যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা গেছে ১৪ আগস্ট। দেলু রাজাকারের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে ছোটখাটো একটা ভূমিকম্প হয়েছিল। এ যুদ্ধাপরাধীর সাঙ্গোপাঙ্গরা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ওই রাজাকারের মৃত্যুজনিত বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। যেমনটি করেছিল ২০১৩ সালে। তখন চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে—এরকম গুজব ছড়িয়ে সারা দেশে তাণ্ডব চালিয়েছিল ধর্মব্যবসায়ীরা। ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। এভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজ তারা সবসময় করে থাকে। এবার ভূমিকম্পের গুজব তেমন কাজে দেয়নি বটে, কিন্তু এ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পরও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে নীরব ভূমিকম্প লক্ষ করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে সাঈদী-প্রেমে আসক্তদের সংখ্যা দেখে আওয়ামী লীগের নেতারাই বিস্মিত, হতবাক। সাঈদীর মৃত্যুর পর তারা শোকাহত হয়ে নানারকম শোকবার্তা দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শনিবার (২৬ আগস্ট) পর্যন্ত এ সংখ্যা হাজার পেরিয়েছে। আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘এত জামায়াত আওয়ামী লীগে ঢুকল কীভাবে?’ শুধু এই নেতা নন, আওয়ামী লীগে ‘সাঈদীর মুরিদ’ সংখ্যা দেখে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন এমন মানুষ হতাশ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাঙালির প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তখনো এ অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের হৃদয়ে পাকিস্তান। ধর্মের ভিত্তিতেই দুটি দেশ আলাদা হয়েছে। মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাকিস্তান মোহ জাঁকিয়ে আছে তখনো। তাই সংগঠনের নাম রাখা হয়েছিল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। যদিও এ সংগঠনটি শুরু থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দ্রুত জনপ্রিয় হয় আওয়ামী লীগ। মুসলিম লীগের দুঃশাসনের কারণে এ অঞ্চলের জনগণের মোহভঙ্গে সময় লাগেনি। খুব দ্রুতই আওয়ামী লীগ জনগণের প্রাণের সংগঠনে পরিণত হয়। এ দেশের জনগণও বুঝতে পারে, পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের নয়। তারা আসলে স্বাধীন হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের পরাধীনতার নতুন শেকলে বন্দি হয়েছে মাত্র। বঙ্গবন্ধু তো ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের স্বপ্ন এঁকেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ বাদ দেওয়া হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিকশিত হয় আওয়ামী লীগ। এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন একটি বার্তা। এ ভূখণ্ড প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র মৌলবাদীদের নয়। মুসলিম বাদ দিয়ে এটি জানিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান। আমরা সবাই বাঙালি’—এ স্লোগানেই আওয়ামী লীগ এ দেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, উজ্জীবিত করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি ও সম্পদ। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ।’ (সূত্র : শেখ মুজিব, বাংলাদেশের আরেক নাম, ড. আতিউর রহমান, পৃষ্ঠা : ২৪৯)
কিন্তু
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট
সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়। জাতির
পিতাকে হত্যার পর শুরু হয়
বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে সমাজে, রাজনীতিতে
এবং রাষ্ট্রে। ধর্মব্যবসায়ীরা মাঠে নামে। স্বাধীনতাবিরোধী
উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতির মাঠে আবার নামানো
হয়। রাজনীতি এবং ধর্মের বিষাক্ত
ককটেল দূষিত করে সরকার এবং
রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। ‘আওয়ামী লীগ ইসলামের শত্রু’,
‘নাস্তিকতাকে লালন করে’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা
মানে ধর্মহীনতা’—এসব কুৎসিত প্রচারণা
হতে থাকে অবিরত আওয়ামী
লীগের বিরুদ্ধে। এ সময় অস্তিত্বের
সংকটে থাকা আওয়ামী লীগকে
সমঝোতা করতে হয়। পিছু
হটতে হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে
আড়াল করে আওয়ামী লীগও
নিজেদের ‘সাচ্চা মুসলমান’ প্রমাণে আদাজল খেয়ে নামে। তোমার
আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনার বদলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ,
নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’—এমন
ধর্মভিত্তিক স্লোগান জনপ্রিয় হয় আওয়ামী লীগে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ঘটা করে ধর্মচর্চার
রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ভোটের
জন্য আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের ধার্মিক প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আওয়ামী
লীগে সাম্প্রদায়িক শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে। ২০০৮ সালের
নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগে
নানা মতলবে নানা ধরনের মানুষের
প্রবেশ ঘটতে থাকে। ২০০৯
সালে দল শেখ হাসিনার
নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার
দায়িত্ব পায়। আওয়ামী লীগ
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করেছিল। দেশের সাধারণ ভোটাররা তাদের এ অঙ্গীকারকে সমর্থন
জানায় বিপুলভাবে। সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। অসীম সাহসের সঙ্গে
তিনি ’৭১-এর বর্বর
খুনি, ধর্ষকদের আইনের আওতায় আনেন। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকারদের বিচার
শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনালে। একে একে আইনি
প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এদের বিচারের রায়ও
কার্যকর করা হতে থাকে।
এ সময়ই খুবই নীরবে
ঘটে আওয়ামী লীগের বড় সর্বনাশ। হুহু
করে আবর্জনার মতো আওয়ামী লীগে
প্রবেশ করে নানা সুবিধাবাদী,
দুর্বৃত্ত, লুটেরা এবং জামায়াত-শিবিরের
ক্যাডাররা। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আওয়ামী লীগে ঢুকেছে দুই
কারণে। প্রথমত পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগকে দূষিত করতে। দ্বিতীয়ত এ সময় যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বহু
জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার সহিংসতা করে। গাড়ি ভাঙচুর,
অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাস করে। এদের বিরুদ্ধে
দেশের বিভিন্ন স্থানে সুনির্দিষ্ট মামলা হয়। মামলা থেকে
বাঁচার জন্য এসব ধর্মান্ধ
রাতারাতি আওয়ামী লীগ বনে যায়।
আওয়ামী লীগে জামায়াত-শিবিরের
অনুপ্রবেশ প্রথম অনুভূত হয় ছাত্রলীগে। প্রয়াত
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম
এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ
খুলেছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
ছাত্রলীগের স্থানীয় পর্যায়ে তো বটেই, কেন্দ্রীয়
নেতৃত্বেও শিবিরের ক্যাডাররা ঢুকে পড়ে। ২০১৫
সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি দলে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে
প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এদের দল থেকে
বের করে দেওয়ার নির্দেশও
দেন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের উদ্যোগে সারা দেশে প্রায়
৭৬ হাজার বিতর্কিত অনুপ্রবেশকারীর তালিকা তৈরি করা হয়।
কিন্তু অজানা কারণে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নেওয়া সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগে নানাভাবে সাম্প্রদায়িক
শক্তির ঘাঁটি শক্ত হতে থাকে।
এদের একটি অংশ ‘আওয়ামী
ওলামা লীগ’ গঠন করে
প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে থাকে। ২০১৬ সালে আওয়ামী
লীগের মূলনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয় ওলামা লীগ।
ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে বিতর্কিত সংগঠনটি।
এ মানববন্ধনে পাঠ্যপুস্তক বাতিলের দাবি তোলা হয়।
ওই বছরের ১০ এপ্রিল জাতীয়
প্রেস ক্লাবের সামনে আরেক মানববন্ধনে ওলামা
লীগের একাংশ বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখকে
‘ইসলামবিরোধী ও হারাম’ বলে
ঘোষণা করে। ২০১৭ সালের
৪ মার্চ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন বাতিলসহ চার
দফা দাবি তোলে। এ
সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা ওলামা লীগের কার্যক্রমে বিরক্ত হন। তাদের সাংগঠনিক
কার্যক্রমে বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যেই
২০১৯ সালে ‘আওয়ামী ওলামা লীগ’ বিপিএলকে (ক্রিকেট
ফ্র্যাঞ্চাইজি) ইসলামবিরোধী বলে ফতোয়া দিয়ে
তা বাতিলের দাবি করে। এ
অবস্থায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়—‘ওলামা
লীগের কার্যক্রম আওয়ামী লীগের নীতিবিরোধী।’ তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে
সরকারকে আহ্বান জানানো হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা জামায়াত আবার
ওলামা লীগকে সক্রিয় করেছে। গত ২০ মে
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী ওলামা লীগের প্রথম ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়। যে সংগঠনের
বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি
দাবি জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে দপ্তর সম্পাদক,
সেই ‘বিতর্কিত’ ‘সাম্প্রদায়িক’ সংগঠনের সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। যিনি ২০১৯ সালে
ওলামা লীগকে আওয়ামী লীগের নীতিবিরোধী বলে চিহ্নিত করেছিলেন।
তিনিও সেই সম্মেলনে উপস্থিত
ছিলেন। এভাবেই ধীরে ধীরে আওয়ামী
লীগে ‘জামায়াত লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এর মৃদু কম্পন অনুভূত
হচ্ছে এখন। দেলু রাজাকারের
মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের
ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা নব্য
রাজাকাররা আর মুখোশ পরে
থাকতে পারছেন না। তারা সাঈদীর
জন্য শোকার্ত। তাদের সমবেদনার ভাষা এমন যে,
জামায়াতের নেতারাও সম্ভবত লজ্জা পাবেন। আমি ছাত্রলীগের সভাপতি
সাদ্দাম হোসাইনকে ধন্যবাদ দিতে চাই। আমি
বেশ কিছুদিন ধরেই তার মেধা,
দৃঢ়তা এবং চেতনার ভক্ত।
আওয়ামী লীগে সাঈদীকে নিয়ে
শোকের মাতমের মধ্যে সাদ্দাম পথ দেখালেন। অতীতে
যেভাবে ছাত্রলীগ পথ দেখিয়েছে, এবারও
ছাত্রলীগ সেই ঐতিহ্যে উদ্ভাসিত
হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রলীগের যারাই সাঈদীর জন্য শোক ও
সমবেদনা জানিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে
তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা
হচ্ছে। এটা সঠিক এবং
সাহসী সিদ্ধান্ত। ছাত্রলীগের পথ অনুসরণ করে
আরও কয়েকটি অঙ্গ ও সহযোগী
সংগঠন এরকম ‘সাঈদী প্রেমিক’দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী
লীগের অন্য সহযোগী অঙ্গ
সংগঠনগুলোকে ছাত্রলীগের মতো সদাজাগ্রত এবং
কঠোর হতে হবে। তা
না হলে জামায়াত একদিন
আওয়ামী লীগকেই গ্রাস করে ফেলবে। তবে
ধর্মব্যবসায়ী অনেক চতুর ও
ধুরন্ধর। এদের মধ্যে অনেকেই
এখনো নীরব। ছাত্রলীগের সাহসী পদক্ষেপের পর, এরা অনেকে
নিজেদের সংযত রেখেছে। মনের
গোপন বেদনা প্রকাশ করেনি। এদেরও চিহ্নিত করতে হবে। তা
না হলে সামনে এরা
আরও বড় সর্বনাশ করবে।
টানা ১৫ বছর ক্ষমতায়
আছে আওয়ামী লীগ। এ সময়ে
শুধু সংগঠনেই ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। প্রশাসনেও এরা শক্ত অবস্থান
করে ফেলেছে। এরাও মুখোশধারী। এরা
কেউ শিবির করেছে ছাত্রজীবনে। কেউ রাজাকারের উত্তরাধিকার।
এরা এখন নব্য আওয়ামী
লীগ সেজে প্রশাসনের অনেক
গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসে আছে। দেলু
রাজাকারের মৃত্যুর পর আমরা এদেরও
কারও কারও শোকের মাতম
দেখেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এখানেও বেশি চালাকরা তাদের
কষ্ট গোপন রেখেছে। এদের
কারণেই বাংলাদেশের আবার একটি সাম্প্রদায়িক
চেহারা দেখা যাচ্ছে। ২০১৩
সালের মে মাসে হেফাজত
যে তাণ্ডব করেছে, তার বিচার হয়
না কেন? নিবন্ধনহীন ফ্যাসিস্ট
জামায়াত কেন আবার সমাবেশ
করার অনুমতি পায়? সরকারকে এসব
সিদ্ধান্ত নিতে কারা প্ররোচিত
করে? তাদের খুঁজে বের করাটা জরুরি।
সেটা যদি না করতে
পারি তাহলে প্রশাসনে এবং আওয়ামী লীগের
ভেতরে থাকা নব্য জামায়াত
দেশটাকে আবার একটা মৌলবাদী
রাষ্ট্র বানাবে। ভেতর থেকে মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা, আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি সব তছনছ করবে।
আওয়ামী লীগ যদি তার
ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা
থেকে সরে যায়, তাহলে
আর এটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের
সংগঠন থাকবে না। প্রশাসন যদি
জামায়াত আর নব্য রাজাকারদের
নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাহলে
বাংলাদেশ আর জাতির পিতার
স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ হবে না। সাঈদীর
মৃত্যু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
মুখে মুখে বঙ্গবন্ধু আর
জয় বাংলা বললেই আওয়ামী লীগ হওয়া যায়
না। এ জন্য আদর্শ
লাগে। গত ১৫ বছর
আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ
হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারায় ব্যস্ত।
আদর্শের চর্চা নেই। অধ্যয়ন, পাঠচক্র
তো এখন নির্বাসিত। আওয়ামী
লীগে এখন নব্য রাজাকাররা
‘জামায়াত লীগ’ করেছে। এই
‘জামায়াত লীগে’র শিকড়
উৎপাটন করতে হবে এখনই।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত
হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী
লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা
যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন
তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই
তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী
আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন
কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী
হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে
৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের
নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির
আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন
যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হবে?
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী
লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী
দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে
তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন,
তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত
কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের
মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত
কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।