একটি সমস্যা নিয়ে আপনি তিনজনের কাছে গেলেন। সমাধানের জন্য। একজন আমলা,
একজন সুশীল এবং একজন রাজনীতিবীদ। আমলা দেখলেন সমস্যা বেশ জটিল। তিনি সমাধানের কোন পথেই
গেলেন না। এটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখলেন। সুশীল বুদ্ধিজীবী সমস্যা গভীর ভাবে শুনলেন।
বেশ চিন্তা করলেন এনিয়ে। তারপর এমন সমাধানের পথে গেলেন যে সমস্যা আরো জটিল হলো। রাজনীতিবীদ
সমস্যা নিয়ে জনগণের কাছে গেলেন। জনগণকে সাথে নিয়ে এর একটা চুড়ান্ত সমাধান করলেন।
উদাহরণটা দিলাম বিভিন্ন উপ-নির্বাচন প্রসঙ্গে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর
গঠিত বর্তমান সংসদ তার মেয়াদের শেষ প্রান্তে। এই সংসদে উপ নির্বাচনের রেকর্ড হয়েছে।
করোনা সহ নানা কারণে বহু সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন। বিএনপির নির্বাচিত ছয়জন সংসদ
সদস্য পদত্যাগ করলে, সেই সব আসনেও অনুষ্ঠিত হয় উপ নির্বাচন। এসব উপ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছে। কোথাও মনোনয়ন
দেয়া হয়েছে পোড় খাওয়া রাজনীতিবীদকে। কোথাও আওয়ামী লীগের পছন্দ ছিলো সুশীল সমাজের
প্রতিনিধি কিংবা ব্যবসায়ী। কোথাও বা আমলা। এসব উপ-নির্বাচন নানা কারণে ছিলো গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের মেয়াদের মাঝপথে এসে বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে সবধরণের নির্বাচন বর্জনের
ঘোষণা দেয়। বিএনপির প্রধান লক্ষ্য ছিলো নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। দীর্ঘ
১৬ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি প্রমাণ করতে চেয়েছে, তাদের ছাড়া দেশে অংশগ্রহণমূলক
নির্বাচন অসম্ভব। গত দুই বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে
অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনকে ‘বৈশ্বিক এজেন্ডা’ বানিয়ে ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এ নিয়ে প্রকাশ্যে আগ্রাসী অবস্থান গ্রহণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো
বলছে, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক। জনমতের প্রতিফলন
যেন সেই নির্বাচনে ঘটে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর দৌড়ঝাপ এখন আর কোন
গোপন বিষয় নয়। ২০১৮’র নির্বাচনের পর দেশের জনগণের মধ্যে ভোট নিয়ে এক অনীহা তৈরী
হয়। ভোট প্রদানে সাধারণ মানুষের আগ্রহ উদ্বেগজনকভাবে কমতে থাকে, এরকম বাস্তবতায়,
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ‘নির্বাচন’ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। বিএনপির
কৌশল হলো, নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ‘তামাশা’ বানানো। যেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক
সরকার গঠনের আন্তর্জাতিক চাপ তৈরী হয়। বর্তমান সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব
নয়-এই বোধ জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করা। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের কৌশল ছিলো, ভোটকেন্দ্রে
জনগণকে ফিরিয়ে আনা। বিএনপি ছাড়াও যে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব তা
প্রমাণ করা। এজন্য এই সব উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নানা রকম চেষ্টা করেছে। ২০১৮’র নির্বাচনের
পর সবধরণের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য ছিলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন।
অধিকাংশ স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সফল হয়েছে। তবে, জাতীয় সংসদের নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ নানা বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। লক্ষনীয় ব্যাপার যে, যেখানে আওয়ামী
লীগের প্রার্থী যেরকম ছিলেন, নির্বাচনও হয়েছে তেমন।
এই যেমন নেত্রকোনা-৪ আসনের কথাই ধরা যাক। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রেবেকা
মোমেনের মৃত্যুতে এই আসন শূন্য হয়। এই আসনে নির্বাচন করার মতো জনপ্রিয় প্রার্থী ছিলেন
বেশ ক’জন। এদের মধ্যে জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শফী আহমেদ, দীর্ঘদিন মাটি কামড়ে
এলাকায় পরেছিলেন। একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবীদ। তৃণমূল থেকে উঠে আসা তুখোড় ছাত্রনেতা
শফী আহমেদ। কিন্তু তাকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগ পছন্দ করে একজন সাবেক আমলাকে।
সাজ্জাদুল হাসান, মেধাবী আমলা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের
সচিব এবং সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ‘চুক্তি ভিত্তিক’ নিয়োগের মহামারীর
মধ্যে তিনি সংক্রমিত হননি। ৫৯ বছরে অবসর নেন, নির্বাচন করার জন্যই। চাকরী থেকে অবসরে
যাওয়ার পরপরই তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। অবশ্য চাকরীতে থাকা অবস্থাতেই
তিনি ‘নির্বাচন কেন্দ্রিক’ উন্নয়নে নিবিড় মনোযোগী ছিলেন। এলাকায় চাউর হয়েছিল যে,
রেবেকা মোমেনের পর সাজ্জাদুল হাসানই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন। কাজেই তার
মনোনয়ন প্রাপ্তি কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিলো না। ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে নানা অস্বস্তি
এবং বিতর্কের প্রেক্ষাপটে নেত্রকোনা-৪ আসন ছিলো আওয়ামী লীগের জন্য এখন পর্যন্ত শেষ
পরীক্ষা। সবাই আশা করেছিলেন, এখানে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ দেখিয়ে
দেবে। একটি উপ-নির্বাচনে জনগণ ভোট উৎসব দেখবে। বিশেষ করে ঢাকা-১৭ তে এগারো ভাগ ভোটের
সমালোচনার জবাব হবে নেত্রকোনা-৪ আসনের উপ-নির্বাচন। কিন্তু এই উপ-নির্বাচন হবার আগেই
শেষ হয়ে গেল। আবার আমরা ‘আমলা’ কারিশমা দেখলাম। নেত্রকোনা-৪ আসনে একমাত্র আওয়ামী
লীগের প্রার্থী ছাড়া আর কেউ মনোনয়ন জমা দেননি। ফলে ২৪ জুলাই নিশ্চিত হয়ে গেল ভোট
ছাড়াই এমপি হচ্ছেন সাবেক আমলা। কদিন আগে জাতীয় পার্টি বলেছিল, তারা সব উপ-নির্বাচনে
অংশগ্রহণ করবে। কোথায় তারা? অন্যান্য দলের প্রার্থীরা কেন মনোনয়ন পত্রই জমা দিলেন
না? একটি নির্বাচনী এলাকায় একজনও স্বতন্ত্র প্রার্থী পাওয়া গেল না? আমি জানি, অনেকেই
বলবেন, মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে সংসদের একটি উপ-নির্বাচনের জন্য প্রার্থী না থাকারই
কথা। বেশ ভালো কথা। কিন্তু এই নির্বাচন তো আওয়ামী লীগের জয় লাভের জন্য জরুরী ছিলো
না। এই নির্বাচন ছিলো আওয়ামী লীগের ‘ভোট ব্যাংক’ যাচাইয়ের নির্বাচন। দেশে গড়ে ৩০
থেকে ৪০ শতাংশ ভোট আছে আওয়ামী লীগের। নেত্রকোনা-৪ আসনটি ঐতিহ্যগত ভাবে আওয়ামী লীগের।
তাই এখানে ‘ভোট উৎসব’ করা আওয়ামী লীগের জন্য ছিলো সহজ কাজ। আমি বিশ্বাস করতে চাই না,
সাবেক আমলা কলা-কৌশল করে অন্য প্রার্থীদের ভোটে দাঁড়াতে নিরুৎসাহিত করেছেন। কিন্তু
আমি মনে করি, একজন প্রার্থীকে দাঁড় করানো আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন কাজ ছিলো না। বিনা
যুদ্ধে যদি রাজ্য জয় করা যায়, তাহলে কি দরকার শক্তি ক্ষয়। সম্ভবত এই তত্ত্বই আওয়ামী
লীগের প্রার্থীকে অনুপ্রাণিত করেছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
জন্য তিনি তার শ্রম ও রশদ মজুত রাখলেন। কিন্তু এতে আওয়ামী লীগের লাভ হলো না ক্ষতি?
‘বিনা ভোট’ সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ঐ নির্বাচনে
অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এনিয়ে আওয়ামী লীগকে
সমালোচিত হতে হয় আজো। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে ভোট ছাড়াই এমপি হবার সুযোগ
তৈরী হয়। এটা আবার প্রমাণ হলো নেত্রকোনা-৪ আসনে। একজন সাবেক আমলা সংসদে বসলেন বটে।
কিন্তু নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সমালোচনা একটু হলেও বাড়লো। আমলাতন্ত্রের
একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো তারা সমস্যার গভীরে যান না। সমস্যাটাকে আড়াল করেন। এক্ষেত্রে
তাই হলো। সমস্যাটা উপ-নির্বাচনে জয়ী হওয়া নয়। আরো একটি আসন প্রাপ্তি নয়। নির্বাচন
ব্যবস্থাকে জনবান্ধব করা। আমলারা সব সময় শুধু নিজের স্বার্থটুকু দেখেন। নিজের লাভের
বাইরে তারা রীতিমতো অন্ধ। নেত্রকোনা-৪ উপ নির্বাচনের ভোট অপমৃত্যু তার সর্বশেষ উদাহারণ।
আমলা ছাড়াও বিগত উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আগ্রহ ছিলো সুশীল, ব্যবসায়ী এবং পেশাজীবীদের
প্রতিও। ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগ বেছে নেয় একজন তরুণ সুশীল বুদ্ধিজীবীকে। মোহাম্মদ
এ আরাফাত, একজন শিক্ষক। টকশোতে চমৎকার কথা বলেন। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার জবাব দেন
নিত্যনতুন যুক্তিতে। দেশের সুশীল সমাজের বড় একটি অংশ যখন আওয়ামী বিরোধী। তখন উজ্জ্বল
ব্যতিক্রম আরাফাত। এক্ষেত্রেই তিনি আরো আলো ছড়াতে পারতেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের
পক্ষে এরকম বহু বুদ্ধিজীবী আছেন যারা সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করেও মুক্তিযুদ্ধে
নেতৃত্বদানকারী দলটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ৭৫ পরবর্তী সময়ে এই সব জাতির
বিবেকরাই ‘জাতির পিতা’ আদর্শকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে নিয়ে
আসা হলো মূলধারা রাজনীতিতে। দেয়া হলো কেন্দ্রীয় কমিটির পদ। গুলশান—বনানীর মতো এলিট
আসনে উপ-নির্বাচনে প্রার্থী করা হলো। কিন্তু এই উপ-নির্বাচন এখন আওয়ামী লীগের গলার
কাঁটা। এনিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমাদের সাথে বিতর্কে ছড়িয়েছে।
১১ দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে বকে দিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এই উপ নির্বাচন
এখন আন্তর্জাতিক বিতর্কে পরিণত হয়েছে। এর আগে ধানমন্ডির মতো আরেক স্পর্শকাতর আসনে
এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মনোনয়ন দিয়েও আওয়ামী লীগ অস্বস্তিতে পরেছিল। কেউ প্রশ্ন
করতেই পারেন, রাজনীতিবীদদের মনোনয়ন দিলে কি লাভ হতো? এর উত্তরে অনেক উদাহারণ দেয়া
যায়। আমি শুধু গাইবান্ধা-৫ আসনের উদাহারণ দেবো। গত বছরের ২৩ জুলাই ডেপুটি স্পীকার
এডভোকেট ফজলে রাব্বী মৃত্যুবরণ করলে এই আসনটি শূন্য হয়। আওয়ামী লীগ এই আসনে মনোনয়ন
দেয় ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতা মহামুদ হাসান রিপনকে। রাজপথে আন্দোলন করা, তৃণমূল থেকে
বেড়ে ওঠা একজন পরিশ্রমী কর্মী। গত বছরের ১২ অক্টোবর প্রথম দফায় নির্বাচন হয়। কিন্তু
নানা অনিয়মের অভিযোগে সেই ভোট বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। ৪ জানুয়ারি নতুন করে ভোটের
তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সেই ভোটে ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী শক্তিশালী
জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়ী হন। এই উপ-নিবার্চন প্রসঙ্গে উত্থাপন করলাম
একারণে যে, ঐ উপ-নির্বাচন নিয়েও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে চর্চা হয়েছিল। নির্বাচন
কমিশনের সাহসী ও নিরপেক্ষ ভূমিকা সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। প্রথমবারের মতো, আন্তর্জাতিক
মহল নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় নিয়েছিল। নির্বাচন ছিলো উৎসব মুখর। এরকম বহু উদাহারণ
দেয়া যায়, যেখানে ত্যাগী, পরীক্ষিত পোড় খাওয়া রাজনীতিবীদরা প্রার্থী হয়ে ভোটের
বিবর্ণতা কাটিয়েছেন। আর সুশীল, ব্যবসায়ী কিংবা পেশাজীবীরা নির্বাচনকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ
করেছেন।
আগামী নির্বাচন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন একদিকে যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হবে। তেমনি নির্বাচন হতে হবে উৎসব মুখর, অংশগ্রহণমূলক। বিএনপি অংশগ্রহণ করুক না করুক, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতেই হবে। বিএনপি যদি শেষ মুহুর্তে নির্বাচনে অংশ নেয়, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পরতে হবে। বিএনপি অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগের জন্য রয়েছে ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের’ চ্যালেঞ্জ। দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আওয়ামী লীগকে আস্থা রাখতে হবে রাজনীতিবীদদের উপরই। প্রায়ই শোনা যায়, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নে আওয়ামী লীগ চমক দেখাবে। এই চমক যে প্রার্থী তালিকায় আমলা, ব্যবসায়ী, হাইব্রীড, সুবিধাবাদী, সুশীলদের প্রাধান্য সৃষ্টি না করে, তা লক্ষ্য রাখতে হবে নীতিনির্ধারকদের। নির্বাচনকে জনগণের উৎসবে পরিণত করতে পারে একমাত্র রাজনীতিবীদরাই। এমনিতেই সংসদ এখন প্রায় ব্যবসায়ীদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে। আমলারাও এবার সংসদে আসতে মরিয়া। এরকম প্রেক্ষাপটে কোনঠাসা রাজনীতিবীদদের লাইমলাইটে আনাটা আগামী নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিতে রাজনীতিবীদদের কতৃর্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেই নিবার্চন হবে বিতর্কহীন, গণতন্ত্র রক্ষা পাবে, দেশ বাঁচবে।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত
হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী
লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা
যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন
তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই
তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী
আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন
কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী
হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে
৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের
নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির
আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন
যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হবে?
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী
লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী
দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে
তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন,
তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত
কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের
মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত
কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।