এডিটর’স মাইন্ড

অবশেষে কূটনীতিকদের বোধোদয়

প্রকাশ: ০৬:৫৯ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২


Thumbnail

সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বিরোধী দলের আন্দোলন এ নিয়ে কূটনীতিকদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা ছিল, কূটনীতিকদের মধ্যে নানারকম প্রশ্ন ছিল। আস্তে আস্তে কূটনীতিকদের বোধোদয় ঘটছে। কূটনীতিকরা এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে এবং তাদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছিল সেই বিভ্রান্তিগুলো দূর হয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ধারণা ছিল যে, আওয়ামী লীগ সরকার বোধোদয় বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন করছেন, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ করা ইত্যাদি অধিকার কেড়ে নিতে চাইছেন। এমনকি ১০ ডিসেম্বরকে নিয়ে কূটনীতিকদের সাথে বিএনপির বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেছিল যে, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ সরকার করতে দিতে চায় না এবং যেখানেই তারা সমাবেশের কথা বলুক না কেন সরকার সেটাতেই বাধা দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কূটনীতিকরা দেখল যে, সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হলো এবং সরকার সহযোগিতা করলো। 

বিএনপির পক্ষ থেকে কূটনীতিকদেরকে বলা হয়েছিল যে, সরকার গায়ে পড়ে বিএনপির সাথে ঝগড়া করতে চায়, একটা অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে বিএনপির ওপর দমনপীড়ন, নির্যাতন করতে চায়। কিন্তু বিএনপির সাম্প্রতিক সময়ে যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশেষ করে ২৪ ডিসেম্বর তারা যখন গণমিছিলের কর্মসূচি দিলো তখন কূটনীতিকদের বিভ্রান্তি দূর হলো। বিএনপির কাছে অনেক কূটনীতিকরা প্রশ্ন করেছিলো ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ কিন্তু তারা কেন ৭ ডিসেম্বর জমায়েত হতে চাইলো। এই প্রশ্নের উত্তর বিএনপি নেতারা কূটনীতিকদের দিতে পারেনি। এখানেও কূটনীতিকরা যে বিভ্রান্ত হয়েছিল সেই বিভ্রান্তি অনেকখানি কেটে গেছে। শুধু তাই নয়, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, জামায়াতের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এখন কূটনীতিকরা দেখছেন যে, জামায়াত বিএনপির অঙ্গ সংগঠন হিসেবে পরিণত হয়েছে। জামায়াত-বিএনপি প্রায় সমান্তরালভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করো গ্রহণ করছে। এর ফলে কূটনীতিকদের মধ্যে একটি শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, বিএনপি আসলে কি করতে চায়? বিএনপি দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা এবং অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে যে সমস্ত বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছিল কূটনীতিকরা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখেছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছে। কিন্তু সকলে দেখেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো এবং বাংলাদেশ সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো করবে। 
বিশেষ করে আগামী বছরে যে দেশগুলো গভীর সঙ্কটের মধ্যে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যে সমস্ত দেশে তীব্র খাদ্য ঘাটতি, ক্ষুধা দেখা দিতে পারে সেই সমস্ত দেশগুলোর বাইরে থাকবে বাংলাদেশ। ফলে সরকার এবং বাংলাদেশ নিয়ে কূটনীতিকদেরকে বিএনপি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যে সমস্ত তথ্য গুলো দিয়েছে সে সমস্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে এখন ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। ফলে কূটনীতিকদের বোধোদয় ঘটছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ তার কৌশল পরিবর্তন করেছে। কূটনীতিকদের কথার ঢালাও সমালোচনা না করে যুক্তি, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বক্তব্যগুলোর অসারতা এবং অসংলগ্নতা তা প্রমাণের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। এটি সরকারের জন্য ইতিবাচক হচ্ছে। এর ফলে কূটনীতিকদের মধ্যে এখন নতুন ধরনের চিন্তা উদ্যোগ হচ্ছে। শুধুমাত্র বিএনপি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা যা বলছে সেটাই যে সত্য নয়, তা এখন কূটনীতিকরা বুঝতে শুরু করেছে।

কূটনীতিক  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে সুসময়ের সুবিধাভোগী বনাম দুঃসময়ের যোদ্ধা

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১৪ জুন, ২০২৪


Thumbnail

গত ১১ জুন ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল মিথ্যা এবং হয়রানিমূলক মামলায়। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশে একটি চিরস্থায়ী অনির্বাচিত সরকার তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশকে গণতন্ত্রহীন করা। আর এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যই সুশীল সমাজের ফ্যাক্টরীতে ‘মাইনাস ফর্মুলা’ আবিষ্কৃত হয়েছিল। ‘মাইনাস ফর্মুলার’ অন্যতম লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া দু’জনকেই রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়া। রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা। রাজনীতি থেকে অপসারিত করার জন্যই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানারকম কাল্পনিক এবং অবাস্তব মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ১৩ জুন ঢাকার গুলশান থানার ইস্টকোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী একটি চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেন। এই চাঁদাবাজির মামলাতেই ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ প্রায় ১ বছর কারাভোগের পর, সব চক্রান্ত উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ১১ জুন ২০০৮ সালে মুক্তি পান। তার এই মুক্তির দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমেই জগদ্বল পাথরের মতো চেপে থাকা সুশীল একনায়কতন্ত্রের অবসানের পথ তৈরি হয়। এক এগারোর সুশীল নিয়ন্ত্রিত অনির্বাচিত সরকার মানুষের জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলেছিল। একদিকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, অন্যদিকে ঢালাও গ্রেপ্তার, হয়রানির মাধ্যমে এক এগারোর সরকার এক আতংকের রাজত্ব কায়েম করেছিল। শেখ হাসিনার মুক্তির মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নবযাত্রার দিন বলা যায় এটিকে। এই দিনটি তাই আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এবার আওয়ামী লীগ দিনটিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেনি। সাদা-মাটা ভাবেই পালিত হয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি। জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের আলোচনায় এস.এম কামাল হোসেন সহ দু’একজন শেখ হাসিনার এই কারামুক্তি দিবসকে বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে ফেনী-১ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নাসিমও বলেন, দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদেরকে সামনে আনতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ব্যস এটুকুই। এটি দেখে মনে হলো, এই দিনের গুরুত্ব উপলব্ধির বোধ শক্তি টুকুও আওয়ামী লীগ হারিয়ে ফেলেছে। অথবা, আদর্শ বিবর্জিত ব্যক্তিরাই এখন আওয়ামী লীগের দন্ডমুন্ডের কর্তা। তারা এই দিনের মাহত্ম বুঝতে অক্ষম। 

শেখ হাসিনা তার নিজস্ব মেধা, প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শীতার কারণে এক এগারোর নীল নকশা ভেস্তে দেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তিনিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। এর মধ্যে নতুন এক শেখ হাসিনার জন্ম হয়। আজকের শেখ হাসিনার সূচনা এখানেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের ঐ সংকটকালীন সময়ে যারা শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন, যারা ‘মাইনাস ফর্মূলা’র বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছিলেন, তারা আজ কোথায়? এই প্রশ্নটি আজ আমাদের সামনে বারবার ঘুরে ফিরে আসে। গণতন্ত্র ও বিরাজনীতি করণের সংগ্রামের যোদ্ধারা হারিয়ে গেছে? নাকি দুঃসময়ের যোদ্ধাদের দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে।

এক এগারোর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমত, যারা শেখ হাসিনার পক্ষে ছিলেন। পক্ষে থাকার কারণে তাদেরকে নির্যাতন এবং কারাভোগ করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সহ বহু নেতাকে সেসময় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যৌথ জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হয়েছিল সীমাহীন নির্যাতন। কেউ কেউ পালিয়ে গিয়েও শেখ হাসিনার পক্ষে লড়াই সংগ্রাম করেছিলেন। যেমন জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং মির্জা আজম। আত্ম গোপনে থেকেও তারা কর্মীদের মাঠে রেখেছেন। দ্বিতীয় অংশ হলো, যারা গ্রেপ্তার হননি। তারা তাদের নিজস্ব সাহস এবং বুদ্ধি দীপ্ততার কারণে রাজনীতির মাঠে সরব ছিলেন। এদের অনেকে ‘মাইনাস ফর্মূলা’র বিরুদ্ধে এবং শেখ হাসিনার পক্ষে রাজপথে এবং নানাভাবে লড়াই সংগ্রাম করেছেন। তাদেরকে আমরা বলতে পারি আওয়ামী লীগের মূল ধারার অংশ। আর তৃতীয় অংশ ছিল ছোট, কিন্তু অত্যন্ত প্রভাবশালী। এরা সংস্কারপন্থী ছিলেন, এরা শেখ হাসিনার সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলেন, গণতন্ত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলেন। এরাই ‘মাইনাস ফর্মুলা’র সমর্থক। নব্য রাজাকার, একালের মোশতাক।

এক এগারোর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের যে তিনটি ভাগ তা সব সংকটেই দেখা যায়। প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটেই আওয়ামী লীগ ত্রি-ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। আমরা যদি ১৯৭৫ সারের ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো সেসময় আওয়ামী লীগ তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলেন, জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। অনেকেই হত্যা করা হয়েছিল। এ দলের মধ্যে রয়েছেন শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। হাজার হাজার নেতা-কর্মী, যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আজকে যিনি রাষ্ট্রপতি তিনিও সে সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছিলেন এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগে এরকম নির্যাতিত ব্যক্তির সংখ্যা হাজার হাজার। দ্বিতীয়ত, যারা তাদের অবস্থানগত কারণে কিংবা গুরুত্বহীন বিবেচনায় গ্রেপ্তার হননি কিন্তু এই সময় তারা দলের হাল ধরেছিলেন, এরাই দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছিলেন। এদের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ পুনঃগঠিত হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন জোহরা তাজউদ্দিন, সাজেদা চৌধুরীসহ নেতৃবৃন্দ। আর তৃতীয় ভাগ ছিল যারা বিশ্বাসঘাতক, যারা খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর পা দিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিল। এই ধরনের বিশ্বাসঘাতকদের তালিকাও কম বড় নয়। খুনি মোশতাকের সঙ্গে যারা হাত মিলিয়েছিল তাদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। আবার কিছু কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা হত্যার প্রতিবাদ না করে খুনিদের সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক রেখেছিলেন নিজে বাঁচার জন্য আপোষ করেছিলেন। গা বাঁচিয়ে চলেছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর এরাই সরব হয়ে ওঠেন। আর একারণেই আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের মূল্যায়ন করার জন্য সংকটকালীন সময়কে সামনে আনা অত্যন্ত জরুরী। সংকটে সাহসী মানুষরাই যেকোন দলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য যে, আওয়ামী লীগে যারা সংকটে বা দুঃসময়ে যোদ্ধা হিসেবে রাজপথে দাঁড়ায়, আদর্শের প্রশ্নে অটল থাকে, সুসময়ে তারা কিছুই পায় না, অনাহুত হয়। তাদের দূরে ঠেলে দেয়া হয়। সুসময়ে কিছু সুবিধাভোগী বসন্তের কোকিল হয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রের চার-পাশে ভীড় করে। তারাই সব মধু চেটে-পুটে খায়। এদের সীমাহীন অপকর্মের কারণে জনগণের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরী হয়। শীতের অতিথি পাখিরাই দলকে সংকটে ফেলে। আবার দল যখন অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত হয় তখন দুঃসময়ের যোদ্ধারা জেগে ওঠে। এটাই আওয়ামী লীগের নিয়তি, এটাই যেন আওয়ামী লীগের ইতিহাস। সুসময়ের সুবিধাভোগীরা দুঃসময়ে হয় বিশ্বাসঘাতক হয় না হয় পালিয়ে যায়। আর সুসময়ে অপাংক্তেয় মানুষরা দুঃসময়ে সাহসী বীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। 

এক এগারোর কথাই বিশ্লেষণ দেখি। ১১ জুন শেখ হাসিনার মুক্তির পেছনে অবশ্যই তার অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশী। নিজস্ব প্রজ্ঞা, মেধা এবং রাজনৈতিক কৌশলের জন্যই শেখ হাসিনার মুক্তির পথ প্রশস্ত হয়েছিল এবং রাজনীতিতে গণতন্ত্র ফিরে এসেছিল। কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধা কে ছিলেন, তারা আজ কোথায়? এক এগারোর সময় শেখ হাসিনার পক্ষে যারা লড়াই করেছিলেন তাদের অনেকেই আজ আর নেই। প্রয়াত জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম চলে গেছেন বহু আগে। এই দু’জন আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দিয়ে আগলে রাখার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। বেগম মতিয়া চৌধুরীর কথা আমরা সকলেই জানি। এক এগারোর সংকটে বেগম মতিয়া চৌধুরীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা তাকে রাজনীতিতে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বেগম মতিয়া চৌধুরী এখন সংসদের উপনেতা। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি এখন গুরুত্বপূর্ণ নন। কোন ভাবেই সরকারের বা দলের নীতি নির্ধারক নন। এক এগারোর সময় যারা শেখ হাসিনাকে আইনী সহায়তা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যরিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি আজ আওয়ামী লীগের রাজনীতির মূল ধারা থেকেই ছিটকে পড়েছেন। এডভোকেট কামরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন বটে তবে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা নন। এডভোকেট সাহারা খাতুন চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। এক ধরনের দুঃখ বেদনা নিয়েই তাঁর প্রস্থান। আবার এক এগারোতে দুদকের ক্ষমতাবান আইনজীবী, যিনি রাজনীতিবিদদের অপদস্ত করার নেপথ্যের কারিগর, তিনি এখন প্রচন্ড ক্ষমতাবান মন্ত্রী।

সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতির চিকিৎসক দলের প্রধান। তাঁর নেতৃত্বেই শেখ হাসিনার অসুস্থতার কথা চিকিৎসকরা প্রথম বলেছিল। এবং এই অসুস্থতার ইস্যুটি নিয়েই একটি জাগরণ তৈরি হয়েছিল। জনমত চলে গিয়েছিল এক এগারোর সরকারের বিপক্ষে। মোদাচ্ছের আলী এখন আওয়ামী লীগের কেউ নন। ক্ষমতাকেন্দ্রেও তার জায়গা নেই। প্রথম মেয়াদে তাকে উপদেষ্টা করা হয়েছিল বটে তারপর তিনি আর কোথাও নেই। এই চিকিৎসক দলের অন্য সদস্যদেরও খুব একটা মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ঐ সময় শেখ হাসিনাকে চিকিৎসা দিতে অসম্মতি জানানো চিকিৎসকরা এখন কেউ উপাচার্য, কেউ বার বার চুক্তিতে থাকছেন নানা লোভনীয় পদে। এক এগারোর সময় যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, যাদের গ্রেপ্তার করা হয় তাদের মধ্যে দুই একজন ছাড়া খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কেউ আছেন বলে মনে হয় না। 

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন, যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন তারাই যেনো ক্রমশঃ ক্ষমতাবান হয়ে উঠছেন। এক এগারোর সময় যারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন, যারা বাংলাদেশে ‘সোনিয়া গান্ধী ফর্মুলা’ বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন তারা এখন মন্ত্রিসভার সদস্য। এক এগারোর সময় যারা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ফর্মুলা দিয়েছিলেন তারাও মন্ত্রিসভায় বিভিন্ন সময় জায়গা পেয়েছিলেন। এক এগারোর এই ষড়যন্ত্রে যারা হাত মিলিয়েছিলেন তারা কেউ কেউ এখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যও বটে। 

গত ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এই সময়ে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, আওয়ামী লীগ নিজেই যেনো বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করছে। আওয়ামী লীগে এখন মাঠ থেকে আসা রাজনীতিবিদরা উপেক্ষিত এবং অগুরুত্বপূর্ণ। বরং হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা নব্য রাজনীতিবিদদের ‘আগ্রাসন’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে দলটিতে। এরাই এখন দল এবং সরকারের নীতি নির্ধারক হয়ে উঠেছে। যাদের অতীত রাজনীতিতে কোন অভিজ্ঞতা নেই, যারা রাজপথে কোন আন্দোলন করেনি, যাদের ত্যাগ শিকারের কোন ইতিহাস নেই তারাই এখন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক। আওয়ামী লীগকেই কি তাহলে এখন বিরাজনীতিকরণ করা হচ্ছে? আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই আমলাদের উপর নির্ভর, পুলিশ প্রশাসনের উপর নির্ভর। কতিপয় আমলা, পুলিশ এখন আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চেপে আমলা এবং অন্যরা কি করছে তার এক টুকরো নজীর পাওয়া যায় বেনজীর কান্ডে। বেনজীর আহমেদ যেভাবে লুণ্ঠন করেছেন তাতে বোঝা যায় আওয়ামী লীগকে এই সুবিধাবাদী চক্র কিভাবে ব্যবহার করছে। সামনে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। আওয়ামী লীগ ৭৫ বছরে পা দিবে। ৭৫ বছর একটি রাজনৈতিক দলের টিকে থাকা অনবদ্য গৌরবের বিষয়। আর এই কারণেই আওয়ামী লীগকে আজকে তার ইতিহাস অন্মেষণ করতে হবে, শিকড়ের সন্ধান করতে হবে। দুঃসময়ে যারা আওয়ামী লীগের যোদ্ধা তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। সুসময়ের সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে দলকে মুক্ত করতে হবে। আওয়ামী লীগ কি তা পারবে? যদি না পারে আগামীর সংকটে, ভবিষ্যতের দুঃসময়ে কেউ ঝুঁকি নিয়ে রুখে দাড়াবে না আদর্শের জন্য। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্যদের পদায়ন: নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত?

প্রকাশ: ০৫:০০ পিএম, ১৩ জুন, ২০২৪


Thumbnail

গত মঙ্গলবার প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল হয়েছে। ৬টি সচিব পদে দপ্তর পরিবর্তন হয়েছে। একজন পদোন্নতি পেয়েছেন। একজন সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই রদবদল নিয়ে সচিবালয়ে এখন ব্যাপক আলাপ আলোচনা চলছে। এবারের রদ বদলের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো বেশ কয়েকজন যোগ্য ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। এর ফলে সচিবালয়ের পেশাদার কর্মকর্তারা অত্যন্ত উল্লসিত এবং আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। 

গত কিছুদিন ধরেই প্রশাসনের মধ্যে ব্যাপক ধরনের রাজনীতিকরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। যোগ্যদের বদলে যারা বেশি চাটুকার, নব্য আওয়ামী লীগার এবং বিশেষ করে যারা সরকারের বা প্রশাসনের একটি গ্রুপের সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ তারাই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পাচ্ছিলেন। ফলে যোগ্যরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন। এই রদবদলে সরকার সেই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এটিকে ইতিবাচক বলছেন প্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তারা।

এবার রদবদলে যে তাৎপর্যপূর্ণ দিকগুলো রয়েছে তার মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে স্থানীয় সরকার বিভাগে বদলি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোঃ ইব্রাহিমকে ভূমি আপীল বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বদলি করা হয়েছে। আবু হেনা মোরশেদ জামান একজন সৎ, দক্ষ, মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময়ে যে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন সেখানে তিনি তার মেধা, মনন এবং যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে কোভিডকালীন সময়ে তাকে সিএমএইচডির পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং সেখানে তিনি  দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি কঠিন সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তার মতো মেধাবীকে ডাক ও টেলিযোগাযোগের মতো অপেক্ষাকৃত অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। এবার তাকে স্থানীয় সরকার বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। 

এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মশিউর রহমানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগে বদলি করা হয়েছে। এটিও একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। মশিউর রহমান একজন মেধাবী এবং পেশাদার আমলা হিসেবে সুপরিচিত। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মত একটি অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে তিনি বেশ কিছুদিন ছিলেন। 

এছাড়াও যে রদবলগুলো হয়েছে তাতে একটি জিনিস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আর তা হলো মেধাবী কর্মকর্তারা ভালো জায়গাগুলো পাচ্ছেন। সচিবালয়ের প্রবল রাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া, যেখানে পেশাদারদেরকে উপেক্ষিত মন্ত্রণালয়গুলোতে রাখা হয় এবং রাজনীতিতে যারা ব্যস্ত, তাদের যোগ্যতা থাকুক না থাকুক তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয় সেই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার একটি সুস্পষ্ট প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসনে যারা দক্ষ, যোগ্য, মেধাবী তাদের এটি আকাঙ্খা ছিলো। রাজনৈতিক বিবেচনায় সচিব করা হোক কিন্তু তাদেরকে যেন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় গুলো না দেয়া হয় এটি ছিলো সরকারি কর্মকর্তাদের এক ধরনের আকাঙ্খা। অনেক দেরিতে হলেও সরকার সেই আকাঙ্খার জায়গাটিতে মনোযোগ দিয়েছেন। এর ফলে সরকারের মধ্যেও একটি মেরুকরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন সরকার এখন দেশের অর্থনৈতিক সংকট সহ অন্যান্য সংকট গুলো মোকাবেলা করতে চায়, প্রশাসনে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো একটি দক্ষ, কর্মক্ষম প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে চায়। তারই বার্তা দেয়া হয়েছে এই রদবদলের মধ্যে। 

সচিবালয়   প্রশাসন   সচিব   পদোন্নতি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

স্পর্শকাতর পদে নিয়োগ বিতর্ক ও জবাবদিহি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১০ জুন, ২০২৪


Thumbnail

বেনজীর-আজিজ কার সৃষ্টি—এ নিয়ে এখন রাজনীতির মাঠ গরম। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এখন এই ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে। বিএনপি বলছে, বহু বেনজীর আছে সরকারের ভেতর। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর পদে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের নিয়ে এই বিতর্ক নতুন নয়। আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েও। পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদ ৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হননি। আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি সময় চেয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে ১৫ দিন সময় দিয়েছে। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যে তিনি দুদকে উপস্থিত হবেন কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদকে নিয়েও চলছে বিতর্ক। বিরোধী দল বলছে, ‘আজিজ-বেনজীর সরকারের সৃষ্টি।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘তারা আওয়ামী লীগের কেউ নন। যোগ্যতার বলেই তারা এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাদের অপরাধের দায় সরকার নেবে না।’ আজিজ-বেনজীর বিতর্কের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বরখাস্ত দুই কর্মকর্তার নানা অপকর্মের কাহিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখরোচক বিষয় হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এসব স্পর্শকাতর পদে কীভাবে নিয়োগ হয়? নিয়োগ পাওয়ার পর তারা কী করছেন না করছেন, তার খোঁজ কে রাখে? তারা তো দায়িত্বে থেকেই অপকর্ম করেছেন। সরকার তখন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনেনি কেন? তখনই যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো তারা ‘দানব’ হয়ে উঠত না। আজকে এ ধরনের সমালোচনাও হজম করতে হতো না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে গাজী হাফিজুর রহমান লিকু দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে এসেও তার চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। প্রথম মেয়াদে থাকা অবস্থাতেই তাকে নিয়ে নানা বিতর্ক ছিল। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন—এমন বিস্তর অভিযোগ আছে। সবাই এসব জানত। তার পরও তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একই পদে। কেন? লিকুর অপকর্মের কাহিনি কি প্রধানমন্ত্রীকে কেউ জানিয়েছিল? তাকে আর দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হবে না, এই পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীকে কেউ দিয়েছিল?

শুধু লিকু নয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস বিভাগের একজন কর্মকর্তার নজিরবিহীন কাণ্ড পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। ওই কর্মকর্তারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নানা রকম অনিয়ম করার সাহস তারা পান কোত্থেকে? যেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এ রকম একজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যারা কাজ করেন তাদের সততা, নৈতিকতা ও আদর্শিক অবস্থান প্রশ্নাতীত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এসব স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব নিয়ে অনেকে দুর্নীতির দোকান খুলছেন, স্বেচ্ছাচারিতার মহোৎসব করছেন। কীভাবে তারা ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’ হচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এখনই তাদের চিহ্নিত না করলে ভবিষ্যতে বড় ক্ষতি হবে।

গুরুত্বপূর্ণ পদে ‘ভুল’ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে বিপদে পড়ার ইতিহাস পুরোনো। সব সরকারই চাটুকারদের খপ্পরে পড়েছে। মতলববাজরা সব সরকারকেই বিভ্রান্ত করে গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছে। এতে ওই সরকারেরই সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে। ভুল ব্যক্তিরা দেশ, জনগণ এবং সরকারের জন্য বিপজ্জনক। ইতিহাসে এটি বারবার প্রমাণিত। কিন্তু আমরা ইতিহাস থেকে শিখি না।

খুনি খন্দকার মোশতাক আজীবন অযোগ্য, কুচক্রী, ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই খুনি ষড়যন্ত্র করেছিলেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। এ কথা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবাই জানতেন। কিন্তু তার পরও মোশতাককে স্বাধীনতার পর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী করা হয়। তাজউদ্দীনকে হটিয়ে তিনিই হন বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে খুনি মোশতাক নানা ছলাকলা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে আসেন, বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রকারী কখনোই বঙ্গবন্ধুর আপন লোক ছিলেন না। ইতিহাসে নিকৃষ্টতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে যে ইতিহাসধিক্কৃত। খুনি মোশতাক পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কী করেছেন, তা জাতি জানে। ভুল লোককে বিশ্বাস করলে, গুরুত্ব দিলে পরিণতি কী হয়—খুনি মোশতাক সম্ভবত তার সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার বিভিন্ন ভুল লোককে, অযোগ্য, আদর্শহীন, লোভাতুর, মতলববাজদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে বিপদ ডেকে আনা হয়েছে। এখনো চারপাশে তাকালে দেখা যায় অনেক ভুল লোক নানা ছলাকলা করে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে যাচ্ছেন। তাদের নিয়োগ কীভাবে হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলে না। সবাই গোপনে হা-হুতাশ করে। তারা রাষ্ট্র এবং সরকারের জন্য বিপজ্জনক।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন জিয়াউর রহমান। হত্যা, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জিয়া তার অবৈধ ক্ষমতা পোক্ত করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন প্রতিপক্ষকে। কোনো শত্রু রাখতে চাননি। যে তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম শব্দ উচ্চারণ করেছে, তাকে তিনি ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি কোনো মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে সেনাপ্রধান করেননি। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত এক দুর্নীতিবাজ সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু সেই দুর্নীতিবাজ এরশাদই জিয়াউর রহমানের ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। জিয়াউর রহমান হত্যার পেছনে এরশাদের হাত আছে কি না, তা পরিষ্কার হতো মঞ্জুর হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় পেলে। কিন্তু সেই মামলার রায় আজও হয়নি। এরশাদ তার জীবদ্দশায় এই মামলার রায় বাধাগ্রস্ত করতে সব চেষ্টা করেন। বিএনপিও রহস্যময় কারণে জিয়া হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটনে আগ্রহ দেখায়নি।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিশ্বাস করতেন আমলাদের। রাজনীতিবিদদের তিনি মোটেই আমলে নিতেন না। আমলাদের ওপর নির্ভর করেই তিনি ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। আমলাদের ক্ষমতাবান করেছিলেন। কিন্তু এরশাদের পতনের পর তার প্রিয় দুই আমলা এম কে আনোয়ার ও কেরামত আলী ডিগবাজি দেন। এরশাদভক্ত এই দুই আমলার বিএনপিতে যোগ দিতে সময় লেগেছে এক সপ্তাহের কম। শুধু আমলা কেন, এরশাদের চারপাশে থাকা কোনো চাটুকারই শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকেনি। ডিগবাজি দিয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেমের মতো চাটুকাররা বদলে যেতে সময় নেননি।

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া বিশ্বাস এবং আস্থা রেখেছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ওপর। প্রচণ্ড ক্ষমতাবান মন্ত্রী ছিলেন হুদা। বিরোধী দলকে নোংরা, অশ্লীল এবং কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করাই ছিল তার প্রধান কাজ। এই নাজমুল হুদাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা দিয়ে বোমা ফাটান। সরকারকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন। নাজমুল হুদা খালেদা জিয়ার দুর্দিনে তার পাশে থাকেননি। সুদিনে দুর্নীতি করেছেন।

১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন দেশকে একটি সুশাসন দিতে, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে। এ কারণেই তিনি ১৯৯১ সালে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন। এটি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই ভুল ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করার পরিণাম কী হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের অজানা নয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের ভূমিকা কী ছিল, তা ইতিহাস সাক্ষী। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসেছিল বিপুল বিক্রমে। বিএনপি-জামায়াত জোট ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত চেয়েছিল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে। এ কারণে একের পর এক দলীয়করণ করেছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রাষ্ট্রীয় প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছিলেন তারেক রহমান হাওয়া ভবনের মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনকে বানিয়েছিলেন এক তামাশার কেন্দ্র। এম এ আজিজের মতো অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে বিএনপি নিজেদের ক্ষতি করে। ক্ষমতা পোক্ত রাখার জন্য খালেদা জিয়া, তারেক রহমান সাতজনকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো একজন ব্যক্তিত্বহীনকে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন করেছিলেন। খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন, এমন চাটুকার বঙ্গভবনে থাকলে তিনি নিরাপদ। এসব করেই বিএনপি তার সর্বনাশ ডেকে আনে। আজ বিএনপি হাজারবার অনুশোচনা করে কেন তারা মইন উ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেছিল। ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করার বেদনায় অনেকে এখনো আর্তনাদ করে ওঠেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের উদাহরণ অনেক দেওয়া যায়। ভুল ব্যক্তি কখনোই কারও জন্য উপকারী হয় না। তারা নিজের আখের গোছানো ছাড়া কিছুই করতে পারে না। কোনো কাজেই আসে না। ষড়যন্ত্র করে, না হয় বিপদে সটকে পড়ে। ভুল ব্যক্তিরা সবসময় অযোগ্য হয়, আদর্শহীন হয়। তারা কোনো সময় ত্যাগ স্বীকার করার জন্য প্রস্তুত থাকে না, তারা কোনো সময় রুখে দাঁড়ায় না। সুসময়ে তাদের মিষ্টি কথায় মজেছেন তো ঠকেছেন। দুঃসময়ে দেখা যায় তাদের আসল রূপ।

অতীতে ভুল ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ দেওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগ সরকারের কম নয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মতো দুর্নীতিবাজকে নিয়োগ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই সিনহাকে এক-এগারোর সময় দুর্নীতির দায়ে বিচারপতি পদ থেকে অপসারণের জন্য বঙ্গভবনে চায়ের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। পরে ড. কামালের কৃপায় তিনি বেঁচে যান। এরকম অবিশ্বাসী, বহুরূপী মানুষ আওয়ামী লীগের চরম ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য, চাটুকার, দুর্নীতিবাজদের নিয়োগদানের প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। কেউ কেউ মনে করতেই পারেন, গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর পদের নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেই হয়। কাজেই এখানে অন্য কারও কিছু করার নেই। আমি এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে একদম একমত নই। এটি প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ নষ্টের আরেকটি ষড়যন্ত্র। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ থাকতেই পারে এবং প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দ এসব নিয়োগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রধানমন্ত্রী যাকে পছন্দ করছেন তার ঠিকুজি উদ্ধার করা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব। কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। যোগ্যতার পাশাপাশি তার আদর্শিক অবস্থান, সততা এবং অতীত কার্যক্রম নিরীক্ষা জরুরি। যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছেন, যারা বিভিন্ন সংস্থায় আছেন তাদের প্রধান কর্তব্য হলো সঠিক, যোগ্য এবং আদর্শবান ব্যক্তিরা এসব পদে যাচ্ছেন কি না, তা নজরদারিতে রাখা। চাটুকারিতা আর ‘জি হুজুর’ না করে সঠিক তথ্য প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া। লক্ষ রাখা, এমন কোনো ব্যক্তি কোনো পদে যাচ্ছেন না তো, যার ব্যক্তিগত ইমেজ বা অতীত প্রশ্নবিদ্ধ। পাশাপাশি স্পর্শকাতর পদে দায়িত্ব পালনরত ব্যক্তিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ জরুরি।

আমি মনে করি, যোগ্যতার চেয়ে একজন ব্যক্তির আদর্শিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। একজন সৎ মানুষ অসৎ ব্যক্তির চেয়ে দায়িত্ববান হন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য নিরাপদ নয়। রাজাকারের সন্তানরা কোনো দিন আওয়ামী লীগের পক্ষের হবে না। উচ্চপদে বসলেই তারা সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত করে অস্বস্তিতে ফেলে। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে তা সরকারের জন্যই ক্ষতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বেনজীর তার সর্বশেষ উদাহরণ। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। দেশে এখন সবাই আওয়ামী লীগ। সরকারের পক্ষে চাটুকারিতা করা মতলববাজদের অভাব নেই। আওয়ামী লীগে ভালোর জন্য দায়িত্বশীল এবং সঠিক সমালোচনাকারীদের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। দলে সরকারের মধ্যে এখন সত্য বলার লোকের অভাব। সবাই তোষামোদে ব্যস্ত। কেউ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেন না। ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মতো সাহসী মানুষ এখন নেই বললেই চলে। এর ফলে অযোগ্য, চাটুকার, দুর্নীতিবাজ, আদর্শহীন মতলববাজরা সরকারের চারপাশে ঢুকে পড়েছে বন্যার পানির মতো। সর্বনাশের বীজ বোনা হচ্ছে সবার অলক্ষ্যে।


দুর্নীতি দমন কমিশন   বেনজীর   আজিজ   বিএনপি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ভারতের নির্বাচন থেকে বাংলাদেশ যা শিখতে পারে

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ০৭ জুন, ২০২৪


Thumbnail

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সারা বিশ্বে এখন চর্চা হচ্ছে। রোববার টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিবেন নরেন্দ্র মোদী। তবে এবার বিজেপি একক ভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। এনডিএ জোটকে নিয়ে দিল্লির মসনদে বসতে হয়েছে নরেন্দ্র মোদীকে। লোকসভা নির্বাচনে জিতেও হেরেছেন মোদী এবং তার দল বিজেপি। অন্যদিকে এই নির্বাচনে কংগ্রেস এককভাবে পেয়েছে ৯৯ টি আসন। বিজেপির চেয়ে উপমহাদেশের প্রাচীনতম দলটি অনেক পিছিয়ে। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট নির্বাচনে ২৩৪ টি আসন পায়। আসন বিবেচনায় কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে গেছে। কিন্তু হেরেও নির্বাচনে জয়ের আনন্দ উপভোগ করছে কংগ্রেস এবং তার মিত্ররা। ভারতে জোট সরকারগুলোর ইতিহাস খুব একটা সুখের নয়। জনগণের কাছে তাদের অঙ্গীকার পূরণের চেয়ে, জোটের শরীকদের মন রক্ষায় তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। কথায় কথায়, উঠতে-বসতে শরীকরা ধমক দেয়। সরকার থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দেয়। তাই রোববার গঠিত এনডিএ জোট সরকার কতদিন টিকবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে এই নির্বাচনকে সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের অনবদ্য কাব্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতের নির্বাচন আসলে জনগণের ক্ষমতায়নের বিজয়, গণতন্ত্রের জয়। এক্সিট পোল, জরীপ, পূর্বানুমানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে ভারতের জনগণ। এই নির্বাচন বিজেপি এবং কংগ্রেসের জন্য শিক্ষা। শুধু কংগ্রেস, বিজেপি না সারা বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই নির্বাচন একটি শিক্ষণীয় মডেল। ভারত প্রমাণ করলো গণতন্ত্র কেন সেরা শাসন পদ্ধতি। 

বাংলাদেশে ধুঁকতে থাকা গণতন্ত্রের জন্য এই নির্বাচন দৃষ্টান্ত। এই নির্বাচন থেকে অনেক কিছুই পেতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতি। এই নির্বাচন বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের জন্য শিক্ষণীয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কথাই ধরা যাক। এই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেই পারে। ভারতের নির্বাচন অনেক বিষয়েই আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তা এবং অনুপ্রেরণাও বটে। নির্বাচনের আগে বিজেপি কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোটকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল। অতি আত্ম-বিশ্বাসী বিজেপি নেতারা চারশো আসনের আওয়াজ তুলেছিল। কংগ্রেসের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে গেছে বলেও কৌতুক করেছিলেন ডাক সাইটে বিজেপি নেতারা। রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধী হয়েছিলেন উপহাসের পাত্র। কিন্তু ভোটাররা বিজেপির দর্পচূর্ণ করে দিয়েছে। জনগণ বিজেপির দম্ভের জবাব দিয়েছে ভোটের ব্যালটে। অতি অহংকার যে কোন দলের জন্য ক্ষতিকর। এটা ভারতের নির্বাচনের অন্যতম শিক্ষা। টানা চারবার ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের মধ্যেও অহংকার এবং অতি আত্মবিশ্বাস এখন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিজেপির মতো আওয়ামী লীগের নেতারাও বিরোধী দল নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করেন। আওয়ামী লীগের কারো কারো একমাত্র কর্ম সকাল-সন্ধ্যা বিএনপিকে গালমন্দ করা। কিন্তু জনগণ যে এটা পছন্দ করে না, ভারত তার প্রমাণ। ভারতের নির্বাচন থেকে তাই আওয়ামী লীগকে সংযত হবার শিক্ষা নিতে হবে। কাউকে ছোট ভাবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি থেকে আওয়ামী লীগকে সরে আসতেই হবে। 

গত দশ বছর ভারতে চলেছে ‘মোদী ম্যাজিক’। বিজেপি নয়, নরেন্দ্র মোদীর একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে। মোদী একাই তৃতীয়বার বিজেপিকে ক্ষমতায় আনবে এমন একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিলো দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু তারপরও তারা জোটকে অবহেলা করেনি। জোটের দলগুলোকে উপেক্ষা করেনি। এনডিএ জোটের ছোট ছোট দল গুলোকেও সম্মান দিয়েছে। আত্ম বিশ্বাসী হলেও নিতীশ আর নাইডুকে ইন্ডিয়া জোট থেকে বের করে এনে নিজেদের ছাতার নীচে জায়গা দিয়েছে। যে কারণে সরকার গঠনে কোন রকম ঝুট ঝামেলা হয়নি। আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় এসে, ১৪ দলীয় জোটকে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। মহাজোট বলতে এখন কিছু নাই। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ মহাজোটের শরীকদের নিয়েই মন্ত্রীসভা গঠন করেছিল। ২০১৪ সালেও মহাজোট এবং ১৪ দলীয় জোট আওয়ামী লীগের কাছে ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে জোটে অরুচি শুরু হয় আওয়ামী লীগের। এবছরের নির্বাচনে জোটকেই বিড়ম্বনা মনে করে আওয়ামী লীগ। ১৪ দলকে তো ভিক্ষা দেয়ার মতো কয়েকটি আসন দিয়েছিল। সেখানেও হানা দেয় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ তার আদর্শিক জোটের গুরুত্ব হয়তো নতুন করে অনুভব করবে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের পর। জোটের প্রতি সম্মান শুধু বিজেপি দেখায় নি, কংগ্রেসও দেখিয়েছে। মূলত: ইন্ডিয়া জোটের কারণেই নতুন জীবন পেয়েছে কংগ্রেস। ভারতের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, একক দলীয় রাজনীতির চেয়ে জোটবদ্ধ ঐক্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় বন্ধুহীন আওয়ামী লীগ আশা করি, ভারতের পর জোটের গুরুত্ব অনুভব করবে। ছোট ছোট দলগুলোকে কাছে টানবে।

ভারতের নির্বাচনের পর সব থেকে আলোচিত বিষয় ‘মোদী ম্যাজিকের অকার্যকারিতা’। সারা বিশ্বেই আলোচনা হচ্ছে মোদী ম্যাজিক কি শেষ হয়ে গেল? রাজনীতি কোন ম্যাজিক বা আবেগ চিরস্থায়ী না। জনগণের কাছে একটি রাজনৈতিক দলকে জনপ্রিয় হতে হয় কাজ দিয়ে। আওয়ামী লীগের মধ্যে এখন শেখ হাসিনা নির্ভরতা প্রবলভাবে। কংগ্রেস ‘রাহুল গান্ধী’ নির্ভরতা থেকে সরে এসেছে বহু আগেই। এবারের নির্বাচনে বিজেপির ত্রাতা হিসেবে মোদী টনিক কাজে লাগেনি। তাই আওয়ামী লীগকেও শেখ হাসিনা নির্ভরতা থেকে বেরুতে হবে। সংগঠনের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। দলে বিভক্তি দূর করে শক্তিশালী করতে হবে। শৃংখলা ফেরাতে হবে।

আমি মনে করি ভারতের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়। কট্টর হিন্দুত্ববাদকে প্রত্যাখান করেছে ভারতের জনগণ। এই নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের পক্ষে রায় দিয়েছে জনগণ। বাংলাদেশের জনগণও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে হৃদয় থেকে লালন করে। এদেশের মানুষও ধর্ম ভীরু, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মেও নামে বাড়াবাড়ি ঘৃণা করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান দল নিঃসন্দেহে বিএনপি। কিন্তু ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি যেন এখন পথ হারা। বিপন্ন মানুষ যেমন বাঁচার জন্য খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, ঠিক তেমনি বিএনপি এখন অস্তিত্বের প্রয়োজনে জামায়াত সহ ধর্মান্ধ, মৌলবাদীদের দিকে আবার ঝুঁকছে। কিন্তু ভারতের নির্বাচন বিএনপিকে জানিয়ে দিলো, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা এই অঞ্চলে নেই। বিএনপি যদি আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করতে ধর্ম কার্ড খেলে তাহলে তা তাদের জন্যই হবে বুমেরাং।

এই নির্বাচন থেকে বিএনপি আশাবাদী হতেই পারে। বিশেষ করে কংগ্রেস যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিএনপি মনে করতেই পারে সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। আন্দোলন এবং সংগঠন গড়ে তোলার অব্যাহত চেষ্টার ফল কংগ্রেস পেলে বিএনপি কেন পাবে না? অবশ্যই পাবে। কিন্তু সেজন্য বিএনপিকে কংগ্রেসের রাজনীতির কিছু বাঁক বদলকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে হবে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন রাহুল গান্ধী। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কংগ্রেস নির্বাচন করে নতুন সভাপতি। এটি কেবল কংগ্রেসের জন্যই ইতিবাচক হয়নি, রাহুল গান্ধীকেও দেয় নতুন জীবন। সাধারণ জনগণ বুঝতে পারেন রাহুল গান্ধী নেতৃত্বের জন্য লালায়িত নন। এতে রাহুল গান্ধী সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরী হয়। আমার বিবেচনায় এটা কংগ্রেসের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। বিএনপির নেতৃত্ব ২০১৪, ২০১৮ এবং এবছরের নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে। এই তিন নির্বাচনেই বেগম জিয়া এবং তারেক জিয়ার সিদ্ধান্ত ও কৌশল ছিলো ভুল। বিএনপির নেতারাও স্বীকার করেন ২০১৪ তে বিএনপি নির্বাচনে গেলে ভালো করতো। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ‘সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের’ যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা গ্রহণ করলে, বিএনপির রাজনীতির আজ এই হাল হতো না। ২০১৮ সালে তাদের মনোনয়ন বাণিজ্য, জামায়াতকে ২০ আসন দেয়া এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট’ গঠন ছিলো আত্মঘাতী রাজনীতি। আর এবছর বিএনপির নির্বাচন বর্জন, তথাকথিত ‘অসহযোগ আন্দোলন বিলাশ’ ছিলো বাস্তবতা বিবর্জিত। একের পর এক ভুল করার পরও বিএনপির নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া এখন অকার্যকর। দলের নেতৃত্ব তারেক জিয়ার হাতে। কিন্তু তিনি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। কোন ব্যর্থতার দায়িত্ব তিনি নেন না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ তিনি ছাড়েন না। তারেক জিয়া বিদেশে বসে কিভাবে দলের প্রধান নেতা সে প্রশ্ন দেশে-বিদেশে। রাহুল গান্ধীর কাছ থেকে তিনি কি শিক্ষা নেবেন? ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে তিনি কি সরে দাঁড়াবেন। বিএনপিকে বাঁচাতে কি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুলভ সাহসী সিদ্ধান্ত নেবেন? নাকি নিজের বিত্ত বৈভবের লোভে তিনি পদ আঁকড়ে থাকবেন। আমরা জানি, লন্ডনে তারেক জিয়া আরাম আয়েশের বিলাসী জীবন কাটান। তার এই রাজকীয় জীবনের অর্থ আসে বিএনপির কল্যাণে। আর একারণেই তিনি পদ ছাড়তে রাজী না। কিন্তু কংগ্রেসের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলে তিনি উপকৃত হবেন, বিএনপি বাঁচবে। এপ্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। রাহুল গান্ধী গত ১০ বছর নিরলস পরিশ্রম করেছেন। ‘পাপ্পু ভাই’ থেকে তিল তিল করে নিজেকে একজন পরিণত রাজনীতিবীদ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তার ‘ভারত জোড়ো’ পদযাত্রা রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গত ১০ বছরে তিনি চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। সামনে থেকে লড়াই করেছেন। রাহুল গান্ধী পালিয়ে থাকেন নি। গ্রেপ্তারের ভয়ে বিদেশে আশ্রয় নেন নি। রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জন্ম, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের জন্য শিক্ষা হতে পারে। তারেক জিয়া যদি বিশ্বাস করেন তিনি একজন দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ নন তাহলে তার সামনে দু’টি পথ। যে দুটি পথ রাহুল গান্ধী দেখিয়েছেন। প্রথম পথ হলো বিদেশে থাকা অবস্থায় তিনি দলের নেতৃত্বে থেকে সরে দাঁড়াবেন। দেশে আছেন এমন কাউকে নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন। দ্বিতীয়ত, নেতৃত্ব রাখতে চাইলে তিনি দেশে আসবেন। মামলা মোকাবেলা করবেন। জেলে যাবেন। সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন। একজন রাজনীতিবীদ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবেন। তারেক জিয়াকেই প্রমাণ করতে হবে তিনি রাজনীতিতে দুর্নীতির বরপুত্র নন।

ভারতের নির্বাচনে বিরোধী দল ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এনেছেন। বিজেপি নির্বাচনে ক্ষমতা অপব্যবহার করছে, প্রশাসন, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে বিস্তর অভিযোগ ছিলো বিরোধী পক্ষের। বিরোধী নেতাদের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়েছে, মামলা হয়েছে। ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম শরিক আম-আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল নির্বাচনের আগে। এসব নানা অভিযোগের পরও বিরোধী দল নির্বাচনের মাঠ ছাড়েনি। নির্বাচন বর্জন করেনি। প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। মাটি কামড়ে থেকেছে। বাংলাদেশের বিরোধী দল গুলোর জন্য এটি একটি বড় শিক্ষা। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণের শক্তির উপর আস্থা রাখতে হয়। অন্যায় অত্যাচারের জবাব দেয়ার একমাত্র উপায় হলো ভোট। ভোটে আস্থা না রাখা মানে গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারানো। বিএনপি সহ বিরোধী দল গুলো বিগত তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দু’টিতেই ভোট বর্জন করে। তারা জনগণের শক্তির উপর আস্থা রাখতে পারেনি। বিশেষ করে এবারের নির্বাচন বর্জন ছিলো বিএনপির গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সব প্রভাবশালী দেশ গুলো চেয়েছিল নির্বাচন হোক অংশগ্রহণমূলক। নির্বাচনে যেন কারচুপি, পক্ষপাত এবং অনিয়ম না হয় সেজন্য তারা নানারকম চাপ দিয়েছিল সরকারকে। এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার একটি সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিলো প্রধানমন্ত্রীর। যেকোন মূল্যে একটি সুন্দর নির্বাচন করার ব্যাপারে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বিএনপি এবং বিরোধী দল গুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ভারতের নির্বাচনের ফলাফলের পর কি তারা একটুও অনুতপ্ত নন? 

ভারতের নির্বাচন আওয়ামী লীগ বিএনপি সহ সব রাজনৈতিক দলগুলোকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা দিলো তা হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্র ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদল সম্মিলিত সম্পৃক্ততার ফল। আওয়ামী লীগ একা নির্বাচন করে গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারবে না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন করে গণতন্ত্র ফেরাতে পারবেনা। বিরোধী দল হীন গণতন্ত্র অকার্যকর এবং অর্থহীন। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি ট্রেড ইউনিয়ন নয়। কথায় কথায় ‘খেলবো না’ বলা কোন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জনগণই শেষ কথা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ তা চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিলো। ভারতের নির্বাচন শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের তাবৎ গণতন্ত্রকামী মানুষকে দিয়েছে নতুন আস্থার আলো।

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

১৪ দলে ভাঙনের সুর

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ০৭ জুন, ২০২৪


Thumbnail

১৪ দলকে পুনর্গঠন এবং সক্রিয় করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকে ১৪ দলের নেতাদের মান অভিমান ভাঙানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেন। গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৪ দলের বিভিন্ন নেতারা আবেগঘন কথাবার্তা বলেন, হতাশার কথা বলেন। তাদেরকে কীভাবে অবজ্ঞা, অবহেলা করা হচ্ছে তার ফিরিস্তিও তুলে ধরেন। বিশেষ করে নির্বাচনে ১৪ দলকে উপেক্ষার বিষয়টি সামনে চলে আসে। 

প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ধৈর্য্যের সঙ্গে সবার বক্তব্য শুনেছিলেন। এরপর তিনি ১৪ দলকে সক্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর পরপরই ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে ১৪ দলের নেতৃবৃন্দের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং তারা বিভিন্ন বিষয়ে ধীরে ধীরে কর্মসূচি পালনের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরমধ্যেই গতকাল বাজেটের পর ১৪ দলের মধ্যে ভাঙনের সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি এই বাজেটের তীব্র সমালোচনা করেছেন। রাশেদ খান মেনন এই বাজেটকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এর ফলে দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিকরা সুবিধা পাবে, সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে। একই রকম অবস্থান গ্রহণ করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনিও এই বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করেছেন। 

অতীতে কোন সময় আওয়ামী লীগের শরিকরা বাজেট নিয়ে সরাসরি ভিন্নমত পোষণ করেনি। বাজেট নিয়ে তাদের ভিন্ন মত তারা জোটের ফোরামে আলোচনা করেছেন এবং সেই অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ চিত্রটা ভিন্ন। বাজেটের পরপরই রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনু মুখ খুলেছেন। তারা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই প্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে যে, তাহলে কী ১৪ দল ভেঙে যাচ্ছে? একটি জোটের মধ্যে শরিকরা সরাসরি কী সরকারের অবস্থান বা প্রধান দলের অবস্থানের সমালোচনা করতে পারে? 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেট নিয়ে সমালোচনার সঙ্গে ১৪ দলের ভাঙনের কোন সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব অর্থনৈতিক কৌশল এবং নীতি রয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির একটি অর্থনৈতিক অবস্থান আছে। তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মনে করছে, বাজেট সঠিক হয়নি। অন্যদিকে জাসদও বাজেটকে ইতিবাচকভাবে দেখছে না। সেটা প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু ১৪ দলীয় জোট একটি আদর্শিক জোট। এই জোটের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পৃক্ত রয়েছে। কাজেই আদর্শিক জোট সামান্য ভুল বোঝাবুঝি থেকে ভেঙে যাবে এমনটি মনে করেন না কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষকই। 

তবে এখন যেহেতু জাসদ, সাম্যবাদী দল বা ওয়ার্কার্স পার্টি সরকারে নেই, কাজেই তাদের স্বাধীন অবস্থান রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো ১৪ দলের শরিক সবাই নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হয়েছেন এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যারা যে দলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবেন সেই দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না, অবস্থান গ্রহণ করতে পারবেন না। সেটা করলে তাহলে তা ‘ফ্লোর ক্রসিং’ হিসেবে বিবেচিত হবে। কাজেই ১৪ দলের শরিকরা যদি শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে বাজেটের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে সেখানে একটি অন্যরকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। 

তবে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল স্বাধীন সত্তা। যে কোন বিষয়ে তাদের মতামত দেওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে তারা বাজেটের পক্ষেই অবস্থান নিবে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা আশা প্রকাশ করেছেন।

১৪ দল   আওয়ামী লীগ   বাজেট   হাসানুল হক ইনু   রাশেদ খান মেনন  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন