর রাজনীতিবিদরা তো ক্ষমতাহীন। ধীরে
ধীরে ‘আমলাতন্ত্র’ জেলা এবং উপজেলায়
পল্লবিত হলো এভাবেই। এখন
জেলায় কিংবা উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা
জনপ্রতিনিধিদের চার পয়সার দাম
নেই। জেলা প্রশাসক আর
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এখন জনপ্রতিনিধিদের ফোন
পর্যন্ত ধরেন না। এরকম
অভিযোগ জাতীয় সংসদে একাধিক সংসদ সদস্য করেছেন,
কিন্তু লাভ হয়নি। জনপ্রতিনিধিরা
বড়-মাঝারি-ছোট আমলাদের বিরুদ্ধে
অভিযোগ করতে করতে ক্লান্ত।
একমাত্র জায়গা যেখানে আমলাদের তেমন আধিপত্য ছিল
না তা হলো—রাজনীতি
ও নির্বাচন। আমলারা এখনো বাংলাদেশে ভালো
রাজনীতিবিদ হয়ে উঠতে পারেননি।
রাজনৈতিক দলের ‘ম্যানেজার’ হিসেবে অনেকেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু কেউ নেতা হতে
পারেননি। প্রয়াত এইচ টি ইমাম
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেটি
রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়। আমলাতন্ত্রের ফাইল,
নোট ইত্যাদি বিষয়গুলোকে রাজনীতিতে তিনি নিপুণভাবে সংযুক্ত
করেছিলেন। তবে আমির হোসেন
আমু, তোফায়েল আহমেদ কিংবা বেগম মতিয়া চৌধুরীর
মতো তারকা হতে পারেননি। বিএনপির
মধ্যে প্রয়াত এম কে আনোয়ার
অনেক প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু তিনিও বিএনপিতে ম্যানেজারের কাজই করতেন। জাতীয়
সংসদে বিভিন্ন সময়ে আমলারা এসেছেন
বটে, কিন্তু কেউ আলো ছড়াতে
পারেননি। রাজনীতির সহজাত স্বতঃস্ফূর্ত কখনোই আমলাদের মধ্যে থাকে না। এ
জন্যই কি আমলাদের রাজনীতি
এবং রাজনীতিবিদদের ওপর এত রাগ?
এত আক্রোশ? আমরা যদি গত
১৪ বছরের রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যক্রমের পোস্টমর্টেম করি তাহলে দেখব,
আমলারা বিরাজনীতিকরণের একটি গোপন ব্যাধি
রাষ্ট্রের ভেতরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজ, অশিক্ষিত, প্রজ্ঞাহীন—এমন একটি পরিকল্পিত
প্রচারণা আমলারা গত ১৪ বছর
ধরে করে যাচ্ছেন। কখনো
প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে। জনগণের
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কালিমা লিপ্ত করে আমলারা রাষ্ট্রের
‘চাকর’ থেকে ‘প্রভু’তে পরিণত হতে
চান। এজন্য সবকিছু দখলের পরও তারা তৃষ্ণার্ত।
এজন্যই ২০১৮-এর নির্বাচন
তারা পরিকল্পিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। ২০১৮-তে বিশ্বের
সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ
জিতত। কিন্তু আমলারা সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেননি। এটি
ছিল গণতন্ত্র এবং নির্বাচনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমলাতান্ত্রিক
ক্যু। ওই নির্বাচন সুষ্ঠু
হলে আজ নির্বাচন নিয়ে
এত অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি
হতো না। তারা ২০১৮
সালে কিছু কাণ্ড করে
আওয়ামী লীগ সরকারকে অবিরত
ব্ল্যাকমেইল করছে। রাষ্ট্রের সবকিছু দখল করে নিয়েছে।
রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের মিশন শেষ করে
আমলারা এবার জাতীয় সংসদও
দখল করতে চান। জাতীয়
সংসদকেও অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের ক্লাবে পরিণত করতে চান। বিরাজনীতিকরণের
এ ষড়যন্ত্রের দৃশ্যমান রূপ হলো এক
সচিবের নির্বাচনী সভা। যে সভায়
তিনি রাজনীতিবিদ এমপিকে দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য বলেছেন। আমলারা সাধু এবং ধোয়া
তুলসীর পাতা হলেন কবে?
কানাডার বেগমপাড়ায়, যুক্তরাষ্ট্রে কিংবা যুক্তরাজ্যে আমলাদের বাড়িঘর কিংবা সম্পত্তি কি বৈধ পথে
উপার্জিত? নির্বাচন করার বিপুল অর্থ
একজন নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করা সরকারি কর্মচারী
পাবেন কোত্থকে? এ প্রশ্নগুলো আজ
করতে হবে সাধারণ নাগরিকদেরই।
আমলাতন্ত্রের এ রাজত্বে সরকারি
কর্মচারীরা সবকিছু থেকেই আইন করে দায়মুক্তি
নিয়েছেন। এ প্রজাতন্ত্রের মালিক
জনগণ। জনগণের ওপর আমলাদের খবরদারি
রুখতে হবে এখনই। তা
না হলে বিপন্ন হবে
গণতন্ত্র। জনগণ হারাবে তার
অধিকার।
লেখক
: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত
হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী
লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা
যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন
তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই
তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী
আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন
কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী
হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে
৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের
নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির
আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন
যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হবে?
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী
লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী
দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে
তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন,
তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত
কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের
মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত
কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।