ডিসেম্বর, ১৯৯৮। দৈনিক সংবাদ ভেতরের পাতায় ছোট্ট একটি খবর—‘গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের কিস্তি না দিতে পেরে আত্মহত্যা করলেন এক কৃষক।’ যশোরের শার্শার ঘটনা। ’৯৮-এর বন্যায় সব ভেসে যায়। এ অঞ্চলের অনেক কৃষকই গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছিলেন। নতুন ফসল উঠলেই তা বিক্রি করে সুদসহ ঋণের টাকা শোধ করবেন, এ আশায়। কিন্তু প্রলয়ংকরী বন্যা সবকিছু তছনছ করে দেয়। কৃষকরা গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসে যান। অন্তত বন্যার সময়টুক যেন কিস্তির টাকা গ্রহণ বন্ধ থাকে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের উপজেলা অফিস জানিয়ে দেয়, এটা তাদের ক্ষমতার বাইরে। বন্যাদুর্গত সর্বস্বান্ত মানুষগুলোর ওপর কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়ে। শুধু যশোর নয়, সারা দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা এক ভয়ংকর সংকটে পড়েন। অনেক এলাকার স্থানীয় সংসদ সদস্যরা বিষয়টি অর্থমন্ত্রীর নজরে আনেন। অর্থমন্ত্রী সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, সব এনজিওকে বন্যার সময় কিস্তির টাকা মওকুফ অথবা আপাতত গ্রহণ না করার নির্দেশ দেন। আশা, প্রশিকাসহ বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সরকারের নির্দেশ প্রতিপালন করে। তারা বন্যার সময় এক মাসের সুদ মওকুফ করে। কিস্তির টাকা গ্রহণ দুই মাস স্থগিত করে। কিন্তু ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ সরকারের ওই সিদ্ধান্ত মানতে অপারগতা প্রকাশ করে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার বিবরণ দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে সরকারের সিদ্ধান্ত বা জবাবের অপেক্ষা না করেই আগের নিয়মে কিস্তি আদায় অব্যাহত রাখার জন্য সব আঞ্চলিক অফিসে চিঠি পাঠায় গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এ সময় কিস্তি আদায়ের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্যোগে গঠন করা হয় বিশেষ টিম (বাহিনী)। এলাকার ক্ষমতাবান, পেশিশক্তি আছে এমন তরুণদের এ টিমে নেওয়া হয়। এরা ঋণগ্রহীতাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রথমে হুমকি দিতে শুরু করে। এরপর বাড়ির টিনের চাল কিংবা অন্যান্য আসবাবপত্র জোর করে কেড়ে নেয়। এতেও কাজ না হলে কিস্তি আদায়ে শারীরিকভাবে নির্যাতনের পথ বেছে নেওয়া হয়। আর মামলা তো আছেই। ’৯৮-এর আগস্ট থেকে ’৯৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক কিস্তি আদায়ের জন্য সারা দেশে প্রায় ১৩ হাজার সার্টিফিকেট মামলা করে। এসব মামলায় অন্তত দুই শতাধিক দরিদ্র কৃষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এদের কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো থানায় ও আদালতে। দেখে মনে হতো দুর্ধর্ষ অপরাধী। এ সময় গ্রামীণ ব্যাংকের অত্যাচার থেকে বাঁচতে অনেক কৃষক নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যান। রুস্তম মণ্ডল এরকম কিস্তি নিষ্পেষণের নির্মম শিকার। সংবাদের ওই খবরে বলা হয়েছিল, রুস্তম মণ্ডলের পাঁচটি সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা বাকি পড়েছিল। কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তার বিরুদ্ধে মামলা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। উপায়ান্ত না দেখে রুস্তম মণ্ডল আত্মহত্যা করেন। তিনি একা নন, বন্যা-পরবর্তী ওই কঠিন সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে বেশ কজন কৃষক আত্মহত্যা করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিষয়টি জাতীয় সংসদে ‘পয়েন্ট অব অর্ডারে’ উত্থাপন করেছিলেন তরুণ সংসদ সদস্য মির্জা আজম। তিনি বলেছিলেন, ‘২০০ টাকার জন্য একজন কৃষককে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া অমানবিক, অন্যায়।’ তিনি কৃষকদের বিরুদ্ধে এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি করেছিলেন। কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় যারা ‘আত্মহত্যা’ করছেন, তাদের আসলে হত্যা করা হচ্ছে বলেও মির্জা আজম অভিযোগ করেন। জাতীয় সংসদে বিষয়টি উত্থাপিত হওয়ার পর এ নিয়ে হৈচৈ হয়। এ সময় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। বিবৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংক কিস্তি আদায়ের জন্য কৃষকদের ওপর হয়রানি অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে। বিবৃতির শেষে এসে লেখা হয়েছিল, ‘আইন সবার জন্য সমান। কোনো বিশেষ ব্যক্তির জন্য আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই।’ ২৫ বছর পর ওই ঘটনাটি আবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, ড. ইউনূসকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে। গত ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে হয়রানি করা হচ্ছে বলে উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। ১০ দিন গোপন রেখে ‘ইউনূস সেন্টার’ সেই চিঠি প্রকাশ করে ২৭ আগস্ট। সেদিন আবার দেশের সুশীল সমাজের ৩৪ জন এক যুক্ত বিবৃতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সরকারের আচরণে উদ্বেগ জানান। এর পরদিন ১৬০ জন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব (যাদের মধ্যে শতাধিক নোবেলজয়ী) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক খোলা চিঠি পাঠান। বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটনসহ ১৬০ জন বিশিষ্ট বিশ্ব নাগরিক যৌথভাবে লেখা খোলা চিঠিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানান। এর এক দিন পর হিলারি ক্লিনটন এক টুইট বার্তায় ড. ইউনূসের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানান। গভীর মনোযোগ গিয়ে এ বিবৃতি পড়তে পড়তেই আমার চোখের সামনে রুস্তম মণ্ডলের বাড়ির দৃশ্যটা ভেসে উঠল। ১৯৯৮ সালের ওই সময়টাতে আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘পরিপ্রেক্ষিত’ নামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুষ্ঠান করি। সংবাদের খবরের সূত্র ধরে কিস্তির পরিশোধের হয়রানি নিয়ে একটি পর্ব করি। যশোরের রুস্তম মণ্ডলের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি। কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় বাড়ির টিনগুলো সব খুলে নিয়ে গেছে গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন। রুস্তম মণ্ডলের ছোট মেয়েটি বিবর্ণ, ফ্যাকাশে। স্ত্রী হতবিহ্বল, শোকে কাতর। যশোরে গ্রামীণ ব্যাংকের আঞ্চলিক ম্যানেজার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই।’ আমি ড. ইউনূস এবং রুস্তম মণ্ডলকে পাশাপাশি দাঁড় করলাম। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ। আর রুস্তম মণ্ডলের মৃত্যুর পরও কিস্তি আদায়ের মামলা চালিয়ে যাওয়ার আইনি অজুহাত। আসলে কোনটা সঠিক? আইন কি সবার জন্য সমান?
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ তাহলে ড. ইউনূস এবং রুস্তম মণ্ডলের জন্য দুই রকম নীতি কেন?
প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট আমিনুল হক এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো লড়তেন। যেদিন তিনি মারা যান, সেদিন সকালেও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানিতে গিয়েছিলেন। একটি দুর্নীতি মামলায় এরশাদের জামিনের বিরোধিতা করতে। এ সময় উত্তেজিত হয়ে যান এ নির্লোভ মানুষটি। বলেন, ‘১০ টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে একজন কৃষকের কোমরে রশি বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পয়সার অভাবে ওই কৃষক আদালতে যেতে পারেন না। আর রাষ্ট্রের কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, বড় উকিল ব্যারিস্টার ভাড়া করে বড় দুর্বৃত্ত আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এটা ন্যায়বিচার নয়।’ আপিল বিভাগ থেকে বেরিয়ে যেতে যেতেই তার হার্ট অ্যাটাক হয়। তিনি মারা যান। ড. ইউনূসকে নিয়ে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির যে মাতম তাতে আমার আবার অ্যাডভোকেট আমিনুল হকের কথাগুলো মনে পড়ল। ড. ইউনূসের পক্ষে ১৬০ জন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোভিত্তিক জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ‘সিজিয়ন পিআর’ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ এই ১৬০ জন ব্যক্তিকে একটি জনসংযোগ ফার্ম এ বিবৃতিতে স্বাক্ষরের জন্য প্ররোচিত করেছে। ‘সিজিয়ন পিআর’ বিশ্বের অন্যতম একটি খ্যাতিমান জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি অর্থের বিনিময়ে যে কোনো ব্র্যান্ড, কোম্পানি, সংস্থা বা ব্যক্তির কৌশলগত প্রচারণা করে। প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বব্যাপী ১৭০টি দেশে শাখা রয়েছে। ৪০টি ভাষায় তারা জনসংযোগ করে। এক হাজারের বেশি গ্রাহকের ইমেজ বৃদ্ধির কাজ করে এ প্রতিষ্ঠানটি। আমার প্রশ্ন হলো, ড. ইউনূসের পক্ষে এরকম একটি বিবৃতি তৈরি তাতে এত বিশিষ্টজনের স্বাক্ষর গ্রহণের দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে? এ জন্য ব্যয় হয়েছে কত? এর আগেও ড. ইউনূসের পক্ষে ৪৬ জনের একটি বিবৃতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বিজ্ঞাপন প্রচারের কয়েক কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। ড. ইউনূস কি টাকা দিয়ে বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছেন? তিনি কি আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছেন? ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না কেন? তিনি কি প্রচলিত আইন, বিচারের ঊর্ধ্বে? এর আগেও একাধিক মামলায় লড়েছিলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী এ অর্থনীতিবিদ। সেসব মামলা করেছিলেন ড. ইউনূস নিজেই। বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণে, তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অবসর দেওয়া হয়েছিল। সরকারের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তখন আদালতের প্রতি তার আস্থা ছিল। এখন নেই কেন? ওই মামলায় অবশ্য ড. ইউনূস হেরে যান। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সরকারের অবসর প্রদানসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বৈধ ঘোষণা করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ড. ইউনূস তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা ‘ইউনূস ট্রাস্টে’ দান করেন। এনবিআর এ সময় তার কাছে ১৫ শতাংশ দানকর দাবি করে। ড. ইউনূস এই দানকর দিতে অস্বীকৃতি জানান। এনবিআরের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত ৩১ মে তিনটি আয়কর রেফারেন্স মামলায় ড. ইউনূস হেরে যান। মামলায় রায় মেনে নিয়ে ১২ কোটিরও বেশি টাকা তিনি পে-অর্ডারের মাধ্যমে এনবিআরে জমা দেন। এখন শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকরা মামলা করেছেন। ড. ইউনূস এ মামলা আদালতের বাইরে টাকাপয়সা দিয়ে মিটমাট করতে চেয়েছিলেন। টাকা লেনদেনও হয়েছিল অবৈধ পন্থায়। এ নিয়েও মামলা সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে এ মামলা এখন শ্রম আদালতে চলছে। ড. ইউনূস মামলা করলে ঠিক আছে, অসুবিধা নেই। কিন্তু শ্রমিকরা মামলা করলে সমস্যা? এটা কোন ধরনের ন্যায়বিচার। আমি বিশ্বাস করি, ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা স্থগিত করার আবেদনে যারা স্বাক্ষর করেছেন, তারা অধিকাংশই এ সম্পর্কে বিন্দু বিসর্গও জানেন না। তাদের ভুল বুঝিয়ে এ ব্যাপারে প্ররোচিত করা হয়েছে। সাবেক মার্কিন ফার্স্টলেডি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ড. ইউনূসের প্রতি আলাদা পক্ষপাত আছে। সবসময়ই তিনি ড. ইউনূসের জন্য বিশেষ কিছু করতে উৎসাহী হন। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে যখন তাকে (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) অবসর দেওয়া হয়, তখন হিলারি সব প্রটোকল লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। এবারও তার টুইটার বার্তা আক্রমণাত্মক। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় আইনের শাসনের কথা বলে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থে তারাই আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। সারাক্ষণ মানবাধিকারের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা না দেওয়া যে মানবাধিকার লঙ্ঘন, এটি তারা মানে না। তাহলে আইনের শাসন মানে কি ড. ইউনূসের মতো মার্কিন অনুগত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেওয়া।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল : poriprekkhit@yahoo.com
ড. ইউনূস রুস্তম মণ্ডল আইনের শাসন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত
হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী
লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা
যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন
তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই
তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী
আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন
কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী
হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে
৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের
নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির
আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন
যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হবে?
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী
লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী
দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে
তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন,
তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত
কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের
মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত
কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।