বাংলাদেশ এখন কারা চালাচ্ছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই হয়তো নানা ধরনের মত দেবেন। কেউ বলবেন, এটা আবার কোন ধরনের প্রশ্ন? আওয়ামী লীগই দেশ চালাচ্ছে গত ১৫ বছর ধরে। সামনের পাঁচ বছর আওয়ামী লীগই দেশ চালাবে। আওয়ামীবিরোধী গোষ্ঠীরা বলবে, বিদেশি প্রভুরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে। আসলে দেশ চালাচ্ছে তারাই। ক্ষমতাহীন রাজনীতিবিদরা বলবেন, দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। তাদের হাতেই সব কলকাঠি। মন্ত্রী, এমপিরাই সব অলংকার। আর আমলারা বলবেন, দেশ চালাচ্ছেন চুক্তিতে থাকা এক ডজন আমলা। একটা সিন্ডিকেট। প্রশাসনের সব শীর্ষ পদ এই চুক্তিভিত্তিক আমলারা দখল করেছেন, তারাই দেশ চালান এখন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। আর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব থাকার কথা। কিন্তু আপনি বাংলাদেশ কীভাবে চলছে, তা যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে দেখবেন, দেশ চলছে আসলে চুক্তিতে। চুক্তিতে থাকা কতিপয় দেবদূতই এখন এ রাষ্ট্রের ভাগ্য বিধাতা। প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ এখন চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তাদের দখলে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব থেকে রাজউকের চেয়ারম্যান। মুখ্য সচিব থেকে এনবিআরের চেয়ারম্যান—সব চুক্তির দখলে। শুধু আমলা কেন? কোথাও কোথাও চুক্তি যেন আমৃত্যু ঠিকাদারি। ওয়াসার এমডির চুক্তি শেষ হবে না কোনোদিন। চুক্তি থেকে মুক্তি নেই নিউরো অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের। এরকম উদাহরণের অভাব নেই।
একটি রাজনৈতিক সরকারের সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য থাকে। যেসব লক্ষ্য নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশ করা হয়। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নই একটি সরকারের প্রধান কাজ। আর এ কাজে মূল চালিকাশক্তি হলো প্রশাসন। একটি সরকার প্রশাসনের মাধ্যমেই তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে। এ কারণে যে কোনো শাসনব্যবস্থায় প্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনকে বলা হয় সরকারের হৃৎপিণ্ড। প্রশাসনের মাধ্যমে একটি সরকারের অভিপ্রায় সঞ্চারিত হয় তৃণমূল পর্যন্ত। প্রশাসন যত দক্ষ, দায়িত্বশীল এবং সচল থাকে সরকারও তত সফল হয়। সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে প্রশাসনের তাল মেলানোটা তাই অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসন যদি সরকারের লক্ষ্য অর্জনে ঠিকঠাকভাবে কাজ না করে, তাহলে সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়। এ কারণে রাজনৈতিক সরকার এমন প্রশাসন চায় যারা সরকারের আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হয়। সরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জানে ও বোঝে।
এজন্য সব গণতান্ত্রিক দেশে আমলাতন্ত্রকে এখন ঢেলে সাজানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পুরোপুরি রাজনৈতিক। প্রেসিডেন্ট বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন আপাদমস্তক বদলে যায়। আগামী নির্বাচনে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হন, তাহলে বাইডেনের সময়ে নিযুক্ত কর্মকর্তারা বিদায় নেবেন। ব্রিটিশ প্রশাসন রক্ষণশীল। সরকার পরিবর্তন হলেও প্রশাসনে তার আঁচড় খুব একটা পড়ে না। বলা হয়, ব্রিটেনে আমলাতন্ত্রই একমাত্র স্থায়ী। এ উপমহাদেশ প্রশাসন বিন্যাসে ব্রিটিশ ঐতিহ্য ও রীতি ধারণ করেছে। এখানে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে প্রশাসনের পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা আমলাই খুনি মোশতাকের শপথ করিয়েছিলেন। তিনি আবার জিয়ার আমলেও জেল থেকে বেরিয়ে পদাবনতি নিয়ে লজ্জাহীনভাবে চাকরি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে আমলারাই জিয়ার সঙ্গে সাফারি স্যুট আর সানগ্লাস পরে খাল কেটেছেন। তারাই এরশাদের আমলে ক্ষমতাবান ছিলেন। এরশাদের বিশ্বস্ত আমলারাই খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠজন হয়েছেন। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমলারা গিরগিটির মতো রং পরিবর্তন করেন। তবে সব আমলাই চাটুকার এবং ‘যখন যার তখন তার’ নীতিতে চলেন না। আমলাদের মধ্যে কারও কারও রাজনৈতিক চেতনা এবং আদর্শ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রাজনীতি, পারিবারিক পরিচিতি ইত্যাদি নানা কারণে আমলাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা এবং নিজস্ব মত থাকে। অনেকেই তার আদর্শিক অবস্থান পাল্টে ফেলতে পারেন না। একটি সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের পক্ষের লোকজন ভিন্নমতের আমলাদের চিহ্নিত করেন। একটি দল ক্ষমতায় এলে কিছু আমলা ক্ষমতাবান হন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। আবার কেউ কেউ কোণঠাসা হন রাজনৈতিক বিবেচনায়। এসব সত্ত্বেও ১৯৯১ সালের আগে প্রশাসনের দলীয়করণ এবং রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজার সংস্কৃতি খুব একটা ছিল না। ’৯১ সালে নাটকীয়ভাবে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। আমলাতন্ত্রে আওয়ামীবিরোধী গোষ্ঠী রাতারাতি খালেদা জিয়া এবং বিএনপি নেতাদের নৈকট্য অর্জন করেন। বিএনপিতে তখন প্রাক্তন চীনাপন্থিদের দাপট। আমলাদের মধ্যে সাবেক চৈনিক বামরা সহজেই বিএনপির নীতিনির্ধারক হয়ে যান।
এ সময় প্রশাসনে আওয়ামীপন্থিদের খারাপ পোস্টিং, পদোন্নতি না দেওয়ার রীতি শুরু হয়। তবে প্রশাসনে রাজনীতিকরণ চরম আকার ধারণ করে ২০০১ সালে। ২০০১ সালে জুলাইয়ে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে একমুহূর্তে ১৩ সচিবকে বদলি করেন। তখন থেকে আমলাতন্ত্রে যে হিংস্র প্রতিহিংসা এবং দলীয়করণের সূচনা হয়, তা এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে প্রশাসনে আওয়ামী নির্মূল কার্যক্রম শুরু করে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক থাকা কর্মকর্তারা বিএনপি-জামায়াতের রোষানলে পড়েন। সংখ্যালঘু হলে তো কথাই নেই। গোপালগঞ্জে বাড়ি হলে চাকরি থেকেও নেই। তাদের পদোন্নতি আর আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়া যেন একই ব্যাপার। এ সময় আবার কিছু দুষ্টু আমলা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েলের রাজনৈতিক কৌশল নেন। একজন আমলাকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বানিয়ে দিলেই তাকে ল্যাং মারা খুব সহজ হয়ে যায়। এভাবে আমলাতন্ত্রের ভেতর শুরু হয় নোংরা খেলা। প্রশাসনের রাজনীতিকরণ ভয়াবহ রূপ নেয় ‘হাওয়া ভবনে’র মাধ্যমে। পদোন্নতি, ভালো পোস্টিং পেতে ঘুষ দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়। আমলাতন্ত্রে ‘ভাইয়া গ্রুপের’ উদয় হয়। যারা সিনিয়রদের ওপর ছড়ি ঘোরানো শুরু করেন ভাইয়া গ্রুপের পুঁচকে আমলারা। প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। রাজনৈতিক চোরাবালিতে আটকে যায় আমলাদের পেশাদারিত্ব। মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা নয়—আমলাদের পদোন্নতির মাপকাঠি হয় চাটুকারিতা, অতীত রাজনীতি এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে আমলাতন্ত্রে পেশাদারিত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। এ সময়ে প্রশাসনে দলীয়করণ এবং পক্ষপাত প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এখন মেধা যোগ্যতায় তদবির ছাড়া প্রশাসনে নির্বিঘ্নে পদোন্নতি পাওয়া যায়—এটা কেউ বিশ্বাসই করে না। টানা ক্ষমতায় থাকার জন্য এখন প্রশাসনে সবাই আওয়ামী লীগ। কে কার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগ, তা নিয়ে যুদ্ধ হয়। আওয়ামীপন্থি বিপুল আমলার মধ্যে তারাই এগিয়ে যান যারা চাটুকারিতার ঝাড়ফুঁক ভালো জানেন। যে যত বড় চাটুকার, পদোন্নতি তার। সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কলাকৌশল যারা যত বেশি ভালোভাবে রপ্ত করেছেন, তাদের ভালো পদায়ন হয়েছে। আমলাতন্ত্র এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে যেমন অনেক নেতা মেয়াদ শেষ হলেও দায়িত্বে থাকেন, তেমনি প্রশাসনেও আমলারা ৫৯ বছরের অবসরে অনিচ্ছুক। আমলাদের মধ্যে ভাবখানা এখন এমন যে, আওয়ামী লীগ যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, তারাও ততদিন বিভিন্ন পদে থাকবেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কিংবা বিভিন্ন কমিশনে বা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে। প্রশাসনে রাজনীতিকরণের ক্যান্সারের মধ্যেই নতুন ব্যাধি হলো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। এখন একজন সরকারি কর্মকর্তা প্রথমে আওয়ামী লীগ হয়ে (কিংবা আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ হয়ে) দ্রুত বিভিন্ন পদোন্নতি নেন। এরপর সরকারের ঘনিষ্ঠদের কাছে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে ‘সচিব’ হন। তারপর চাটুকারিতার সর্বোচ্চ কসরত দেখিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের যে রীতি, তা একটি বিশেষ ব্যবস্থা। খুব জরুরি এবং অপরিহার্য প্রয়োজন ছাড়া কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়।
ধরা যাক, একজন সচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ওই মন্ত্রণালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলমান। এ ক্ষেত্রে ওই কাজটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ওই সচিবের পদে বহাল থাকাটা জরুরি। এমন ক্ষেত্রেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ মহামারির আকার ধারণ করেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা কর্মকর্তারা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, রাষ্ট্রপতির সচিব, সংসদ সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব, বাণিজ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, এনবিআরের চেয়ারম্যান সবাই চুক্তিতে। এ তালিকায় সম্প্রতি কৃষি সচিবও যুক্ত হয়েছেন। দেশ এখন চলছে চুক্তিতে। একজন নিয়মিত আমলা যখন একটি মন্ত্রণালয়ে প্রশাসনের সচিব পদে থাকেন তখন তার জবাবদিহি থাকে। লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিন্তু চুক্তিতে থাকা একজন কর্মকর্তার জন্য জবাবদিহি মুখ্য বিষয় নয়। তিনি বোনাস চাকরি উপভোগ করেন। চুক্তি পোক্ত রাখতে দেনদরবার করেন, রাজনৈতিক নেতার মতো জ্ঞান বিতরণ করেন। ভবিষ্যতে আবার চুক্তি পেতে কিংবা চুক্তি শেষে নতুন দায়িত্ব পেতে লবিং করেন। এই আমলা মন্ত্রী, এমপিদের পাত্তা দেন না, অধস্তনদের কথা শোনেন না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা কর্মকর্তা আজকের কথাই ভাবেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ভাবেন না। এর ফলে তার কাছ থেকে জনগণ কিছুই পায় না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রশাসনের মধ্যেও একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। একজন ব্যক্তির চুক্তি প্রশাসনে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার পদোন্নতির দরজা বন্ধ করে দেয়। চুক্তিতে থাকা চাটুকারদের জন্য মেধাবী সম্ভাবনাময় কর্মকর্তার পদোন্নতির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসনে উদ্ভাবনী, সৃজনশীলতা এবং মেধার লালন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চুক্তির কারণে। এমন যদি হতো, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন। তার দক্ষতায় দেশের উপকার হয়েছে, তাহলে এর পক্ষে অন্তত একটা যুক্তি থাকত। কিন্তু যারা চুক্তিতে আছেন, তাদের কেউ নিজেদের চাকরি দীর্ঘস্থায়ী ছাড়া দেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারেননি। এই যেমন ধরা যাক, এনবিআরের চেয়ারম্যানের কথা। দ্বিতীয় দফায় তিনি দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। তার চুক্তি কি রাজস্ব আদায়ের সংকট কমাতে পেরেছে? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের চুক্তি কি বাজার অস্থিরতা কমাতে পেরেছে? সবক্ষেত্রেই এরকম প্রশ্ন উঠেছে এখন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে সৃষ্টি করছে হতাশা। তরুণ কর্মকর্তারা হতোদ্যম হয়ে পড়ছেন। যারা চুক্তির জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন, তাদের লক্ষ্য দেশ সেবা নয়, সচিব বা বড় কর্তা হিসেবে আরও কিছুদিন ক্ষমতা উপভোগই তাদের আরাধ্য। চুক্তিতে থাকা আমলারা শেষ চুমুক পর্যন্ত উপভোগ করতে চান, সবকিছু চেটেপুটে খেতে চান। নিজেকে ছাড়া কিছুই ভাবেন না। চুক্তিতে থাকা প্রত্যেক আমলা সরকার এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা এবং দায়। নিজেদের স্বার্থে এরা জনগণের টাকা অপচয় করছেন। সচিবদের প্রায় অর্ধেকই এখন চুক্তিতে। এটা আওয়ামী লীগের নীতিগত অবস্থানের পরিপন্থি।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ঢালাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। আওয়ামী লীগ নিজেই তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, অনেকেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পক্ষে ভিন্ন যুক্তি দেন। বলা হয়, এ দেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩। ৬০ কিংবা ৬৫ বছর বয়সে এখন মানুষ ভালোমতো কর্মক্ষম থাকেন এবং সেবা দিতে পারেন। একজন সরকারি কর্মকর্তার পেছনে রাষ্ট্রের জনগণ বিপুল বিনিয়োগ করে। অথচ যখন তিনি মেধা ও দক্ষতার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হন, তখনই তার অবসরের ঘণ্টা বাজে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অবসরে যান ৬৫ বছর বয়সে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর। তাহলে সরকারি কর্মকর্তারা কেন ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যাবেন? একই দেশে অবসরের বয়স ভিন্নতা কতটা যৌক্তিক, তা ভাবার সময় এসেছে। অবসরের বয়সসীমা বাড়ালে সবাই সমান সুযোগ পাবেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য লাজ-লজ্জাহীন তোষামোদীর প্রতিযোগিতাও বন্ধ হবে। একজন ব্যক্তির জন্য ১০ জনের পদোন্নতির পথ রুদ্ধ হবে না। চুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক হবে না। সরকার যদি সিনিয়র আমলাদের বেশি দিনের সেবা চায়, তাহলে চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি করুক। কিন্তু চুক্তির অত্যাচার থেকে প্রশাসনকে মুক্তি দিক। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রশাসনকে ক্রমেই বিকলাঙ্গ করছে। কয়েকজন স্তাবকের হাতে জিম্মি হচ্ছে প্রশাসন।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
বাংলাদেশ প্রশাসন রাজনীতি আওয়ামী লীগ মন্ত্রিপরিষদ মন্ত্রণালয় সৈয়দ বোরহান কবীর
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে
বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর,
সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার
বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়?
একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে
নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পরামর্শটি এখন সামনে এসেছে, তা হলো বিএনপির
নেতৃত্ব পরিবর্তন। এমন এক নেতৃত্ব সামনে আনা যিনি দেশে থাকেন এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগ
করতে পারেন। কদিন আগে কূটনৈতিকপাড়ায় এক চায়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে বিএনপির দুজন
ডাকসাইটে নেতাও উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রণকারী কূটনীতিকের বিএনপি নিয়ে অন্তহীন কৌতূহল।
বিএনপির নেতাকে দেখেই তিনি প্রশ্ন করলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোমরা এ অবস্থান নিলে
কেন? বিএনপির ওই নেতা গৎবাঁধা বুলির মতো কিছু বাক্য আওড়ালেন।
কূটনীতিকের প্রশ্ন, যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যাপারে তোমরা
কী করবে? এবার ওই বিদেশি মুচকি হেসে বললেন, আমি জানি এর উত্তর তোমার কাছে নেই। এ উত্তরের
জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তোমরা কেন সক্রিয় কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাও
না? বিএনপির নেতা ওই সন্ধ্যায় বিদেশি কূটনীতিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু
ওই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেলাম গত বুধবার। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের কাছ
থেকে। আলাল এসেছিলেন ডিবিসির ‘রাজকাহন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক নাজনীন মুন্নী
জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারেক রহমান বাইরে আছেন, মামলায় তার শাস্তি হয়েছে। বেগম জিয়ার শারীরিক
অবস্থাও খারাপ। এ দুজনকে বাদ রেখে কীভাবে দ্রুত দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অথবা অন্য
কোনো সমাধান আছে কি না?’ এবার অবশ্য আলাল নীরব থাকেননি। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন,
‘খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি না, সে বিকল্প
চিন্তা আমাদের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের পক্ষ থেকে
একটি কমিটি বা বডি বাছাই করা হবে, যারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।’ আলালের বক্তব্য
বিশ্লেষণ করলে সোজাসাপ্টাভাবে বলা যায় বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব থেকে জিয়া পরিবারকে
মুক্ত করার বিষয়টি এখন আর শুধু গুজব নয়। বিএনপিতেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই, বিশেষ করে ২০১৮ সালে বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার
পর থেকেই বিএনপিতে জিয়া পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি সামনে আসে। একটি রাজনৈতিক
দলের প্রধান নেতাকে হতে হয় সার্বক্ষণিক। তাকে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে
সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত নির্দেশনা দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮
সাল থেকেই এ ব্যাপারে বিএনপি একটি শূন্যতার মধ্যে আছে। বিএনপি মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটির
সদস্যরা সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। সহজভাবে বলা যায়, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার
নেই। বেগম জিয়া যখন মুক্ত ছিলেন, তখন বিএনপির সিদ্ধান্তের জন্য নেতারা দলের চেয়ারপারসনের
দ্বারস্থ হতেন। চেয়ারপারসন কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাস্তবতা নিরিখে সিদ্ধান্ত
নিতেন। কিন্তু বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র
ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।
যদিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানকে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব
দেওয়াটা ছিল গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগে গঠনতন্ত্রের ওই ধারাটি
রহিত করেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে বসে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা বাস্তবতা-বিবর্জিত।
ঢাকার চেয়ে লন্ডন ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। দলটির সকালে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন, সেটা বিকেলে
বা সন্ধ্যায় নিতে হয়। বিএনপির অনেকেই দলটিকে ‘সান্ধ্যকালীন রাজনৈতিক দল’ হিসেবেও ইদানীং
ডাকতে শুরু করেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র এমন যে, এখানে দলের চেয়ারপারসনকে সর্বময় ক্ষমতা
প্রদান করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে এরকম অগণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র থাকতে পারে
কি না, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে বাস্তবতা হলো এই যে, দলের প্রধান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই
কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য নেতারা স্রেফ আজ্ঞাবহ কর্মচারী।
অনেকটা পাইক-পেয়াদার মতো। মালিকের এক কথায় তাদের চাকরি চলে যায়।
বিএনপি আসলে একটা লিমিটেড কোম্পানির মতো। যে কোম্পানির সব শেয়ারের
মালিক জিয়া পরিবার। ফলে বেগম জিয়া যখন জেলে, তারেক রহমান লন্ডনে, তখন বিএনপির অন্য
নেতারা অসহায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকেন। কর্মীরা প্রশ্ন করলে, নেতারা উত্তর দিতে
পারেন না। বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কোনো জিজ্ঞাসার তাৎক্ষণিক উত্তর
নেই বিএনপি নেতাদের কাছে। বছর দুয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন।
সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট ফার্ম ভাড়া করেছে কি না।
জবাবে প্রথমে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, না। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তিনি যখন
চলে যাচ্ছিলেন, তখনই তার কাছে ফোন এলো দূরদেশ থেকে। বিএনপি মহাসচিব ফিরে এলেন। উত্তেজিতভাবে
বললেন, আওয়ামী লীগের জুলুম নির্যাতনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্যই তাদের লবিস্ট ফার্ম
আছে। এই তো সেদিন বিএনপি নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করল। বেগম জিয়াসহ নেতাকর্মীদের
মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেওয়া হলো। নির্দেশটি এসেছিল লন্ডন থেকে। লন্ডনে
অবস্থানকারী নেতা সেখানে বসে কীভাবে বুঝবেন বাংলাদেশে কী তীব্র তাপপ্রবাহ।
বিএনপি কোনো নেতাই সাহস করে বলতে পারলেন না, বাংলাদেশের আবহাওয়ার
অবস্থা, প্রচণ্ড গরমে মানুষের যাই যাই অবস্থার কথা। কর্মসূচি ঘোষণা হলো। এরপর সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো তীব্র সমালোচনা। এ আবহাওয়ায় বিএনপির এ রাজনৈতিক কর্মসূচিকে
তুলাধুনা চলল। অবশেষে লন্ডনে থাকা নেতার বোধোদয় হলো। তিনি আবার ফরমান জারি করলেন সমাবেশ
বাতিল। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। প্রতিকূল পরিস্থিতির
মধ্যেই দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন। কোথায় তাকে
সাবাশি দেওয়া হবে, শুরু হলো নাটক। লন্ডন থেকে বার্তা এলো, ফল প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
দায়িত্ব নেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীরাই হতবাক।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ছয় আসন পেয়ে যদি বিএনপির নির্বাচিতরা সংসদে যেতে পারেন, তাহলে
খোকন কেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিতে পারবেন না? কারও কাছে
উত্তর নেই।
খোকন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দায়িত্ব নিলেন। এরপর আবার নাটক।
অবশেষে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে দলটি। বিএনপিতে এখন এরকম সিদ্ধান্ত বদলের
উৎসব চলছে। সকালের সিদ্ধান্ত বিকেলে বাতিল হচ্ছে। দেশের বাস্তবতা, পরিস্থিতি বিবেচনায়
না নিয়ে সামরিক ফরমানের মতো নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে। দূরে থেকে সিদ্ধান্ত দিলে এমনই
হবে স্বাভাবিক। বারিধারার কূটনৈতিকপাড়ায় নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের ব্যাপক কদর
ছিল। চা, নাশতা, নৈশভোজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিএনপি নেতারা। এ সময় বিএনপি নেতাদের
মধ্যে একটি বাক্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়—‘আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’ (খুব শিগগিরই
আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জানাব)। বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নির্বাচনে বর্জনের কৌশল কী?
নির্বাচনের পর কী করবে—সব প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি নেতাদের উত্তর এই এক বাক্য। কূটনৈতিকপাড়া
বিএনপি নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অক্ষমতায় বিরক্ত। একজন কূটনীতিক একবার বলেই ফেললেন,
‘তোমাদের দলে তো অনেক অভিজ্ঞ নেতা আছে। এ সময়ের জন্য তাদের কাউকে দায়িত্ব নিতে বলো
না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরেও বিএনপির পক্ষ থেকে সেই বাক্যটিই উচ্চারিত হয়েছে। বিএনপির
জন্য জিয়া পরিবারের বাইরে আপৎকালীন সময়ে কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তটি স্পর্শকাতর।
দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে এ নিয়ে যুক্তিহীন আবেগ কাজ করে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস
করেন, জিয়া পরিবারের বাইরে থেকে নেতৃত্ব এলে দলটি টিকবে না। কোন্দলে কয়েক টুকরো হয়ে
যাবে।
জিয়া পরিবার মুক্ত বিএনপির ধারণা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা, অপরাধ, ‘কবিরা
গুনাহ’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপিকে বাঁচানোর এটিই একমাত্র পথ। নির্বাহী দায়িত্ব
থেকে বেগম জিয়া বা তারেক রহমান সরে গেলেই বিএনপির কর্তৃত্ব তারা হারাবেন না। ভারতের
কংগ্রেসের নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের কেউ নেই। কিন্তু তবুও এখনো এ পরিবারই উপমহাদেশের
প্রাচীনতম দলটির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেননি। কঠিন পরিস্থিতি
মোকাবিলার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের হাতে।
’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। তাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ
থেকে বিচ্যুৎ হয়নি আওয়ামী লীগ। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগই শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বে বসিয়েছে
বিপুল সম্মানে, অফুরান ভালোবাসায়। যে কোনো রাজনৈতিক দলের সংকট আসলে আদর্শের পরীক্ষা।
আদর্শের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আদর্শবান অভিজ্ঞ নেতা প্রয়োজন।
এক-এগারোর সংকটে আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফের মতো নেতা
পেয়েছিল বলেই দলটি ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে এ সময় বিএনপি পেয়েছিল
তাদের ভাষায় ‘বিশ্বাসঘাতক’ আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমানদের। যারা নিজেদের আদর্শবান
নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। এ উপলব্ধি যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হয়েছিল,
তার প্রমাণ মেলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে। তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ
উপেক্ষা করে, তিনি বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন জিল্লুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। হয়তো
মনের ভেতর এক দীর্ঘশ্বাসকে চাপা রেখেছিলেন। এই ভেবে যে, তিনি তার দলে জিল্লুর রহমানের
মতো একজন বিশ্বস্ত নেতা পাননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই মেরুর দল। দুটি দলের নীতি,
আদর্শ বিপরীতমুখী। সংকট মোকাবিলায় দুই দলের অভিজ্ঞতা দুরকম। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে
আদর্শবান নেতারা ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। বিএনপির সংকটে দায়িত্ববানরা করেছেন
প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিংবা কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির
জন্য স্বস্তি আনতে পারেননি। এক-এগারোর সময় ইয়াজউদ্দিন-মান্নান ভূঁইয়ারা দলের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র করেছেন বলে বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো দাবি করেন। দুই দলের এ বিপরীত পরিস্থিতিতে
প্রধান কারণ আমার মতে ‘আদর্শ’।
আওয়ামী লীগে কিছু নেতাকর্মী আদর্শের চর্চা করে। একটি নির্দিষ্ট
আদর্শের ভিত্তিতে দলটি পরিচালিত হয়। আর বিএনপির একমাত্র আদর্শ হলো, আওয়ামী লীগ বিরোধিতা।
ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগবাটোয়ারার জন্য গঠিত এ ক্লাবে সবাই কিছু চান। তা ছাড়া আওয়ামী
লীগের একজন তৃণমূলের কর্মীও মনে করেন, দলটা তার। কিন্তু বিএনপির সবাই বিশ্বাস করেন,
দলের মালিক জিয়া পরিবার। তারা শুধুই চাকরবাকর। যে কারণে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। সিদ্ধান্ত
গ্রহণে জিয়া পরিবারের জন্য অপেক্ষা করেন। নেতৃত্বে বাইরের কেউ এলে তারা বিশ্বাসঘাতকতা
করবেন, জিয়া পরিবারকে মাইনাস করবেন—বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের এমন আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা
থেকেই। তা ছাড়া জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ রাজনৈতিক দলটিই তাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র
পথ। নেতৃত্ব ছাড়লে আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণেই হয়তো জিয়া পরিবারের সদস্যরা
নেতৃত্ব ছাড়তে চান না। নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেই একজন সাত্তার, সাইফুর রহমান, কিংবা মান্নান
ভূঁইয়ার জন্ম হবে। এ অবিশ্বাসের কারণেই, নির্বাচনে অযোগ্য বেগম জিয়া, তারেক রহমান নির্বাচনবিমুখ।
বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি চারটি—অবিশ্বাস, সন্দেহ, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদ। এ কারণেই
বিএনপি জিয়া পরিবারমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কেউ কি বাড়ির কেয়ারটেকারকে হেবা
দলিলে বাড়ি লিখে দেয়?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি উপজেলা নির্বাচন শেখ হাসিনা
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রতিদিন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন, হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা আসলে দলের নির্দেশনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এই নির্দেশনা মানছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান ওবায়দুল কাদেরের নয়, এই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত তাঁর তার বক্তব্যেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন দেখা গেল যে, একমাত্র প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়েছেন। অন্য কেউই ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি। ওবায়দুল কাদের এই ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথা বারবার ঘোষণা করছেন।
বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি যেন এখন এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। ভূতুড়ে বাড়িও বলা যায়। যে বাড়ির কর্তারা থাকেন অন্ধকারে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেখানে চাকরবাকর, সেরেস্তাদাররা থাকেন আতঙ্কে। কেউ জানে না আগামীকাল কী হবে। ১৭ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যে এখনো টিকে আছে, তা এক বিস্ময়। তার চেয়েও বড় কৌতূহল বিএনপি কে চালায়? একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দলটি এখন যেন পথ হারিয়েছে। পথের দেখা পেতে, বিএনপিকে বাঁচাতে নানা জনের নানা মত। অনেকেই অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন।
আগামী ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ্যতা, দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভাপতি কী অবস্থান গ্রহণ করেন এবং কীভাবে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন সেটির দিকে তাকিয়ে আছে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা টালমাটাল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা নিয়েছিলেন যে, দলের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা কোন মন্ত্রী-এমপিই মানেননি। ইদানিং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদককে দেখে মনে হয় অসহায়। তিনি বারবার চিৎকার করছেন, দলের নেতাকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত মানার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন, আবেদন-নিবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছেন না।
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।